20 Jun

চলো যাই ভিন দেশে

লিখেছেন:রূপা সেনগুপ্ত


উৎসবের দিন হলে বড়মা থালা সাজিয়ে খেতে দেন। বড় জেঠু আর বাবা একসঙ্গে খেতে বসেন। আজ সংক্রান্তি। আজ আমাদের নিরামিষ আহার। প্রায় সাতটা কাঁসার বাটি; বড় কাঁসার থালার পাশে সাজানো। বড়মা ধীর স্থির শান্ত স্বভাবের মানুষ। দেশ যে আজ উত্তপ্ত তার কোন ছাপ বড়মার মুখের কোথাও নেই। এই মাধবদীতে তিনি সবার বড়মা। সে কী হিন্দু কী মুসলমান!

আজ যেন বড় জেঠু বেশ চিন্তিত। আমাদের গলির মুখে যে কাঁঠালগাছটা তাতে কে যেন একটা পোস্টার টাঙিয়ে রেখে গেছে।  তাতে লেখা, আওয়ামী মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ।

বড় জেঠা বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন,

–  এই কাজডা কে করল ক দেখি!

–  হগলে তো কইতাসে মেজভাইয়াদায়।

–  আমাগো মাধবদিতে তো হিন্দু মুসলমানে কুন বিবাদ ছিল না। এইসবের কী দরকার আসিল, ক দেহি!

–  বড়দা, অল্পবয়সী পোলাপানের কাম। অত ভাইবেন না। আমি সামসুরের লগে কথা কমু।

– ভাবুম না ভাবি তবু যেন পরানডায় ব্যথা করে রে।

বড়মা মোচার ঘন্টর বাটিটা একটু এগিয়ে দিয়ে বলেন  –  থির হইয়া খান দেহি। দুশ্চিন্তা মাথায় লইয়া খাইতে নাই। খাওয়া হজম হয় না।

আমি হাতপাখা নাড়া বন্ধ করে শুনছিলাম। বড়মা আমার দিকে ফিরে বলল – ওই ময়না, তুই হাঁ কইরা কথা গিলিস না তো। যা ঘরে যা। আমি বাতাস করতাসি।

কথার মাঝখানে উঠে যেতে মন চাইছিল না। কিছু যে গোলমাল তা আমারও কেমন মনে হচ্ছিল। তবে কি ওই রেখা রুনুদের মতন আমাদেরও চলে যেতে হবে! আমরা কোথায় যাব? ইন্ডিয়ায় সবাই তো রওনা দিয়েছে। কিন্তু ও তো ভিন দেশ! ওখানে তো আমাদের কেউ নেই।

দেশটা স্বাধীন হইল, কিন্তু কেন যে দুইটা ভাগ হইল কে জানে ! –  এই চিন্তা বড় জেঠা ফণীভূষন সাহাকে খুব চিন্তিত করে। তাদের কাপড়ের ব্যবসা। বাংলা ভাগের আগে তিনি তাঁর বাবার সঙ্গে কতবার যে কলকাতায় যাতায়াত করেছেন তার ঠিক নেই। এখন বেশ ক’বছর ওদেশে যান না। ওটা যে কী করে ভিন দেশ হল ! তিনি ভেবে থৈ পান না।

 

খবরে শোনা, এর মধ্যে দেশের রাজনীতিতে বেশ কতগুলো পরিবর্তন হয়ে গেছে। মুজিব দুই বছর আগেই মানে গত ১৯৫৩ সালে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগের’ সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন। পরের বছর সাধারণ নির্বাচনে মুজিবের ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ জয়ী হয়েছে। মুজিব সমবায় ও কৃষি মন্ত্রী হয়েছেন। তবু দেশ শান্ত হয়নি তেমন ভাবে।

এসব কথা আমি সর্বদা শুনছি। বড় জেঠাও কাগজে আর রেডিওতে মাঝেমাঝেই নানান গোলমালের খবর শুনে  ভীত হয়ে পড়ছেন। কেউ কেউ বলছেন, দেশত্যাগী ভারতীয়রা দেশে ফিরে এলো বলে। তারা এসে জমিজমা ফেরত চাইবে। আর  এই নিয়ে ফের হিন্দু মুসলিমের বিরোধ বাঁধবে। এই রকম খবর নাকি খবরের কাগজে ছাপা হচ্ছে। এই নিয়ে একটা গোলমাল যে বাঁধতে পারে তা ভেবে বোধকরি বড়জেঠা একটু অস্থির হয়ে পড়েছেন। এই দেশ এই গ্রাম বড়জেঠার খুব প্রিয়। যখন প্রতিবেশীরা একে একে রওনা দিত, তখন নাকি বড়জেঠা লুকিয়ে কাঁদতেন।

 

আমারও মন ভাল নেই। একটু বেলা পড়ে এলে ঘাটপাড়ে এসে বসি। মেঘনা নদীর পারে এই যে ঘাট; এটা হলো স্টিমার ঘাট। শুনেছি এই ঘাট থেকে স্টিমারে করে  আমাদের তাঁতের কাপড় আর  নারায়ণগঞ্জ থেকে রং, সোজা কলকাতায় যেত। আমাদের কাপড় আর রঙের ব্যবসা। দাদুভাই আর জেঠা নাকি প্লেনে করে যাতায়াত করতেন। দাদুভাইও অসময়ে চলে গেলেন। ব্যবসাটাও আর আগের মতন নেই।

আর কদিন পরেই দুর্গাপূজা। এবার যেন আর সেই পুজো পুজো গন্ধটাও নেই।

দেশভাগের আগে আমাদের জমিদার বাড়িতে  দুর্গাপুজোয় খুব  ধুমধাম হত। নারায়ণগঞ্জ থেকে পালমশাই এসে জমিদার বাড়ির পুজোমণ্ডপে একমাস ধরে থাকতেন। তৈরি হত উমা মায়ের মাতৃমূর্তি।  খড়ের তৈরি কাঠামোর ওপর দু’বার করে মাটির প্রলেপ দেওয়া হত, হাতের আঙুলের চাপে ফুটে উঠত দেবীরূপ। এসব গল্প আমার শোনা। তখন আমি যে খুব ছোট। মায়ের সঙ্গে অবশ্য পুজোর ওই ক’টা দিন ঠাকুরদালানে যেতাম। সারাদিন ছুটে ছুটে বেড়াতাম। সে আর এখন হয় না। আমার মতন তের চোদ্দ বছরের মেয়েরা বাড়ির বাইরে খুব সাবধানে পা ফেলি। কীসের একটা অজানা আশংকায় আজকাল যেন সবাই কেমন ভীত হয়ে থাকে।

 

আমি তবু বিকেল হলে নদীর কাছে আসি। নদী যে আমার খুব প্রিয়। এই মেঘনা নদীর ছলাৎ ছলাৎ শব্দ , নৌকার দুলুনি আমাকে বেশ আচ্ছন্ন করে দেয়। নদীর জলে আকাশের নেমে আসা, সূর্যের ডুব দেওয়া, এই সব আমায়  বড্ড টানে।

বানের জল এলে নদীটা ফুঁসে ওঠে। আর বর্ষা এলে দুই কুল ছাপিয়ে জল দৌড় দেয় গৃহস্থের বাড়ির উঠোনে। তখন চাষের বিস্তীর্ণ জমি, নিচু জায়গা, পাটখেত এমনকি গৃহস্থের বাড়ির উঠোনেও জল থৈ থৈ করে। প্রায় সব বাড়িতেই গোড়ালিডোবা জল । একটা লাঠি নিয়ে আগাছা ভেঙে সরিয়ে সরিয়ে চলতে ফিরতে হয়। তারপর শরতের মেঘ যখন আকাশে ভেসে বেড়ায়, নদীটাও তখন বেশ শান্ত হয়ে পুজোর আনন্দে মেতে ওঠে। আমি নদীর দিকে তাকালাম। নদীর জলে আমার কিশোরী মুখ দেখে চোখে জল এল। কে ভাগ করল দেশটা? কেন? আমি কেন চলে যাব ভিন দেশে? আমাকে  তো কেউ জিজ্ঞেস করেনি? নীলুচাচাও তো বলেছিল তাঁকেও নাকি কেউ জিজ্ঞেস করেনি । কিন্তু দেশ তবু দু-ভাগ হল।

 

এ গাঁয়ে সবাই জেঠাকে বড়বাবু আর জেঠিকে বড়মা বলে। নীলুচাচাও তো বলছিল সেদিন, বড়বাবু আর বড়মা না থাকলে তিনিও থাকবেন না। কী কাণ্ড! এসব হিসেব আমার মাথায় কিছুতেই ঢোকে না। তবু যেন কেমন দুশ্চিন্তা হয়! কেমন মন খারাপ করে!

 

 

এ গাঁয়ে প্রায় সবাই পুজো এলেই নিজের সামর্থ অনুসারে টুকটাক ঘরের সারাই বাছাইয়ের কাজ সারেন। কেউ টিনের দেওয়ালের নিচের দিকে আলকাতরার প্রলেপ দেন, যাতে বৃষ্টিতে টিনের ক্ষতি না হয়। যে কয়ঘর হিন্দু আছেন, তাঁদের মধ্যেও যেন থাকি কিনা থাকি না ভাব। উৎসবের আনন্দও যেন তেমনভাবে ছোঁয় না। তবু কেউ কেউ টিনের চাল পাল্টায় , কেউ বা ভাঙা টালি পাল্টিয়ে নতুন টালি লাগায়। নরেনকাকা ঘরামীর কাজ করেন। তিনি সমুদের চালের টালি পাল্টাচ্ছিলেন আর আপনমনে গান গাইছিলেন,

দুঃখের দেশে দুঃখের নদী

কাইন্দা বইয়া যায়,

সুখের জ্বালায় মনমাঝি তুই

কাঁদস আরে হায়…

এ গান শুনে মনের ভেতর কেমন যেন একটা কষ্ট পাক দিয়ে ওঠে। সেই কষ্ট কান্না হয়ে চোখ ভিজিয়ে দেয়। আমি যে কখন হাঁটতে হাঁটতে নদীর পাড় ছেড়ে বোসপুকুরের দিকে চলে এসেছি খেয়ালই নেই। হঠাৎ চমক ভাঙে, কুলসুম চাচী পিঠে হাত রাখে আমার। বলে – কান্দিস না রে ময়না। মন খারাপ করিস না। সুদিন আমাগো ঠিক আইব দেহিস। কুলসুম চাচী উঠোনে মাছ শুকনো করছিল। ভাদ্রের চড়া রোদে ছোট চাপিলা মাছ শুকিয়ে নিলে বেশ কিছুদিন থাকে। পাশে মাটির হাড়ি খানকতক। নোনা ইলিশ তৈরির পর্ব চলছে। কুলসুম চাচী এই অঞ্চলে সবচেয়ে ভাল নোনা ইলিশ তৈরি করতে পারে। চাচীর শ্বশুর রশিদ মিঞা সেই মাছের হাঁড়ি নিয়ে দূরদূরান্তে চলে যায়। দেশভাগের আগে নাকি হুগলি জেলার শ্রীরামপুর-শেওড়াফুলি অঞ্চলে বিক্রি করতে যেতেন। ওঁদের নাকি বেশ কিছু আত্মীয় আছেন ওদিকে। এখন তো আর ওদিকে যান না!

আমি একটা ছোট্ট জলচৌকির ওপর বসলাম। নাকে মাছের গন্ধ। এ গন্ধ আমার চেনা। এখন আর নাকে আঁচল চাপা দেই না। প্রাণ ভরে দেশের গন্ধ নিয়ে নেই। জানি আমাদেরও চলে যেতে হবে। আমি চাচীকে বললাম যে আজকের ওই পোস্টারটা জেঠার মনোবল ভেঙে দিয়েছে খুব।

 

কুলসুম চাচী বিধবা। প্রায় বছর পাঁচেক আগে ওঁর বর মারা যায়। দুজনেরই বয়স তখন পঁচিশ ছাব্বিশ। কুলসুম চাচীর যে কেন আর নিকা হল না কে জানে! দেখতে ভারী সুন্দর তাকে। ঠাকুমা বলেন কুলসুমের শরীরের বাঁধন ভারী সুন্দর। একদম পেটানো, শক্তপোক্ত। সেই থেকে শ্বশুরঘরে ঘানি টানছেন তিনি। সারাদিন প্রচুর কাজ থাকে চাচীর। আমি তো তাকে কোন সময়ই বসে জিরোতে দেখি না। তাছাড়া ওদের বাড়িতে তো অনেক লোক! আমি একটু বসে এবার উঠে পড়লাম। দু’পা এগোতেই দেখি বৈষ্ণব দিদি একটা টিনের ছোট বাক্স নিয়ে ঘাটের দিকে চলেছেন। আমাকে দেখে হাসলেন। শুষ্ক হাসি। আমি বললাম,

– দিদি যাও কই?

– এদিকে আর থাকন যায় না বুইন। পশ্চিমারা তো হিন্দু মুসলমান কাউরেই ছাড়তাসে না। কোলে কাপড়ে জড়ানো পিতলের শ্রীকৃষ্ণ। তিনি বললেন –  যাই গা নবদ্বীপে। নামগান কইরা একটা পেট চালাইয়া লইমু।

আমার যেন কেমন শূন্য লাগে। এইসময় পশ্চিমদিক থেকে একদল লোক এই ঘাটপাড়ের দিকে আসছিলেন। একটু কাছে আসতেই দেখলাম ওই দলে বেশ ক’জন বাচ্চা আর মেয়েমানুষ আছেন। বৈষ্ণব দিদিও একটু চলা থামিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। দুজন পুরুষের মাথায় ফেট্টি। হালকা রক্তের দাগ। একজন মহিলা এগিয়ে বৈষ্ণব দিদির কাছে জল চাইলেন। বড্ড কাতর কণ্ঠে বললেন – একটু পানি পামু গো? দিদি তাঁর কমণ্ডলু খুলে জল দিয়ে গান ধরলেন,

 

পিয়াস লাগিয়া জলদ সেবিনু বজর পড়িয়া গেল

জ্ঞানদাস কহে কানুর পিরীতি, মরন অধিক শেল।

 

বললেন বুইন ওরাও বুঝি পুবে চললো! গরিবের কোন জাত নাই!

দিদি এবার গান ধরলেন,

 

কে গো মুরলী বাজায়!

এ ত কভু নহে শ্যামরায়!

ইহার গৌর বরণে করে আলো,

চূড়াটি বাঁধিয়া কেবা দিল!

ইহার বামে দেখি চিকণবরণী,

নীল উয়লি নীলমণি॥

 

এই দেশে এই গাঁয়ে তো আর এমন মানুষ বুঝি থাকবে না কেউ। আমি জানি জেঠা এসব শুনলে কেঁদে ভাসাবেন। বড্ড নরম মনের মানুষ তিনি। আমিও নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালাম।

 

ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামছে। পাটক্ষেতের ওপারে, বুলুদের বাঁশঝাড়ের ওপরে এসে লাল সূর্য যেন থমকে দাঁড়ায়। দূরে আজানের ধ্বনির সঙ্গে সোমনাথের মায়ের শাঁখের শব্দ মিলেমিশে একটা যেন যাই যাই ডাক দিয়ে যায়। আমি কলতলায় দাঁড়িয়ে এসব দেখি। জেঠি ডাক দেন –  ময়না, দেরি করস কেন? জল লইয়া চইলা আয়। সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালবি তো! সব দিকে জেঠির খুব নজর। তুলনায় মা শান্ত। শুনেছি মায়ের বাপের বাড়ি ছিল ফরিদপুরে। রায় উপাধি পাওয়া জমিদার বংশ। অনেক ইস্কুল কলেজ মায়ের পূর্বপুরুষেরা করে গেছেন। তাঁরা সবাই দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গেই ইন্ডিয়ায় চলে গেছেন। যতদিন জমিদারী প্রথা ছিল ততদিন, তারপর আর এমুখো হন নি। মায়ের আপন দুই জ্ঞাতি কাকা ওদেশে আছেন। মাকে এটা সেটা পাঠান। টুকটাক চিঠিপত্র লেখেন।

জেঠিমা উনুন ধরান। মাকে তরকারি কী কী কূটতে হবে নির্দেশ দিয়ে তিনি দুধ জ্বাল দিতে বসেন। বুধিগাই এবেলা প্রায় আধ বালতির বেশি দুধ দিয়েছে।

– জেঠিমা আজ কি পায়েস করবা?

– নারে মা। আইজ রাইতে সবাই দুধ ভাত খাইও। তরকারি শুধু আমাগো মাইয়াগো লাইগ্যা।

– আমি দুধ খামু না। আমার ভাগেরটা নারান-দারে দিও।

– ঠিক আছে। সে হইব খন।

নারান-দা আমাদের ব্যবসার কাজে সাহায্য করেন। বাবা বলেন নারণের মত কর্মচারী পাওয়া মুশকিল। অবিবাহিত  প্রায় বৃদ্ধ নারান-দা আমাদের বাড়িতেই থাকেন। তাকে সবাই দাদা বলেই ডাকে।

নারান-দা জেঠিকে এসে বললেন,

– বড়মা সবাই কইতাসে সামসুরের কথা ওই নুরুল আলীর পোলারা শোনে না। ওরা বড্ড জেদি।

– তাই নাকি রে! তুই ভালো কইরা খোঁজ লইস। আমরা নইলে ইন্ডিয়ায় যাইবার ব্যবস্থা পাকা কইরা লমু। ঘরে এতগুলান যুবতী মাইয়া!

– হ। ওরাই এই পোস্টারগুলা মারতাসে। কেমন জানি ভালা ঠেকতাসে না। গোলমাল হওয়ার ভয় আছে তো মনে হয়। ওরা নাকি যদুবাবুগো ধান কাটা লইয়াও কী সব গোলমাল করতে চেষ্টা করসিল।

– প্রতিবেশীগো লগে বিবাদ কইরা থাকন  যায় নাকি! ধুর , এবার বুঝি শ্রীকৃষ্ণ আর এদেশে রাখব না!

এসব শুনে আমার বুক কাঁপে । শরীর খারাপ লাগে। আমি ঘরে গিয়ে হ্যারিকেনটা জ্বালিয়ে বই নিয়ে বসি। কেন জানি না একটুও পড়ায় মন বসে না।

কুলসুম চাচীর ছোটবোন, নাম পারু, ওর নাকি শাদি। ভারী খুশি কুলসুম চাচী। আমার কাছে খুশিতে কলকল করে কত কথা বললেন। মিরপুরে থাকেন তাঁর চাচা। সেখানে তাঁদের পুকুরে আছে বিরাট বিরাট কাতলা মাছ । তাঁদের টাটকা মাছ আর সবজির অফুরন্ত ভাণ্ডার। সড়কপথে গেলে খরচ বেশি পড়বে তাই তাঁর ইচ্ছে লঞ্চে সদরঘাট, ভৈরবঘাট হয়ে মিরপুরে যাবেন। সত্যি বলতে কী আমি তো তেমন কোথাও যাইনি। শুধু কয়েকবার এক মায়ের জ্ঞাতি আত্মীয়র বাড়ি গোপালদি গেছি। তাই পথঘাট তেমন চিনিও না। আর জলপথে আমার বেশ ভয় লাগে। প্রতি বছর এই পুব পাকিস্তানের কত মানুষ যে নৌকাডুবিতে মারা যায়! যদিও এইদেশের মানুষেরা জলপথে যাতায়াতে খুবই অভ্যস্ত।

আমি ঘাড় নেড়ে সায় দিলাম। ভাবলাম খুশির যাওয়া আর দুঃখের যাওয়ার মধ্যে বিস্তর ফারাক। আমি জিজ্ঞেস করলাম

– চাচী তুমি কি লইয়া যাইবা? বইনেরে তো কিছু দিবার লাগে।

– আমি তো গরিব মাইয়া মানুষ। তোর চাচায় থাকলে নায় অন্য কথা!  আমার চুড়ি ভাইঙ্গা একটা নাকের ফুল বানাইতে দিসি মধু স্যাকরা কাছে। অইয়াই দিমু।

– তাই! ভালা করস। আমারও একখান  নাকের ফুল করতে লাগব।

– তাইলে শিগগির বানাইতে দিও ময়না। শুনতাসি সব সোনারবেনেরা ইন্ডিয়ায় যাইব গা। পাসপোর্ট চালু হইব তো!

– হুঁম জেঠায়ও কইতাসিল। পাসপোর্ট চালু হইলে এই হুরুম দুরুম যাওন আওন বাইর হইয়া যাইব।

কেমন যেন একটা চাপ  চারিদিক থেকে আসছে। আমি চাচীর দাওয়া ছেড়ে বুলাদের বাড়ির দিকে হাঁটা দিলাম।

আজ রোদের তেমন তেজ নাই। আকাশের একদিকে দুই খণ্ড ধূসর মেঘ। একদিকে সাদা আর এক কোণে কালো।  আকাশেও দুই ভাগ! হায়রে! বুলার মা রোদে দেওয়া জামাকাপড় বেশ পাট পাট করে ভাঁজ করে রাখছিলেন। বললেন পিঁড়ি পেতে বসতে। বুলার বাবা কিছুদিন আগেই দেশ ছেড়েছেন। সুবিধামতন পরিবারকে নিয়ে যাবেন। আমি বললাম

– কাকী তোমার মন খারাপ করব না?

– কী আর করা ক দেহি?

– কাকায় কোন পত্র দিসে ?

– হ। তিনি তো ঐখানে চাউলের দোকান দিসেন। খুচরা ব্যবসা।

– তাই বুঝি?

এখানে বুলার বাবা বিজয় সাহার বড় চালের আড়ৎ ছিল। পাইকারি ব্যবসাদার ছিলেন তিনি। ওদেশে গিয়ে হয়ত তেমন সুবিধা করতে পারেননি।

গেটের সামনের স্থলপদ্ম গাছ থেকে দুটো পদ্ম ফুল তুলে আমার হাতে দিয়ে বললেন যে, আমি যেন জলে ভিজিয়ে রাখি, কাল সকালে ঠাকুরকে দিতে পারব। আমি ফুল হাতে নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলাম। মনে হয় বৃষ্টি নামবে। এবার যেন বর্ষা একটু বেশিদিন ধরে থাকছে।

আজ এখনো বৃষ্টি হচ্ছে। সন্ধে হলে ঝিঁঝিঁপোকা আর ব্যাঙের ডাকের সঙ্গে টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার শব্দ হয়। এই ঘরটায় ঠাকুমা শোন। এখন সঙ্গে আমি আর রাঙাদিও শুই । এ ঘরটা অনেক পুরনো । ঘরের খুঁটি শাল কাঠের , তাই বেশ মজবুতও। ওই খুঁটির গায়ে যেন অনেক কথা লেখা! ওই খুঁটি বহু ঘটনার সাক্ষী! ঠাকুমার শাশুড়িমা থাকতেন এই ঘরে। তাই ঠাকুমা এই ঘরটা বদলাতে দেন নি। বাকি ঘরের চেহারা জেঠা পাল্টিয়ে ফেলেছেন।  একটা হ্যারিকেন জ্বালিয়ে ঠাকুমা পা মেলে হাঁটুতে রসুন তেল লাগাচ্ছিলেন। আমি বললাম ,

– জানো ঠাকুমা, কুলসুম চাচীর বইনের নাকি শাদি । চাচী কইতাসিল মধু স্যাকরায় ইন্ডিয়ায় যাইব গা। তুমি যে কইসিলা আমাগো দুই বইনেরে এইবার নাকের ফুল দিবা । তাই কইতাসিলাম…

আমার কথা শেষ করার আগেই ঠাকুমা বলে উঠলেন , এই ছেড়ির পাড়ায় পাড়ায় ঘোরন দেহি কমে না!

– আইজও তুই গেছিলি ওই পাড়ায়!

– তবেই না বুলার-মায় পদ্মফুল দিল।

– তরে না কইসি একা একা ঘুরবি না।

– কেন ? সোনাকাকায় তো কয় চারদিকের খবর নিবা, কাগজ পড়বা। খবর শুনবা। চোখ কান খোলা রাখবা।

– ওই হীরালালেই তর সর্বনাশ করতাসে। তুই কেলাসে ফাস্টো হইয়া মাথা খাইসস অর।

ঠাকুমা গজগজ করে বলতে লাগলেন আমাগো সাহার ঘরে বিদ্যাধরী হইয়া কী হইব? সেই তো ঘরকন্নাই করতে হইব। আমি বললাম, কী যে কও! আমি তো ইস্কুলমাস্টারি করুম। আমার মামার বাড়ির দাদুরা ফরিদপুরে অত ইস্কুল বানাইল কি এমনি এমনি!

হঠাৎ ঠাকুমা আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন বইনেরে এই দেশে আজ আছি কী কাইল নাই , কে কইতে পারে কী হইব। আর তুই স্বপন দেখস মাস্টারনি হবি!

আমার বুকটা হু হু করে উঠল এবার। সত্যিই তো আমি কি স্বপ্ন দেখছি? আসলে আমার মন যেন বাঁধা ওই মেঘনার স্টিমার ঘাটে, ওই জলে ডোবা মাঠে কিংবা ওই জলে ভাসা শাপলা লতায় ।

এক একটা রাত যেন কাটতে চায় না। তবু কেটে যায়। বৃষ্টি ভোরের দিকে কমে যায়। আমি ঘুমিয়ে পড়ি। উঠতে উঠতে বেশ অনেকটা দেরি হয়ে যায়। মা হাঁসগুলোকে খাবার দিতে দিতে বলেন,

– ময়না, বাদামি সাদা ছোপছোপ হাঁসাটা জানস কাইল ঘরে ফিরে নাই। সন্ধে থিকা বৃষ্টি তো, তাই তরে কিছু কই নাই।

– তাইলেও আমারে কইতে হইত।

– একবার যা না মা। দেখ গা, সোনা গো পুকুর পাড়ে ওই কলাবতী ঝোপে আছে নাকি!

– দেখি। যাইব কই? পাইয়া যাইবা।

– যদি ভামে মাইরা দেয়!

মায়ের মুখটা খুব করুণ লাগে। মা একটু নরম মনের । পোষা গাই কুকুর বিড়াল হাঁস টিয়া তাঁর সন্তানতুল্য।

 

এখন সকাল আটটা হবে। আমি সোনাদের বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। পথে সোনাদের আমবাগান পড়ে। তাঁর ভিতর দিয়ে সরু রাস্তা। রাস্তার দুইধারে নাম জানা না-জানা অনেক গাছ। আমি লেবুগাছ চিনি। লেবু পাতা ছিঁড়ে একটু ঘষে নাকে লাগলাম। ভারী মিষ্টি গন্ধ। বাগানের শেষে পুকুর। ওই পুকুরের পাড় ঘিরে কত গাছ! মায়ের মত করে আমিও ডাকলাম  – আয় আয় চৈ চৈ। কিন্তু না ওই হাঁসাটা তো পেলাম না। আমি পুকুরপাড় ধরে এক চক্কর মারলাম। নাঃ। নেই তো!

সোনাদের বাড়িতে যদি যায়, এই ভেবে ওদের বাড়িতে গেলাম। সোনার বড়দিদি লতুদি এসে বলল, হাঁসটা কী আর পাবি? কাইল নদীর পাশে ওই পশ্চিমের পোলাগো দল ফিস্টি করসে। আমি কান চাপা দিলাম। চোখে জল এল। আমাদেরকে এই অঞ্চলের সবাই খুব মান্য করত এতদিন। তবে কি সত্যিই দিন বদলে যাচ্ছে?

চুপচাপ বাড়ি যাবার মেয়ে আমি নই। আমি পশ্চিমপাড়ায় গেলাম। মাঠের কিনারে পোড়া কাঠ, উনুন আর হাঁসের পালক দেখে বুঝলাম কী হয়েছে। সমুকে হাতের সামনে পেয়ে বললাম, কইতে পারতি একবার, তগ পয়সা নাই! মাংস কিনার পয়সা আমিই দিতাম। শেষে কিনা আমাগো হাঁসটারে চুরি কইরা খাইলি?

ভ্যাবাচ্যাকা সমু বলতে চেষ্টা করল যে, ও জানত না । আমি মুখ ঘুরিয়ে হাঁটা দিলাম।

বাড়ি ফিরে আমার খুব শরীর খারাপ করতে লাগল। মা দুবার জিজ্ঞেস করে উত্তর না পেয়ে যা হোক কিছু বুঝে বা না বুঝে চুপ করে গেল।

গ্রামদেশে দুস্টু ছেলেরা  হাঁস মুরগী চুরি করে খায়, এ খুব চেনা চিত্র। কিন্তু আমার দাদু প্রাণবল্লভ সাহা, জেঠা ফণীভূষণ সাহার বাড়ির হাঁস কেন, একটা গাছের গায়েও না জিজ্ঞেস করে কেউ হাত দেয় না। এই সম্মান আমার ঠাকুমাও যত্নে রক্ষা করেন। তাই এই ঘটনাটা বড্ড ব্যথা দিল বাড়ির মেয়ে পুরুষ সকলকে। বেদনার সঙ্গে চাপা ভয় সকলের চোখে মুখে। এর মধ্যে নারানদা এসে এক ভয়ংকর দুঃসংবাদ দিলেন। কুলসুম চাচীকে নাকি কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সে তাঁর বোনের বিয়েতে উপস্থিত ছিল না। এই নিয়ে বেশ একটা শোরগোল পড়ে গেল এই অঞ্চলে। নানান রকম গুনগুনানি। আসলে এই ঘটনা আগে কখনও ঘটে নি। এর মধ্যে আর একটা খবরে জেঠা খুব ভয় পেয়ে গেলেন। কামারপাড়ার দুলালকেও নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ কেউ বলতে লাগলেন কুলসুমের সঙ্গে দুলালকে নাকি এদিক সেদিক অনেকেই দেখেছেন। দুলাল কুলসুমকে ফুসলিয়ে ইন্ডিয়ায় পালিয়ে গেছে, এমন খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে লাগল। জেঠা এসব শুনে বারবার আপন মনে বলতে লাগলেন – দুলাল এইডা কী করল! এই লইয়া পূজার পর গোলমাল না লাগে। সত্যি মিথ্যা কেডায় যাচাই করব। দুস্টু লোকের ভারী বইয়া গেসে।

 

আজ নবমী । এমন ফ্যাকাসে দুর্গোৎসব এ অঞ্চলে আগে কেউ দেখেনি। পুজোর পরে একটা বড় গোলমাল লাগতে পারে এমন একটা খবরে যেন বাতাস ক্রমশ ভারী হয়ে উঠছে। জেঠা সব ভাইদের নিয়ে ঠাকুমার ঘরে বসেছেন। বললেন, আমি সব ব্যবস্থা কইরা লইসি , হাতে দুই দিন সময় তাড়াতাড়ি খুব দরকারি জিনিস গোছগাছ কইরা লও মা। তোমার বৌমাগোরে দেখাইয়া দাও। ওই দেশে চান্দাকাকায় সব ব্যবস্থা করব কইসে। আপাতত আমরা মেজবউয়ের জ্ঞাতির বাড়িতে একতলায় ভাড়া উঠুম।

জেঠি বা সোনাকাকিকে নয়, সমস্যা মেজবউ মানে আমার মাকে নিয়ে, সে তাঁর গাই কুকুর বিড়াল হাঁস এসব ছেড়ে গোপালদি যেতেই চায় না, তো ইন্ডিয়ায়!

আজ নরেনকাকা এসেছেন। ঠাকুমা বললেন, নরেন আজ তো কোন কাম নাই, তুই বরং এক কাম কর , একখান গান ধর। কাকা গাইলেন,

 

যোগী হে কে তুমি হৃদি-আসনে

বিভুতিভূষিত শুভ্র দেহে,

নাচিছ দিক বসনে

 

এ গান নাকি রবি ঠাকুর মানুষের মঙ্গল কামনায় শিবের উদ্দ্যেশে লিখেছেন। নরেন কাকা বললেন  – হে প্রভু তুমি সকল বিষ কন্ঠে ধারণ করে মানুষকে শান্ত কর। হঠাৎ দেখি আমার মায়ের দুচোখে জল। মা আঁচলে মুখ মুছে বললেন – ঠাকুরপো , আপনে আমাগো হাঁসগুলানরে দেইখেন।

 

আজ দশমী।  সকালে উঠে মা আমাদের এক জ্ঞাতি কাকিকে ডেকে বাকি পশুপাখিদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন। তারপর বসে বরণকুলো সাজিয়ে সোনাকাকীকে বললেন,

– চ রে, আইজ বেলাবেলি মায়েরে বরণ কইরা আসি।

– হ মেজদি চলো। এবারই তো এই দেশে , জানিনা সামনের দশমীতে কোথায় থাকুম।

আমিও সঙ্গে গেলাম। উমা মায়ের মুখে পান পাতা বোলাতে বোলাতে মা হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলেন। বললেন , আবার আইস্য মাগো। খালি আমিই থাকুম না। তুমি মা পোলাপান লইয়া শূন্য বাপের ঘরে… বলেই মা অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। কানে বিজলিকাকুর ঢাকের মৃদু শব্দে বিদায়ের সুর শুনতে শুনতে আমিও নাকি মূর্ছা গেছিলাম।

তারপর বাড়ির বারান্দায় বসে মা মেয়ে জড়াজড়ি করে মনের কষ্ট কমাবার চেষ্টা করেছি গোটা দিনভর।

পরদিন ভোরে, এ গাঁয়ের এককালে সুপ্রসিদ্ধ সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী ফণীভূষন সাহা তাঁর গৃহদেবতা রাধামাধবকে সঙ্গে নিয়ে সপরিবারে নৌকায় চড়লেন। পিছনে পড়ে রইল পিটুলীগোলায়  লক্ষ্মীর পায়ের চিহ্ন আঁকা উঠোন, বাঁধানো তুলসীমঞ্চ, আরও কত কী !

 

হাপুসনয়নে কাঁদছেন আমার মা, আর নদীর পারে বিদায় জানাতে আসা অনেকের মাঝে প্রিয় সখী জ্ঞাতি-জা, ফুল-কে বলছেন,

– ফুলরে, তুই কিন্তু বোইন সন্ধ্যাবেলায় আমার তুলসীতলায় একটু প্রদীপের আলো দেখাস, পাশে হরির থানেও একটু প্রদীপ জ্বালাইয়া দিস।

– রাঙাদি তুমি চিন্তা কইরো না। আমি আছি যতদিন, ততদিন তুলসীতলায় ঠিক বাতি জ্বালুম।

নৌকাটা ঘাট ছেড়ে আস্তে আস্তে দূরে চলল, ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে মায়ের প্রিয় সখী ফুল ,আমার প্রিয় বন্ধু বুলা, প্রিয় প্রতিবেশী,  গাছপালা, পাটক্ষেত, আমবাগান। আমার চোখ হঠাৎ গিয়ে পড়ল মেঘনার জলে, দেখলাম  চোখের জলে মাখামাখি বিষাদ ভরা, প্রিয় সব কিছু ফেলে আসা নিজের দুঃখী মুখ। চললাম, প্রিয় নদী, সেই ভিন দেশে।

[মতামত ও বানানবিধি লেখকের নিজস্ব]

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ