বিয়ের বাজারে ময়ূখ মিত্রকে অবহেলা করবে এমন বুকের পাটা কোনো মেয়ের বাপেরই হবে না। কথাটা আলোকপর্ণা ভালোভাবেই জানেন। তাই দেখাশোনার সময় নিঃসংকোচে বলেই ফেললেন- আপনাদের মেয়ের আমাদের বাড়িতে কোন অসুবিধাই হবে না । ময়ূখ আমার একমাত্র ছেলে , দিশা বৌমা নয় মেয়ের মত থাকবে। ছেলে যদিও চাকরি নিয়ে খুব ব্যাস্ত , কত নামকরা এমএনসি ওদের ,তার আবার টপ পোস্ট , তাবলে বৌকে সময় দেবেনা , এমন শিক্ষা দেইনি ওকে আমি । একটু মুডি ছেলে আমার ,দিশাকে ওর মন বুঝে চলতে হবে এই যা । আর ময়ূখ যখন অফিসে থাকবে, দিশা আমার সাথে গল্প গুজব করবে । তিন বছর হল ময়ূখের বাবা চলে গেছেন , বাড়িতে একা লাগে, আমিও সঙ্গী পাব । মেয়েতো ভালো গানও জানে বললেন , মাঝে মাঝে শোনাবে একটা আধটা । আমি কিন্তু তোমার খুব ভালো বন্ধু হতে পারি মা, যদি তুমি চাও অবশ্য ।
ছেলের মায়ের এমন কথা শুনে স্বভাবতই দিশার বাবা মা আহ্লাদে গদগদ। পরিমল বললেন – না, না দিদি, নিজের মেয়ে বলে বলছিনা , দিশার মত এমন ভদ্র, শান্ত স্বভাবের মেয়ে …. আপনাদের বাড়িতে মানিয়ে গুছিয়েই চলবে ও ।
– হ্যাঁ আর তার জন্য স্বামী আর শ্বশুরবাড়িকে অনেকটা সময় দিতে হবে । তাই বিয়ের পর দিশার ওই প্রাইভেট ব্যাঙ্কের চাকরিটি ছাড়তে হবে । আপনি মেয়েকে ইংলিশে মাস্টার্স করিয়েছেন পরিমলবাবু , দিশা উচ্চশিক্ষিত, আমরা শুধু এটুকুই চাই । ময়ূখেরও ইচ্ছা নয় ওর স্ত্রী চাকরি করুক । আমরা মেয়েদের চাকরি করার বিপক্ষে নই , তবে যাদের সংসারে প্রয়োজন তারা করুক না । ময়ূখ যা রোজকার করে,আপনাদের মেয়ে আরামে আয়েসে থাকবে সারাজীবন।এবার আপনারা ভেবে দেখুন ।
দিশার বাবা মা হয়তো সঙ্গে সঙ্গেই সম্মতি জানাতেন কিন্তু মেয়ের অন্ধকার হয়ে আসা মুখটার দিকে তাকিয়ে পারেননি । কিন্তু আলোকপর্ণা নিশ্চিত ছিলেন ফোনটা আসবেই আর সেটাই হল । দুদিনের মধ্যেই পরিমল জানালেন তাঁর মেয়ে দিশা একান্ত ঘরোয়া হয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে রাজি । মনে মনে হাসেন আলোকপর্ণা।
মেয়েটা যে সেলফ ডিপেন্ডেন্ট , নারীস্বাধীনতা এই জাতীয় সেন্টিমেন্ট আঁকড়ে না থেকে নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ বেছে নিতে পেরেছে, এতে বেশ খুশি হলেন তিনি ।
যথাসময়ে লাল বেনারসিতে সেজে দিশা প্রবেশ করল তার নতুন জীবনে । সে যে রূপে লক্ষী গুনে সরস্বতী,সেকথা আত্মীয় মহলে আগেই প্রচার করেছিলেন আলোকপর্ণা। নতুন বৌ দেখে আমন্ত্রিতরা সবাই চক্ষু কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করলেন । নিজের পরমাসুন্দরী বৌকে নিয়ে বন্ধু বান্ধবীদের গুঞ্জন ময়ূখ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করল । দিশাই কেবল তার মাস্টার্সএ ফার্স্ট ক্লাস ও রবীন্দ্রসংগীতে ডিপ্লোমার অহরহ প্রচার শুনে কেমন একটা লজ্জিত হয়ে পড়ল ।
কথা রেখেছেন আলোকপর্ণা। দিশার আরামে আয়েসে জীবন কাটানোর সব বন্দোবস্ত তিনি নিজের হাতে করেছেন। তাঁর পছন্দমত শৌখিন আসবাবে সেজেছে দিশা ময়ূখের ঘরটা । পরিমলের দেওয়া সোনার গহনাগুলো ঢাকা পড়েছে তাঁর উপহার -ভারী জড়োয়ার সেটে । বৌভাতের পরের দিনই ছেলে বৌয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন থাইল্যান্ডে হানিমুনের টিকিট । দিশা সচ্ছল পরিবারের মেয়ে , কিন্তু প্রাচুর্যের সাথে পরিচিত নয়। তাই কিছুটা হতভম্ব হয়েই জীবনের এই অধ্যায়ের সে কেবলমাত্র নীরব দর্শকে পরিণত হয়েছে ।
বিয়ের পরও দুই পক্ষের আত্মীয়স্বজনের নিমন্ত্রণ রক্ষা ও বেশ কিছু পোস্ট ম্যারেজ পার্টি এটেন্ড করতে করতে কাটলো প্রায় তিনটে মাস । সকলেই একটি বিষয়ে একমত । ময়ূখের স্ত্রী ভাগ্য আর দিশার স্বামী ভাগ্য দুটিই ঈর্ষণীয় । দিশার প্রাক্তন কলিগ সোমা সেদিন দেখা করতে এসে বললো ,- বাড়ির চাপে চাকরি ছাড়তে হল বলে মন খারাপ করছিলি, এখন দেখ কেমন রাজার থুড়ি রানীর হালে আছিস । ময়ূখদা তো চোখে হারাচ্ছে তোকে আর শাশুড়ি মাও তো বেশ ভালো বলেই মনে হল ।তুমি এখন মৌজ কর, আমরা দশটা পাঁচটা খেটে মরি আর বসের বাক্যবাণ শুনি ।
সত্যি এ বাড়িতে দিশার অনন্ত অবসর কাজের লোক, রান্নার লোক ছাড়াও আছেন মিনুমাসী, ময়ূখের আয়া আর আলোকপর্ণার চব্বিশ ঘন্টার আটেনডেন্ট । দিশার কাজ বলতে ময়ূখ অফিস যাওয়ার সময়ে তার জিনিসপত্র এগিয়ে দেওয়া , তারপর সারাদিন শাশুড়ি ও মিনুমাসীর সাথে টুকটাক গল্পগাছা , নিজের পছন্দের বই পড়া ,গান শোনা , ফোন ঘাটা আর রূপচর্চা । সেদিকে অবশ্য আলোকপর্ণা বেশ আধুনিক । দিশা যেন মাসে অন্তত একবার পার্লার ট্রিটমেন্ট করায় , জিম – যোগার মাধ্যমে নিজেকে সুস্থ ,সতেজ রাখে, পার্টিতে ময়ূখের পছন্দমত পোশাকেই সাজে – সব দিকেই তাঁর সজাগ দৃষ্টি । এমনকি অফিস পার্টিতে কার সাথে ঠিক কতটা কথা বলতে হবে , বসের স্ত্রীর গাম্ভীর্য কতটা হওয়া উচিত, সেটাও তিনি আগে থেকেই শিখিয়ে দেন ওকে । দিশার মনে হয় সে যেন একটা খুব দামি শোকেসের পুতুল যাকে ময়ূখ পরিচিত সমাজে দেখিয়ে আনন্দ পায় আর এ পুতুলটিকে যত্ন করে সুন্দর রাখার দায়িত্ব আলোকপর্ণার । ময়ূখ মিত্রের স্ত্রী ছাড়া তার যেন অন্য কোন পরিচয় থাকতে নেই । বাবা মা , বন্ধু বান্ধবদের সাথে এসব কথা আলোচনাও করে না দিশা , তারা বুঝবেনা ।
বাধ্য হয়ে একদিন ময়ূখকে বলে দিশা – আমার এভাবে বসে শুয়ে দিন কাটাতে ভালোলাগছেনা, আমি কিছু করতে চাই ।
– কি করবে আবার তুমি ?
– ভাবছি পিএইচডির জন্য চেষ্টা করব ।
– সে করতেই পারো , কিন্তু ডিগ্ৰী বাড়িয়ে চাকরির কথা ভেবোনা যেন ।
– কেন তোমরা এমন ভাবো , মেয়েরা কি শুধু প্রয়োজনে চাকরি করে ? তাদের কি নিজের একটা পরিচয় তৈরী করতে ইচ্ছে করেনা ?
– জানি দিশা কথাগুলো বলতে ভালো , শুনতেও খাসা , কিন্তু এ বিষয়ে সব কথা বিয়ের আগেই শেষ হয়ে গেছে ।চাকরিটা ছাড়ার সময় দিশার ভেবেছিল বিয়ের পর ময়ূখকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে যদি রাজি করানো যায় , কিন্তু সে আশার প্রদীপ নিবে আসছে ক্রমশ । কিছুটা মরিয়া হয়েই বলে দিশা – আমার বন্ধুরা করোনার ফলে স্কুলছুট বা পিছিয়ে পড়া বাচ্ছাদের বিভিন্ন জায়গায় ক্যাম্প করে পড়াচ্ছে , আমিও কটা দিন ওদের সাথে যোগ দিতে চাই ।
– পাগল হলে নাকি , এই গরমে তুমি যাবে ঐসব ক্যাম্পে ছেলে পড়াতে , ওগুলোতো বেশিরভাগ বস্তি এলাকায় হয় ।
দিশার ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙে ।- আমার কি নিজের কোন ইচ্ছে অনিচ্ছে থাকতে নেই ? তুমি ঠিক কি চাও ময়ূখ ?
বামহাতে দিশার কোমর জড়িয়ে তাকে কাছে টেনে কপালে একটা চুমু খেয়ে ময়ূখ বলে – আমি শুধু চাই , আমার সুন্দরী বৌটাকে যেন কোন কষ্ট করতে না হয় , তুমি আরো পড়তে চাইলে পড় না , সমাজসেবা করতে চাইলে এনজিও ওপেন কর । তাছাড়া আর বছরখানেক পর তো আমাদের একটা ছোট্ট ময়ূখ বা মিষ্টি দিশাকে আনতে হবে না পৃথিবীতে ? তখন সময়ই পাবেনা এতকিছু ভাবার ।
ময়ূখ অফিস চলে যাবার পর কান্নায় ভেঙে পড়ে দিশা । সত্যিই ময়ূখ কিছু বোঝেনা, না ইচ্ছে করে বুঝতে চায়না দিশার যন্ত্রনাটা । কি বলে গেলো ময়ূখ ? দিশার মেয়ে হলে তো আবার একটা পুতুল তৈরী হবে,ছেলে হলে দ্বিতীয় ময়ূখ মিত্র । আকাশ পাতাল ভেবেও কুলকিনারা পায়না সে ।
কদিন পর বিকালে আলোকপর্ণার বান্ধবী রীতা তার ছেলে বৌকে নিয়ে বেড়াতে এসেছেন। অতিথিদের অনুরোধে দিশা অনেকদিন পর গান গাইল — যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙলো ঝড়ে । অন্তরের কান্না এমনভাবে ঝরে পড়ল তার কণ্ঠে যে শ্রোতাদের চোখে জল । রীতার ছেলে তমোঘ্ন বলেন,- বৌদি , এমন ট্যালেন্ট ঘরে লুকিয়ে রাখে কেউ ? রেডিও , টিভিতে অডিশন দিন না , এখন তো রিয়ালিটি শোর যুগ । আমার বন্ধু অভিজিৎ একটা নামী বেসরকারি চ্যানেলে মিউসিক ডিরেক্শনের কাজ করে । বলেন তো যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারি ।
– ধন্যবাদ, আমাদের বাড়ির বৌ টিভিতে গান গাইবে না । দিশা কিছু বলার আগেই কঠিন স্বরে বলে ওঠেন আলোকপর্ণা । তমোঘ্ন কিছু একটা বলতে গিয়েও মায়ের ইশারায় চুপ করে যায় ।
– মা, বিয়ের আগে কথা হয়েছিল আমি চাকরি করব না , গান গাইবনা সে কথা তো দিইনি, রীতারা চলে যাবার পর সরাসরি শ্বাশুড়ীকে প্রশ্ন করে দিশা ।
– তোমার গান গাওয়ায় তো বাধা নেই মা , শুধু তাই নিয়ে কারবার করতে বারণ করছি ,আমি তো তাও তোমায় ঘরোয়া জায়গায় গান গাইতে দি, আমার শ্বাশুড়িতো আমার গান গাওয়ার জায়গা ঠিক করেছিলেন একমাত্র ঠাকুরঘর ।
কি একটা বলতে গিয়ে হঠাৎ থমকে যায় দিশা, তারপর বলে,- মা , আপনি গান গাইতেন?
আলোকপর্ণা কেমন একটা থতমত খেয়ে কোন উত্তর না দিয়ে তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে চলে যান ।- কি হল বলত মীনুমাসি ?
চায়ের কাপ ধুতে ধুতে পুরো ঘটনাটাই লক্ষ করেছে মীনু ।- না জেনেই দিদির বড় দুর্বল জায়গায় নাড়া দিয়ে ফেলেছো বৌমনি , এতো বছরেও সে ঘা শুকোয়নি ।
– কি বলছো গো , কিসের ঘা ?
– আমি তোমার শাশুড়ির বাপেরবাড়ির লোক , ছোট্ট থেকে দিদিকে দেখছি , গানই তার ধ্যান জ্ঞান ।বাড়িতে ওস্তাদ এসে তালিম দিতেন , কত প্রতিযোগিতায় মেডেল পেতো দিদি , সিনেমার গানগুলো , দিদির গলায় যেন আসল গানের থেকেও ভালো শোনাতো । গান নিয়ে তার কত স্বপ্ন । এক জলসায় গান গাইতে গিয়েই তো দিদি তার শ্বশুরমশায়ের নজরে পড়ে । বর্ধমানের পুরানো জমিদার বংশ, বিশাল নামডাক, জামাইবাবু ভিলাইতে বড় চাকরি করেন , দিদির বাবা এমন সম্মন্ধ হাতছাড়া করেন কিভাবে ? বিয়ের পর দিদির সাথে আমি গিয়েছিলাম সে বাড়িতে আর গিয়েছিল দিদির হারমোনিয়ামখানা । দিদির শ্বাশুড়ি ওখানা দেখেই বলেছিলেন – ওটা ওই পুরোনো আসবাবের ঘরে রেখে এসো বাছা , তোমার মেয়ে হলে সে শিখবেন । বাড়ির বৌ তো আর গলা সাধবে না । তবে তোমার শ্বশুরমশায় গান ভালোবাসেন , মাঝে মাঝে ঠাকুরঘরে বসে তাঁকে শ্যামাসংগীত শুনিও ।
– তারপর ? মার গান বন্ধ হয়ে গেল ?
– তা না তো কি, বনেদি বাড়ি, কত লোকজন, বাড়ির বৌ গান করবে, তা কেউ ভাবতেই পারত না । দিদির কদিন সে কি কান্নাকাটি। জামাইবাবুকেও কত বলেছিল তাকে ভিলাই নিয়ে যাওয়ার জন্য , সেখানে যদি … কিন্তু না , সেও তো বাড়ির ধারা , এক্কেবারে গোঁড়া । বছর ঘুরতেই ময়ূখদাদা এলো,দিদি তখন একদিন লুকিয়ে আমার হাতে একখানা প্যাকেট দিয়ে বললে সেটা জলে ফেলে দিতে । কৌতূহলবসে খুলে দেখি , তাতে দিদির প্রাণভোমরা , সব মেডেল আর সার্টিফিকেটগুলো , বাপেরবাড়ি থেকে আসার সময় লুকিয়ে এনেছিল। ফেলিনি, রেখে দিয়েছি, দিদি জানেনা তারপর ময়ূখদাদা বড় হল, দিদির শ্বশুর-শ্বাশুড়ি গত হলেন, জামাইবাবু ট্রান্সফার নিয়ে কলকাতায় চলে এলেন , ওদিকের বাড়ির ভাগ বেচে সল্টলেকে ফ্ল্যাট কেনা হল – দিদিও কেমন বদলে গেল ধীরে ধীরে ।
তার মানে আজ থেকে প্রায় বত্রিশ বছর আগে আরো একটি পাখিকে এনে খাঁচায় বন্দী করা হয়েছিল ! ডানাছেটে জোর করে তার মন থেকে মুছে দেওয়া হয়েছিল আকাশের স্বপ্ন ! তাই কি এখন এই রক্ষনশীলতা ?
শুধুই বনেদি বাড়ির নিয়ম নাকি প্রতিশোধ ? আলোকপর্ণার জন্য দিশার কষ্ট হয় ।
পরের দিন দুপুরে হঠাৎ বৃষ্টি । দিশা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে উপভোগ করছে আর্দ্র বাতাসের স্পর্শ ।
আলোকপর্ণার উচ্চস্বর শুনে তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে যায় । তিনি তখন দিশার ঘরের জানালা বন্ধ করেছেন। দিশাকে দেখে বলে ওঠেন – তোমার কি কোন সেন্স নেই ? জানলার পাশে হারমোনিয়াম রেখে গেছো , বৃষ্টির ঝাঁট এসে ভিজছে ওটা দেখতে পাওনি ? যন্ত্রে দেবী সরস্বতীর বাস , তাকে অবহেলা কর তুমি নাকি আবার গাইয়ে হবে বলে তর্ক করছিলে ।
পরম মমতায় হারমোনিয়ামের গায়ে লেগে থাকা জলের ফোঁটাগুলো আঁচলে মুছে চলে গেলেন আলোকপর্ণা ।দিশা মুচকি হাসলো , তার প্রথম পরীক্ষা সফল ।
ময়ূখ আজ দেরি করে ফিরবে অফিস থেকে । এমন দিনগুলোয় বিকালে দিশা মাঝে মাঝে বাবা -মার সাথে দেখা করতে যায় বালিতে। কিন্তু আজ হঠাৎ হারমোনিয়াম নিয়ে ডাইনিংএ বসে পড়ে, যেখানে আলোকপর্ণা বই পড়ছিলেন । দিশাকে দেখে একটু বিরক্তই হন তিনি । সে বিরক্তি চরমে ওঠে দিশার আমি গান শোনাব একটি আশা নিয়ে গাওয়ার ধরণ শুনে ।
– রবীন্দ্রসঙ্গীত ভালো পারো ,সেটাই করোনা , আবার হেমন্ত মুখার্জিকে নিয়ে টানাটানি করছো কেন ?
– কি যে বলেন মা, আজ যে ওনার জন্মদিন , রেডিও টিভিতে কত অনুষ্ঠান , আর আমি শিল্পী হয়ে ওনাকে একটা ট্রিবিউট দেব না ?
– শ্রদ্ধা জানাতে হলে গানটা সঠিকভাবে গাওয়া উচিত , নইলে শ্রদ্ধা না হয়ে শ্রাদ্ধ হয় গানের ।আলোকপর্ণা বেশ রেগে গেছেন ।
দিশা মুখ বেঁকিয়ে বলে – এমন করে বলছেন যেন আপনি খোদ হেমন্ত মুখার্জির থেকে গানটা শিখে এসেছেন । সমালোচনা করতে গেলেও যোগ্যতা লাগে মা , আমি গানে ডিপ্লোমা আর আপনার দৌড় তো ওই ঠাকুরঘর পর্যন্ত ।
আর সহ্য হলো না আলোকপর্ণার। একেই কাল অশান্তির কারণে মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে ছিল, তার ওপর দিশার এই ভুল গান আর উদ্ধত ব্যবহার ,সংযমের সব বাঁধ ভেঙে দিলো তার । দিশার থেকে হারমোনিয়াম কেড়ে নিয়ে গাইলেন তার অতি প্রিয় গান , যা একসময় বহু আসরে গেয়েছেন , পুরস্কৃত হয়েছেন , প্রশংসার বন্যায় ভেসেছেন ।
রান্নাঘর থেকে ছুটে এলেন মীনু – এতো বছর পরেও তোমার গলাটা একই রকম মিষ্টি আছে দিদি , প্রাণটা আমার জুড়িয়ে গেল। দিশা আনন্দে জড়িয়ে ধরলো শ্বাশুড়িকে – কেন মা ? কিসের জন্য এখনো গানকে নিজের বুকে বন্দী রেখে এত কষ্ট পাচ্ছ ? তোমার কণ্ঠে যে সরস্বতীর বাস , এতে কি তার অপমান হচ্ছেনা ? আর আলোকপর্ণা ? তার দুচোখে শ্রাবণধারা । প্রবল আবেগে কোথায় যেন ভেসে যাচ্ছে গানের ওপর জমে থাকা দুরন্ত অভিমান, কমে আসছে বুকের দহনজ্বালা ।
দিশা ছাড়বার পাত্রী নয়, আলোকপর্ণার থেকেই আধুনিক গানের শিক্ষা নেবে সে। জোর করে শিখতে শুরু করে , সেই সূত্রে কখন যেন আলোকপর্ণার গলায় একটা গান লিখো আমার জন্য গানটি রেকর্ড করে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে দেয়, তাঁর অজান্তেই । মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাল হয় ভিডিওটি , শুভেচ্ছায় ভরে ওঠে কমেন্ট বক্স । আলোকপর্ণার পুরোনো কিছু শ্রোতা তাঁকে চিনতে পেরে আনন্দে আপ্লুত হয়ে ওঠেন।
– করেছো কি দিশা তুমি , দুদিন বাদে কাজ থেকে ফিরে ময়ূখ বলে, আমার মাকে তো রীতিমত সেলিব্রিটি করে তুলেছো । আজ অফিসে দেবোত্তম দেখালো মায়ের গানের ভিডিওটা , ওরা তো সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ । তুমি গান গাও এটাই জানতাম , কিন্তু আমার নিজের মা ই যে এতো ভালো গান করে….
— সেটা জানতেনা , তাই ত ? কিকরে জানবে ? জানার চেষ্টা করেছো কখনো ? চিরকাল তো আলোকপর্ণা মিত্রকে বাড়ির বৌ আর তোমার মা হিসেবেই দেখে গেছো , তার যে নিজস্ব কোন পরিচয় থাকতে পারে , ভালোলাগা , ইচ্ছে অনিচ্ছে থাকতে পারে , সেসব ভেবে দেখোনি কোনোদিন । অবশ্য দোষটা তোমার নয় । এ সমাজের শিরায় শিরায় প্রবাহিত যে পিতৃতন্ত্র , তাকে উপেক্ষা করতে পারেনি তোমার পরিবার , তোমার বাবা , এমনকি তোমার মা ও । তাই উচ্চশিক্ষিত , কলকাতার মত আধুনিক শহরের বাসিন্দা হয়েও তুমি তোমার বৌকে পুতুল করে সাজিয়ে রেখেছ বাড়িতে , নিজের মায়ের মনেও কোনোদিন উঁকি দিয়ে দেখোনি , সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটাকে হারিয়ে কতটা কান্না জমে পাথর হয়েছে তার বুকে ।
মাথা নিচু করে বসে ময়ূখ , হয়তো চেনা জগতের বাইরে গিয়ে নতুন কিছু বোঝার চেষ্টা করছে , জীবনে প্রথমবার । দিশার বেশ মজা লাগে । দিদিমনির মত বলে স্বামীকে , যদি সত্যিই বুঝতে পেরে থাকো তোমার ভুল , তোমায় প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে ময়ূখ । রামমোহন , বিদ্যাসাগরের মত কোন বিশাল বিপ্লব করতে হবেনা তোমায় , শুধু একটা ছোট্ট কাজ , বল পারবে ?
কদিন পর । ময়ূখ সেদিন অফিস ছুটি নিয়েছে । সকাল সকাল তৈরি হয়ে নিতে বলেছে মাকে , কার বাড়ি নাকি গুরুপূর্ণিমার পুজোর নিমন্ত্রণ আছে । দিশা একটা সুন্দর তসরের শাড়ি পরার জন্য অনুরোধ করেছে আলোকপর্ণাকে , নিজেও লালপাড় ঢাকাইয়ে সেজেছে । যথাসময়ে ময়ূখের গাড়ি এসে থামলো সুন্দর সাজানো একটা কমিউনিটি হলের সামনে । সেখানে বেশ ভিড় । আলোকপর্ণা দেখলেন , বেশ কিছু অচেনা মানুষের সাথে উপস্থিত আছেন শহরের নামী কিছু সংগীতশিল্পী ,ময়ূখের বেশ কিছু বন্ধু , সহকর্মী , আলোকপর্ণার
কিছু আত্মীয়-বন্ধু , এমনকি দিশার মা বাবাও ।
বিস্মিত আলোকপর্ণা ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলেন, কাদের বাড়ির পুজো রে বাবাই ?
— চল না , গেলেই দেখতে পাবে ।
ময়ূখ আর দিশা আলোকপর্ণাকে নিয়ে লাল কার্পেটের উপর দিয়ে হেঁটে উঠল একটা ছোট্ট , সুসজ্জিত মঞ্চে ।সমবেত সবাই করতালি দিয়ে অভিবাদন জানিয়ে আসন গ্রহণ করলো । রীতিমত অপ্রস্তুত আলোকপর্ণা চাপা স্বরে দিশাকে জিজ্ঞাসা করলেন – এসব কি ? পুজোটা কোথায় হচ্ছে ?
পুজো তো এবার শুরু হবে মা । দিশা মাইক হাতে নিল । সকলকে উদ্যেশ্য করে বললো – কিছুদিন আগে আমার পোস্ট করা একটি গান খুব জনপ্রিয় হয়েছে , আপনারা সকলেই শুভেচ্ছা জানানোর সাথে সাথে সেই শিল্পীর আরো অনেক গান শুনতে চেয়েছেন , অনেকে সংগীতশিক্ষাও নিতে চেয়েছেন তাঁর কাছে । প্রায় ত্রিশ বছর নিয়মিত চর্চার বাইরে থাকার পরও এমন গান , কণ্ঠে মা সরস্বতীর বাস হলে তবেই সম্ভব । সেই গানের পাখি যে এতদিন বন্দী ছিল সংসারের খাঁচায় , তাকে আমরা আজ মুক্ত করব সুরের আকাশে , তার জন্যই এতো আয়োজন , আর সেই শুভ কাজটা করবে তার ছেলে ময়ূখ ।
এগিয়ে এলো ময়ূখ । আলোকপর্ণার হাতে একটা ছোট্ট যন্ত্র দিয়ে বললো , এটা প্রেস কর মা, তোমার উপর এতদিন হয়ে চলা অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করতে দাও আমাকে ।
মন্ত্রমুগ্ধের মত আলোকপর্ণা একটা বোতাম টিপলেন , মঞ্চের ডিজিটাল স্ক্রিন উন্মুক্ত হয়ে উজ্জ্বল অক্ষরে ফুটে উঠলো — সুরের আকাশে সংগীতশিক্ষাকেন্দ্র , শিক্ষিকা : শ্রীমতী আলোকপর্ণা মিত্র । সমবেত দর্শকদের করতালি শেষে দিশা আবার বললো , এই হলটির পাশে একটি ঘরে আজ থেকে শুরু হল আমাদের মায়ের গানের স্কুল । মা আমাকে একদিন গান নিয়ে কারবার করতে বারণ করেছিলেন , তাই এই সংগীতশিক্ষাকেন্দ্র হবে সম্পূর্ণ অবৈতনিক । এই সাধিকার সাথে সুরের সাধনায় মগ্ন হতে চাইলে আপনারা যোগাযোগ করবেন, উনি এবার থেকে অনুষ্ঠানেও গান গাইবেন , সে ব্যাপারেও যোগাযোগ করতে পারেন আমার সাথে , আমি ওনার প্রথম ছাত্রী এবং আজ থেকে ওনার অ্যাসিস্ট্যান্ট ।
আলোকপর্ণা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরেন দিশাকে , আবেগরুদ্ধ কণ্ঠস্বরে বলেন, আজ তুই আমায় নতুন জীবন দিলিরে মা , কোনোদিন ভাবতেও পারিনি আমার কথাও কেউ এভাবে চিন্তা করবে ।
কর্পোরেট বস ময়ূখ মিত্র কোন খামতি রাখেনি আয়োজনে । সুরের আকাশে সেজেছে আলোকপর্ণার পাওয়া সেইসব মেডেল ও সার্টিফিকেটে যা মিনুমাসী তুলে দিয়েছে ময়ূখের হাতে । আলোকপর্ণাকে ঘিরে আছেন বন্ধু , শুভানুধ্যায়ী , রয়েছেন বেশ কিছু রিপোর্টারও । দূরে দাঁড়িয়ে দিশা দুচোখ ভরে দেখছে , উপভোগ করছে মুহূর্তটা । পাশে এসে দাঁড়ালো ময়ূখ । আলতো করে দিশার আঙুল ছুঁয়ে বললো , — মাকে এতো খুশি আমি কখনো দেখিনি আগে । থ্যাংকস টু ইউ দিশা , তার সাথে , সরি ।
– হঠাৎ সরি কেন ?
– মায়ের প্রতি যে অন্যায় আমার সেকেলে বাড়ির লোকেরা করেছিল , সেই একই অন্যায় আমি আর মাও করেছি তোমার সাথে । বাড়ি বা পরিস্থিতির চাপে আমাদের শর্ত মানলেও তুমি যে মন থেকে খুশি ছিলেনা , সেটা বুঝতে আমি অনেক দেরি করে ফেললাম । আমায় ক্ষমা কোরো ।
দিশার আজ নিজেকে খুব নিশ্চিন্ত লাগছে । কেবলমাত্র নিজের ইচ্ছামত পড়াশুনা বা গানবাজনা করতে পারবে সেইজন্যে নয় , দিশা নিশ্চিন্ত কারণ এতদিনে তার আগামী প্রজন্মর জন্য তৈরি হয়েছে একটা সুস্থ ,স্বাভাবিক পরিবেশ ।
[মতামত ও বানানবিধি লেখকের নিজস্ব]
Tags: গল্প, ত্বমেকা ঘোষ, সুরের আকাশে
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।