25 Jan

ইলেকশন ডিউটি

লিখেছেন:ত্রিদিবেশ বন্দ্যোপাধ্যায়


মলয়বাবুর মাথায় যেন বজ্রাঘাত হল। সারাজীবন বিহারে কাটিয়ে একমাস হল কলকাতায় হেডঅফিসে বদলি হয়ে এসেছেন। এখনো অফিসের ঘাঁতঘোত বিশেষ বোঝেননি। অসুবিধায় পড়লে যে কাকে ধরতে হবে, অফিসের মধ্যে কেন্দ্রবিন্দুটি যে ঠিক কোথায়,  তার হদিস এখনও করে উঠতে পারেননি। ফলে তিনি চোখে অন্ধকার দেখলেন। মলয়বাবু চিরকালই শান্তিপ্রিয় লোক- ঝুটঝামেলায় তাঁর বড় ভয়। সেরকম সম্ভাবনা দেখা দিলেই তিনি সেখান থেকে সরে পড়েন। কিন্তু এই ঝামেলায় পালাবার পথ নেই, ইলেকশন কমিশনার আছে পিছে। পশ্চিমবঙ্গে ইলেকশনের দিন ঘোষনা হয়ে গেছে। সব অফিস থেকে ভোটকর্মীদের নাম চেয়ে পাঠানো হচ্ছে, এই অফিসেও লিস্ট তৈরী হয়ে গেছে।

মলয়বাবু নিজের সীটে গালে হাত দিয়ে ভাবছেন, কী করা যায়। নিজের পুরনো অফিস হলে ঠিক কিছু না কিছু ব্যবস্থা করে নিতে পারতেন। এখানে তো জানতেই পারেননি লিস্ট তৈরী হবার আগে পর্যন্ত। অ্যাডমিনিস্ট্র্যাটিভ অফিসারের টেবিলে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে এসেছেন জ্বল জ্বল করছে নিজের নাম- মলয় কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। কাজে মন লাগছেনা, আচ্ছা ঝামেলায় পড়া গেল!

মফঃস্বলের মানুষ মলয়বাবু। কাটোয়া লাইনের বাঁশবেড়িয়া থেকে রোজ যাতায়াত করে অফিস করেন। কোলকাতার হালচালও বিশেষ বোঝেননা। তা ছাড়া প্রায় পঁচিশ বছর ফিল্ড অফিসে চাকরি করে এই বয়সে কলকাতায় ঠিক স্বচ্ছন্দও হতে পারেননা। চেনেন শুধু বড়বাজার টুকু। অফিস ফেরতা মাঝে মাঝে নেমে একটু কেনা কাটা করেন, দামে খুব শস্তা হয়না কিন্তু ঝাড়াই বাছাই ডালটা, মশলাটা পাওয়া যায়, চিনির দানা গুলো একটু বড় বড় হয়। তারপর হেঁটে হাওড়া ব্রীজ পেরিয়ে কাটোয়া লোকার ধরেন।

এবার ভোটে যে কী হবে ! এমনিতেই কলকাতায় তৃণমূল কংগ্রেসের বেশ দাপট, তর ওপর শেষ মুহুর্তে কংগ্রেস এর সঙ্গে জোট হয়ে গেল। তৃণমূল নেত্রী হুঙ্কার দিচ্ছেন ছব্বিশ বছরের বামফ্রন্টের অপশাষনের এবার শেষ। লোকসভা ছিল কোয়ার্টার ফাইনাল, কোলকাতা পুরসভা ছিল সেমিফাইনাল আর আগামী বিধানসভা হবে ফাইনাল। স্লোগান তুলছেন ‘হয় এবার, নয় নেভার’। আর বামফ্রন্টও বলে দিয়েছে আগামী পঁচিশ বছর বামফ্রন্টই পশ্চিমবঙ্গ শাষন করবে। তৃণমূল নেত্রীর মহাকরণ দখলের স্বপ্ন দিবাস্বপ্নে পরিণত হবে। ফলে এবার হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। আর লড়াই যত তীব্র ততই গন্ডগোলের আশঙ্কা। বাঁশবেড়িয়া এখন শান্ত, সেখানে ডিউটি পড়লে অত চিন্তা ছিলনা। কিন্তু অফিস তো কলকাতায়, সুতরাং ডিউটি কলকাতাতেই পড়বে। মলয়বাবুর মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে। উনি উঠে গিয়ে ওয়াশরুম থেকে ঘাড়ে মাথায় জল দিয়ে আসেন। 

ওঃ কত কথা মনে পড়ে যায়। কী ভাবে ডজ করে করে প্রত্যেকবার শেষ মুহুর্তে কোনো না কোনো ভাবে ঠিক বেঁচে গেছেন এই যন্ত্রনা থেকে। মলয়বাবু সত্তর সালের গ্র্যাজুয়েট। তখন নকশাল বাড়ি আন্দোলন তুঙ্গে। বাঁশবেড়িয়া নকশালদের বেশ শক্ত ঘাঁটি ছিল। মলয়ের বেশ কয়েকজন বন্ধুও সক্রিয় নকশাল হয়ে গিয়েছিল। এখন ভাবতে বেশ অবাক লাগে মলয় নিজেও নকশালদের গুপ্ত সভায় দু একবার যোগ দিয়েছিল। তার কারণও সেই একই। ও ঝুট ঝামেলা এড়িয়ে চলতে চায়। তখন এমন একটা অবস্থা ছিল ওদের সঙ্গে যাবনা বললেও যে কোনো বিপদ হয়ে যেতে পারতো। ও গুটি গুটি পায়ে গিয়ে হাজির হতো সেই সব সভায়, কখনো গঙ্গার ধারে কখনো কোনো পোড়ো বাড়িতে। সেখানে শুনতো বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস। সেখানে পরিকল্পনা হত কী ভাবে ব্যালট পেপার ছিনতাই করে ভোট বানচাল করে দিতে হবে। সেই সময়েই ও কাছেই একটা স্কুলে চাকরি পেয়ে গিয়েছিল। চাকরিটা ওকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল বলা যায়। মলয় চাকরির ছুতোয় নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিল। তারপর এসে গেল একাত্তরের নির্বাচন। দেয়ালে দেয়ালে ভোটের প্রচারের পাশাপাশি লেখা হতে লাগল ভোট বয়কটের আহ্বান। রেডিওতে কিছুক্ষণ পর পরই ঘোষক মনে করিয়ে দিতেন  ভোট দেওয়া পবিত্র কর্তব্য। নকশালপন্থী প্রভাবিত জায়গাগুলিতে নিরাপদে ভোটপর্ব সমাধা করতে হাজির হয়ে গেল সেনাবাহিনী। মানুষের মনোবল অটুট রাখতে শহরের অলিগলি দিয়ে সেনারা মার্চ করতে লাগল। সে এক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি। 

নির্বাচনের দিন ঘোষণা হতেই স্কুলে চিঠি এসে গেল ভোটকর্মীদের নাম পাঠানোর জন্য। নিজের নাম লিস্টে দেখেই মলয় আঁতকে উঠেছিল। মনে পড়ে গিয়েছিল ওর নকশাল বন্ধুদের পরিকল্পনার কথা- কী ভাবে ব্যালট পেপার ছিনতাই করা হবে, প্রয়োজনে কীভাবে বোমা ছোড়া হবে। পাইপগান কার কার কাছে থাকবে ইত্যাদি।

বিশুবাবুর মাথাতেই প্রথম বুদ্ধিটা এসেছিল। পন্ডিত স্যার তো শুনে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন- ভোটে দাঁড়াতে হবে! এযে জলে কুমীর ডাঙ্গায় বাঘ। ওর বাড়িতেই মিটিং বসেছিল। অনেক টানা হেঁচড়ার পর স্থির হল ভোটে প্রার্থী হবেন পন্ডিত স্যার। মলয় নিজে প্রস্তাবক, বিজনবাবু সমর্থক। ওরা তিনজনে জামানতের টাকা ভাগ করে দিয়ে যথাসময়ে মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে স্কুলে কাগজপত্র জমা দিয়েছিলেন। ইলেকশন ডিউটি থেকে নাম কাটাতে ওদের আর কোনও অসুবিধেই হয়নি।

তারপর এল বাহাত্তর সালের সেই ঐতিহাসিক নির্বাচন। ততদিনে নকশাল আন্দোলন স্তিমিত। গ্রাম শহরে নকশালপন্থী রাজনৈতিক কর্মীরা ছত্রভঙ্গ, দ্বিধাবিভক্ত।তার জায়গায় রাজনৈতিক শক্তির নতুন বিন্যাস হয়ে গেছে। ভোট আসছে শুনে বিজনবাবুতো ভয়ে সিঁটিয়ে গেলেন। মলয়কে একদিন ফিসফিস করে বললেন, “গতবার তো নকশালদের হাত থেকে কোনক্রমে রক্ষা পাওয়া গিয়েছিল কিন্তু এবার তো কংশাল, এরা তো আরও সাঙ্ঘাতিক। মলয় কিছু একটা কর”। ভোট এগিয়ে আসতে আবার মিটিং বসল সে পন্ডিত স্যারেরই ঘরে। উনি প্রথমেই বলে দিলেন, “ মলয়, আগের বার আমি ক্যান্ডিডেট ছিলাম, এবার আমাকে রেহাই দাও ভাই। এবার তুমি ক্যান্ডিডেট আর আমরা প্রস্তাবক ও সমর্থক”। শেষ পর্যন্ত অদ্ভূত ভাবে রেহাই পাওয়া গিয়েছিল। মাত্র এক বছর আগে নির্বাচন হয়েছে। তাই নতুন করে নাম চেয়ে পাঠানোর বদলে হুবহু পুরোন লিস্ট ধরে নিয়োগপত্র এসে গেল। মলয়ের তাতে নাম নেই।

সেই সময় স্কুলের চাকরি বিশেষ ভাল ছিল না। মলয় এদিক ওদিক চাকরির চেষ্টা করছিল। বিমল স্যার বলতেন- “চলে যাও মলয়, এখনও বয়স আছে। যদি পার তো বেরিয়ে যাও। আমাদের তো আর সময় নেই। সারাজীবন স্কুলে চাকরি করে কী শিখেছি জান? ‘লোকটি গরীব’ ইংরাজী ‘দি ম্যান ইস এ টীচার’।

মলয়ের বড় লোভ হত – একটা যদি বোনাস পাওয়া ওভারটাইম পাওয়া চাকরি পাওয়া যেতো! ওর অবিশ্বাস্য মনে হত যে কোন কোন চাকরিতে বেড়াতে যাবার জন্যে টাকা পাওয়া যায়। ছুটি না নিলে কোম্পানী তার বদলে টাকা দিয়ে দেয়। স্কুল শিক্ষকতা করে বুড়ো হয়ে যাওয়া বিমল স্যারের কথাগুলো ওর মনে ধরেছিল। শিক্ষকদের পোশাক আসাক ও জীবন যাত্রার মান দেখে ওর মনে হয়েছিল সত্যিই ‘লোকটি গরীব’ ইংরাজী ‘দি ম্যান ইস এ টীচার’। সেই সময় পেয়ে গিয়েছিল আই আধা সরকারী সংস্থার চাকরিটা। প্রথম প্রথম ভেবেছিল বিহারে চাকরি করতে যাবে কিনা, তারপর চলেই গিয়েছিল।

কিন্তু চাকরিতে যোগ দিয়েই সেই এক বিপদ। ছমাসের মধ্যে সাতাত্তর সালের নির্বাচন। সে এক ঐতিহাসিক নির্বাচন।জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে সারা ভারতবর্ষে আন্দোলন চলছে। জরুরী অবস্থা উঠে গেছে। হঠাৎ মুক্তি পেয়ে মানুষের ক্ষোভ, রোষ বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়ে সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মত দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে গণ আন্দোলনের রূপ নিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে নকশাল আন্দোলন স্তিমিত হয়ে গেলেও বিহারে নতুন করে দানা বাঁধছে। বিহারের রাজনীতিতে জাতপাতের লড়াই।  ভূমিহার, রাজপুতদের সঙ্গে পিছড়ে বর্গের মানুষের লড়াই। নকশালপন্থীরা বিহারের পেছিয়ে পড়া মানুষদের সংগঠিত করে নেমে পড়েছে উচ্চবর্ণের মানুষদের সঙ্গে লড়াইয়ে। ফলে পশ্চিমবঙ্গে জন্ম হলেও নকশাল আন্দোলন বিহারে অনুকুল জমি পেয়ে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে। এই পটভূমিকায় সাধারণ নির্বাচন এগিয়ে আসছে। মলয় ভেবেছিল চাকরিই ছেড়ে দেবে।কিন্তু ছাড়া হয়নি কারণ ফিরে গেলেও আর স্কুলের চাকরিটা আর ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা ছিলনা।

উপায়ান্তর না দেখে একদিন শ্রীবাস্তব সাহেবের চেম্বারে ঢুকে পড়ল মলয়। শ্রীবাস্তব সাহেব শুদ্ধ হিন্দী বলতেন কিন্তু বাংলাটা বলতে না পারলেও বুঝতে পারতেন। কিন্তু এ কোন ভাষা! উনি মলয়ের কথাবার্তা একবিন্দু বুঝতে পারছেন না। মলয় কাঠ বাঙ্গাল ভাষায় কাতর মিনতি করে চলেছিল যে সে এক বিন্দু হিন্দী জানে না। হিন্দী পড়তে জানেনা, হিন্দী সংখ্যাগুলো সে চিনতেই পারেনা। ইলেকশন ডিউটিতে গেলে সে কোন কাজই করতে পারবে না। অফিসের বড়বাবু এসে দোভাষীর কাজ করে সাহেবকে বোঝান যে সত্যি এরকম লোককে দিয়ে ইলেকশন ডিউটি চলবে না। হিন্দীপ্রেমী শ্রীবাস্তব সাহেব মলয়ের নাম কেটে দিতে রাজী হবার আগে মলয় কে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নেন যে পরের ইলেকশনের আগে সে হিন্দী পড়তে ও লিখতে শিখে নেবে। বিহারে চাকরি করবে আর হিন্দী অক্ষর পরিচয় থাকবেনা এটা তিনি কিছুতেই মেনে নেবেন না।

এর পরের ঘটনাটা মনে পড়লে মলয়ের এখনও মলয়ের হাসি পায়। ভাগ্যিস সাহস করে লাহিড়ি সাবের বাসায় পৌঁছে গিয়েছিল সেদিন। অফিস ছুটির পর সকলে বেরিয়ে গেলেও মলয় অপেক্ষা করছিল। প্রায় ছটার সময় লাহিড়ি সাহেবের গাড়িটা বেরিয়ে গেলে মলয় গুটি গুটি হানা দিল লাহিড়ি সাহেবের কোয়াটার্সের দিকে। টাউন্সিপের এই দিকটা বেশ ঝকঝকে। অফিসারদের বড় বড় বাংলো, সামনে প্রশস্ত লন। বেশির ভাগ বাংলোতেই এখন ফুলের সমারোহ। শীতকাল বাগানগুলো সব মরশুমী ফুলে আলো হয়ে আছে। রাস্তার দুধারে সারি সারি বাংলো। হেজ গাছের বেড়া সুন্দর করে ছাঁটা। রাস্তা থেকে ভেতরটা পরিস্কার দেখা যায়। মলয় দেখল লাহিড়ি সাহেব অফিসের পোশাকেই বাগানে বেতের চেয়ারে বসে। ওঁর স্ত্রী পাইপ হাতে গাছে জল দিচ্ছেন। ঢুকব কি ঢুকবনা ভেবে কয়েকবার মলয় সামনের রাস্তায় ঘোরাঘুরি করল, শেষে একটু ইতস্তত করে লোহার গেটে হাত রাখল। ক্যাঁচ করে আওয়াজ হতেই ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকালেন লাহিড়ি সাহেব।

-“আরে এস মলয় এস”। লাহিড়ি সাহেব বুঝতে পারেন না – এই তো অফিস থেকে এলেন- এরই মধ্যে আবার কী দরকার পড়ল মলয়ের। তবু সে কথা বুঝতে না দিয়ে আন্তরিক ভাবে মলয়কে ডাকেন। লাহিড়ি সাহেব মলয়কে বেশ স্নেহ করেন ওর চটপট স্বভাবের জন্যে। মলয়কে যে কোন কাজ দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়, কোন নতুন কাজ বোঝাতে দুবার বলতে হয় না।  অফিস টাউনশিপে থাকার সুবাদে সম্পর্কগুলো অফিসের বাইরেও বিস্তৃত হয়। মলয়ও কাজের প্রয়োজনে কয়েকবারই লাহিড়ি সাহেবের বাংলোয় এসেছে।

-“এই এলাম স্যার”। 

– “হ্যাঁ হ্যাঁ, এস এস । দেখ, আমার বাগান কেমন হয়েছে বল। যাই বল চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া, ক্যাসকেট, পিটুনিয়া যতই থাক বাগান আলোকরে তোমার গাঁদা ফুল। ইনকা র সাইজ দেখেছ? ওইদিকে দেখ জুবিলী, জমাট গড়নটা শুধু লক্ষ্য কর। আমি তো বলি অন্য কিছু লাগাতে হবে না শুধু গাঁদা লাগিয়ে যাও”। 

 বাড়ির ছেলেটি ট্রেতে করে তিন কাপ চা এনে বেতের টেবিলটার ওপর রাখে। -“ নাও এসো, চা খাও”। 

মলয় জড়সড় হয়ে লাহিড়ি সাহেবের পাশের চেয়ারটায় বসে। 

–“ তুমি শুধু ইনকা জুবিলীর প্রশংসা করলে। আমি যে এত খাটছি, কোথায় পচা খোল, কোথায় মাছের তেল কাঁটার পচা জল-  স্নোবল’টার কথা তোমার একটু মনে এলনা?”- মিসেস লাহিড়ি অনুযোগ করলেন। 

-“হ্যাঁ হ্যাঁ স্নোবল টাও দেখবে চল। সকালবেলা যখন ফুলটার ওপর শিশির জমে থাকে তখন সত্যিই মনে হয় স্নো বল। সাদা ধপধপে। একদিন সকালে এসো না। মর্নিংওয়াকে যাওনা? ফেরার পথে একদিন এসে শিশির ভেজা স্নোবল দেখে চা খেয়ে যেও”।

-হ্যাঁ স্যার, একদিন আসব সকালে। বলছিলাম কি……

– তবে যাই বল সাদা গাঁদা যেন গাঁদা ফুলের বংশের কলঙ্ক। ওইটা আমি একেবারেই পছন্দ করিনা। নার্সারি থেকে জোর করে গছিয়ে দিয়েছে। 

– আমি বলছিলাম কি… মলয় প্রসঙ্গ বদলাতে চেষ্টা করে।

– বলুন তো , ম্যাডাম আলোচনায় যোগ দেন, বাগানে সব রকম ফুল না থাকলে কি বাগান মানায়? না শুধু গাঁদা লাগাও। 

– সত্যি কথা বলতে কি ছোটবেলা থেকে আমরা ফুলগাছ দেখেছি, গাঁদা, রজনীগন্ধা, গন্ধরাজ, কামিনী, চাঁপা—–এইসব। তোমার ঐ বিলিতি ফুল…

– হ্যাঁ ঐ জন্যে ছোটবেলা থেকে যা শুনেছ, যা দেখেছ তার বাইরে কিছু ভাবতে পার না। ছোটবেলা থেকে গাঁদাফুল দেখে এসেছ—সুতরাং শুধু গাঁদা লাগাও। আর সাদা গাঁদা দেখনি তাই সেটা সহ্য করতে পার না। 

– হ্যাঁ এটা বলেছ একেবারে খাঁটি কথা। আচ্ছা মলয় , তুমি কীরকম যেন উসখুস করছ- হয়েছে টা কি?

– স্যার বলছিলাম কী…

-আহা ধাড় না চুলকে কী হয়েছে বলবে তো ।

– স্যার আমি …বাবা হতে চলেছি।

মিসেস লাহিড়ি চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে বিষম খেয়ে ওঠেন, কাপ থেকে চা চলকে উঠে ওনার শালটা ভিজিয়ে দেয়। লাহিড়ি সাহেব কোনরকমে সামলে নিয়ে বলেন—– তা বাবা হতে চলেছ— তো হয়েছে টা কী? সবাই তো এক সময়ে বাবা হয়। 

– না মানে আমার স্ত্রীর এখন অ্যাডভান্সড স্টেজ। 

– তা অ্যাডভান্সড স্টেজ তো আমার কাছে এসেছ কেন? ডাক্তারের কাছে যাও। 

– না মানে বলছিলাম কি স্যার— আমার সন্তান বোধহয় সারা জীবন আমার ছবিতেই প্রণাম করবে। আমাকে আর দেখতে পাবে না।

– কী আবোল তাবোল বকছো? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?

– না স্যার মাথা আমার ঠিকই আছে। তবে এইবার খারাপ হবে।

মিসেস লাহিড়ি আর ধৈর্য রাখতে পারেননা। এগিয়ে এসে বলেন কী হয়েছে বলুন তো? এমন সব কথা বলছেন…।

– স্যার, ইলেকশন ডিউটিতে নাম পাঠানো হচ্ছে, ধানবাদ ঝড়িয়া কোথায় ডিউটি পড়বে কে জানে। আপনি তো জানেন স্যার এখনকার ভোটে মাফিয়াদের রাজত্ব। তারা কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে খোলা খুলি বন্দুক নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। এদিকে ঘরে ঐ অবস্থা। 

লাহিড়ি সাহেব কীভাবে রিঅ্যাক্ট করবেন ভেবে ওঠার আগেই মিসেস লাহিড়ি বলে ওঠেন- “ঠিকই তো। এই অবস্থায় কাউকে ইলেকশন ডিউটিতে পাঠায়!” তার পরের দিন লিস্ট থেকে মলয়ের নাম বাদ পড়ে গিয়েছিল। অফিসের বড়বাবু প্রশ্ন তুলেছিলেন একটা নাম কাটলে সবাই নাম কাটাতে চাইবে। কেউই ইলেকশন ডিউটিতে যেতে চায়না। লাহিড়ি সাহেব বড়বাবুকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, “ আপনি বলে দেবেন আমি নিজে হাতে মলয়ের নাম কেটেছি। ওকে আমি একটা বিশেষ কাজ দেব যেটা করে ওর পক্ষে ভোটে যাওয়া সম্ভব হবে না। যদি কেউ কিছু বলে আমার কাছে পাঠাবেন”। ইলেকশনের কিছুদিন পড়ে মলয় ছেলে হবার খবর দিলে লাহিড়ি সাহেব বলেন,  “ বাড়ি গিয়ে খবরটা দিতে হবে। আমার স্ত্রী তো মাঝে মাঝেই তোমার খবর জিজ্ঞেস করে”। 

প্রৌঢ় মলয়বাবু নিজের মনেই হেসে ওঠেন । সত্যিই কী কান্ডটাই না হয়েছিল। এর পর কিছুটা পদোন্নতি হয় ও অফিসের বিশেষ একটা দায়িত্ব পাওয়ায় সামান্য চেষ্টাতেই কোন না কোন ভাবে ইলেকশন ডিউটি এড়িয়ে যেতে পেরেছিলেন। আজ এত দিন পড়ে এই বয়সে … মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে। এমন জানলে কলকাতা অফিসে আর কিছুদিন পরেই জয়েন করতেন। বিহারে এবার ভোট হচ্ছে না, ওখানে থাকলে কোন বিপদ ছিল না। 

– কী মলয়বাবু – কী এত ভাবছেন? কলকাতা অফিসে ঠিক মন বসছে না না কি?

– না না তা নয়। তবে এসেই ইলেকশন ডিউটিতে ফেঁসে গেলাম, এই আরকি। 

– তাই নাকি? ওঃ কম ইলেকশন ডিউটি করলাম মশাই জীবনে!  আগে আগে তো পাঁচ বছরে একবার ভোট হত, লোকসভা, বিধানসভা একসঙ্গে। একবার গেলেই পাঁচ বছরের দায় নিশ্চিন্ত। এখন এ বছর বিধানসভা তো পরের বছর লোকসভা। তা এত ঝামেলা করে ভোট হচ্ছে- তো পাঁচ বছর চলুক, তা নয় কখনো তেরো দিন, কখনো তেরো মাস। আমাদের যত মরণ।

– তা এতো বার যে ভোট করালেন ঝামেলায় পড়েননি কখনও?

– তা আর পড়িনি? তাই বলে তো ঝামেলায় পড়ে তো পৈত্রিক প্রাণটা দিয়ে দিলে চলবে না। যার যে এলাকায় প্রভাব তার কথা শুনে চলতে হবে। ফলস ভোট? দিয়ে যাও ভাই যত খুশি। আমি ছা পোষা মানুষ, আমার কি দরকার মশাই অত গণতন্ত্র রক্ষা করার। 

– তা তো ঠিকই। তবু টেনশান তো হয়ই। ওপর পক্ষেরও তো শক্তি থাকতে পারে। তখন তো আর এক তরফা হবে না। ঐ দু-এর মাঝে পড়ে তখন তো এই গরীব ব্রাহ্মণের প্রাণটা চিঁড়ে চ্যাপটা। তা আপনার টেনশান হচ্ছে না? 

– আরে আমি তো মুক্ত পুরুষ। পঞ্চাশ পেরিয়ে গেলে আর ইলেকশন ডিউটিতে যেতে হয়না।

– তাই নাকি? এই রকম নিয়ম?  মলয় বাবু উৎসাহিত হয়ে ওঠেন।

-হ্যাঁ, কিন্তু আপনার কি পঞ্চাশ হল নাকি?

-হ্যাঁ এই জানুয়ারিতে পঞ্চাশ পূর্ণ করেছি। 

– বলেন কি? দেখে তো মনেই হয় না, এখনো তো আপনাকে চমৎকার নায়ক সাজানো যায়। 

মলয়বাবু রসিকতায় কান না দিয়ে সোজা উঠে যান অ্যাডমিনিস্ট্র্যাটিভ অফিসারের টেবিলে, যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছেন। “মিঃ সরকার আমার তো পঞ্চাশ হয়ে গেছে। আমার নাম তো ইলেকশন ডিউটিতে যাবার কথা নয়” । 

তাই নাকি আপনি পঞ্চাশ? দেখে তো বোঝাই যায়না। ঠিক আছে, আমি ডেট অফ বার্থটা ভেরিফাই করে নামটা কেটে দেব। 

ফিরে গিয়ে নিজের চেয়ারে বসতে বসতে কানে এল, “মলয় বাবু পঞ্চাশ! ভাবাই যায় না”। চেয়ারে বসে এক গেলাস জল খেলেন। ইলেকশন ডিউটি থেকে অব্যাহতি পাওয়া গেছে, কিন্তু ভার মুক্ত লাগছে না তো। ধীর পায়ে বাথরুমে গেলেন। চোখে মুখে জল দিয়ে বেশ তাজা লাগলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে বেশ ভাল করে দেখলেন, চুল আঁচড়ালেন। সামনের চুল গুলোয় সামান্য পাক ধরেছে- কিন্তু পাতলা একটুও হয়নি। নিজের চুল নিয়ে গর্ব ছিল, মলয়বাবু চুলে হাত বোলাতে বোলাতে ভাবেন ঠিকই আছে। এখনও বিশেষ কিছু হারাননি। মুখ চোখ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন, কপাল, চোখের কোলে হাত বোলালেন। গলার চামড়াটা একটু আলগা হয়েছে কি? গলার বোতামটা লাগিয়ে পাশ ফিরে দেখলেন নিজেকে। বোঝা যায়না তেমন নয়। রোজ রেল স্টেশনের ওভার ব্রীজে ওঠার সময় নিজের অজান্তেই হাতটা রেলিঙে চলে যায়। সিগারেটটাও আর সহ্য হচ্ছে না। খেলেই কিছুক্ষণ ঘন ঘন নিশ্বাস নিতে হয়। 

নিজের চেয়ারে এসে বসেন মলয়বাবু। পঞ্চাশ। ‘পঞ্চাশ’ শব্দটা যেন ধাক্কা দিল আজ বিকেলে। জন্মদিনগুলো আসে চলে যায়। পায়েস রান্না হয়, মন্দিরে পুজোও দেওয়া হয়। তবে পঞ্চাশ পেরিয়ে যাওয়াটা সেই ভাবে উপলব্ধি হয় নি। আজ সকলে ‘মলয়বাবু পঞ্চাশ?’ বলতে ‘পঞ্চাশ’ শব্দটা বিশেষ তাৎপর্য নিয়ে হাজির হল। অন্য দিকে মন দেবার চেষ্টা করলেও শব্দটা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগলো। ‘পঞ্চাশ’ মানে কি সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়া? নাঃ –এসব ভেবে লাভ নেই। যত ভাববেন তত পেয়ে বসবে। পঞ্চাশ আবার একটা বয়স হল নাকি! এক সময়ে বোধহয় মানুষ পঞ্চাশেই বৃদ্ধ হয়ে যেতো। তবেই না ‘পঞ্চাশোর্ধে বনং ব্রজেৎ’ কথাটা চালু হয়েছিল। এখন মানুষের আয়ু কত বেড়ে গেছে। পঞ্চাশ বছর বয়সী মানুষদের বৃদ্ধ তো বল যায়ই না, প্রৌঢ়ও বলা যায়না বেশিরভাগ সময়। নিজেকে তার তো যুবকই মনে হয়। নাঃ এতো মহা মুশকিল হল দেখছি- পঞ্চাশের ভূত টা কিছুতেই মাথা থেকে নামছে না। বিরক্ত হয়ে মলয়বাবু চেয়ার থেকে উঠে পড়েন, ঘড়ি দেখেন, প্রায় পাঁচটা বাজল। ব্যাগ গুছিয়ে অফিস থেকে বেরোলেন। 

– হ্যাঁগো, তোমার কিছু হয়েছে?

কেন? কী আবার হবে? 

      না- মুখটা কেমন লাগছে। কী হয়েছে বলনা।

কী আবার হবে! মহা মুশকিল তো।

ইলেকশন ডিউটিতে যেতে হবে তাই মন খারাপ?

নাম কেটে গেছে- যেতে হবে না।

তাই? কী করে কাটালে নাম? এবার কী গল্প বানালে?

এবার আর গল্প বানাতে হয়নি। পঞ্চাশ হয়ে গেলে ইলেকশন ডিউটিতে যেতে হয়না।

বাঃ এতো দারুণ খবর। তার মানে পঞ্চাশ বছর তো একটা আশীর্বাদ।    

সবাই বলছে, আপনি পঞ্চাশ?

তাই মন খারাপ? এটাতো আরও আশীর্বাদ। তুমি ‘পঞ্চাশ’, অথচ মনে হয় চল্লিশ-পয়তাল্লিশ। চল আজ উদযাপন করি। 

মলয়বাবু যেন একটু শান্তি পেলেন।

[বানানবিধি/মতামত লেখকের নিজস্ব]

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ