ক্রিং….ক্রিং… ক্রিং টেলিফোনটা বেজে উঠতেই মাথার কাছে রাখা টেলিফোনটা ঘুম জড়ানো চোখে হাতে নিয়ে বলে উঠলেন ডা. ধনঞ্জয় দত্ত… হ্যালো… কে বলছেন?
ডাক্তারবাবু! আমি বিদ্যুৎ, রাজবাড়ির কেয়ার বলছি, এত রাতে আপনার ঘুমের বিঘ্ন ঘটানোর জন্যে আমি দুঃখিত। নিরূপায় হয়ে আপনাকে ফোন করছি।
কেন কি হল? আমাদের রাজবাড়িতে কয়েকদিন আগে জমিদারবাবুর মেয়ের এক বান্ধবী এসেছিলেন নেদারল্যান্ড থেকে। রাজবাড়ির ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করবেন বলে।
বেশ তো! এখন কি হলো?
ওই বান্ধবী মানে তুহিনা দিদিমণি হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। কথা বলতে পারছেন না। সারা দেহটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। খিঁচুনী হচ্ছে। হাতে-পায়ে খিল ধরে যাচ্ছে। আপনাকে এখুনি একবার আসতে হবে।
ঠিক আছে তুমি রাজবাড়ির বড় গেটটা খুলে রাখো। আমি গাড়ি নিয়ে আসছি। ঘড়িতে তখন বাজে রাত দুটো।
কিছুক্ষণের মধ্যে গাড়ির হর্ণ শুনে দারোয়ান গেট খুলে দেয়। রাজবাড়িটা গঙ্গার পাড়ে প্রায় দশ-বারো বিঘে জুড়ে। বাহারি ফুলে সাজানো দীর্ঘ লন পার হয়ে দোতলা বাড়ির গাড়ি বারান্দায় গিয়ে থামেন ডা. ধনঞ্জয় দত্ত। বিদ্যুৎ ডাক্তারবাবুকে নিয়ে ঢোকেন দোতলার একটা ঘরে। বাড়ির লোকজন দাঁড়িয়ে রয়েছেন। সকলের চোখে- মুখে আতঙ্কের ছাপ। ঘুম ছুটে গেছে সকলের।
বিদ্যুৎ ডাক্তারবাবুকে একটা বেডের কাছে দাঁড় করালেন। রোগীনীর মুখ থেকে গোঙানি শব্দ বেরোচ্ছে। হাত-পা শক্ত হয়ে যাচ্ছে থেকে থেকে। থরথর করে কাঁপছে সারা দেহটা। ভাল করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে খারাপ কিছু পেলেন না ডা. দত্ত। বাড়ির লোকেদের কাছ থেকে রাতের খাবার ও অন্যান্য খবরাখবর নিয়েও তেমন কিছু ক্ল্যু পেলেন না। শুধু ওর বান্ধবী টি বলল, ‘কাল রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে একটা ভুতের গল্প হচ্ছিল। ওকে বলা হয়েছিল, এখানে গঙ্গার ধারে অশরীরি আত্মা ঘুরে বেড়ায়। নিশি রাতে নুপুরের ধ্বনি শোনা যায়। কে যেন নুপুর পায়ে নাচের সুরে এদিক ওদিক ঘুরতে থাকে।’ মাঝে মধ্যে আমাদের দোতলার বাড়িতেও সেই নুপুরের শব্দও চলে আসে।’
তোমাদের মধ্যে এসব আলোচনা কতক্ষণ হয়েছিল? তা বেশ কিছুক্ষণ।
এরপরে কোথাও একটা আলোর সন্ধান পেয়ে তড়িৎকে বলেন ডা. দত্ত একটা বড় কাগজের ঠোঙা আনতে।
একটু অবাক হয়ে তড়িৎ চলে যায় যাজবাড়ির রান্নাঘরে। খুঁজে একটা ঠোঙা এনে দেন ডাক্তারবাবুকে। ঠোঙাটা হাতে নিয়ে তুহিনা দিদিমণির নাক-মুখ ঢেকে চেপে ধরেন কিছুক্ষণ। সবাই ভাবতে থাকে ডাক্তারবাবুর এ কেমন চিকিৎসার ধরণ? শ্বাস নিতে না পেরে তো রোগী অক্কা পেয়ে যাবে?
অবাক কান্ড। কিছুক্ষণের মধ্যে তুহিনাদিদিমণি শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে যায়। জিজ্ঞাসা করে, ‘আমার কি হয়েছিল?’
ডাক্তারবাবু মুচকি হেসে বলেন, তোমায় নিশিতে পেয়েছিল। মানে? ভুতে ধরেছিল।
তারপরে হেসে বলেন তোমার কিছু হয় নি। ভূতের গল্প শুনে তোমার অবচেতন মনে একটা কাল্পনিক নুপুরপরা রমনীর ছবি ভেসে উঠে অবচেতন স্তরে প্রতিক্রিয়া তৈরী হওয়ায় ওইসব শারিরীক উপসর্গ দেখা দিয়েছিল। এটাকে ‘হিস্টেরিক আ্যটাক’ বলে। শ্বাসের হার বেশি হওয়ার জন্যে দেহের মধ্য থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড বেশি মাত্রায় বেরিয়ে যাওয়ায় দেহেতে ক্ষারীয় মাত্রার আধিক্য ঘটায় ওইসব উপসর্গের কারণ। আমি ঠোঙা চেপে ধরায় ওই কার্বন ডাই অক্সাইডের বেশি মাত্রায় বেরিয়ে যাওয়াটাকে আটকাতেই তুমি স্বাভাবিক হয়ে গেছ। এটাকে ঠোঙা থেরাপি বলতে পারো। ভোর হতে এখনও অনেক বাকি, শুয়ে পড়ো বলেই বাইরে বেরিয়ে আসেন ডা. ধনঞ্জয় দত্ত।
[মতামত ও বানানবিধি লেখকের নিজস্ব]
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।