ভোলা গিয়েছিল রায়না। প্রায় দুঘন্টা পরে বাড়ি ফিরে দেখে বৌ খুশি ঘরে নেই, পাশের বাড়ির বিশু আর বিশুর বৌ ওর বাড়িতে বসে আছে।
ওদের কাছেই শুনল, সন্ধ্যেবেলা খুশি ঘাটে গিয়েছিল। ঘাটে সাপে কামড়েছে। ওর সঙ্গে ঘাটে গিয়েছিল তিলুর বৌ লক্ষ্মী। সেই চেঁচামেচি করে লোক জড়ো করেছে।
তারপর লক্ষ্মী, তিলু, আর মহাদেব একটা টোটো ভাড়া করে ওকে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেছে।
বৌয়ের খবর শুনেই ভোলা হাঁউমাউ করে উঠল।
বিশু এক ধমক দিল, কান্না থামা, আমার বাইকে ওঠ। খণ্ডঘোষে তোর শ্বশুরবাড়িতে খবর দেওয়া হয়েছে, এতক্ষণে তোর বড় সম্বন্ধী পৌঁছেও গেছে। ফোনটা নিয়ে বেরোস না কেন, গাড়ল?
বৌকে বলল, তুমি এ বাড়িতে তালা দিয়ে বাড়ি চলে যাও। আমরা বর্ধমানে খেয়ে নেব। যদি দরকার হয়, আমি রাতটা হাসপাতালেই থেকে যাব। চিন্তা কোর না।
সগড়াই থেকে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল পর্যন্ত পুরো রাস্তাটা ভোলা ঘ্যানঘ্যান করতে করতে এল, যখন নিয়ে গেল তখন জ্ঞান ছিল? কি সাপ জানিস? হ্যাঁরে, বাঁধনটা বেশ টাইট করে দিয়েছিলি তো? হে বিষহরি মা মনসা, বিষ টেনে নাও মা।
শেষে বিশুকে আবার ধমক দিতে হল, তুই থামবি? নাহলে এবার কিন্তু এ্যাকসিডেন্ট হয়ে যাবে।
হাসপাতালে পৌঁছে ওয়ার্ডের বাইরে সম্বন্ধী আর বন্ধুদের দেখে ওকে আর রোখা গেল না।
এখন কেমন আছে? মুখ দিয়ে কি গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে ? ডাক্তার কি বলছে? দাদা, আমাকে মিথ্যে বলোনা, খুশি বাঁচবে তো? তুমি দেখেছ? ও, মেয়েদের ওয়ার্ডে ঢুকতে দেবে না বুঝি? তিলুর বৌটাও তো একবার বেরিয়ে এলে পারে। শেষে যখন শুনল, খুশিকে দেখে ডাক্তারবাবু বলেছেন, এত দেরি করে আনলেন? তাতে ভোলা ডুকরে কেঁদে উঠল, ওরে, তাহলে খুশি আর বাঁচবে না রে।
ওর ঘ্যানঘ্যানানিতে বিরক্ত হয়ে খুশির দাদা বাদল বলল, তোমরা তো আছ, আমি একটু চা খেয়ে আসি।
ওয়ার্ড থেকে মাঝে মাঝে একজন নার্সদিদি বেরিয়ে এসে কোন পেশেন্টের নাম করে ডাকছেন, ওঁর বাড়ির লোক কে আছেন, একবার আসুন। ওমনি সেই পেশেন্টের বাড়ির লোক এগিয়ে যাচ্ছে।
এবার সেই দিদি এসে ডাকলেন, কুসুম মণ্ডলের বাড়ির কে আছেন, কুসুম মণ্ডল? কেউ সাড়া দিলনা। আরও দু একবার ডেকে নার্সদিদি বিরক্ত হয়ে চলে গেলেন।
তারপর চা খেয়ে ফিরল বাদল, কোন খবর আছে? এরা বলল, না দাদা।
এদিকে ভোলা কারও সঙ্গে কথা বলছে না, খালি বিড়বিড় করে হে মা মনসা, হে মা বিষহরি করছে।
এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে এল লক্ষ্মী, কি রকম মানুষ তোমরা? বসে আছ, সাড়া দিচ্ছ না। ডাক্তারবাবু ডাকছেন যে।
এরা অবাক, কই, আমাদের ডাকেনি তো। ডাকেনি মানে? এইমাত্রই তো কুসুম মণ্ডলের বাড়ির লোককে ডেকে গেলেন।
বন্ধুরা আরও অবাক। এই ভোলা, তোর বৌয়ের ভাল নাম কুসুম তুই জানিস না?
ভোলা অপ্রস্তুত হয়ে বলল, মাইরি, মনে ছিলনা।
বাদল বিরক্ত হয়ে বলল, খুব হয়েছে, চল, আমিই যাচ্ছি।
ফিরে এসে বলল, ডাক্তারবাবু একটা ওষুধ লিখে দিয়েছেন, আনতে যাচ্ছি।
জিজ্ঞেস করলাম, অবস্থা কেমন, তো বলল, এখনো কিছু বলা যাচ্ছে না। এতটা শুনেই ভোলা আবার ডুকরে কেঁদে উঠল।
বাদল বিরক্ত হয়ে বলল, এই, এখানে একদম কাঁদবে না। অনেক রুগীর বাড়ির লোক আছে।
বিশু বলল, চল তো, তুই বাইরে চল। এখানে কান্নাকাটি করলে হাসপাতালের লোক আমাদের বার করে দেবে।
বাইরে এসে গেটের বাইরেই শ্যামসায়রের ঘাটে বসে ভোলার কান্না আরও বেড়ে গেল।
আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেবল বলে চলেছে হে মা মনসা, হে মা বিষহরি। বিশু পাশের দোকান থেকে কিছু কচুরি তরকারি খেয়ে আরও চারটে ঠোঙা মহাদেব, তিলু, ভোলা আর লক্ষ্মীর জন্যে নিল। এই নে, এটা খেয়ে নে। আমি ভেতরে ওদের জন্যে নিয়ে যাচ্ছি। ভোলা যন্ত্রের মত হাত বাড়িয়ে দিল।
বাদল ফিরল প্রায় এগারোটায়। ওষুধটা নিয়ে ডাক্তারবাবু বললেন, এটা এখুনি দিয়ে দিচ্ছি। আপনাদের সকলে থাকার দরকার নেই। বাইরে একজন থাকুন যাতে ডাকলে পাওয়া যায়। তবে মনে হয় ঘন্টা পাঁচেকের আগে দরকার হবে না। ততক্ষণ বিশ্রাম করুন।
বাদল বলল, তোমরা দেখ কাছাকাছি কোথাও একটু গড়িয়ে নিতে পারো কিনা। আমি এখানেই আছি।
মহাদেব, তিলু আর বিশু সামনের এক চাতালে গিয়ে বসল, তারপর কখন যেন ওখানেই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
ঘুম ভাঙল বাদলের ডাকাডাকিতে। ওঠ, ওঠ, খুশির জ্ঞান ফিরেছে। তিলুর বৌ এসে বলল, বিপদ কেটে গেছে। ভোলাকে দেখতে চাইছে। কই সে, কোথায়?
কপালে হাত ঠেকিয়ে বিশু বলল, যাক বাবা। বিপদ কেটে গেছে। যা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু ভোলা ভেতরে নেই ? তাহলে বোধহয় এখনো ওই ঘাটেই বসে আছে। আয়, দেখি। বাদল ভেতরে চলে গেল, আর এরা গেল বাইরে ভোলাকে ডাকতে।
কিন্তু ভোলা তো ঘাটে নেই। কোথায় গেল? ভোর চারটেয় ভাল করে ফরসাও হয়নি। কোন কোন ঘাটে দু একজন গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। সব কজনকেই খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। কই, ভোলা তো নেই। মহাদেব বলল, তাহলে বোধহয় ও আমাদেরই মত ভেতরেই কোথাও শুয়ে আছে। তোরা বরং বাইরে দেখ, আমি আর বাদলদা ভেতরটা খুঁজি। কিন্তু খোঁজাখুঁজিই সার, ভোলাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তিলু বলল, নাঃ, এখানে নেই। চল, ভেতরেই যাই। তখনই বিশুর নজরে পড়ল, যেখানে ভোলা বসেছিল তার একটু দূরেই একজোড়া চটি আর একটা শার্ট পড়ে আছে।
আরে, এটা ভোলার জামা না?
হ্যাঁ, তাইতো।
তাহলে ও কোথায়? বৌয়ের শোকে জলে ডুবল নাকি?
ধ্যাৎ, এখানে ডুবজল নেই। তাছাড়া সাঁতার জানলে কেউ ডুবতে পারে না।
তবে শালা গেল কোথায়? চেঁচিয়ে ডাক, কোথায় আর যাবে, আছে এখানেই কোথাও।
ওরা দুজন ভোলা, এই ভোলা, কোথায় তুই বলে চেঁচাতে লাগল, কিন্তু কোন সাড়া নেই।
ততক্ষণে চারদিক পরিস্কার হয়েছে, চায়ের দোকানগুলো খোলা শুরু হয়েছে, রাস্তায় বেশ কিছু লোকজনও বেরিয়েছে। অনেকে কৌতুহলী হয়ে, কি হয়েছে ভাই, কাকে খুঁজছেন, কত বয়েস, কেমন দেখতে, এইরকম সব প্রশ্ন করছে।
দু জনের জায়গায় এখন দশ বার জন ভোলাকে খুঁজছে।
ভেতর থেকে ইতিমধ্যে মহাদেব বেরিয়ে এসেছিল।
সে এবার ভেতরে খবর দিতে গেল, ভোলাকে পাওয়া যাচ্ছে না। খবরটা লক্ষ্মী হয়ে খুশির কানেও উঠল। এবার সে কাঁদতে লেগে গেল। লক্ষ্মী একবার বাইরে এসে খোঁজ নেয়, তার পরেই ভেতরে খুশিকে সাহস জোগায়। ভেতরে গেলে খুশি তাগাদা দেয়, বাইরে এসে খোঁজ নেবার জন্যে, আর বাইরে এলে তিলু বকে খুশিকে ছেড়ে আসার জন্যে। এইভাবে প্রথমে পুরো ফিমেল ওয়ার্ড, তারপর বিল্ডিং এর বাইরেও খবরটা ছড়িয়ে পড়ল, পেশেন্টের বাড়ির একজনকে পাওয়া যাচ্ছে না, হয়ত জলে ডুবে গেছে। একেবারে হৈহৈ কাণ্ড।
বেলা চড়ছে। লোকজনও বাড়ছে। সঙ্গে ‘কি হয়েছে ভাই’ পাবলিকও বাড়ছে।
খুশির কান্না, বাদলের উদ্বেগও বাড়ছে। বিভিন্ন ঘাটে হাতমুখ ধুতে আসা লোকও বাড়ছে। এরা বেশির ভাগই রাতে হসপিটালে থাকা পেশেন্ট পার্টি, ঝোপড়ি দোকানে কাজ করা কিশোর এইসব। এরকমই একজন ভিড় থেকে অনেকটাই দূরে একটা ঘাটে নামতে গিয়ে দেখে একটা লোক গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে চোখ বুঁজে কি যেন বিড়বিড় করছে। সে কিছুক্ষণ দেখল। হয়তো চান করতে নেমে ইষ্টমন্ত্র জপ করছে। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল, নড়ন চড়ন নেই, তাকাচ্ছেও না। তার মনে হলো ব্যাপারটা গোলমেলে। ডাক দিল, এই, কে তুমি, ওখানে কি করছ? ভোলা একবার দেখল, তারপর মুখটা ঘুরিয়ে নিল, কিন্তু কোন সাড়া দিল না। এ রকম কয়েকবার ডাকার পর তারও গলা চড়ল। ঘাটে আরও কিছু লোক ততক্ষণে জড় হয়ে গেছে। একজন বলল, তুমি সেই সাপে কাটা বৌটার স্বামী নও তো? এবার ভোলা ডুকরে কেঁদে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে হৈহৈ শুরু হয়ে গেল, পাওয়া গেছে, পাওয়া গেছে। যত হুজুগে লোক শ্যামসায়রের পাশে জুটেছিল, সব এই ঘাটে এসে জুটল। ভোলার তিন বন্ধু আর বাদলও এল। বিশু সোজা জলে নেমে গিয়ে ভোলার দু কাঁধ চেপে ধরে বলল, এই শালা, আমরা ওদিকে গরু খোঁজা করছি, তোর বৌ কাঁদছে, তুই এখানে কি করছিস?
এবার ভোলা ফ্যালফ্যল করে তাকাল, পুরো ভিড়টাকে দেখল, তারপর যেন বিশ্বাস হচ্ছে না এইভাবে বলল, খুশি বেঁচে আছে?
তুই কি ভেবেছিলি মরে গেছে?
তবে যে ডাক্তার বলেছিল, আনতে দেরি হয়েছে, অবস্থা ভাল না? তাই ভেবেছিলাম, মা মনসা যদি ওকে নেয়, তবে সঙ্গে আমাকেও নিক।
তাই সাপের কামড় খাবি বলে গলাজলে বসে আছিস? ওদিকে তোর বৌটা কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলল। তুই মানুষ না পাঁঠা রে? চল, ওঠ।
ভোলা জল থেকে উঠে এল। সর্বাঙ্গে কাদা, খালি গা, প্যান্টটার রং পর্যন্ত বোঝা যাচ্ছে না। বাদল বলল, এই অবস্থায় গেলে খুশি আবার অজ্ঞান হয়ে যাবে। তোমরা কেউ একজন গিয়ে স্টেশন রোডের কোন দোকান থেকে যা হয় কিছু জামাকাপড় কিনে আন। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে কিছু খেয়ে তবে আসবে। আমি ততক্ষণ গিয়ে খুশিকে খবর দিই। এই টাকাটা রাখ।
বাদল ভেতরে গিয়ে সুখবরটা দিতে খুশির মুখে হাসি ফুটল।
তারপর সব কথা বলতে পুরো ফিমেল ওয়ার্ড জুড়ে হাসির হররা উঠল। সকালের শিফটের নার্সদিদি ছিলেন বেশ বয়স্ক। খুব রসিক। বললেন, বেহুলা লখিন্দরের গল্প শুনেছি, বেহুলা স্বামীর প্রাণ ফিরিয়ে এনেছিল। এখানে লখিন্দর মা মনসার কবল থেকে বেহুলার প্রাণ ফিরিয়ে আনল। তোমার শিবরাত্রির জোর আছে বাছা, সাক্ষাৎ ভোলানাথ বর পেয়েছিলে, একেবারে বুকে করে রেখেছে।
লজ্জায় গাল লাল করে খুশি মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসল।
প্রায় একঘন্টা পরে ভোলা এল নতুন পাজামা পাঞ্জাবি পরে সলজ্জ হাসিমুখে। দরজায় দাঁড়িয়ে খুশিকে দেখল, যেন নতুন করে শুভদৃ্ষ্টি হল। নার্সদিদি বললেন, তুমিই সেই লখিন্দর? এস, ভেতরে এস। তোমার জন্যে আজ কোন মানা নেই। বৌয়ের পাশে একটু বস। একটু বেহুলা লখিন্দর একসঙ্গে দর্শন করি।
ভোলা জিজ্ঞেস করল, এখন কেমন আছে?
একেবারে ঠিক হয়ে গেছে। মনে হয়, এবেলাই ছেড়ে দেবে। ডাক্তারবাবু একবার দেখবেন, তারপর ছুটি।
ভোলা উঠল, তারপর বেরোবার আগে নার্সদিদিকে ঝপ করে একটা প্রণাম করে ফেলল।
সারা রাত খুব ধকল গেছে। ফাঁড়া কেটে গেছে, সকলের আর থাকার দরকার নেই।শুধু ভোলাই রইল, বাকি সবাই ফিরে গেল।
ঘন্টা দুয়েক পরে হাসপাতাল থেকে রিলিজ নিয়ে যখন ভোলা আর খুশি টোটো স্ট্যান্ডের দিকে রওনা হল, ওদের নববিবাহিত বরকনে মনে হচ্ছিল। সেই দেড় বছর আগের মত।
খুশী জিগ্যেস করলো, গলাজলে দাঁড়িয়ে কি মন্তর পড়ছিলে গো ।
ভোলার এখন একমুখ হাসি । বললো, ওই যে শুনলি না ? মা বিষহরিকে বলছিলাম আমাকেও টেনে নাও গো মা । তোকে ছাড়া কি আমি থাকতে পারি রে খুশী ।
টোটোর ড্রাইভারটা ঘাড় ঘুরিয়ে একবার পেছনে দেখলো দুজনকে ।
খুশী বললো, আহা, একেবারে মিথ্যের ঝুড়ি !
[মতামত ও বানানবিধি লেখকের নিজস্ব]
Tags: অনিমেষ বন্দ্যোপাধ্যায়, গল্প, লখিন্দর
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।