16 Jun

ইচ্ছে হয়ে ছিলি

লিখেছেন:ত্রিদিবেশ বন্দ্যোপাধ্যায়


মানুষের জীবনে অবসর কি কাঙ্ক্ষিত? যখন মানুষ কাজের মধ্যে থাকে, উদয়াস্ত পরিশ্রম করে সংসার প্রতিপালন করে, সন্তানদের মানুষ করে তাদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত করে তখন কখনো কখনো মনে হয় বটে, ‘কবে যে অবসর পাবো’! তারপর একদিন গুটি গুটি এসে যায় অবসরের দিন। মনে হয়, “আঃ বাঁচা গেল, এবার একটু আরাম করব”। সত্যিই আরাম করার দিন এখন মনোময়ের। অবসরের পর নতুন ছন্দে বেঁধে ফেলেছিলেন নিজের জীবনকে। প্রাতঃভ্রমন, বাজার –হাট, ব্যাঙ্ক-পোস্টঅফিস, বাড়ির সকলের ছোটখাট অসুখ বিসুখে ডাক্তার বদ্যি। বিকেলে কিছু পরিচিত বয়স্ক মানুষের সঙ্গে পাড়ার পার্কে আড্ডা। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সুর কাটতে লাগলো। প্রাতঃভ্রমন শীতকালে, বর্ষাকালে বন্ধ। ধীরে ধীরে পায়ের জোর কমল,  বাকি রইল দোকান বাজারের কাজ। তাও বন্ধ হল একদিন বাজারে গিয়ে অসুস্থ হবার পর। কয়েকজন পরিচিত মানুষ সঙ্গে করে বাড়ি দিয়ে গেল। রাস্তায় সাইকেল, মোটর সাইকেল, গাড়ি বাড়ল। হার্টের ব্যামো ধরা পড়ল, হাঁটতে গেলে হাঁপ ধরে। প্রাতঃভ্রমন পুরোপুরি বন্ধ হল। পর। এখন সবসময় মনোময় শোনেন, “তুমি বস আমরা করে দিচ্ছি। তোমাকে আর বাইরে যেতে হবে না, আমি নিয়ে আসব”।

মনোময় ভাবেন মেয়েদের জীবনে সেরকম ভাবে অবসর থাকে না। সেটাকে একরকম আশীর্বাদও বলা যায়। সংসারের কাজ কিছুটা হলেও তো থাকে, তাতেই দিনের অনেকটা সময় ব্যস্ত থাকা যায়। এইরকম একটা সময়ে মনোময়ের অবসর জীবনটাকেই বোঝা বলে মনে হতে লাগলো। কতক্ষণ আর বই, পত্রপত্রিকা নিয়ে দিন কাটানো যায়! কাজের মানুষ মনোময় ভাবেন হঠাৎ এইরকম নিস্কর্মা হয়ে গেলে জীবনটাই কিরকম পা্নসে হয়ে যায়।

সেই পা্নসে জীবনে স্বাদ এসেছিল যখন গোগোল একটু বড় হল। গোগোলকে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া ওকে একটু গল্প বলা, ওকে খেলাচ্ছলে একটু পড়ানো। এইসব নিয়ে দিন কাটছিল। ধীরে ধীরে গোগোল আর একটু বড় হল, ওরও নিজের একটা জীবন গড়ে উঠছিল। বিকেলবেলা  দাদুনের সঙ্গে বেড়িয়ে ওর মন ভরে না। ও বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে চায়। আর মনোময়েরও বয়স হতে লাগলো। ধীরে ধীরে সংসারের মধ্যে থেকেও একা হয়ে যাচ্ছিলেন মনোময়।

এইরকম সময়ে একটা ছোট্ট কথা মনোময়ের জীবনটা বদলে দিল। সেই যে কথায় বলে না একটা স্ফুলিং একটা দাবানল সৃষ্টি করতে পারে। তেমনি মানুষের জীবনেও একটা ছোট কথা ছোট ঘটনা জীবনটাকেই বদলে দেয়। একদিন বিকেলে মনোময় নিজের ঘরের সামনে ইজিচেয়ারটায় বসে আছেন। এমনসময় গুটি গুটি গোগোল এসে হাজির। সেই ছোটবেলায় বিকেলবেলা দাদুর সঙ্গী থাকতো গোগোল। প্রথমে দাদু শক্ত করে নাতির ঘাত ধরে বেড়াতেন, ধীরে ধীরে সময় বদলাল নাতিই দাদুর হাত ধরে দাদুকে একটু ঘুরিয়ে নিয়ে আসতো। তারপর আরেকটু বড় হলে গোগোলের বিকেলে মাঠে খেলতে যাওয়া শুরু হলে বিকেলে দাদু-নাতির দেখা হওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

“কীরে খেলতে যাসনি?”

“না দাদুন, আজ খেলা হবে না। দাদুন একটা কথা বলব কাউকে বলবে না?”

“ কীএমন গোপন কথা রে কাউকে বলা যাবেনা?”

“আগে বল কাউকে বলবে না”।

“ ঠিক আছে, ঠিক আছে বলবনা।বল।

‘দাদুন, পাখি পুষব, কিনে দেবে?”

“পাখি পুষবি? সে কিরে?

“হ্যাঁ দাদুন, আমার বন্ধুর বাড়িতে দেখে এসেছি। বদ্রি পাখি, নানা রঙের হয়, দারুণ সুন্দর”।

মনোময়ের কানে তখন আর কোনো কথাই ঢুকছে না। উনি পেছিয়ে গেছেন প্রায় ষাট বছর, গোগোলের বয়সে। পাখি পোষার সখ হয়েছিল বালক মনোময়ের, টিয়া পাখি। বাবাকে বলেছিল, “বাবা, পাখি আর খাঁচা কিনে দেবে? পুষব”। বাবা ধমক দিয়ে উঠেছিলেন, “পাখি পুষবি? লেখাপড়া কর মন দিয়ে, পাখি পুষবে! যত্তো সব”। ছেলের ছলছল চোখের দিকে তাকিয়ে মায়ের মন গলেছিল। বলেছিল, “কাঁদিস না। আমি বাবাকে বুঝিয়ে বলব”। মা বোধহয় বাবাকে বোঝাতে পারেনি। দুঃখ ধীরে ধীরে সয়ে যায়, মনোময়েরও সয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সুপ্ত অবস্থায় কিছুটা হলেও থেকে গিয়েছিল মনের গভীরে।

আজ গোগোলের একটা কথা –‘দাদুন, পাখি পুষব কিনে দেবে?’ মনোময়ের সেই সুপ্ত বাসনাটা জাগিয়ে দিল। সেদিনের মতোই চোখ ছলছল করে করে উঠলো প্রৌঢ়ের। তবে আজ অন্য কারণে। গোগোলের পাখি পোষার ইচ্ছে মনোময়ের সুপ্ত ইচ্ছেকে যেন জীয়ন কাঠি ছুঁইয়ে জাগিয়ে দিয়েছে। উনি ইতিমধ্যেই ঠিক করে ফেলেছেন গোগোলের ইচ্ছাপূরন করবেন। আসলে উনি নিজেরই ইচ্ছাপূরণ করতে চলেছেন, তাই এই আনন্দাশ্রু। গোগোলের নরম শরীরটা জড়িয়ে ধরে, তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বুঝিয়ে দিলেন ‘দাদুন রাজি’।

এর পরের কয়েকটা দিন কেমন যেন ঘোরের মধ্যে কাটল গোগোলের, দাদুনেরও। এক ফাঁকে গোগোলের সঙ্গে ওর বন্ধুর বাড়ি গিয়ে পাখির খাঁচা, পাখি দেখে মনোময় মুগ্ধ হয়ে যান। ওনার ধারনা ছিল পাখি পোষা মানে একটা খাঁচা আর একটা টিয়া পাখি। এটারই তো বায়না ছিল বাবার কাছে। কিন্তু এযে মস্ত খাঁচা। কত পাখি, কত রঙ!

বাড়ি এসে গোগোল জিজ্ঞেস করল ভয়ে ভয়ে “দাদুন, হবে না?”

“ কেন হবে না? ঠিক হয়ে যাবে”।

“ দাদুন, তুমি এইটা একটু পড়ে নাও, এখানে বদ্রি পাখি সম্পর্কে সব দরকারি কথা লেখা আছে।”। মায়ের মোবাইল ফোনটা এনে গোগোল গুগল খুলে দাদুনকে দেখায়। গোগোলের এখন দশ বছর বয়স। মনোময় নিজের দশ বছরের কথা ভাবেন।

“ হ্যাঁরে তুই এত কী করে শিখলি?”

“ এতো খুব সহজ দাদুন। তোমাকে আমি শিখিয়ে দেব”।

“ আমার আর এই বয়সে এসব শিখে লাভ নেই, দে দেখি কী লিখছে ওখানে”।

‘যারা পাখি পোষেন তারা সাধারনত বদ্রি পাখি দিয়েই শুরু করেন’। বাঃ আমরা তাহলে ঠিকই শুরু করছি। ‘আকারে খুব ছোট, খুব সুন্দর দেখতে, নানান রঙের হয়’ –এতো দেখতেই পেলাম। ‘অস্ট্রেলিয়ার পাখি’ বাবা! সাহেব পাখি। ‘ভীতু ও লাজুক প্রকৃতির হয়’ খুব ভাল। হ্যাঁ হ্যাঁ এইগুলো খুব দরকারি কথা। খাঁচা বড় করে করতে হবে যাতে পাখিরা একটু ওড়াউড়ি করতে পারে।

ধ্রুবর বিয়ের পর বাড়িতে দোতলা করা হয়েছিল। আধখানা ছাদ জুড়ে দক্ষিণ মুখো দুটো ঘর সামনে ঢাকা বারান্দা। তার সামনে খোলা ছাদ। নানা রকম মরশুমি ফুলের টব দিয়ে সাজানো। পাশাপাশি লঙ্কা, টমেটো, একটা দুটো বেগুন গাছ, একটু ধনেপাতা এদের নিয়েই মনোময়ের সময় কাটে। এটাই এখন মনোময়ের সাম্রাজ্য।

‘পড়, তারপর কী লিখেছে’।

‘’এই দেখো, এই খানে লিখছে পাখি যেন কিছুক্ষনের জন্যে রোদ্দুর পায়”।

“খুব ভাল কথা। এই দেখ, বারান্দার এই পাশটায় খাঁচা থাকলে পূবের রোদ্দুর রোজ সকালে পাবে। আবার এখান থেকে আকাশটাও কিছুটা দেখতে পাবে। আকাশ না দেখতে পেলে পাখি কখনো ভাল থাকে? এর চেয়ে ভাল কিছু হয়না। যাকগে আরও অনেক কিছু জানতে হবে তবে সেসব পরে জানলেও চলবে। আগে খাঁচা, পাখি নিয়ে আসি।”

ধ্রুব অফিস যায়, মিতা, গোগোল স্কুল যায়। ফলে দিনের বেলা যে যার মত খেয়ে নেয়।  রাতে সবাই একসঙ্গে খেতে বসে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা হয়। রমলা বলল, “হ্যাঁরে গোগোল, দাদুর সঙ্গে একটু বেশি ভাব দেখছি কদিন। ব্যাপারটা কী? কিছু বায়না আছে নিশ্চয়ই”।

মনোময় আর গোগোল মুখ চাওয়াচায়ি করে। মনোময় ভাবেন এবার শর্তভঙ্গ করার সময় হয়েছে। গোগোলকে চোখ দিয়ে বলেন কোনো চিন্তা নেই। তার পর বলেন, “গোগোলের পাখি পোষার শখ হয়েছে”। সবাই অবাক, ‘সেকি!’, ‘সে যে অনেক ঝামেলা, কে দেখাশোনা করবে?’ ‘আমরা বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে পারবনা, গেলে ফিরে এসে দেখব সব মরে গেছে’। ‘লেখাপড়ার ক্ষতি হবে’, ‘এসব কে ওর মাথায় ঢোকাল?’ মনোময় ধ্রুব আর মিতার এক ঝাঁক প্রশ্নের মুখে পড়লেন। রমলা অবশ্য কোনো কথা বললেন না। সকলের কথা শুনছেন আর ভাবছেন বলটা কোনদিকে গড়ায়। মনোময়ের ছোটবেলায় পাখি পোষার শখ ছিল- সে গল্প রমলার জানা ছিল।

মনোময় তাঁর কথাগুলো বলতে একটু সময় নিলেন। ধীরে ধীরে, দুদিন ধরে, সব কথা গোগোলের সামনে নয়। বললেন, পাখি পোষায় ঝামেলা কিছু নেই। একটা সন্তানকে বড় করতে কত ঝামেলা। আমরা কি কখনো তাকে ঝামেলা বলে মনে করি? করিনা তো। কারণ সন্তানের প্রতি আমাদের ভালবাসা। আর শিশুকে ভালবাসতেও শেখাতে হয়। গোগোল যদি জন্মে থেকে দেখতো বাড়িতে পাখির খাঁচা আছে সেটার প্রতি ওর মায়া, ভালবাসা যা হোত আমার মনে হয় ওর ইচ্ছেয় যে পাখিগুলো আসবে তাদের প্রতি ওর অনেক বেশি মায়া, মমতা, ভালবাসা জন্মাবে। আর যার মনে ভালবাসা থাকে সে শুধু পাখিকেই ভালবাসবে তা নয়, সকলকেই ভালোবাসতে শিখবে।

“শোন গোগোল, মা বাবা রেগে যাচ্ছে, কিন্তু আমি তোর দলে। পাখি কিনে আনলেই কিন্তু হবে না, তার যত্ন করতে হবে, সময়ে খেতে দিতে হবে, প্রতিদিন জল বদলে দিতে হবে। অসুখ করলে ওষুধ দিতে হবে। পারবি তো?” মনোময় টেবিলের তলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে গোগোলের হাঁটুতে একটা চিমটি কাটে। গোগোল ওর নিস্পাপ, বড় বড় চোখ দুটো তুলে ঘাড় নাড়ে। মনোময়ের মায়া হয়। সত্যিই তো স্কুল, পড়া, বন্ধুদের সঙ্গে খেলার পর কীকরে ও পাখির সব কাজ করবে? মনোময় হেসে ফেলেন। আমি তো তোর অ্যাসিস্ট্যান্ট আছিই, আমি সাহায্য করব। কিন্তু দায়িত্ব তোমার, এটা মনে রাখতে হবে। সবাই হেসে ওঠে। মনোময় গোগোলের মাথার চুলগুলো ঘেঁটে দেন।

ছুতোর মিস্ত্রী এসে কাজ শুরু করে দিল। সেদিন স্কুল থেকে ফিরেই একছুটে দোতলায় গিয়ে দেখে খাঁচা নয়, একটা খাঁচা ঘর তৈরী। খাঁচার মধ্যে একটা শুকনো গাছের ডাল, তিনটে কলসি গায়ে ফুটো করে ঢোকা বেরোনোর রাস্তা করা। গাছের ডালে দোলনা। “দাদু, এত বড়?” “বাঃ ওড়বার একটু জায়গা দিতে হবে না? একটু উড়তে না পারলে কি পাখির শরীর ভালো থাকে?”

মহালয়ার দিন পাখি এসে গেল, ছটা। সেদিন ঘটা করে উদ্বোধন হল। বাড়ির সব কাজ কর্ম বন্ধ, কেউ ছাদ থেকে নামছেইনা। গবেষণা চলছে, কোন পাখিটা সবচেয়ে সুন্দর। পাখিগুলো উড়ছে, গাছের ডালে বসছে, দোলনায় দুলছে।

“ দাদুন ওরা খুব খুশি হয়েছে মনে হচ্ছে”।

“হবেনা? আমরা যখন ছোট বাড়িতে থাকতে থাকতে বড় বাড়ি কিনি আমরা খুশি হই না? ওদেরও তো পাখিওয়ালার খাঁচা থেকে এখানে এসে মনে হচ্ছে রাজপ্রাসাদে এসেছে”।                       রমলা বলল, “শোন, আজ মহালয়ার দিন এরা এসেছে। কে কবে জন্মেছে জানিনা, আমরা এদের জন্মদিন প্রতি বছর মহালয়ার দিন পালন করব”।

ধ্রুব বলল “খুব ভাল, মা। কিন্তু জন্মদিন তো একবছর দেরী। আজ জন্মের দিনটাও তো আমাদের পালন করতে হবে। আমরা বরং সন্ধ্যে বেলা ছাদে ডিনার করব। আমি ছাদে আলোর ব্যবস্থা করে টেবিল চেয়ার সাজিয়ে ফেলছি। তুমি আর মিতা ভাল রান্না বান্না করে ফেল”।

“দাদুন, আমরা তো ভাল ভাল খাব, আর এরা?”

“ দেখ, দেখ। গোগোলের ঠিক খেয়াল আছে পাখিদের কথা। গোগোল, পাখিরা তো রাত্তিরে খায় না। আর আজকের খাবার তো দেওয়া হয়েই গেছে।“

“ তবু কিছু একটা দেব আমরা যখন খাব। খেতেও তো পারে”।

“ ঠিক আছে। ফল তো সব আনা আছে, কিছু একটা দিস”।

“ দাদুন, তুমি স্ট্রবেরি এনেছ, দেবো?

“ হ্যাঁ হ্যাঁ, সাহেব পাখি তো, আজ বিশেষ দিনে স্ট্রবেরি দেওয়াই ভাল”।

একদিন মনোময় ধ্রুবকে বলছিলেন, “দেখ পাখি পোষা মানে শুধু একটা শখ বা একটা খেয়াল নয়। এটা একটা শিশুকে গড়ে দিতে পারে। সে পশুপাখি, প্রকৃতি সম্পর্কে আগ্রহী হয়, তার দায়িত্ব জ্ঞান জন্মায়, সে ভালবাসতে শেখে”।

“বাবা, তুমি আমাকে এসব বলছ কেন? আমি প্রথমে একদিন লেখাপড়ার ক্ষতি হবে- এসব বলেছিলাম। কিন্তু তুমি কিছু চাও সে বিষয়ে আমি কখনও প্রশ্ন করি কি?”

“ না না আমি সেকথা বলতে চাইনি। লক্ষ্য করেছিস কি গোগোলের স্বভাব কেমন বদলে গেছে? বেলা অবধি ঘুমোন অভ্যাস ছিল। ডেকে ডেকে তুলতে হোত। এখন কেমন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে যায়। আমি ওকে বলেছিলাম, পাখিরা তোমার বন্ধু। ওরা ভোরবেলা উঠে বন্ধুকে দেখলে খুশি হয়। রোজ সকাল সকাল উঠে ওদের সঙ্গে দুটো কথা বলে যাবে। এইটুকুতেই কাজ হয়ে গেছে। আর সত্যিই সকাল বেলা গোগোলকে দেখেই ওদের ডানা ঝাপ্টানো, কিচিরমিচির বেড়ে যায়।“

“হ্যাঁ বাবা, আমি লক্ষ্য করেছি”।

“ আমি সব কাজ করে দিই, কিন্তু আমি ওকে বলি এসব তোমার কাজ, আমি তোমার হয়ে করে দিচ্ছি। আমি বুড়ো হয়েছি। কবে ওষুধ দেবার দিন, কবে চান করানোর দিন আমার আর আজকাল এসব মনে থাকে না। আমাকে জিজ্ঞেস করবে আমি সব কাজ করেছি কিনা। আমি মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ভুলে যাই। ও এসে মনে করিয়ে দিলে তাড়াতাড়ি গিয়ে করি, ও খুব খুশি হয়। তবে স্নান আমাকে করাতে দেয়না। পাইপ দিয়ে বৃষ্টির জলের মত ওদের স্নান করাতে গোগোল খুব ভালোবাসে”।

##

আজও প্রতিদিনের মতো পাখির ডাকেই ঘুম ভেঙেছিল। পুব আকাশ তখন রাঙা হয়ে আসছে। এই সময়টা মনোময় আর রমলার একান্ত নিজস্ব। ছাদে পাশাপাশি দুটো চেয়ারে বসেন। একসঙ্গে দুজনে চা খান। নানা কথা, পুরোন কথা বলতে কিছুটা সময় কাটে। রমলা নীচে নেমে যান, স্নান পুজোপাঠ ও দৈন্যন্দিন কাজে। তখন পূবের রোদ্দুরে পাখিরা স্নান করছে। সারা রাতের সঞ্চিত এনার্জি নিয়ে খাঁচার মধ্যে ডানা ঝটপট করছে, শুকনো গাছের এ ডাল ও ডালে বসছে। দোলনায় জোড়ায় জোড়ায় বসে দোল খাচ্ছে। মনোময় সূর্য প্রণাম, সূর্যের স্তব করে খাঁচার সামনে গিয়ে দাঁড়ান। পাখিরা তখন দল বেঁধে কিচির মিচির করে তাদের প্রিয় মানুষটাকে সুপ্রভাত বলে। মনোময় ওদের সঙ্গে কিছুক্ষণ বক বক করেন। এমন সময়ে গোগোল এসে গেল। পাখিরা গোগোলকে দেখে দ্বিগুন উৎসাহে ডানা ঝাপ্টাল। গোগোল ওদের বন্ধু।

“দাদুন ঐ দেখ, ঐ দেখ হাঁড়ির মধ্যে তাকাও, দুটো বাচ্চা ফুটেছে।“

“তাই নাকি, দেখি তো” বলে চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে এগিয়ে আসেন। মাথাটা একটু টাল খেয়ে গেল কি! অনেক চেষ্টা করে হাঁড়ির মধ্যের অন্ধকারে ঠাহর করতে চেষ্টা করেন, আবছা দেখতে পেলেন নতুন প্রাণের নড়াচড়া। আজ রবিবার, মনোময়ের ছুটি। আজ গোগোল পাখির সব কাজ করবে। খাঁচা পরিস্কার, পাখিদের খাবার দেওয়া, জলের জায়গা গুলো ভরে দেওয়া, স্নান করানো। অন্যদিন মনোময় এসব নিজেই করেন। ছুটির দিনেও উনি করতে পারেন, কিন্তু গোগোলকে একটু দায়িত্বশীল করার জন্যে এই ব্যবস্থা।

মনোময় এই সময়টায় নরম রোদে গাছপালাগুলোর পরিচর্যা করে নেন। গাছগুলোর গোড়া খুঁড়ে, আগাছা তুলে পরিস্কার করলেন। তারপর লঙ্কাগাছ গুলোর পাতা কুঁকড়ে গেছে দেখে ওষুধ স্প্রেয়ার এনে উবু হয়ে বসে গাছগুলোতে ওষুধ দিচ্ছিলেন। হঠাৎ আবার মাথাটা টলে উঠল, এবার একটু বেশি। শরীরটা একটু অন্যরকম খারাপ লাগলো। উঠতে গিয়ে পড়ে গেলেন। শব্দ পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে গোগোল দেখে দাদুন পড়ে আছে মাটিতে।

মনোময় এখন বিছানায়, তাকে ঘীরে রমলা, ধ্রুব, মিতা, গোগোল। পাড়ার একজন ডাক্তার দেখে গেছেন। অ্যাম্বুলেন্স আসছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাসপাতালে যেতে হবে।

পাখিগুলো সব খাঁচা থেকে বেরিয়ে এসেছে। তারা সব কিচির মিচির করে কত কথা বলতে বলতে মনোময়কে নিয়ে ভেসে চলেছে আকাশে। যেন রামধনু ভেসে যাচ্ছে আকাশের বুক চিড়ে। মেঘের মাঝখান দিয়ে ভেসে গিয়ে ওরা ঘন নীল আকাশে পৌঁছে যায়। মনোময় ভাবেন এত নীল আকাশ তো আগে দেখেননি। উড়তে উড়তে এক সময় বাতাস পাতলা হয়ে আসে, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। মনোময় বলেন “ বিদায় বন্ধুরা। যাও তোমরা এবার ফিরে যাও। আমার এখনকার পথ আমার একার, এখানে কেউ কারো সঙ্গী হতে পারে না। যাও ফিরে যাও, গোগোল তোমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে”।

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ