24 Oct

জীবন যেরকম

লিখেছেন:সিদ্ধার্থ সান্যাল


ভাঁটার ফিরতি টানটা নদীগুলোর সুবিস্তৃত মোহনায় বোঝা যায় সবার আগে ।

বিস্তীর্ণ জলরাশি ধীরে ধীরে সরে যায় সমুদ্রের গভীরে ।

সুন্দরবনের আষটেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকা সব নদী আর খাঁড়ির জল সরতে থাকে মোহনার থেকে অপেক্ষাকৃত দ্রুত গতিতে ।

ভালো করে খেয়াল করতে না করতেই উন্মুক্ত হয়ে যায় নদীর চর, বেরিয়ে পড়ে নদীতীরের চ্যাটচ্যাটে আঠালো নোনা মাটি, তার মধ্যে অজস্র কাঁকড়ার গর্ত।

সে মাটিতে তাড়াতাড়ি চলতে পারা যায় না, পায়ের জুতো এঁটেল মাটিতে আটকে আটকে যায় ।

নদীতীরের চরের ওপর দিয়ে ছোট্ট দলটা আগেপিছে লাইন দিয়ে চলছে, সব থেকে আগে আছে দুর্গা ।

সে এই দলটার মাথা, আর ঠিক বলতে গেলে দলের সব থেকে ভালো মোবাইল ফোনটার মালকিনও বটে ।

পেছন পেছন আসছে তার চার সঙ্গিনী, লতা, মিনতি, বাসন্তী আর বীণা ।

সকলের পরনে শালোয়ার কামিজ, পিঠে ঝুলছে সস্তার ব্যাকপ্যাক, যার মধ্যে আছে খেপের পোশাকের ঝকমকে শাড়ী, ঝুটো গয়না, ঘুঙুর জোড়া আর সাজসজ্জার যৎসামান্য আনুষঙ্গিক, পাউডার, চকচকে টিপ, কাজল, আর অবশ্যই লিপস্টিক ।

দলের ছোটো এই লাইনের শেষে রয়েছে গাঁট্টাগোঁটটা চেহারার সুবল, ধুতি আর সাদা সার্ট, মাথায় একটা গামছা পাগড়ীর মতো করে বাঁধা, গলায় ঝুলছে ঢোল ।

কাদা থেকে বাঁচবার চেষ্টায় সুবল ধুতিটা তুলে বেঁধেছে হাঁটুর ওপরে ।

জলকাদার রাস্তায় সকলের পায়েই রবারের হাওয়াই চটি, তাই সকলের চলার গতি শ্লথ, কাদায় পা আটকালে টেনে টেনে তুলতে হচ্ছে ।

একমাত্র সুবলই ব্যতিক্রম, তার একহাতে চটিজোড়া অন্যহাতে একটা লম্বা থলে, ঢাউস জলের বোতলের মাথা উঁকি মারছে তার ভেতর থেকে ।

কিন্তু তাড়াতাড়ি চলার বাড়তি সুবিধা থাকলেও সকলকে পেরিয়ে তার এগিয়ে যাওয়ার উপায় নেই ।

দলের অলিখিত নিয়ম হচ্ছে লাইনের শেষে থাকবে একমাত্র পুরুষ সদস্য ।

হন হন করে যেতে যেতে লাইনের মাথা থেকে দুর্গা তাড়া দিলো,

-‘চল তোরা দিকি একটু পা চাইল্যে । নেতাইদা একবার ফোন করিছে গেস্ট হাউস থেকি । সবসুময় ধমকি দ্যায় টাকা কাটাই দিবে । বলে, তাতে যদি তোদের খ্যাল হয় সুময়ে আসবার জন্যি ।’

বীণা বললো,

‘আইজ ভাঁটার সুময়ই তো বদলাই গেইছে না । টানের উজানে যেইতেই সজনেখালি থেকি বিশ মিনিটের রাস্তায় ঘন্টাভর লেগেইছে।

সুবল পেছন থেকে হেঁকে বললো,

-‘পাঁচ মিনিটের মধ্যি বাঁধে চড়ি যাবো তো । তারপর তো মাইলটাক ইটের রাস্তা, দশ মিনিট লাগবে । তুই-ই তো কইলি পাড়ে পাড়ে হেঁইটে যাবি ।’

দুর্গা বেশ তাড়াতাড়ি এগোচ্ছিল । এবার দাঁড়িয়ে গেলো । বোধহয় একটু দম নেওয়ার ইচ্ছা ।

ঘুরে গিয়ে সুবলের দিকে চেয়ে বলল,

-‘সাধে কই নাই সুবলদা । জেটি থেকি মটররিস্কা এই ছয় জনায় দেড়শর কম নিত কি না কও? সক্কলি জানে খেপ মারতি যাই আমরা । ওই রিস্কার ট্যাকা তো নেতাইদা দিতনি । ক্যাবল নাচগান, রাতের খোরাক আর লৌকোভাড়া দিবার ‘কনট্যাক’ হইছে । তাইলে এইটুক হেঁইটে গেলি পর পঁচিশ ট্যাকা ভাগে বাড়লনি, কও? ’

দুর্গার কথাটা একেবারে সত্যি ।

নিতাই কুণ্ডু যে টুরিস্ট কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে এইরকম সব সান্ধ্য অনুষ্ঠানের জন্য সাকুল্যে কতো টাকা নেয় সেটা কেউ কখনো জানতে পারে না ।

যারা নিজেরা অনুষ্ঠানটা উতরে দেয় তারা তো নয়ই ।

আর খোদ টুরিস্ট কোম্পানির হিসাবের ধরণধারণই আলাদা ।

সেখানে তাদের টুরিস্ট ক্লায়েন্টের মাথাপিছু রেটের হিসাব থাকে ।

তাই নীচের তলার সব থোক হিসেবই গুলিয়ে যায় ।

দুর্গার অকাট্য ব্যাখ্যার পর দলটা আবার হন হন করে চলতে থাকে ।

বাঁধে ওঠার জন্য মানুষের পায়ে পায়ে তৈরি মাটির ধাপের সিঁড়ি একটু এগিয়েই পাওয়া যাবে ।

#

গড়খালি জেটির পাশেই বাজার অঞ্চলে একটা গুমটি সাইজের ছোট্ট ঘর, নিতাই কুণ্ডু বলে সেটা তার ‘আপিস’!

কোলকাতার যত সুন্দরবন ভ্রমণসংস্থার কাজকারবারের দৌড় থেমে যায় এই নিতাই কুণ্ডু টাইপের লোকেদের এইসব গুমটি আপিস অবধি এসে ।

পুরো দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার উনিশটা ব্লকের এলাকা ধরলে এই সব আপিসের সংখ্যা কিছু কম নয় ।

নিজেদের গালভারী নাম এরা নিজেরাই দিয়েছে, টুরিস্ট কোম্পানির ‘সাইট সিইয়িং এজেন্ট’!

সুন্দরবন আর গঙ্গাসাগর এলাকা ঘোরার জন্য যতগুলো টুরিষ্ট এন্ট্রি পয়েন্ট আছে সেখানেই এই নিতাই কুণ্ডুরা হাজির তাদের আপিস আর প্যাকেজ নিয়ে ।

লঞ্চ ভাড়া, মাথাপিছু চব্যচোষ্য খাওয়াদাওয়া, প্রাইভেট লজে টুরিস্ট রাত্রিবাস, গাইডেড ভ্রমণ, মায় লজের সান্ধ্যকালীন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্যাকেজ এরা বিক্রি করে কোলকাতার ছোটবড় সব পর্যটন সংস্থাগুলোকে ।

এই সুন্দরবনের জলজঙ্গলের রাজত্বে এরাই মুকুটহীন রাজা, এদের ডিঙ্গিয়ে শহুরে কোম্পানিগুলোর ঘাস খাওয়ার কোনও উপায় নেই ।

সরকারি পর্যটন দপ্তরের ব্যাপার স্যাপার অবশ্য আলাদা ।

তাদের সরকারি লীজ নেওয়া লঞ্চ আর টুরিস্ট লজ আছে, আর আছে মাইনে করা গাইড ।

কোলকাতার অফিস থেকে বেঁধে দেওয়া মাথাপিছু রেট, কমবেশি করার জায়গা নেই ।

প্রাইভেট কোম্পানিদের জন্য তৈরি অন্যান্য অনেক প্যাকেজের সঙ্গে নিতাই কুণ্ডুদের ব্যবস্থা করা আছে গ্রামে গ্রামে নাচগানের দলের সঙ্গে ।

সেসব দলের বাড়তি জীবিকা চলে সুন্দরবনের টুরিস্টদের লজগুলোতে রাত্রিবাসকালে তাদের বৈচিত্র্যহীন নিঃশব্দ সন্ধ্যেগুলো স্থানীয় লোকসংস্কৃতির সুরভিতে সুরভিত করে। কালের নিয়মে সেই স্থানীয় সংস্কৃতির গান আজ কিছুটা অবসৃত ।

ডিমান্ড সাপ্লাইয়ের সূত্র মেনে আসরের আংশিক দখল নিয়েছে এক দো তিন আর উড়ি উড়ি যায় ।

তবে প্রহ্লাদের মতো কয়েকজন হাতে-গোনা শহুরে ট্যুরিষ্ট যে মাঝে মাঝে স্বপ্না চক্রবর্তী, নির্মলেন্দু বা স্বপন বসুর গানের অনুরোধ করেন না এমনটা নয়।

তেমন সুযোগটা পেলে দুর্গা তার নিজের বাঁধা দুএকটা ঝুমুরগানও শুনিয়ে দ্যায় কলকেতার বাবুবিবিদের।

এই দলটায় দুর্গা অবিসংবাদী লিডার ।

সে গান বাঁধে, সেই গানে হাতে-গোনা দুতিনটা সুর বসিয়ে দেয় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, আর গানের সঙ্গে সাথীদের নাচও শেখায় হাত-পা আর আঙ্গুল খেলিয়ে।

লাটের ইস্কুলে দুর্গা সাত ক্লাস পাস দিয়েছিল।

তার বুদ্ধি বিবেচনা যে দলের সকলের থেকে বেশী সেটা সবাই বুঝতে পারে ।

সব থেকে বড়ো কথা হোল, ঘর থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে কোরে সে কলকেতায় টানা এক মাস বাস করে এসেছে!

সে বিয়ে অবশ্য ধোপে টেঁকেনি সেই এক মাসের বেশী ।

জেদি আর তেজী দুর্গা নিজেই ছেড়ে এসেছিলো দোজবরে স্বামীর দক্ষিণ কোলকাতার বস্তির ঘর ।

কোলকাতার বর্ণময় জীবনযাপনের আকর্ষণ তাকে আর কোনদিন সেখানে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি ।

কিন্তু সেরকম ছাড়ান কাটান তো আজকাল সুন্দরবনের লাটগুলোর ঘরে ঘরে আকচার হচ্ছে ।

শহরের এই রোগ নিয়ে জঙ্গলে এখন কেউ আর মাথা ঘামায় না ।

এই সবকিছু মিলিয়ে মিশিয়ে তাই দলের মধ্যে দুর্গার অবস্থান সবার ওপরে ।

সেজন্য সন্ধ্যেবেলার এইরকম নাচগানের খেপের টাকা থেকে দুর্গার ভাগে পঞ্চাশ টাকা বেশী গেলে কেউ তা নিয়ে আপত্তি করে না ।

নিতাই কুণ্ডুও সান্ধ্য অনুষ্ঠানের ‘কনট্যাক’ করার জন্য দুর্গার সঙ্গেই কথা বলে ।

দুর্গা অবশ্য ‘নেতাইদা’-র প্রতি যে বিশেষ উচ্চ ধারণা পোষণ করে সেরকমটা নয় ।

বরং চলতি কিছু প্রাকৃত শব্দ দুর্গা নিতাই কুণ্ডুর পেছনে প্রায়ই তার সম্বন্ধে ব্যবহার করে থাকে ।

দুর্গার এই পুরো দলটা যার কথা শোনে তিনি হচ্ছেন মিহিরদা, মিহির ভটচায, যিনি এই ঝড়খালি সজনেখালি অঞ্চলে ‘বন্ধু’ নামে একটি এনজিও চালান গত দশ বছর ধরে ।

পরিবেশ সচেতনতার প্রসারের জন্য কাজ শুরু করলেও ধীরে ধীরে বন্ধু এনজিও এই অঞ্চলের গ্রামবাসীদের আর্থিক সংস্থানের উন্নয়নের কাজেও সহায়তা করছে বেশ কিছু সময় ধরে ।

দুর্গার দলের প্রত্যেক সদস্যই বন্ধু পরিচালিত সজনেখালির একটা কম্যুনিটি সেন্টারের স্বনির্ভরগোষ্ঠীর বিভিন্ন হাতেকলমের কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত।

কেউ বাঁশের চাটাই, ঝুড়ি, মাদুর বোনে, কেউ ডালের বড়ি দ্যায়, কেউ বা শিখে নিয়েছে গোয়ালঘরে মাশরুমের চাষ আর মৌমাছি পালবার খুঁটিনাটি ।

‘বন্ধু’-র ব্যবস্থাপনায় কমিউনিটি সেন্টারের এই সব প্রডাক্ট চলে যায় শহর কোলকাতার বাজারে ।

এনজিও-র সর্বেসর্বা মিহিরদার জানাশোনাটা রাজ্যের সীমানা ছাড়িয়ে রাজধানী দিল্লী, এমন কি বিদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত ।

মাঝে মাঝে মিহিরদার সঙ্গে সেন্টার দেখতে আসে বিশিষ্ট বিদেশী লোকজন ।

কইয়ে-বইয়ে দুর্গা বিদেশী অতিথিদের সেন্টারের কাজকর্ম বাংলা ভাষায় বোঝায় ।

আর মিহিরদা, উপস্থিত সকলের বিস্ফারিত চোখের সামনে দুর্গার কথাগুলো গড়গড় করে তাদের ইংরেজিতে বুঝিয়ে বলতে থাকে ।

দুর্গা মিহিরদার ভরসার পাত্রী, তাই কম্যুনিটী সেন্টারে দুর্গার এই বিশেষ ভূমিকাটা বরাবর চলে আসছে।

এসব কারণে নিতাই কুণ্ডু টাইপের আপাদমস্তক স্বার্থান্বেষী এজেন্টও দুর্গাকে একটু সমঝে চলে ।

আজ সন্ধ্যেয় পাখিরালয়ের একটা ট্যুরিষ্ট লজে কোলকাতা থেকে আসছে একদল ভ্রমণবিলাসী বয়স্ক মানুষের দল ।

জঙ্গলের নিরুত্তাপ সন্ধ্যেকে তাদের কাছে মনোরম করে তোলার জন্যে সজনেখালির দুর্গা এন্ড কোম্পানির আজ নাচগানের বরাত, ব্যবস্থাপনায় নিতাই কুণ্ডু ।

টেম্পো ট্রাভেলারের পিছনের দিকের সিটগুলো থেকে কেউ কোরাস গানে গলা মেলাচ্ছে না ।

সেখানে বয়স্ক চার পাঁচ জন পুরুষ যাত্রী ঝুঁকে পড়ে নিজেদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর আলোচনায় মগ্ন, একজনের চোখ তো মোবাইলের স্ক্রিন থেকে সরছে না ।

সামনের দিকে বসা অপেক্ষাকৃত ইয়ং বিগ্রেডের এই ব্যাপারটা পছন্দ হচ্ছে না একেবারেই ।

এই উইক এন্ড সুন্দরবন ট্রিপের মুখ্য উদ্গাতা হচ্ছে সত্যব্রত আর বৈশাখী দম্পতি ।

সত্যব্রত ওরফে সতুর জানাশোনা এক ট্যুর কোম্পানির মালিকের সঙ্গে ।

ফ্যামিলি হোয়াটস গ্রুপের ওয়ালে সতু আমন্ত্রণ জানাতেই তিন দিনের মধ্যে নিকট আর দূরের আত্মীয়, আর পরিচিত অল্প পরিচিত বন্ধুবান্ধব নিয়ে পনের জনের দল একেবারে তৈরি ।

শেষ সময়ে দলে ভিড়ে গেছেন বয়স্কতম সদস্য, সত্তরোরধ সকলের দিপুকাকা ।

বয়সের ভারে তিনি কিছুটা শ্লথগতি, চোখের নজরও কম, কিন্তু উৎসাহে কোনও ঘাটতি নেই ।

টেম্পো ট্রাভেলার চলছে বেশ জোরে, নিজের সিট থেকে সতু ঘুরে দাঁড়িয়ে উঠলো পিছনের দিকে মুখ করে ।

বাসের গতির জন্য সে ডানহাত দিয়ে সিলিঙয়ের রডটাকে চেপে ধরে আছে ।

কোরাস গানের আওয়াজের ওপরে গলা তুলে সতু বললো,

-‘হ্যালো, হ্যালো…এই যে সিনিয়ার সিটিজেনের গ্যাং! তোমরা গাইছো না কেন? না কি বলবে, তোমরা ধিতাং ধিতাং বোলে গানটা জানো না!’

সতু হ্যালো হ্যালো শুরু করতেই কোরাস গানের আওয়াজ কিছুটা ঢিমে হয়ে এসেছিলো ।

সতুর শেষ কথা শুনেই এবার সামনের দিকের গায়ক গায়িকারা ধিতাং ধিতাং থামিয়ে সমস্বরে হই হই করে চিৎকার করতে লাগলো, ‘শেম, শেম, শেম, শেম!’

এমন সে চিৎকার যে ড্রাইভার গাড়ির গতি কমিয়ে এক পলকের জন্য পিছনে তাকিয়ে বোঝবার চেষ্টা করলো ব্যাপারটা কি হলো ।

হই হই করা তুমুল হাসির সঙ্গে শেম শেম স্তিমিত হয়ে এলে সিনিয়র সিটিজেনের একজন দেবাশিস, পেছনের সিট থেকে জিজ্ঞাসা করলো,

-‘আমাদের ডেসটিনেশন কতদূর অর্জুন, আর কতো সময় লাগবে?’

রিটায়ার্ড দেবাশিস আর স্ত্রী সুস্মিতা দিল্লীপ্রবাসী, কদিনের জন্য তাদের কোলকাতা ভ্রমণ ।

এই উইক এন্ড সুন্দরবনটা তাদের প্ল্যানের মধ্যে ছিল না, তাই তারা বেশীরকম উৎসাহী ।

যাকে বলা হল সেই অর্জুন বসেছিল ড্রাইভারের পাশে, বনেটের ওপাশের সিঙ্গল সিটে ।

এ রাজ্যের সরকারি সিনিয়র আমলা হওয়ার সুবাদে এইদিকে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণায় বেশ কিছুদিন পোস্টেড ছিল, সমস্ত অঞ্চলটা হাতের তালুর মতো চেনে ।

সে যেচে ওই সিটটায় বসে গেছে ।

তাই রাস্তা ভুল হওয়ার বিপদ থেকে নিশ্চিন্ত হয়ে বেশীর ভাগ যাত্রীই ধিতাং ধিতাং-য়ে ব্যস্ত ।

অর্জুন দেবাশিসের প্রশ্নে আদ্ধেকটা ঘুরে বসে জবাব দিলো,

-‘দশ মিনিটের মধ্যে গড়খালি পৌঁছে যাবো দাদা । ওখান থেকেই লঞ্চে উঠতে হবে ।’

-‘গড়খালির জেটির কাছে নিতাই কুণ্ডু নামে এজেন্সির একজন থাকবে, সে বাসের নম্বর জানে, বাসের কাছে চলে আসবে, আমি ফোন করে দিয়েছি ।’ সত্যব্রত যোগ করলো ।

দলের মধ্যে বৈশাখী একজন ট্রেনড, মেডেল পাওয়া গায়িকা ।

সে আর দুয়েকজন মহিলা আবার হই হই করে উঠলো, ‘এই, সব থামলে কেন, গাও গাও ।’

আবার সমস্বরে শুরু হয়ে গেলো, ‘দুরন্ত ঘূর্ণির এই লেগেছে পাক…’

ঘূর্ণির সেই প্রবল পাকের প্রভাবে দেশের অগ্রগতির ওপর আলোচনা আপাতত স্তব্ধ হয়ে রইলো ।

#

সত্যব্রতর এক পাড়াতুতো বন্ধু সুকুমার এই টুরিস্ট কোম্পানিটা চালায় ।

সুন্দরবন বেড়ানোর এই উইক এন্ড প্যাকেজটা বেশ সুবিধাজনক মনে হয়েছিল সত্যব্রতর।

শনিবারে কোম্পানির ব্যবস্থা করা টেম্পো ট্রাভেলারে চড়ে সকাল নটার মধ্যে গড়খালি পৌঁছে লঞ্চে চড়ে সেখানেই ব্রেকফাস্ট ।

তারপর ঢুকে পড়ো সুন্দরবনের জলপথের শিরা উপশিরায়, দেখতে থাকো ভুবনবিখ্যাত ম্যানগ্রোভ অরণ্য আর উপভোগ করো তার শৈল্পিক নির্জনতা ।

দুপুর একটার মধ্যে ঝড়খালি ব্যাঘ্র প্রকল্প দেখা সেরে লঞ্চেই জম্পেশ লাঞ্চ, ভাত, মুগের ডাল, টাটকা গলদা চিংড়ির কারি আর সরষে-পম্ফ্রেট সহযোগে ।

তারপর আবার জলপথে ঘণ্টা তিনেক ঘোরাঘুরি, তার সঙ্গে  বিকেলে লঞ্চেই  চা, ভেজ পকোড়া ।

বনাঞ্চলে সন্ধ্যে নেমে আসে তাড়াতাড়ি, নিঃশব্দে, চিতাবাঘের ক্ষিপ্রতায় ।

তাই সূর্য পশ্চিমে ঢলে গেলেই আলো থাকতে থাকতে পাখিরালয়ের গেস্ট হাউসে ঢুকে পড়া ।

গেস্ট হাউসের সন্ধ্যে কিন্তু নিরুত্তেজ কাটবে না ।

সুকুমারের গড়খালির এজেন্ট নিতাই কুণ্ডু সে ব্যবস্থা করে রেখেছে ।

সন্ধ্যেবেলায় দুর্গা কৈবর্তের ‘কাননবন্ধু’ দল ডিনারের আগে সাতটা থেকে পাক্কা এক ঘণ্টা লোকাল নাচগান পরিবেশন করবে অতিথিদের মনোরঞ্জনের জন্য, সঙ্গে চা আর চিকেন পকোড়া ।

তারপরে ডিনারে ভাত বা রুটি, ডাল, বেগুনভাজা আর চিকেনকারি ।

পরদিন সজনেখালি বাঘপ্রকল্প, ওয়াচ টাওয়ারে উঠে বাঘের দর্শন, অভাবে তার চলনপথ দর্শন, বিস্তীর্ণ বিদ্যা নদীতে ঘন্টাদুয়েক জলবিহারের পর জলের ওপরেই লাঞ্চ সেরে বিকালে গোসাবা জেটিতে অবতরণ ।

নিতাই কুণ্ডুর নিপুণ ব্যবস্থাপনায় সুকুমারের টেম্পো ট্রাভেলার গড়খালি থেকে পরের দিন বিকেলে গোসাবায় পাক্কা হাজির থাকবে ।

রাস্তা ঠিকঠাক থাকলে সন্ধ্যে সাতটায় ভেতরে বাস কোলকাতায় ঢুকে যাবে ।

সুকুমারের একটাই শর্ত ছিল, ‘ ভাই সতু, পনেরজনের কম দল হলে কিন্তু আমার রেটে পোষাবে না, লোক পনেরোর কম হলে মাথাপিছু রেট কিন্তু অনেক বেড়ে যাবে।’

ট্যুরের বিবরণ জেনে সত্যব্রতজায়া বৈশাখীর বিপুল উৎসাহ জেগে উঠলো ।

ফ্যামিলি হোয়াটস আপ গ্রুপে দেওয়ার পর কয়েকদিনের মধ্যেই আশাতীতভাবে জুটে গেলো জরুরী পনের জনের দল, তুতো ভাইবোন দিদি জামাইবাবুদের সঙ্গে, সিনিয়র পূবালী দিদি, তাঁর দুই বন্ধু দম্পতি আর সকলের সিনিয়ার দিপুকাকু ।

বড়ো দলটায় প্রায় সকলেই জোড়ায় জোড়ায়, দিপুকাকু, সতুর পিসতুতো দাদা অমিতাভ আর অবীরা পুবালীদিদিকে বাদ দিয়ে ।

প্রৌঢ়া পূবালী গোস্বামী দক্ষিণ কোলকাতার এক নামী নৃত্যগীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিন্দোল-এর স্বত্বাধিকারিণী ।

যৌবনে নাচের চর্চা ছিল ভালোরকম, স্বামীর প্রতিষ্ঠিত স্কুলে নাচ শেখাতেন, ছিল অনেক ছাত্রী ।

এই বয়সেও তাঁর উৎসাহ উদ্দীপনা যুবক যুবতীদেরও হার মানাতে পারে ।

স্বামীর মৃত্যুর পর একা হাতেই হিন্দোল-এর আলাপ আর বিস্তার সামলে চলেছেন ।

কোলকাতার সাংস্কৃতিক মহলে বেশ ভালোরকম জানাশোনা তাঁর, ফোনে ফোনে পাঁচ মিনিটের মধ্যে দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু দম্পতিকে এই সুন্দরবন উইক এন্ড ট্রিপে সামিল করে ফেলেছেন ।

বাকি রইলো সত্যব্রতের প্রবাসী দিদি জামাইবাবু সুস্মিতা আর দেবাশিস, মাসতুতো দাদা জিষ্ণু আর তার স্ত্রী পলা, পলার বোন সুনীতা আর তার স্বামী অর্জুন ।

পঞ্চাশের ওপরে গড় বয়েসের এই পনের জনের দলটাকে নিয়ে বাসটা স্টিয়ারিঙের কসরত দেখাতে দেখাতে ধীরে ধীরে গড়খালির ঘিঞ্জি হই হট্টগোলে ভরা জেটির এলাকায় ঢুকে পড়লো ।

বাসের গতি কমে আসতেই মধ্যবয়েসী, সাদা গোঁফের একজন মোটাসোটা মানুষ তড়াক করে বাসের পাদানিতে উঠে পড়ে বললো, ‘সবাইকে নমস্কার, সতুবাবু কে ? আমার নাম নিতাই কুণ্ডু, হালতুর সুকুমারের ভায়রা ।’

#

পাখিরালয়ের এই ঘরোয়া টাইপের প্রকৃতিবান্ধব টুরিস্ট লজটা এক রাত কাটানোর প্যাকেজ হিসেবে মধ্যমানের সাইট সিয়িং কোম্পানিগুলোর কাছে বেশ প্রিয়।

এর অনেকগুলো কারণ আছে ।

প্রধান কারণ হয়তো রাত্রিবাসের জন্য ঘরপিছু ভাড়া, যা অধিকাংশ মধ্যবিত্ত ভ্রমণপিপাসু বাঙ্গালীর নাগালের মধ্যে ।

টুরিস্ট কোম্পানি তো পার্টির সাইজ অনুযায়ী একসঙ্গে দশ বারোটা পর্যন্ত ঘর নিয়ে নেয়, সুতরাং তাদের জন্য থাকে আলাদা ডিসকাউনট।

নদীবাঁধের ওপরের চওড়া রাস্তা থেকে মাত্র পঞ্চাশ ষাট গজের মতো দূরে প্রকৃতিবান্ধব লজের দোতলা লম্বা স্কুলবাড়ির প্যাটার্নে তৈরি বিল্ডিঙ ।

তার সারিবাঁধা জানলাগুলো খুলেছে নদীর মুখ চেয়ে ।

বিস্তীর্ণ নদীর ওপারে সুন্দরী, গরান, হেঁতাল গাছের গহীন জঙ্গলের মধ্যে সূর্যের আলো হারিয়ে গিয়েছে ।

নদীর জলের ভেতর থেকে ক্ষণে ক্ষণেই শুশুকের উঁকি আর জলের ওপরে উড়ন্ত নানান প্রজাতির বক, মাছরাঙ্গা আর নাম-না-জানা পাখির দল ।

বাঁধের ধারে ধারে বুনো ফুলের ঘনঝোপের ওপরে নানা রঙের প্রজাপতি আর মৌমাছির ক্লান্তিহীন ওড়াউড়ি ।

প্রকৃতির এই অসাধারণ রূপ দেখার জন্য দোতলার জানলার পাশে চেয়ার টেনে বসে যাও, যেটুকু সময় প্রকৃতিবান্ধব লজে কাটবে তোমার মনে হবে সার্থক সময় কেটেছে ।

বৈচিত্র্য না থাকলেও খাওয়া দাওয়া বেশ ভালো, ঘরোয়া রান্না, সুন্দরবনের মহার্ঘ বস্তু পেয় জলের অভাবও বিশেষ নেই ।

লজের একতলায় ছোট্ট ষ্টেশনারী দোকানটা পর্যটকদের বিসলারি জলের বোতল আর শেষমুহূর্তে ভুলে-যাওয়া জিনিস সরবরাহ করতে হামেহাল হাজির রয়েছে ।

একরাতের জঙ্গলভ্রমণে এর থেকে বেশী স্বাচ্ছন্দ্য এদেশে কেউ আশা করে না ।

ফলে বর্ষার কয়েক মাসের অফ সিজন বাদ দিলে বছরের বাকি সময়টাতে প্রকৃতিবান্ধব লজের ছোট ছোট ডবল বেডের কামরাগুলো প্রায় ভর্তিই থাকে ।

যারা অপেক্ষাকৃত ভাগ্যবান তারা নদীমুখো দোতলার ঘরগুলোতে আসর জমায় ।

লজের সামনের জমিতে বাগান, শুকিয়ে যাওয়া একটা ফোয়ারা আর একটা বড়ো দোচালা টিনের শেড । বাঁশের বাঁখারি ওপরে মাটির প্রলেপ দিয়ে তৈরি তার দেওয়াল ।

সেই চালার ভেতরে সিমেন্টের ঢালাই-করা মাঝারি সাইজের সারিবাঁধা অনেক টেবিলের সামনে রাখা গোটা ষাটেক রংবেরঙের প্লাস্টিকের চেয়ার।

এটাই হচ্ছে প্রকৃতিবান্ধব লজের ডাইনিং হল কাম সান্ধ্য অনুষ্ঠানের অডিটোরিয়াম ।

নিতাই কুণ্ডুর সৌজন্যে এখানেই আজ সন্ধ্যেয় দুর্গার কাননবন্ধু দল কোলকাতার পার্টির সামনে স্থানীয় লোকসংস্কৃতির এক নমুনা পেশ করবে ।

নৌকোভাড়ার চারশো টাকা, আলাদা দেড় হাজার টাকা আর দলের রাতের খাওয়া কবুল করে নিতাই কুণ্ডু এক ঘণ্টা প্রোগ্রামের ‘কনট্যাক’ করেছে দুর্গার সঙ্গে ।

দুর্গার ঠিক পেছনে পেছনে লতা হাঁটছে, সাবধানে পা ফেলে ফেলে ।

আঠালো মাটিতে পায়ের চটি আটকে চলার গতি মন্থর হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সে চটি যে হাতে তুলে নেবে তার জো নেই ।

দুর্গার কড়া নির্দেশ, খেপের দিন, আসর শেষ হওয়ার আগে মেয়েদের কেউ খালিপায়ে হাঁটবে না, সে গাঁয়ের রাস্তায় বা যেখানেই হোক, আসরে যাওয়ার সময় তো একেবারেই নয় ।

কাননবন্ধুর অবিসংবাদী লিডার বিনা কারণে শুধু শুধু এই নির্দেশ জারি করেনি ।

এই তো মাস তিনেক আগে এইরকম একটা আসরে যাবার জন্য সন্ধ্যের সময় সকলে মিলে চলছে হনহন করে ।

ভাঁটার পরে নিচের মাটি শক্ত ছিল, তবু জলেভেজা প্যাচপেচে চরে চলার সুবিধা করার জন্য পায়ের চটি ছিল সবার হাতে ।

দেখ না দেখ দলের মধ্যে বয়েসে সব থেকে ছোট সদস্য মিনতির পা কেটে গেলো শামুকের খোলার টুকরোয় ।

সে অঘটনে দুর্গার ওড়নার কাপড় ছিঁড়ে বাঁধা হল পট্টি, ভ্যানরিকশায় বাড়তি খরচ হল তিনশো আর নাচের দলে একজন কম দেখে নিতাই কুণ্ডু কেটে নিলো ‘কনট্যাক’-এর দুশো টাকা ।

আর মিনতির বাড়িতে এমন সোরগোল উঠলো যে ওর বাবা মা তো পারলে কাননবন্ধুর দল থেকেই মিনতির নাম কাটিয়ে দ্যায়।

সে যাত্রায় দুর্গার অনুরোধে মিহিরদা এসে তাদের বোঝাতে তবে সবকিছু রক্ষা পায়, কাননবন্ধুর সদস্য সংখ্যা শেষ পর্যন্ত অটুট থেকে গেলো।

সেই থেকে দুর্গার এই নিয়ম, খেপের দিন পায়ের চটি কোনসময়ই হাতে উঠবে না ।

এ নিয়মে সুবলদার ছাড়, কারণ দুর্গার অকাট্য বক্তব্য ঢোল দাঁড়িয়ে বা বসেও বাজাতে পারা যায়, হাতদুটো বাঁচিয়ে রাখতে পারলেই হলো ।

দুর্গার পেছন পেছন চলতে চলতে লতা এইসব কথা ভাবছিলো…দুর্গাদিদি সত্যিই দুহাত বেড় দিয়ে এই ছোট্ট দলটাকে সবরকম ঝড়ঝাপটা থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে ।

দুবছর আগে যখন মিহিরদা ঝড়খালির দিঘিরপুরের শ্বশুরঘর থেকে তাকে নিয়ে এসেছিলো দুর্গার কাছে, সজনেখালিতে ওর থাকার একটা ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য, তখন এক কথায় দুর্গা বলে দিলো যতদিন কোনও ব্যবস্থা না হয় ততদিন লতা তার সঙ্গেই থাকবে ।

দুটো বছর ঘুরে গেছে, আলাদা থাকার সে ব্যবস্থা আজও হয়নি ।

কারণ দুর্গার কোনও উদ্যোগ নেই সে ব্যাপারে ।

উপরন্তু লতা এখন কাননবন্ধু নাচগানের দলের একজন অপরিহার্য সদস্য ।

তার সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের উন্মেষ তথা বিকাশ হলো দুর্গার নিরন্তর ট্রেনিং-এ ।

আর বন্ধু-র লোকজন তাকে শিখিয়ে দিয়েছে কি করে এক ঘণ্টায় একশর বেশী ধুপকাঠি তৈরি করে প্যাকেটবন্দী করে ফেলা যায় ।

দুবছরের মধ্যে লতা হয়ে উঠলো একজন স্বনির্ভর মহিলা যে কিনা খাইখরচ আর ঘরভাড়া বাবদ প্রতিমাসে জোর করে কিছু টাকা দুর্গার হাতে গুঁজে দ্যায় ।

#

সুন্দরবনের চলতি কথায় লতা একজন বাঘবিধবা, ঝড়খালির এক প্রত্যন্ত বাঘবিধবা গ্রামের বাসিন্দা, যে গ্রামের বেশীর ভাগ পুরুষ জীবনধারণের তাড়নায় জঙ্গলে গিয়ে বাঘের আক্রমণে প্রাণ দিয়েছে ।

ঝড়খালির দিঘিরপুর গ্রামের অনন্ত মউলে-র সঙ্গে পাথরপ্রতিমার রামগঙ্গা গ্রামের আঠারো বছরের সুশ্রী চেহারার লতা-র যখন বিয়ে হলো বছর চারেক আগে, তখন তাদের ঘরের উঠোন সেজেছিল রঙ্গিন কাগজের শিকলির বাহারে আর বাজনাও বেজেছিল খুব।

ঝাঁকড়া চুল আর শ্যামলা রঙের পেটানো চেহারার পাত্রকে দেখে গাঁয়ের লোকজন বলেছিল লতার ভাগ্য ভালো, বর যেন এক্কেরে মিঠুন চক্কোত্তি ।

একটা মাঝারি সাইজের খাসী কেটে গ্রামশুদ্ধ ভোজ আর প্রথামত নদীর ঘাট অবধি একটা ছোটখাটো ঢোল কাঁসির মিছিল করে গাঁয়ের লোকজন তাকে বিদায় করেছিল ।

লতার বর অনন্ত মউলে লতাকে ভাল বেসেছিল খুব ।

বাড়িতে সে যতক্ষণ থাকতো লতাকে চোখে হারাতো ।

বিধবা মায়ের চোখ এড়িয়ে সময় অসময়ে ঘরের মধ্যে টেনে নিয়ে যেতো, নতুন বউ লতার তখন খুব লজ্জা করতো ।

অনন্ত লজ্জাহীন, মিটমিট করে হেসে বলতো,

-‘নজ্জা কইরবো কেনে রে ? সুহাগ করার জন্যি অন্যের বিয়া-করা মেয়িছেলে লয়ে তো ঘরে আগল দিই না । তুই হলি গিয়া আমার নিজির মাগ, দুদিন পরি আমার ব্যাটার মা হবি তো!’

উত্তরে লতা কিছু বলতে গেলে অনন্ত নিজের পুরুষ্টু ঠোঁটজোড়া লতার ঠোঁটের ওপর চেপে ধরতো, ভেসে যাওয়া ছাড়া সদ্যযৌবনা লতার তখন আর কোনও উপায় থাকত না ।

‘কিন্তুক সুন্দরবনির শিউলি-মউলে মরদগুলার ঘরির অ্যামুন নিশ্চিন্ত আশ্রয়ি থেকি সদ্য বিয়ে-করা মাগের সঙ্গি অ্যামুন টায়িম কাটাইলে চইলবে কি!’

পেটের জ্বালায় তাদের সুন্দরবনের নিবিড় জঙ্গলের ডাঙ্গায় ডাঙ্গায় প্রতি মুহূর্তে প্রাণ হাতে করে ঘুরে বেঁচে থাকার রসদ সংগ্রহ করতে হয় ।

সারা বছর জঙ্গলে কাঠের সন্ধান, আর বছরে দুবার বোশেখ জষ্টি আর আশ্বিন মাসে মধুর খোঁজ ।

#

হারান গুণিনের দলের মউলে ছিল অনন্ত, জঙ্গলে কাঠ কাটতো আর চাক কেটে মধু মোম আনতো।

সুন্দরবনের শয়ে শয়ে প্রান্তিক জঙ্গুলে গ্রামের মধ্যে হাতে-গোণা কয়েকজন নামী বাউলে বা গুণিনের মধ্যে হারান একজন ।

জট বেঁধে যাওয়া বাবরি চুল আর দাড়ির মধ্যে তার সিঁদুর টিপ-পরা এবড়ো খেবড়ো মুখ আর জ্বলজ্বলে দুটো চোখ দেখলে মনের মধ্যে ভয় আর ভক্তি দুই-ই জেগে ওঠে ।

হারান গুণিনের খোলা বুকে আবার একটা গভীর ক্ষতের দাগ, বহু বছর আগে সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল বাঘের থাবা পড়েছিল তার বুকে।

সেবার লোকের মুখে মুখে আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল হারান গুণিনের খিলেন মন্ত্রের জোরে নাকি দক্ষিণ রায়ের মুখে খিল পড়ে গিয়েছিলো, সে মুখ আর হাঁ করতে পারেনি ।

তাই সে যাত্রায় বাঘের সামনাসামনি পড়েও হারান গুণিনের ঘাড় কামড়ে ধরতে পারেনি বড়োমিয়াঁ।

শতাংশের একের ভাগ্যে তার প্রাণটা বেঁচে যায় ।

বুকে থাবা বসিয়ে হারানের সঙ্গীদের টাঙ্গির ঘা খেয়ে আহত রয়েল বেঙ্গল বাঘ আবার জঙ্গলে ঢুকে পড়েছিল ।

সেই থেকে ঝড়খালি অঞ্চলে হারান গুণিনের বড়ো নামডাক ।

কালে সে নিজেই মউলে আর কাঠুরের দল তৈরি করেছে ।

সরকারের কাছে জঙ্গলের কাঠ আর মধুর ‘লাইসেন’ নিয়ে মাসের মধ্যে দিন পনেরো গভীর জঙ্গলের মধ্যে পায়ে হেঁটে আর কুমীর কামট ভরা নদীর বুকে দাঁড় বেয়ে কেটে যায় হারানের দলের সদস্যদের।

রোজগার যেমনই হোক তার জন্য পদে পদে বিপদ অনেক ।

এই বিখ্যাত হারান বাউলের দলে ছিল অনন্ত ।

ডাকাবুকো তাগড়া চেহারার জোয়ান মানুষটার ভয়ডর ছিল কম ।

জঙ্গলের কাঠ আর মধুর চাক কাটার কাজ শুরু করার সময় লাইনের সামনে আর শেষ করার সময় পেছনে ছিল তার স্থান ।

চার বছর আগের জষ্টি মাসের সেই ঝকঝকে সকালে প্রথামত দক্ষিণ রায়, বনবিবি আর পীর বদরের পুজো সেরে ঝড়খালির ঘাট থেকে রওনা দিয়েছিল হারান বাউলের দলটা ।

বড়ো নৌকো নদীর তীরের কাছ বরাবর রেখে ছোট ডিঙ্গি নৌকো নিয়ে খাঁড়ির ভেতরে ঢুকে অগভীর নেমেছিল আট জন, কু ডেকে খাঁড়িতে জঙ্গলের দলকে অনুসরণ করার জন্য ডিঙ্গি নৌকোয় ছিল একজন ।

জলে নামার আগে গুণিনের খিলান মন্ত্র পড়ে, মাথার পেছনে মানুষের মুখের মুখোশ লাগিয়ে, জঙ্গলের মধ্যে আধঘণ্টাটাক হেঁটে এক জায়গায়ই গরান আর সুঁদরি গাছের  ঘের দেওয়া কয়েকটা বড়সড় চাক পেয়ে গেলো অনন্তর দল ।

হেঁতালের পাতা জ্বালিয়ে ধোঁয়া দিয়ে মৌমাছি তাড়ান হোল ।

তারপর বনবিবিকে স্মরণ করে কাস্তে হাতে গামছা দিয়ে মুখ শরীর ঢেকে গাছে উঠে গিয়েছিলো অনন্ত ।

তিনটে গাছ থেকে কয়েকটা চাক কেটে নামিয়ে ডিঙ্গি নৌকায় ফিরে আসার সময় খাঁড়ির ধারের উঁচু জমি থেকে বাঘ লাফিয়ে পড়লো লাইনের শেষে থাকা অনন্তের ওপর ।

সেই মুহূর্তেও সাহস না হারিয়ে হাতের ধারালো কাস্তটা  অনন্ত সজোরে বসিয়ে দেয় বাঘের ঘাড়ে ।

যে হাতে কাস্তে চালিয়েছিল সে, কাঁধ থেকে অনন্তর সেই ডান হাত চলে গেলো বাঘের মুখে ।

হারানের বিখ্যাত খিলান মন্ত্র বড়মিয়াঁর ওপরে যে কোনও কাজ করতে পারেনি সেটার প্রমাণ পাওয়া গেলো হাতেনাতে ।

সঙ্গীদের তারস্বরে চিৎকার আর টাঙ্গি বর্শার আঘাতে ব্যতিব্যস্ত বাঘ মুখে অনন্তের ডান হাত আর ঘাড়ে বিঁধে থাকা কাস্তে নিয়ে সেবারের মতো জঙ্গলে ঢুকে যায় ।

বাহুমূলে জড়ানো রক্তে ভেজা গামছার ঢের আর জ্ঞানহীন অনন্তকে নিয়ে চার দাঁড়ের নৌকো শন শন বেগে যখন ঝড়খালির খাটে পৌঁছলো তখন অনন্ত আর সাড়া দিচ্ছে না ।

অজস্র রক্তক্ষরণে ততক্ষণে নৌকোর গলুই ভাসছে, অনন্তের শ্বাস ক্ষীণ হয়ে এসেছে, চোখ বন্ধ।

সেই চোখ আর তার খুললো না  ।

স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার পর অনন্তকে মৃত ঘোষণা করে আধিকারিক প্রথামত তার নামঠিকানা তুলে নিলো সরকারি খাতায় ।

#

তিন মাসের বিবাহিত অনন্ত মউলি এভাবেই পরিসংখ্যানের একটা অংশ হয়ে রয়ে গেলো গভর্নমেন্টের মাসিক বাঘমারি রিপোর্টে ।

সাদা চাদরে ঢাকা অনন্তের শরীর যখন এসে পৌঁছলো তার বাড়ির উঠোনে, ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠে লতার শ্বাশুড়ি-মা যখন ছেলের দেহের পাশে আছাড়ি পিছাড়ি খাচ্ছে, ঘিরে থাকা পাড়া প্রতিবেশীর হা-হুতাশের মধ্যেও সদ্য বিবাহিত লতা তখনও বুঝে উঠতে পারেনি তার জীবনে কি বিপর্যয় নেমে এলো ।

বিস্তীর্ণ সুন্দরবনের যে অঞ্চলে সে বেড়ে উঠছে, ব-দ্বীপের কৃষি ও হস্তশিল্প প্রধান সেই অঞ্চলে এই রকম বাঘমারি দুর্ঘটনা বা প্রাণহানির সঙ্গে তার বিশেষ পরিচয় নেই ।

অনন্তের মুখে সদ্য সদ্য শুনেছিল সে গহীন বিপদসংকুল জঙ্গলের কিছু রোমহর্ষক কাহিনী ।

নতুন বউয়ের কাছে জাহির করা সে সব গল্পের কেন্দ্রে ছিল তার অকুতোভয় স্বামী ।

সেই স্বামীর নিথর মৃতদেহের সামনে মূক স্তব্ধ চিন্তারহিত হয়ে শুষ্ক শূন্যদৃষ্টিতে লতা কতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো সবার মাঝে, সমবেত সহানুভূতি আর কান্নার রোল কিছুই বোধহয় তার কানে পৌঁছলো না।

কখন যে সকলে কাঁধে করে অনন্তের শবদেহ নিয়ে চলে গেলো তাও সে খেয়াল করলো না ।

এর মধ্যে কোন একজন তার নিস্পন্দ দেহটাকে ধরে ধরে দাওয়ায় বসিয়ে দিয়েছে ।

লতার সম্বিত ফিরলো যখন এক প্রতিবেশিনী দাওয়া থেকে একটা পাথরের টুকরো তুলে এনে তার হাতের সস্তা শাঁখাদুটো ঠুকে ঠুকে ভেঙ্গে দিলো ।

আর একজন এসে লতার মাথায়, সিঁথিতে, এক ঘটি জল ঢেলে দিলো ।

কপালের দুপাশ দিয়ে দুগালের ওপর নেমে এলো মেটে সিঁদুর ধোয়া জলের ধারা ।

সে জলের ধারায় লেখা হয়ে গেলো বাঘবিধবা গ্রামের এক নতুন সদস্যের নাম ।

বাঁধে ওঠার পাকদণ্ডী পথটা পেরিয়ে লতা এগিয়ে যেতেই পিছন থেকে বীণা হেঁকে বললো,

-‘হেই রে লতু,  কোতায় যাস, দুগগা তো বাঁধে উইঠে গেলো রে ! মনটা কনে আছে তোর ?’

লতা দাঁড়িয়ে গেলো । সন্তর্পণে চোখের জলটা মুছে পিছন ফিরে বললো,

-‘খেয়াল করি নাই গ বীণাবৌদি, এইতো আসতেছি।’

লতা তাড়াতাড়ি পিছিয়ে এসে বীণার পিছন পিছন পাকদণ্ডী রাস্তায় উঠে পড়লো…‘পুরানো কাহন ভাইবতে নাই রে লতু, কক্ষুণো ভাইবিস না বোন, ওতে মন বড়ো উচাটন হয়’…দুর্গাদিদি পইপই করে বারণ করেছে ।

লতা আর একবার ওড়নার প্রান্ত দিয়ে মুখচোখটা ভালো করে মুছে নিলো ।

বীণা বয়সে একটু বড়ো, তাই দুর্গা বাদে বাকি সকলে তাকে বৌদি ডাকে ।

বীণার স্বামী গগন কাহার হচ্ছে বাঁধালি গগন।

সারা বছর ধরে জঙ্গলের খাঁড়ি, খাল আর নালার মুখে বাঁশের চটা আর নাইলনের জাল দিয়ে বাঁধ বেঁধে গগন বাঁধালি মাছ ধরতে থাকে ।

মাছের শুঁটকি করার জন্য নিজের ঘরের সামনে দুটো ‘খটি’ লাগিয়েছে সে, নিজের তৈরি বাঁধ পাহারা দেবার জন্য বানিয়েছে ‘কুজিঘর’ ।

সারা বছর রোজগার ভালোই থাকে সুন্দরবনের মাছের কারবারিদের ।

সে হিসেবে গগন বাঁধালির বাবা মা ছেলে মেয়ে আর বউ নিয়ে খুব স্বচ্ছল গেরস্তি না হলেও অভাবের সংসার নয় ।

বাপ দাদার শেখানো পথ ধরে সময় পেলে গগনের ঢোল বাজানোর শখও আছে ।

বীণা আর দুর্গা একই বত্রিশ নম্বর লাটের মেয়ে, ছোটবেলা থেকে বীণাদিদির সঙ্গে দুর্গার জানাশোনা।

ছোট্ট বয়েস থেকে বীণা ‘বায়োস্কোপ’-এর গান হুবহু নকল করে তাক লাগিয়ে দিতো সকলকে ।

কিশোরী বয়সেই লাটের মধ্যে ছোটখাটো সেলিব্রিটী হয়ে উঠেছিলো সে ।

বিয়ের আর অন্যান্য অনুষ্ঠানে বীণাকে বাদ দিয়ে গানের আসর জমতই না ।

আর সেইসব আসরে বীণার গানের সাথে দুর্গা থাকতো তার নিজের নাচের ছোট্ট দল নিয়ে ।

বীণার এই অশিক্ষিত পটুত্বের প্রকাশ ও প্রচার পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেলো সজনেখালির গগন বাঁধালির সঙ্গে বিয়ের পর ।

বীণার বাপের ঘর তার গায়ন ক্ষমতা ব্যাখ্যান না করাতে গগনের পরিবার জানতে পারেনি তাদের ঘরের বউয়ের এমন প্রতিভার কথা ।

তাই মাসের পর মাস এক কলিও গান না গেয়ে বীণা, বিশাল সাইজের এলুমিনিয়াম হাঁড়ির ঢেরে, নালা খালের মুখে  ‘ঘুনি’ বসিয়ে সদ্য ধরে আনা ছোটো মাছের জাত আলাদা করার কাজে ব্যস্ত হয়ে রইলো ।

কোনো অবসরে গগনের ঢোলটা যদি বা বেজে উঠতো, তার মনের মধ্যে উথালপাতাল করতো, গলায় গান এসে যেতো, কিন্তু মুখে কুলুপ দিয়ে রাখতো বীণা, কোন আওয়াজ বার করতো না ।

এসব বছর দুই আগেকার কথা, যে সময়ের পর থেকে কাহার বাড়ির সাংস্কৃতিক চেহারাটা বদলে গেলো।

তার কয়েকমাস আগেই অবশ্য বীণার বাপের বাড়ি বত্রিশ লাটের কৈবর্ত পরিবারে একটা ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটেছে ।

সে বাড়ির ডানপিটে মেয়ে দুর্গা কোলকাতায় জীবন কাটাবার তীব্র নেশায় প্রতিবেশী দিদির ভাগনে ত্রিভুবনকে বিয়ে করবে বলে সর্বসমক্ষে ঘোষণা করে দিয়েছে ।

ত্রিভুবন নাকি দখিন কোলকাতার রাস্তায় অটোরিস্কা চালায়, তার বাসায় সাদাকালো টিভি আছে ।

বাসার উঠোনে কলের মুণ্ডি ঘোরালেই জল পড়ে ।

যখন তখন দুর্গাকে অটোতে বসিয়ে কোলকাতা শহর ঘুরিয়ে নাকি ঘুরিয়ে দেখাবে সে ।

তাই বাড়ির সব গুরুজনদের তীব্র অমতে ত্রিভুবনের সঙ্গে আড়ম্বরহীন গাঁটছড়া বেঁধে সে কোলকাতায় পাড়ি দিয়ে দিলো ।

দুর্গার বিয়ের জন্য কোনও আসর বসেনি, তাই বন্ধুর বিয়েতে বীণার গান গাওয়াও হয়নি ।

আর তার পরে দিন কয়েকের যোগাযোগে সজনেখালির গগন কাহারের সঙ্গে বীণারও বিয়ে হয়ে গেলো।

হঠাৎ করে বত্রিশ নম্বর লাট কেমন যেন শান্ত আর শব্দহীন নিস্তরঙ্গ হয়ে গেলো ।

#

তবে জীবন তার ঘটনাবলী তো সাধারণ নিয়ম মেনে সাজায় না, নিয়ম মানার দায়ও নেই তার ।

সে যেরকম নিজে অনিশ্চিত অনির্দেশ্য, সেরকমই তার আধার ।

তাই একমাস কাটতে না কাটতেই দুর্গা তার স্বামীর ঘর আর স্বপ্নের কোলকাতা শহর থেকে লাট বত্রিশে স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করলো ।

তার চোয়াল এখন আগের থেকে আরও শক্ত, মনের ভাবের প্রতিফলন তার মুখের সর্বত্র ।

মিহির ভটচাযের মানুষ চিনতে ভুল হয় না ।

দুর্গার লড়াই করার স্বাভাবিক ক্ষমতা বুঝতে তার দেরি হয়নি ।

সুন্দরবনের নরম মাটির মেয়েদের চালনা করতে এমন একজনের প্রয়োজন সে বহুদিন ধরেই অনুভব করছিলো।

দুর্গাকে বেশী বোঝাবার দরকার হয়নি মিহিরের।

লাটের জীবন, বাপমায়ের ওপর নির্ভর বর্ণহীন দিনগত পাপক্ষয়, দুর্গার তেজী বেপরোয়া মানসিকতার সঙ্গে একেবারেই খাপ খায় না ।

তাই প্রথম সুযোগেই, বাড়ি ফিরে আসার কয়েক মাসের মধ্যেই সে দ্বিতীয় বার বাপমায়ের অমতে ঘরের নিশ্চিন্ত আশ্রয় ছেড়ে মিহিরদার পেছন পেছন সজনেখালিতে ‘বন্ধু এনজো’-র দরবারে পৌঁছে গেলো।

সেখানে তখন তার বত্রিশ লাটের বীণাদিদি সদ্য সদ্য পাঁপড় তৈরিতে হাত পাকাচ্ছে ।

গগন কাহারের শহুরে ভাবগতিকের জন্য মিহির ভটচাজকে বেশী খাটতে হয়নি বীণাকে বন্ধু-তে সামিল করতে ।

বীণাকে দেখেই দুর্গার মনে পড়ে গেলো তাদের কয়েকমাস পুরনো বিনোদন-ভরা দিনগুলোর কথা, আর মনে হলো নাচগানের একটা দল করলে কেমন হয় ।

সুন্দরবনের পর্যটকেরা দীর্ঘ সন্ধ্যেরাত কাটাবার জন্য এপর্যন্ত একটিমাত্র ‘জলপথ’ অবলম্বন করে ছিল ।

সেখানেও আবগারি জলপুলিশের আলটপকা রেড ।

হোটেল আর গেস্টহাউসের মালিকদের সদাসন্ত্রস্ত ভাব ।

বীণাকে নিয়ে দুর্গার গানের দল তৈরির প্রস্তাব শুনে গগন কাহার প্রথমে যারপরনাই অবাক হলো ।

বিয়ে হয়ে যাওয়া ইস্তক কোনদিন সে বীণার গলায় এক লাইন গান শোনেনি, অবাক তো হবেই ।

দুর্গা তাকে বারবার অনুরোধ করাতে এক বিকালে বাড়ির উঠোনে পরিবারের সকলকে নিয়ে সে শুনলো বীণার গলায় চলতি হিন্দি সিনেমার গান ।

শুনলো আর হতবাক হয়ে গেলো ।

শুধু সে নয়, পরিবারের অন্য সদস্যরাও তার সুরেলা গান শুনে একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেলো ।

আদতে কাহার জাতে গানবাজনার চল আছে ।

সুন্দরবনে বিয়ে, পার্বণে, উৎসবে ঢোল কাঁসি নাকাড়া-র ব্যান্ডে একসময় তাদের একচেটিয়া রাজত্ব ছিল ।

গগন নিজেও অবসরকালে ঢোলে চাঁটি মারার অভ্যেসটা বজায় রেখেছে ।

তাই বীণার শ্বশুর আর গগনের অনুমতি আদায় করতে দুর্গার আর কোন বেগ পেতে হয়নি ।

ওদিকে সব কিছু জেনে চমৎকৃত মিহির শুধু সবুজসঙ্কেতই নয়, ‘বন্ধু’-র একতলা বাড়ির কোণে একটা ছোটো ঘর দিয়ে দিলো দলের মহড়ার জন্য।

দলের নামও ঠিক করে দিলো ‘কাননবন্ধু’ ।

অধিকন্তু ব্যবস্থা করলো সুন্দরবন টুরিষ্ট কোম্পানি আর তাদের এজেন্টদের কাছে ‘কাননবন্ধু’র আবির্ভাববার্তা পৌঁছানোর ।

আজ, দুবছর পরে, ‘কাননবন্ধু’ নাচগানের দলের সদস্যসংখ্যা সুবল ঢালিকে নিয়ে ছয়, টুরিস্ট সিজনে হপ্তায় প্রায় প্রতি সন্ধ্যেয় প্রোগ্রাম, বীণা তাদের লীড সিঙ্গার আর নাচের ‘মোশনমাস্টার’ একমাদ্বিতীয়ম দুর্গা কৈবর্ত!

বিস্তীর্ণ নদীর একদিকে তীর থেকে কিছু দূরে লঞ্চটা ভাসছে।

এইদিকের তীরটায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু বসতির আভাস, চোখে পড়ে মানুষের ক্বচিৎ আনাগোনা ।

বিশাল নদীর ওপারে সুন্দরবনের অনাহত জঙ্গল, পটে আঁকা আবছা ছবির মতো, নিশ্চল, অনতিক্রম্য ।

একটা মাঝারি সাইজের ট্রলার ঢেউ কেটে কেটে চলে গেলো মাঝনদী দিয়ে ।

ঢেউয়ের ধাক্কায় লঞ্চ হালকা ভাবে দুপাশে দুলতে লাগলো, যেন তাকে একটা খেলায় পেয়েছে ।

নোঙ্গরের শেকল লঞ্চের হালের সঙ্গে ঠুকে গিয়ে হালকা আওয়াজ তুলতে লাগলো ।

পাশাপাশি, আগে পিছে অনেকগুলো টুরিস্ট লঞ্চ স্থির ভেসে রয়েছে ।

নদীর ওপর দিয়ে কয়েকটা পাখীর অক্লান্ত ওড়াউড়ি, পলকে পলকে তাদের উড়ানের দিক বদল, হঠাৎ হঠাৎ ভেসে আসছে তাদের তীক্ষ্ণ চিৎকার ।

বাকি সব নিঝুম, সময় থেমে থাকার মতো অলস নৈঃশব্দ্য ।

এই ঘন্টা দুয়েক বিরতির সময়, দুপুরের খাওয়া সেরে নেওয়া আর ইঞ্জিনের বিশ্রাম ।

কিছুক্ষণ আগে ভাত, পেঁয়াজ দেওয়া মসুর ডাল, বেগুনী, চিংড়ির ঝাল আর সরষে-পম্ফ্রেট দিয়ে লঞ্চের ডেকে পাতা চেয়ার টেবিলে লাঞ্চ সমাধা হয়েছে ।

সত্যব্রতর প্রশ্নের উত্তরে রাত্রে গেস্ট হাউসের ডিনারে চিকেন কারির ঘোষণা করে দিয়েছে নিতাই কুণ্ডু ।

ডেকের ওপরে পাতা চেয়ারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে সবাই, পড়ন্ত শীতের নরম রোদ উপভোগ চলছে ।

এর মধ্যে দীপুকাকার বোধহয় মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে দুপুরবেলায় খাওয়ার পর একটা ছোট ভাতঘুম তাঁর বরাবরের অভ্যেস ।

ব্যাস আর যায় কোথায়, সবাই মিলে ওঁকে নিয়ে পড়েছে ।

অর্জুন বলল,

-‘ওপরতলায় লঞ্চের সারেঙের গুমটিতে দেখলাম বেশ লম্বা একটা কাঠের সিন্দুকের মতো আছে । ওপরে একটা লম্বা গদি পাতা। দীপুকাকা, সারেঙকে বলি গদির ওপরে একটা চাদর পেতে দিতে? গদি যখন আছে তার চাদরও থাকবে ।’

-‘গরম ভাতের সঙ্গে এমন চিংড়ির ঝাল আর সরষে দিয়ে পম্ফ্রেট খাওয়ার পর কাকুর বয়সে চোখ জড়িয়ে আসা কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার নয় । তার ওপর…আচ্ছা কাকু, কটা গলদা চিংড়ি খেয়েছেন?’ সত্যব্রতর টিপ্পনী ।

কথার শেষদিকে সতু এমন নিরীহ ঠাণ্ডা গলায় আচমকা প্রশ্নটা করলো যে সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। ।

দূরের একটা টেবিলে মিক্স ডাবলসে টোয়েনটি নাইন খেলা চলছে, জিষ্ণু আর তার বড়ো দিদি পূবালী একদিকে, অন্যদিকে বৈশাখী আর অমিতাভ ।

হাসির আওয়াজে জিষ্ণু চোখ তুলে বললো,

-‘বোধ হয় চারটে, না কি পাঁচটা…তাই না দিপুকা?’

আবার একচোট হাসির ফোয়ারা ।

অর্জুন বলল, ‘পাঁচটা খেলে তো ঘুম পাবেই জিষ্ণুদা!’

দিপুকাকা অপ্রতিভ না হয়ে হেসে বললেন,

-‘যাহ্‌, দুটো খেয়েছি । তবে তোমরা যা-ই বলো না কেন, এখানে তোমাদের মধ্যে একমাত্র সতুই  আমাকে আমার কমবয়েস থেকে দেখছে । জানিনা ও আমাকে কখনো খেতে দেখেছে কি না, তবে সেই সব বয়সে দশ-বারোটা গলদা তো যখন তখন খেতাম । এই তো বছর দশেক আগে এই সুনীতার বিয়েতে চিংড়ির মালাইকারি ছিল, সাত-আটটা তো নিশ্চয়ই খেয়েছিলাম । শোন, আমরা হচ্ছি শ্যামপুকুর স্ট্রীটের ঘটি, তালপুকুরের বাঙ্গাল নই যে ‘আমাগো গাছভরা ইলিশ আর পুকুরভরা ধান আছিল’ ! চিরকালের মোহনবাগান আমরা, চিংড়ি আমাদের শিরায় শিরায় !

অর্জুন আর জিষ্ণু হই হই করে চেঁচিয়ে উঠলো, ‘হিয়ার হিয়ার!’

সবাই হাসতে লাগলো ।

সতু বলে উঠলো, ‘দিপুকাকার জবাব নেই! একেই বলে ওস্তাদের মার শেষ রাত্রে! কি রকম দিলো বলো দিকি…দিপুকাকা হচ্ছে আমাদের একেবারে সুনীল গাঙ্গুলীর কাকাবাবু…এক ঢিলে কতোগুলো…’

এমন সময় বিকট ভটভট আওয়াজ করে লঞ্চের ইঞ্জিন চালু হয়ে গেলো…সতুর কথার শেষ অংশটা আর শোনা গেলো না ।

লঞ্চ তার নোঙ্গর তুলে মাঝনদী পেরিয়ে ধীরে ধীরে ওপারের তীরের দিকে সরে যেতে লাগলো ।

ভাঁটার জোরাল টান সুরু হয়ে যাওয়াতে তার গলুইয়ের অভিমুখ তেরছা হয়ে আছে ।

আর একটা ট্রলার, বেশ বড়ো এটা, বড়ো বড়ো ঢেউ তুলে, চিমনির ঘন ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে কোলকাতার দিকে চলে গেলো ।

সুনীতা একটু উত্তেজিত গলায় বলে উঠলো, ‘ওই দ্যাখো, বাংলাদেশের জাহাজ!’

সকলে সেদিকে ফিরে তাকাল, ট্রলারের পেছনে আর সারেঙের কেবিনের ওপরে ঘন সবুজের মধ্যে লাল গোলার মতো ছাপ দেওয়া ফ্ল্যাগ পতপত করে উড়ছে ।

জিষ্ণু উদ্ভাসিত মুখে বললো, ‘ইলিশ আসছে, কোলকাতার বাজারে পদ্মার ইলিশ!’

সত্যব্রত বললো, ‘আমি তো জানি বাংলাদেশের বেশীর ভাগ ইলিশের সাপ্লাই খুলনা যশোর রোড দিয়ে কোলকাতায় ঢোকে ।’

দিপুকাকা মজার গলায় বললেন,

-‘কোন পথে ইলিশ আইল সে প্যাচালে তোমাগো কি কাম কও তো! পাতে পদ্মার ইলিশ পড়লেই তো ব্যাবাক মজা হইবো…না কি ?’

সবাই হেসে উঠলো । অমিতাভ বলে উঠলো,

-‘দিপুকাকা একেবারে ফুলফরমে আছেন!’

জিষ্ণু বললো, ‘এসব ওই নিতাই কুণ্ডুর গলদা চিংড়ির এফেক্ট ।’

সবাই জোরে হেসে উঠলো, দিপুকাকাও ।

ওপারের নিস্তব্ধ জঙ্গল ক্রমশই চোখে পরিষ্কার হয়ে আসছে, বিকালের রোদ ঘন জঙ্গলের মাথায় মাথায় ।

নীচে চরের আঠালো মাটিতে খুঁটির পর খুঁটি পুঁতে নদীর তীর ধরে দুমানুষের বেশী উঁচু নাইলনের জাল লাগানো রয়েছে, খাঁড়ির মুখটা বাদ দিয়ে ।

তীরে কয়েকটা শীর্ণ বাঁদর আর বক ছাড়া কিছু চোখে পড়ছে না ।

দুটো দলই জলের ধারের মাটি থেকে খুঁটে খুঁটে খেতে ব্যস্ত ।

টোয়েনটি নাইন খেলা শেষ, পুরো দলটা এখন চেয়ার ছেড়ে রেলিংয়ের ধারে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে ।

অর্জুন খুব মনোযোগ দিয়ে বাইনোকুলার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে জঙ্গলের ভেতরে দেখার চেষ্টা করছে ।

বৈশাখী কৌতুহলী স্বরে জিজ্ঞাসা করলো,

-‘বাঁদরগুলো কি রোগা দেখেছো? চরেতে ঘুরে ঘুরে কি খাচ্ছে বলতো খুঁটে খুঁটে ? ওখানে তো কোন গাছ নেই যে ফল পড়ে থাকবে!’

অর্জুন চরের দিকে বাইনোকুলার নামিয়ে আনলো । তারপর চোখ না সরিয়ে বললো,

-‘কাঁকড়া, কাঁকড়া খাচ্ছে । সুন্দরবনে সবাই নন-ভেজিটেরিয়ান, বুঝলে?’

তারপর বৈশাখীর দিকে ফিরে বললো,

-‘এই ছোট্ট ছোট্ট কাঁকড়াগুলোকে চিতি কাঁকড়া বলে । এগুলো খেতে খুব টেস্টি ।’

-‘আহা, বেচারি ! ফল না পেয়ে কাঁকড়া খাচ্ছে !’ পলার সংক্ষিপ্ত মন্তব্য ।

অর্জুন মুখ তুলে ওদের দিকে একবার তাকিয়ে আবার বাইনোকুলারের আইপিসে চোখ সেঁটে দিলো ।

অমিতাভ একটু দূর থেকে হেঁকে বললো,

-‘অর্জুন, তুমি বাইনোকুলারটা ওই মাটির দিকেই তাক করে রাখো । যদি অন্ততঃ বাঘের পায়ের ছাপ দেখতে পাও । লঞ্চ থেকে নদীর তীরের জঙ্গলে বাঘকে ঘুরতে কেউ দেখতে পেয়েছে বলে শুনিনি । তবে তুমি ক্যানিংএ পোস্টেড ছিলে এটা জানতে পেরে যদি বড়োমিয়াঁ নিজে চরে এসে দেখা দেন সে আলাদা কথা ।’

কয়েকজন অস্ফুটে হেসে উঠলো ।

অর্জুন বাইনোকুলারে চোখ রেখেই বললো,

-‘দাদা, সুন্দরবনে চলমান বাঘ দেখতে পাওয়া একটা স্ট্যাটিস্টিক্যাল প্রবেবিলিটি । অ্যানড ম্যাথামেটিক্যালি দ্যাট ইজ নেভার জিরো । আমি তো ডাঙ্গায় দেখছি । আপনারা জলের দিকেও খেয়াল রাখুন । বাঘ সাঁতরে নদী পেরিয়ে যাচ্ছে তা-ও তো দেখেছে লোকেরা ।’

-‘যাহ্‌, বাঘ এই এতো বিশাল নদীতে সাঁতার কাটতে পারবে না কি !’’ সচকিত পুবালীদির সন্দিগ্ধ প্রশ্ন ।

পুবালীদির সঙ্গে আসা দুই সিনিয়র সিটিজেন ব্যানারজি আর কর দম্পতি এতক্ষণ চুপচাপ রেলিঙয়ের ধারে দাঁড়িয়ে জলযাত্রা উপভোগ করছিলেন ।

মিস্টার ব্যানারজি এবার বলে উঠলেন, ‘খুব পারে! সুন্দরবনের রয়াল বেঙ্গল টাইগার দক্ষ সাঁতারু । বিদ্যা নদীর মতো চওড়া নদীতে সাঁতার কেটে এসে কাঠুরে মউলেদের নৌকো থেকে প্রমাণ সাইজের মানুষের ঘাড় কামড়ে তুলে নিয়ে আবার সাঁতার কেটে জঙ্গলে ফিরে গেছে, এমনও হয়েছে, বুঝেছো পূবালী! তবে সেরকম ঘটনা বেশীর ভাগ রাতেই ঘটেছে ।’

পূবালীদি বিস্ফারিত চোখে একবার সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে নিয়ে তারপর একনজর লঞ্চের রেলিঙের দিকে দেখলেন । বোধহয় মনে মনে রেলিঙয়ের উচ্চতার হিসেব করলেন ।

সত্যব্রত পূবালীদিকে লক্ষ্য করছিলো । হেসে উঠে বললো,

-‘দিদি, মাভৈ! রাতে আমরা পাখিরালয়ের গেস্ট হাউসে থাকবো । গত একশ বছরে ওই জায়গায় বাঘ আসার কোন হিস্ট্রি নেই ।’

ভাঁটার স্রোতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঘুট ঘুট করে লঞ্চ এগিয়ে চললো ।

বিদ্যা নদীর দুপাশেই এখন নিবিড় জঙ্গল, সুন্দরী, গরান, কেওড়া আর হেঁতাল গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বছরের পর বছর দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চিন্তে নীরবে ।

ঘণ্টা দুয়েক ঘুরে ফিরে এসে লঞ্চ ঢুকে পড়বে দত্তা নদীতে, আজকের মতো ভিড়বে পাখিরালয়ের জেটিতে ।

‘কাননবন্ধু’-র সদস্যরা যখন প্রকৃতিবান্ধব গেস্ট হাউসে এসে পৌঁছলো তখন সন্ধ্যে ঘন হয়ে এসেছে ।

কোলকাতার দলের সকলে ততক্ষণে যে যার রুম বুঝে নিয়ে ঢুকে পড়েছে ।

সকলেই চেঞ্জ করতে ব্যস্ত, সেই সকাল ছটা থেকে একটানা এক কাপড়ে চলছে ।

পূবালীদি ছাড়া সকলেই জোড়ায় জোড়ায় আছে, দিপুকাকা আর অমিতাভ একটা কামরায় ঢুকে গেছে ।

নিতাই কুণ্ডু হাঁকডাক করে এক প্রস্থ চা, আদা, দুধ আর এলাচ দিয়ে ফোটান, কাঁচের গ্লাসে করে ঘরে ঘরে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে ।

আর রিসেপশনে কামরার চাবি বিতরণ করার সময়ই সে ঘোষণা করে দিয়েছে সন্ধ্যের আসল চা-টা সার্ভ করা হবে সামনের ‘অডিটোরিয়াম’-এ, সাথে চিকেন পকোড়া আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ।

দুর্গারা যখন গেট দিয়ে ঢুকলো তখন নিতাই অডিটোরিয়ামে, চেয়ার সাজিয়ে রাখার তদারক করছে ।

ওদের দেখেই তার বকাবকি শুরু,

-‘তোরা সবসময় দেরী করে ঢুকিস । সবাই পনেরো মিনিটের মধ্যে নীচে নামতে শুরু করবে । এখন কখন তোরা রেডি হবি আর কখনই বা ফাংশান শুরু করবি ।’

দুর্গা তাড়াতাড়ি বললো, ‘পনেরো মিনিটেই আমোরা তৈরি হয়ি যাবোখনে নেতাইদা, তুমি চাপ নিওনি । তোমার গেস্ট নিচি আসার আগই আমোরা সব রেডি হয়ি যাবো । তুমি ক্যাবল আমাদের এটটু চা-এর বন্দবস্ত করি দ্যাও দিকিনি, নইলি কারুল গলাইতো খুলবেনি, সুবলদার হাতও ভারি হয়ি যাবে ।’

-‘আচ্ছা আচ্ছা, সে আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি । তোরা এখন কিচেনের পাশের ঘরটায় চলে যা, পাশেই বাইরে মুখ হাত ধোয়ার বেসিন আর আয়না আছে ।’

এ গেস্ট হাউস সকলের ভালোরকম চেনা, মেয়েরা দুদ্দাড় করে ভেতরে চলে গেলো, এবার অনুষ্ঠানের জন্য চটজলদি সাজগোজ করে নিতে হবে ।

সকলের ব্যাগেই সাজার জিনিস আর হাত-আয়না আছে, একটা জিনিসও আনতে ভুলে গেলেই দুর্গার বকুনি একেবারে বাঁধা ।

সুবলের ওসব বালাই নেই ।

থলের মধ্যে একটা চিরুনি আছে, ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুলগুলো একটু ভালো করে আঁচড়ে নিয়ে, পরনের ধুতিটা হাঁটু থেকে নামিয়ে সার্টটা একটু ঝেড়েঝুড়ে নিলেই সে একেবারে রেডি ।

অডিটোরিয়ামের বাইরে একটা জলের কল আছে, গেস্ট হাউসের উঁচু জলট্যাঙ্কের পিলারের ঠিক পাশে ।

কলের মুণ্ডিটা ঘুরিয়ে দিয়ে জলের ধারায় সুবল পা দিয়ে কচলে কচলে পায়ের কাদা তুলতে লাগলো ।

#

আর সকলে বেসিনে মুখহাত ধুয়ে ভেতরে চলে গেছে ।

মুখে ভালো করে সাবান মাখিয়ে বাসন্তী চোখ আধখানা খুলে মুখে জলের ছিটে দিতে যাবে, তখনই আয়নায় দেখলো পেছনে হালকা অন্ধকারে একটা মানুষের ছায়া ।

তাড়াতাড়ি চোখেমুখে জল দিয়েই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো, পেছনে একটু দূরে মুখে নিঃশব্দ হাসি নিয়ে সুবল দাঁড়িয়ে আছে ।

বাসন্তী মুখ ফেরাতেই সুবল তাড়াতাড়ি এগিয়ে এলো ।

ত্রস্ত বাসন্তী ডানপাশে দূরে বন্ধ দরজার দিকে একবার তাকালো, তারপর ফিসফিস করে বললো,

-‘তুমি হেথায় কি করতিছ, যাও যাও, এখুনি চলি যাও, কেউ দেখলি…। ’

সুবলও ফিসফিস করে বললো,

-‘কেউ দেখবেনি, সবাই শাড়ী পরতিছে । আর দেখলেই বা কি! তর সঙ্গে তো একটা কথা ক্যাবল কইতে এলম ।’

-‘তোমার সঙ্গি আমার এখন কোন কথা নাই । তুমি যাও কেনে এখান থেকি, যাও ।’

বাসন্তী কথা শেষ করে আবার ঝটিতি বন্ধ দরজার দিকে একবার তাকিয়ে নিলো ।

সুবল বাসন্তীর সন্ত্রস্ত ভাব অগ্রাহ্য করে অনুযোগের স্বরে ফিসফিস করলো,

-‘এতোটা পথ একসাথি হেঁইটে এলম আমি তো ভাবিছিলম তুই নিজই আমার আগে আগে চলবি, কথাটা কয়ে নেব, তা তর তো সে হুঁশই নাই।’

বাসন্তীও ফিসফিস করতে লাগলো,

-‘তোমার তো সেই একোই কথা । কত্যবার বলিছি মিহিরদার বউয়ের শরীল এখনও ঠিক হয় নাই, এখন আমি ওই ঘর ছেড়ি আইসতে পারব নাই । যে মানুষগুলা আয়লায় বাপ-মা, ভাই বুন চলি যাবার পর এতো কাল ধরি আমারে ঘর, ভাত সব দিইছে, তাদির বিপদের সুময় কি করি আমি নিজির ঘর বসানর কথা কই!

-‘আহা হা, সেসব কথা এখুন আর কইছি না । সে তো আমি তোর জন্যি সবুর কইরবো রে বাসন্তী। এখুন এই দ্যাখ না, দ্যাখ, তোর জন্যি আমি এইটা আইনছি ।’

বলে সুবল সার্টের পকেট থেকে একটা সোনালী রঙের ঝকঝকে নেকলেস বার করে বাসন্তীর সামনে মেলে ধরলো ।

বাসন্তী একেবারে অবাক হয়ে গেলো ।

সে একবার জিনিসটা দেখছে, আবার দেখছে সুবলের উদ্ভাসিত মুখ ।

-‘আমার কথাটো হইছে যে আইজ এইটা পর‍্যে তুই নাচবি বাসন্তী । দুগগা এই কনট্যাক-এর কথা কইতেই আমি ক্যানিং গিয়া এটা আনছি, সুরমা জুয়েলারি থিকা, কয় সিটি গোল্ড ।’

সুবল চকচকে চোখে ফিসফিসিয়ে বলল ।

তারপর বাসন্তী কিছু বোঝার আগেই ওর পেছনে গিয়ে দ্রুত হাতে ওর গলায় নেকলেসটা পরিয়ে দিলো।

দুদ্দাড় করে কাজটা করেই অতো বড়ো চেহারার মানুষটা নিঃশব্দে ছোট ছেলের মতো দৌড়ে পালিয়ে গেলো সেখান থেকে ।

বাসন্তী শরীরে শিহরন আর মনে এক অজানা পুলক নিয়ে অবাক হয়ে সুবলের চলে যাওয়া দেখলো, চোখে তার বিভ্রান্তি ।

মুহূর্ত পরে সে নেকলেসটা গলার ওপরে সমান করে পেতে আয়নায় ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জিনিসটা দেখতে লাগলো ।

গলার সামনের পুরোটা ভরে যাওয়া নেকলেসটার ডিজাইনটা সুন্দর, চওড়া চেনের তলায় কয়েনের সারি, তার থেকে ছোট ছোট কল্কার পেন্ডেনট ঝুলছে ।

আয়নার কাছে গিয়ে ভালো করে দেখতে যাবে বাসন্তী, এমন সময় বন্ধ দরজার ওপার থেকে দুর্গার গলা ভেসে এলো,

-‘বাসন্তী, কি রে, এতো টাইম লাগাইছিস, মুখির ছাল তুলছিস না কি!’

বাসন্তী তাড়াতাড়ি নেকলেসটা গলা থেকে খুলে দোপাট্টার মধ্যে লুকিয়ে নিতে নিতে গলা তুলে বললো,

-‘ওই বাথরুম গেইছিলাম তো, এই আসতেছি ।’

তারপর দোপাট্টার অন্য প্রান্ত দিয়ে মুখ গলা ঘাড় ভালো করে মুছে আয়নায় একবার দেখে নিয়ে সাজঘরের দিকে যেতে যেতে মনে মনে হাসলো…’মানুষটার পছন্দ আছে’!

প্রকৃতিবান্ধব গেস্টহাউসের অডিটোরিয়ামে পনেরো জনের টুরিস্ট শ্রোতাদর্শক আর নিতাই কুণ্ডু ।

এমন ছোটখাটো অনুষ্ঠান করেই অভ্যস্ত কাননবন্ধু নাচগানের দল ।

কখনো সখনো বড়ো পার্টি হলে পেমেন্ট একটু বেশী হয় ।

এসব কায়দাকানুন দুর্গা বেশ ভালোই শিখে গেছে এই দুবছরে ।

‘কনট্যাক’ করার সময়ই নেতাইদাকে জিগ্যেস করে নেয় কতোজনের আসর হচ্ছে ।

মিহিরদা কাননবন্ধুর কোন অনুষ্ঠানের শুরুতে বলার জন্য সহজ বাংলায় সুন্দর একটা মুখবন্ধ লিখে দিয়েছিল।

আসরের পর আসরে সেটা বলে বলে দুর্গার একেবারে মুখস্থ হয়ে গেছে।

কিছুদিন হলো দুর্গা আবার সেটুকু স্বর উঠিয়ে নামিয়ে বলতে শিখেছে, কোরাস গানের ট্রেনিংটা কাজে লেগে গেছে ।

তাতে শুরুটা, যাকে বলে, কিছুটা প্রফেশনাল লাগে, নাইবা থাকলো মাইকের অনুষঙ্গ ।

আজ সন্ধ্যায় সেভাবেই শুরু হোল ।

দলের সকলের পায়ে ঘুঙুর, দুর্গার আরম্ভিক কথকতার বাছা বাছা জায়গায় ঢোলে চাঁটি পড়ছে, বেজে উঠছে ঘুঙুরের ঝঙ্কার।

শ্রোতাদর্শকদের মধ্যে একটু চোখ চাওয়াচাওয়ি হলো, সকলের দৃষ্টিতে কৌতুকের সঙ্গে যেন কিছু আশাতীত কিছু পাওয়ার আভাস ।

জিষ্ণু ফিসফিস করে অর্জুনকে বললো,

-‘এ তো দেখছি রবীন্দ্র সদনের শুরুয়াত!’

অর্জুনের ওপাশে ছিল সুনীতা, সেও ফিসফিস করলো,

-‘নিতাই কুণ্ডু এদের জোগাড় করেছে ভালো, এই জঙ্গলের মধ্যে এরকম…’

পলা সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো ।

পুবালীদিদির অনুচ্চকণ্ঠে ঝঙ্কারের সুর,

-‘চুপ কর তো, তোদের কেবল মাথায় তোলা স্বভাব!’

এসব কথার মধ্যেই ঘুঙুরের সমবেত ঝঙ্কার আর ঢোলের প্রবল চাঁটির মধ্যে বনবিবির বন্দনা দিয়ে কাননবন্ধুর অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেলো,

-‘দয়া করো মা জননী, তোমার পদ চুমি ।

যেমন দয়া করেছিলে দুঃখেরে তুমি ।

আমরা বড়ো অভাজন, পেটের দায়ে এসেছি মাগো

তোমার এ কানন ।’

বীণার উদাত্ত কণ্ঠস্বরের আওয়াজ শুনে নড়েচড়ে সকলে সোজা হয়ে বসলো ।

#

এখন চা পকোড়ার বিরতি চলছে ।

আধঘণ্টায় টানা নাচ আর গোটা পাঁচেক গান হয়ে যাওয়ার পর একটু ফাঁক পেয়েই গেস্ট হাউসের একটা বাচ্চা ছেলে চিকেনের বড়ো বড়ো একরাশ পকোড়ার ট্রে, কাগজের প্লেট, টিস্যু পেপার আর কাঁচের গেলাসে গেলাসে ধোঁয়া ওঠা চা নিয়ে অডিটোরিয়ামে ঢুকে পড়লো ।

পূবালী সম্পর্কে জিষ্ণুর দিদি, জিষ্ণু আর অর্জুন তাই দুজনে চেয়ার ছেড়ে উঠে তাড়াতাড়ি বাইরের দিকে চলে গেলো ধূমপানের তাগিদে ।

অবশ্য তার আগে পলা আর বৈশাখী হাসাহাসি করে ইশারায় তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল দুপাশের দেওয়ালে সেলোটেপ দিয়ে লাগানো নোটিশের দিকে, ‘অডিটোরিয়ামে ধূমপান নিষেধ’!

সকলে আদা এলাচ দিয়ে ফোটান চা আয়েস করে খাচ্ছে, সঙ্গে চিকেনের পকোড়া ।

একটা বড়ো পকোড়া ভেঙ্গে ভালো করে দেখার পর দিপুকাকার মন্তব্য,

-‘এ তো সিক্সটি ফরটি দেখছি!’

-‘মানে ?’ বৈশাখীর মুখে পকোড়া ভর্তি, তাই ছোট্ট জিজ্ঞাসা ।

-‘ মানে? সিম্পল! ষাট ভাগ বেসন আর চল্লিশ চিকেন! মচমচে করার জন্য মনে হচ্ছে চালের গুঁড়োও দিয়েছে ।’ দিপুকাকার জবাব ।

জিষ্ণু আর অর্জুন বাইরে থেকে ঘুরে এসে চা পকোড়ায় মন দিয়েছে ।

অর্জুন বললো,

-‘কাকু আপনি যাই বলুন খেতে কিন্তু জম্পেশ হয়েছে ।’

কাননবন্ধুর দলটা শুধু চা নিলো ।

দুর্গা ইশারা করে গেস্ট হাউসের ছেলেটাকে ওদের ভাগটা রেখে দিতে বলল ।

অমিতাভ বেচারা একটু একা পড়ে গিয়েছে, এই দলের বেশীর ভাগ লোকেদের সঙ্গেই পূর্বপরিচয় নেই।

মামাতো ভাই সতু আর বোন সুস্মিতার আগ্রহে সে এই দলে সামিল হয়েছে ।

সুন্দরবন দেখা ছিল না তাই এই সুযোগটা ছাড়তে চায়নি ।

ধীরেসুস্থে খেয়ে হাত মুছে সে দুর্গার কাছে এগিয়ে এলো।

এতক্ষণে সবাই আবার যে যার চেয়ারে বসে পড়েছে, অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় ভাগ শুরুর প্রতীক্ষায় ।

অমিতাভ দুর্গাকে জিগ্যেস করলো,

-‘তোমরা কি টুসু পরবের গান করো?’

অমিতাভর প্রশ্নটা শুনে দুর্গার মুখে অবাক আর খুশী এই দুই মিলিয়ে একটা ভাব ফুটে উঠলো ।

বৈশাখী উঁচু গলায় বলে উঠলো,

-‘টুসু কি পরব অমিতদা? সুন্দরবনের পরব?’

অমিতাভ জবাব দিলো,

-‘শুধু সুন্দরবনের নয় । বলতে পারো, টুসু নবান্ন উৎসবের আদিবাসী ভার্সন । সুন্দরবনে তো অনেক কাল ধরে সিগনিফিক্যান্ট নাম্বারে আদিবাসী রয়েছে । তাই জিগ্যেস করছিলাম আর কি ।’

পূবালীদিদি বললেন,

-‘টুসু সাঁওতালদের একটা প্রধান পরব, গানের সঙ্গে নাচ মাস্ট ।’

-‘হ্যাঁ, সুন্দরবনের আদিবাসীদের মধ্যেও টুসুর নাচগান হয়, মোরগ লড়াই হয়, পউষ সংক্রান্তির দিনে।’

অর্জুন হেসে উঠে বলল,

-‘দিদি, অমিতদা একেবারে পুরো হোমওয়ার্ক করে এসেছে, কোনও কথা হবে না ।’

সবাই হেসে উঠলো ।

দুর্গা এতক্ষণ যে কথা বলছিল তার মুখের দিকে তাকাচ্ছিল । এবার সুযোগ পেয়ে অমিতাভের দিকে তাকিয়ে বলল,

-‘গাই তো আমোরা টুসুর গান । ওর সাথি সোন্দর নাচও আছে কেনে । আপুনি শোনেন তো…’

সবাই হই হই করে বলে উঠলো,

-‘হোক হোক ।’

বৈশাখী বলে উঠলো,

-‘এই যে শোন, এর পরে সাধের লাউ আর তার পরে ঠাকুরজামাই এলো ঘরেতে গাইতে হবে । প্রথমেই বলে রেখেছিলাম, এখনো গাওনি ।’

দুর্গা ঘাড় নেড়ে সুবলকে আর মেয়েদের ইশারা করলো ।

চারজন মেয়ে হাত ধরাধরি করে একটা বৃত্ত তৈরি করতেই সুবলের ঢোল আর দুর্গার হাতের করতাল দ্রুতলয়ে বেজে উঠলো, শুরু হয়ে গেলো টুসুর গান আর তার সঙ্গে হাত ঘুরিয়ে ঘুরে ঘুরে নাচ ।

‘সব পাড়ায় যেও টুসু, উতোরপাড়ায় যেও না

উতোরপাড়ায় জোড়া সতীন পান দিলে খেও না ।’

কয়েক মিনিট আগে কাননবন্ধুর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেলো ।

বেশ তাড়াহুড়ো করছে এখন ওরা সকলে ।

ওদের রাতের খাবারটা গেস্ট হাউস থেকে রেওয়াজমত প্যাকেটে এসে গিয়েছে, যে যার ব্যাকপ্যাকে ভরতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে ।

দলের মধ্যে সব থেকে ছোটখাটো চেহারার মেয়ে মিনতি একটা রঙ্গিন সুতোর কাজকরা দারুণ সুন্দর দেখতে ছোট্ট বাস্কেট নিয়ে সকলের কাছে ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে, সকলেই দশ বিশ টাকা দিচ্ছে, বস্তুবাদী ধনতান্ত্রিক সভ্য মানুষের খুশী হওয়ার প্রতীক।

মিনতি ঘুরতে ঘুরতে অমিতাভর কাছে এলো, হাতের বাস্কেটটা সামনে বাড়ানো।

অমিতাভ একবার মিনতির দিকে তাকাল, তারপর পকেট থেকে পার্স বার করে একটা একশ টাকার নোট সেই বাস্কেটে রেখে দিলো ।

প্রায় সকলেই লক্ষ্য করছিলো, অস্ফুটে একটা ও-ও আওয়াজ ভেসে এলো ।

দলের সকলেই বেরিয়ে গেছে, দুর্গা দাঁড়িয়ে আছে মিনতির জন্য ।

অমিতাভ একবার সকলের দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে মিনতিকে ডাকল,

-‘এই, এদিকে শোন একমিনিট ।’

মিনতি আবার সামনে আসতেই অমিতাভ বলল,

-‘এইরকম সুন্দর বাস্কেট কোথায় পাওয়া যায় বলো তো ? লোকাল প্রডাক্ট? মানে, সুন্দরবনেই তৈরি হয়?’

-‘হ্যাঁ তো, আমোরাই বানাইছি, আমাদের এনজো বন্ধু আছে না, সেই থানে আমোরাই বানাই।’

মিনতির হাবভাবে তাড়াহুড়ো, নৌকো ধরার দেরী হয়ে যাচ্ছে ।

অমিতাভ লক্ষ্য করলো সেটা, বলল,

-‘তোমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে বোধহয় । আমাকে বাস্কেটটা বিক্রি করবে? পঞ্চাশ টাকা দেবো ।’

এরকম অভাবিত এবং অভিনব প্রস্তাবে মিনতি অবাক হয়ে গেলো ।

ও দুর্গার দিকে তাকাতেই দুর্গা ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিলো ।

মিনতি ত্রস্ত হাতে বাস্কেট থেকে নোটগুলো তুলে নিয়ে বাস্কেটটা অমিতাভর হাতে দিয়ে দিলো ।

অমিতাভ একটা পঞ্চাশ টাকার নোট মিনতির হাতে দিয়ে বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ’।

প্রায় দৌড়তে দৌড়তে দুর্গা আর মিনতি অডিটোরিয়াম থেকে বেরিয়ে গেলো ।

উপস্থিত সকলে এতক্ষণ নীরব দর্শক হয়ে সবকিছু লক্ষ্য করছিলো ।

দুর্গা আর মিনতি বেরিয়ে যেতেই তিন চারজন জোরে হাততালি দিয়ে উঠলো ।

জিষ্ণু বলে উঠলো,

-‘এই, শোন, শোন তোমরা! মেয়েগুলো এতক্ষণ ধরে পরিশ্রম করলো, তাই-ই অমিত একটু বেশী দ্রবীভূত হয়ে দেড়শ টাকা খরচা করে ফেলেছে । এতে তোমাদের প্রবলেমটা কি? মেয়েগুলোর বয়েসগুলোও তো দ্যাখো, জাঙ্গল বিউটি!’

ইঙ্গিতটা বুঝে সবাই আবার হো হো করে হেসে উঠলো ।

বৈশাখী হাসতে হাসতে বলে উঠলো, ‘আর অমিতদার বয়েসটাও দ্যাখো! এই বয়েসে পুরুষদের একটু…’

আবার একচোট হাসি ।

হাসির মধ্যেই অর্জুন উঁচু গলায় বলে উঠলো,

-‘কিন্তু দীপুকাকা তো কুড়ি টাকা দিয়েছেন, আমি দেখেছি ।’

এবার হই হই করে হাসির আওয়াজে অডিটোরিয়াম প্রায় কেঁপে ওঠার জোগাড় ।

হাসির আওয়াজ একটু কমলে অমিতাভ বলে উঠলো,

-‘দ্যাখো, আমার ডিফেন্স খুব সিম্পল । আমি লোকাল স্যুভেনির কিনতে ভালোবাসি ।’

তারপর হাতের বাস্কেটটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বললো,

-‘এটা আজ না নিলে কাল বিকালে গড়খালি থেকে কিছু একটা ঠিক কিনতাম । আমার কথায় ওরা দু-দুটো টুসুর গান গাইলো, স্বতঃস্ফূর্ত নাচলো, তাই আমি সেই প্যাশনটাকে রেসপেকট করলাম ।’

প্রাক্তন নৃত্যশিল্পী পুবালীদি অমিতাভর কথার মাঝে বলে উঠলেন,

-‘তোমরা যে কি দ্যাখো জানি না! পলাকে বলছিলাম তো, ওই মেয়েটা, যে টিপস কালেক্ট করছিলো তাকেও বলেছি, এদের নাচের মুদ্রার তো কোনও মা বাপ নেই!’

অমিতাভ পুবালীদির দিকে একবার তাকিয়ে আবার বলতে লাগলো,

-‘আর একশ টাকার টিপসের কথা ? তোমাদের এখন যে আসর বসবে আমার তো বাবা সেখানে কোনো খরচ নেই । আর এই ট্রিপে একটা ব্যাপারে অন্তত আমি তোমাদের থেকে লাকি, সো কল্ড বাজে খরচের এক্সপ্ল্যানেশন নেওয়ার মতো কেউ সঙ্গে নেই।’

বলে অমিতাভ হেসে উঠলো ।

অর্জুন অপাঙ্গে সুনীতার দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,

-‘এটা অমিতদা একদম খাঁটি কথা বলেছে! এখন চলতো, তাড়াতাড়ি চলো সব ওপরে, নিতাই কুণ্ডুকে বলে দিয়েছি ঠিক দশটায় আমরা ডিনার করবো ।’

তারপর অমিতাভর দিকে ফিরে বললো,

-‘আপনার চিন্তা নেই, দেবাশিসদারও একই ব্যাপার! আপনাদের দুজনের আর মেয়েদের জন্য স্প্রাইট আছে, অন দ্য হাউস স্যার।’

#

চাঁদের আলো জলের ওপর পড়ে নদীর বুকে এক মায়াবী আলোছায়ার খেলা ।

আজ বোধহয় সপ্তমী, চাঁদের আকার দেখে দুর্গা ভাবলো…যেন তাকে পুরোপুরি গড়তে গিয়ে আদ্ধেকটা আলো কম পড়ে গিয়েছে!

অবশ্য দুপাশের গহন জঙ্গলের মধ্যে পূর্ণ চাঁদের আলোর জোরাজুরিও খাটে না ।

জঙ্গলের ভেতরে একটু না এগোতেই নিকষ অন্ধকার তাকে গ্রাস করে নেয়।

কেবল সুন্দরী, গরান আর হেঁতাল গাছের মাথায় মাথায় কষ্টেসৃষ্টে তার বেঁচে থাকা ।

রাতের জোয়ার আসার সময় হয়ে গিয়েছে ।

এই জোয়ার আর ভাঁটার মাঝের একটুখানি সময় নদী বুঝি বিভ্রান্ত হয়ে থাকে ।

এই সময়টায় তার বুকে মানুষের রাজত্ব, যেদিকে ইচ্ছে সে নৌকা চালিয়ে নিয়ে যেতে পারে । হালের মাঝি নৌকোর মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে সজনেখালির জেটির দিকে । পাড়ের আলোর বিন্দুগুলো খুব ধীরে ধীরে বড়ো হয়ে উঠছে ।

দাঁড়ের হালকা আওয়াজ আসছে ছপ ছপ, বাকি পৃথিবী শব্দহীন ।

মাঝে মাঝে শুধু রাতচরা অজানা পাখীর তীক্ষ্ণ চিৎকার ।

পাটাতনে বসে আছে সকলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে, কার মুখে কোনও কথা নেই, সারাদিনের ক্লান্তি এখন যেন সকলের শরীরে চেপে বসেছে ।

নৌকো ছাড়তেই দুর্গা সকলের পাওনা টাকা ঠিকমতো ভাগ করে দিয়েছে ।

এই ভাগ করার ব্যাপারটা নিতাই কুণ্ডুও জানে ।

তাই সবসময় পেমেন্ট করে দেয় পঞ্চাশ টাকার বান্ডিলে ।

নিজের ভাগের টাকাটা হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে দুর্গা বসেছিল চুপ করে।

মনে তার পুরনো দিনের ভাবনার আনাগোনা।

সেদিনও এইরকমই এক সপ্তমীর সন্ধ্যারাতে ত্রিভুবনের হাত ধরে সে বত্রিশ লাটের ঘাট থেকে পাথরপ্রতিমার ভটভটিতে উঠেছিলো ।

সে রাতেও চাঁদের হালকা আলোয় চকচক করছিল নদীর ঘাট, তীরের আসশ্যাওড়া আর ভাঁটফুলের জঙ্গল ।

সে রাতে ঘাটে ছিল না কোনও ঢোল কাঁসি, না এসেছিলো কোনও দুর্গার নিজের মানুষ তাদের বিদায় দিতে ।

তারা সবাই বসেছিল তাদের নিজের নিজের ঘরে, বুকে পাষাণ চাপিয়ে ।

একুশ বছরের জীবনটা যাদের সঙ্গে ওতপ্রোত কাটিয়েছিল দুর্গা, তাদের সকলকে আঘাত দিয়ে সে বেরিয়ে এসেছিলো ।

বেরিয়ে এসেছিলো তার মনের মানুষের হাত ধরে, কোলকাতার স্বপ্নে বিভোর হয়ে ।

অপরিণত বুদ্ধিতে পেছনের দিকে তাকাবার আগ্রহ সেদিন তার ছিল না ।

তারপর নদী পেরিয়ে পাথরপ্রতিমার সস্তা হোটেলের অপরিসর তক্তাপোশে ত্রিভুবনের সঙ্গে তার সেই প্রথম নিশিযাপন ।

প্রথম রাতে মানুষটা যেন পাগল হয়ে গিয়ে তার শরীরের ওপর অধিকার খাটিয়েছিল ।

দুর্গা অবাক হয়নি খুব একটা, ত্রিভুবনের সাথে সাথে নিজের কামনায় ভেসে গিয়ে লজ্জা আর অস্বস্তির সঙ্গে খুশীই হয়েছিলো সে ।

বরং ত্রিভুবনের সতর্ক সহবাসে সে নিশ্চিন্ত হয়েছিলো ।

এই ভেবে নিশ্চিন্ত হয়েছিলো যে লোকটার দায়িত্ববোধ আছে ।

তাদের দুজনের কাছেই অনভিপ্রেত ফল তার কাম্য নয় ।

যদিও অনেক পরে দুর্গা বুঝতে পেরেছিল তার অন্তর্নিহিত কারণ ।

অবাঞ্ছিত দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার জন্য সেটা ছিল ত্রিভুবনের চতুর পরিকল্পনা ।

তবু ত্রিভুবনের সেদিনের সেটুকু বোধের জন্য আজও দুর্গা মনের কোন এক কোণে যেন সেই মিথ্যাভাষী চতুর লোকটার প্রতি কিছুটা ঋণী হয়ে আছে ।

তার স্বপ্নের শহর কোলকাতার প্রথম দুতিন সপ্তাহের দিন আর রাতগুলো স্বপ্নের মতোই কেটে গিয়েছিলো ।

যদিও ত্রিভুবনের অটোরিকশা বদলে গিয়েছিলো তিনচাকার মোটর-লাগানো সাইকেল রিকশায়…সাদাকালো টিভি দেখবার জন্য যেতে হতো বস্তির পাশের প্রতিবেশীর ঘরে ।

আর বস্তির একফালি ঘরটা তাদের বত্রিশ নম্বর লাটের প্রশস্ত উঠোন ঘেরা চারচালা ঘরগুলোর তুলনায় কিছুই ছিল না ।

তবু কোলকাতা তো জ্বলজ্বল করে জেগে ছিল দুর্গার চোখের গোড়ায় ।

ছিল তার দোকান-জমজমাট ফুটপাথের বাহার ।

আর ছিল ফুচকা ভেলপুরির ঠেলাগাড়িগুলো ।

মনে মনে ক্ষমা করে দিয়েছিল সে ত্রিভুবনের সব মিথ্যাভাষণ ।

কোলকাতায় তার সঙ্গে ঘর বসানোর, সংসার করার উদগ্র আকাঙ্ক্ষায় ।

কিন্তু বিধাতার ইচ্ছে ছিল অন্যরকম ।

তাই মাসের শেষদিকে এসে সোনারপুরের বাপের বাড়ি থেকে এসে বস্তির ঘরে উপস্থিত হলো চন্দ্রা, ত্রিভুবনের বিয়ে করা প্রথম বৌ ।

এতোটা মিথ্যে নিতে পারল না দুর্গা ।

সে নিশ্চুপ হয়ে গেলো, চিৎকার চেঁচামেচি কিছুই করলো না ।

নির্লজ্জ ত্রিভুবন বলেছিল দুজনকে মিলে মিশে থাকতে, একটা ব্যবস্থা নাকি সে করবেই।

সেই সন্ধ্যেবেলায়ই দুর্গা কানের দুটো সোনার টাব বিক্রি করে হাজার দুয়েক টাকা জোগাড় করলো ।

রাতে ঘরের বাইরে রাস্তার দোকান থেকে খাবার কিনে এনে খেলো ।

ঘরের মেঝেতে মাদুর পেতে শুয়ে থাকলো ।

ওর ভাবগতিক দেখে ত্রিভুবন বা চন্দ্রা কেউই ওর সঙ্গে কথা বলার সাহস করলো না ।

পরের দিন ভোরে ত্রিভুবন আর চন্দ্রার ঘুম ভাঙ্গার আগেই ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে অনেকটা হেঁটে ঢাকুরিয়া স্টেশনে পৌঁছলো দুর্গা ।

লক্ষিকান্তপুর লোকালে চেপে, ক্যানিং পাথরপ্রতিমা হয়ে বত্রিশ লাটের ঘাটে ভটভটি থেকে যখন নামলো দুর্গা, তখন ওর সিঁথি সাদা ধবধব করছে ।

মিনতি আস্তে করে ডাকলো, ‘দুগগা দিদি, শুনতিছ?’

দুর্গার চিন্তার সুতোটা কেটে গেলো ।

অবাধ্য চোখের কোণটা সকলের চোখের আড়ালে মুছে নিয়ে দুর্গা বলে উঠলো,

-‘সুবলদা, বাসন্তীর নেকলেসটা খুব সোন্দর হইছে গ । না, না, বাসু আমারে বলে নাই, আমি সব বুঝি গ, বুঝি, কিছু কই না, দিদি হই তো!

অন্ধকারে সুবলের অস্ফুট আওয়াজ ভেসে এলো ।

দুর্গা আবার বলে উঠলো,

-‘শুন সুবলদা, এই শীতটা পার কইরে আমি মিহিরদার সঙ্গি কথা কইব, তুমাদির চার হাত এক করার জন্যি । হ্যাঁ রে মেয়ে!’

এই বলে দুর্গা পাশে বসা বাসন্তীর খোঁপাটা নেড়ে দিতেই খোঁপা খুলে একঢাল চুল বাসন্তীর পিঠে ছড়িয়ে পড়লো, খোঁপা করার নকল বলটা গড়িয়ে জলে পড়ে গেলো ।

মিনতি বলে উঠলো, ‘যাহ্‌, বলটা পড়ি গেলো যে ।’

ওর উৎকণ্ঠ গলার স্বর শুনে সকলে হেসে উঠলো ।

সকলের হাসি থেমে গেলে অন্ধকারের মধ্যে আবার মিনতির গলা, ‘ও দুগগা দিদি ।’

-‘উঁ, বল না, শুনতেছি ।’

-‘মুদরা মানে কি গ দিদি?’

-‘মুদরা !’

-‘হ্যাঁ তো । ওই যে আইজ ওখানি একজন ছিল না, ফরসাপানা, চোখি চশমা, বেধবা গ, সিঁথেয় সিন্দুর নাই । ও-ই ভদ্দর মেয়িছেলেটা আমারে বলিছে ।’

-‘কি বলিছেন উনি?’

-‘ওই তো । আমাদের মুদরা নাকি ঠিক নাই। মুদরা কি গ দুগগাদিদি?’

দুর্গা শুনে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলো ।

তার মন সে সময়টুকুতে তার সাত ক্লাসের সব পাঠ্যবিষয় আঁতিপাঁতি করে মিনতির প্রশ্নের জবাব খুঁজতে লাগলো…মুদরা…মুদরা…মুদ্রা ।

চকিতে তার মনে পড়ে গেলো…হাতে ধরা রয়েছে তার ভাগের টাকা, কড়কড়ে অনেকগুলো নোট ।

অন্ধকারের মধ্যেই দুর্গা ডান হাতটা উঁচু করে ধরে বলে উঠলো,

-‘মুদরা মানে ট্যাকা রে মিনু, এই যে দ্যাখ…আমাদের নাচগানের রোজগারের ট্যাকা, বুঝলি কি না ।’

মিনতি বোধহয় মাথা নাড়লো, অন্ধকারে সেটা আর দেখা গেলো না ।

নৌকায় সব নিস্তব্ধ হয়ে গেলো আবার ।

কেবল কালো জলের ওপর দাঁড়ের শব্দ…ছপ ছপ ছপ ।

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • অনিমেষ বন্দ্যোপাধ্যায় on October 27, 2022

    এই পরিবেশ আর সমাজ একদমই চিনিনা। এদের নিয়ে লেখাও পড়িনি। সুন্দরবনের জীবন নিয়ে একটা সিনেমা দেখেছিলাম, জলবেশ্যা উপন্যাস থেকে বানানো। আজ অন্য একটা দিক কাছ থেকে দেখলাম। একদম নতুন অভিজ্ঞতা। লেখককে ধন্যবাদ।

    মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ