আজকাল সব সময় লিখতে ভালো লাগেনা বৈভব সেনের।আগে লেখার আনন্দে লিখতেন। এখন যেন লেখাটাও ধরাবাঁধা কাজের পর্যায়ে চলে গেছে। সব সময় যন্ত্রের মতো কাজ করায় তাঁকে। অনেকে প্রশংসা করলেও, নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে মাঝে মাঝে সংশয় জাগে মনে! বৈভব লক্ষ্য করেছেন বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সকলেই প্রায় ধরাবাঁধা চাকরী, বাড়ি, ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স নিয়ে নিশ্চিন্ত জীবন কাটাতে চায়। এর বাইরে কিছু করতে বা ভাবতে চায়না। লেখার জগতে এসে বৈভব নিজেকে জীবন-যান্ত্রিকতা থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন। ভেবেছিলেন লেখাই তাঁকে দেবে জীবনের অভিনব আস্বাদন! নির্জনে,একাকিত্বে, আত্মচেতনার গহনে যখনই নিজেকে নতুন করে খুঁজে পেয়েছেন, তখনই লেখাতেও তার প্রতিফলন ঘটেছে। সেসব লেখা পড়লে আজও রোমাঞ্চিত বোধ করেন বৈভব। আজকাল এত বেশী সাহিত্যসভা, কনফারেন্স-এ যেতে ইচ্ছে করেনা, তবু অভ্যাসমতো যেতেই হয় বৈভবকে। মানসিক ক্লান্তি এক এক সময় ভীষণভাবে গ্রাস করে তাঁকে। অথচ সুন্দর সাজানো ফ্ল্যাট, গাড়ি, সব রকম আধুনিক স্বাচ্ছন্দের মধ্যে বৈভবের স্ত্রী আরতি হয়তো সুখেই আছেন। স্বামীর ঐশ্বর্যে আরতি গর্বিতা। অন্যান্য গৃহিণীদের সঙ্গে কথা বলার সময় আরতি কেমন অনায়াসে বলতে পারেন যে গত মাসেই তাদের একটি নতুন ওয়াশিং মেশিন এসেছে।
আজকের আরতির সঙ্গে পঁচিশ বছর আগের জেলা শহরের কলেজে পড়া দুই বেণী দোলানো উচ্ছল আরতির কোন মিল খুঁজে পান না বৈভব। তখন বৈভব জেলা শহরে সবে মাত্র স্কুল মাস্টারির চাকরী পেয়েছেন। ওই স্কুলেরই হেড মাস্টার ত্রিভুবন দত্তের মেয়ে আরতিকে দেখে বৈভবের মনে হয়েছিল যেন তিরতির স্রোতের মতো বয়ে চলা, সব কিছু এলোমেলো করে দেওয়া এক ঝলক মিষ্টি হাওয়ার পরশ। আরতির লাজুক দৃষ্টি, কথা বলতে বলতে প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়া, অনাবিল হাসি — সব কিছুই বৈভবের উদাস লেখক সত্তাকে ছুঁয়ে গেছিল।
বৈভবের বাবা ছিলেন বড় ব্যবসায়ী। বৈভব এম. এ. পাশ করে বাবার ব্যবসায়ে যোগ না দিয়ে জেলা শহরের স্কুলে চাকরী নেওয়ায় তাঁর বাবা খুবই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। জগতে নিজের নিজস্ব পরিচিতি, স্বীকৃতির বাসনা জেগে উঠেছিল বৈভবের মনে।
আজকাল রবিবারেও ব্যস্ত থাকেন বৈভব। গতকাল একটি নামী পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যার জন্য ‘শেষ প্রহর ‘ উপন্যাসটি শেষ করে শুতে বৈভবের প্রায় রাত একটা বেজে গেছে। ওরা সমানেই উপন্যাসের জন্য তাড়া দিচ্ছিল। আরতিও বৈভবকে সকাল সকাল ডেকে দেন নি। ঘুম থেকে উঠবে সকাল ন’টা বেজে যায় বৈভবের। শরীরে জড়তা, মাথাটা ভার লাগে তখনও। ফোন করে সেদিনের সব কটা প্রোগ্রাম ক্যানসেল করে দেন বৈভব। আজকের দিনটা শুধু নিজের জন্য। আকাশটা বড় মেঘলা, বাতাসে ছুটির আমেজ ছড়িয়ে আছে। এরকম একটি ছায়াময় দিনে নিজেকে হারিয়ে ফেলার ইচ্ছে হয়! ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষের ভিড় ছাড়িয়ে দূরে বকুলগাছের দিকে তাকিয়ে থাকেন তিনি। অজস্র ফুলে ভরে গেছে গাছটি। জীবনের হাসি, সুর যেন মিশে আছে গাছটাতে। এই পলিউশনের যুগে এই গাছটার দিকে তাকিয়ে উদ্দাম প্রাণের স্পন্দন অনুভব করেন বৈভব!
আরতি কাজের ফাঁকে ঘরে এসে ঢোকেন। বাড়িতে কাজের লোক, ঠাকুর সবাই থাকলেও আরতি অনেক কাজই নিজে হাতে করেন । আরতির সারা মুখ ঘর্মাক্ত। মধ্যচল্লিশে বেশ স্থূলকায়। তবে তার সেই ধারালো নাক, বাঁ গালের তিল, মুখের সুন্দর শ্রী আজও আছে। বৈভবকে ব্যালকনিতে একভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আরতি একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন , “আজ তুমি বেরোবে না?”
“না, আজ কোন কাজ নয়। ”
বৈভব ঘরে এসে আলতো করে আরতির হাত ধরে বলেন, “চলো না আরতি আজ কোথাও ঘুরে আসি।”
আরতি একবার স্বামীর দিকে তাকান । তারপর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, “আমার যে অনেক কাজ আছে।”
“থাক কাজ! আজ আমি আমার সব প্রোগ্রাম ক্যানসেল করে দিয়েছি। চলো অনেকদিন বাদে দুজনে কোথাও নিরুদ্দেশ হয়ে যাই।”
নরম সুরে আবদার করেন বৈভব। আরতি তবু যেতে রাজী নন ।
“আজ নয়, আর একদিন যাব।”
আরতি আজকাল যেন বৈভবকে এড়িয়ে চলেন । সন্তানহীন জীবনের শূন্যতা ওদের মধ্যে ধীরে ধীরে ব্যবধানের প্রাচীর গড়ে তুলেছে। আরতি বৈভবের লেখাও আর আগ্রহ ভরে পড়েননা । অথচ বৈভব আরতিকে সব সময় বোঝার চেষ্টা করেন। যে আরতির কাছে বৈভব ছিলেন সব থেকে কাছের মানুষ, কলেজ ছুটির পর যে আরতি দৌড়ে আসতেন বৈভবের কাছে, পুরোনো বটের তলায় বসে বৈভবের কবিতা শুনতেন একমনে, সেই আরতিকে খোঁজার চেষ্টা করেন বৈভব। পাখির ডাক, রোদের মিঠে সুর আর নির্জন প্রকৃতির কোলে সময়ধারা বয়ে যেত সাবলীল গতিতে! কবিতা শোনার পর আরতির চোখে মুখে লেগে থাকতো মুগ্ধতার রেশ!ভালোবাসার ঢেউ যেন দুটি হৃদয়কে ভাসিয়ে নিয়ে যেত একই মোহানার দিকে!
ব্রেকফার্স্ট সেরে বৈভব সেন একাই বেরিয়ে পড়েন রাস্তায়। ড্রাইভারকে ছুটি দিয়ে দেন। রান্নাঘরের ব্যস্ততার মধ্যে বৈভব কোথায় যাচ্ছেন সে বিষয়ে আরতি আগ্রহ দেখাননা।
লেখক বৈভব সেনের পরিচিত মহল নেহাৎ ছোট নয়। তাই রাস্তায় চেনা পরিচিত দেখলেই ভদ্রতার খাতিরে হাসি বিনিময় করতেই হয়! বৈভবের ব্যালকনি থেকে যে বকুলগাছটা চোখে পড়ে সেই পথে হাঁটতে হাঁটতে বহু দিনের চেনা পার্কটার কাছে এসে দাঁড়ান বৈভব। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মার্চ মাসে বেশ গুমোট গরম বোধ হচ্ছে। সকালের ফুরফুরে হাওয়াও আর নেই। হঠাতই বুকের বাঁ দিকে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করেন বৈভব। সারা শরীর মুহূর্তে ঘেমে ওঠে। কোন কিছু বোঝার আগেই চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে আসে। সমস্ত বোধ অবলুপ্ত হয়। নিজেকে সামলানোর আগেই বৈভবের অবশ দেহ লুটিয়ে পড়ে মাটিতে।
জ্ঞান ফিরলে বৈভব নিজেকে তাঁর ঘরে শোওয়া অবস্থায় দেখে সব কথা মনে করতে চেষ্টা করেন। শরীরে তখনও জড়তা, মাথাটা বেশ ভার লাগে। ধীরে ধীরে চোখ খুলে আরতিকে চিন্তিত মুখে পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন। বৈভবের মাথায় হাত দিয়ে খুব নরম স্বরে আরতি জিজ্ঞাসা করেন, “এখন কেমন লাগছে?”
” অনেকটা ভালো। ”
আরতির পাশে তাঁদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান ডাক্তার মিত্র বৈভবের পালস, প্রেসার চেক করে জানান একটা মাইল্ড স্ট্রোক হলেও বিপদ কেটে গেছে। ডাক্তার মিত্র যাবার আগে আরতিকে ওষুধপত্র বুঝিয়ে দেন এবং বৈভবকে বার বার রেস্টে থাকার কথা বলেন। বৈভব আবার কিছু ক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েন। শরীরে যেন হাজার ক্লান্তি। বহুদিন পর আরতির সেবা যত্নে আন্তরিকতার স্পর্শ পেয়ে বৈভবের ভালো লাগে। ঠিক যেন আগের আরতি, যে সব সময় বৈভবের জন্য ভাবতেন,বৈভবের কাছে থাকতেন।
বিকেলের দিকে বৈভব অনেকটা সুস্থ বোধ করেন। আরতি বিছানার পাশের জানলাটা খুলে দেওয়ায় ঠান্ডা হাওয়া ঢুকে শীতলতা ছড়িয়ে যাচ্ছে! বালিশে আধ শোওয়া অবস্থায় বসে বৈভব দেখতে পান পঁচিশ বছর আগের তরুণ বৈভব সেনকে। স্মৃতির পর্দায় অনেক মুখই জীবন্ত হয়ে ওঠে!
বৈভবের সাফল্যের পেছনে ভবেশ বসু, শ্রীমন্ত রায়ের ভূমিকা ছিল সক্রিয়। শুধু ভালো লিখলেই নামকরা লেখক হওয়া যায়না–এই অভিজ্ঞতা বৈভবের হয়েছিল। তখন তিনি কয়েকটি লিটল ম্যাগাজিনে লিখতেন, সাহিত্য সভায় গিয়ে পেছনের সারিতে বসে বড় বড় সাহিত্যিকদের কথা শুনতেন। সঙ্গে প্রভাস, মলয় ও সূর্যও থাকতো। এরা সকলেই ছিলেন বৈভবের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ‘বাণীবীথি’ পত্রিকার সম্পাদকমন্ডলীর অন্যতম কবি বিজন রায় ছিলেন প্রভাসের কাকা। তাই প্রভাসের কবিতা সহজেই ‘বাণীবীথি’ পত্রিকায় প্রকাশের জন্য মনোনীত হয়। এরপর কয়েকটি নামী দামী পত্রিকায় প্রায়ই প্রভাসের কবিতা প্রকাশিত হওয়ায় প্রভাসের সঙ্গে বড় বড় সাহিত্যিক গোষ্ঠীর যোগাযোগ গড়ে ওঠে। প্রভাসের প্রতি তখন বৈভব বেশ ঈর্ষাকাতর হয়ে উঠেছিলেন। প্রভাসও আর আগের মতো ওদের আড্ডায় আসতেননা । সহজভাবে কথা বলতেননা । একটু হলেও দূরত্ব বজায় রেখে চলত। প্রভাসকে বৈভব এড়িয়ে চলতেন। ধীরে ধীরে তাঁদের বন্ধুত্বের সহজ সম্পর্কে ভাঙন ধরতে থাকে। বৈভব তাঁর কবিতার পান্ডুলিপি নিয়ে প্রকাশকের দরজায় দরজায় একটু অনুগ্রহ পাবার আশায় ব্যর্থ হয়েছেন অনেকবারই। বাজারে তখন প্রভাস রায়ের দু দুখানি কাব্যগ্রন্থ। হতাশায় যন্ত্রণায় মাঝে মাঝে ভেঙে পড়তেন বৈভব। নিজের বিশ্বাস হারাতে বসেছিলেন। তখন তাঁর সেই মানসিক অবস্থা অনন্যাই শুধু বুঝেছিলেন। অনন্যার সঙ্গে বৈভব, সূর্য, মলয়, ও প্রভাসের ইউনিভার্সিটিতে আলাপ হয়।
তাঁদের সব আলোচনায় অনন্যা সহজভাবে যোগ দিতেন । বৈভব যে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত তা অনন্যাই বুঝতে পেরেছিলেন ।
একদিন হঠাতই অনন্যা ফোন করে বলেন,”বৈভব এখনই একবার আমাদের বাড়ি আসবে?”
“তোমাদের বাড়ি?কেন?”
আমার মেসোমশাই কবি ভবেশ বসু, চেনো নিশ্চয়ই, উনি এসেছেন। তোমার লেখা পড়ে প্রশংসা করছিলেন। তুমি এলে ওনার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব।”
ভবেশ বসুর সঙ্গে কথা বলে সেদিন বৈভব নতুন করে জীবনের অর্থ খুঁজে পেয়েছিলেন। এরপর একদিন অনন্যার সঙ্গে গঙ্গার পাড় ধরে শুকনো পাতার মর্মরতা ভেঙে হাঁটতে হাঁটতে বৈভব বলেছিলেন, “সত্যি অনন্যা তুমি আমার জন্য যা করেছ….”
অনন্যা উদাসীনভাবে অন্যদিকে তাকিয়েছিলেন । তখন চৈত্রের আকাশে রামধনুর রঙ, আচমকা হাওয়ার চাপল্য অনন্যার শাড়ির আঁচল এলোমেলো করে দিচ্ছিল। অনন্যাকে মনে হচ্ছিল প্রকৃতির বুকে বেড়ে ওঠা শকুন্তলার মতো এক নিসর্গ কন্যা! বৈভবের কথা শেষ না হতেই অনন্যা বলেন , “শুধুই কৃতজ্ঞতা! তুমি আমাকে কোনদিনও বুঝলেনা বৈভব!”
অনন্যার গলার স্বরে শ্লেষ মেশানো ছিল। সত্যি সেদিন বৈভব অনন্যাকে বুঝতে চান নি। এর কিছুদিন পরেই জেলা শহরের চাকরী নিয়ে বৈভব কলকাতা ছাড়েন। কয়েকমাস পর মলয়ের চিঠিতে বৈভব জানতে পারেন খুব ধনী অবস্থাপন্ন ঘরে অনন্যার বিয়ে হয়েছে। কিন্তু বিয়ের নিমন্ত্রণ পত্র না পাওয়ায় বৈভব অবাক হয়েছিলেন, পরে বুঝেছিলেন অনন্যা তাঁর ওপর অভিমান করেছে। অনেক বছর অনন্যার আর কোন খবর পাননি তিনি। বেশ কিছু বছর পর হঠাৎ খবরের কাগজে গাড়ি দুর্ঘটনায় প্রভাসের মৃত্যুর খবর খুবই বিমর্ষ করেছিল বৈভবকে! মলয় সূর্য তখন বাংলার বাইরে চাকরী করছে।
বছর দশেক পর লেখক হিসাবে যখন বৈভব খ্যাত হন, আরতিকে নিয়ে জেলা স্কুলের চাকরী ছেড়ে কলকাতায় ফ্ল্যাট কিনে স্থায়ীভাবে কলকাতা চলে আসেন। লেখালিখিতে ডুবে যান।
তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবে কেটে গেছে অনেক ক্ষণ! বাইরে সন্ধ্যা নেমেছে! বৈভব চেয়ে দেখেন আরতি এসে ঘরের আলো জ্বেলে দিয়ে গেছেন। বৈভব ধীরে ধীরে উঠে বসেন। আরতি ঘরে এসে বৈভবকে ওষুধ ও জলের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলেন ,” এখন কেমন লাগছে? ”
বৈভব আরতির দিকে এক পলক তাকিয়ে হেসে বলেন, “ভালো!”
আরতি আঁচল দিয়ে বৈভবের কপালের ঘাম মুছিয়ে দিয়ে বলেন, “এখন কদিন তোমার বিশ্রাম! অজ্ঞান অবস্থায় সেই ছেলেটি যখন তোমায় রিক্সা করে বাড়ি নিয়ে এলো,আমি এত ভয় পেয়ে গেছিলাম! তুমি আর কোনদিন গাড়ি ছাড়া এভাবে একা বেরোবেনা! যদি রাস্তায় কিছু একটা বিপদ ঘটে যেত!”
বলতে বলতে আরতির গলা ধরে এলো, চোখ ছলছল করে উঠল! বৈভব লক্ষ্য করেন বহুদিন বাদে আরতি তার সঙ্গে সহজ ব্যবহার করছেন। তিনি আরতির দুটো হাত ধরে সান্ত্বনার সুরে বলেন, “এখন তো আমি ভালো আছি। দুশ্চিন্তা কোরোনা!”
আরতি চোখের কোণ মুছে বলে, ” তুমি বিশ্রাম নাও। কিছু দরকার লাগলে আমায় ডেকো। বিছানা থেকে যেন উঠোনা!”
আরতি চলে যেতে গিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ালো।
“আমি তো বলতেই ভুলে গেছি সেই ছেলেটি পাশের ঘরে তোমার সঙ্গে দেখা করবে বলে বসে আছে।”
“কোন ছেলেটা?”
বৈভবের স্বরে বিস্ময়!
“তুমি অজ্ঞান হয়ে পড়লে ওই তো লোকজন ডেকে তোমায় রিক্সায় বাড়ি নিয়ে এসেছে। বড় ভালো ছেলে। তুমি কেমন আছো জানার জন্য বিকেল থেকে বসে আছে। ”
বৈভব আগ্রহের সুরে বলেন, “তাই নাকি? আগে বলোনি তো? নিয়ে এসো ওকে।”
আরতি একটি সতেরো আঠারো বছরের কিশোরকে নিয়ে ঘরে ঢোকেন। ছেলেটির ফর্সা সুকুমার চেহারা। ঘরে ঢুকেই ছেলেটি বৈভবকে প্রণাম করে।
“কি নাম তোমার?”
ছেলেটি বৈভবের দিকে লাজুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে উত্তর দেয় ” দ্যুলোক রায়। ”
“কোথায় থাকো?”
“কাছেই গভ: কোয়াটার্সে।”
দ্যুলোক প্রায়ই আসে। বৈভবের সঙ্গে গল্প করে। বৈভব লক্ষ্য করেন কম বয়েসী ছেলেদের মধ্যে যে চটুলতা চপলতা থাকে দ্যুলোকের মধ্যে নেই। শান্ত, ভদ্র, লাজুক প্রকৃতির ছেলে দ্যুলোক। তার কথায়, হাসিতে শিশু সুলভ সারল্য আছে। দ্যুলোক সাহিত্যানুরাগী। বৈভবের লেখার খুব ভক্ত। একদিন কথায় কথায় বৈভব জানতে পারেন দ্যুলোকের বাবা নেই, মা স্কুল টিচার। দ্যুলোক এলে আরতিরও খুব ভালো লাগে। দ্যুলোক ধীরে ধীরে বৈভব আরতির সংসারের একজন হয়ে ওঠে।
মাস খানেক বাদে বৈভব আবার লেখালেখি শুরু করেন। দ্যুলোক যে কবিতা লেখে সে কথা আরতিই বৈভবকে জানান। দ্যুলোককে জিজ্ঞাসা করলে সে মাথা নিচু করে থাকে। একদিন বৈভব জোর করে দ্যুলোকের লেখা দেখতে চান। প্রথমে জড়তা থাকলেও একদিন দ্যুলোক তার একটি লেখা বৈভবকে এগিয়ে দেয়। কবিতাটি পড়ে চমকে ওঠেন বৈভব। এত সুন্দর শব্দ চয়ন, চমৎকার বিন্যাস তাঁকে বিস্মিত করে। তিনি দ্যুলোককে আরো লিখতে উৎসাহ দেন। ছেলেটির প্রতিভা আছে। দ্যুলোককে ঠিক মতো এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলে সাফল্যের শীর্ষে উঠবেই– এ ব্যাপারে বৈভব নি:সন্দেহ।
দ্যুলোক প্রায় দু সপ্তাহ ধরে বৈভবের সঙ্গে দেখা করতে আসছেনা। হঠাৎ একদিন রাস্তায় দ্যুলোককে দেখে বৈভব তার না আসার কারণ জিজ্ঞাসা করায় দ্যুলোক উত্তর না দিয়ে মাথা নীচু করে থাকে। বৈভব দ্যুলোকের হাত দুটো ধরে বলেন, “আমায় বলবিনা তোর অসুবিধার কথা?”
দ্যুলোকের চোখে কয়েক ফোঁটা অশ্রু বিন্দু লক্ষ্য করেন বৈভব।
” কি হয়েছে তোর? কাঁদছিস কেন? ”
” মা চাননা আমি লিখি। ”
“কেন চাননা? তুই যে লিখতে পারিস সকলে কি তা পারে? উনি তো টিচার। উনি নিশ্চয়ই এটা বোঝেন।”
“আমি তো বাবার মতোই বড় লেখক হতে চাই। জানিনা কেন মা তা চান না।”
বৈভব একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন, “কি নাম তোর বাবার?”
“প্রভাস রায়।”
নামটা শোনা মাত্র বৈভব চমকে ওঠেন। এতদিন দ্যুলোককে চেনেন, অথচ দ্যুলোক যে প্রভাসের ছেলে জানতেই পারেনি। তিনি কিছু ক্ষণ দ্যুলোকের দিকে চেয়ে থাকেন, তারপর দ্যুলোকের পিঠে হাত দিয়ে সস্নেহে বলেন, ” ঠিক আছে। আমি তোর মাকে বুঝিয়ে বলবো। ”
“আপনি যাবেন আমাদের বাড়ি?”
দ্যুলোকের চোখ খুশিতে ভরে ওঠে। বৈভব হেসে মাথা নাড়েন।
পরদিন রবিবার। দ্যুলোকের ঠিকানা খুঁজে বের করে কোয়াটার্স-এর দরজায় কড়া নাড়েন বৈভব। একজন বয়স্কা মহিলা দরজা খোলেন।
“মিসেস রায় আছেন? ”
“বসুন। ডেকে দিচ্ছি। ”
বয়স্কা মহিলা ভেতরে চলে গেলেন। ঢুকেই একটি বসার ঘর– খুবই রুচিসম্মত ভাবে সাজানো। চারটি সুদৃশ্য চেয়ার, একটি সেন্টার টেবিল, দুপাশে দুটি বুক সেলফে অনেক বই — বেশীর ভাগই অবশ্য কবিতার। চেয়ারে বসে ঘরটি নিরীক্ষণ করতে করতে হঠাৎ দেওয়ালে প্রভাসের একটি ছবি চোখে পড়ল বৈভবের। খুবই জীবন্ত ছবি, উজ্জ্বল হাসির আভাস সমস্ত মুখে ছড়িয়ে পড়েছে।প্রভাসের ফটোতে একটি টাটকা রজনীগন্ধা ফুলের মালা ঝুলছে। রজনীগন্ধা ছিল প্রভাসের প্ৰিয় ফুল। রজনীগন্ধা নিয়ে প্রভাস কবিতাও লিখেছিল। বৈভব এই নিয়ে ঠাট্টা করে প্রভাসকে বলেছিলেন, “কে তোর এই রজনীগন্ধা, যে তোর হৃদয়ে তার সুবাস ছড়িয়েছে। ”
বৈভব প্রভাসের ফটোর দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে এসব কথা ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক গিয়ে গেছিলেন, ঘরে একজন ভদ্রমহিলা এসে দাঁড়িয়েছেন তা খেয়ালই করেননি। ভদ্রমহিলাকে হঠাৎ দেখতে পেয়ে সচকিত হয়ে বৈভব নমস্কার জানান। ইনিই দ্যুলোকের মা– বৈভব বুঝতে পারেন। ভদ্রমহিলার পরণে সাদা তাঁতের শাড়ি, চোখে চশমা, নীচের দিকে তাকিয়ে আছেন। দেখে মনে হয় তিনি সবেমাত্র স্নান সেরে এসেছেন। পিঠে এক ঢাল সিক্ত চুল ছড়িয়ে। বেশ দীর্ঘাঙ্গী। ভদ্রমহিলা এবার ধীরে ধীরে মুখ তুলে বৈভবের দিকে তাকিয়ে বলেন, “নমস্কার। আমিই দ্যুলোকের মা মিসেস রায়।”
আরে এ যে অনন্যা! বয়স বাড়লেও চশমার নীচে সেই গভীর চোখ দুটি চিনতে ভুল করেননি বৈভব।
“অনন্যা তুমি?”
বৈভবের বিস্ময় মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। অনন্যা একটু হেসে শান্ত স্বরে বলেন, “হ্যাঁ বৈভব, ঠিকই চিনেছো। জীবনটা যে কত বিচিত্র লেখক হয়েও তুমি তা বুঝলেনা! তাই আজও অবাক হও।”
“অনন্যা আমি যে কিছুই বুঝতে পারছিনা।”
বৈভব অবুঝ ভাবে অনন্যার দিকে তাকিয়ে থাকেন। অনন্যা আবার নীচের দিকে মুখ করে শাড়ির আঁচলের এক প্রান্ত আঙ্গুলে জড়াতে জড়াতে বলেন , “তুমি নিশ্চয়ই শুনেছিলে আমার বিয়ে হয়েছিল এক ধনী ব্যবসায়ীর একমাত্র ছেলের সঙ্গে।
কিন্তু নিজের রুচি, শিক্ষাগত সংস্কার ত্যাগ করতে না পারায় শ্বশুরবাড়িতে মানিয়ে নিতে পারিনি। এক বছরের মধ্যেই আমাদের ডিভোর্স হয়ে যায়। আমি তখন মানসিকভাবে ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়ি। আত্মবিশ্বাস শেষ হয়ে গেছিল!সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল আত্মহত্যাই বোধহয় আমার একমাত্র পথ!”
অনন্যা একটু থামেন।
“তারপর?”
বৈভবের স্বরে জানার আকুলতা।
“সেই চরম বিপদের দিনে প্রভাসই আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। প্রভাস যে আমায় চিরকালই ভালোবাসতো তা বুঝতে পারিনি। সেদিন প্রভাস সব যন্ত্রণা মুছে দিয়ে আমার জীবন সুখের আশ্বাসে ভরিয়ে দেয়। কিন্তু চিরস্থায়ী সুখ হয়তো আমার কপালে ছিলনা!”
অনন্যার মুখে বিষাদের ছায়া লক্ষ্য করেন বৈভব।
“প্রভাস যে তোমায় বিয়ে করেছিল আমি তা জানতাম না।”
অনন্যা বৈভবের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন, “আমি কিন্তু তোমার সব খবরই রাখতাম।”
বেশ কিছু ক্ষণ নীরবতার মধ্যে কাটে। একটা অপরাধবোধ বৈভবকে ভীষণভাবে গ্রাস করতে থাকে। বৈভবই এবার প্রশ্ন করেন, “অনন্যা, তুমি তোমার ছেলের প্রতিভার কথা জানো?”
অনন্যা জানলার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে উদাসীন ভাবে বলেন, “জানি।”
“তবে কেন তুমি দ্যুলোককে কবিতা লিখতে বারণ করছো?”
অনন্যার ভুরু ঈষৎ কুঞ্চিত হয়!হঠাৎ বলে ওঠেন, “কবিরা বড় স্বার্থপর হন। তুমি, প্রভাস–সবাই স্বার্থপর। নইলে তুমি আমাকে এভাবে ভুলে থাকতে পারতেনা, আর প্রভাসও আমায় অসহায়ভাবে ফেলে চলে যেতনা! কিন্তু দ্যুলোককে আমি হারাতে পারবনা!ওই যে আমার একমাত্র অবলম্বন! ”
কথা বলতে বলতে অনন্যার গলার স্বর নরম হয়ে আসে। চশমা খুলে চোখ মোছেন অনন্যা। বৈভব অবাক হয়ে অনন্যাকে দেখছিলেন। সেই মুহূর্তে তিনি অনন্যাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাননা! অনন্যা চিরকালই আভিমানিনী। তবু শেষবার অনন্যাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন।
“অনন্যা, তোমার মনের অবস্থা আমি বুঝি। কিন্তু দ্যুলোকের কথা একবার ভাবো। ওর এত বড় একটা প্রতিভা এভাবে নষ্ট হয়ে যাবে! আজ প্রভাস বেঁচে থাকলে কখনোই তা হতে দিত না।”
অনন্যা স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে। বৈভব অনন্যাকে নিরুত্তর দেখে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ অনন্যা বলেন, “বৈভব, শোন, যেওনা! দ্যুলোককে আমি আর লিখতে বাধা দেবনা। শুধু তুমি ওকে একটু সাহায্য কোরো।”
অনন্যা চশমাটা পরে বৈভবের দিকে তাকিয়ে সহজ ভাবে একটু হাসার চেষ্টা করেন। বৈভব দেখেন অনন্যার মুখ থেকে আশঙ্কার মেঘ ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে!
[মতামত ও বানানবিধি লেখকের নিজস্ব]
Tags: গল্প, জনা বন্দ্যোপাধ্যায়, মেঘ-মুক্তি
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।