সেবার ভাদ্রমাসে জেঠিমা শৈলবালা খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বাড়ির সক্কলের তিনি বড়-মা। তাঁকে দেখাশোনা করেন আমাদেরই এক জ্ঞাতি পিসি বিনু। সেবার বিনু পিসিও গেলেন তাঁর সতীন-পোর ছেলের মুখে ভাতে। বাড়িতে সেরকম দেখভাল করার লোক নেই। বড়মা শৈলবালা মানুষটা আবার তেমন সুবিধের নয় বলে কাজের মেয়ে হরিদাসী কাছে ঘেঁষে না। পান থেকে চুনটি খসার জো নেই। তারওপর আঁশ নিরামিষের বড্ড বাতিক।
পুজোর মুখে কত কাজ ; জামা কাপড়ে রোদ লাগানো। ঠাকুর দালানের উঠোনে গোবর নিকোনো। নারকেল গাছ থেকে নারকেল পেড়ে তা থেকে আবার বেছে গুছিয়ে বিয়াই বাড়িতে পাঠানো। এসব ফেলে শৈলবালার বিশ্রাম নিতেই মন চায় না, আর সেই তিনিই কিনা বিছানা নিলেন!
এইসব কাজ কী করে উদ্ধার হবে সেই চিন্তায় আমার মায়ের মুখ শুকিয়ে আমসি। এমনিতে মা আমার বড্ড ভীতু । সব কিছুতেই বড়দি বড়দি করে হেদিয়ে মরে। মা এ-ঘর ও-ঘর ঘুরছে আর বলছে কী করে যে কী হবে !
এইভাবে দিন কয়েক কেটে যায়। বড়মা বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমাকে ডাকেন। আমি তাঁর খুব আদরের। আমি তাই কাছাকাছিই থাকি। জল ওষুধ এগিয়ে দি। আমাকে ডেকে বলেন – মুক্তা তুই একবার বাক্সখান খুইল্যা নীল খাতাটা আনবি? আমি নিয়ে আসি। বড়মা বলেন একাশি পাতা খোল দেখি। খুইল্যা পড়। বুঝলাম এখাতার সব পাতা তাঁর মুখস্ত। এ খাতাটা তো কোন দিন হাত দিতে দিতেন না ! আজ যে নিরুপায়।
আমি পড়তে শুরু করি – নবদ্বীপের ভট্টাচার্যবাড়ি। জমিদার বাড়ি। বহু বছর ধরে হয়ে চলেছে এই বাড়ির পুজো। আসলে এই পুজোর একটা রহস্য আছে ! এখানে মায়ের গায়ের রং লাল। বলা হয়, বহু বছর আগে একবার মায়ের পুজোর সময় চণ্ডীপাঠ ভুল হয়েছিল। তখনই নাকি দেবীর গায়ের রং লাল হয়ে যায়। কার্তিক এবং গণেশ নিজেদের স্থান পরিবর্তন করে ফেলেন। মা শুধু লালই হয়ে যান না, মায়ের মুখ দক্ষিণ দিকে ঘুরে যায়।
আমার বড়মা লেখাপড়া জানেন অল্পই। এ তাঁর নিজের লেখা। এ খাতায় বিভিন্ন পুজোর নিয়ম রীতি লেখা আছেন এটা জানতাম। কিন্তু এসব তথ্য যে তিনি লিখে রেখেছেন তা জানতাম না। জানব কি করে? তিনি তো ধরতে দিতেন না।
তাঁর দেবদ্বিজে ভক্তি বলার অপেক্ষা রাখে না। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
– বড়মা ওখানেই মানে নবদ্বীপে তোমার বাপের বাড়ি ছিল তাই না?
– হ। আমার বাপে আর মায় তো বাংলাদেশ থিক্কা ঐখানেই আইয়া উঠসিল। কত কষ্টে ঘর বানাইসিল। আমি তো পূজা আইলেই ভট্টাচার্য বাড়ির ঠাকুর দালানে বইয়া ঠাকুর বানানো দেখতাম। কাউরে কইস না যেন! আমি তখন সাত কী আট বছরের হমু, পাল দাদু কইল এইবার মায়ের মুখটা তর মতো হইসে বইন!
– তুমি তো সত্যিই প্রতিমার মতো সুন্দর বড়মা! তুমি কি একবার যেতে চাও?
– এইবার যামু ভাবসিলাস! কী জানি পারুম কি না!
– কেন পারবে না? নিশ্চয়ই পারবে।
বললাম তো কিন্তু এমন অসুস্থ হয়ে পড়তে ওই মানুষটাকে কোন দিন দেখি নি। আমারও খুব মন খারাপ হয়ে গেল।
তিনি আমার গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন আইজ থিকা এই খাতাটা তুই রাখ।
আজ পয়লা আশ্বিন। ডাক্তারবাবু জবাব দিয়ে গেছেন। এ বাড়ির বড়মা, দাপুটে শৈলবালা মিশে গেছেন যেন তোষকের সঙ্গে। সাদা ধবধবে চাদরে ঢাকা বড়মার মুখটা দেবীর মতো সুন্দর লাগছে যেন! রাতে আজ আমি থাকছি এ ঘরে। অনেক রাত এখন । আকাশে বাঁকা চাঁদের আলো এসে পড়েছে তার মুখে। এ আমি কী দেখলাম! যেন নীল খাতায় লেখা লাল হয়ে যাওয়া সেই ভট্টাচার্য বাড়ির দেবীর মুখ বড়মার মুখে বসানো!
ভোর রাতে বড়মা চলে গেলেন। সবাইকে সময় মতো ডেকে এনেছি আমি। সামনেই দুর্গা পূজা। আমি জানি এ আমার ভ্রম । হয়ত অল্পক্ষণ ঘুমলাগা চোখে দেখা স্বপ্ন। তবু ভাবতে খারাপ লাগছে না আমাদের বড়মা মা দুগ্গার কাছে কৈলাসে যাত্রা করেছেন।
[মতামত ও বানানবিধি লেখকের নিজস্ব]
Tags: গল্পের সময় ব্লগ, নীল খাতা, রূপা সেনগুপ্ত
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।