টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে রূপ। বড়ো সাধের টেবিল ওর। বিছানায় ছড়ানো আছে কিছু শাড়ি আর রাশিকৃত গয়না। মাটির,, পুঁতির,টেরাকোটার ,আরো কত যে রকমের .. সব গহনা ওর দেওয়া ও বলতে শুভ কাকুর।
খুব সৌখিন মানুষ । আলাপ হয়েছিল বেড়াতে গিয়ে শিলং পাহাড়ে।এমনিতেই শিলং পাহাড়ের সাথে সেই যে রবীন্দ্রনাথ অমিত আর লাবণ্যের রোমান্টিকতা যোগ করে দিয়েছিলেন তার কোনো ক্ষয় নেই। ফেডেড জিন্টস আর ব্ল্যাক পুলভার ,গলায় ক্যামেরা ঝোলানো মানুষটা কে দেখেই রূপের খুব ভালো লেগে গিয়েছিল।
কী অনুপম ব্যক্তিত্ব ! আর কী রোমান্টিক! আলাপের পরই বলে উঠেছিল এই সবুজ নীল তাঁতের শাড়ি পরা আপনি যেন অন্য আর এক প্রকৃতি। কুয়াশার মত আছে কিন্তু নেই নেই আবছায়াতে ঘেরা। আসলে নারীর মধ্যেও থাকে প্রকৃতির মতোই রহস্যময়তা। বলেই ফটাফট ছবি তুলেছিলো । পাশে মা দাদা , রূপ কুন্ঠিত বোধ করছিল খুব।
কিন্তু সকল দ্বিধা কাটিয়ে ভদ্রলোক আলাপ করলেন বাবার সাথে। নিজের পরিচয় দিলেন। মায়ের সাথে এমন গল্প জুড়লেন যেন কতকালের বন্ধু। কি শান্ত ভদ্র মানুষ! গল্প বলা শুরু করলেন কত রকমের। সারা ভারত ওনার ঘোরা। বিদেশেও চলে যান সময় পেলেই। কিন্তু কোথাও যেন একটা আশ্চর্য সরলতা ভোরের হওয়ার মত ঘিরে ছিলো ওনাকে।
স্মৃতির নিঃশ্বাস ফেলে রূপ টেবিল ছেড়ে উঠে আসে। বিছানায় বসে গয়নাগুলো হাতে তুলে নেয়। সেবার শান্তিনিকেতনে সোনাঝুড়ির মেলা থেকে কিনে দিয়েছিলো এইগুলো। একটার পর একটা। কিনেই লোকজন মানামানি নেই, গলায় রেখে বলছিলো ,তোমাকে এটাতে দারুন মানাবে। কখনো বলেছিলো জিন্স আর টপ পড়লে এটা পড়বি। খুব এলিগেন্ট লুক। একটা আলতো হাসি দুলে গেল রূপের সারা মুখে। কখনো তুমি, কখনো আপনি ,শুভদার কোনো নির্দিষ্ট সম্ভাষণ ছিলো না তার জন্য।
রূপ ভাবে শুভদা আমার তার বাবার থেকেও বড়ো। তবু কেন যে কাকু বলতে পারিনি। মা খুব অসন্তুষ্ট হতো। একি ধিঙ্গপনা রে তোর , বাবার চেয়েও বড় মানুষ কে দাদা দাদা বলে লাফাস। কিন্তু শুভ কে কাকু বলে ডাকার কথা রূপ ভাবতেও পারে না। শুভদা যেন চিরহরিৎ অরণ্য।
সেবার শান্তিনিকেতনে একটা দুপুরে অঝোর বৃষ্টি নেমেছিল। শুভ দা বলেছিল ভিজবি? আমি তো এক পায়ে খাড়া।
গাড়ি নিয়ে সোজা চলে গেলাম সোনাঝুড়ির জঙ্গলে। সে কী উন্মাদের মত বর্ষণ ! সর্ব অঙ্গ বেয়ে গলে গলে নামছে জলের ধারা। গাছের নগ্ন ধারা স্নান দেখে একটা গাছকে জড়িয়ে গাছ হতে চেয়েছিলো রূপ। তখনই শুভ দার ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো অন্য এক মানুষ।গম্ভীর গলায় বলেছিল সব জেনে নিলে সম্পর্কের রোমাঞ্চ ফুরিয়ে যায়।
কুন্ঠিত রূপের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,পাগলী মেয়ে একটা।
নিজেকে মেলে ধরাই রূপের প্রকৃতি। সেই অভিমান থামাতে পরদিন গাড়ি নিয়ে সোজা রাঙামাটির বুটিকে। এই হারটা কিনে দিয়েছিল সাথে ম্যাচ করে কাঁথা স্টিচেরর ওপর এপ্লিকের কাজ করা শাড়ি ও ব্যাগ।
সেটা অন্য পাশে সরিয়ে রাখলো রূপ। অন্য একটা শাড়ি মুঠোয় চেপে ধরলো রূপ। ছিন্নভিন্ন শাড়িটা সে ফেলে দেয় নি। এর সাথে ম্যাচিং গহনার সেটটা খুঁজে পাওয়া যায় নি। এটাই ওর জয়ের লক্ষণ। সর্বশক্তি দিয়ে লোপামুদ্রা কে সেদিন ঠেলে ফেলে মাড়িয়ে দিয়েছিলো সে। দু চোখের জল টলটল করে ওঠে অনুশোচনা। আচ্ছা জয়ের না পরাজয়ের চিন্হ লেগে আছে এই শাড়িতে! ছুঁড়ে ফেলে দিলো শাড়িটা।
মনে পড়ে এই শাড়িটা উপহার পাওয়ার দিন পনেরো বাদে রূপ শুভ কে প্রশ্ন করেছিল, ঠিক এই সেট তুমি আর কাউকে কিনে দিয়েছো?
কেন বলো তো?
সেদিন ‘ অনির্বান’ থেকে ধুপ, মোমবাতি কিনে বেরোচ্ছি দেখি তেরো পার্বনে খেতে ঢুকছে এক মাঝবয়সী মহিলা।সাথে বোধ হয় মেয়ে এবং ওনার কর্তা, মহিলা হুবহু এই সাজে?
-লম্বা মত মহিলা? মেয়েটা আরো লম্বা?
-হুঁ
আরে ও তো আমার বান্ধবী লোপামুদ্রা, আমি ওকে মুদ্রা বলে ডাকি। রাগ হলে বলি তুমি অচল পয়সা। এই যুগে তোমাকে নিয়ে চলা যায় না।
অভিমান করে রূপ বলেছিল আমাকে যা দিয়েছো তা অন্য কাউকে দিতে পারলে?
না পারার কি আছে?
তোমার খারাপ লাগলো না?
কি মুশকিল খারাপ লাগবে কেন? ও তো আমার বন্ধু। তোমার জন্য কেনার পর মনে হলো ওর জন্যও কিনি।
আমাকে লুকিয়ে কিনেছিল?
এই প্রথম শুভদা একটি বিরক্ত হলো ,কেন লুকাবো? তুমি অন্য দোকানে কেনাকাটা করছিলে তখন আমি মুদ্রার জন্য কিনেছি।
২
কি করছো মুদ্রা?
মিশ্র খাম্বাজ প্রাকটিস করছি
এই এত রাতে?
গুরুজী কাল এই রাগটা শুনবেন।
আমাকে একটু শোনাবে?
তারপর কতক্ষণ ধরে বিভোর হয়েছিলো দুজনে। বাজনা থামলে , মুদ্রা বলে, এতো রাতে জেগে তুমি কি করছিলে?
লিখেছিলাম। কিন্তু এতো ফোন বিরক্ত লাগছিলো। যা চায় না যাদের চায় না তারা বারবার কেন ফোনে আসে রাতের বেলা,দিনের বেলা ,যখন তখন
তুমি প্রশ্রয় দাও,তাই আসে
কি করবো আমি? ফোন করলে বলবো কথা বলবো না।
সেটা তোমার ব্যাপার । কিন্তু মেয়েরা তোমার রোমান্টিকতা দেখে মুগ্ধ হয়, তুমি এই বয়সেও সেটা উপভোগ করো। তারা সম্পর্ক টেনে নিয়ে যেতে চায় ….
–কিন্তু আমি তো চাই না। আমি যদি বিয়ে করতাম তাহলে ওরা সবাই আমার মেয়ের বয়সী হতো, আমার এই অসম মুগ্ধতা আর ভালো লাগে না।
– শুভ তুমি ভুল কথা বলছো। তুমি চাও মেয়েরা তোমায় ঘিরে থাকুক।
তুমি ভুল বুঝছো মুদ্রা । বোঝার চেষ্টা করো,আমি ফটোগ্রাফার ।ছবি তোলা আমার নেশা এবং পেশা। প্রতিটি সুন্দর আমার কাছে ঈশ্বরের অবদান। তা সে ফুল হলে ফুল,সাগর হলে সাগর। সবুজ বনানী, মরুভূমি ,ঝর্ণা বা নারী আমার কাছে সৌন্দর্যের সংজ্ঞা। আমি তাদের ধরে রাখতে চেষ্টা করি।
তবে এতো অন্তরঙ্গতা করো কেন?
মুহূর্তের জন্য। প্রত্যেকদিন সূর্য ডোবে, কিন্তু সৌন্দর্য প্রতিদিন আলাদা আলাদা। আমি নারীর রূপের মধ্যেও সেই অরূপের সন্ধান করি।
মুদ্রা হাসতে হাসতে বলে, তবে মরো….
শুভ চুপ করে যায়,আত্মবিশ্লেষণ করে হয়তো বা। একটু পরে বলে বিশ্বাস করো আমার বন্ধু বলতে শুধু তুমি…
কথা ঘুরে যাচ্ছে দেখে মুদ্রা বলে,কি লিখছিলে শোনাও
এইভাবে বোনা হয় একটা সম্পর্ক রাগ অনুরাগ বিতৃষ্ণা ও বিশ্বাস দিয়ে।
মাসখানেক বাদে মুদ্রা একটা কার্ড ধরিয়ে দেয় শুভর হাতে। মুচকি হেসে বলে, খুলে দেখো।
কার্ড দেখেই চমকে যায় শুভ
তোমার একক?? আরে বাঃ এতো আমার স্বপ্ন পূরণ। কিন্তু অনেক দূর যে…
তুমি যাবে না?
তুমি ভাবছো কি করে আমি যাবো না? নিজে তো যাবোই বন্ধুবান্ধব নিয়ে যাবো।
আর বান্ধবী?
আবার ঝগড়া করার তাল খুঁজছো ?
তারপর কতদিন কত পরিকল্পনা,কি ভাবে যাওয়া হবে? কাকে কাকে বলবে…
আমাকে তো ওরা গাড়ি পাঠিয়ে দেবে, মুদ্রা বলে। ঠিক আছে আমার বড়ো গাড়িটা নিয়ে নেব ।
৩
অভিশপ্ত নিয়তির মত হলুদের ওপর নেভি ব্লু আর গোলাপির মোটিভের কাজ করা শাড়িটা আবার হাতে নেয় রূপ ।
শুভদা আগে কিছুই বলে নি , শুধু বলেছিলো দূরে,হলদিয়ায় একটা উচ্চাঙ্গ সংগীতের অনুষ্ঠান শোনাতে নিয়ে যাবে।। বলেছিল,সাজবি কিন্তু সুন্দর করে।
শুভদার গাড়িতে সেদিন অনেকজন। রূপের একটু অস্বস্তি লাগছিলো। সবাই পুরুষ। শুভদা স্টিয়ারিংয়ে। আলাপ করিয়ে দিয়ে বলেছিল শুভদা ,এই আমার বন্ধু রূপদর্শী মজুমদার। রূপের খুব ইচ্ছে করছিলো শুভদার পাশে বসে। কিন্তু সেখানে অন্য জন আগে থেকেই আছে।
শেওয়াফুলি পেরোনোর পর একটা দুধ সাদা ইন্ডিকা এসে যোগ দিলো। শুভ দা বললো ,চলো রূপ তোমাকে আলাপ করিয়ে দিই..
দরজা খুলে যাকে দেখলো তাকে দেখেই রূপের রাগ হয়ে গেল হঠাৎ। এই সেই লোপামুদ্রা। যাকে তেরপার্বনে খেতে ঢুকতে দেখেছিলো। এর ই অনুষ্ঠান আজ । জানলে সে কিছুতেই আসতো না। আর কী আশ্চর্য এক শাড়ি ,গহনা। এ বারে তো শুভদা ওকে বলেনি এই শাড়ি পড়ে আসতে।
কী আশ্চর্য কাকতলীয় ব্যাপার!
লোপামুদ্রাও অবাক হয়ে দেখছে, তার মত একই সাজে কে এটা? সে তো শুভকে ঘুণাক্ষরেও জানায়নি সে হলুদ শাড়ি পড়বে। এটা শুভ তাকে গিফট করেছিলো ,মাদুরা থেকে ঘুরে এসে। তার মানে ওকেও… দুজনার হতচকিত ভাব কাটিয়ে পরস্পরের আলাপ পর্ব সেরে শুভ বললো রূপ, তুমি মুদ্রার সাথে যাও। ওকে, লেটস গো, বলেই হেঁটে গেলো নিজের গাড়ির দিকে। দুটো অসম বয়সী নারী তখন একে অপরকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে ছায়ার সাথে লড়ে যাচ্ছে সমানে।
কোলাঘাটের ধাবাতে চা খেতে নেমে শুভ একটু শান্তি পেলো। হলুদ দুই প্রজাপতি হাসির ডানায় ভর করে উড়তে উড়তে আসছে।
সিগারেট সুখটান দিয়ে শুভ গাড়ি যখন ছাড়লো ততোক্ষনে সাদা ইন্ডিকা দৃষ্টির বাইরে। বেশ কিছুটা যাবার পর শুরু হলো জ্যাম। সারি সারি ট্রাক, বাইক, চারচাকা…
কী ব্যাপার? এই তো সব ঠিক ছিল। মুদ্রাদের গাড়ি কতদূর এগিয়ে গেল? তাদের না নিয়ে গেলই বা কেন ড্রাইভার? এমন কথা তো ছিলো না
শুভ ফোন করতে লাগলো।কী আশ্চর্য রিং হয়ে যাচ্ছে সবার ফোনে। ড্রাইভার ,মুদ্রা,রূপ সব ফোন বেজে যাচ্ছে। মুহূর্তে হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল। উল্টো পথে আসা এক দাঁড়িয়ে যাওয়া ট্রাক কে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে? কিসের জ্যাম?
বহুত জোড়সে একসিডেন্ট হুয়া…
কার গাড়ি? কি গাড়ি?
উত্তর শোনার ধৈর্য নেই শুভর। গাড়ি বাঁ দিকে দোকান ঘেঁযে দাঁড় করিয়ে ছুট লাগলো।
বন্ধু প্রবাল বললো, কী পাগলামি করছিস ? ছুটে কতদূর যাবি? তুই ধরেই বা নিছিস কেন ওনাদের গাড়িই একসিডেন্ট করেছে?
তুই গেলে,সাথে আয়
উদ্ভ্রান্তের মত ছুটে চললো শুভ। এককালের নাম করা অথলিট একে টপকে ,টপকে ওকে পাশ কাটিয়ে ছুটে চললো।
জীবনের সব দৌড় একসময় থেমে যায়। শুভও থামলো। জনতার ভিড় ঠেলে সামনে গিয়ে মুহূর্তের জন্য স্থবির হয়ে গেল। নয়ানজুলিতে মুখ হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে সাদা ইন্ডিকা। হলুদ শাড়ি এক নারী মুখ গুঁজে পড়ে আছে। গাড়ির নম্বর দেখেই আবার যেন হাতে পায়ে জোর এলো । বাঁচাতে হবে ,যে ভাবেই হোক বাঁচাতেই হবে।
নয়ানজুলি তে নামতে যাবে পুলিশ হাত চেপে ধরলো। কী পাগলামি করছেন মশাই। গলা অব্দি পাঁক। কজন ছিলো গাড়িতে?
তিনজন। ড্রাইভার আর দুই মহিলা।
ততক্ষনে ড্রাইভারের হদিস মিলেছে। স্থানীয় লোকজন নিয়ে পুলিশ নেমেছে উদ্ধারে। কিন্তু এর একজন কই?
কে যেন বললো, একটা মেয়েছেলের ওপরেই আর একটি মেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে।
অন্য কে বললো, তবে তো নিচের জনকে বাঁচানো দুস্কর।
অস্বাভাবিক একটা শব্দ বেরিয়ে এলো শুভর গলা থেকে, কে আছে নীচে?
ভিড় ঘিরে ধরেছে ততোক্ষনে শুভ কে। কে কে ছিল? কে হয় তারা শুভর ?
এক প্রত্যক্ষদর্শী বিজ্ঞের মত বললো, আরে বউ আর মেয়ে গো দিদা।
প্রবীণ একটা হাত এসে পড়লো শুভর কাঁধে
ঠাকুরকে ডাকো বাবা, ভগমান যেন দুটোকেই কেড়ে না নেয়। যে কোনো একজন যেন বাঁচে, নইলে তুমি কি নিয়ে বাঁচবে?
কার জীবন প্রার্থনা করবে শুভ?
[মতামত ও বানানবিধি লেখকের নিজস্ব]
Tags: গল্প, নন্দিতা সিনহা, রূপ কথা
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।