25 Jan

অভিনেত্রীর খোঁজে

লিখেছেন:প্রবুদ্ধ বাগচী


উল্টোদিকের সোফায় বসে থাকা মেয়েটা এতক্ষণ মন দিয়ে একটা ম্যাগাজিন পড়ছিল। পত্রিকাটা মুখের ওপর থেকে সরিয়ে নিতে এবার ওর পুরো মুখটা দেখতে পেল রাজীব। হাতের ম্যাগাজিনটা বেশ খানিকটা জোরেই নিচু টেবিলটায় রাখল মেয়েটা। মুখে বেশ বিরক্তিচিহ্ন। বিরক্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক। সেই বেলা এগারোটা থেকে অপেক্ষা করছে, আর এখন প্রায় চারটে বাজে। রাজীবেরও এবার বেশ অধৈর্য লাগছিল। সেই সঙ্গে ভীষণ খিদে পাচ্ছিল ওর। হয়তো মেয়েটারও তাই হবে।

ঘরটা যখন ছেলে-মেয়েতে ভর্তি হয়ে ছিল, তখন আলাদা করে মেয়েটাকে চোখে পড়েনি রাজীবের। এখন ঘরে মাত্র ওরা দুজন। রাজীব দেখল মেয়েটা সোফায় বসেই শরীরটাকে একটু এদিকে ওদিকে নাড়াচাড়া করছে। বোধহয় একটানা বসে থাকার ফলে জড়তাটা কাটাতে চাইছে। একবার মাথা উঁচু করে ঘরের সিলিঙের দিকেও তাকাল। এই অস্বস্তিকর নীরবতাটা কাটানোর জন্যে একবার কথা বলবে নাকি ওর সঙ্গে? 

তবে তার আর দরকার হল না। সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে মেয়েটা নিজেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল রাজীবের উদ্দেশে, কী ব্যাপার বলুন তো? আর কতক্ষণ এইভাবে ওয়েট করতে হবে ?

একটু থতমত খেয়ে রাজীব বলল, সত্যি, আমিও তাই ভাবছি !

— না মানে আপনি ভাবুন, বেলা এগারোটায় রিপোর্ট করতে বলেছিল আর এখন নিজের হাতঘড়িটার দিকে তাকাল মেয়েটা।

রাজীব বলল, আমি একবার না হয় বাইরে গিয়ে খবর নিয়ে আসি সবারই হয়ে গেল অথচ আমাদের এখনও

মেয়েটা বলল, যদি কাইন্ডলি একবার যান। এতটা দেরি হবে বাড়িতেও বলা ছিল না জানিয়ে দিয়েছি অবশ্য

এবার রাজীব খানিকটা মুখ ফস্কেই যেন বলে ফেলল, কোথায় আপনার বাড়ি ?

– আন্দুল। আপনি ?

– আমি কোন্নগর

#      

                     

মাস খানেক আগে স্টেশনের টিকিট কাউন্টারের পাশে বিজ্ঞাপনটা চোখে পড়েছিল রাজীবের। ‘বাংলা সিনেমায় অভিনয়ের জন্য অল্পবয়সী অভিনেতা/ অভিনেত্রী চাই’। এই শখটা রাজীবের অনেকদিনের। কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় ডিপার্টমেন্টের নাটকে একটা ভাল রোল পেয়েছিল — ওই বছর কলেজ সোস্যালে ওই নাটকটাই আবার করা হল। সবাই খুব প্রশংসা করেছিল। অনিকেত স্যার আলাদা করে বলেছিল, অভিনয়টা ছেড়ো না। এখন থার্ড ইয়ারের পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পর তেমন কিছু করার নেই। বিজ্ঞাপনের সঙ্গে দেওয়া ফোন নম্বরটায় যোগাযোগ করেছিল রাজীব। ওরাই আজ আসতে বলেছিল কলকাতার এই অফিসটায়। সকাল থেকে আরও অনেকেই জড়ো হয়েছিল এই বড় ঘরটায়। বোঝাই যাচ্ছিল বিজ্ঞাপন দেখে অনেকেই এখানে এসেছে। দুপুরে একবার সিগারেট খেতে বাইরে বেরিয়েছিল — তখন শুনল, গত চারদিন ধরেই নাকি ছেলেমেয়ের ভিড় হচ্ছে এই অফিসে। 

#                              

বাইরে থেকে ঘুরে এসে রাজীব ঘরে পা রাখতেই মেয়েটা জিজ্ঞাসা করল, কিছু খবর পেলেন ?

সামনের সোফাটায় বসে পড়ে রাজীব বলল, রিসেপশন থেকে বলল, দেরি হবে। ওয়েট করুন। 

– ওফফ, আরও ওয়েট ! মেয়েটা যথেষ্ট বিরক্ত হচ্ছে বোঝাই যাচ্ছে।

রাজীব কোনও জবাব দিল না। বুঝতেই পারছে যতক্ষণ না ওর ডাক আসে এইভাবে চুপ করে বসে থাকতে হবে। মেয়েটার সঙ্গে গল্প গুজব করে সময় কাটিয়ে দেওয়া যায় হয়তো —কিন্তু একেবারে অপরিচিত মেয়েটা আবার কীভাবে বিষয়টা নেবে সেটা বোঝা মুশকিল। সামনের টেবিলে রাখা খবরের কাগজ আর পত্র পত্রিকা গুলোও আর উল্টে পালটে দেখতে ইচ্ছে করছে না। মনে হয় মেয়েটারও একই অবস্থা। খানিকটা উসখুস করে মেয়েটা এবার বলল, কী মনে হয়, আল্টিমেটলি আমাদের কি ডাকবে?

যেহেতু ঘরে কোনও দ্বিতীয় ব্যক্তি নেই, প্রশ্নটা রাজীবকেই করা।

একটু থেমে রাজীব বলল, আমি শুনলাম গত চারদিন ধরেই এই বাছাই পর্ব চলছে।

– বাবা, তাহলে তো এর মধ্যেই অনেকের অডিশন হয়ে গেছে !

– হয়তো কাল পরশু আরও অনেকের হবে !

– রিয়ালি ! ব্যাপারটা তো দেখছি চাকরির পরীক্ষার মতোই ! একটু থামল মেয়েটা। তারপর আবার রাজীবের দিকে ফিরে বলল, আচ্ছা, আপনি আগে এইরকম কোনও সিনেমা কোম্পানির ইন্টারভিউ দিয়েছেন?

– না, এই প্রথম। 

– আমি এর আগে একটা দিয়েছি। মাস তিনেক আগে, অবশ্য সেটা হয়নি। এবারেও ওই সেন্টার থেকেই কল দিয়েছে। 

– কল দিয়েছে মানে? রাজীব এবার কৌতূহলী হয়। 

– কেন ? কলকাতার একটা এজেন্সিতে আমার নাম রেজিস্ট্রেশন করা আছে, ওরাই খবর থাকলে কল পাঠায়। কেন আপনার নাম লেখানো নেই ?

– না তো। আমি কোন্নগর স্টেশনের টিকিট কাউন্টারের পাশে একটা বিজ্ঞাপন দেখে একটা ফোন নম্বরে যোগাযোগ করেছিলাম। ওখান থেকে আজকে আসতে বলল।

– তাই বুঝি ! আমি অবশ্য এরকম  কোনও বিজ্ঞাপন দেখিনি। আচ্ছা, আপনি এর আগে কোথাও অভিনয় করেছেন? 

– ওই একটু আধটু আর কি ! কলেজে, পাড়ার ক্লাবে

– আরিব্বাস ! তাহলে তো আপনার ফেয়ার চান্স . বাই দা বাই আপনার নামটাই তো জানা হয়নি !

– রাজীব। অনার্স ফাইনাল ইয়ার পরীক্ষা দিয়ে এখন কনফার্মড বেকার !

– আমি শ্রেয়া । আপনার অনার্স কীসে ? জানেন, আমিও অনার্স নিয়েছিলাম — কিন্তু রেজাল্ট ভাল হল না, কেটে গেল ।

– আমার পলিটিকাল সায়েন্স। আপনার ?

– ছিল। হিস্ট্রিতে। কিন্তু ওই যে বললাম, কেটে গেল। এখন তেমন কিছু করি না। পাড়ার একটা ট্রেনিং সেন্টারে কম্পিউটার শিখি। বাড়িতে বলেছিল দুয়েকটা টিউশন করতে। কিন্তু জানেন তো, আমার না ভাল লাগে না। আমার খুব অভিনয় করতে ইচ্ছে করে — আপনার করে না ?

এতগুলো কথা একসঙ্গে শুনে একটু অবাক হয় রাজীব। হয়তো একটানা অপেক্ষা করার পর বোরডম কাটানোর জন্যে একটু বেশি কথা বলছে মেয়েটা।

রাজীব ছোট্ট করে জবাব দিল, হ্যাঁ, করে। 

– আমি তো রোজ তিন ঘণ্টা করে টিভির নানা চ্যানেলে সিরিয়াল দেখি, শুধু অভিনয় দেখার জন্য ! ইস আমায় যদি কেউ একবার ডাকত ! শুনেছি নাকি, টিভি সিরিয়ালে চান্স পেতে গেলে চেনাজানা লোক থাকতে হয় — আপনি জানেন কিছু?

– না, আমার এসব ব্যাপার ঠিক জানা নেই। আমি আসলে

– তার মানে আপনি সিরিয়ালে অভিনয় করতে ইন্টারেস্টেড নন বলছেন! প্রায় রাজীবের মুখের কথা কেড়ে নেয় শ্রেয়া। 

– না না ওরকম কিছু নয়। আমি আসলে টিভি সিরিয়ালের ব্যাপারে কোনোদিন এগোইনি। তাই ঠিক ওই ব্যাপারে বিশেষ কিছু.

– তার মানে আপনি একেবারে ফিল্মে নামতে চান! তাই এখানে এসেছেন? ব্যাপারটা যত সহজ ভাবছেন ততটা কিন্তু সোজা নয়!

শ্রেয়ার কথার ভঙ্গিটা খুব অদ্ভুত। অচেনা একজনের সঙ্গে কেউ এমনভাবে কথা বলে নাকি ? রাজীবের এবার একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। কী উত্তর দেবে ও ঠিক ভেবে উঠতে পারল না। এরকম ঠেস দেওয়া কথার জবাব না দিলেই বা কী ? প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও  রাজীব আবার টেবিল থেকে একটা পত্রিকা হাতে তুলে নিল। পত্রিকা খুলে তার পাতায় চোখ রেখে খুব আস্তে আস্তে বলল, আমি এখানে অত ভেবেচিন্তে আসিনি। বিজ্ঞাপনটা দেখলাম, রেজাল্ট না বেরোনো অবধি হাতে তেমন কাজ নেই . । একটু থেমে, পত্রিকাটার একটা পাতা উল্টিয়ে —– আমাদের এলাকার একটা নাটকের গ্রুপের সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ আছে, মাঝে মধ্যে সেখানে অভিনয় করি .

– ওরেব্বাস ! এটা আপনি কিন্তু চেপে গেছেন, রাজীবদা !

– একটা কথা বলব, কিছু মনে করবেন না তো?

– কী ?

– আপনাকে আমি রাজীবদা বলব, আর আপনি আমায় ‘তুমি’ করে বলুন না ! মনে হয় আমি আপনার থেকে জুনিয়র।

রাজীব এবার মনে মনে একটু সতর্ক হল। মেয়েটার মাথা-টাথা ঠিক আছে তো ? মাত্র কিছুক্ষণ আগেও চুপ করে একলা বসেছিল অথচ এখন মুখে কথার খই ফুটছে, আর তার ভঙ্গিটাও খুব আশ্চর্য ! আর সব থেকে অবাক লাগল ওই ‘বলব’ কথাটা । আর কখনও রাজীবের সঙ্গে ওর দেখা হবে নাকি ?এই তো আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ওদের ডাক আসবে, তারপর যে যার মতো ফিরে যাবে। তাছাড়া হঠাৎ করে একজন অপরিচিত মেয়েকে ‘তুমি’ করে বলা যায় নাকি ? রাজীব অন্তত এটা পারবে না।

রাজীবকে চুপ করে থাকতে দেখে, এবার আবার কথা বলল শ্রেয়া। 

– কী আমার প্রোপোজালটা পছন্দ হল না, তাই তো? ঠিক আছে। আমায় আপনি ‘তুমি’ করে না বললেও আমি আপনাকে রাজীবদাই বলব। আমার খুশি আমি বলব, আপনি বাধা দেওয়ার কে?

এবার মনে মনে হেসে ফেলল রাজীব। সত্যিই বোধহয় মেয়েটার মাথায় গোলমাল আছে। না হলে এমনভাবে কেউ কথা বলে ! রাজীব বুঝতে পারছিল এই প্রসঙ্গটা না ঘোরালে চলবে না। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই ও এবার বলল, আপনি প্রচুর সিরিয়াল দেখেন তাই না ?

– হ্যাঁ দেখি তো। কিছু কিছু সিরিয়ালে আমাদের বয়সী কোনো কোনো মেয়ে কেমন অভিনয় করে দেখেছেন ? ইস, আমি যদি একবার চান্স পেতাম. আপনি বোধহয় সিরিয়াল দেখেন না, তাই না ? জানি, অনেকে খুব নাক-উঁচু থাকে, সিরিয়াল-টিরিয়াল দেখলে তাদের জাত চলে যায় ! 

আবারও রাজীবের কানে লাগল কথাটা। কারণ ওটা ওকে শুনিয়েই বলা। কী ভাবছে মেয়েটা কে জানে ! হঠাৎই একটা সম্ভাবনা ওর মাথার মধ্যে ঝিলিক দিয়ে উঠল। ওকে কি উত্যক্ত করে খানিকটা উত্তেজিত করে দিতে চাইছে শ্রেয়া ? এই ঘরের মধ্যে ওরা তো আসলে প্রতিদ্বন্দ্বী । চিন্তাটা একবার উঁকি দিয়েই আবার মিলিয়ে গেল। কিন্তু এই সম্ভাবনার কথাটা সোজাসুজি বলে দেওয়াটা বোধহয় ঠিক হবে না। এই ঘরে শ্রেয়া ছাড়া আর কেউ নেই। যেরকম গোলমেলে কথাবার্তা বলছে তাতে যদি আচমকা চেঁচামেচি করে বসে তাহলে একটা বিশ্রি ব্যাপার হবে। সেক্ষেত্রে রাজীবেরই বিপদ বেশি। ও একটু সতর্ক হয়ে গেল। 

এখনও কতক্ষণ এখানে বসে থাকতে হবে ঠিক নেই। যেভাবে হোক সময়টা তো কাটাতে হবে। বাইরের করিডর টায় গিয়ে অবশ্য দাঁড়ানো যায়, কিন্ত খুব বেশিক্ষণ ওখানে দাঁড়ালে আবার রিসেপশন থেকে আপত্তি করছে। আসলে যারা অডিশন দিতে এসেছে তারা সবাই এই বড় ঘরটায় অপেক্ষা করুক, এমনটাই ওদের নির্দেশ। সাত পাচ ভেবে রাজীব ঠিক করল খুব শান্তভাবে শ্রেয়ার কথাটার একটা জবাব দেবে। 

বলল, দেখুন শ্রেয়া, আমি সিরিয়াল দেখি না সময় পাই না বলে। সন্ধের দিকে আমায় কয়েকটা টিউশন করতে হয়। আপনি দেখেন, ভালই করেন। অভিনয় করতে গেলে অভিনয় দেখতেও হয়।

– একদম ঠিক বলেছেন। আমি তো এমনকি সন্ধেবেলা লোডশেডিং হয়ে গেলে বেশি রাতে ওগুলোর রিপিট টেলিকাস্টও দেখি। আমার শোয়ার ঘরে একটা ছোট টিভি আছে। আপনারও কি আছে?

রাজীব হাল্কাভাবে হেসে মাথা নাড়ল। না না টিভি নেই। আমার একটা ছোট মিউজিক প্লেয়ার আছে — মাঝে মধ্যে গান শুনি।

– ও বাবা, আপনি তাহলে গানও জানেন ! কই আগে বললেন না তো ! হঠাৎ বেশ একটা উত্তেজনায় চোখ দুটো বড় বড় হয়ে যায় শ্রেয়ার। 

– এখনই বা বললাম কোথায়? বললাম, গান শুনি। গান শুনতে গেলে তা জানতে হয় নাকি? নিজেকে একদম স্বাভাবিক রেখে রাজীব উত্তর দেয়। 

– না, তা অবশ্য নয়, শ্রেয়া বলতে থাকে, তবে গান আমিও খানিকটা শিখেছিলাম।

– ভালোই তো। তা সেটা বন্ধ করলেন কেন ?

– আর ভাল লাগল না, তাই। আমায় তো কেউ অভিনয়ের চান্সই দিচ্ছে না। শুধুমুধু গান শিখে হবেটা কী? তখন বাবা মা দুজনেই বলবে, তুই বরং গানটাই কর। আমি মোটেও করব না। আচ্ছা, রাজীবদা, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব ?

রাজীব আবার সতর্ক হয়। এ মেয়ে কখন যে কী প্রশ্ন করে বসে ঠিক নেই। তবে মুখের ওপর তো না বলা যায় না, তাই একটু সময় নিয়ে বলল, বলুন।

– আপনি তো আমায় নাম ধরে ডাকলেন, তাহলে কেন আমায় ‘তুমি’ করে বলতে চাইছেন না বলুন তো ?

আবার সেই অদ্ভুত প্রশ্ন। রাজীব এবার বেশ বিড়ম্বনায় পড়ে গেল। কী জবাব দেবে এর? ব্যাপারটা যদি শ্রেয়া নিজে না বুঝতে পারে তাহলে তো মুশকিল। কারণ এটা তো ঠিক বুঝিয়ে বলার মতো কোনো বিষয় নয়। আর এই ছেলেমানুষী প্রশ্নের কীই-বা জবাব দেওয়া যায়। চটজলদি কিছু না বলে রাজীব একটু সময় নিচ্ছিল। 

শ্রেয়া অধৈর্য হয়ে আবার ছুঁড়ে দিল তার কথা , কী চুপ করে আছেন যে !

রাজীব বলল, ভাবছি। 

– কী ভাবছেন ?

– ভাবছি এই ‘তুমি’ আর ‘আপনি’ নিয়ে আপনি এত মাথা ঘামাচ্ছেন কেন?

– এ মা, বুঝতে পারলেন না !

– না তো !

– তাহলে শুনুন। আমি বুঝতেই পারছি আজ আপনি এখানে যে অডিশন দিতে এসেছেন, তাতে আপনি চান্স পাচ্ছেনই, একদম সিওর। ব্যাস হয়ে গেল ! তার মানে আর কয়েকমাসের মধ্যে সিনেমার পর্দায় আপনার মুখ দেখা যাবেই যাবে — তার মানে আপনি তখন একজন সেলিব্রিটি !

– তো ?

– তখন আপনার ফ্যানরা আপনাকে ঘিরে থাকবে। সবাইকে তো আর আপনি ‘তুমি’ বলবেন না । কিন্তু আমায় ডাকবেন—তার মানে—-সবাই তখন আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে—দ্যাট মিনস, আমিও একটু-আধটু বিখ্যাত হয়ে যাব ! সবাই বলবে, কাগজে লিখবে, বিখ্যাত নায়ক রাজীব . এই যা আপনার সারনেমটা তো জানা হয়নি

-সুর

– তার মানে হল রূপোলি পর্দার নায়ক রাজীব সুর.অবশ্য বিখ্যাত নায়ক সারনেম ব্যবহার করবে কি.যাই হোক, আপনার একজনই ফ্যান আছে যাকে তিনি ‘তুমি’ করে বলেন —- ভাবতে পারছেন ব্যাপারটা ? একটু থামল শ্রেয়া। আবার শুরু করল খুব আন্তরিক ভঙ্গিতে, এই সত্যি করে বলুন তো, তখন আমায় এক আধটা চান্স পাইয়ে দেবেন তো ? নাহলে কি আর আমি কোনোদিন চান্স পাব নাকি?

রাজীবের এবার বেশ মজা লাগছিল। মেয়েটার মধ্যে একটা আশ্চর্য সারল্য আছে। শুধু ছেলেমানুষী নয়, অদ্ভুত কতগুলো বিশ্বাস নিয়ে বসে আছে ও। শ্রেয়ার কথাগুলো শুনে কিছুটা অবাকও হচ্ছিল একই সঙ্গে। তাই খানিকটা মজা করার জন্য রাজীব প্রসঙ্গটা ঘুরিয়ে দিতে চাইল। বলল, আর যদি উল্টোটা হয়? আপনি চান্স পেলেন, আমি পেলাম না !

– ধ্যাৎ, তাই আবার হয় নাকি? আপনি রেগুলার অভিনয় করেন, আপনার এক্সপিরিয়েন্স আছে . ওরা এই রকম ছেলে মেয়েই চাইছে। আমি তো কোনোদিন স্টেজেই নামিনি, আমার কী করে হবে?

– তা বলে আগেই এতটা আপসেট হচ্ছেন কেন? অনেক ডাইরেক্টর একদম ফ্রেশ মুখ চান জানেন তো? সত্যজিৎ রায় তাঁর ফিল্মে অপর্ণা সেন, শর্মিলা ঠাকুর, জয়া ভাদুড়ি এদের নেননি !

– এবার কিন্তু আপনি আমায় ইন্সাল্ট করছেন, রাজীবদা ! উত্তেজিত হয়ে সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে শ্রেয়া। রাজীব আবারও পুরো দস্তুর অপ্রস্তুত। আমতা আমতা করে বলল, ইন্সাল্ট ! কেন আমি কী করলাম ?

– আমি আপনাকে বারবার বলছি আমি অভিনয় করতে চাই অথচ অথচ আজ অবধি কেউ আমায় আবেগে কথা আটকে আসে শ্রেয়ার। একটু বিরতি নিয়ে শ্রেয়া বলতে থাকে, আপনি আমায় অপর্ণা সেন জয়া ভাদুড়িদের সঙ্গে কম্পেয়ার করেআপনি তো ভালই জানেন শেষের কথাগুলো আর শোনা যায় না। দুহাতে মুখ ঢেকে শ্রেয়া বসে পড়ে সোফায়। শরীরটা ফুলে ফুলে উঠছে, বোঝা যাচ্ছে আবেগের প্রচন্ড চাপ বেরিয়ে আসছে কান্না হয়ে। 

রাজীব ঠিক কী করবে ভেবে পেল না। এমন একটা বিচিত্র পরিবেশের মুখে যে পড়ে যেতে হবে তার জন্য সত্যিই কোনও প্রস্তুতি ছিল না ওর। থাকবেই বা কী করে? আর পাঁচজনের মতো ও এখানে এসেছে অভিনেতার অডিশন দিতে। সকাল থেকে সেই বিষয়টাই ঘুরে বেড়াচ্ছে মাথার মধ্যে তার সঙ্গে একটা চাপা উদ্বেগ। কিন্তু আচমকা ঘটে যাওয়া এই ঘটনার কীভাবে মোকাবিলা করবে ও — কিছুই যেন বুঝে উঠতে পারছে না । এইভাবে একটা একা ঘরে ওরা দুজন রয়েছে। একদম সামনে উল্টোদিকের সোফায় বসা শ্রেয়া একটা সাধারণ কথায় যে এমনভাবে রিঅ্যাক্ট করতে পারে এটা ও স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। কী ঝামেলাতেই না পড়া গেল এখন! ও যে খুব ভেবেচিন্তে কথাটা বলেছে তাও নয়। তুমি আপনি নিয়ে মেয়েটা এমন সব আবোলতাবোল কথা বলছিল, তার থেকে বিষয়টা খানিকটা ঘোরানোর জন্যই যেন কিছুটা হাল্কা মেজাজে কথাটা বলেছে রাজীব। তার পরিণতি যে এমন হবে কে জানত! জানলে কি আর কিছু বলত নাকি ? চিন্তার ব্যাপার হল শ্রেয়া যদি হঠাৎ এখন কোনও রকম বেশি চেঁচামেচি করে বা ওর নামে কোনো অভিযোগ করে বসে তাহলে সবাই শ্রেয়ার কথাই বিশ্বাস করবে। এই কথাটা ভেবে রাজীব ভেতরে ভেতরে টেনশনে ঘামতে আরম্ভ করল। সত্যি, কী যে এক উটকো ঝামেলায় পড়া গেল !

আবার শ্রেয়ার দিকে তাকাল রাজীব। এখনও ফুঁপিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। দুহাতে মুখ ঢাকা। হাতের আঙুলের ফাঁক দিয়ে অল্প অল্প জলের ধারা গড়িয়ে নামছে গাল বেয়ে। এতটা আপসেট হয়ে পড়ল মেয়েটা ? রাজীব ভাবতে থাকে। আসলে মনে হয় ও খুব ইমোশনাল। নাহলে একটা অচেনা পরিবেশে রাজীবের মতো একজন সদ্য পরিচিত হওয়া ছেলের সামনে এমন আচরণ করা সম্ভব ? রাজীব কিছু ঠাহর করতে পারে না। কী করবে ও? ঘর থেকে বেরিয়ে যাবে ? যদি সেক্ষেত্রে শ্রেয়াও কাঁদতে কাঁদতে ওর সঙ্গে বেরিয়ে আসে ! তবে তো একটা সিন ক্রিয়েট হয়ে যাবে! শুধু এই ভাবনাটাই রাজীবকে আটকে রাখল সোফাটায়। ও ক্রমশ আড়ষ্ট হয়ে যেতে থাকল। 

#                       

রাজীব সুর কে আছেন ? বাইরে থেকে লোকটা ঘরে ঢুকেছে। হাতে একটা লম্বা কাগজ। এই লোকটাই সকাল থেকে ঘরে এসে একে একে সবার নাম ডেকে ভেতরে পাঠাচ্ছে। রাজীব লোকটার দিকে তাকাল। 

– যান, ভিতরে চলে যান। করিডোর দিয়ে সোজা গিয়ে ডানদিকের দুনম্বর ঘর। নির্দেশ দিয়ে হাতের কাগজটায় রাজীবের নামটা বোধহয় কেটে দিল লোকটা। তারপর আবার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। রাজীব দেখল লোকটার কথা শুনে শ্রেয়া মুখ তুলে তাকিয়েছে। দুচোখ জলে ঝাপসা। চোখের আই লাইনার ঘেঁটে গেছে কান্নায়। কেমন যেন একটা অস্বাভাবিক দৃষ্টি। 

কিন্তু রাজীবকে তো এবার উঠতেই হবে। সকাল থেকে যার জন্য এই লম্বা অপেক্ষা এবার সেই পরীক্ষার মুখোমুখি হওয়ার পালা। কিন্তু শ্রেয়াকে এইভাবে রেখে কোথায় যেন কী একটা কাঁটার মতো খচখচ করে বিঁধছে রাজীবের মনে। এটা কি সহানুভূতি না অন্য কিছু? কিন্তু ওর যখন ডাক এসেছে ওকে যেতেই হবে। দেরি করার তো উপায় নেই। 

সোফা ছেড়ে উঠতে গিয়েও রাজীব খেয়াল করল আবারও শ্রেয়া মুখ ঢেকেছে দুইহাতে। সামনের নিচু টেবিলটার ওপর কনুইয়ের ভর রেখে আবারও অল্প অল্প কাঁদছে মেয়েটা। ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা কান্নাই নিশ্চয়ই। নাহলে এমন হবে কেন? রাজীবের হঠাৎই খুব খারাপ লাগতে থাকল। ওর একটা কথায় এতটা কষ্ট পাচ্ছে মেয়েটা ! শেষবারের মতো ওকে বোঝানোর চেষ্টা করে দেখবে নাকি? যদি কিছু কাজ হয়। অন্তত তাতে পরিস্থিতিটা একটু হাল্কা আর সহজ হয়। কেমন যেন একটা মায়ার বোধ গ্রাস করতে লাগল রাজীবকে।

#

দেখুন, আমি ঠিক ওইভাবে বলতে চাইনি কথাটা। রাজীব আরও কাছে এগিয়ে এল শ্রেয়ার। সামনে দাঁড়িয়ে বুঝতে চাইল ওর কথার কী প্রতিক্রিয়া হয় শ্রেয়ার মধ্যে। কিন্তু কই শ্রেয়ার তো কোনও ভাবান্তর নেই। 

– মানে ওটা একটা কথার কথা আপনি একটু বুঝবার চেষ্টা করুন শ্রেয়া..

শ্রেয়ার মুখের ওপর রাখা হাতদুটো সামান্য নড়ল যেন। 

রাজীব বলল, আপনি আসলে আমার কথাটাকে ভুলভাবে নিয়ে ফেলেছেন

শ্রেয়ার শরীরে আবার কাঁপন। ইস মেয়েটা বোধহয় আবার কান্না আরম্ভ করল। কয়েক ফোঁটা জল পড়ল টেবিলের ওপরে রাখা কাগজটায়। রাজীব দেখল। তার মানে ওর কথায় কোনো কাজই হচ্ছে না, বরং আরও উল্টো প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। শ্রেয়া আবার কাঁদছে মাথা নিচু করে। রাজীবের মনের মধ্যে তীব্র  অ সহায়তার বোধ চারিয়ে যাচ্ছে এবার। কী করবে ও ? মনের মধ্যে উথাল পাথাল ঝড়। ওদিকে সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, ওকে এবার ভেতরে যেতে হবে অথচ.

রাজীব হাঁটু গেড়ে বসল টেবিলটার পাশে। তারপর খুব গাঢ় গলায় বলল, শোনো শ্রেয়া একবার আমার দিকে তাকাও

মুখের ওপর থেকে দুহাত সরিয়ে নিল শ্রেয়া। পদ্মের কুঁড়ি ভেঙে যেভাবে বেরিয়ে আসে তার পাপড়ি । শ্রেয়ার দৃষ্টি সরাসরি এসে পড়ল রাজীবের মুখে। এলোমেলো হয়ে যাওয়া প্রসাধনে অগোছালো সেই মুখ। কান্না নয়, সেই মুখ জুড়ে বিজয়িনীর চওড়া হয়ে আসা হাসি। 

[বানানবিধি/মতামত লেখকের নিজস্ব]

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ