24 Oct

ফ্রেসকো

লিখেছেন:রামকিশোর ভট্টাচার্য


লস… ট্রেড…প্রফিট … লেবার… প্রোডাকশন… সারাদিন এত পরিশ্রম কার জন্য। হাফ সেঞ্চুরি করে ফেললে। বিয়ে করবে বলে তো মনে হয় না । দাম্পত্য সময় যে কি সেটা বুঝতেই চাইলে না । টাকার জন্য ছুটে কি হবে?

আমার এই মধ্যবিত্ত প্রশ্ন শুনে পরীক্ষিত যেভাবে তাকিয়ে ছিল তাতে ছিল এক আশ্চর্য নির্লিপ্ত। মুখে কোন উত্তর ছিল না। শুধু সময় ঢুকে পড়ছিল দুজনের মাঝখানে।

পরীক্ষিত সেন । বিয়ে করেনি । প্রেম রঙের বয়সে একবার তাকে ভালোবেসেছিল একটা মেয়ে। তার গ্রামেরই, কিন্তু পরীক্ষিতের অদ্ভুত নির্লিপ্তির জন্য সে মেয়ে অন্য কারোও জীবনে।

এখন ঘোরতর কাজের মধ্যেই কেটে যায় সময়। প্রতি পল অনুপল মেপে চলতে হয়।  সারাদিন কর্মের মহাকর্ষে ঘুরছে সে। ওয়ার্ককালচার নিয়ে ভাবতে হয় তাকে। তার ব্যক্তি জীবনে যেন ইমারজেন্সির বাহানা বলে কিছু নেই। সবই তার ইচ্ছাধীন।

ছোটবেলা থেকেই একটু অন্য রকমের সে। ওর মুখেই শোনা ছোটবেলা থেকেই একা থাকাটা ওর সবচেয়ে পছন্দের।

দামি গোল্ড ফ্রেমের হালকা নীল হাই পাওয়ার চশমা পড়ে থাকা গম্ভীর ডিপ্লোম্যাটিক মুখোশের আড়ালে ওসব সময়েই একটা রহস্য লুকিয়ে রাখে। যদিও সেটাকে কোন নাটক ভাবার কারণ নেই । কেন জানিনা মনে হয় তার সব রহস্য মহাজগৎকে ভিজিয়ে দিতে পারে।

ওর সঙ্গে ওর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কথা বললেই দেখেছি ও আকার ইঙ্গিতে যতি চিহ্ন বসিয়ে দেয়। নীতি মেপে কথা বলার অভ্যাস তার। সেদিনও সেটাই করল সে । এই স্বভাবটার জন্যই ওর সীমিত সংখ্যক বন্ধুদের কেউই ওকে নিয়ে খুব একটা উৎসাহ দেখায় না।

আগে ভাবতাম ও হয়তো খুব বেশি ইমোশনাল নয় । কিন্তু পরে মনে হয়েছে সেটা আমার ভুল। মাঝে মাঝে অন্য মন থাকলে দেখি। চোখ থেকে উড়ে যায় স্বপ্নপাখি । সেসময় চোখের মনিটা আশ্চর্যরকমভাবে নেচে ওঠে। আর তার বাহান্ন বছরের মুখটা কেমন শিশুর মত আদল পেয়ে যায় । তখন তার গভীরে লুকিয়ে থাকা বীজ থেকে একটা চারাগাছ উঁকি দেয়।

বেশ কয়েক বছর পরীক্ষিত ইতালিতে ছিল। সেখানেই কোম্পানি ম্যানেজমেন্ট পড়েছে সে। জীবনকে নিজের হাতে কী করে গড়ে তুলতে হয় তা বোধহয় ওখান থেকেই শেখা , অনেক সময় তার সব কথার মানে বুঝি না আমি , লিঙ্ক খুঁজে পাই না। মাঝে মাঝে সে বলে–

ইতালি দেশটা আমার খুব ভালো লেগেছিল। প্রতিদিন নতুন ভাবে জেগে উঠতাম , নিজের চারিদিকে খুব স্বপ্ন ছড়িয়ে রাখতাম। সে সব স্বপ্ন এখন মাঝে মাঝেই হাত  নেড়ে নেড়ে ডাকে। আমি ফিরেও তাকাই না। সেদিন একটা স্বপ্ন হঠাৎ আমার কাকু বলে ডেকেছিল …কাকু… বলে নিজেই হা হা করে হেসে ওঠে কৌতুকে।

– তবে কোনদিন কারও ধার করা জিভে কথা বলিনি আমি।

একটু থামে।  তারপর গলায় নানারকম মড্যুলেশন এনে সে বলে যায় – পাওয়া আর না পাওয়া এ দুটোর মাঝখানে ওরা কেমন অনায়াসে নিবৃত্তির একটা রেখা টেনে দিতে পারে । ওখানে যদি আবার চলে যেতে পারতাম…

বলতে বলতে হঠাৎ চুপ করে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে যায়। ইতালিতে আর না যাওয়ার কারণ ও নাকি সামান্য। যা আমাদের অজানা । প্রসঙ্গ উঠলেই বোঝা যায় ও কেমন ভেতরে ভেতরে ভেঙে যাচ্ছে । তাই আমরাও তার পাশে একটা কেয়ারফুল বিস্ময় চিহ্ন বসিয়ে রেখেছি।

বছর খানেক আগে রাজারহাটের কাছাকাছি সে একটা ফ্ল্যাট কিনেছে । নতুন তৈরি হওয়া ফ্ল্যাট। ওর মুখেই শোনা চোদ্দতালার টপ ফ্লোরের পুব -দক্ষিণে কোমে ওর ফ্ল্যাটটা বেশ বড়ো। চারপাশে অনেক দূর সবুজ গড়িয়ে গেছে। জনবসতি কম। তাই সেটা পছন্দ ওর।

 

বেশ কয়েকবার সে আমাকে আমন্ত্রণ জানালেও নানা কাজে যাওয়া হয়নি। বা যেতে পারিনি এর পিছনে অনিচ্ছিদেবীরও হয়তো কিছুটা ভূমিকা ছিল।

মধ্য শীতের এক ছুটির সন্ধ্যা কুড়োতে কুড়োতে নিজের গাড়ি নিয়ে হঠাৎ হাজির হলাম পরীক্ষিতের ফ্ল্যাটে। একটু আদর রঙের গোধূলি নেমছে চারপাশে। তখনও বাস রাস্তা তৈরি হয়নি। চারপাশে বেশ গ্রাম্য আমেজ লেগে আছে। একদল ফুরফুরে হাওয়া সবসময় খেলে বেড়াচ্ছে এপাশে ওপাশে। প্রত্যেক ফ্ল্যাটের সামনেই ব্যালকনি।

অত বড় বাড়িটায় মাত্র দু-তিনটে ফ্ল্যাটে লোক এসেছে। তাও নীচের দিকে। টপ ফ্লোরে পরীক্ষিত একাই আছে। তবে বিক্রি হয়ে গেছে সবগুলিই। ষোলশো স্কোয়ার ফুট শুধু একার জন্য! এখানেও নিজেকে যেন বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা তার। যেন একটা নিজের পৃথিবী গড়ে নিতে চেয়েছে সে।

ওর ফ্ল্যাটে আসবার খুব কম। সবই অ্যান্টিক। পরীক্ষিত বেশি ঝকঝকে জিনিস পছন্দ করে না। তবে ওর সাজানোর গুণে ঘরটা অসাধারণ রূপ পেয়েছে। প্রত্যেক ঘরে বিভিন্ন সেডের হালকার রং। প্রত্যেকটাই চোখকে শান্তি দেয় ।সে বলে – যত নিয়নের সাজ তার ভিতরে ঠিকানা জানতে গেলে  দেখবে নিজের অস্তিত্বটাই ভুলে যাচ্ছ। এক সময় নিভে যায় সব ।তখন প্রাণপাখির যে দশা হয় তা যার হয় সেই বোঝে।

বলতে বলতে দেখি অন্য এক মন এসে বাসা বাঁধে তার ভিতরে। তার চোখে মুখে ছায়া খেলে তার। সে ছায়ার ভিতরে অন্য জীবনকথা । অন্য মানের চিত্র ।

ড্রইং রুমে হালকা নীল পেইন্ট করা দেওয়ালে কেবল দুটো ছবি। একটা রাফায়েল ফ্রেসকো ‘এক্সপালসন অফ হেলিওডোরাস ফ্রর্ম দ্য টেম্পল’, পোপ জুলিয়স টু কে নিয়ে এই ছবিটার  কথা তার মুখে বারবার শুনেছি। রাফায়েল ওর খুব প্রিয় শিল্পী। মাঝে মাঝেই বলতে শুনতাম – জিওভানি দ্য সানতির ছেলে রাফায়েল । রাফায়েলের মন্ড ক্রসিফিকেশন ছবিটা যতবার দেখেছি ভিতরে ভিতরে কি ভীষণ নাড়া খেয়েছি।  সরীসৃপের ক্রোধ ছড়িয়ে পড়েছে।

ওর ঘরে দ্বিতীয় ছবিটার নাম ‘মা’। যামিনী রায়ের আঁকা । ওই ছবিটার সামনে এসে ও চুপ করে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো তারপর সোজা একটা পুরনো স্কচের বোতল নিয়ে এসে বলল – ২০০ বছরের প্রবীণ স্কচ। আমার গ্ল্যামার কুইন। চলো একটু বসি ওর সঙ্গে । দেখবে নুনমেশা স্মৃতির ভিতরে কত জন্মের ছবি, দুরুহ বেদনা, আনন্দ পাশাপাশি আসবে ।

আমি পরীক্ষিতকে কোনো দিন গুনগুন করতে শুনিনি । কিন্তু যখন নিজেই বোতল আর গ্লাস নিয়ে আসতে আসতে বাক- এর সুর ভাঁজতে ভাঁজতে এলো, আমি আবিষ্কার করলাম ওর ভারী পর্দার আড়ালে রামধনুর রঙটি। যা আরও স্পষ্ট হলো ঘরে সাজানো বাক্ আর বিটোফেনের রেকর্ড দেখে । সেই সঙ্গে সেই সাবেকি পিতলের চোঙ লাগানো গ্রামোফোন। দম দিলে বাজে।

সেই বিদেশিনী মদের  আড্ডায় দুজনে এতই মেতে গিয়েছিলাম যে শীত রাত্রি কখন গাছাগাছির  উপর আঁচল বিছিয়ে নেমে এসেছিল তা আমাদের খেয়ালই ছিল না । পরীক্ষিতের এত দিনের জমিয়ে রাখা কথা স্রোতেভেসে যেতে যেতে আমি খুঁজছিলাম তার লুকিয়ে রাখা দীর্ঘশ্বাসের ফাঁক ফোকরগুলি। চোখের সামনে পাতায় পাতায় তার মনের ছবি আর টুপটাপ বিষন্নতা ।

নিজের মধ্যে শামুকের মতো গুটিয়ে থাকা পরীক্ষিতকে আমার কোনদিনই নিঃস্ব মনে হয়নি।

আজ প্রথম দেখলাম গভীর জলে ছোট ছোট বৃত্ত উঠছে । ঘুরপাক খাচ্ছে। দেখলাম খুলে যাচ্ছে পরীক্ষিতের এত দিনের বর্ম! খুলে যাচ্ছে তার অন্তরের অজ্ঞাতবাসের গুহাচিত্র সব। চোখ- ভ্রু- থুতনি –  এমনকি গালের হাড় দুটোর নকশাও পাল্টে যাচ্ছিল।  বদলে যাচ্ছিল চিত্রনাট্য সব। সব যুক্তি মিশে যাচ্ছে স্কচের গ্লাসে। যেন কত দূর থেকে ছুটে আসছে সে… দ্রুতগতিতে দুলছে বুকের দোলন । একটা বেগুনি আলোয় অদ্ভুত লাগছিল তাকে। একটু থেমেই হঠাৎ বলে ওঠে- জানো কাল একটা মজার ঘটনা ঘটেছে

আমি বললাম- তোমার জীবন তো মজার ঘটনাময়।

একটু হেসে বলে – না না এটা অন্যরকম। কাল তখন রাত একটা কি দুটো, ব্যালকনিতে বসে অমাবস্যার আকাশের সঙ্গে স্কচমাখা মনে মনে আলাপ করছি… বয়ে যাচ্ছে গতিশীল স্কচের গন্ধ ।

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি পরীক্ষিতের দিকে, ওর শিরায় শিরায় বিদেশী মদের আভা, একটা আলস্য ভাব ঝুলে আছে মুখে, ওই আলস্য ভাবের মধ্যেই যেন ডানা মুড়ে বসে থাকা একটা মন কেমনের পাখি কথা বলে চলে

– হঠাৎ আলোর সব নিভে গেল। ফ্ল্যাটে এখনও জেনারেটর আসেনি, আমি অল্প অল্প সিপ করছি আর দূরে নিশ্বাস বন্ধ করে পড়ে থাকা স্থির স্থবির অন্ধকারকে দেখছি। অন্ধকারের ভিতরেও কিছু মিথ থাকে জানোতো? আমি সেই সব মিথের চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছি…

আমি একটু মুচকি হেসে বলি- নিজেকে তখন খুব একা লাগছিল নিশ্চয়ই?

এবার যেন গলাটা একটু কেঁপে গেল পরীক্ষিতের, ঠোঁট কামড়ে দু- এক সেকেন্ড থেকেই বলে উঠলো

– একটুও না। বরং আমার ভিতরের একটা আড়াল খসে যাচ্ছিল আস্তে আস্তে। আমার ভিতরের আমি টা দুলে উঠছিল বার বার ।হঠাৎ দেখলাম আমার ভিতর থেকেই বেরিয়ে আসছে অনেক মানুষ,  মস্তিষ্কের অসংখ্য কোষ থেকে বেরিয়ে আসছিল তারা।

আমি বলি – নাকি মন থেকে?

–  মন মানে তো চিলেকোঠায় যার বাস । তারা সেই চিলেকোঠার স্টোর রুম থেকেই নেমে আসছি। প্রত্যেকেই আমার মতন কিন্তু আমি নয়। চেনা হলেও ভীষণ অচেনা। রহস্যময়। ভেঙে যাচ্ছিল আমার নিভৃতি। অন্ধকারের ভিতরে যে আলো থাকে, যে আলো কষ্টের বদলে নৈরাত্ম দেয়, খুলে দেয় সব জট- জটিলতা সেই অস্পষ্ট আলোয় দেখলাম তাদের একদলের সারা গায়ে ফাটল। সবার মুখগুলো কাঁচের জানলার মতন । তাদের বুকে কত অঙ্কের হিসেব লেখা আছে! হিসহিসে হিসেব ।

একটা অদ্ভুত শব্দ করে পরীক্ষিত হাসলো। হাসিও মাঝে মাঝে মানুষের চেহারাকে জটিল করে দেয়। আস্তে আস্তে গেলাসে একটা চুমুক দিয়ে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ভার ছড়িয়ে দিল ব্যালকনিতে। তারপর বলল – আবছা কয়েকজনের হাতে জ্বলছে ডিভাইন ক্যান্ডেল। অন্য হাতে রুটি। তাদের দেখতে দেখতে আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল রাফায়েলের বিখ্যাত ছবি ‘দ্য মাস অফ বলসেনার কথা’,  সে এক অলৌকিক ঘটনা, আমি দেখলাম অল্প অল্প রক্ত ঝরে পড়ছে ক্রসের মতো ওই সামনের মাঠটায়… তাদের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছে সে এক রমনী! হাওয়ায় চুল উড়ছে। নিষ্পাপ তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি তাকে আমি চিনি, খুব চিনি, অথচ তখন চিনতেই পারছিলাম না!

হঠাৎ আমার হাতটা চেপে ধরে পরীক্ষিত, তারপর বলে – দেখলাম আমার হাতে রয়েছে এক পবিত্র পাত্র,ওপরে আকাশ, তাও যেন ঠিক চেনা নয়। রমনীর  গা থেকে উঠে আসা মিষ্টি গন্ধ মাখা প্রত্যুষের রং থেকে তৈরি হচ্ছিল সংকেত।

আমি প্রশ্ন করি-  কিসের সংকেত ! তুমি প্রত্যুষের রং চিনতে পারো!

ও বলে-  সে তোমায় বোঝাতে পারবো না দীপক। মানুষগুলোর চোখ হয়নার মত হিংস্র আর প্রশ্ন মুখর,তারা হাসছে। সে হাসির রং কি ধূসর। তারা আঙুল নেড়ে নেড়ে শাসাচ্ছে! আমার শরীরের চিলেকোঠায়  এত ভাঙাচোরা মানুষ এলো কি করে! ভাবতে ভাবতে গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল চারপাশ থেকে আমার নিজের ভিতরে ঢুকে যাচ্ছিল। চারপাশ থেকে আমার নিজের ভিতরে ঢুকে যাচ্ছিল একরাশ শূন্যতা।

আমার বেশ নেশা হয়ে গিয়েছিল। পরীক্ষিতের কথাগুলো শুনতে আর একটুও ভালো লাগছিল না আমার । গ্লাসের তরলও শেষ হয়ে গিয়েছিল অনেকক্ষণ। নিজেই একটু ঢেলে নিলাম, বারবার মনে হচ্ছিল ওর কথাগুলো বড্ড বেশি বানানো। তবু অবিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু ও বলেই চলেছে

–  আমি কিছুতেই পারছিলাম না ওদের ব্যুহ থেকে বেরিয়ে আসতে। আমার হাতের পাত্রে পবিত্রতার মধ্যে ছোট ছোট ঢেউ, সূক্ষ সূক্ষ  আন্দোলন উঠেছে, কিন্তু তখন চিলেকোঠাটা বেশ সাফসুতরো লাগছিল ।

মুখ দিয়ে হঠাৎ বেরিয়ে গেল – অসম্ভব … অসম্ভব, এসব কি বলে চলেছো! তোমার নেশা হয়ে গেছে ।

পরীক্ষিতের নাক মুখ আলো লাল হয়ে গেল, কিন্তু সে রঙের ভাষা বোঝার ক্ষমতা আমার ছিল না তখন। ও বলেই চলে – আমার ভিতরে তিরতির ব্যাথা একটা বয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ শরীরটা কেমন যেন ফুরফুরে হয়ে গেল।  নিজেকেই বললাম এদের নিয়ে আবার ভাবার কি দায় ? আমি কি ধর্মপুত্র’ আমি দেখলাম এই আমি আর ভিতরের আমি এক নয়। আমি পুরুষ হলেও… আমার আঙ্গুলগুলো পুরুষের মতো নয়।

আমি প্রসঙ্গ বদলের জন্য বললাম-  তুমি ভালো রঙ চিনতে পারো। আমি রং কানা ।ছোটবেলায় আমি একবার দোলন চাঁপার গায়ে সবুজ দিয়েছিলাম। মা খুব হতাশ হয়েছিলেন।

গেলাসটা আবার ভোরে নিয়ে বলে – আমি গ্রামের মানুষ । রঙের কোচিং আমার মাঠে ঘাটে পাওয়া।  কালার সেড আমার অনুভবের প্রতি বুননে। তবু মা আমায় বলত আমি নিজের ভিতরের রংটাই চিনিনি, তখন বুঝিনি কিন্তু পরে যখন বুঝলাম… সেদিন  বুঝলাম…

হঠাৎ একদম চুপ হয়ে গেল সে।

স্পষ্ট দেখলাম পরীক্ষিতের চোয়াল প্রথমে শক্ত হয়েই একদম ঝুড়ে পড়লো। তার ঠোঁটে মরে যাওয়া হাসি । আভিজাত্য অহংকার ছিঁড়ে যাচ্ছিল হওয়াই চপ্পলের স্ট্রাপের মতই। আমার মনে হল তার ভিতরের দরজা সম্পূর্ণ খুলে যাবে এবার। আমি দীপক সামন্ত জীবনে অনেক রকম লোক দেখেছি কিন্তু সেই প্রথম একটা চরিত্রকে বদলে যেতে দেখলাম চোখের সামনে। উলটে যাচ্ছিল পাতা। উড়ছে পুড়ছে। টুপ টুপ ঝাঁক ঝাঁক কষ্ট নামছে। এক অদ্ভুত তন্ময়তা ঘিরে আছে পরীক্ষিতকে –

জানো দীপক…..

এবার গলাটা একদম বদলে গেছে তার! আলতো মেয়েলি পুরুষ কন্ঠের দাঁড়ি কমার উত্থান পতন আমায় যেন দাঁড় করিয়ে দিচ্ছিল একটা ভূতগ্রস্ত টার্মিনাসের ভিতরে, সেখানে পরীক্ষিতের কথার তীব্র অংশগুলো আমায় এবার ছুঁতে শুরু করেছে। তার এই আলো- বাতাস- বর্ণমালা সব আমি বুঝতে পারছি… ও বলে চলে।

– দেখলাম মোমদানে একটা মোমবাতি। তাতে আগুন দিলাম। সেই আগুনের আলোয় দেখলাম সামনে পড়ে আছে কিছু পাবলিক সেন্টিমেন্ট। মাতালের মতন । ওদের স্ফূর্তিমুদ্রা দেখে হাসি পাচ্ছিল আমার। নিজেকে একদিন অপদার্থ মনে হয়েছিল । প্রতিদিন বার বার মনে হয়েছে নিঃস্ব নিজেকে শুইয়ে দিই একটা গরম সসপ্যানের ভিতরে। দেখি উত্তাপ বুঝতে পারি কিনা । কিন্তু এই প্রথম আমি সেই প্রত্যুষার আলোকে অনুভব করলাম নিজের ভিতরেই। আমার নিজের রঙ বদলে যাচ্ছিল । এই বাইরের চেহারাটা গলে যাচ্ছিল। ইতালির সেই সব ভাঙা গান , নরম আঙুলের আলতো আ্ঁচ… সবুরে ফলানো  চুমু… সব সব… ভিতরের  ঋতু বদলে যাচ্ছিল … জীর্ণ পাতাদের অগোছালো স্বরলিপিরাও বদলে যাচ্ছিল। একটা ঋতু… একটা পাতা… একটা খুশি রঙের বিরাট ক্যানভাসে দিগ্বিদিক  বদলে যেতে যেতে বলে দিচ্ছিল নেশা খুব দামী… খুব দামী ।

একটা ঋতুপর্ণ… একদল ঋতুপর্ণের কিরণ সাত সুরে বেঁধে দিচ্ছিল আমার দেহ – সেতারের তার। করুনা… ব্যথা… বিপন্নতা সেই কিরণের সুরে বলছিল- তুমি থাকো… তুমি থাকো… বন্ধনহীন, ডাক দিলে সারা পাবে ভিতর থেকেই। ভিতরে ভিতরে হা- ক্লান্ত আমি সেই আলাপ শুনতে শুনতে দেখলাম সেইসব ছেঁড়া ফোঁড়া কিম্ভূত কিমাকার মানুষদের, যাদের থেকে এতদিন অক্ষমের মতই আড়াল চেয়েছি, তাদের তখন ইঁদুরের মতই লাগছিল। পতঙ্গের মত লাগছিল। সব হাহাকার ছিঁড়ে যাচ্ছিল কুটি কুটি। কনফিডেন্স, আমার আত্মবিশ্বাস আমায় বার বার আঘাত দিচ্ছিল ।

পরীক্ষিত এতক্ষণ যা যা বলেছে তা যেন কোনো এক সৃষ্টির ঘোরে। এটাও নিশ্চিত সে স্ট্যাডিস্টও নয়।পোক্ত তার আত্মবিশ্বাসও। হয়ত তার সব প্রকাশের কেন্দ্রে আছে স্কচএর গূঢতর ব্যঞ্জনা। রাত এখন পশ্চিমে। তার গায়ে মদ গন্ধ লেগে। দূরে একলা নির্জন দাঁড়িয়ে থাকা একটা লাইট পোস্টের মৃদু আলোই হঠাৎ কেমন অন্তর্ভেদী হয়ে গেল!

দেখলাম আমার সামনে ধীরে ধীরে ভীষণ অসহায় একটা মানুষের পোস্টারটাই বদলে গেল। তাকে নিয়ে সব প্রশ্নের অসুখ সেরে গেল আজ । তবু তাকিয়ে থাকি তার দিকেই। তার ভিতরের সব মহার্ঘ্য বর্ণমালা ছুঁয়ে ছুঁয়ে নিজেকেই নিজে বলে উঠলাম – আহা পড়তে শিখেছি আমি, মনখারাপের ভিতরের রং পড়তে পেরেছি আজ অন্য আলোয়। প্রথম পাঠকের গৌরব নিয়ে তাকালাম সামনে । পরীক্ষিতের চশমা সামনের টেবিলে রাখা আছে। তাকে কোন প্রেম বাঁধতে পেরেছে কি না তা নিয়ে ভাবার আগেই সেই কাচে দেখলাম লেগে আছে এক প্রত্যুষার ফ্রেসকো….

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ