ষাটের দশক তখন শেষের দিকে।
কৈশোরের পরিধানগুলো স্কুলে রেখে এসেছি যত্ন করে । উচ্চ মাধ্যমিকের মার্কসীটটা ভাঁজ করে পকেটে নিয়ে সাইকেলে করে এক বন্ধুর সাথে কলেজে ভর্তি হতে গেলাম। সোনাদা একটু হেসে যত্ন করে মার্কসীটটা একটা বড় খামে ভরে দিয়ে বললেন, এটা তোমার পরে অনেক কাজে লাগবে। সাবধানে রেখো। আর একটা টাইপ করা এটেস্টেড কপি এখানে জমা দিয়ে যেও ।
শ্রীরামপুর কলেজ।
বড় গেট দিয়ে ঢুকলে গাছে ঘেরা প্রশস্ত রাস্তা। ডান দিকে পরিপাটি খেলার মাঠ। বাঁদিকে সবুজ সুন্দর লন, দু দুটো পাশাপাশি টেনিস কোর্ট। আর চোখের সামনে দাঁড়িয়ে অনেক দশকের আভিজাত্য নিয়ে সম্ভ্রান্ত উচ্চশির মূল ভবনটি।
গঙ্গার দিকে তাকিয়ে।
অনেক দিনের বন্ধুত্ব ওদের।
শ্রীরামপুর কলেজ।
উইলিয়াম কেরির সৃষ্টি ভারতের শিক্ষা আর সংস্কৃতির ইতিহাসের সম্ভবতঃ উজ্জ্বলতম প্রতীক।
দুশো বছরেরও বেশি এই প্রতিষ্ঠানটি ভারতের প্রথম স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ও । কলকাতা, বম্বে এবং মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপনা হয় আরও তিন দশক পরে।
এখানেই আমার বড় হবার হাতে খড়ি।
দেখতে দেখতে বছর খানেকের মধ্যেই কলেজটার ১৫০ বয়স এসে গেল।
উৎসবের সময়।
হাজার অনুষ্ঠানে তখন কলেজ যুবতী।
শুনলাম এবছরের সাহিত্য পত্রিকাও বেশ বড়সড় হবে।
স্কুল জীবনে একবার ম্যাগাজিনে একটা গল্প লিখে একটু হাততালি পেয়েছিলাম। সেটা বোধহয় কলেজের কোনো আড্ডায় বড়াই করে বলে ফেলেছি। খুব ভুল কাজ। সঞ্জীব এসে বললো – দীপু আমাদেরও কিছু লেখা উচিত। কেরী সাহেবের কলেজ। ভদ্রলোক বাংলা আর বাঙালির জন্য এত করেছেন। রবি ঠাকুর তাকে আধুনিক বাংলার জনক বলেছেন। তার কলেজের ১৫০ পূর্তি।আমরা একটা ছোট বাংলা কবিতাও দিতে পারবনা সাহিত্য পত্রিকায়?
আমি সাহিত্যের লোক নই। কবি তো একদমই না।
পাড়ার কমলদা কবিতা লেখে। দেখতেও বেশ কবি কবি। একটা বইও বের করেছে। আমি তার কোনো লাইনেরই মানে খুঁজে পেতামনা। একদিন তাই জিজ্ঞেস করে ফেলেছিলাম।
– বুঝবি না দীপু। এগুলো কবিতা নয় রে, বেদনার নির্যাস।
ব্যস।
কবিরা কষ্ট পেতে থাক। কবিতারা বেঁচে থাকুক।
আমি লিখলে হয়তো কবিতারাই কষ্ট পাবে।
খোঁচাটা কিন্তু খুব জোরে এলো। সঞ্জীবের সাথে আরও কয়েকজন যোগ দিলো। একই ধুন। আমরা একটা ছোট কবিতাও দিতে পারবনা পত্রিকায়?
আমরা। গৌরবে বহুবচন এই শব্দটা অনেক সময়ই এক গরিব একবচনের ওপর দায়িত্বের অহঙ্কার চাপায়।
তাই হলো।
ভাবলাম দেখিই না চেষ্টা করে – জল পড়লে একটু পাতা নড়ে কিনা।
কবিতারা কিন্তু সাংঘাতিক জেদী হয়।
সারা রাত আমার ঘুম এলো না।
আর সারা রাত ধরে একটা কবিতাও নড়ে বসলনা ।
রাত শেষ। ক্লান্ত মস্তিষ্কে, আধো ঘুমে, নেশাছন্ন কলমে এক দীর্ণ শীর্ণ কবিতার সাথে আমার ভোর হলো।
সে কবিতা খুবই শীর্ণ – কয়েকটি লাইন মাত্র ।
আর অত্যন্ত দীর্ণ তার জনকের প্রতিভায়।
আবেগ ছিল কিন্তু অনেক। মানে বেশ অনেক অনেক।
আমি তো তখন সতেরোর বছরের ছটফটানি। ষাটের দশকের উদ্দামতার শরিক।
সে সময়ে সে বয়সে যেমন বাঙালি যুবক।
স্বপ্নে পৃথিবী বদলায় তখন।
আমার কবিতা আক্রমন করলো সব আততায়ীদের। তীব্র আঘাত।
এবং সেই কবিতাটি প্রকাশিতও হয়ে গেলো কার ভুলে কে জানে !
পঞ্চানন দা ফিজিক্স অনার্সের ক্লাস নিতে নিতে একদিন হাসি মুখে খবর দিলেন –
দীপঙ্কর তোমার কবিতাটা পড়লাম । বেশ লিখেছ । মানেটা বুঝলাম বলে আরও ভালো লাগলো ।
একটু সময়ছাড়া ছিল কবিতাটি । কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক সংজ্ঞা ছিলনা তার ।
একই কবিতায় গান্ধীজি সন্মানিত, লুমুম্বাও।
সে সময়ে সেটা বেশ অপরাধ ছিল । আজও হয়তো ।
আমার বন্ধুরা কিন্তু সব দলেই ছিল । সেটা তখন অপরাধ ছিলনা ।
প্রথমে বামেরা এলো । আধা হাসি মুখে মোটা বেদনার প্রলেপ ।
দুঃখী মুখের প্রশ্ন ছুটে এলো।
তুমি কি জানো বিপ্লব এখন কোন স্তরে?
আমি সত্যিই জানতাম না যে বিপ্লবের স্তর হয় । সেটা বলে ফেলে আরও ভুল করলাম। ওদের দুঃখ আর একটু বাড়লো।
শেষে যেতে যেতে জানিয়ে গেল যে আমার একটু দায়িত্বশীল হওয়া উচিত ছিল।
এটা নতুন নয়। এই উপদেশটা আমায় সারা জীবনই তাড়িয়ে বেড়িয়েছে । একদিন দায়িত্বশীল হয়ে সবাইকে দেখিয়ে দিতে হবে ঠিক।
সন্ধে বেলায় সাইকেলে করে বাড়ি ফেরার পথে শুনলাম দক্ষিনি বন্ধুরা আমায় দেখিয়ে বলছে – এই সেই কবি – যে সবার নামে কবিতা লিখেছে।
আমার প্রথম কবিতা আমায় বিখ্যাত করলো।
পরিধি একটু ছোট।
হোক।
বেশ গর্ব হলো নিজেকে নিয়ে।
বন্ধুরা খোঁচা দেয়নি তারপরে অনেক দিন।
কবিতারা তো এমনিতেই আমাকে প্রশ্রয় দেয়না।
তখন লিটল মাগাজিনের যুগ। আমার দু একজন বন্ধু লিখে নাম করতে শুরু করেছে।
আমি ফিজিক্সের ক্লাশে ফেরত। হাইজেনবার্গ সাহেবের অনিশ্চয়তা নীতিই জীবনের চরম সত্য।
এই সব দার্শনিকতায় সময় গড়িয়ে চলল।
চলতে থাকলো।
পার্থ কেমিস্ট্রি পড়ত। চন্দননগরের ছেলে । টেবিল টেনিসের চ্যাম্পিয়ন আর আড্ডা দিতে দিতে সিগারেট চাইলে পুরোটাই দিয়ে দিত। একদিন আড্ডার মধ্যে হঠাৎ প্রশ্ন করলো – আরে “গান্ধী-লুমুম্বা” কবিতাটা তোর লেখা নাকি? নামটা তো তোর ই দেখলাম।
চন্দননগরে একটা লিটল ম্যাগাজিনে ও কবিতাটা পড়েছে। আমার অনুমতি ছাড়াই ছেপেছে শুনে একটু রাগ করলো।
আমি একটুও রাগতে পারলাম না।
অনেকদিন পরে অনিশ্চয়তা নীতিটাকে ফিকে করে একটু ভালো ভালো লাগলো কেমন।
পার্থ কথা দিতে বাধ্য হলো যে আমাকে ওই পত্রিকার একটা কপি এনে দেবে।
এবার কমলদাকে দেখিয়ে দেব আমার বেদনার নির্যাস।
দু-তিন সপ্তা পার্থকে দেখিনি। বড়দিনের ছুটির পর এলো। চেপে ধরলাম পত্রিকাটার জন্য।
একটু প্রবলেম হয়েছেরে দীপু।
তোর কবিতাটা পড়ে এক রাজনৈতিক দল ওদের হুমকি দিয়েছে যে এমন কবিতা ছাপলে ওদের অফিস উড়িয়ে দেবে। পত্রিকাটা এখন বন্ধ আছে। আমার মনে হয় তোর কাউকে বলা উচিত না যে কবিতাটা তোর লেখা।
একটু অন্য রকম কবিতা লেখা শুরু কর না।
ও কি আমার নামটাও বদলাতে বলেছিল?
ভয় পেলামনা একটুও।
আবার খুব খুব গর্ব হলো কবিতাটার জন্য।
খ্যাতির পরিধি আর একটু বাড়ল।
আরও বাড়বে।
জীবন হাইসেনবার্গে এ থেমে থাকেনা।
সময় তাড়িয়ে বেড়ায়।
আমাকে তাড়িয়ে একদিন সায়েন্স কলেজে নিয়ে এলো। মনে আছে সায়েন্স কলেজেএকদিন সত্যেন বসুকে দেখেছিলাম। খুব অপরাধ বোধ হয়েছিল। উনি কি কোনদিন ভেবেছিলেন যে আমার মত অপদার্থরা একদিন এখানে ভীড় করবে।
কবিতা লিখবে?
কলকাতা আর পশ্চিম বাংলায় সেই সময়টায় অনেক বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতা একটু করে ফিকে হচ্ছে। বাঙালি আবার আড্ডা দেওয়ার স্বর্ণযুগে ফিরছে। আমার ধারণা এই স্বর্ণযুগের অনেক রাজকুমারই থাকত সায়েন্স কলেজে।
অবাধ অনুকূল পরিবেশ। একাধিক ক্যান্টিনে আশ্রয়। পাঁচু বাবুর ড্রয়িং ক্লাস পালিয়ে সময়ও থাকত হাতে।
তখনও রাত জেগে ফুটবল দেখা শুরু হয়নি। দল বেঁধে ময়দানে যেতাম। কিংবা সিনেমা হলে।
পাবলো নেরুদা থেকে পরিমল দে – সুনীল গাঙ্গুলী থেকে সুনীল গাভাস্কার – আড্ডার ব্যাপ্তি অবাধ।
এবং এ আড্ডার পরিসীমা সায়েন্স কলেজ থেকে রাজপথ পেরিয়ে আমাদের বাড়ি বাড়ি ছড়িয়ে পড়ত ছুটির দিনগুলিতে।
এমনি এক রবিবারে আমার বাড়িতে আড্ডার পালা পড়লো।
বন্ধুদের একজন চিন্ময়। তার বিবরণ এখানে প্রাসঙ্গিক।
চিন্ময় মিত্র মোহনবাগানের জন্য আমদের সবাইকেই খুন করতে পারত।
সে ক্লাসে বসে বা বাসে দাঁড়িয়ে যখন তখন ঘুমিয়ে পড়তে পারত।
আর বাদাম খাওয়া শেষ হলে ঠোঙ্গাটা খুলে তাতে ছাপা খবর বা গল্পটা পড়ে নিয়ে সেই কাগজেই হাত মুছত।
সেই রবিবারের সকালে আমি বন্ধুদের বাড়ি আনতে রিষড়া স্টেশনে পৌঁছে গেছি।
স্নিগ্ধ সকাল। দেড় কিলোমিটার দূরে বাড়ি। হাঁটা দূরত্ব।
পথে এক রেলওয়ে ক্রসিং। চার নম্বর গেট।
চার নম্বর গেটকে বিখ্যাত করেছে ধর্মদার মিষ্টির দোকানের সিঙ্গাড়া আর জিলিপি।
বন্ধুদের জন্য কিনে আনলাম।যেমন নিয়ম – নিমেষেই শেষ এবং চিন্ময় যথারীতি ঠোঙ্গাটিকে টিসু পেপার বানানোর দিকে প্রথম পদক্ষেপে।
কথায় ব্যস্ত ছিলাম।
হঠাতই আমার কাঁধে এক বিশাল হস্তাঘাত।
কানে এলো এক পৈশাচিক চিত্কার।
চিন্ময়ের মুখ অসম্ভব আনন্দে বিকৃত।
হাতে তার জিলিপির ঠোঙ্গার খোলা কাগজটি।
পড়ে শোনালো-
দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায়, ১৯৬৯, শ্রীরামপুর কলেজ।
এর মানে তো তুই।
এর মানে তো এই গান্ধী-লুমুম্বা কবিতাটা তোর লেখা… রাইট ?
এইবার বুঝলাম তোর মত কৃপণের জিলিপি খাওয়ানোর এত উৎসাহ কেন।
সব গল্পেরই এক গল্পকার থাকে। সে ঠিক করে দেয কোন চরিত্রের কখন কি করণীয়।
এ গল্পের তো কোনো গল্পকার নেই।
আমি এক অসহায় পরিস্থিতি সংকটে।
গল্পকারের অনুপস্থিতি আঘাত করছে আমায়।
সামনে আমার জীবনের একমাত্র কবিতা ছেঁড়া জিলিপির ঠোঙ্গা হয়ে পড়ে আছে।
চিন্ময় পিশাচ হাসছে।
অন্য বন্ধুদের দেখে বন্ধু বন্ধু লাগছে না।
আমার কি করণীয় এখানে?
একবার অতনু বলেছিল আমি নাকি একটু রোমান্টিক এবং সেহেতু আমার প্রতিক্রিয়া কখনও সাধারণের থেকে একটু ভিন্ন হয় – অতনু প্রায়ই মিথ্যে বলে যদিও।
রোমান্টিক না চর্মরোগ জানিনা। আমার মনটা হঠাৎ খুব খুশিতে ভরে উঠলো।
আমার কবিতা কতদিন পরে আমার কাছে ফিরে এলো – হোকনা সে ঠোঙ্গা হয়ে।
আমার খ্যাতির পরিধি আরও বাড়ল।
ধন্য আমার কবিতা। ধন্য আমি।
আমি এখন চোখ ভরা জল নিয়ে হাসছি।
অবোধ বন্ধুরা ভাবলো এটা চিন্ময়ের হস্তাঘাতের ফল। হৃদয় টিদয় সবাই থোড়ি বোঝে।
ঐটুকু ছোট সময়ে আমি নিজেকে নিজেই চিরন্তন করলাম।
সবাই আবার বাড়ির পথে চলা শুরু করলাম।
আমার কবিতা রাস্তার ধরে নোংরা ঠোঙাতে চিন্ময়ের ব্যঙ্গ বিদ্রুপের সাথে শুয়ে থাকলো।
সময় আরও পাঁচ দশক পেরিয়ে নিয়ে এসেছে আমায়।
কিন্তু আমি জানি আমার সেই কবিতা নতুন কোনো বিস্ময় নিয়ে আবার দেখা দেবে।
ততদিনের জন্য গল্পটা শুধু থেমে আছে।
শেষ হয়নি।
[মতামত ও বানানবিধি লেখকের নিজস্ব]
Tags: কবিতার গল্প, গল্প, দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায়
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।