17 Jun

পেশাদারিত্ব

লিখেছেন:রামকিশোর ভট্টাচার্য


মিলন আমার বন্ধু।  পেশায় সাংবাদিক।  আমরা এক শহরেই থাকি। আমাদের দুজনের মধ্যে শুধু চারটে রেললাইনের তফাৎ। এ যেন অনেকটা পুব দিকে তুমি আর পশ্চিমে আমি। মাঝখানে রেলগাড়ি ছুটে চলে যায় । আমার চেয়ে মিলন দু-তিন বছরের বড় হলেও , আমি তাকে নাম ধরেই ডাকি। আবার আমি যাদের দাদা বলে ডাকি ও তাদের নাম ধরেই ডাকে ।

তা সেই মিলন অনেক কষ্টে শ্রীরামপুরের এক প্রান্তে একটা জমি কিনলে । কিনলে তো ভালো,  কিন্তু সেই জমিকে সরকারি খাতায় নিজের নামে নথিভুক্ত করতে গিয়ে তার বেহাল অবস্থা।  যে ছেলে পোস্টাপিসে একাউন্ট করে চেক বই নিতে ভুলে যায়,  তিনি তিন চার বছর পর যার অবস্থা বিপাকে টাকা তুলতে গিয়ে মনে পড়ে সেই চেক বই না তোলার কথা। সে যে জমি সংক্রান্ত ব্যাপারে বেশ নাজেহাল হবে সেটাই তো স্বাভাবিক ।

একদিন চৈত্রের দুপুরে রাস্তায় দেখা,  আপন মনে একটা সিগারেট পোড়াতে পোড়াতে চলেছে সে , আর সঙ্গে রাস্তা চলেছে ঘামতে ঘামতে । আমি যে তার পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছি সেদিকেও খেয়াল নেই। আমি তার আমি তার নজর আমার দিকে ফেরাতে বল্লাম

– চললে কোথায় এই ভর দুপুরে

– আরে পার্থ ! আর বোলো না যাচ্ছি সেটেলমেন্ট অফিসে । আমার নামে জমির পর্চা তোলার ফর্ম টা আমি নিজে ভর্তি করে জমা দিয়ে এসেছি । মাস তিনেক আগে। আজ পর্চা নিতে যাচ্ছি। মনে মনে ভাবলাম কাজ সেরেছে , এই অফিসের ভিতরে বেশ কিছু ডাইমেনশন আছে । চোখে যা দেখবেন বা ভাববেন আসলে তা নয়। কতটুকুই বা একসঙ্গে দেখা যায় । হাজার চেষ্টা করলেও সবদিক দেখা যাবে না।  জনে জনে তার বিস্তার আছে। দালালকে এড়িয়ে নিজের ফর্ম ফিলাপ করে জমা দিয়েছে। কাজ হলে হয়।

মুখে বললাম – তুমি নিজেই ফিলাপ করে জমা দিলে!   দালালরা কিছু বলল না!  দেখো কি হয় আবার। চলো তাহলে আমি ওই দিকেই যাই। জমির খাজনা টাও দিয়েই আসি ।

মৃদু মৃদু কথার সময় বাঁধতে বাঁধতে  দুজনে ঢুকলাম মল্লিক পাড়ার পাড়ার পথে সঙ্গী করে ।

অবাক করা ব্যাপার অফিসে গিয়ে জানলাম মিলনের পর্চা হয়ে গিয়েছে। জি টি রোড এর অফিসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে । ওখান থেকেই নিতে হবে।

ইতিমধ্যে আমার কাজও শেষ তাই আবার দুজনে চললাম রাজপথের অফিসে । গলিপথের ঝামেলা কেটেছে। সেখানে গিয়ে জানলাম যন্ত্রে মিলিয়ে সেগুলি অফিসারের সামনের টেবিলে ট্রেতে  রাখা আছে,  যে যার দেখে নিতে হবে।

মিলন গিয়ে খুঁজে দেখল সেখানে তারপর পর্চা নেই,  অথচ অফিসের কম্পিউটারে দেখালন সেটি হয়ে গিয়েছে। অনেক খোঁজার পরেও পাওয়া গেলনা  যখন তখন সেই অফিসার বাবুটি বললেন

– তাহলে অতুলবাবু নিয়ে গিয়েছেন বাড়িতে,  ধারাসা পাড়য় শিব মন্দিরের পাশে তাঁর বাড়ি , ওখান থেকে নিয়ে নিন।

– কে অতুল বাবু!

স্তম্ভিত মিলনের চাপা ক্ষোভের মৃদু প্রকাশ

-তিনি আমার পর্চা তাঁর বাড়ী নিয়ে যাবেন কেন ! কেনই বা আমি তাঁর বাড়ি থেকে সেটা সংগ্রহ করবো?  একজন দালাল এগিয়ে এলো খুব ধীরে বলল এটাই এখনকার নিয়ম,  আপনি তার বাড়ি যান,  সামান্য কিছু টাকা দিয়ে নিয়ে নিন পর্চাটা ।

সবাই দেখলাম মিলনের দিকেই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে । যেন ভাবছে এটা কোন গ্রহের জীব রে!

 

মিলনের মুখ দেখে বুঝলাম সাংবাদিক মিলনের ভিতর আগুন জ্বলছে । একটিও কথা নেই এবার । শুধু একটা সিগারেট পুড়ে চলেছে আপন মনেই ।

শেষ বসন্তে প্রবল গরমের সেই দুপুরেই ধারাসাপাড়ায় শিব মন্দিরের পাশে এক প্রবীণ মধ্যবিত্ত দোতলা বাড়ির দরজায় আমরা দুজনেই উপস্থিত।

বেশ জোরে জোরে আঘাত ।

শব্দের ডেসিবেলটা মাপলে মিলনের ক্ষোভের পরিমাণটা বোঝা যেত-

এক মহিলা বেরিয়ে এলেন,

মিলন ক্ষুব্দ গলায় বেশজোরের সঙ্গে বলে উঠলো

– অতুল বাবু কই ?;আমার পর্চা তিনি নিয়ে এসেছেন কেন?

ভদ্রমহিলা আঙ্গুল তুলে দোতলার দিকে তাকিয়ে বললেন

-উনি ওখানে আছেন

এক টুকরো আকাশ উঁকি দেওয়া দোতলার এক ফালি বারান্দার দিকে তাকিয়ে আমরা দেখলাম – এক নাদুস-নুদুস গোলগাল শরীর লুঙ্গির গিঁট ঠিক করতে করতে বেরিয়ে এসেছেন , তখনও দিবানিদ্রার  সুখাবেশটি লেগে আছে চোখে।  ইশারায় আমাদের ওপরে ডাকলেন।

মিলন আর আমি ওপরে গেলাম , মিলন ফেটে পড়ল রাগে

– আপনি আমার পর্চা নিয়ে এসেছেন কেন ? ফর্ম আমি নিজে ফিলাপ করেছি- আপনাকে নিয়ে আসার অধিকার কে দিয়েছে?

অতুল তার তুলতুলে শরীরটা নিয়ে গেলেন অতি প্রবীণ একটি লোহার আলমারি দিকে

তারপর বললেন-  আপনার নাম

– মিলন গুপ্ত

চার-পাঁচটা কাগজের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন সেই মহামান্য পর্চা।

মিলন তখনো তাঁকে নানা কথা বলে চলেছে । অথচ অতুলের মুখে একটিও শব্দ নেই।  মুখে একটুও অপরাধবোধও লেগে নেই। শুধু বিশ্বের সব থমথমে ভাবটি যেন জমে আছে সেই ঘরে ।

কাগজটি নিয়ে আমি আর মিলন উঠে দাঁড়ালাম। এগিয়ে যাচ্ছি দরজার দিকে । হঠাৎ পিছন থেকে মৃদুকণ্ঠে একটি উচ্চারণ

– শুনুন

দুজনে ঘুরে দাঁড়ালাম। অতুলবাবু খাটে বসে আছেন। তর্জনীটা তুলে রেখেছেন শুধু ।

আমরা দুজনেই একটু অবাক,  বাইরের গরম হাওয়া আর ভিতরের ফ্যানের হাওয়া মিলেমিশে এক হয়ে একটু একটু গুমোট।অতুলবাবুর তুলতুলে শরীর স্থির বসে আছে ,

-প্লিজ , একটা টাকা দিয়ে যান-

মিলনের ক্ষুব্ধ মুখটা নিমেষে কেমন বদলে গেল।

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ