।। ১ ।।
গ্রেট ম্যাজেস্টিক সার্কাসে কারান্ডিকারের বাঘের খেলা দেখে বেরিয়ে ফিরতে ফিরতে ফেলুদা জটায়ুকে বলল-
আপনার কি কলকাতায় ফেরার খুব তাড়া আছে?
লালমোহনবাবু প্রায় অন্ধকার রাস্তায় খানাখন্দ বাঁচিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তখন নিচুস্বরে ‘আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায়’ গানটা গুনগুন করছিলেন। ফেলুদার প্রশ্নে গান থামিয়ে একটু ভেবে বললেন ‘বরং আগামীকাল কলকাতা ফিরে যেতে হবে ভেবেই মনটা খারাপ লাগছে মশাই। কেন বলুন তো?
না তাহলে একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে একটু দেখা করে যেতাম। হাজারিবাগ থেকে গাড়িতে যেতে ঘণ্টা দুয়েক মত লাগে। সঙ্গে যখন গাড়ি এবং হরিপদবাবু দুজনেই আছেন তখন একটা চান্স নিলে মন্দ হয় না।
‘ইনি কি আপনার পরিচিত কেউ’ প্রশ্ন করলেন জটায়ু।
হ্যাঁ পরিচিত তো বটেই, হয়তো আপনারাও তাঁকে চেনেন, কিন্তু মুখোমুখি আলাপ হয়নি কোনদিন।
‘আপনি কার কথা বলছেন বলুন তো’? এবার জটায়ুকে বেশ কৌতূহলী বলে মনে হয়।
সেটা ক্রমশ প্রকাশ্য। আগে বলুন আপনি যেতে রাজি আছেন কিনা।
সে আর বলতে! আপনার সঙ্গে খোদ মগনলালের ডেরায় অবধি গিয়ে ঢুকলুম আর এতে আপত্তির কি থাকতে পারে বলুন?
যাক এটা তাহলে ফাইনাল। আমরা কাল সকাল ঠিক সাতটার মধ্যে বেরিয়ে পড়ছি, আশা করা যায় নটার ভেতর পৌঁছে যাব।
আমরা আধঘণ্টা হল হাজারিবাগ ছেড়ে এন এইচ ১২২এ ধরে পূর্ব দিকে চলেছি। ফেলুদা বসেছে সামনে, হরিপদবাবুর পাশে, আমি আর লালমোহনবাবু পিছনে। একটু আগে উনি ফিসফিস করে আমাকে বললেন ‘তোমার দাদা বোধহয় রাঁচির পাগলাগারদ দেখতে যাচ্ছেন’। হরিপদবাবুকে দেখলাম কোন নির্দেশ দেওয়ার দরকারই হচ্ছে না। বুঝলাম যা বলার ফেলুদা আমরা গাড়িতে ওঠার আগেই বলে দিয়েছে।
একটা ল্যাবেঞ্চুস মুখে ফেলে একটু নাটকীয় ভাবেই এবার জটায়ু বললেন-
‘আমি কোন প্রশ্ন করবো না , শুধু একটি কথা বলবো, পারি’?
মুচকি হেসে ফেলুদা বলল ‘পারেন’।
যেখানে যাচ্ছেন সেখানে যদি বিপদের আশঙ্কা থাকে তাহলে উপযুক্ত অস্ত্রটি আশাকরি সঙ্গে আছে, কারণ আমি এবার সম্পূর্ণ নিরস্ত্র।
‘লালমোহনবাবু আমরা যেখানে যাচ্ছি সেখানে বিপদের আশঙ্কা নেই। আর থাকলেও তাকে মোকাবিলা করবার মত ঢের বেশি শক্তিশালী অস্ত্র সেখানে আছে’।
-আপনি কি মগজাস্ত্রের কথা বলছেন ফেলুবাবু?
-না আমি হাতিয়ারের কথাই বলছি। তবে যার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি তার মগজাস্ত্রের ক্ষমতা আমার চেয়েও বেশি।
‘বলেন কি মশাই! আপনার থেকে মগজাস্ত্রের জোর বেশি এমন লোক তো ভূভারতে আছে বলেই জানতুম না, এই তল্লাটে সে লোক কেমন করে আসবে বলুন তো’?
‘আছে আছে’ ফেলুদা এবার সোজা হয়ে বসে বলল। আর তাঁকে আপনারাও ভাল ভাবেই চেনেন।
‘কে বলুন তো’?
‘লালমোহনবাবু আমরা এখন যাচ্ছি গিরিডি। বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক প্রোফেসর শঙ্কুর সঙ্গে দেখা করতে’।
‘অ্যাঁ প্রোফেসর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু’!! জটায়ুর চোখ কপালে উঠে গেল।
।।২ ।।
এন এইচ ১২২এ ধরে আমরা যখন গিরিডির কালীবাড়ির সামনে পৌঁছলাম তখন ঘড়িতে সকাল সাড়ে নটা। এই রাস্তা সোজা বারগান্ডা ব্রিজের ওপর দিয়ে উশ্রি নদী পেরিয়ে চলে গেছে গিরিডি কলেজের দিকে। আরও খানিকটা এগিয়ে যেতেই বাঁ দিকে একটা বড় রাস্তা পড়ল যার নাম স্যার জগদীশচন্দ্র বোস রোড। রাস্তার মোড়ে ফেলুদার ইশারায় হরিপদবাবু গাড়িটা একপাশে দাঁড় করালেন। একটা চায়ের দোকানের সামনে কয়েকজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে চা খেতে খেতে গল্পগুজব করছিলেন। এঁদের দেখে বাঙালী বলে চিনে নিতে কোন অসুবিধে হয় না। ফেলুদা তাদের দিকে এগিয়ে যেতেই একজন বলে উঠলেন –
প্রোফেসর শঙ্কুর বাড়ি খুঁজছেন তো? কোন কাগজের রিপোর্টার আপনি?
ফেলুদা সামান্য অপ্রস্তুত হয়ে ফের নিজেকে সামলে নিয়ে বলল –
প্রোফেসর শঙ্কুর বাড়ি খুঁজছি এটা আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন, কিন্তু আমি কোন কাগজের রিপোর্টার নই, অন্য কারণে একটু ওঁর সঙ্গে দেখা করবার দরকার ছিল।
‘ও আচ্ছা। তা উনি থাকেন সরস্বতী শিশু বিদ্যামন্দির নামে একটা স্কুল আছে তার কাছেই, উশ্রি নদীর দিকটায়। আপনারা এই রাস্তা ধরে সোজা চলে যান, তারপর …’
‘আপনারা কি শঙ্কু মশাইয়ের বাড়ি যেতে চান’? প্রশ্নটা এল একমাথা সাদা চুল ও মোটা সাদা গোঁফওয়ালা এক প্রবীণ ভদ্রলোকের কাছ থেকে। পরনে ধুতি আর খদ্দরের পাঞ্জাবি। ‘ওঁর বাড়ির কাছেই আমার বাড়ি। আপনাদের আপত্তি না থাকলে আমিই সঙ্গেকরে নিয়ে যেতে পারি ।’
‘তাহলে তো আমাদের খুবই সুবিধে হয়, আপনি আমাদের সঙ্গে গাড়িতেই আসুন’ বললেন জটায়ু।
এবার ফেলুদা আমাদের সঙ্গে পিছনের সিটে বসলো আর ওই প্রবীণ ভদ্রলোক হরিপদবাবুর পাশে বসে বললেন ‘আপনি সোজা চলুন, নিউ উশ্রি ব্রিজে ওঠার আগেই মোড় ঘুরে ডানদিকের রাস্তাটা ধরবেন ।’
গাড়ি চলতে শুরু করার পর ভদ্রলোক বললেন –
যদি কিছু মনে না করেন আপনাদের পরিচয়টা জানতে পারি?
হ্যাঁ নিশ্চয়ই, আমার নাম শ্রী প্রদোষ চন্দ্র মিত্র, এটি আমার ভাই তপেশরঞ্জন এবং উনি আমাদের বন্ধু শ্রী লালমোহন গাঙ্গুলি।
‘প্রদোষ মিত্র!’ ভদ্রলোকের চোখ কপালে উঠেছে। ‘গোয়েন্দা প্রদোষ মিত্র, মানে আপনিই ফেলু মিত্তির! বলেন কি মশাই! নমস্কার। আপনারা নিশ্চয়ই হাজারীবাগ থেকে আসছেন। গ্রেট ম্যজেস্টিক সার্কাসের সেই বাঘ পালানোর কেসটা সল্ভ করে’?
আজ্ঞে হ্যাঁ। কিন্তু আপনি এত খবর পেলেন কি ভাবে?
‘আরে মশাই গত কদিন ধরে এখানকার কাগজে তো ওই একটাই খবর, বাঘ ধরা পড়বার খবরটাও তো বেশ বড় করেই বেরিয়েছে, আর আপনার নামও তো লিখেছে সেখানে । শঙ্কু মশাইকেও তো আমিই পড়ালাম খবরটা। আপনার আশ্চর্য বুদ্ধির খুব প্রশংসা করছিলেন উনি । ’
আপনার পরিচয়টা… ? বললেন জটায়ু ।
‘আমি শঙ্কু মশাইয়ের প্রতিবেশী । বন্ধুও বলতে পারেন। আমার নাম শ্রী অবিনাশ চন্দ্র মজুমদার ।’
‘অবিনাশ বাবু’! আমি আর লালমোহন বাবু প্রায় একসঙ্গে বলে উঠলাম।
আপনিও তো বিখ্যাত লোক মশাই। আপনি আফ্রিকায় শঙ্কু মশাইকে গোরিলার কবল থেকে বাঁচিয়েছিলেন না?
জটায়ুর প্রশ্নে জিভ কেটে অবিনাশ বাবু বললেন ‘ও কিছু না। আফ্রিকা কেন, সমুদ্রের তলায়, তিব্বতে অনেক যায়গাতেই তো যাওয়া হয়ে গেল শঙ্কু মশাইয়ের দৌলতে। আপনিও তো ফেলুবাবুর সঙ্গে কিছু কম ঘুরে বেড়ালেন না। ওহ, থর মরুভূমিতে উটের পিঠে চেপে আপনাদের দৌড় চিরকাল মনে থাকবে মশাই’।
ইতিমধ্যে আমাদের গাড়িটা উশ্রি নদীর কাছে এসে পড়েছিল। অবিনাশবাবু বললেন ‘এইবার ডানদিকে’। নদীকে বাঁয়ে রেখে কিছুটা যাওয়ার পর একটা বড় ইস্কুল পেরিয়ে পাঁচিল ঘেরা লাল রঙের দোতলা বাড়ির সামনে গাড়ি থামালাম আমরা। গেট থেকে দেখা যাচ্ছে ভিতরে অনেকটা বড় বাগান। নানা রকম গাছ রয়েছে তাতে। একটা গুলঞ্চগাছের তলায় ডেক চেয়ার পাতা। অবিনাশবাবু গেট খুলে ভিতরে ঢুকে হাঁক দিলেন –
‘পেল্লাদ আছো ।’
ধুতি আর হাফ হাতা ফতুয়া পরা একজন বয়স্ক মানুষ বাগানের পিছন দিক থেকে বেরিয়ে এসে সামনে দাঁড়ালো।
বলি শঙ্কু মশাই বাড়িতে আছেন নাকি? এঁরা কলকাতা থেকে এসেছেন ওঁর সঙ্গে দেখা করতে।
‘আছেন, তবে উনি তো এখন লাবুটারিতে। দেখা কইরবেন কিনা জানিনে। কি নাম বলবো আজ্ঞে’?
ইতিমধ্যে ফেলুদা পকেট থেকে ওর ভিজিটিং কার্ড বের করেছে। সেটা প্রহ্লাদের হাতে দিয়ে বলল ‘এটা বাবুকে গিয়ে দিয়ে বল আমরা বেশিক্ষন সময় নেব না, একবার দেখা করেই চলে যাব’।
‘আচ্ছা আপনারা ভেতরে বসেন ।’ প্রহ্লাদ আমাদের বৈঠকখানায় বসিয়ে ভিতরে চলে গেল। সাদাসিধে একটা ঘর। একটা টেবিল, কয়েকটা চেয়ার আর একটা বইয়ের আলমারি ছাড়া বিশেষ কোন আসবাব নেই ঘরে। ভিতরে যাওয়ার দরজার পাশে দেওয়ালে একটা ছবি টাঙানো রয়েছে, বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক আলবার্ট আইনস্টাইনের। বাঁ দিকের দেওয়ালে আর একটা ছবি রয়েছে যেটাকে জটায়ু ‘হিজিবিজি’ বলে বললেও ফেলুদা বলল ওটা বিখ্যাত আমেরিকান অ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিস্ট শিল্পী জ্যাকসন পোলকের আঁকা।
‘আপনারা একটু বসেন, বাবু হাতের কাজটা শেষ করেই আসতিচেন’। ট্রেতে করে জলের গেলাস নিয়ে ঘরে ঢুকে বলল প্রহ্লাদ। ‘ভাল কথা বাবু আপনাদের আজকে দুপুরে এইখানেই খেয়ে যেতে বলেচেন । আপনারা আজ্ঞে দুপুরে ভাত খায়েন না হাত রুটি, তাহলে সেইমত ব্যবস্থা করিগে। আর অবিনাশবাবু আপনিও বাড়িতে একটা খবর পাঠায়ে দ্যান, দুপুরের খাওয়া আজ এইখানেই’।
।।৩।।
‘আচ্ছা মশাই আইনস্টাইন নামে তো একজন ফিলিম ডিরেক্টারও ছিলেন, তাই না? ওই কিসব জাহাজ টাহাজ নিয়ে ছবি বানিয়েছিলেন’? দেওয়ালে টাঙানো আইনস্টাইনের ছবিটার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন জটায়ু।
‘আপনাকে নিয়ে আর পারা গেল না মশাই! আইনস্টাইন নয়, তার নাম আইজেনস্টাইন, বুঝেছেন’।
‘অ আইজেনস্টাইন’ জটায়ু নামটা দুবার বিড়বিড় করে নিলেন।
‘জাহাজ নিয়ে বায়স্কোপ? টাইটানিকের কথা বলছেন তো, সেই সমুদ্রে জাহাজ ডুবে যাবে, আমি দেখেছি ওটা, খাসা ছবি’ বললেন অবিনাশবাবু।
ফেলুদা কিছু বলার আগেই বাইরের বারান্দায় একটা কর্কশ কণ্ঠস্বর শোনা গেল –
‘খাসা ছবি … আপনাকে নিয়ে আর পারা গেল না মশাই’
লালমোহনবাবু দরজা দিয়ে বাইরে উঁকিদিয়েই চেঁচিয়ে উঠলেন ‘ওরে বাবা এটা আবার কি’? আমিও বেরিয়ে এসেছিলাম। সামনে তাকিয়েই আমার চোখ ঝলসে গেল। একটু সামলে নিয়ে বুঝতে পারলাম ওটা একটা রঙবেরঙের ঝলমলে পালকওয়ালা প্রকাণ্ড পাখি। একটা ম্যাকাও! কখন জানি এসে বসেছে বারান্দায় রাখা দাঁড়ের ওপর। আর কোন সন্দেহ নেই কথাগুলো ওই পাখির মুখ থেকেই বেরিয়েছে।
পাখিটা লালমোহনবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল ‘বুয়েনা দিয়া’।
ও আপনাকে গুড মর্নিং বলছে, পিছন থেকে ফেলুদা বলল ।
লালমোহনবাবু কিছু বলার আগেই আমরা ভিতরের ঘর থেকে চটি পায়ে হেঁটে আসার শব্দ শুনতে পেলাম আর তার পরমুহূর্তেই দরজা দিয়ে ঘরে এসে ঢুকলেন প্রোফেসর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু। অবিকল সেই চেহারা। সেই টাক, সাদা দাড়িগোঁফ, চশমা। ঘরে ঢুকেই তিনি সোজা এগিয়ে গেলেন ফেলুদার দিকে। দার্জিলিঙে রাজেনবাবুর পরে এই প্রথম ফেলুদাকে দেখলাম শঙ্কুকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে। শঙ্কুও ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে পিঠ চাপড়ে দিলেন।
ফেলুদার সঙ্গে শঙ্কুর দেখা হওয়ার মুহূর্তটা নিয়ে আর একটু নাটকীয় ভাবে লেখার ইচ্ছে আমার ছিল। কিন্তু ফেলুদা এমন ধমক দিল যে সেটা আর লিখছি না। ও বলল-
‘পাঠককে স্পেস দিতে শেখ। আমার সঙ্গে প্রোফেসর শঙ্কুর দেখা হওয়ার মুহূর্তটা নিয়ে সব পাঠকেরই কিছু নিজস্ব কল্পনা আছে। তাদের সেটা নিজেদের মতকরে ভিস্যুয়ালাইজ করে মজাটা পেতে দে। সব কথা তুই লিখে দিস না ।’
ফেলুদার দেখাদেখি আমিও ঢিপ করে একটা প্রনাম সেরে নিলাম, জটায়ু হাত জোড় করেই কাজটা সারলেন। আমরা প্রণামপর্ব শেষ করে চেয়ারে বসার পরে প্রোফেসর শঙ্কু বললেন –
‘আপনাদের হাজারিবাগে আসার খবরটা আমি কাগজে পড়েছি। তখনই মনে হয়েছিল যে আপনারা হয়ত একবার গিরিডিতে এলেও আসতে পারেন। না এলে অবিশ্যি আমাকেই যোগাযোগ করতে হত, কারণ আপনার সঙ্গে মতবিনিময় এবং পরামর্শ করবার করবার জন্য আমিও একই রকম আগ্রহী। কিন্তু আজ সকালে পাওয়া একটা চিঠি থেকে নিশ্চিত হলাম যে আপনারা গিরিডিতে আসছেনই । কাজেই যদি মনে হয় আপনাদের আগমন আমার কাছে অপ্রত্যাশিত, তাহলে সেটা ঠিক নয় ।’
ফেলুদা দেখলাম বেশ অবাক হয়েছে। ও বলল –
‘প্রথমত আমাকে আপনি না বলে তুমি বললে খুব খুশি হব, দ্বিতীয়ত এই চিঠির ব্যাপারটা যদি আর একটু খুলে বলেন, কারণ গিরিডি আসছি বলে তো কোন চিঠি আমরা পাঠাই নি, তাছাড়া এই আসার সিদ্ধান্তটাও নেওয়া হয়েছে কাল রাত্রে, সেক্ষেত্রে ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই রহস্যজনক বলে মনে হচ্ছে’।
শঙ্কু একটু হেসে বললেন –
‘বেশ বেশ। আসলে আজ সকালে মাকড়দা থেকে একটা চিঠি পেয়েছি। শ্রীমান নকুড় চন্দ্র বিশ্বাসের। চিঠিটা খুব ইন্টারেস্টিং। সেখানে নকুড়বাবু তোমাদের আসার খবর তো আগাম জানিয়েছেনই, সেই সঙ্গে মজা করে লিখেছেন আমাদের দুজনের মধ্যে একটা নামের মিল উনি খুঁজে পেয়েছেন। আমার ডাকনাম তিলু আর তোমার ডাকনাম ফেলু। নকুড়বাবু লিখেছেন ‘ফেলুবাবু আর তিলুবাবুর এই অবিস্মরণীয় সাক্ষাতকার দৃশ্য স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করিবার নিমিত্ত সশরীরে গিরিডিতে উপস্থিত থাকিবার পরিকল্পনা করিয়াছি’। কাজেই আমরা এক্সপেক্ট করতে পারি নকুড়বাবুও যে কোন মুহূর্তে এসে পড়তে পারেন।
‘উরিব্বাস এ তো ঐতিহাসিক ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে মশাই’! লাফিয়ে উঠলেন জটায়ু।
ইতিমধ্যেই প্রহ্লাদ কফি নিয়ে এসেছিল। সেটা শেষ করে অবিনাশবাবু বললেন –
‘তিলুবাবু ও ফেলুবাবু এখন আমি উঠি, কারণ আমাকে একবার ব্যাঙ্কে যেতে হবে, কাজ মিটিয়ে স্নান সেরে আমি আবার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই এসে পড়বো। আপনারা ততক্ষন কথাবার্তা বলুন’।
‘সেকি মশাই! আপনি চললেন নাকি? আপনার সঙ্গে দেখা হওয়াটাও তো আমার কাছে কম স্মরণীয় ঘটনা নয়’।
বৈঠকখানা থেকে বাইরে যাওয়ার দরজার ঠিক সামনেই মুখোমুখি হয়ে গেলেন অবিনাশবাবু এবং নকুড়বাবু।
।।৪।।
‘তোমাদের এক অতি পরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে সম্প্রতি’। কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে সেটাকে টেবিলে নামিয়ে রেখে বললেন প্রোফেসর শঙ্কু।
‘আপনি কার কথা বলছেন’?
শঙ্কু মুচকি হেসে বললেন ‘মগনলাল মেঘরাজ’।
‘কিড়িং’ করে একটা শব্দ শুনে বুঝলাম সেটা লালমোহনবাবুর পেয়ালাপিরিচে ঠোকাঠুকি লাগার ফল।
‘আপনার সঙ্গে ওর কি প্রয়োজন থাকতে পারে’? ফেলুদা জানতে চায়।
‘তোমরা তো নিশ্চয়ই জানো যে স্পেনের গ্রানাডা অঞ্চলে মন্টেফ্রিও শহরে আমরা গিয়েছিলাম অ্যালোকেমিক উপায়ে সোনা তৈরি করা যায় কিনা এই বিষয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে। তখন সেখানে সাভেদ্রার তৈরি তিনটে সোনার মূর্তি আমি পেয়েছিলাম। তারমধ্যে কাঠবিড়ালি আর গোলাপটা সন্ডার্স এবং ক্রোলকে দিয়েছিলাম, প্যাঁচাটা আমি সঙ্গে করে ওই অভিযানের স্মৃতি হিসেবে গিরিডিতে নিয়ে আসি। তখন থেকে ওটা আমার কাছেই আছে। কিছুদিন আগে সন্ডার্স লন্ডন টাইমসে আমাদের অভিযানের বিষয়ে একটা ফিচার লিখেছিল। সেখানে লেখার সঙ্গে তিনটে মূর্তির ছবিও ছাপা হয়েছিল। লন্ডনেরই কোন অজানা ক্লায়েন্ট মূর্তিগুলো কিনতে চায়। তারই এজেন্ট হয়ে এই মগনলাল রীতিমত অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল দিন দশেক আগে’।
‘আপনি কি বললেন’?
‘বললাম টাকার দরকার থাকলে সলোমন ব্লুমগার্টেনকে ফরমুলা বিক্রি করে বা অর্গাসকে আমার প্রিয় কাকটি বিক্রি করেও আমি মিলিওনেয়ার হতে পারতাম। তা যখন হইনি তখন এই প্যাঁচাটা সামান্য কিছু টাকার জন্য বিক্রি করে দেব এটা ভাবাই মস্ত ভুল হয়েছে মগনলালের। এও বললাম যে সে একলাখ টাকা অফার করলেও আড়াই লাখ পর্যন্ত দিতে রাজি আছে সেও আমি জানি, কারণ চোখে অমনিস্কোপ থাকায় তার হাতব্যাগের মধ্যে পাঁচটা পাঁচশো টাকার নোটের বান্ডিল আমি দেখতে পাচ্ছিলাম। শেরওয়ানির পকেটে রাখা হার্টের ওষুধের শিশিটার কথাও বললাম’।
তাতে ওর কি রিঅ্যাকশান হল?
‘মগনলাল যে খানিকটা ঘাবড়ে গেছে সেটা বুঝতে পারলাম, তবে তুখোড় লোক তো, প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই নিজেকে সামলে নিল। তারপর অবিশ্যি গলাটাকে একটু খাদে নামিয়ে “শুনুন প্রোফেসর শঙ্কু” বলে আবার শুরু করতে যাচ্ছিল, তা আমি বাধা দিয়ে বললাম যে আমি জানি উনি সবার কাছে জিনিস চেয়ে নেন না, দরকার হলে নিয়ে নেন, কিন্তু আমি আবার চাইলেই সবাইকে জিনিস দিই না, ইচ্ছে হলে না চাইতেও অনেক কিছু দিয়ে দি ।’
শঙ্কু বললেন –
‘শুনুন মগনলালজি, আমার কাছে দু রকম ভ্যানিশ করবার ব্যবস্থা আছে। আপনার হার্টের অবস্থা ভাল নয়, ইচ্ছে হলে আমি আপনাকে আমার মিরাকিউরলের দুটো বড়ি উপহার হিসেবে দিতে পারি যা খেলে আপনার হার্টের সমস্যা ভ্যানিশ হয়ে যাবে, আর যদি গায়ের জোরে আমার কাছথেকে মূর্তিটা আদায় করে নেবেন ভেবে থাকেন তাহলে আপনাকে চিরতরে ভ্যানিশ করে দেওয়ার ব্যাবস্থাও আমার আছে। আপনাকে আমি তিন দিন সময় দিচ্ছি, আপনার কোনটা পছন্দ আমাকে ভেবে জানাবেন’।
‘হুমকি দেওয়ার ব্যাপারটা তো মগনলালের একচেটিয়া বলেই জানতাম। এ তো দেখছি আপনিই উল্টে মাগনলাল কে হুমকি দিয়ে দিলেন’ অবাক হয়ে বলল ফেলুদা।
শঙ্কু মৃদু হেসে বললেন ’আসলে কি জানো ফেলু, আজকাল একটা অদ্ভুত ব্যাপার হয়েছে। কিছু অর্ধশিক্ষিত লোক ততোধিক অশিক্ষিতদের প্রশ্রয় পেয়ে নিজেদের বিরাট ক্ষমতাবান কেউকেটা বলে মনে করছে। এরা এতটাই নির্বোধ যে ক্ষমতার দম্ভে সামনের মানুষটিকে ইনভেরিয়েবলি ইনফিরিওর বলে ধরে নিচ্ছে। ফলে কার সঙ্গে কোথায় বসে এরা কি বলছে সে বিষয়ে আর হুঁশ থাকছে না। আমি যৌবনে জার্মানিতে বসে খোদ গোয়েবলসের মোকাবিলা করেছি। সে অনুপাতে মগনলাল তো চুনোপুঁটি। আমার বাবা আমায় শিখিয়েছিলেন বিদ্যা দদাতি বিনয়ং, তাই আমি কি জানি না জানি এ নিয়ে গর্ব করিনি কখনো। কিন্তু এখন আমার মত পাল্টেছে। এই অর্ধ শিক্ষিত দাম্ভিকদের টের পাইয়ে দেওয়া দরকার যে তোমাকে আমি এতক্ষন টলারেট করেছি এইটাই তোমার সৌভাগ্য, যদি নিজেকে সুপিরিওর ভেবে থাকো তাহলে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে তোমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে আমার এক মুহূর্ত সময় লাগবে না, যা ঘটেছে তোমার পূর্বসূরিদের ক্ষেত্রেও ।’
‘দিন না ব্যাটাকে ভ্যানিশ করে আপনার ওই অ্যানাইহিলিন পিস্তল দিয়ে’ বলে উঠলেন উত্তেজিত জটায়ু।
‘সেটা সম্ভব নয় লালমোহনবাবু’।
কেন?
‘তিন দিন নয়, মগনলাল পরের দিনই জানিয়ে দেয় সে প্যাঁচার মূর্তি চায় না, মিরাকিউরলের বড়ি চায়’।
‘সেই প্যাঁচার মূর্তিটা একবার দেখতে পারি’ বললেন লালমোহনবাবু।
‘যদি শুধু চোখে দেখতে চান তাহলে আমি এখানে বসেই ওটা আপনাদের দেখিয়ে দিতে পারি, কিন্তু হাতে নিয়ে দেখতে চাইলে তিলুবাবুকে কষ্ট করে ওটা ল্যাবরেটারির আলমারি থেকে বের করে নিয়ে আসতে হবে’ বললেন নকুড়বাবু।
‘তোমরা বোসো, আমি আসছি’ বলে শঙ্কু ঘর থেকে বেরিয়ে চলে গেলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফিরে এলেন নিরেট সোনার তৈরি একটা প্যাঁচার মূর্তি হাতে নিয়ে’। আমরা শঙ্কুকে ঘিরে দাঁড়িয়ে মূর্তিটা দেখলাম। লালমোহনবাবু চোখ গোল গোল করে বললেন ‘উরিব্বাস’।
।।৫।।
‘এবার বলুন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইছিলেন কেন? মগনলালকে শায়েস্তা করবার পক্ষে তো আপনি নিজেই যথেষ্ট’। প্রশ্ন করলো ফেলুদা।
‘হ্যাঁ তুমি ঠিকই বলেছ ফেলু, মাগনলাল বা ওর মত লোকেরা আমার কাছে কখনই কোন বড় সমস্যা নয়, কিন্তু এই মগনলালের কাছে এমন একটা জিনিস আছে যেটা আমার পক্ষে তো বটেই গোটা পৃথিবীর মানুষের পক্ষেই এক মারাত্মক বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে’।
কি সেটা?
‘লোভ, মাত্রাতিরিক্ত, বিবেকবুদ্ধি বর্জিত, বল্গাহীন লোভ , আর সেটাকে চরিতার্থ করবার জন্য যেনতেন পন্থা অবলম্বন করার মাত্রাহীন ক্ষমতার দম্ভ’।
‘মগনলালের লোভকে তো আপনি শায়েস্তা করেছেন ।’
‘ঠিক, কিন্তু লোভ জিনিসটাকে তো চিরকালের মত শায়েস্তা করতে পারিনি’
‘লোভ তো মানুষের চরিত্রের একটা অবিচ্ছেদ্য উপাদান, তাকে হয়ত নিয়ন্ত্রনে রাখা যেতে পারে, কিন্তু পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করা কি আদৌ সম্ভব ।’
‘হ্যাঁ সম্ভব সম্ভব সম্ভব’ টেবিলে চাপড় মেরে বলে উঠলেন উত্তেজিত প্রোফেসর শঙ্কু।
কিছুক্ষনের জন্য নেমে এল অদ্ভুত নীরবতা। সেই নীরবতা ভাঙলো বেড়ালের মৃদু ডাকে। আমরা দেখতে পেলাম কখন জানি নিউটন এসে ঢুকেছে বৈঠকখানায় আর গা ঘষছে শঙ্কুর পাতলুনে। হয়তো নিউটনের কারণেই শঙ্কুর উত্তেজনা কমে এল, বেড়ালটাকে কোলে তুলে নিয়ে তার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে তিনি বললেন –
‘তোমরা বায়োকেমিস্ট জন ড্রেক্সেলের নাম শুনেছ’?
‘যিনি সেই প্রাচীন আরবিপুঁথি থেকে পাওয়া ফরমুলা নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছিলেন? পৃথিবীর সুন্দরতম জিনিস তৈরি করবার পরীক্ষা, কিন্তু তিনি তো রহস্যজনক ভাবে মারা যান এবং তাঁর ফরমুলার কি হল সেটাও শেষপর্যন্ত জানা যায়নি। আমার মনে পড়ছে এই জন ড্রেক্সেলের ছেলে আপনার কাছে এসেছিল, কিন্তু তারপর কি হল সেকথা আপনিও আর লেখেন নি, আমরাও জানতে পারিনি’।
শঙ্কুর চোখদুটো উজ্বল হয়ে উঠলো। ‘আশ্চর্য তোমার স্মরণশক্তি, সিদ্ধেশ্বর ঠিকই বলেছিল, ওঁর সঙ্গে কিন্তু আমার চিঠি লেখালিখি ছিল তিব্বত অভিযানের সময়। তিব্বতি পুঁথি সম্পর্কে মত বিনিময়ও হয়েছিল, পণ্ডিত মানুষ এবং নির্লোভ, ঠিক যেমনটি আমি পছন্দ করি ।’
‘যাইহোক যা বলছিলাম’ শঙ্কুর চোখে আবার বিষণ্ণতার ছায়া –
‘হ্যাঁ ড্রেক্সেলের ঘটনাটা আমি লিখিনি কারণ লিখতে হলে অনেক অপ্রিয় কথা লিখতে হত, আর সবচেয়ে বড় কথা এই অভিযানে আমি ব্যর্থ হই। নির্মম ভাবে পরাজিত হই’।
‘পরাজিত হন’!! জটায়ুর প্রশ্নে বিস্ময় । ‘এ যে অবিশ্বাস্য ।’
‘হ্যাঁ আমি ব্যর্থ হই। তোমরা তো আলেকজান্ডার ক্রাগের তৈরি ‘হিপনোজেন’ গ্যাসের কথা জানো। জন ড্রেক্সেলও প্রায় এমনই একটা গ্যাস নিয়ে গবেষণা করছিলেন। কিন্তু পার্থক্য এই যে ড্রেক্সেলের আবিষ্কৃত ওই গ্যাস যদি কোন মানুষের ওপর প্রয়োগ করা হয় তাহলে তার মন থেকে বা বলা ভাল মস্তিস্ক থেকে লোভ, হিংসা দম্ভর মত বদগুণগুলো চিরকালের মত মুছে যাবে। ড্রেক্সেলের পরিকল্পনা ছিল বিশ্বব্যাপী একটা সংগঠন তৈরি করার। এই সংগঠনের সদস্যরা গোপনে বিশ্বের সমস্ত প্রান্তে একইসঙ্গে এই গ্যাসের প্রয়োগ ঘটাবে। ফলে যুদ্ধ জিনিসটা চিরকালের মত দুনিয়া থেকে লোপ পেয়ে যাবে। হিংসা বলে কিছু থাকবে না। পৃথিবীর কোন প্রান্তে আর কখনো শোনা যাবেনা একটাও বোমা বা গুলির শব্দ বা আক্রান্ত মানুষের আর্তনাদ ।’
‘এইটাই পৃথিবীর সুন্দরতম জিনিস’? বলল ফেলুদা।
‘হ্যাঁ, অথবা বলতে পার ওই চ্যাপলিন গ্যাসের প্রভাবে যে পরিবর্তিত মানুষের মন, যেখানে লোভ, হিংসা দম্ভর কোন অস্তিত্ব নেই সেটাকেই পৃথিবীর সুন্দরতম জিনিস বলে উল্লেখ করে গেছেন জন ড্রেক্সেল’।
‘এই চ্যাপলিনটা আবার কি ব্যাপার’? প্রশ্ন করলেন জটায়ু।
‘ড্রেক্সেল তাঁর আবিষ্কৃত গ্যাসের নাম দিয়েছিলেন চ্যাপলিন। উনি ছিলেন চলচ্চিত্রকার চার্লি চ্যাপলিনের অনুরাগী। গ্রেট ডিক্টেটর ছবির অন্তিম কথাগুলো ওঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। ওই গোটা স্পীচটা উনি ওঁর ল্যাবরেটরির দেওয়ালে লিখে রেখেছিলেন। তাই চ্যাপলিনের নামেই উনি ওঁর আবিস্কারের নামকরণ করেন ।’
ফেলুদা বলল ‘কিন্তু জন ড্রেক্সেলের ছেলে তো সন্দেহ করেছিল আবিস্কারের কৃতিত্ব নিজে নিয়ে নেওয়ার জন্য গ্রিমাল্ডি নামের আর একজন বৈজ্ঞানিক ওঁকে খুন করেন, যদি সেটা ঠিক হয় তাহলে অন্তত ফর্মুলাটা ওই গ্রিমাল্ডির কাছে থেকে যাওয়ার কথা’।
‘ড্রেক্সেলের ছেলে যা সন্দেহ করেছিল এক্ষেত্রে তারচেয়ে অনেক গভীরতর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন তিনি। আমি যখন ড্রেক্সেল আইল্যান্ডে গিয়ে পৌঁছই তখন গ্রিমাল্ডিও খুন হয়ে গেছেন’।
সে কি?? ফেলুদার ভ্রু কুঁচকে গেছে।
‘খবরটা আমিই আগাম জানিয়েছিলাম তিলুবাবু কে’ অনেক্ষন পর মুখ খুললেন নকুড় বাবু।
‘কিন্তু গ্রিমাল্ডিকে খুন করলো কারা’??
শঙ্কু কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলেন। তারপর বলতে শুরু করলেন –
‘ আবিস্কারের পেটেন্ট নেওয়ার জন্য গ্রিমাল্ডি আগেথেকেই তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছিল। কিছু আন্তর্জাতিক এজেন্টের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিল সে। কিন্তু ব্যাপারটা বিশেষ এগোচ্ছিল না কারণ তখনো আবিষ্কারটা কি বিষয়ে সেটা ড্রেক্সেল গ্রিমাল্ডির কাছে গোপন রেখেছিলেন । কিন্তু এরপরেই তিনি একটা মারাত্মক ভুল করেন । পরীক্ষামূলক ভাবে গ্যাসটা প্রয়োগ করেন নিজের ওপরে। এতে যেমন ড্রেক্সেলের নিজের মন থেকে লোভ, হিংসা, দম্ভ ইত্যাদি চিরকালের মত দূর হয়ে যায় তেমনি মানুষের প্রতি অগাধ বিশ্বাস তাঁর মনে বাসা বাঁধে। এরই ফলস্বরূপ তিনি গ্রিমাল্ডিকে নিজের পরিকল্পনার কথা সবিস্তারে জানিয়ে দেন । গ্রিমাল্ডি আবার খবরটা জানায় আন্তর্জাতিক এজেন্টদের। এই এজেন্টরাই খবরটা পৌঁছে দেয় সেইসব মহাশক্তিশালী রাষ্ট্রনায়কদের কানে যারা বাইরে থেকে পরস্পরের চরম শত্রু হলেও আসলে ভিতরে ভিতরে অভেদাত্মা বন্ধু। এরা সেইসব মানুষ যারা দশকের পর দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্যকে পরিণত করেছে একটা চিরস্থায়ী যুদ্ধক্ষেত্রে। ইরাক, ইরান, সিরিয়া, প্যালেস্টাইন, ইসরায়েল, গাজা থেকে যারা এই যুদ্ধকে আফগানিস্তান পাকিস্তান হয়ে এনেফেলেছে ভারতবর্ষের প্রায় ঘাড়ের ওপরে। এরা দিনের বেলায় সন্ত্রাসের বিরোধীতা করে রাত্রে ভয়ঙ্কর সব মারণাস্ত্র তুলে দেয় সন্ত্রাসবাদীদের হাতে কোটি কোটি পেট্রোডলারের বিনিময়ে। এরাই শান্তি প্রতিষ্ঠার ভান করে মারাত্মক সব রাসায়নিক অস্ত্র নির্দ্বিধায় প্রয়োগ করে নিস্পাপ শিশুদের ওপরে। এরা সেইসব মানুষ যুদ্ধ যাদের কাছে একটা দারুন লাভজনক ব্যাবসা, যা থেকে কোটি কোটি টাকার মুনাফা হতে পারে, তাই নিজেদের ঘরটুকু বাদ দিয়ে যাতে পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে প্রতিদিন কোন না কোন যুদ্ধ চলতে পারে এটা নিশ্চিত করাই তাদের একমাত্র লক্ষ। কাজেই এরা যদি একবার খবর পায় একটামাত্র বৈজ্ঞানিক আবিস্কারের জোরে পৃথিবী থেকে যুদ্ধ জিনিসটা চিরতরে লোপ পেয়ে যেতে পারে, তাহলে সেটাকে ধ্বংস করবার জন্য যে কোন উপায় অবলম্বন করতে তারা পিছপা হবে না। ড্রেক্সেল সেই ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের বলি হয়েছিলেন। যদিও ড্রেক্সেল কে খুন করেছিল গ্রিমাল্ডিই, কিন্তু যে বৃহত্তর শক্তি এর পিছনে ছিল তাদের কাছে গ্রিমাল্ডিকেও বাঁচিয়ে রাখার কোন কারণ বা প্রয়োজন ছিল না’।
একটু দম নেওয়ার জন্য শঙ্কু থামলেন। তারপর বললেন –
‘আমি যখন ড্রেক্সেল আইল্যান্ডে গিয়ে পৌঁছই তার অনেক আগেই ওরা ড্রেক্সেলের ফরমুলা, কাগজপত্র, ল্যাবরেটরি সব নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছে। নকুড় বাবুর সাহায্যেই আমি এমন একজন ব্যক্তির সন্ধান পেয়েছিলাম যিনি ড্রেক্সেলের কর্মকাণ্ডর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং আশ্চর্যজনক ভাবে প্রানে বেঁচে যান। তাঁর কাছেই আমি এইসব খবর জানতে পারি। জন ড্রেক্সেলের বাকি ২৭জন সহকারীর আর কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি’।
।।৬।।
“ওহ, সাধে কি আর বলে ট্রুথ ইজ স্ট্রঙ্গার দ্যান ফিকশান, দুর্ধর্ষ দুশমন, না মশাই নিজের কানে না শুনলে এ জিনিস আমি বিশ্বাসই করতুম না” বললেন জটায়ু।
“বটে, তাহলে আর একটা দুঃসংবাদ আপনাদের জানাই। আপনারা তো মিরাকিউরলের কথা জানেন। আজ থেকে প্রায় চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ বছর আগে স্বর্ণপর্ণী গাছের পাতা থেকে এই ওষুধ আমি তৈরি করেছিলাম। এই গাছ কসৌলি থেকে যোগাড় করে এনে আমার বাগানে তার পরিচর্যা করে আরও গাছের বিস্তার ঘটিয়েছিলাম। কিন্তু মানুষের লোভ এবং হঠকারিতার ফলে যে মারাত্মক পরিবর্তন ঘটেছে আবহমণ্ডলে তারই প্রভাবে আজ এত বছর পরে আমার স্বর্ণপর্ণী গাছগুলো শুকিয়ে মরে যাচ্ছে। আমি বহু চেষ্টা করে, আমার সমস্ত বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি প্রয়োগ করেও এই সমস্যার সমাধান করতে পারি নি। ফলে শেষপর্যন্ত অনেক তোয়াজ করে একটিমাত্র গাছকে আমি বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছি। কিন্তু সেটাও কতদিন বাঁচবে তা এক্ষুনি বলা যাচ্ছে না”। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন প্রোফেসর শঙ্কু।
“সে কি !! কিন্তু স্বর্ণপর্ণী গাছ না থাকলে তো মিরাকিউরল তৈরি করা…”
“সম্ভব নয় । আমার কাছে আগে তৈরি করা ওষুধ যতটুকু আছে সেটা শেষ হয়ে যাওয়ার পর নতুন করে আর ওষুধ তৈরি করা যাবে কিনা সেটা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত”।
“আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাওয়ার কারণটা কিন্তু এখনো আপনি বললেন না প্রোফেসর শঙ্কু” মুখ খুলল ফেলুদা।
“উনি তো চললেন” বললেন নকুড় বাবু।
‘কোথায়’?
‘পৃথিবী ছেড়ে … তবে সশরীরে এবং সজ্ঞানে’ ।
‘মানে’? চোখ কপালে উঠেছে ফেলুদার।
‘তিন্তিড়ি তিন্তিড়ি তিন্তিড়ি’ বাইরের বারান্দায় ম্যাকাও এর কর্কশ চীৎকার শোনা গেল।
শঙ্কু কিছুক্ষন চুপ করে বসে থাকার পর বলতে শুরু করলেন –
“দেখ ফেলু, আমার পৃথিবীতে থাকার মেয়াদ আর মাত্র কয়েকমাস। এর মানে এই নয় যে আমি মারা যাব, মিরাকিউরলের গুণে এই বয়েসেও আমি শারীরিক ভাবে এতটাই সুস্থ যে সে সম্ভাবনা নেই। কিন্তু আজ অনেক বছর ধরেই আমি একটা বিশেষ গবেষণায় ব্যাস্ত ছিলাম। সেটা সাফল্যের সঙ্গে শেষ করতে পেরেছি। এইবার আমার চূড়ান্ত পরীক্ষা”
‘কি বিষয়ে গবেষণা’? ফেলুদার ভুরু কুঁচকে গেছে।
“মঙ্গল গ্রহ অভিযানের গবেষণা। আমার রকেট তৈরির কাজ শেষ হয়েছে। বাকি সবকিছুই প্রস্তুত। রসদ এবং উপযুক্ত পোশাক তৈরির কাজ চলছে, সেটা শেষ হলেই আমি, প্রহ্লাদ এবং নিউটন মহাকাশে পাড়ি দেব। বুঝতেই পারছ এর পরের অংশটা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত, সেখানে গিয়ে আমাদের কি হবে, কতদিন পরে আমরা পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারবো, আদৌ ফিরে আসা হবে কিনা এইসব কিছুই জানা নেই আমার। এমনকি নকুড়বাবুও এই ব্যাপারে কিছু বলতে পারেন নি, সম্ভবত এই গ্রহের বাইরে ঘটে যাওয়া ঘটনা সম্পর্কে কিছু বলা ওঁর পক্ষে সম্ভব নয়। যদিও নকুড়বাবু যেতে চেয়েছিলেন আমার সঙ্গে, কিন্তু আমি রাজি হই নি, কারণ এই পৃথিবীতে আমার প্রতিনিধিত্ব করবার জন্যও কয়েকজনের থাকা দরকার। আমি ঠিক করেছি মঙ্গল গ্রহে পাড়ি দেওয়ার আগে যাদের ব্যক্তিগত ভাবে ভরসা করি এবং খুব কাছের মানুষ বলে মনে করি তাদের প্রত্যেককে দশটা করে মিরাকিউরলের বড়ি দিয়ে যাব। ইতিমধ্যেই ক্রোল, সন্ডার্স এবং সামারভিলের কাছে আমার ওষুধ পৌঁছে গেছে। অবিনাশবাবু আর নকুড়বাবুও ওষুধ পেয়ে গেছেন। এ বাদে তোমাদের তিনজনের জন্য আমি তিরিশটি মিরাকিউরলের বড়ি শিশিতে ভরে আলাদা করে রেখেছি। আমার একান্ত ইচ্ছে সেটা আমি নিজের হাতে তোমাদের হাতে তুলে দিই, আর তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাওয়ার এইটাই হচ্ছে একমাত্র কারণ। গিরিডিতে না এলে হয়তো দেখতে আমিই তোমার রজনী সেন রোডের বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়েছি ।”
“আপনি মঙ্গলগ্রহে চলে যাচ্ছেন !!!” জটায়ুর চোখে বিস্ময়
“তাহলে আপনার বাকি সব আবিষ্কারগুলোর কি হবে? আপনার অমনিস্কোপ, রিমেম্ব্রেন, বটিকা ইন্ডিকা, অ্যানাইহিলিন পিস্তল…”
“দেখুন লালমোহন বাবু, দুটি আবিস্কার আমি দেশের মানুষের স্বার্থে সরকারকে অফার করেছিলাম। এক নম্বর বটিকা ইন্ডিকা, যেটা খেলে মানুষ ক্ষুধা এবং তৃষ্ণার হাত থেকে রেহাই পেতে পারে অতি সহজে। এটা তৈরি করতে মূলত দরকার বটফলের রস যার কোন অভাব আমাদের দেশে নেই। দেশের কোন অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ বা জলাভাব হলে বটিকা ইন্ডিকা দিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ বাঁচানো যেতে পারে। দ্বিতীয়টা হল ল্যুমিনিম্যাক্স আলো। দেশের যে সব প্রত্যন্ত গ্রামে আজও ইলেক্ট্রিসিটির ব্যবস্থা করা সম্ভব হয় নি, বা মানুষ দারিদ্রের কারণে তা ব্যবহার করতে অপারগ সেখানে স্কুলে স্কুলে যদি ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে লুমিনিম্যাক্স আলো বিতরণ করা যায় তাহলে শিক্ষাক্ষেত্রেও একটা বিরাট উন্নতি হতে পারে বলে আমার বিশ্বাস। হয়ত মিরাকিউরলটা এভাবে ছড়িয়ে দিতে পারলে ভাল হত, কিন্তু সেটা কেন সম্ভব নয় আগেই বলেছি আপনাদের”।
“দারুণ, সরকার নিশ্চয়ই এককথায় রাজি হয়ে গেল”? লালমোহনবাবু উত্তেজিত।
শঙ্কু মৃদু হাসলেন। বিষণ্ণ ম্লান হাসি।
“না লালমোহনবাবু। সরকারের তরফ থেকে আমাকে জানানো হয়েছে বটিকা ইন্ডিকা বা ল্যুমিনিম্যাক্স আলো সম্পর্কে ওঁরা পরে ভেবে দেখবেন, আপাতত আমি যেন দেশের স্বার্থে অ্যানাইহিলিন পিস্তলের ফর্মুলাটা সরকারের হাতে তুলে দি। ব্যাপারটা বুঝতে পারছ ফেলু? যা থেকে খাদ্যাভাব মিটে যেতে পারে চিরকালের মত, বা শিক্ষাক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নতি হতে পারে সেটার চেয়ে সরকারের কাছে অ্যানাইহিলিন পিস্তলের মত ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্রটা দেশের স্বার্থে বেশি প্রয়োজনীয় মনে হচ্ছে!”
“আপনি রাজি হলেন অ্যানাইহিলিন পিস্তলের ফর্মুলাটা দিতে”?
শঙ্কু ফেলুদার প্রশ্নটা শুনে আবার একটু হাসলেন, তারপর বললেন –
“বুঝলে ফেলু, দেশের মহান নেতাদের মত প্রতিভার অধিকারী না হলেও সামান্য কিছুটা বোধবুদ্ধি তো আমার আছে। আর তার ভরসাতেই বলতে পারি এ দেশের মানুষের স্বার্থরক্ষা করতে গেলে খাদ্য এবং শিক্ষারই প্রয়োজন, মারণাস্ত্রের নয়। যে আন্তর্জাতিক এজেন্টরা জন ড্রেক্সেলের গবেষণা পণ্ড করে দিয়েছিল তারাই আমাকে অ্যানাইহিলিন পিস্তলের ফর্মুলাটার জন্য কোটি কোটি ডলারের প্রলোভন দেখিয়েছে। আমি সে ফাঁদে পা দিই নি । কারণ আমি জানি একবার ওই ভয়ঙ্কর অস্ত্র ওদের কাছে গেলে যুদ্ধবাজ নেতা আর সন্ত্রাসবাদীদের হাতে প্রাণ যাবে দুনিয়ার অসংখ্য নিরীহ মানুষের। আর যদি দেশের কথা বল, আমার কাছে ভারতবর্ষ মানে এর গাছপালা, পাহাড়, নদী, আকাশ, জন্তু জানোয়ার, পাখি আর প্রাণশক্তিতে ভরপুর সাধারণ মানুষ। বিজ্ঞানী হিসেবে, ভারতবাসী হিসেবে যদি আমার কোন কর্তব্য বা দায়বদ্ধতা থেকে থাকে সেটা এদের কাছে। কিন্তু দিল্লীর গোলঘরে বসে থাকা একদল স্বার্থপর, ক্ষমতালোভী নেতার প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য প্রদর্শন করবার কোন দায় আমার নেই, যদি এরা দাবী করে এরাই হচ্ছে ভারতবর্ষ, আমি বলবো এরা মিথ্যেকথা বলছে। যে কোন সময় নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এরা ওই ভয়ঙ্কর অস্ত্র প্রয়োগ করতে পারে আমারই দেশের মানুষের ওপর। বিজ্ঞানী হিসেবে দ্বিতীয়বার একই ভুল আমি আর করতে পারি না”।
“দ্বিতীয়বার বলছেন কেন”?
“যে দিন বিজ্ঞানীরা যুদ্ধবাজ নেতাদের হাতে পরমাণু বোমার মত ভয়ঙ্কর অস্ত্র তুলে দিয়েছিল সেইদিনই প্রথমবারের মত মারাত্মক ভুলটা হয়ে গেছে। এর ফলাফল কি হতে পারে সেটা আমরা হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে নিজের চোখে দেখতে পেয়েছি। তুমি হয়তো বলবে তার পরে তো আর কখনো পরমাণু বোমা কোথাও ব্যবহার করা হয় নি। হ্যাঁ এটা সত্যি কথা। কিন্তু বোমা বানানো বন্ধ হয়েছে কি? বরং আজকে পৃথিবীর একাধিক দেশের কাছে পরমাণু বোমা তৈরির ফরমুলা রয়েছে যা চিরকালের মত পৃথিবীকে ঠেলে দিয়েছে এক অনিশ্চিত ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের দিকে। বিভিন্ন দেশের যুদ্ধবাজ নেতারা যে পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র জমা করে ফেলেছে তাতে এই গ্রহটাকে দশবার ধ্বংস করে ফেলা যায়। আমি চাইনা সেই মারাত্মক মারণাস্ত্রের তালিকায় অ্যানাইহিলিন গানের নামটা যুক্ত হোক। আমি চাইনা ওপেনহাইমার বা কালাশনিকভের সঙ্গে আমার নামটা একত্রে উচ্চারিত হোক। যদি প্রোফেসর শঙ্কুর নাম এ দেশের মানুষ মনে রাখতে চায় তাহলে সেটা বটিকা ইন্ডিকার আবিষ্কর্তা হিসবেই মনে রাখুক যার একটি হোমিওপ্যাথিক সাইজের বড়ি একজন মানুষের ক্ষুধা-তৃষ্ণা চব্বিশঘণ্টার মত মিটিয়ে দিতে পারে । অ্যানাইহিলিন পিস্তল পৃথিবীতে একটিমাত্র আছে, সেটি প্রোফেসর শঙ্কুর সঙ্গেই পাড়ি দেবে মঙ্গল গ্রহে এবং এই পৃথিবীতে তার আর কোন অস্তিত্ব থাকবে না ।”
।।৭ ।।
“রিমেমব্রেনের হেলমেটের মধ্যে কি আছে বলুন তো মশাই। পায়ে ঝিঁ ঝিঁ ধরলে যেমন হয়, তেমন টাকে ঝিঁ ঝিঁ ধরা পিন ফোটানো গোছের একটা ফিলিং হচ্ছে”। নিজের টাকে হাত বোলাতে বোলাতে কথাটা বললেন লালমোহনবাবু।
আমরা ঘণ্টাখানেক হল গিরিডি থেকে বেরিয়ে কলকাতার দিকে রওনা দিয়েছি। গাড়ি চলতে শুরু করবার পর থেকেই লালমোহনবাবু ওঁর লাল খাতায় ক্রমাগত লিখে চলেছেন। দুপুরের খাওয়া শেষ হওয়ার পরে আমরা গিয়েছিলাম প্রোফেসর শঙ্কুর ল্যাবরেটরি দেখতে। অমনিস্কোপ, লিঙ্গুয়াগ্রাফ, রিমেমব্রেন ইত্যাদি দেখে রোবু ওরফে বিধুশেখরের গান শুনে যখন অ্যানাইহিলিন পিস্তলটা দেখছি জটায়ু বলে উঠলেন-
“আমার অ্যানাইহিলিন পিস্তলের ফরমুলা চাই না, কিন্তু শঙ্কুমশাই যদি অনুমতি দেন তাহলে নেক্সট উপন্যাসে প্রখর রুদ্রর হাতে অ্যানাইহিলিন পিস্তলটা দিতে চাই। পারি”?
শঙ্কু একটু অবাক হয়ে হেসে বললেন “তা পারেন”।
‘কিন্তু একটা শর্ত আছে’ বলল ফেলুদা।
‘কি শর্ত’?
“আপনার গপ্পের হিরোর মাথা বড্ড গরম। কথায় কথায় বন্দুক পিস্তল চালিয়ে দেওয়ার একটা টেন্ডেন্সি আছে। শর্ত হচ্ছে একমাত্র আত্মরক্ষার প্রয়োজনে এবং খুব সংকটজনক পরিস্থিতিতে না পড়লে প্রখর রুদ্র অ্যানাইহিলিন পিস্তলটা ব্যবহার করতে পারবে না, রাজি”?
‘অগত্যা, অর্ধেক সমস্যার সমাধান তো আমার অ্যানাইহিলিনের জোরেই হয়ে যেত মশাই। আপনার মত মগজাস্ত্র খাটানোর টাইম কি প্রখর রুদ্রর আছে, না আমার আছে। কিন্তু আজকাল বয়সের জন্যই কিনা জানিনা, ভাল ভাল আইডিয়া মাথায় এসেও প্লটের খেই হারিয়ে যায়, তখন খানিকটা ম্যনেজ দেওয়ার জন্যই গাঁজাখুরি গোঁজামিল দিতে হয় ।”
“হারানো প্লটের খেই ফিরে পেতে আপনি আমার রিমেমব্রেনের সাহাজ্য নিয়ে দেখতে পারেন” প্রস্তাব দিলেন প্রোফেসর শঙ্কু।
হেলমেট মাথায় পরবার পর ফেলুদাই প্রশ্ন করতে শুরু করলো। আর সে সবের উত্তরে কম্বোডিয়ায় কুরুক্ষেত্র, লোমহর্ষক লাক্ষাদ্বীপ, সাংহাইতে সংঘর্ষ এইরকম বেশ কয়েকটা না লেখা উপন্যাসের নাম শোনা গেল লালমোহনবাবুর মুখে। একটু পরে স্ট্রেন হচ্ছে বুঝতে পেরে শঙ্কুর নির্দেশেই যন্ত্রটা বন্ধ করে দেওয়া হল। তারপর কিছুক্ষনের জন্য দেখলাম জটায়ুর একেবারে মৌনদশা, মুখে লামা স্মাইল, যেমন দেখেছিলাম এল এস ডি খাওয়ার পরে। এরপর আমরা বাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলাম বাগানের এককোণে টিনের ছাউনি দেওয়া একটা উঁচু ঘরে। সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে মঙ্গল অভিযানের জন্য শঙ্কুর তৈরি রকেট। অবিনাশবাবু বলে উঠলেন –
“আমার মুলোর ক্ষেতের ক্ষতিপূরণের টাকাটার কথা কিন্তু ভুলে যাবেন না”।
“মুলোর ক্ষেত? সেটা কি ব্যাপার”? জানতে চাইল ফেলুদা।
“আর বলবেন না মশাই, এর আগেও তো শঙ্কুমশাই একটা রকেট তৈরি করেছিলেন, সেটা ওড়াতে গিয়ে ভেঙে পড়ে আমার মুলোর ক্ষেতের দফারফা করে ছেড়েছেন। তা উনি বলেছিলেন ক্ষতিপূরণ দেবেন, সেইটেই মনে করিয়ে দিলুম আর কি। টাকাটা বড় কথা নয়, কিন্তু ওঁর মত বৈজ্ঞানিকের ফেলিওরের ধাক্কাও তো কম না, আর সেটা আমাদেরই সইতে হয়। এই তো বছর খানেক আগে রকেট তৈরি করতে গিয়ে ট্যানট্রাম না কি এক কেমিক্যালের রিঅ্যাকশানে বিকট বিস্ফোরণ হল। পেল্লাদের ডাকাডাকিতে ছুটে এসে দেখি উনি অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে আছেন আর ওই ব্যাটা কলের মানুষ বিধুশেখর ঘটাং ঘটাং করে মাথা নেড়ে চলেছে। জ্ঞান ফেরার পর শঙ্কু মশাই বললেন ও ব্যাটা নাকি ঘাড় নেড়ে ওকে বারণ করছিল। তা শুনলেই পারতেন, কিন্তু না, ওঁকে বোঝায় কার সাধ্যি”।
মৌনদশা কেটে যাওয়ার পরেই লালমোহনবাবু ভয়ঙ্কর উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। নকুড়বাবু ওঁকে প্রশ্ন করলেন –
“আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে”?
“নাহ, তেমন কিছু না, কিন্তু গত বিশ বছরে যতগুলো গপ্পের প্লট ভুলে গেছিলাম, বা খেই হারিয়ে ফেলেছিলাম সব একসঙ্গে মনে পড়ে গেছে মশাই। এইগুলো লিখে না রাখলে তো আবার ভুলে যাব, তাই বড় অস্থির লাগছে”।
“ভয় নেই, ওগুলো এত সহজে আপনি আর ভুলে যাবেন না” বললেন শঙ্কু।
ফেলুদা বলল “গিরিডি থেকে ফেরবার সময় গাড়িতে অনেকটা সময় পাবেন। তখন বরং এইগুলো আপনার লাল খাতায় লিখে রাখবেন”।
রকেট দেখে আমরা বাগানের মধ্যে দিয়ে ঘুরে সামনের বৈঠকখানায় ফিরে এলাম। আসার সময় দেখতে পেলাম বাগানে নিউটনের সঙ্গে খেলা করছে একটা ছোট্ট বানর প্রজাতির জানোয়ার। একে বলে স্লো লরিস। এর নাম ঢিমু। ঢিমু অবিনাশবাবুকে দেখেই এক লাফে ওঁর কাছে এসে কাঁধে চড়ে বসলো। কর্ভাস দেখলাম শঙ্কুর ডেক চেয়ারের হাতলে চুপটি করে বসে আছে, কাককে কোনোদিন এমন শান্ত হয়ে বসে থাকতে দেখিনি। ঢিমুকে অবিনাশবাবুর কাঁধে চাপতে দেখে নিউটন লেজ ফুলিয়ে গরগর করতে শুরু করে দিল আর ঠিক তখনি বারান্দার দিক থেকে হ্যা হ্যা করে ম্যাকাওয়ের কর্কশ হাসির শব্দ পেলাম।
বৈঠকখানায় ঢুকে দেখি প্রহ্লাদ কখন জানি প্লেটে করে ফল কেটে সাজিয়ে রেখে গেছে। প্রোফেসর শঙ্কু বললেন –
“আসুন, আমার তৈরি ম্যাঙ্গরেঞ্জ ফল খেয়ে দেখুন। আম আর কমলালেবু মিলিয়ে এই গাছের বীজ তৈরি করেছি আমি”।
ফল খেয়ে দেখলাম লালমোহনবাবুর চোখ কপালে উঠে গেল ।
“এ তো দেবভোগ্য ফল মশাই! এ জিনিস নিয়মিত খেলে তো চেহারায় ধ্যানি ভাব এসে যেতে বাধ্য”।
শঙ্কু কয়েক মিনিটের জন্য ভিতরে চলে গিয়েছিলেন। ফিরে এলেন গোটা চারেক ছোট কাঁচের শিশি হাতে নিয়ে। এর মধ্যে অপেক্ষাকৃত বড় শিশিটা ফেলুদার হাতে দিয়ে বললেন –
“এতে তিরিশটা মিরাকিউরলের বড়ি আছে, তোমাদের তিনজনের জন্য। এছাড়া আর একটা আলাদা শিশিতে পাঁচটা বড়ি দিয়ে দিলাম সিদ্ধেশ্বরের জন্য। আমার নাম করে ওঁকে দিও। তিব্বতের গুম্ফা থেকে আনা একটা অতি প্রাচীন পুঁথিও তোমাকে দেব, সেটাও আমার তরফ থেকে সিদ্ধেশ্বরকে উপহার দিও। আর এই তৃতীয় শিশিটায় আছে বটিকা ইন্ডিকার গুলি। যাওয়ার পথে একটা করে খেয়ে দেখতে পারো, রাস্তায় আর কিছু খাওয়ার দরকার হবে না। চতুর্থ শিশিটায় আছে এয়ার কন্ডিশানিং পিল। পকেটে রাখলে শীতকালে গরম আর গরমকালে ঠাণ্ডা লাগবে। আগামী ১৩ই জানুয়ারি ভোর বেলায় মঙ্গলগ্রহের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবো আমরা। যদি ফিরে আসি আবার দেখা হবে, যদি না আসি আমার আবিস্কারের মধ্যে দিয়েই মনে রেখ আমাকে। আমি জানি একটু আগে যে কথাগুলো তোমাদের বলছিলাম সেটা শুনতে একটা লম্বা লেকচারের মতই ক্লান্তিকর লাগছিল হয়ত। আসলে মাত্র বিশ বছর বয়েসেই আমি কলকাতার স্কটিশচার্চ কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিই। ফলে লেকচার দেওয়ার অভ্যাস আমার তখন থেকেই। আর চাকরীটা ছেড়ে দিই কারণ শ্রোতাদের মধ্যে ধৈর্যর অভাব আমি লক্ষ করেছিলাম। তোমরা গ্লোবট্রটার এবং নৃতত্ববিদ মনমোহন মিত্রর নাম শুনেছ কিনা জানি না। সে বলত মানুষকে চিনতে গেলে সময় দিতে হয়, ধৈর্য লাগে। তেমনই এই যে পৃথিবীতে আমরা বাস করছি তাকে ভালভাবে বুঝতে গেলেও সময় দিতে হয়, ধৈর্য লাগে । মিশরের মহাকাশযান যে পাথর আমাকে দিয়ে গিয়েছিল তার ভিত্তিতে যতটুকু বুঝতে পেরেছি সেটাই বললাম তোমাদের। তোমরা বলেই বললাম ।”
“সেই পাথরের রহস্য কি আপনি ভেদ করতে পেরেছেন ইতিমধ্যে”? ফেলুদা জানতে চাইল।
“না, তবে মূল কথাটা তো ওরাই বলে দিয়ে গিয়েছিল। আজ যে মানুষ ধ্বংসের পথে চলেছে, তার কারণই হল মানুষ নিঃস্বার্থ হতে শেখেনি। যদি শিখত তাহলে মানুষ নিজের সমস্যার সমাধান নিজেই করতে পারত। এর চেয়ে ভাল ‘মিনিয়েচারাইজেশান’ আর কি হতে পারে”?
পুনশ্চ – প্রোফেসর শঙ্কুর সঙ্গে আমাদের দেখা হওয়ার প্রায় বছর দুই পরে খবরের কাগজে ওঁকে নিয়ে একটা লেখা বেরিয়েছিল। সেখানে লিখেছিল “প্রোফেসর শঙ্কু কে? তিনি এখন কোথায়? এটুকু জানা গেছে যে তিনি একজন বৈজ্ঞানিক। কেউ কেউ বলে যে তিনি নাকি একটা ভীষণ এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে প্রাণ হারান। আবার এও শোনা যায় যে তিনি কোনও অজ্ঞাত অঞ্চলে গা ঢাকা দিয়ে নিজের কাজ করে যাচ্ছেন, সময় হলেই আত্মপ্রকাশ করবেন”। লেখাটা পড়া শেষ করে কাগজটা একপাশে ভাঁজ করে রেখে ফেলুদা বনবন করে ঘুরতে থাকা সিলিং ফ্যানটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বসে রইল।
[মতামত ও বানানবিধি লেখকের নিজস্ব]
Tags: গল্প, গিরিডিতে ফেলুদা, দেবরাজ গোস্বামী
email:galpersamay@gmail.com
অনিমেষ বন্দ্যোপাধ্যায় on September 27, 2022
ওঃ। দুর্ধর্ষ রকমের ভালো। গোয়েন্দাগরি, সায়েন্স ফিকশন, সিনেমা, রাজনীতি, সব মিলিয়ে মিশিয়ে এক মহাভোজ। সত্যজিৎ রায়ের লেখা গুলে খেয়ে আইকনিক চরিত্রগুলোকে নিয়ে (খালি তারিণীখুড়ো নেই), তাদের বিশেষত্ব পুরোপুরি বজায় রেখে একটা টানটান গল্প।
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।