এ শহরে তখন আমি আনকোরা নতুন। পরিচিত তেমন কেউই ছিলোনা। দুচারজন সদ্যঘনিষ্ঠ সহপাঠীদের ছাড়া চিনতাম স্টেশনের কাছে চায়ের দোকানের মালিক গঙ্গাদা, বটতলার নিতাই আর চালতাবাগানের বাচকুনদা। এছাড়াও আমার খুব ভালো লাগতো আরো একজনকে, তার নাম কেয়ামাসী যার সঙ্গে আমার আলাপটা হঠাৎ হয়ে গিয়েছিলো।
একদিন রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় পেছনদিক থেকে জোরে আসা রিক্সার ধাক্কায় পড়ে গিয়েছিলাম। একটু কেটেও গিয়েছিলো। সেখানেই ছিলো আমার সহপাঠী সুখেন। আমার মৃদু আপত্তি সত্ত্বেও সে আমাকে একরকম জোর করেই নিয়ে গেলো কাছের একটি বাড়িতে। ওর দূর সম্পর্কের মাসী। কলিং বেল শুনেই দরজা খুললেন এক ভদ্রমহিলা। আমি তখন নিজের ব্যাথার কথা ভুলে ওনাকেই দেখছিলাম। চোখদুটি বড়ো সুন্দর, পরণের হালকা নীল শাড়ীতে খুব মানিয়েছে। সর্বোপরি, চেহারায় একটা ব্যক্তিত্বের স্পষ্ট ছাপ।
সুখেন বললো, – “কেয়ামাসী, আমার বন্ধু। একটু আগেই একটা রিক্সার ধাক্কায় পড়ে গিয়েছিলো। একটু ফার্স্ট এড লাগবে , তাই এখানেই চলে এলাম।”
— বেশ করেছিস ।
এরপর কেয়ামাসী যখন নিজের হাতে আমার ছড়েযাওয়া জায়গাগুলো পরম মমতায় তুলো দিয়ে পরিস্কার করতে শুরু করলেন , আমি আড়ষ্ঠ হয়ে থাকলাম। একটু লজ্জাও করছিলো। ওনার আঙ্গুলের স্পর্শ, শরীরের ঘ্রাণ আর ঘরের বাতাসে হালকা পারফিউম – এসব মিলে এমন মোহময় পরিবেশ যে আমি আমার ব্যাথা বা ডেটলের গন্ধ সত্ত্বেও মনে মনে চাইছিলাম কেয়ামাসীর মুখের দিকে ঐরকম কাছ থেকে আরো কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকতে।
এরপর থেকে সুখেনের সঙ্গে মাঝেমাঝেই কেয়ামাসীর বাড়ি যাওয়া শুরু হলো। কেয়াদি বলে ডাকতে খুব ইচ্ছে করতো। কারণ ‘ মাসী ‘ সম্বোধনের মধ্যে সামান্য দূরত্ব থাকেই। যাইহোক, সেইসূত্রে সুখেনের কলেজের ও পাড়ার বন্ধুরাও কেয়ামাসী বলেই ডাকতো যদিও তাঁর মধুর ব্যবহারের মধ্যেও এমন একটা দূরত্ব থাকতো যেটা অতিক্রম করে বেশি ঘনিষ্ঠতা সহজে কেউ করতে পারতোনা। সেটা হয়তো কিছুটা প্রয়োজন ছিলো।
কেয়ামাসী তাঁর তিন কামরার সুসজ্জিত ফ্ল্যাটে একাই থাকতেন। এখানকার লোকেরা জানেনা তাঁর তিনকুলে কেউ আছে কিনা। শোনা যায় আগে নাকি অন্য কোথাও থাকতেন। তিনি যথেষ্ট সুন্দরী, উচ্চশিক্ষিতা এবং একটু দূরে কোনো একটি কলেজের বাংলার অধ্যাপিকা। মোটামুটিভাবে এগুলোই লোকেরা জানে।
কেয়ামাসী একদিন নিজে থেকেই আমাকে বললেন, সুখেনকে সবসময় না পেলেও তুমি মাঝেমাঝে এসো। কোনো সঙ্কোচ করতে হবেনা। তোমার তো বাংলা অনার্স ?
আমার ভালোই হলো। আমার অনার্সের বিষয় নিয়ে অনেককিছু আলোচনা করার সুযোগ পেলাম অমন একজন বিদগ্ধ মানুষের সঙ্গে। তাই সাহস করে যেতে শুরু করলাম। জানতাম যে উনি পাড়ার মধ্যে কারো সাথে বেশি মেলামেশা করেননা কারণ কিছুটা সময়ের অভাব আর কিছুটা লোকের অকারণ কৌতুহল। আমার কানেও আসতো। অবিবাহিতা নাকি ডিভোর্সি , আত্মীয়স্বজন নেই না সম্পর্ক রাখেনা। খুব দেমাক, নিশ্চয়ই কোনো গোপন প্রেমিক আছে । চরিত্রই বা কেমন , ইত্যাদি।
ইতিমধ্যে আমি কেয়ামাসীর খুব কাছের একজন হয়ে গেছি। তাঁর সঙ্গ আমার ভালো লাগতো উপরন্তু তাঁর সাথে সাহিত্য ছাড়াও নানা বিষয়ে গল্প করলে আমি খুব সমৃদ্ধ হতাম।
একবার একটা ছুটির দিনে সন্ধ্যায় চলে গেলাম। বেশ কয়েকবার কলিং বেল বাজাবার পর দরজা খুললো। দেখলাম কেয়ামাসীর পরণে একটা পিঙ্ক শাড়ি, দুই ভ্রুর মাঝখানে ছোট্ট লাল টিপ, এমনিতেই ঢেউখেলানো চুলটা মনে হলো যেন বেশ কিছুটা অবিন্যস্ত। লক্ষ্য করলাম সমস্ত মুখে বিন্দু বিন্দু স্বেদচিহ্ন । চোখের কোণে টলটলে স্নেহ আর মজার ঝিলিক। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম। অনাবিল হাসিতে মুখ ভরিয়ে উনি বললেন,
— এসো, ভেতরে চলে এসো।
আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললাম,
— কোনো অসুবিধা করলাম কি ? মনে হচ্ছে আপনি কোনো কাজে খুবই ব্যস্ত আছেন।
— হ্যাঁ , ঠিকই ধরেছো। তবে যে কাজটা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম বা এখনও আছি, চলো আজ তোমাকে সেই কাজের ঘরেই নিয়ে তাই।
এই বলে তাঁর সঙ্গে যে ঘরটিতে ঢুকলাম সেখানে আমি আগে কোনোদিন যাইনি।বুঝলাম সেটা একটা বড়ো মাপের স্টুডিও। চারিদিকে দেয়ালজুড়ে অনেক ছবি টাঙানো। ঘরের মাঝখানে স্ট্যান্ডে বড়ো ক্যানভাসে একটি প্রায় সমাপ্ত ছবি। কেয়ামাসী যে একজন চিত্রশিল্পী আমি তখন জানতে পারলাম। দেখলাম বেশিরভাগ অপরূপ নিসর্গ দৃশ্য। শান্ত, লোকালয়হীন, ছায়াচ্ছন্ন স্বপ্ননীল প্রকৃতি। ক্যানভাসে যেটির কাজ তখনও একটু বাকি রয়েছে তাতে কাঞ্চনজঙ্ঘার সম্পূর্ণ সৌন্দর্য অনাবৃত। বরফমন্ডিত পরিবেশ। মেঘের মতো, জ্যোৎস্নার মতো আর্দ্র করুণ রঙের ওপর রৌদ্রের প্রতিফলন। কেয়ামাসীর এই গুণটি আবিষ্কার করার পর থেকে ওনার ওপর শ্রদ্ধা যেন একলাফে অনেকটা বেড়ে গেলো।
এমনি করে দিন যায়। ক্যালেন্ডারের পাতা বদলে বদলে পেরিয়ে যায় মাসের পর মাস।কেয়ামাসীর বসার ঘরে মাঝেমাঝেই আমাদের আড্ডা জমতো। বিশেষকরে রবিবার বা অন্য ছুটির দিন। আমি, সুখেন আর ঘনিষ্ঠ দুয়েকজন । বটতলার নিতাই বা চালতাবাগানের বাচকুনদা কম আসতো। ইচ্ছে হলে অনায়াসেই সেই আড্ডায় থাকতে পারতো কিন্তু অদৃশ্য একটা পাঁচিল হয়তো অনুভব করতো বলে নিজেরাই আসতোনা। একটা দূরত্ব কেয়ামাসী হয়তো নিজেই রাখতে ভালোবাসতেন। হয়তো চাইতেন তাঁকে ঘিরে একটা রহস্যময়তা থাক। এমনিতে তাঁর প্রকৃত বয়স বোঝা যেতো না। বয়স মতোই হোক, যৌবনকে তিনি ধরে রেখেছেন শরীরী ছন্দে ও উজ্জ্বলতায়। তিনি উচ্চশিক্ষিতা, চিত্রশিল্পী এবং একইসঙ্গে সহজ অমায়িক ব্যবহার সত্ত্বেও কারো অন্তরঙ্গ না হবার বিরল ক্ষমতাসম্পন্না । তবুও তাঁর সঙ্গ পাবার ব্যাকুলতা আমি ছাড়াও আরও অনেকের কাছেই ছিলো অপ্রতিরোধ্য। ওনার নিজস্ব স্টুডিওতে অবশ্য আমি আর সুখেন ছাড়া অন্য কারো প্রবেশাধিকার ছিলোনা জানতে পেরেছিলাম। একথাও জেনেছিলাম যে কেয়ামাসী হঠাৎ কোনো খেয়ালে সখের ছবি আঁকা শুরু করেননি। সরকারি আর্ট কলেজের পেশাগত শিক্ষা আছে।
একদিন রবিবার সকালে সুখেনের ফোন পেলাম। বললো, — “মাসী আমাদের দুজনকেই আজ সকালে আসতে বলেছে।”
চলে গেলাম। ঘরে ঢুকেই বসতে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ মাসীর নির্দেশ, ওখানে নয়, একেবারে ব্রেকফাস্টের টেবিলে গিয়ে বসো।
আমি মৃদু আপত্তি করলাম, আমিতো বাড়িতে ব্রেকফাস্ট করেছি।
মাসী কী বুঝলেন জানিনা তবে আমার কথায় বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে বললেন, এ বয়সে দুবার খাওয়া যায়, কি গো তাইতো ?
আমি চুপ করে রইলাম। তারপর কাজের মাসীকে ডেকে কিছু নির্দেশ দিয়ে আমাদের সঙ্গে গল্প শুরু করলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
— আপনি পোর্ট্রেট আঁকেননা ?
— হ্যাঁ, খুব কমই। আমার নিজের কাছেই কিছু শর্ত আছে। যেমন ধরো কোনো ভালো মডেল পেতে হবে। ধৈর্য ধরে তাকে আমার কাছে কয়েকটা সিটিং দিতে হবে এবং তার মুখাবয়বে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে যা সচরাচর দেখা যায়না।
ইতিমধ্যে ব্রেকফাস্ট এসে গেলো। টোস্ট , ওমলেট ,কফি আর কিছু ফল।
— নাও, শুরু করো। কফিটা না ঠান্ডা হয়ে যায়।
একটু পরে বললেন, তোমাদের দুজনকে আমার জন্যে একটা কাজ করতে হবে।
আমার ভীষন আনন্দ হচ্ছিলো। সাগ্রহে বললাম, বলুননা। কী কাজ , কোথায় ?
মাসী একটু হেসে বললেন, না, সেরকম কঠিন কিছু নয়। সামনের মাসে সাত তারিখ থেকে এক সপ্তাহ ধরে আরো তিনজনের সঙ্গে আমার কিছু ছবি এক্সিবিশনে প্রর্দশিত হবে। কলকাতার সিমা আর্ট গ্যালারীতে। তোমাদের একটু সাহায্য চাই। যেমন, সব ছোটবড়ো ক্যানভাসগুলো খুব সাবধানে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা। আমি একটা রাইট-আপ দেবো, সেটা ভালো কোনো জায়গায় ছাপানোর ব্যবস্থা করা। রোজ প্রর্দশনীর হলে কিছুক্ষণ থাকা – এইসব আর কি। তবে অবশ্যই নিজেদের পড়ার ক্ষতি করে নয়। সামনেইতো তো তোমাদের পার্ট টু।
যথাসময়ে সিমা গ্যালারীতে অনেকের সঙ্গে কেয়ামাসীর ছবির এক্সিবিশন হয়ে গেলো। শুনতে পেলাম ওনার কাজ নাকি সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে। বিদুষী ও সুন্দরী শিল্পীর সঙ্গে কথাবার্তা বলে সবাই মুগ্ধ।
একটি বিখ্যাত সাময়িকীর আর্ট ক্রিটিক লিখলেন, ” শিল্পীর জলরঙের চিত্রগুলিতে রঙের যথাযথ ও পরিমিত প্রয়োগে নিসর্গ, নৌকা ও নদী অসাধারণ সৌন্দর্য নিয়ে দেখা দিয়েছে। নৌকা যেন চলমান জীবনের প্রতীক। শিল্পীর কিছু কিছু কাজ দেখলে মনে হবে এই প্রকৃতি যেন মৌন, অপেক্ষমান। শিল্পীহিসেবে কেয়া সান্যালের ভবিষ্যৎ নিঃসন্দেহে বিপুল সম্ভাবনাময়।”
এরপর থেকে কেয়ামাসীর বাড়িতে সময় পেলেই চলে যেতাম। কতো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গল্প হতো। এইসব আড্ডায় আমি নিজেকে সমৃদ্ধ করার সুযোগ পেতাম। একটা ভীষণ রকম ভালোলাগা থেকে ক্রমশ ওনাকে গভীর শ্রদ্ধা করতে শুরু করলাম।
সকালে অথবা সন্ধ্যায় চা বা কফির সঙ্গে কিছু স্ন্যাকস্ থাকতোই। কেয়ামাসীর একক সংসারে গিন্নী ও অভিভাবক বলতে সবই ঐ কাজের মাসী। ঘরদোর গুছিয়ে রাখা, বাজারে যাওয়া সবই তার কাজ। রান্নাটা একেবারে দুবেলার করে দিয়ে সন্ধ্যা হলেই নিজের বাড়িতে চলে যায়।
ক্রমশ আমার পরীক্ষার দিন এগিয়ে এলো। পার্ট ওয়ানের রেজাল্ট মোটামুটি ভালোই ছিলো কিন্তু পার্ট টু আরো ভালো করতে না পারলে মুশকিল হয়ে যাবে। তাই বাইরে বেরোনো কমিয়ে পড়ার ঘরে বেশি সময় কাটতে লাগলো। আমার ছিলো বাংলায় অনার্স। কেয়ামাসী যেহেতু বাংলাসাহিত্যের একজন বিদগ্ধ অধ্যাপিকা , তাই সময় পেলেই কিছু আলোচনা করার জন্য যেতাম। আবার একটানা পড়তে পড়তে ক্লান্ত লাগলে চলে যেতাম স্টেশনের কাছে গঙ্গাদার চায়ের দোকানে। সেখানে মাঝেমাঝেই নিতাই বা বাচকুনদাও থাকতো। একদিন কথায় কথায় নিতাই বললো, কিরে ,তোর কেয়ামাসীর খবর কি ? ছবিটবি আঁকা চলছে ?
হঠাৎ এই প্রসঙ্গ এসে পড়ায় আমি একটু অবাক ও বিব্রত বোধ করলাম। একটু নির্লিপ্ত ভাবে দায়সারা গোছের জবাব দিলাম, জানিনা, বেশ কিছুদিন যাইনি।পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। তাই কিছু বলতে পারবোনা। আমি…
আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে নিতাই বলে উঠলো, তোর সঙ্গে এতো ভাব , মাঝেমাঝে গেলে পারিস।
এরপর এই নিয়ে আর কোনো কথা হয়নি, তবে কথাগুলো বলার সময় নিতাইয়ের ঠোঁটে মুচকি হাসির ছোঁয়া আমার নজর এড়ায়নি। এর ভেতরে আমার টিউটোরিয়াল ক্লাশে একটা রচনা পরীক্ষা হয়ে গেলো। বিষয় ছিলো, ” নারী স্বাধীনতা” । ঐ বিষয়ে কেয়ামাসীর একটা লেখা আমি আগেই পড়েছিলাম। তার থেকে কয়েকটি লাইন লাগিয়ে দিলাম। লিখলাম : ‘ আপন ভাগ্য জয় করবার জন্যে এযুগের নারী এগিয়ে আসছে জাজপুরের চুমকি, দূর্গাপুরের বুল্টি বাগদি, বাঁকুড়ার ছিপলি আর আজমগড়ের হাসিনার হাত ধরে। ইতিহাস দেখিয়েছে প্রবল পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীকে চিরকাল দমিয়ে রেখেছিলো এবং তাদের বদ্ধ ঘরে রাখবার জন্যে ধর্মকে কাজে লাগানো হয়েছিলো নারীকে দেবী সাজিয়ে বা ডাইনি তকমা দিয়ে। এযুগেও তার একক অস্তিত্বকে রক্তচক্ষু দেখিয়ে চলেছে সমাজ।’
সেদিন টিউটোরিয়াল থেকে ফেরার পথে ভাবলাম বেশি রাত হয়নি, হাঁটতে হাঁটতে একবার কেয়ামাসীর সঙ্গে দেখা করে আসি।
উনি নিজেই দরজা খুললেন। আমি হেসে বললাম, কেমন আছেন ? পরীক্ষার জন্যে একদম সময় পাচ্ছিলাম না।
কথাটা আলটপকা বলে মনে হলো বোকার মতো বলে ফেললাম। কেনোইবা আমি ধরে নিলাম যে আমার দীর্ঘ অনুপস্থিতির জন্যে তিনি খুব চিন্তিত ছিলেন। এই অপ্রস্তুত অবস্থাটা কাটাবার জন্যে আমি সোজা তাঁর স্টুডিওতে ঢুকে পড়লাম। দেখলাম, কিছুদিন আগের কাজ কয়েকটি প্রকৃতিদৃশ্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সেই তিরতিরে নদী, টুকরো পাথর, গাছের নীচে ঝরা পাতার স্তুপ। কিন্তু সবচাইতে বেশি যেটা চোখে পড়লো তার জন্যে আমি একটুও প্রস্তুত ছিলাম না।
সযত্নে আঁকা একজন মানুষের মুখ এবং মনে হলো সে আমার ভীষন পরিচিত। লেখায় ও রঙে ফুটিয়ে তোলা তার পুরু ঠোঁট, কঠিন মুখের ওপর চোখদুটো যেন শরীরী ক্ষুধায় জ্বলছে। দেখলেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে ছবিটা এখনো অসমাপ্ত। আরও কিছু কাজ বাকি আছে।
আমি হতবাক। আমি টের পাচ্ছিলাম আমার ভেতরে একটা আগুনের আঁচ। কেয়ামাসী তখন কাছে ছিলেননা। মনে হলো ইচ্ছাকৃত অন্যমনস্কতা নিয়ে খানিকটা দূরে সরে ছিলেন। আমার অজান্তেই চোয়ালের কাছটা শক্ত হয়ে উঠলো। অনেকক্ষণ পর্যন্ত কোনো কথা বলতে পারছিলাম না। মন বলছিলো ,এ কাকে তুমি ঘরে ঢুকিয়েছো মাসী ? এ তো
রাজীব। লোকেরা নাম দিয়েছে – রাজুগুন্ডা। এ অঞ্চলের সবাই জানে খুন, তোলাবাজি ও একাধিক ধর্ষণের মামলায় অভিযুক্ত রাজু অনেকবার জেল খেটেছে।
রাস্তায় তাকে দেখলে সবাই এড়িয়ে চলে। কোনো ভদ্রলোক একে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে দেবার কথা ভাবতেও পারেনা। ভাবছিলাম কেয়ামাসীর সঙ্গে এর কেমন করে যোগাযোগ হতে পারে। এতোবড়ো ক্যানভাসে প্রমান সাইজের মুখটা ফুটিয়ে তুলতে ইতিমধ্যে রাজুকে কতগুলো সিটিং দিতে হয়েছে কে জানে। শেষ করার আগে নিশ্চয়ই আরো কয়েকটা সিটিং লাগবে।
আমি কিছুই বলছিনা দেখে মাসী নিজেই বললেন, বসো, চা খাবে ?
— না, রাত হয়ে গেছে। আজ যাই।
— একটুও বসবেনা ? তাহলে এতটা রাস্তা এলে…
একটা মিথ্যা বলতে বাধ্য হলাম, এদিকেই একটা কাজ ছিলো বলে এসেছিলাম, এখন বসবোনা ।
রাজীব, ওরফে রাজুগুন্ডা এরপর এপাড়ায় যাতায়াত করতে শুরু করলো। অনেকেই দেখেছেন। আমি ওকে চিনতাম। জিন্সের সার্ট প্যান্ট আর বাদামী রঙের কোলাপুরি চপ্পল ওর ব্র্যান্ড হয়ে গিয়েছিলো। সবসময়ই এটা পরে চলাফেরা করতো। আগে সে এসব দিকে আসতোনা । কিন্তু আজকাল এদিকে তার ঘনঘন গতিবিধি অনেকের নজরে এসেছে। গুঞ্জন তোলার মানুষ সবজায়গায় থাকে। আমি চেষ্টা করতাম এই বিষয়ে মাথা না ঘামাতে। কেন জানিনা কেয়ামাসীর বাড়িতে সেদিনের পর থেকে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। ইচ্ছে হলেও পাদুটো যেন আটকে যেতো। নিজের মনকে অনেকবার বোঝাতে চেষ্টা করেছি ওনার একটা ছবির মডেল হিসেবে রাজু যদি ঐ বাড়িতে যায় তার জন্যে আমার আপত্তি করার কারণ থাকতে পারেনা। তবে কি আমার অবচেতনে কেয়ামাসীর ওপরে আমার কোনো অধিকারবোধ তৈরি হয়েছে ?
এতদিনে পার্ট টু ফাইনাল শেষ হলো। এবার খুব পড়েছিলাম। পরীক্ষার ফল আশাতীত ভালো হয়েছে। খুব হালকা, ফুরফুরে লাগছে মন।
এখন আমার অনেক অবসর। সেদিন ছিলো রবিবার। তখন রাত আটটা হবে। ইচ্ছে হলো সুখেনকে সঙ্গে নিয়ে কেয়ামাসীর বাড়িতে একটা জল্পেশ আড্ডা দিয়ে আসি । কিন্তু সুখেনকে পাওয়া গেলোনা। ঠিক করলাম তাহলে একাই যাবো। হয়তো ওনার একটু অভিমান হয়ে থাকতে পারে। কারণ বেশ কিছুদিন ধরেই আমি একটা ফোন করেও খবর নিইনি। সেই সন্ধ্যার সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে খুশি মনে ওনার বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম।
বাড়িতে পৌঁছে দরজার বেল বাজালাম। একবার, দুবার। আরো কয়েকবার। কোনো আওয়াজ হলোনা। কোথাও কোনও লোডশেডিং নেই। তার মানে সুইচটা অথবা বেলটাই খারাপ। অনেক ভেবে দরজায় ধাক্কা না মেরে আস্তে ঠেললাম। আশ্চর্য, ভেতরের ছিটকিনিটা হঠাৎ খুলে গেলো। শব্দ একটু হলেও কেউ আসছেনা দেখে আমি সাহস সঞ্চয় করে খুব সন্তর্পনে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। জুতো রাখার জায়গায় চোখ পড়তেই দেখি একজোড়া বাদামী রঙের কোলাপুরি চপ্পল সযত্নে তুলে রাখা আছে। আমি চমকে উঠলাম। এ চপ্পলের মালিককে তো আমি চিনি।
এই পরিস্থিতিতে মন থেকে সব চিন্তা দূরে সরিয়ে দিলাম। বুঝলাম, পোর্ট্রেটের জন্যে ও এখন স্টুডিওতে পোজ দিয়ে বসে আছে আর তাকে দেখতে দেখতে একতলার স্টুডিওর নির্জন ঘরে একজন মগ্ন শিল্পী তার সামনের ফ্রেমে রাখা ক্যানভাসে তুলির আঁচড় কাটছে। এসব বিরল দৃশ্য দেখতে বেশ লাগে।
এমতাবস্থায় শিল্পী ও তার মডেলকে কিছু বুঝতে না দিয়ে একেবারে নিঃশব্দে আমি স্টুডিয়োর দরজাটা সামান্য ফাঁক করলাম।
একি অভাবনীয় এক বিস্ফোরণ ! সেই মূহূর্তে আমার মাথার ওপর আকাশ কেঁপে উঠলো। এ আমি কী দেখছি ?
দুটো পা টলছে। মনে হচ্ছে পড়ে যাবো। জানিনা এই অবস্থায় কখন কেমন করে ছুটে বেরিয়ে গেলাম। অনেকটা পথ একটা ঘোরের মধ্যে চলতে চলতে পৌঁছে গেলাম নদীর ধারে। একটা পাথরের ওপর চুপ করে বসেছি। অনেকটা সময় কাটলো।
আকাশে চাঁদ, তার আলো পড়েছে নদীর জলে। আহা, অবিরল এই জলধারায় যদি মনটাকে ভেজাতে পারতাম ! ঠিক কী কারণে জানিনা একটা বেয়াড়া বিবর্ণতা ক্রমশ আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে। সামনের প্লাবিত জলধারার কাছে মন চাইছে আমার এই ভীষণ একলা “আমি”টাকে , এই করুণ বিদ্ধস্ত “আমি”কে ডুবিয়ে দিতে। এই মুহূর্তে চাইছি প্রবল এক বৃষ্টিপাত যার ধারাবর্ষণে মুছে যাবে সব অনাকাঙ্ক্ষিত আবর্জনা। তারপর আমার মনে বোধহয় আসবে নির্লিপ্ত প্রশান্তি। মনকে শাসন করলাম, বোঝালাম কেয়ামাসী আমার কে ? কেউতো নয়। সামান্য কয়েকবছরের পরিচয়।
তবুও আমার সমস্ত শরীর কাঁপিয়ে , হৃদয় মথিত করে নেমে এলো বাঁধভাঙা কান্না।
[বানানবিধি/মতামত লেখকের নিজস্ব]
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।