১
ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ থেকেই সন্ধ্যের মুখে মুখে জালালাবাদের ওপর দিয়ে বয়ে আসা পানশিরের ঠাণ্ডা হাওয়ার ভূমিকাটা নিয়ে নেয় মরু অঞ্চলের শুকনো ধুলোর ঝড় ।
কিছু সময়ের জন্য শহরময় বইতে থাকে হালকা গরম হাওয়া ।
তখন পেশাওয়রের সব বাড়ির জানলা দরজা বন্ধ হয়ে যায়, দোকানগুলো সামনের ঝাঁপটা ফেলে রাখে আর ছাতের ওপরে ক্ষারে কেচে শুকোতে দেওয়া পাজামা কুর্তা শেরওয়ানিগুলো তড়িঘড়ি নামাতে থাকে পাখতুন সুন্দরীরা ।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা সাইকেল, টাঙ্গা আর ঠেলাগাড়ির ওপরে ধুলোর পাতলা আস্তরণ পড়ে যায় কিছুক্ষণের মধ্যেই ।
ঘণ্টাভর এলোমেলো জোর হাওয়া চলার পর চারদিক আবার শান্ত হয়ে আসে ।
রাস্তায় বিছিয়ে যাওয়া শুকনো পাতা মাড়িয়ে চলতে শুরু করে দেয় যানবাহন আর পথচলা মানুষ ।
বাজারে দোকানপাটের ঝাঁপ খোলে, বাড়তি ব্যস্ততা নিয়ে লোকজন কেনাকাটা শুরু করে দেয় ।
#
আবদুল রশিদের দা-আ-স্তানগোইয়ের সান্ধ্য আসর এই বিকেলগুলোতে কিছুটা দেরী করে শুরু হয় ।
দিনের আলো কমে যাওয়ার আগেই কাঁধের থলের মধ্যে হ্যাজাক বাতি আর পশমের বসবার পাতলা শতরঞ্চিটা ভরে হাতে মোটা জাবদা খাতাটা নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে পেশাওয়র শহরের মশহুর দা-আ-স্তানগো আবদুর রশিদ খান।
প্রৌঢ় দেহটাকে নিয়ে টুক টুক করে পুরনো কাবুলি দরওয়াজার মধ্যে দিয়ে নমকমণ্ডির পথে চলতে থাকে কিসসা কহানি বাজারের প্রশস্ত চত্বরের দিকে ।
লম্বা রাস্তা চলার পথে অনেক চেনা মুখ আদাব জানায় ।
এর মধ্যে যদি ধুলোর ঝড় উঠে যায় রাস্তার পাশের কোন দোকানের ঝাঁপের পেছনে দুদণ্ড দাঁড়িয়ে যায় দা-আ-স্তানগো রশিদ খান।
চিনতে পারলে দোকানের মালিক সসম্ভ্রমে পানির বদনা এগিয়ে দেয়, আখরোট বাদাম খিদমতে পেশ করে ।
ঝড় থেমে গেলে প্রৌঢ় পাঠান কামিজের জেব থেকে কাপড়ের টুকরো বার করে পরিষ্কার করে প্রাচীন চশমার কাঁচ ।
তারপর আবার চলতে থাকে কিসসা কহানি বাজারের পথে…গল্প বলার সওদাগর দা-আ-স্তানগো আবদুর রশিদ খান ।
#
কয়েক পুরুষের খানদানি দা-আ-স্তানগো আবদুর রশিদ খান ।
খোলা বাজারে, একঝাঁক মুগ্ধ মনোযোগী শ্রোতার সামনে, কণ্ঠস্বরের জাদু গলায় মেখে নিয়ে গল্পের পর গল্প বলে যাওয়ার শিল্পকলা দা-আ-স্তানগোই ।
রশিদ খানের খানদানের কোন পুরুষ থেকে এই সুকুমার কলার শুরু তা জানে না সে ।
দাদাজির কাছে কেবল শুনেছে পেশাওয়রে শিখ রাজত্বের সময়ে দরবারের খাস দা-আ-স্তানগো ছিল তাদের কোন পূর্বপুরুষ ।
মুলকের মালিকের অবসর সময় সুভাষিত গল্পের জাল বুনে ভরিয়ে দেওয়ার কাজ ছিল তার ।
শিখ সেনাধিপতি সরদার হরি সিং নালওয়া ছিলেন নিজে দা-আ-স্তানগোইয়ের একজন ঋদ্ধ সমঝদার ।
তাঁর প্রচেষ্টায় উর্দু ফারসি ভাষার কাহিনীসংপৃক্ত দা-আ-স্তানগোইয়ের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল কিছু হিন্দু পৌরাণিক গল্প, বেতালপঞ্চবিংশতি, পঞ্চতন্ত্র আর বৌদ্ধ জাতকের কাহিনী ।
উর্দু ভাষায় সেই কথকতার অসাধারণ শিল্পী পেশাওয়রের মশহুর দা-আ-স্তানগো এই আবদুর রশিদ খান ।
দাদাজি দা-আ-স্তানগো আমির খানের হাতের লম্বা বলিষ্ঠ আঙ্গুল ধরে ছোট্ট রশিদ এই কিসসা কহানি বাজারের দা-আ-স্তানগোইয়ের দরবারে পা রেখেছিলো, সে বোধহয় পঞ্চাশ বছরেরও বেশী হয়ে গেছে ।
সেইসব দিনগুলোর খুঁটিনাটি আজ মনেও নেই তার ।
কেবল মনে আছে দাদাজি-র ভরাট গমগমে গলার স্বরের জাদুতে চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে দেখা দেওয়া গল্পের চরিত্রগুলো, সেই কণ্ঠস্বরের ওঠাপড়ার দক্ষতায় তৈরি হওয়া মুহূর্তগুলোর আবেশ ।
আর দাদাজি-র সামনে আসরে বসে থাকা অনেক অনেক দা-আ-স্তানগোই শ্রোতার চোখের মুগ্ধতা ।
সেই পঞ্চাশ বছর আগে কিসসা কহানি বাজারের রমরমাই ছিল অন্য রকম ।
শিখ শাসনের শেষ হয়ে তখন ইংরেজ শাসকের হাত ক্রমশ শক্ত হয়ে চেপে বসছে পেশাওয়র শহরের ওপর ।
দেওয়াল-ঘেরা প্রাচীন শহরের চারদিকের মাটির পুরনো দেওয়াল বদলে যাচ্ছে পোড়া ইটের শক্তপোক্ত গাঁথুনিতে ।
শহরের সুরকিঢালা প্রধান রাস্তাগুলোতে বসছে পাথরের ইট ।
ওদিকে লড়াকু মানসিকতার পাখতুনি যুবকদের সতর্ক ভাবে ঝাড়াই বাছাই করে তালিম দিয়ে ইংরেজ তৈরি করছে তাদের নতুন ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সেনাদল ।
এক দশকেরও আগে ঘটে যাওয়া দেশীয় সিপাহিদের নিষ্ফল বিদ্রোহের কাঁটা তখনও ব্রিটিশ সরকারের মনের ভেতরে গেঁথে রয়েছে অমলিন।
#
এর মধ্যেই কিসসা কহানি বাজারের শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্য জেগে আছে পেশাওয়র শহরের সন্ধেবেলার সহজ বিনোদন হয়ে।
কহানি বাজারের গল্প বলার সওদাগরিতে সেসময় রশিদের দাদাজী আমির খান একমাত্র দা-আ-স্তানগো ছিল না ।
তবে সে ছিল অবশ্যই সব থেকে জনপ্রিয় আর খ্যাতিমান, তুলনাহীন ছিল তার গল্প বলার কথনভঙ্গী ।
বিশাল কিসসা কহানি বাজারের পরিসরে সন্ধেবেলায় সেকালে অন্তত পাঁচ ছয়জন দা-আ-স্তানগো নিজেদের গল্প বলার পসরা সাজিয়ে দূরে দূরে বসে যেতো নিজস্ব টুকরো টুকরো শ্রোতার দল নিয়ে ।
তার মধ্যে আমির খানের আসরের চারপাশে ভিড় করে বসে থাকতো বেশীর ভাগ মুগ্ধ শ্রোতা।
ওস্তাদ দা-আ-স্তানগোর কণ্ঠস্বরের নাটকীয়তা, সংলাপ পরিবেশনের দক্ষতা তাদের বসিয়ে রেখে দিতো নিজের নিজের জায়গায় ।
কাহিনীর চরম পরিণতি শোনার আগে তারা উঠে চলে যেতে পারতো না ।
আর আমির খানের সামনে পেতে রাখা রঙিন সিল্কের কাপড়ের টুকরোটার রঙ ঢাকা পড়ে যেতো শরতাজপরা মহারানীর মূর্তি খোদাই করা বড়ো বড়ো অজস্র তামার মুদ্রায়।
কিছু সম্পন্ন মুগ্ধ শ্রোতা সেই রেশমি রুমালের ওপরে সন্তর্পণে নামিয়ে রেখে যেতো একটা বা দুটো রৌপ্যমুদ্রা ।
আসর ভেঙ্গে যাওয়ার পর ছোট্ট রশিদের কাজ ছিল সন্ধ্যের সেই উপার্জন এক জায়গায় জড়ো করে একটা রেশমি থলিতে গুছিয়ে তোলা ।
তার আরও মনে আছে ফিরতি পথে দাদাজীর সঙ্গে ঝুলোঝুলি করে নমকমণ্ডির রাস্তায় একটা ঘুপচি দোকানের সামনে টাঙ্গা থামানো।
তারপর সেই দোকানে বড়ো মাটির জালাতে বরফে জমানো মালাইদার কুলফি খাওয়ার কথা ।
#
দাদাজী-র ইন্তেকাল হল পরিণত বয়সে ।
তখন রশিদ খানের কৈশোর ।
মশহুর দা-আ-স্তানগো আমির খানের জানাজাতে সেদিন শয়ে শয়ে তিন প্রজন্মের মুগ্ধ শ্রোতার দল পায়ে হেঁটেছিল কবরিস্তান পর্যন্ত ।
কিশোর রশিদ সেদিনই ঠিক করে নিয়েছিল সে-ও বড়ো হয়ে দা-আ-স্তানগো হবে দাদাজি-র মতো, আব্বুজানের মতো ।
দাদাজি আমির খান চলে যাবার চল্লিশ দিনের ‘অরবিন’-এর পর রশিদের আব্বুজান মোহাম্মদ আলিও প্রতি সন্ধ্যেবেলায় কিসসা কহানি বাজারে আসর বসাতে শুরু করে দিলো ।
তার নিজের আব্বুজান আমির খানের মৃত্যুশয্যায় কসম খেয়েছিল সে,
‘দা-আ-স্তানগোইয়ের পারিবারিক ঐতিহ্য যেমন করে হোক সে বজায় রাখবে। আর আব্বুজানের লখত-ই-জিগর রশিদ বুলবুলকেও সে তালিম দেবে, তাকে ওস্তাদ দা-আ-স্তানগো তৈরি করবে।’
মৃত্যুপথযাত্রী দাদাজীর পায়ের কাছে বসে জলভরা চোখে কিশোর রশিদ শুনেছিলো সেই কসম-এর বার্তালাপ।
তাই সারা সকাল ভেড়ার পালের দেখভাল আর দুপুরে মাদ্রাসার পড়াশোনা সেরে আব্বুজানের সাথে নিয়ম করে বিকালে সে বেরিয়ে পড়তে শুরু করলো কিসসা কহানি বাজারের পথে ।
এখন সে আর ছোট্ট রশিদ বুলবুল নয়, মাদ্রাসাতে তার পুরো নাম দরজ করা আছে আবদুর রশিদ খান ।
দা-আ-স্তানগোইয়ের আসরের গল্পের পটভূমিকার বর্ণনা, পাত্র পাত্রী, কাহিনীর চলন, বাঁক আর পরিণতি, এখন সব কিছুই কতকটা বুঝতে পারে সে ।
গভীর মনোযোগ দিয়ে তাই রশিদ শুনে যায় তার আব্বুজানের দা-আ-স্তানগোই ।
লক্ষ্য করে দা-আ-স্তানগোর কণ্ঠস্বরের ওঠাপড়া, কিভাবে তৈরি করা যায় নাটকীয়তার আমেজ, যা সামনের শ্রোতাকে উৎকর্ণ করে রাখে, তার মনঃসংযোগ ব্যাহত হতে দেয় না ।
সেটা ছিল রশিদ খানের কিশোর বয়স ।
বয়ঃসন্ধিতে তার গলার আওয়াজ তখন ভেঙে বদলে যাচ্ছে ।
তবু সেই ভাঙ্গা স্বর নিয়ে তাদের বাড়ির ছাদের ওপরে গিয়ে দা-আ-স্তানগোইয়ের মহড়া দেয় সে ।
আরব্যরজনীর গল্পের সিন্দবাদ নাবিক আর আলিবাবার রোমহর্ষক কাহিনী, মোল্লা নাসিরুদ্দীন আর রুমীর কিসসা, এমন কি পেশওয়রে শিখ রাজত্বের কালে দাদাজী আমির খানের জাবদা খাতায় ঢুকে যাওয়া বৌদ্ধ জাতক, পঞ্চতন্ত্র আর বেতাল পঞ্চবিংশতির কাহিনী ।
দা-আ-স্তানগো পরিবারের পারিবারিক সম্পত্তি, সেই পেটমোটা খাতায় পাতার পর পাতায় ধরে রাখা আছে এইসব অজস্র কাহিনীর রূপরেখা ।
ওস্তাদ দা-আ-স্তানগোর কিসসা বলার সময় খাতার দিকে চোখ রাখার দরকার পড়ে না ।
অবশ্য অজস্র কাহিনীর স্তুপ থেকে একটা গল্প বাছবার সময় ওই খাতাটা কাজে দেয় ।
সেই দিনগুলোতে কিশোর রশিদের কোন কিসসা-ই তখনো পুরোপুরি স্মৃতিতে গেঁথে যায়নি ।
বিশেষ করে কহানির সমস্ত আকর্ষণীয় সংলাপ সে যথাযথ নাটকীয়তার সঙ্গে পেশ করতে চায়, যেমনটি দেখেছে সে দাদাজিকে করতে ।
তাই খাতা সামনে রেখে, ছাতের নির্জনে প্রাণপণে সে মুখস্থ করে চলে একের পর এক কিসসা, আরব্যরজনী, নাসিরুদ্দীন, রুমী, পঞ্চতন্ত্র, জাতক, আর বেতালপঞ্চবিংশতি !
গল্পের চলন আর ঘটনার অভিঘাতের সঙ্গে মানানসই করে তোলে তার বাচনভঙ্গি, কণ্ঠস্বরের ওঠাপড়া ।
দাদাজীর কসম, তাকে যে ওস্তাদ দা-আ-স্তানগো হতেই হবে ।
২
এসব পঞ্চাশ বছর আগেকার কথা ।
আব্বুজানের কাছে রশিদ শুনেছিলো যে বছর ইংরেজ সরকার জমরুদ কিলা থেকে তাদের সৈন্যছাউনি সরিয়ে এনে শহরের প্রান্তে বিরাট ক্যান্টনমেন্ট তৈরি করলো সে বছরই নাকি জন্ম হয় রশিদের।
সেটা ছিল ইংরেজি ১৮৬৮ সাল ।
সেই হিসেবটা ঠিক ধরলে আবদুর রশিদ খানের বয়স এখন বোধহয় বাষট্টির দোরগোড়ায় ।
আম্মিকে দেখেনি রশিদ খান ।
তার কাছে আম্মি আর আব্বু বলতে ছিল একটাই মানুষ, আব্বুজান, পেশাওয়রের খানদানি দা-আ-স্তানগো মোহাম্মদ আলি খান ।
পরপর দুটি মৃত কন্যা সন্তানের জন্ম দেবার পর মোহাম্মদ আলির চিররুগ্না বিবি হামিদা বেগম তৃতীয় সন্তান রশিদের জন্মের পরে বেঁচে ছিল মাসখানেক ।
মিঙ্গোরা শহর থেকে দাদাজি আমির খানের এক দূর সম্পর্কের বহেন এসে সামলে দিয়ে যায় নবজাতকের জীবনের প্রথম দুটো বছর ।
আমির খান খানদানের বংশপ্রদীপের নাম রেখে দিলো আবদুর রশিদ, আল্লা হাকিমের দাস ।
আব্বু আমির খানের পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও রশিদের আব্বু মোহাম্মদ আলি আবার নিকা করেনি ।
তখন বুক দিয়ে আগলে পোতা ছোট্ট রশিদ বুলবুলকে বড়ো করে তোলার ভার নিয়ে নিলো তার দাদাজি, শহরের উস্তাদ দা-আ-স্তানগো আমির খান ।
মহিলাবিহীন খান পরিবারে তখন তিনজন ভিন্ন বয়সের পুরুষ সদস্য, দুজন হামেহাল কাজের লোক আর পঞ্চাশটা ভেড়া ।
#
মোহাম্মদ আলি কিন্তু তার আব্বুজানের মৃত্যুশয্যায় খাওয়া কসমের পুরোটা রক্ষা করতে পারেনি ।
মার্চ মাসের সেদিনটা রশিদ খান কখনই ভুলতে পারে না ।
এক বছর হয়ে গেলো তার শাদি হয়েছে ।
মিঙ্গোরা শহর থেকে এসেছে রশিদের বিবি।
মোহাম্মদ আলির সেই অশীতিপর খালার সম্বন্ধ করা তার পড়শির
সুন্দরী মেয়ে নুসরত ।
দুদশকেরও বেশী আঁধার হয়ে থাকা দা-আ-স্তানগো পরিবারের ঘর আলো করা নুসরত ।
সারাদিন সে ঝলমল করে ঘুরে বেড়ায় বাড়ির এদিক ওদিক।
নুসরতের পায়ের কঙ্কণের শিঞ্জিনী আর রশিদের মনে পেশাওয়রের বসন্তকালের আবেশ খান পরিবারের ঘরদুয়ারের বাতাসে ভেসে বেড়ায় সর্বক্ষণ ।
সেদিন সকালে নাস্তা তখন সবে শুরু করেছে রশিদ ।
সূর্য ওঠার আগে তার আব্বু তাদের মেষপালক বুড়ো রহমতের সঙ্গে খোঁয়াড় থেকে বার করে নিয়ে গেছে ভেড়ার পাল ।
সকালে ঘণ্টা দুয়েক ঘরের পেছনের টিলার ওপারের বিশাল মাঠে তাদের চরতে যাওয়া রোজকার নিয়ম ।
তারপর আব্বু ফিরলে বাপছেলের দুজনের একসাথে চলে নাস্তা পর্ব ।
কিন্তু আজ তাদের দেরী হচ্ছে ফিরতে ।
আব্বুর জন্য অপেক্ষা করতে করতে নুসরতের রেখে যাওয়া গরম পরোটার থেকে ভেঙে সবে এক টুকরো মুখে তুলেছে রশিদ, এমন সময় হুড়মুড় করে রহমত উঠোনে ঢুকে দৌড়ে একেবারে রশিদের সামনে এসে হাঁফাতে থাকলো ।
বুড়ো মানুষ, হাঁফ ধরে বেদম হয়ে গেছে, বোঝাই যাচ্ছে পথে দৌড়তে দৌড়তে এসেছে ।
রশিদ তার ব্যাপার-স্যাপার দেখে অত্যন্ত অবাক হয়ে রহমতকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে গেলো ।
তার আগেই সে হাউমাউ করে যা বললো তাতে বোঝা গেলো বড়ো মালিকের খুব বিপদ হয়েছে ।
টিলার ওপর থেকে দুটো ভেড়াকে তাড়িয়ে নীচে নামাতে গিয়ে পা ফসকে বড়ো মালিক একবারে টিলার নীচে গড়িয়ে পড়ে গেছে ।
বোধহয় গড়িয়ে পড়ার সময় কোন বড়ো পাথরে মাথায় চোট লেগে অনেক খুন বেরিয়েছে ।
মুখে চোখে পানি ছিটিয়েও বড়ো মালিক আঁখ খুলছে না ।
অনেক লোক ওখানে জড়ো হয়ে গেছে ।
ছোট মালিককে ডাকতে ও ছুটে ছুটে এসেছে।
রহমতের কথা শুনতে শুনতেই নাস্তা ফেলে রশিদ ঝটিতি উঠে দাঁড়িয়ে প্রায় চিৎকার করে নুসরতকে ডাকলো।
রশিদের সেই চিৎকার শুনে বাড়ির ভেতর থেকে নুসরত দৌড়ে এলো ।
তাকে তাড়াতাড়ি সংক্ষেপে দুর্ঘটনার কথা বলে রশিদ উঠোন থেকে রহমতকে নিয়ে বেরোতে যাবে, এমন সময় বাইরে থেকে হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে এলো প্রায় আট দশ জন প্রতিবেশী ।
তাদের পেছন পেছন চারজনে বয়ে নিয়ে এলো একটা মাচার ওপরে শোয়া মোহাম্মদ আলির অজ্ঞান দেহটা ।
তার চোখ বন্ধ, নিঃশ্বাস পড়ছে অতি ধীরে ধীরে ।
#
মোহাম্মদ আলির সেই বন্ধ চোখ আর খোলেনি ।
তিন দিন তিন রাত অজ্ঞান হয়ে থাকলো রশিদের আব্বুজান মোহাম্মদ আলি ।
তার নিঃসাড় দেহের চারপাশে ঘিরে, আল্লার দোয়া ভিক্ষা করতে থাকলো রশিদ, নুসরত আর প্রতিবেশীরা ।
ইউনানী হকিম সকালে বিকালে দাওয়াই বদলে দিয়ে চেষ্টা করতে লাগলো তার জ্ঞান ফিরিয়ে আনার ।
গম্ভীর শঙ্কিত মুখ নিয়ে আসা-যাওয়া করলো প্রিয় দা-আ-স্তানগোর বহু গুণমুগ্ধ শ্রোতার দল ।
কিসসা কহানি বাজারের সতীর্থ দা-আ-স্তানগো কয়েকজন এসে ভরসা দিয়ে গেলো তরুণ রশিদকে ।
কিন্তু সকল প্রিয়জনের আশা ভরসা আর দুয়াকে ব্যর্থ করে, আব্বুজান আমির খানকে দেওয়া কসম ভুলে, পেয়ারের একলৌতা বেটা আবদুর রশিদকে কিসসা কহানি বাজারের ওস্তাদ দা-আ-স্তানগোর আসনে স্থিত করার আগেই মোহাম্মদ আলি অকালে বেহেস্তের পথে যাত্রা করলো।
আব্বুকে দাফন করে এসে রশিদ খান ঘরে ফিরে এসে জানলো নুসরত সন্তানসম্ভবা ।
#
নুসরত গর্ভবতী হয়েছে জানবার পরই রশিদের দৃঢ় বিশ্বাস হয়ে গেলো তার আব্বুজান তাদের সন্তান হয়ে নুসরতের গর্ভে ফিরে এসেছে ।
কিন্তু তার এই বিশ্বাসের কথা নুসরতকে জানতে দিলো না রশিদ।
কেবল বিবির বাড়তি খেয়াল রাখার জন্য শ্বশুরবাড়িতে তদ্বির করে নুসরতের
মা-র সিফারিশে এক শক্তসমর্থ আফগানি কাজের মেয়ে বাড়িতে আনিয়ে নিলো ।
আর চল্লিশ দিনের ‘অরবিন’-এর কাল কেটে যেতেই রশিদ খান রোজ সন্ধ্যায় তার ঠিকানা বেঁধে নিলো কিসসা কহানি বাজারে…দা-আ-স্তানগোইয়ের আসর বসালো বাইশ বছরের আবদুর রশিদ খান, পেশাওয়রের কনিষ্ঠতম
দা-আ-স্তানগো ।
#
আবদুর রশিদ খানের দা-আ-স্তানগোইয়ের খ্যাতি পেশাওয়রের কোণে কোণে ছড়িয়ে পড়াটা ছিল কেবল সময়ের অপেক্ষা ।
লোকচক্ষুর আড়ালে তার বছরের পর বছরের গভীর অনুশীলনের ফল ফলতে দেরী হয়নি ।
সন্ধ্যাবেলায় কহানি বাজারের প্রশস্ত চত্বরে ঘুরে বেড়ায় কতো উদ্দেশ্যবিহীন সাধারণ মানুষ ।
তাদের মধ্যে অনেকেই রশিদের আসরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে তার উদাত্ত কণ্ঠস্বরে আর গল্প বলার বাচনভঙ্গিতে আকৃষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে যায় ।
আসরে বসে পড়ার আগে পাশের মানুষটাকে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করে তরুণ কথকের পরিচয় ।
সেই মানুষটা চকচকে চোখে নীচুস্বরে বলে,
‘একে চেনো না, এ তো মরহুম দা-আ-স্তানগো উস্তাদ আমির খানের পোতা ! ওর আব্বু মোহাম্মদ আলিরও তো এই জায়গাটায়ই আসর বসতো । খুদাতালার মর্জিতে অকালে বেচারির ইন্তেকাল হলো । এর দাদাজী আমির খানকে আমি তো বহোত বহোত শুনেছি । সে ছিল উস্তাদো কা উস্তাদ দা-আ-স্তানগো । আহা, তার এই পোতা তো ইনশাল্লা দাদাজীর মান জরুর রাখবে ।’
আর কথা না বাড়িয়ে দুজনেই চত্বরের মেঝে ঝেড়েঝুড়ে আসরে বসে পড়ে…নাবিক সিন্দবাদ যে তখন বিশাল পাখির পিঠের ওপর চেপে বসে মেঘের ওপর দিয়ে উড়তে শুরু করেছে !
#
রফিকের জন্মের বেশ কয়েক বছর পর থেকে রশিদ খানের মনে আব্বুজানের পুনর্জন্মের বিশ্বাসটা ধাক্কা খেতে শুরু করলো ।
ইতিমধ্যে দা-আ-স্তানগো পরিবারে আরও একজনের আগমন হয়েছে ।
কনিষ্ঠতম সদস্য, রশিদের ছোট ছেলে ইফতিকার, স্বভাবে জেদি, দামাল, অল্প বয়স থেকেই আপাদমস্তক পাক্কা পাখতুনি পাঠান!
তার বড়ো ভাই কিশোর রফিক শান্ত, ধীর স্থির।
তার গলার স্বর মৃদু।
বাচনভঙ্গিতে নাটকীয়তা একেবারেই অনুপস্থিত ।
অনাকর্ষক সেই কণ্ঠস্বরে দা-আ-স্তানগোইয়ের শৈলী হাসিল করা যে তার পক্ষে যে খুবই কঠিন এই ভেবে রশিদ খান সর্বক্ষণ মুষড়ে থাকে ।
উপরন্তু খানদানি শিল্প দা-আ-স্তানগোইয়ের প্রতি রফিকের বিস্তর অনাগ্রহ ।
আব্বুর প্রতি রফিকের পেয়ারের কোন কমতি নেই ।
কিন্তু সন্ধেবেলায় আব্বুর সাথে কিসসা কহানি বাজারের দিকে টহল দেওয়ায় তার ঘোরতর অনিচ্ছা ।
সেসময়টায় কিশোর রফিকের মন পড়ে থাকে তার পাঠ্য বইয়ের পাতায়। অটোম্যান রাজত্বের ঘটনাসংকুল ইতিহাস আর মধ্যপ্রাচ্যের আধুনিক শহরগুলোয় জেগে ওঠা নবীন সংস্কৃতির আবহে সে অনেক স্বচ্ছন্দ বোধ করে ।
পড়াশুনায় তার মেধা ও আগ্রহ প্রচুর ।
আব্বুর কাছে অবিরাম দরবার করে সে ভর্তি হয়ে গেছে পেশাওয়রের নতুন মিডল ইংলিশ স্কুলে ।
তার স্কুলব্যাগে এখন নানারকম ইংরাজি আর উর্দু ভাষায় ছাপা বইয়ের ভিড় ।
মাদ্রাসায় কোরাণ আর গোলেবকাওলির গল্প পড়া আবদুর রশিদ খান তার বড়ো ছেলের পড়াশোনার কোন হদিশ করতে পারে না ।
৩
নমকমণ্ডির অপ্রশস্ত রাস্তায় আজকাল যখন তখন বিকট ভোঁক ভোঁক আওয়াজ করে মোটরগাড়ি এসে পড়ে ।
পথচলতি পেশাওয়রি পুরনো মানুষজনের কাছে মোটরগাড়ি এক অভিজ্ঞতা, কারুর কারুর কাছে উপদ্রবও বটে ।
বিশেষ করে ঘোড়া আর উট দিয়ে টানা গাড়িগুলোর গাড়োয়ানদের কাছে মোটরগাড়ি একটা বিরাট ঝঞ্ঝাটের ব্যাপার ।
পুরনো শহরের সংকীর্ণ রাস্তায় তাদের শ্লথগতির যানবাহন মোটরগাড়ির পাশ কাটিয়ে না যেতে পারে সামনের দিকে, না পিছন দিকে ।
বাজারের রোজকার হই হট্টগোলের মাঝে সে এক বাড়তি ঝামেলা ।
কখনও কখনও মোটরগাড়ীর অধৈর্য সওয়ারী নেমে এসে অন্য পক্ষের মুখোমুখি হয়ে বচসা শুরু করে দেয় ।
দুপক্ষের উত্তেজিত কথাকাটাকাটির মধ্যে ছোটখাটো হাতাহাতির ঘটনা যে ঘটে না তা নয় ।
পুরনো কাবুলি গেটের পাশ দিয়ে নমকমণ্ডির রাস্তায় যেতে যেতে রশিদ খানের পাশ দিয়ে এখন ভোঁক ভোঁক আওয়াজ তুলে একটা মোটরগাড়ি বেরিয়ে গেলো ।
সে দেখল ছাদখোলা গাড়িতে দুজন ইংরেজ মেয়েমানুষ বসে রয়েছে ।
মোটরগাড়ি, তাতে আবার সফর করছে আঢাকা মাথায় মেয়েমানুষ !
গাড়ি চালাচ্ছে একজন এদেশি ড্রাইভার, মাথায় তার পাঁচগজী বিরাট পাগড়ি ।
রশিদ খান ভাবলো জ্ঞান হওয়ার পর থেকে পঞ্চাশ বছরের বেশী সময় ধরে সে এই শহরটাকে দেখছে ।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার চিরচেনা পেশাওয়রে কতোই না পরিবর্তন এসেছে ।
এখন এখানে দুটো বড়ো হাসপাতাল, তার আব্বুর মতো হয়তো কাউকে আর বিনা চিকিৎসায় মরতে হচ্ছে না ।
খ্রীসটান মিশনারি আর চার্চের সাহায্যে বেশ কয়েকটা স্কুল খুলে গেছে, ইংরাজি পড়ানো হয় সেখানে । দুটো কলেজ ।
ইংরেজ তৈরি করেছে ঘড়িঘর, ভিক্টোরিয়া হল ।
আরও তৈরি হয়েছে রেল স্টেশন ।
পেশাওয়র থেকে এখন রেলের স্টিম ইঞ্জিন টেনে নিয়ে যাচ্ছে লম্বা লম্বা ট্রেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ।
মালপত্র আর মানুষজন আসাযাওয়া করছে এ শহর থেকে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার বড়ো বড়ো অন্য অনেক শহরে ।
যেসব পাখতুন ব্যবসায়ীদের টাকা হয়েছে তারা দেওয়াল-ঘেরা শহরের পুরনো এলাকা ছেড়ে নতুন এলাকায় বাড়ি করে উঠে যাচ্ছে ।
সেইসব এলাকায় নতুন রাস্তাগুলো চওড়া, রাস্তার পাশে থামের ওপরে বাতি জ্বালাবার ব্যবস্থা ।
সেসব বাড়ির ছেলেমেয়েরা ইংরাজি স্কুলে পড়তে যাচ্ছে, স্কুলের পর কলেজ ।
কলেজের পর ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার নানা শহর, কাবুল, লাহোর, করাচী, দিল্লী, লখনউ, বম্বেতে কাজের সন্ধানে ছড়িয়ে পড়ছে ।
#
তার নিজের বাড়িতেও তো এখন কতো পরিবর্তন ।
কলেজের পড়া সেরে বড়ো ছেলে রফিক কাবুল ইউনিভারসিটি থেকে বড়ো ডিগ্রি নিয়ে এসে ইসলামিয়া কলেজে ইতিহাস পড়াচ্ছে ।
বরাবরের মেধাবী পড়ুয়া ছেলে সে ।
পরিবারের ব্যাপারে নির্বিকার, কিছুটা আত্মকেন্দ্রিকও বলা যায় ।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দা-আ-স্তানগো আব্বুর সঙ্গে ধীরে ধীরে অনেক মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়েছে তার ।
বিশেষ করে প্রতি সন্ধ্যায় কিসসা কহানি বাজারে আব্বুর দা-আ-স্তানগোইয়ের দরবার সাজিয়ে বসা তার একেবারেই পছন্দ নয় ।
‘সারা পেশাওয়র শহরে আমার ছাত্র ছাত্রী ছড়িয়ে আছে ।
প্রফেসর রফিকের আব্বা রোজানা ভরাবাজারে গলা কাঁপিয়ে নাটক করে কিসসা বলছে আর শ্রোতারা গল্প শোনার পরে সামনের রেশমি রুমালে টাকা রেখে যাচ্ছে, এই ব্যাপারটা আমার একেবারেই বরদাস্ত হয় না আম্মি ।’
গতকাল রাতেও খাওয়ার সময় রফিক সকলের সামনে আবার পুরনো অনুযোগটা তুলেছিল ।
দস্তরখানে তখন পরিবারের সকলে বসে, রশিদ খান, নুসরত, রফিকের বিবি লায়লা, তাদের তিন বছরের ছেলে রিজওয়ান আর রফিকের ভাই ইফতিকার ।
রফিক থামতেই তার ভাই ইফতিকার কিছু বলতে গেলো ।
সে-ও পড়ায়, নিজের ইচ্ছেয় কাজ নিয়েছে এক মিশনারি স্কুলে ।
নিশ্চয়ই তার আব্বুর পক্ষ নিয়েই কথা বলতে গেলো সে ।
কারণ রফিক ভাইজান এইসব কথা তুললে সে সর্বদাই আব্বুর নিজের খোয়াইশের কথা তুলে তাকে সমর্থন করেই কথা বলে ।
কিন্তু রফিক হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে আবার বলতে লাগলো,
‘আম্মিজান, তুমি আব্বুকে বোঝাও যে এইভাবে টাকা রোজগার করাটা আমাদের আর মানায় না । অনেকদিন ধরে আমি আর ইফতিকার দুজনেই বাঁধা মাইনের চাকরি করি। এটা আব্বুর একরকমের উঞ্ছবৃত্তি, প্রায় মোহতাজই বলা যায় । এতে আমার মানহানি হয় আম্মি। আর তাছাড়া সকলেরই তো সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলা উচিত । আজকের দিনে কে কথকের গলায় দা-আ-স্তান শুনতে চায় বলো ? এখন শহুরে পাখতুন আফগানদের মধ্যে লেখাপড়া কতো বেড়েছে । উর্দু ভাষায় ছাপা আরব্যরজনী, মোল্লা নাসিরুদ্দীন, রুমী, এমন কি ঈশপের গল্প, এসব বই এখন বইয়ের দোকানে সাধারণ দামেই পাওয়া যাচ্ছে । তাই নতুন প্রজন্মের আর কোন ছেলেছোকরা কিসসা কহানি বাজারের আসরে হাজির হয় না । তারা গল্পের বই কিনে এনে বাড়িতে পড়ে ।’
রফিক থেমে গিয়ে জলের গ্লাস তুলে নিয়ে এক ঢোক জল খেলো।
সকলে রফিকের কথা শুনতে শুনতে চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আড়চোখের নজর রশিদ খানের দিকে ।
দা-আ-স্তানগো রশিদের চোখ খাওয়ার প্লেটের দিকে, ডানহাতের দুটো আঙ্গুল কাবাব নিয়ে নাড়াচাড়া করছে ।
নুসরত সন্ত্রস্তভাবে হাতের ইঙ্গিতে রফিককে থামতে বললো, তার বিবি লায়লার চোখে মুখে অস্বস্তি ফুটে উঠেছে ।
কোন কিছু গ্রাহ্য না করে রফিক এবার সরাসরি তার আব্বাকে নিশানা করলো,
‘আব্বু, তোমার কি নজর চলে না যে বেশ কয়েক বছর কিসসা কহানি বাজারে দা-আ-স্তানগোইয়ের আসরে, তোমার নিজের আসরে, শ্রোতা কতো কম হয়ে গেছে ? অশিক্ষিত বয়স্ক মানুষ ছাড়া আর কেউ সেখানে দা-আ-স্তানগোর মুখে গল্প শোনার জন্য দুঘণ্টা সময় নষ্ট করে না ! আমার ওদিকটায় যাওয়া হয় না বটে বহুদিন, তবে আমি খবর রাখি। কিসসা কহানি বাজারে এখন বোধহয় একমাত্র দা-আ-স্তানগো আমার আব্বু আবদুর রশিদ খান…তাই না আব্বু ?’
রফিকের গলার হালকা শ্লেষের সুরটা বাচ্চা রিজওয়ানটাকে বাদ দিয়ে উপস্থিত সকলেরই কানে বাজলো।
রফিক থেমে গেলে রশিদ খান মাথাটা তুলে একবার সকলের মুখের দিকে তাকালো ।
প্রৌঢ়া বিবি নুসরতের চোখের ভাষায় অনুনয় দেখতে পেলো সে, ‘তোমাকে এসব কথার জবাব দিতে হবে না ।’
রশিদ খান ধীরে চশমা চোখ থেকে নামিয়ে জোব্বার কোণ দিয়ে কাঁচদুটো পরিষ্কার করে চশমাটা আবার পরে নিলো ।
তারপর চশমার ওপর দিয়ে রফিকের দিকে স্থির দৃষ্টিতে এক মুহূর্ত তাকিয়ে নিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বললো,
-‘বেটা রফিক, পহেলা বাত হচ্ছে রোজগার করার জন্য আমি দা-আ-স্তানগোই করি না । এইটা বাচিক শিল্প কলা, আমরা এই শিল্পের খানদানী কলাকার । আমার আব্বুজান দাদাজীর মৃত্যুশয্যায় তাঁর কাছে আমার সামনে কসম খেয়েছিলেন আমাদের এই খানদানি শিল্পকে বরকরার রাখবেন আর আমাকেও উস্তাদ দা-আ-স্তানগো বানাবেন । আল্লার মর্জিতে তিনি অসময়ে চলে গেলেন, জন্নত হাসিল হয়েছে তাঁর । কিন্তু খুদার মেহেরবানিতে আমাকে তিনি কোন কসমের বন্ধনে বেঁধে রেখে যাননি, যেতে পারেননি । সেই জন্য আমার তরফ থেকে তোমার বা ইফতিকারের ওপর দা-আ-স্তানগোইকে ভালো লাগানোর জন্য কোনোদিন কোন চাপ ছিল না । এতে আমার বেশ কষ্ট হয়েছে, কিন্তু আমি সহ্য করেছি । সব সময় ভেবেছি এই নতুন দুনিয়ায় তোমাদের জীবন তোমাদের নিজেদের। তবে জেনে রাখো, যতদিন তোমাদের এই বুড়ো আব্বুর বুকে শ্বাস থাকবে ততদিন এই পরিবারে দা-আ-স্তানগোই থাকবে । সেই কয়েকটা দিন আমাকে সহ্য করে নাও । আমাকে নিয়ে তোমাকে কেউ কোন কথা শোনালে তখন তাকে এই কথাগুলোই বলবে ।’
রশিদ খান থেমে গেলো ।
নিঃশব্দ ঘরে রশিদ খানের রেওয়াজি মন্দ্রস্বর যেন প্রতিধ্বনির মতো ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলো ।
এবার রশিদ খান উঠে দাঁড়ালো । তারপর সকলের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে একটা বড়ো নিঃশ্বাস ফেলে আবার বলে উঠলো,
‘আরও একটা কথা শোন রফিক বেটা, যেটা তুমি বা ইফতিকার এখন পর্যন্ত জানতে না, তোমাদের আম্মিজান জানে । তুমি দা-আ-স্তানগোই থেকে রোজগারের কথা বললে…সে নাকি মোহতাজি রোজগার ! জেনে রাখো, তুমি কলেজে চাকরি নেওয়ার পর থেকেই আসর থেকে যে সামান্য টাকাপয়সা পাওয়া যায় সেটা আমি প্রতি জুম্মাবারের নমাজের পরে ইমামের চান্দাঝোলায় গরীব দুঃস্থদের জন্য দান করে আসছি । বেশক তোমাকে কোনোদিন ওই মানহানির টাকায় রোটি খেতে হয়নি । খুদা হাফিজ ।’
চিত্রপটের মতো স্তব্ধ বসে থাকা সব মানুষগুলোর সামনে দিয়ে রশিদ খান ধীরে ধীরে ঘরের বাইরের বারান্দায় বেরিয়ে গেলো ।
কাঠের সিঁড়িতে শুধু তার ক্লান্ত পদশব্দ শোনা যেতে লাগলো, কিছুসময় ধরে।
৪
শেষ ক্লাসটা নিয়ে টিচারদের বসবার ঘরে ঢুকতে ঢুকতেই ইফতিকারের নজরে পড়লো ওর নির্দিষ্ট চেয়ারটার সামনে টেবিলে একটা বড়ো হলুদ রঙের লিফাফা পড়ে আছে ।
এই লিফাফা ওর পরিচিত ।
সেন্ট মেরী স্কুলের মাদার প্রিন্সিপালের সই-করা চিঠি এইরকম লিফাফাতে প্রাপকের কাছে পাঠানো হয় ।
মনে মনে একটু হেসে ইফতিকার নিজের চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে যাবে,
টেবিলের উলটো দিক থেকে গণিতের টিচার আশরফ খান চোখের ইঙ্গিতে লিফাফাটা দেখিয়ে হেসে বলল,
-‘ইফতিকার ভাই, আপনার নামে আবার এত্তেলা এলো নাকি ! প্রিন্সিপ্যাল সিস্টার আপনাকে সত্যই খুব পছন্দ করেন দেখছি ।’ বলে হাসতে লাগলো ।
-‘হ্যাঁ, পড়ে দেখি কি লিখেছেন এবারে ! গত মাসে তো চিঠি দিয়েছিলেন ম্যাগাজিন পাশতুন-এ আমি কৃষকদের দুরবস্থা আর প্রশাসনের উদাসীনতা নিয়ে যে লেখাটা লিখেছিলাম সেটা নিয়ে ।’
ইফতিকার টেবিল থেকে একটা লেটার ওপেনার তুলে চিঠিটা যত্ন করে খুলতে খুলতে বললো।
ঘরে আর কেউ নেই ।
স্কুলের ছুটি হয়ে গিয়েছে । বোধহয় সব টিচারই যে যার বাড়ি চলে গেছে ।
আশরফ বললো, ‘সেই তো ! দেশের পাখতুন কৃষকদের দুর্দশা নিয়ে আপনি বা অন্য কোনো টিচার লিখলে এই মিশনারি ইংরেজি স্কুলের কি অসুবিধা হয় তা তো আমি বুঝি না ।’
ইফতিকার চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়বার উদ্যোগ করছিলো ।
আশরফের কথা শুনে হেসে উঠে বললো, ‘এতো ভালো গণিত জানো আর এইটা মেলাতে পারছো না ! আরে বাবা, ব্রিটিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে লিখেছিলাম তো ! ব্রিটিশ মিশনারি স্কুল এই সব লেখা-টেখা বন্ধ না করার উদ্যোগ নিলে সরকারী অনুদান তো বন্ধ হয়ে যেতে পারে । তাই আমাকে ওয়ার্নিং ! বুঝতে পারলে ?’
ইফতিকার থেমে গিয়ে এবার চিঠি পড়তে লাগলো ।
আশরফ বুঝতে পারার ভঙ্গি করে ঘাড় নেড়ে কৌতূহলী দৃষ্টিতে ইফতিকারের চিঠি পড়া লক্ষ্য করতে লাগলো ।
এবারের চিঠিতে কি লেখা সেই নিয়ে খুব ঔৎসুক্য তার ।
#
এই স্কুলে সিনিয়র টিচার ইফতিকারের প্রতি আশরফ খানের বন্ধুত্ব মেশান একরকম গভীর সম্ভ্রম রয়েছে ।
গত তিন বছর যাবত সেন্ট মেরী মিডল ইংলিশ বয়েজ স্কুলে গণিতের টিচার আশরফ ।
স্কুলে জয়েন করার প্রথম মাসেই বয়সে অন্তত পাঁচ বছরের বড়ো ইফতিকারের সঙ্গে ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেলো তার ।
স্কুলে ইংরাজি পড়ায় ইফতিকার, এডওয়ার্ডস কলেজের ডিগ্রী আছে তার ।
ছাত্রদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় সে ।
তার সঙ্গে কথায় কথায় আশরফ জানতে পেরেছে পাখতুনদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ও অন্যান্য সামাজিক ও আর্থিক উন্নতির জন্য গত দশ বছর ধরে ইফতিকার নানারকম কর্মকাণ্ডে সামিল হয়েছে ।
গোপন রাখার কসম খেয়ে আরও জেনেছে তার তরুণ বয়সেই বয়সে বছর দশেকের বড়ো বাদশা খানের সঙ্গে তার ভালোরকম ব্যক্তিগত পরিচয় হয়ে যায় ।
এখন সে বাদশা খানের ‘রেড শার্ট’ দলের সদস্য, খুদাই খিদমতগারের একজন শিক্ষক নেতা ।
বাদশা খানের পত্রিকা ‘ম্যাগাজিন পাখতুন’-এ কৌমের নানারকম সমস্যা নিয়ে সে স্বনামে বেনামে প্রায়ই লিখে থাকে ।
#
চিঠি পড়া শেষ করে ইফতিকার হাসতে হাসতে নীল কাগজে টাইপ-করা চিঠিটা
টেবিলে আশরফের দিকে এগিয়ে দিয়ে চোখের ইঙ্গিতে তাকে পড়তে বললো ।
আশরফ একবার তার দিকে তাকিয়ে চিঠিটা তুলে নিয়ে পড়তে লাগলো…
‘প্রধান শিক্ষিকা সিস্টার ডরোথির নজরে এসেছে যে ইংরাজির শিক্ষক জনাব ইফতিকার আলি খান প্রায়ই অবাঞ্ছিতভাবে তাঁর ক্লাসে পাঠ্য-বহির্ভূত নানা কাহিনী ছাত্রদের সামনে পেশ করে থাকেন । যেসব কাহিনী সাম্প্রতিক কালে ছাত্রদের সামনে বলা হয়েছে তার মধ্যে আছে বলশেভিক, ফরাসী বিপ্লব, ভারতে সিপাহী বিদ্রোহ আর পাঞ্জাবের নানা গালগল্প ও জনশ্রুতি । এই স্কুলের সিনিয়র শিক্ষক হিসাবে জনাব ইফতিকার আলি খানের এই আচরণ সম্পূর্ণ নিয়মবহির্ভূত এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধের সামিল । সেই কারণে তাঁকে এই মর্মে সাবধান করা হচ্ছে যে ভবিষ্যতে তিনি যেন ক্লাসে পাঠ্য-বহির্ভূত এই সব উল্লেখিত বিষয় আলোচনা করার চেষ্টা না করেন। অন্যথায় তাঁর বিরুদ্ধে নিয়মানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
চিঠিটা পড়ার পর আশরফ কিছুটা বিমূঢ় দৃষ্টিতে বন্ধুর দিকে তাকালো ।
ক্লাসে কেবল গল্প বলার জন্য এইরকম কড়া চেতাওনির কারণ সে আদৌ বুঝতে পারছে না ।
ইফতিকার তার হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে হেসে বললো,
-‘এই চিঠিতে যেসব কাহিনীর উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো দেখলে তো আশরফ ! আরে বাবা, তোমরা ব্রিটিশরা যে গ্যারিবলডি আর ম্যাটসিনিকে এতো পছন্দ করো, ডিউক অফ ওয়েলিংটন যে তোমাদের ন্যাশনাল হিরো, তাদের কাহিনীও তো ছাত্রদের শুনিয়েছি ! সেসব কাহিনীগুলো তাহলে ঠিক আছে…সেগুলো নিয়মানুগ ? আসলে কি জানো আশরফ ভাই, ব্রিটিশ স্বার্থে একটুও আঁচড় লাগতে পারে এমন কিছুই সহ্য করা হবে না । স্বাধীনতা অর্জন করার জন্য মানুষের সংগ্রামের কাহিনী তো নয়ই, সে মানুষ যে কোন দেশেরই হোক ।’
আশরফ ঘাড় নেড়ে বললো,
-‘হ্যাঁ বুঝতে পারি এটা । আপনি আগেও অনেকবার বলেছেন ।’
ইফতিকার যেন ঘোষণার সুরে বলে উঠলো,
-‘গল্প, কিসসা, কাহিনী শোনাব না… আমি ! আশরফ ব্রাদার, তুমি জানো আমরা হচ্ছে কয়েক পুরুষের খানদানি দা-আ-স্তানগো । আমার পরদাদা উস্তাদ দা-আ-স্তানগো মরহুম আমির খানকে এখনও পেশাওয়রের বুজুর্গ মানুষ একডাকে চিনতে পারবে । পেশাওয়রে যে-ই রাজত্ব করে থাকুক না কেন, তাঁর সময়ে কিসসা কহানি বাজারের ওই চত্বরটুকুতে তিনি-ই ছিলেন রাজা । আমার দাদাজি, আল্লার মর্জিতে অল্প সময়ের জন্য ওই বাজারে তিনিও রাজ করে গেছেন । আর আমার আব্বুজান ? গল্প বলার অমন শিল্পী আমি তো দেখিনি ।’
-‘আমি ছোট বয়েসে আপনার আব্বাকে অনেকবার শুনেছি, আমার আব্বুর সাথে গিয়ে । এককথায় অসাধারণ ।’
আশরফ ইফতিকারের কথার মধ্যেই বলে উঠলো ।
ইফতিকার থেমে গিয়ে আশরফের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল একবার ।
তারপর আবার বলতে শুরু করলো,
-‘দা-আ-স্তানগোইয়ের সেই শুদ্ধ রক্ত আমার শরীরে বইছে । আশরফ ভাই, আমার খানদানে আমি-ই এই নতুন প্রজন্মের দা-আ-স্তানগো । তবে আমি গোলেবকাওলি আর সিন্দবাদ নাবিকের গল্প শোনাই না, কোনোদিন শোনাবও না । আমার কহানি, আমার আসর আলাদা, শ্রোতা আলাদা । আমি কাঁচা মাটির তৈরি নতুন মানুষগুলোকে শোনাই এক নতুন পৃথিবীর দিকে দিকে জেগে ওঠা নতুন কাহিনীর মানুষগুলোর কথা, উইলিয়াম ওয়ালেস আর উইলিয়াম টেল-এর কহানি, রবার্ট ব্রুস, রবিনহুড, রানা প্রতাপ, টিপু সুলতান, নানা ধুন্ধুপন্ত, কুয়র সিং, তাতিয়া টোপী আর লক্ষ্মীবাঈয়ের কথা, আর হালফিলের ভ্লাদিমির লেনিনের জীবনকহানি ! সে সব কতো মহান স্বাধীনচেতা মানুষ, কতো যে তাদের হার-না-মানা বীরত্বের গল্প ! এই শোষক আর শাসকের দল, এরা কি করে সহ্য করবে সেসব কহানি…করতে পারে না আশরফ ভাই, করতে পারে না ! আমাদের নেতা বাদশা খানসাহেব একদম ঠিক বলেন এই ব্রিটিশ প্রশাসনের মতো অসহিষ্ণু ব্যাপার আর কিছু নেই।’
বলতে বলতে কিছুটা উত্তেজিত হয়ে পড়ছিলো ইফতিকার ।
থেমে গিয়ে যেন একটু দম নিয়ে ইফতিকার আবার বললো,
-‘তুমি সেরভেন্তিস পড়েছো ব্রাদার ?’
আশরফ এতক্ষণ চোখে মুগ্ধতা আর সমীহ নিয়ে একদৃষ্টে ইফতিকারের দিকে
তাকিয়েছিল ।
প্রশ্ন শুনে হঠাৎ চমকে গিয়ে নেতিবাচক ঘাড় নাড়লো ।
ইফতিকার যেন তার উত্তরের প্রতি খেয়ালই করলো না ।
নিজের মনেই বললো,
-‘এরা সকলেই এক একজন সেরভেন্তিস-এর সেই ডন কুইক্সোট, উইন্ড মিলের মধ্যে সর্বক্ষণ দৈত্য দেখতে পায় । কিংবা কে জানে, ওরাই হয়তো ঠিক । আমরা সত্যিই হয়তো ওদের জন্য শত্রু…এক একজন দৈত্য । কেবল আমরা নিজেরাই সেটা বুঝতে পারি না !’
৫
গত কয়েকদিন ধরে পেশাওয়রের রাস্তায় রাস্তায় পুলিশ ও মিলিটারির টহল বেড়ে গিয়েছে ।
রাস্তায় রাস্তায় যখন তখন ধুলো উড়িয়ে বিকট ঘরঘর শব্দ করে সৈন্যদের নিয়ে মিলিটারি বাস যাচ্ছে ।
খান পরিবারে শহরের সবরকম খবর পাওয়া যায় রশিদের বড়ো ছেলে রফিকের থেকে ।
শহরের এক প্রান্তের বাসগৃহ থেকে অন্য প্রান্তের কলেজে সাইকেলে তার রোজ যাতায়াত ।
তার ছাত্ররা কলেজে আসে দেওয়াল-ঘেরা পুরনো শহরের চারদিক থেকে, বিভিন্ন দিকের গেট পার করে, কেউ কেউ সাইকেলে, বেশীর ভাগ পায়ে হেঁটে ।
তাই তাদের সংগ্রহে থাকে পেশাওয়রের হালচালের টাটকা খবর ।
ছাত্রদের কাছ থেকে সেসব খবর পৌঁছে যায় তাদের শিক্ষক মহলে ।
আর রাতের খাওয়ার সময় রফিক সেসব খবর একের পর এক বলতে থাকে ।
#
এই খবরের সাথে সাথে পেশাওয়র শহরের অশান্তি যেন আবদুর রশিদ খানের পরিবারেও জবরদস্ত ভাবে ঢুকে পড়েছে ।
বিকেলের মরা রোদে ধীর পায়ে কিসসা কহানি বাজারের দিকে চলতে চলতে রশিদ খান কাল রাতের ঘটনার কথাই ভাবছিলো ।
রাতে সকলে একসঙ্গে বসে খেতে খেতে রফিক কাল যে খবরটা উত্তেজিতভাবে বলেছে সেটা শুনে রশিদ খান নিজেও কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে ছিল ।
ইফতিকারকে প্রশ্ন করে রফিকের আনা সংবাদের সত্যতা যাচাই করার প্রয়োজন পড়েনি ।
তার মৌনতাই প্রমাণ করে দিয়েছিলো যে খবরটা সঠিক ।
#
‘ইতিমধ্যে শহরের বড়ো খবর হচ্ছে কয়েক মাস আগে বাদশা খান তার স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংস্থাগুলো ভেঙে দিয়ে খুদা-ই-খিদমৎগার গঠন করার কথা ঘোষণা করেছে । তার পর থেকেই নাকি বাদশা খান ও তার সহকর্মীদের ওপর ইংরেজ সরকারের বাড়তি নজরদারি শুরু হয়ে গেছে । একটা চাপা উত্তেজনা শহরের গলিতে মহল্লাতে টের পাওয়া যাচ্ছে । ছোট ছোট জটলায় নীচুস্বরে কথাবার্তা, খবরের কাগজে চোরাগোপ্তা প্রতিবাদী সভার বিক্ষিপ্ত খবর। বাদশা খানের খুদাই খিদমৎগারের সদস্যদের নাকি বেলাগাম ধরপাকড় করা হচ্ছে ।
শহরে জোর গুজব বাদশা খানকে ইংরেজ সরকার তার নিজের বাড়িতে গৃহবন্দী করে রেখেছে । আরও গুজব কয়েকদিনের মধ্যেই হয়তো শহর কোতোয়াল এই সংস্থাটাকেই বেআইনি ঘোষণা করে দিতে পারে।’
এইসব খবর শুনে রফিক কাল তার ক্লাসে ছাত্রদের সাবধানে থাকার, খুদাই খিদমতগারের কোন সদস্যের সংশ্রবে কিছুদিন না থাকার জন্য পরামর্শ দিচ্ছিলো।
সেই সময় নাকি এক ছাত্র উঠে দাঁড়িয়ে তাকে পরামর্শ দেয় রফিক স্যার যেন তাঁরভাইজান জনাব ইফতিকার আলি সাহেবকে কিছুদিনের জন্য পেশাওয়র ছেড়ে অন্য শহরে গিয়ে লুকিয়ে থাকতে বলেন ।
ছাত্রটি নিজে রেড শার্ট দলের ভলান্টিয়ার ।
তার কাছে গোপন খবর আছে, খুদাই খিদমৎগারের প্রথম সারির কয়েকজন বিশিষ্ট নেতাদের গ্রেপ্তার করার পর অনেক শিক্ষক নেতাদেরও জেলে ঢোকানো হবে ।
তাই ইফতিকার সাহেবের মতো নেতাদের এখনই সাবধানে শহর ছেড়ে চলে যাওয়াটা ঠিক হবে ।
ছাত্রটির বক্তব্য শুনে রফিক প্রায় এক মিনিট স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো ।
এই অভাবিত ঘটনাক্রমে তার কান লাল হয়ে কিছুক্ষণের জন্য বাকরুদ্ধ অবস্থার শিকার হয়েছিলো সে ।
তারপর কোনোরকমে সামলে নিয়ে ছাত্রটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে বসতে বলে ক্লাস শেষ করে দেয় রফিক ।
টিচার্স রুমে এসেও সুস্থির হতে পারেনি সে।
তার সম্পূর্ণ অগোচরে, নিশ্চিত ভাবে খানদানের সকলের নজর এড়িয়ে, তার ভাইজান না কি খুদাই খিদমৎগারের সদস্য, এমন কি একজন নেতা !
যে খবর বড়ো ভাই হয়ে সে জানে না, সেটা তার ক্লাসের ছাত্র জানে !
হয়তো ক্লাসশুদ্ধু সব ছাত্র ওয়াকিফ যে প্রফেসর রফিকের ভাইজান জনাব ইফতিকার আলি রেড সার্ট দলের একজন বিশিষ্ট সদস্য, জেলে বন্দী করে রাখার মতো সে একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ।
ছাত্রটি ইফতিকারের নাম যেরকম সম্ভ্রমের সাথে উচ্চারণ করেছিলো, সেটা রফিকের কান এড়িয়ে যায়নি ।
ইসলামিয়া কলেজে এক দশকেরও বেশী সময় চাকরি হয়ে গেছে রফিকের কিন্তু এমন অস্বস্তিকর অবস্থায় সে আগে কোনোদিন পড়েনি ।
এখন ইফতিকার ভাইজান বলুক, যে কথাটা সে শুনে এসেছে সেটা সত্যি না মিথ্যে ।
যদি সত্যি হয় তাহলে বলুক, সকলকে না জানিয়ে, কারুর মতামত না নিয়ে, এমন একটা বিপদের রাস্তা সে কেন বেছে নিয়েছে ।
সে তো এখন বাচ্চা ছেলে নয়, ওর এইসব হরকত-এ পুরা খানদানকেই যে বহোত খতরার সামনা করতে হতে পারে সেটা কি সে জানে না ?
আম্মিজানকে তো তার লাডলা ছোটো ছেলে না কি সব কিছু জানায় !
আম্মিজান এখন বলুক এইসব কথা কি আম্মি জানতো ? যদি জানতো তাহলে কি আব্বুকে বলেছিলো ?
আর আব্বুও যদি আগে থেকে জেনে থাকে তাহলে তো বহোত খুব !
বেশ রাগের গলায় রফিক তার কথা শেষ করে বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস ফেলে দম নিচ্ছিলো ।
ঘটনার গুরুত্ব বুঝে সকলেই নির্বাক, খাবারের থালাতে সবাই খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করছে ।
রফিকের ছেলে রিজওয়ান সন্ত্রস্ত ভাবে একবার এর মুখের দিকে, আর একবার ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে ।
কেবল ইফতিকার মাথা নীচু করে চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে ।
প্রাথমিক হতচকিত ভাব কাটিয়ে উঠে রশিদ খান বিবির দিকে তাকাল।
নুসরতের করুণ চাহনিই জানান দিচ্ছে সে এসবের কিছুই জানতো না ।
এখন রশিদ বুঝতে পারছে কেন ইফতিকারের রোজ ফিরতে রাত হয় ।
একবার তাকে জিজ্ঞেস করতে ভাসা ভাসা উত্তর পেয়েছিল ।
যুবক ছেলে, তার ইয়ারবন্ধু থাকবেই, রশিদ তখন অতো গ্রাহ্য করেনি ।
মিশনারী স্কুল ইফতিকারের, রবিবার পাক্কা বন্ধ থাকে ।
কিন্তু প্রায় প্রতি রবিবার সে সারা দিন বাড়ির বাইরে কাটায় ।
আগে এসব নিয়ে কিছু ভাবেনি রশিদ খান ।
ইফতিকারকে এখন এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করে লাভ নেই ।
বোঝাই যাচ্ছে রফিক যে কথা শুনে এসেছে তার সম্বন্ধে সেটা সম্পূর্ণ সত্য ।
খাওয়া শেষ করে ইফতিকার উঠে দাঁড়ালো ।
তারপর নিরুত্তেজ গলায় বললো,
-আব্বুজান, আম্মিজান, কাল আমার স্কুল আছে । আমি শুতে যাচ্ছি ।’
এতো অভিযোগ করার পরও ছোট ভাই এইরকম অবজ্ঞা দেখানোয় রফিক অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো ।
তারপর জোর গলায় বলে উঠলো,
-‘কিন্তু কেন তুমি আমাদের সকলকে বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছো, তার জবাব নেই তোমার কাছে ? তুমি কি জানো বাচ্চা খানকে পুলিশ তার নিজের বাড়িতে নজরবন্দী করে রেখেছে ?’
ইফতিকার বড়ো ভাইজানের দিকে এক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পর
ঠাণ্ডা গলায় বললো,
-‘আমার নেতা আটক হয়েছে ভাইজান, আর আমি জানবো না !’
আরও উত্তেজিত হয়ে স্থানকালপাত্র ভুলে গিয়ে রফিক প্রায় চিৎকার করে উঠলো,
-‘জেনে রাখো আব্বুজানের ইচ্ছামতো আমি দা-আ-স্তানগো হতে পারিনি, কিন্তু তোমার মতো ইনকিলাবি-ও হইনি।’
শুনে ইফতিকারের ঠোঁটের কোণে একটা অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠলো ।
তারপর সেই হাসিটা ঝুলিয়ে রেখেই সে বললো,
-‘আমি তো ইনকিলাবি আর দা-আ-স্তানগো দুইই বটে ভাইজান । তবে আমার দা-আ-স্তানগোইয়ের আসর কিসসা কহানি বাজারে বসে না, একেবারে ইনসানের দিল-এর মধ্যে গিয়ে বসে ! যাক, তুমি সেসব বুঝবে না ।’
ইফতিকার ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেলো ।
৬
বুধবারের বিকালে পুরনো কাবুলি গেটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে রশিদ খান কাল রাতের এইসব কথাই ভাবছিলো।
ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়ার ব্যাপার দেখে সে নতুন একরকম কষ্ট অনুভব করেছে ।
তবে ইফতিকার খুদাই খিদমৎগারের সদস্য হয়েছে জেনে সে অবাক হয়েছে, কিন্তু দুঃখ পায়নি ।
ছোটবেলা থেকেই ইফতিকারের যেরকম ধরনধারণ তার সঙ্গে এই প্রতিবাদী ব্যাপারটা বেশ মিলে যায়, ভাবলো রশিদ খান ।
আর এই আবদুল গফফর বাদশা খান ও তার কাজকর্মের ব্যাপারে সে যে একেবারেই কিছু জানে না তা তো নয় ।
তার মাদ্রাসার সহপাঠী বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই রাজনীতির খবর রাখে, উৎসাহের সঙ্গে আলোচনাও করে ।
বন্ধুদের আড্ডায় আলোচনায় ভাগ না নিয়ে শুধু শ্রোতা হিসেবে বসে থেকে এই পাখতুনখ্বোয়া অঞ্চলের অনেক খবর তার জানা হয়ে যায় ।
তরুণ বয়স থেকেই এই প্রতিবাদী পাঠান আবদুল গফফর খান তার নানারকম সামাজিক আন্দোলনের জন্য পুরো পেশাওয়র শহরে আলোচনার বিষয় হয়ে রয়েছে ।
এই শহরের লোকজন মান্য করে, তাকে ডাকে বাদশা খান বলে ।
পাখতুন জাতের ছেলেমেয়েদের অবস্থার উন্নতির জন্য সে গত দশ বারো বছর ধরে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে ।
পরের পর অনেকগুলো আন্দোলন করে সে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে চলেছে ।
এই তো কয়েক মাস আগে সে এই নতুন খুদাই খিদমৎগার দলটা গড়েছে ।
কিন্তু এই বাদশা খানের যে বিষয়টা রশিদের সব থেকে অভিনব লাগে সেটা হচ্ছে লড়াকু পাখতুন জাতকে সে পুরোপুরি অহিংস আন্দোলনের পাঠ পড়াচ্ছে !
গান্ধী মহারাজের প্রভাবেই নিশ্চিত সে আন্দোলনের এই রাস্তাটা ধরেছে ।
এই ব্যাপারে কয়েকদিন আগেই বন্ধু মজিদ খানের দোকানের আড্ডায় সকলে আলোচনা করছিল ।
একজন বললো, খুদাই খিদমৎগার দল সম্পূর্ণ অহিংস আন্দোলনের পথ আমল করবে বলে ঘোষণা করেছে বটে, কিন্তু দলটা বাদশা খান চালায় নাকি একেবারে মিলিটারি কায়দায় ।
সেই রকম কড়া নিয়মকানুন, দলে নানারকম ঊর্ধ্বতন অধস্তন পদ ।
এমনকি সদস্যদের নির্দিষ্ট সাজপোশাক, ছেলে ভলানটিয়ারদের লাল পোশাক, মেয়েদের কালো ।
বয়সে অনেক ছোট হলেও এই বাদশা খানকে, তার মকসদকে, রশিদ খান বহোত ইজ্জত করে ।
#
কাবুলি গেটের কাছে এসে রশিদ খানের ভাবনার চটকটা ভাঙলো।
বাজারের সেই হই হট্টগোলটা শুনতে পাচ্ছে না কেন !
একটু দাঁড়িয়ে গিয়ে রশিদ খান চশমাটা মুছে নিয়ে চারিদিকটা একবার ভালো করে দেখলো ।
সত্যিই তো ! বুধবারের হাটের সেই জমজমাট ভিড়টা তো আজ এখানে একেবারেই নেই !
রাস্তার দুপাশের অস্থায়ী ঠেলা গাড়ির দোকানগুলো একটাকেও দেখা যাচ্ছে না ।
তাই সরু রাস্তায় উপচে-পড়া খরিদ্দারদের ভিড়টা নেই ।
পাকা দোকানগুলো খোলা আছে বটে কিন্তু সেখানেও মানুষজন কম ।
দোকানের সামনের আফিমখানায় লোক নেই, গড়গড়ার মাটির কলকেতে আগুন নেই, নলগুলো শীতের সাপের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে এদিক ওদিক পড়ে আছে ।
ব্যাপারখানা কি !
আর দশ হাত গেলেই দোস্ত মজিদের আখরোট বাদাম পেস্তার বড়ো দোকান ।
এক মাইল দূরের কহানি বাজারে যাবার আগে রশিদ খান প্রতিদিন দোস্তের এখানে কিছুক্ষণ বসে যায় ।
দোকানে, দোকানের সামনের আফিমখানায়, আরও কিছু ইয়ার দোস্ত মিলে যায় ।
কিছুক্ষণ খোশগল্প করে সকলের সঙ্গে মাগরিবের নমাজটা এখানে সেরে নেয় রশিদ খান ।
তারপর কয়েক দানা বাদাম মুখে ফেলে আবার কহানি বাজারের দিকে হাঁটা দেয় দা-আ-স্তানগো রশিদ খান ।
নতুন গল্প বলা হবে জানলে কোনোদিন কোন কোন ইয়ারদোস্তও তার সঙ্গ নেয়।
#
মজিদের দোকানে ঢুকতে যাবে রশিদ এমন সময় দেখল ঘরঘর শব্দ করে একটা মিলিটারি লরি কহানি বাজারের দিক থেকে আসছে ।
লরির আওয়াজ শুনেই বোধহয় মজিদ দোকানের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো ।
দোকানের বাইরে রশিদকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে সন্ত্রস্তভাবে চাপাস্বরে তাড়াতাড়ি বলে উঠলো,
-‘আরে দোস্ত ! তুম আজ ভি নিকলে ! এসো এসো জলদি ভেতরে এসো।’
মজিদ রশিদ খানের হাত ধরে টেনে দোকানের ভেতরে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে, এমন সময় বিকট শব্দ তুলে লরিটা সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেলো ।
খোলা লরির পাটাতনের ওপরের দৃশ্য দেখে দুই বন্ধু হতবাক স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ ।
লরির ওপরে অন্তত পনেরো জন উর্দি-পরা নিরস্ত্র গাড়োয়ালি সৈন্য, তাদের হাতে হাতকড়া, দুপাশে বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুজন লালমুখো ব্রিটিশ সৈন্য ।
#
কয়েক মুহূর্ত এরকম কেটে গেলো ।
তারপর মজিদই প্রথম হতচকিত ভাবটা কাটিয়ে রশিদ খানকে টেনে দোকানের মধ্যে নিয়ে এল ।
দোকানে আর কেউ নেই ।
মজিদ খান বিকালের আলো জ্বালায়নি এখনও ।
তাই পুরনো ঘুপচি ঘরের ভেতরটা আলো আঁধারি ।
দুজনে মুখোমুখি দুটো বেঞ্চে বসে বসার পর মজিদ ফিসফিস করে প্রায় নিজের মনেই বললো,
-‘কিছুক্ষণ আগে যে খবরটা পেয়েছিলাম তাহলে সেটা সত্যি !’
রশিদ খানের কাছে আজ সব কিছুই কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে ।
বুধবারের বিকেল বেলায় পুরনো পেশাওয়রের ঘিঞ্জি মহল্লায় লোকজন হট্টগোল নেই, দোকানে দোকানে খরিদ্দার অমিল ।
তার ওপর সরকার তার নিজের সিপাহীদের নিরস্ত্র করে হাতকড়া পরিয়ে সাধারণ বন্দীদের মতো কোথায় যেন নিয়ে গেলো !
মজিদ ভাইয়ের দোকানে আড্ডাধারীরা কেউ নেই !
আর এখন সে ফিসফিস করে কি বলছে ?
কোন খবর পেয়েছিলো দোস্ত মজিদ…যেটা সত্যি হলো ?
রশিদ খান এইসব দ্রুত ভেবে নিয়ে মজিদকে জিজ্ঞেস করতে যাবে এমন সময় সে নিজেই কিছুটা ক্লিষ্ট স্বরে বলে উঠলো,
-‘দোস্ত, শহর কা হালত খুবই খারাপ । তুমি আর এক প্রান্তে থাকো তাই খবর পাওনি । আজ দুপুর থেকে খুদাই খিদমৎগারের অন্তত হাজার ভলান্টিয়ার কিসসা কহানি বাজারের একদিকে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। তাদের দাবি বচ্চা খানকে মুক্তি দিতে হবে । সামনে পুলিশ আর সৈন্যরা ব্যারিকেড করে তাদের আটকে রেখেছে ।’
এটুকু শুনেই রশিদ খানের মেরুদণ্ড দিয়ে একটা শিরশিরে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেলো ।
‘খুদাই খিদমৎগারের ভলানটিয়াররা বিক্ষোভ দেখাচ্ছে…পুলিশ আর সৈন্যদের সামনে ? তাহলে তাদের নেতারা কোথায় আছে…শিক্ষক নেতারা ? তারাও নিশ্চয়ই ওইখানেই আছে ? ইফতিকার তো সক্কালবেলায়ই বেরিয়ে গেছে । বিকালে তো ঘরে আসেনি । ইফতিকারও কি ওইখানে, ওই বিক্ষোভের মধ্যে রয়েছে ?’
মজিদ খান দোস্তের অন্যমনস্ক ভাবটা লক্ষ্য না করে আবার বলতে থাকলো,
-‘ইতিমধ্যে হঠাৎ নাকি সৈন্যদের একটা মোটরগাড়ি ভীষণ জোরে ওই ভলানটিয়ারদের ভিড়ে ঢুকে যায়, চার পাঁচ জন সেই গাড়ি চাপা পড়ে মারা গেছে । কহানি বাজারে এখন নাকি সেইসব লাশ ঘিরে হাজার লোক বসে আছে, যতক্ষণ না পুলিশ আর সৈন্য কহানি বাজার থেকে সরে যাবে তারা সরবে না, লাশও সরাতে দেবে না । দোস্ত, এর মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ আগে আবার এক ভয়ানক ঘটনা ঘটেছে । এক জানপহচান খরিদ্দার কিছুক্ষণ আগে আমাকে বলে গেলো ।’
রশিদ খানের বোধ যেন কাজ করছে না ।
যন্ত্রচালিতের মতো সে জিজ্ঞেস করলো,
-‘আর কি হয়েছে ?’
-‘ভলানটিয়ারদের কিছুতেই সরাতে না পেরে এক ইংরেজ অফসর জমায়েতের ওপর গুলি চালানোর হুকুম দিয়েছিলো । এক গাড়োয়ালি হাবিলদার আর তার অধীনের সৈন্যরা নাকি সেই হুকুম মানেনি, নিরস্ত্র ভলানটিয়ারদের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকার করেছে । ইংরেজ অফসর ওইখানেই নাকি পুরো দলটাকে বন্দি করে ফেলেছে । দোস্ত, আমরা যে লরিটা দেখলাম, ওইটা নিশ্চয়ই সেই গাড়োয়ালি সৈন্যের দলটা ।’
মজিদ খান কথা শেষ করতেই রশিদ খান অন্যমনস্ক ভাবে বলে উঠলো,
-‘তাহলে তো ওখানে গুলি চলেনি দোস্ত, তাই না ?’
-‘কিন্তু চলতে কতক্ষণ ! এই শহরের ইংরেজ কোতোয়াল একেবারে পাগলা কুত্তা হয়ে গিয়েছে । খুদাই খিদমৎগারের সদস্যদের ওপর তার ভীষণ গুসসা । বাদশা খান তার সব সভাতে বলে না যে ইংরেজ সরকার বন্দুক কাঁধে পাঠানের থেকে খালি হাতের পাঠানকে বেশী ভয় পায় ।’
রশিদ খান ফ্যালফ্যাল করে মজিদের দিকে তাকিয়ে রইলো ।
তার কানে কিছু ঢুকলো বলে মনে হোল না ।
সদিকে লক্ষ্য না করে মজিদ আবার বললো,
-‘আমার কথা শোন দোস্ত, তুমি এখন বাড়ি ফিরে যাও । কিছুদিন তো তোমার দা-আ-স্তানগোইএর আসর বন্ধ রাখতেই হবে । দেখছো তো ব্যবসার হালত । বাজার সুনসান । আমিও দোকান বন্ধ করে দেবো একটু পরেই । কবে যে আবার সব স্বাভাবিক হবে তাই ভাবছি ।’
মজিদ খানের কথা শেষ হয়েছে কি হয়নি, দূর থেকে উপর্যুপরি গুলির শব্দ ভেসে এলো । তারপর আবার, আবার । দুজনেই সন্ত্রস্তভাবে উঠে দাঁড়ালো ।
আবার গুলির শব্দ ভেসে এলো ।
রশিদ খান উত্তেজিত ভাবে বলে উঠলো,
-‘আমি যাই দোস্ত । আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে ।’
রশিদ খান ছিটকে দোকানের বাইরের দিকে চলে গেলো ।
-‘হ্যাঁ আমিও তো তাই বলছি…দোস্ত তোমার থলি, কিতাব সব পড়ে রইলো যে…আরে ওদিকে…কহানি বাজারের দিকে কোথায় যাচ্ছো রশিদ ভাই ? ওদিকে থেকেই তো গুলির আওয়াজ…আরে রশিদ…হায় আল্লা…দোস্ত…দোস্ত ’
অত্যন্ত আশঙ্কা নিয়ে মজিদ খান ঝটিতি তার দোকানের বাইরে বেরিয়ে এলো ।
ততক্ষণে দা-আ-স্তানগো রশিদ খান তার চেনা কিসসা কহানি বাজারের পথে অনেকটাই এগিয়ে গেছে ।
গুলির শব্দ ক্রমশ জোরদার হয়ে ভেসে আসছে ।
প্রৌঢ় রশিদ খান প্রায় দৌড়তে শুরু করলো…
‘ইফতিকার বিক্ষোভে গেছে নিশ্চয়ই…গুলি চলছে…নিরস্ত্র মানুষের ওপর…কিসসা কহানি বাজারে নয়া দা-আ-স্তান, নতুন কহানি তৈরি হচ্ছে…আমি উস্তাদ দা-আ-স্তানগো…এইসময় আমি ওখানে না থাকলে চলে…সবুর কর ইফতিকার বেটা …আমি আসছি..’
আবার গুলির শব্দ ভেসে এলো ।
তারপর সে শব্দ চলতে থাকলো…চলতেই থাকলো…
—————————————————————–
পরিশিষ্ট –
১৯৩০ সালের ২৩শে এপ্রিল বুধবার বিকালে পেশওয়রের কিসসা কহানি বাজারে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার সৈন্যরা সীমান্ত গান্ধীর নিরস্ত্র খুদাই খিদমৎগার রেড শার্ট ভলানটিয়ারদের অহিংস জমায়েতের ওপর আধঘণ্টা লাগাতার গুলি চালায়। বেসরকারি সূত্র অনুসারে নিহত হয়েছিলো প্রায় ২০০ মানুষ, আহতের সংখ্যা ছিল প্রায় ৪০০। হাবিলদার চন্দ্র সিং গাড়োয়ালির অধীনস্থ গাড়োয়ালি প্ল্যাটুন নিরস্ত্র মানুষের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকার করলে কোর্ট মার্শালে তাদের ৮ বছরের কারাদণ্ড হয় ।
Tags: গল্প, দা-আ-স্তানগো, সিদ্ধার্থ সান্যাল
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।