ঘন ঘন ঘড়ি দেখছেন প্রতাপবাবু। এখনও অফিসের গাড়িটা নিতে এলো না !
এরকম তো দেরি হয় না। জ্যামে আটকে পড়ল? বোঝা যাচ্ছে না ব্যাপারটা কী ?
প্রতাপবাবু অফিসে ফোন করলেন। ফোন বেজেই চলেছে। ক্রিং… ক্রি… ক্রি….। আশ্চর্য! ফোন তোলার লোকও নেই? রাবিশ। প্রতাপবাবু ঠিক করলেন, আর নয়।
১১ টা বাজে। ট্যাক্সিতে যেতে হবে। আর দেরি করা চলে না। ট্যাক্সি-স্ট্যান্ডে এসে প্রতাপবাবু ট্যাক্সি ধরলেন। ড্রাইভারকে বললেন, “জলদি চালাও, পার্কস্ট্রিট।”
ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে অফিসের গেটে পা রাখলেন। হনহন করে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। হঠাৎ অনিলের মুখোমুখি। অনিল উপর থেকে নীচে নামছিল।
“বুঝলে অনিল, আজ গাড়িটাই পাঠায়নি। কী বিচ্ছিরি ব্যাপার বলো তো?”
অনিল সরকার ‘মহাকাল’ কাগজের সিনিয়র রিপোর্টার। বাজারে বেশ নাম-ডাক আছে। অনিল প্রতাপবাবুর কথার জবাব না দিয়ে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে দ্রুত পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল।
প্রতাপবাবু অবাক হলেন। অনিল যে তাঁকে একপ্রকার এড়িয়ে গেল! তাঁর ভারী রাগ হল। মুখে প্রকাশ করলেন না। সিঁড়ির ধাপগুলো পেরিয়ে অফিসের অন্দরে ঢুকলেন।
মিহিরকে সামনে দেখতে পেয়ে বললেন, “জানো মিহির আজ গাড়িটাই যায়নি। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম…. শেষ পর্যন্ত ট্যাক্সি চেপেই আসতে হল। এ সবের কোনও মানে আছে। অযথা আমার সময় নষ্ট।”
সহকর্মী মিহির বললো, “জানি না দাদা। হয়তো অন্য কোনও কাজে গাড়িটা পাঠানো হয়েছিল।”
“কী বলছো মিহির? আমাকে আনতে যাওয়াটা কাজ নয় ?” বিরক্তি প্রকাশ করলেন প্রতাপবাবু। কথা না বাড়িয়ে এগিয়ে গেলেন তাঁর ঘরের দিকে। দরজার সামনে এসে অবাক। তালা মারা।
কী ব্যাপার? অফিসের কী কোনও নিয়ম-শৃঙ্খলা নেই? হাঁক-ডাক শুরু করলেন। কেউ কিন্তু তাঁর ডাকে সাড়া দিল না। চোখের সামনে ঘর ভর্তি লোক। যে যার কাজ করছে। অথচ তাঁর ডাকে কেউ সাড়া দিচ্ছে না। আশ্চর্য! এই দু-দিন আগেও তিনি একটা হাঁক দিলে অফিস শুরু লোক ছুটে আসতো। তাঁর হুকুম তামিল করার জন্য দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে যেত।
আর আজ! না, আর ভাবতে পারছেন না। উত্তেজনায় মাথাটাও কাজ করছে না। আমি প্রতাপ সরকার। আমার দাপটে বাঘে-গরুতেও এক ঘাটে জল খায়। আর আমার সঙ্গে কী না ….
সম্বিৎ ফিরল অসীম মুখার্জিকে সামনে দেখে। বয়সে ছোটো। মৃদুভাষী। ভদ্র ছেলে। তিনি শুধোলেন, “ব্যাপারটা কী হে
অসীম – ”
“স্যার আপনি বুঝতে পারছেন না? স্যার প্লিজ ট্রাই টু রিয়েলাইজ ইট।”
উপলব্ধি! হুঁশ ফিরল অসীমের কথায়। সত্যিই তো, তাঁর বোঝা উচিত ছিল এসব কীসের ইঙ্গিত!
সোমবার অফিসে গিয়ে দেখেছিলেন, টেলিফোনের তার কাটা। চেঁচামেচি করেছিলেন। মঙ্গলবার গিয়ে দেখলেন, বসার চেয়ারটাই হাওয়া। আর আজ!
হ্যাঁ, এসব পত্রপাঠ বিদায়ের আগাম পূর্বাভাস ছিল। আর এই ইঙ্গিতটা ধরতেই তিনি ব্যর্থ হলেন? বিদায়! এইভাবে, অসম্মান নিয়ে, অপমানের বোঝা নিয়ে। —“স্যার, চলুন! আপনাকে এগিয়ে দিই।’
-“হ্যাঁ, চলো অসীম।”
সেই ফিরে আসা ইস্তক প্রতাপ সরকার যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। ‘মহাকাল’ কাগজের জন্য তিনি কী না করেছেন। ঘর-দোর ভুলেছেন। সংসার ভুলেছেন। শেষে এই পুরস্কার ! মালিক বিপ্লব বিশ্বাসের সঙ্গে তো তাঁর হৃদ্যতার সম্পর্ক। কই তিনি তো কিছু বললেন না? জানালেন না। না কি তাকে সরাবার নেপথ্য নায়ক তিনি স্বয়ং। তিনি জানতেন, অফিসে তাঁর অনেক শত্রু । এই শত্রুপক্ষরা তাঁর বিরুদ্ধে মালিকের কান ভারী করেনি তো। মাথা কাজ করছে না। যতই ভাবছেন বার বার অঙ্কে ভুল হচ্ছে। যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ কোনও নিয়মই কাজ করছে না! উত্তর মিলবে কী করে? আশ্চর্য, অফিসে তাঁর যারা সহকর্মী ছিল, কেউ একবার খোঁজ নিল না। মানুষটার অপমানে পাশে এসে দাঁড়াল না। এত দিনকার হৃদ্যতা, ভালোবাসা, সম্পর্ক- সবই কি সাজানো? এটাই কাগুজে চরিত্র?
প্রতাপ সরকারের মনের তটে একের পর এক বিক্ষুব্ধ ঢেউ সজোরে আছড়ে পড়ছে। পাড় ভাঙছে, ধস নামছে। প্রতাপশালী, প্রভাবশালী প্রতাপ সরকার আজ নিস্তেজ, ভেজা বিস্কুটের মতন। শরীর আছে,সত্তা নেই।
সদ্য প্রাক্তন হয়ে যাওয়া পঞ্চাশোর্ধ প্রতাপ সরকার ঘরে বসে নিজেকে কাটাছেঁড়া করছেন। নিজেকে এখন বানভাসি মানুষের মতন অসহায় লাগছে। এখনও মন থেকে মেনে নিতে পারছেন না, ‘ মহাকাল’ কাগজের নিউজ এডিটরের চেয়ার তাঁর আর নেই। যে প্রতাপ সরকারের প্রতাপে ‘মহাকাল’ কাগজের সাংবাদিকরা সদা তটস্থ থাকতো, আজ তিনি কী না বিপন্ন, বিপর্যস্ত। মনে হয়, কেউ যেন তাঁকে নৌকো থেকে ধাক্কা মেরে মাঝ নদীতে ফেলে দিয়েছে। আর তিনি হাত-পা ছুঁড়ে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন, জলের উপর ভেসে থাকতে। যতবার তিনি জল থেকে মাথা তোলার চেষ্টা করছেন, ততবার একটা অতিকায় দানবীয় ঢেউ তাঁকে জলের মধ্যে চেপে ধরার চেষ্টা করছে।
প্রতাপ সরকার আর ভাবতে পারছেন না। গা দিয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। বুকের বাঁ-দিকটায় কী যন্ত্রণা হচ্ছে? বুঝে উঠতে পারছেন না। বেসিনে গিয়ে ভালো করে চোখে-মুখে জলের ঝাপটা দিলেন। নিজেকে অপ্রকৃতিস্থ লাগছে। এই কী সেই দাপুটে প্রতাপ সরকার? না কি প্রতাপ সরকার নাম নেওয়া অন্য কোনও সত্তা। এমন ঘটনা ঘটবে তিনি ঘুণাক্ষরেও বুঝে উঠতে পারেননি। হ্যাঁ, তাঁর অনেক কপট মিত্র ছিল। স্তাবক ছিল। সংবাদপত্র অফিসে যেটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। সংবাদপত্রে কাজ করবো আর পাশের জন পরম সুহৃদ- এমন ভাবা বাতুলতা মাত্র। কেউ কারোর মিত্র নয়। সবাই মিত্রতাসুলভ ভান করে। আবার হাসতে হাসতে পিছন থেকে ছুরি মারতে হাত কাঁপে না। কাঁপার কথাও নয়। সংবাদপত্রের সংসার বড়ো নির্মম, রুক্ষ,পাথুরে জমির মতো। কে কাকে বাঁচাবে? রক্ষা করবে? উল্টে ধাক্কা মেরে খাদে ফেলে দেবে। কেউ টেরটি পাবে না! কী না হয় এখানে! এই সেদিন ছোটবোন অফিসে ফোন করেছিল। ভাগ্নে অসুস্থ, কোনও ভালো হাসপাতালে ভর্তির সুপারিশের জন্য। ফোনে জনৈক সহকর্মীকে জানিয়েছিল, তিনি জানিয়েছেন— উনি আজ আসেননি। অথচ তিনি সশরীরে হাজির সেদিন। বোনের মুখে ঘটনাটা শুনে হতবাক্ । সহকর্মীরা এমন আচরণও করতে পারে? ছি!
ভাবতে ভাবতে ভাবনার অনেক গভীরে চলে গেছেন। উঠে দাঁড়ালেন। জানালার বাইরে চোখ রাখলেন।
আঁধার নামছে।
তাঁর জীবনেও কী আঁধার নামলো? এক জমাটবদ্ধ অন্ধকারের চোরাবালিতে তিনি তলিয়ে যাচ্ছেন না? বেঁচে থাকার তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। চিৎকার করছেন। শূন্যে হাত ছুঁড়ছেন !
প্রতাপ সরকারের হঠাৎ মনে পড়লো অরূপের কথা। অরূপ পাল। পড়াশোনা করা ছেলে। বেশ ভালো লেখে। বাই নেমে প্রচুর লেখা বের হতো। অরূপের কলমের চাহিদা ছিল। এটাই পরে অরূপের কাল হয়ে যায়। কতিপয় সহকর্মী অরূপের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ ছিল। তারপর কী হল কে জানে। অরূপকে কিছু লিখতে দেওয়া হতো না। অরূপ প্রতিদিন আসতো। চুপ চাপ বসে থাকতো। কোনও কাজ ছিল না। অথচ মাসের শেষে, নিয়মিত বেতন পেত। দু-একদিন নয়, টানা দু’বছর অরূপের সঙ্গে ‘মহাকাল’ এই আচরণ করেছিল। প্রতাপ সরকার বিপ্লববাবুকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করেছিলেন। বিপ্লববাবু তাঁকে এ ব্যাপারে মাথা ঘামাতে বারণ করেছিলেন। প্রতাপবাবু আর কথা বাড়াননি। না, কোনও প্রতিবাদও করেননি। এটা একটা গর্হিত অন্যায় অসভ্যতামি এটা বলার সৎ সাহস দেখাননি। সেই অরূপ পরে চাকরি থেকে ইস্তফা দেয়। প্রতাপ সরকার জানেন, এটাই সংবাদপত্র অফিসের কালচার। কাউকে টাইট দিতে হলে, তাড়াতে হলে মালিকরা কর্মরত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এই থার্ড ডিগ্রি প্রয়োগ করেন। যাঁদের মান-অপমানের বালাই থাকে, তারা ছেড়ে দেয়। যাদের থাকে না, তারা লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে হাসিমুখে পদাঘাত মাথা পেতে নেয়। ভাবটা এই— যতই মারো কলসির কানা, চালিয়ে যাব মোসাহেবিয়ানা।
প্রতাপ সরকার ভাবলেন, অরূপের সঙ্গে তাঁর আজ তফাৎ রইল কোথায়? অরূপের কলম অচল করে দেওয়া হয়েছিল, আর তাঁর ঘরের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ তো মুদ্রার এ-পিঠ আর ও-পিঠ।
প্রতাপ সরকারের মনে পড়ল, বিখ্যাত সাংবাদিক জর্জ হ্যারিসের করুণ পরিণতির কথা। ঘটনাটি শুনেছিলেন প্রবীণ সাংবাদিক সুখেন মুখার্জির কাজ থেকে।
জর্জ হ্যারিস অফিস ভবনের লিফটের দিকে এগোলেন। উপরে উঠবেন। এমন সময় লিফটম্যান এসে তাঁর হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দিল। চিঠি খুলে দেখলেন তাতে লেখা- ‘আপনাকে আর কষ্ট করে আগামীকাল থেকে আসতে হবে না। আপনার এতদিনের সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন। নমস্কার।’ চিঠি পড়ে মি. হ্যারিস অবাক। এমন কাজ ইতর শ্রেণির লোকরাও করে না। তাঁর অবাকের আরও বাকি ছিল। অন্যদিন লিফটম্যান তাকে দেখলেই সেলাম জানাতো। হাতের ব্যাগটাও নিয়ে নিত। স্যার, স্যার করতো। আর আজ লিফটের ভিতর থাকা টুলের উপর বসে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে পা নাচাচ্ছে আর সিগারেট ফুঁকছে! আজ তিনি এতটাই অবজ্ঞার পাত্র। সামান্য একটা লিফটম্যান কী না তাকে অপমান করার স্পর্ধা দেখাচ্ছে! পরম ঘেন্নায় জর্জ হ্যারিস সেই মুহূর্তে সেই স্থান ত্যাগ করেন।
হ্যারিসের পরিণতির কথা ভেবে নিজের মনকে সান্ত্বনা দিলেন। মি. হ্যারিসের মতো একজন কিংবদন্তী সাংবাদিকদের যদি এই হাল হয়, তাঁর অবস্থা সেই তুলনায় এমন কিছু নয়।
নগ্ন অন্ধকারের মুখোমুখি হয়ে আজ এসব সাত-সতেরো ভাবছেন। মনের পর্দায় একের পর এক ছবি আনাগোনা করছে। তারাই উদ্বেল করে দিচ্ছে গোটা হৃদয়। সমস্ত সত্তা।
অথচ এতদিন ভাবেননি।আজ সুতীব্র অপমান আর যন্ত্রণার কশাঘাতে ভাবতে বাধ্য হলেন। কেন, কেন সংবাদপত্রের অন্দরমহলে এত নোংরামি, এত কদর্যতা ? বাইরে থেকে মনে হয়, রূপকথার রাজপুরী। অথচ অন্দরমহলে ঢুকলে চুরমার হবে এই রঙিন মনগড়া মিথ। সংবাদপত্রের জগতে সাংবাদিকদের অবস্থান পদ্মপাতায় থাকা জলবিন্দুর মতো। যে কোনও মুহূর্তে উত্থান, যে কোনও মুহূর্তে পতন। যাকে ভাবছি মস্ত কেউকেটা, পরদিন সে এক ধাক্কায় রাস্তার মাঝখানে। অথচ যে কদিন সাংবাদিক হিসাবে কর্মরত ছিল, সেই কদিন মাটিতে তার পা ছিল না। এই ক্ষণস্থায়ী ভঙ্গুর অহংকার টিকিয়ে রাখার জন্য কী না করেছে। অফিস চত্তরে মারামারি করেছে। গালাগালি করেছে, মদ খেয়ে হুজ্জোতি করেছে। আত্মস্বার্থ বজায় রাখার জন্য মালিকের দালালি করেছে। এর-ওর পিছনে কাঠি দিয়েছে। গ্রহের ফেরে আজ সে একই পরিণতির শিকার।
আজ এতদিন পর, কার্যত গলা ধাক্কা খাওয়ার পর তাঁর নিজেকেই ভীষণ ঘেন্না করতে ইচ্ছে করছে। ভাবছেন, এতগুলো বছর স্রেফ জলে গেল। এই বছরগুলোর কোনও মূল্য নেই। কানাকড়ি যেমন মূল্যহীন, তেমনি এই বছরগুলোও বন্ধ্যা। অন্য কোনও পেশায় থাকলে সম্ভবত এই নীচতার শিকার হতে হত না। জীবনের ব্যালান্স শিট আজ ফাঁকা, শূন্য খাঁচার মতো। আজ এই মহাবিপর্যয়ের জন্য নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে করছেন প্রতাপ সরকার। কেন, কেন, কেন তিনি এতগুলো বছর যাবতীয় অন্যায় দেখেও চুপ করেছিলেন? কেন তিনি নিঃশব্দে স্তাবকতার পথ ধরেছিলেন? আজ নিজেকে মনে হচ্ছে সাংবাদিক নয়, উচ্ছিষ্টজীবী। পরের উচ্ছিষ্ট খেয়ে এতগুলো মূল্যবান সময় হাতের আঙুলের ফাঁক দিয়ে গলে গেল! এই পরিণতির কথা তিনি ভাববেনই। বা কী করে? যখন ঢুকেছিলেন একরাশ তাজা স্বপ্ন নিয়ে, এক ঝাঁক মোহ নিয়ে। লোকে চিনবে, জানবে। সেলাম ঠুকবে। মন্ত্রী-আমলা-ভিআইপিদের উষ্ণ সান্নিধ্য পাবেন। সেই অপরিণত বয়সে, কাঁচা বয়সে, একটা তীব্র প্যাশন তাঁর মনের মধ্যে কাজ করছিল। নামের মোহ, যশের মোহ। না, অর্থকরী দিকটা জুৎসই ছিল না। তবু নিজেকে কেষ্ট-বিষ্টুর স্তরে উন্নীত করার সুতীব্র আকাঙ্ক্ষা অবচেতন মনে ছিল। আজ মনে হচ্ছে, সেই আকাঙ্ক্ষা ছিল শূন্যে প্রাসাদ গড়ার মতো। এসব তখন বুঝবেন কী করে। তখন একটা অন্ধ ঘোরের মধ্যে ছিলেন। এই ঘোর সেই ঘোর বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছানো কিশোর-কিশোরীদের মতন।
ঘরের অন্ধকারে অনেক ক্ষণ বসা হয়েছে। মনের সঙ্গে অনেক লড়াই হয়েছে। প্রতাপ সরকার ভাবলেন, এবার একটু বাইরে বেরনো যাক। মনের উপর চেপে বসা অতিকায় পাথরটাকে সরানো দরকার। স্বগতোক্তি করলেন, কী হবে ভেবে? অন্য সবার যা হয়, আমারও তাই হয়েছে। বরঞ্চ এই ঘটনা না ঘটলে সংবাদপত্রের জগৎ চরিত্রভ্রষ্ট হত। সংবাদপত্রের দুনিয়ায় এটা একটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। সাদামাটা ব্যাপার। এখানে সবাই সব দেখে, শোনে, জানে। কিন্তু, কেউ কারোর নয়। মুখে দেতো হাসি হাসছে। পিছনে ছুরিতে শান দিচ্ছে। কেউ কারোর বন্ধু নয়। কেউ বিপদে পড়লে অন্যরা আনন্দ পায়। উল্টে তাঁকে গভীর গাড্ডায় ফেলার চক্রান্ত করে। একই পেশার লোক, অথচ সহকর্মী নন। এসব কথা বাইরের লোক জানে না।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ভাবলেন, এই দু’দিন আগে তাঁর কৃপাপ্রার্থী হওয়ার জন্য সিঁড়ির ধাপগুলোতে সাংবাদিকদের ভিড় লেগে থাকতো। সাত সকালেই অজস্র দাবি নিয়ে হাজির। ‘একটু দেখা’র আর্জি। যতই তিনি বলেন, ‘আমি কেউ নই’, ততই তাঁরা জোর করে তাকে আঁকড়ে ধরেন। আরও বেশি করে স্তাবকতার পথ ধরেন। ভাবটা এমন, যেন তাঁর সেবা করতে পারলেই তারা ধন্য, কৃতার্থ। তিনি “দেখছি-দেখবো’ বলে বরাভয় দিতেন। এছাড়া টেলিফোনের উপদ্রব তো ছিলই। কতজনের কত রকমের আবেদন-নিবেদন, অনুনয়-বিনয়। এই দু’দিন আগে পর্যন্ত।চেয়ার চলে যাওয়ার পর কেউ তাঁর বাড়িমুখো হয়নি। খোঁজ নেয়নি। ন্যূনতম সৌজন্যবোধ প্রকাশ করেনি। টেলিফোন করা তো দূর অন্তঃ
ভাবলেন, চেয়ারের মহিমার কথা। চেয়ার? না, না, না, মিউজিক্যাল চেয়ার। পায়াহীন এই চেয়ারে বসার জন্যই ল্যাং মারামারি, খামচা-খামচি, দলবাজি, গলাবাজি, দালালি আর ভাঁড়ামি। মালিক চাইলে সম্পদ, না চাইলে বিপদ। মালিক কান দিয়ে দেখেন, চোখের ইশারায় ব্যবস্থা করেন কে চেয়ারে বসবে। তাই আজ এ কাল ও। এই ট্রাডিশন সমানে চলে আসছে। ভাবলেন, যতদিন তাঁর চেয়ার ছিল, স্তাবকদের ভিড় ছিল। আজ একরাশ শূন্যতা। একরাশ যন্ত্রণা। আজ মনে হচ্ছে, পেশা হিসাবে সাংবাদিকতা কোনওমতেই সম্মানের নয়। যেভাবে প্রতিনিয়ত, প্রতি মুহুর্তে অনিশ্চয়তা আর নিরাপত্তাহীনতার শিকার হতে হয়, সম্ভবত আর কোনও পেশায় এমনটি হয় না। সাংবাদিকতা করতে গিয়ে তিনি দেখেছেন, তিনি এক ঘরে হয়ে গেছেন। না আছে বন্ধু-বান্ধব, না আছে ভালোবাসার মানুষ। যেন অন্ধকারাচ্ছন্ন বিচ্ছিন্ন দ্বীপে নির্বাসিত হয়ে বেঁচে থাকা লোককে পরিচয় দিতে ভালো লাগে— ‘আমি সাংবাদিক। ব্যস্ এই পর্যন্ত। বাকিটা অন্ধকার। না লাভ হয় আর্থিক দিক থেকে, না লাভ হয় সামাজিক দিক থেকে। একটা চূড়ান্ত শোষণের জায়গা। পুরুষ হলে সেটাই বুঝি ভালো ছিল। একরকম শোষণ, মহিলা হলে আরেক রকম। ফ্রিলান্সার হলে অন্য রকম। যৌবনকে বিনিয়োগ করে যাও, রিটার্নের আশা কোরো না। তিনি এসব দেখেছেন, উপলব্ধি করেছেন। প্রকাশ করেননি। প্রতিবাদও করেননি। উল্টে নিজের চেয়ার আর প্রতাপ অটুট রাখার চেষ্টা করে গেছেন। মালিকের সুনজরে থাকাকে শ্রেয় বলে মনে করে পথ চলেছেন। শেষ পর্যন্ত সেই পিছল পথেই আছাড় খেয়ে পড়েছেন।রাস্তায় পা দিয়ে প্রতাপ সরকারের আজ যেন অন্যরকম লাগল। বেশ ভালো লাগল। এতদিন রাস্তায় বেরিয়েছেন। রাস্তা, বাড়ি ও তার পারিপার্শ্বিক জীবন ও সৌন্দর্য তাঁর চোখে ধরা পড়েনি। আজকের এই অপ্রত্যাশিত সন্ধ্যায় যেন অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে। মনে দগদগে ঘা আছে ঠিকই। এ সন্ধ্যার মৃদু-মন্দ বাতাস আর শাব্দিক পরিবেশ তাঁর ক্ষতে প্রলেপ দিচ্ছে। এই আটপৌরে গার্হস্থ্য জীবনের শরিক তো তিনি হতে পারতেন। অথচ, হননি। সাংবাদিক হওয়ার পোকা মাথায় কিলবিল করছিল। পতঙ্গ যেমন আগুন লক্ষ্য করে ছুটে যায়, তিনি তেমনি ছুটে গিয়েছিলেন। সংবাদজগতের অগ্নিকুণ্ডের দিকে। আজ ভাবলেন, তিনি আপাদমস্তক পুড়েই মরেছেন।
পোড়ার বিনিময়ে কী পেয়েছেন? কিছুই না। জীবনের ভাঁড়ার আজ খালি। ভাবলেন, শূন্য দিয়ে শুরু করেছিলাম। শূন্য হাতেই ফিরলাম। মাঝখান থেকে জীবনের অনেকগুলো অমূল্য সময় নষ্ট হয়ে গেল। এই অমূল্য বছরগুলোকে অন্য খাতে একটা বিনিয়োগ করলে আজকের অপমানকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হত না। হয়তো জীবন অন্য খাতে বইতো। হয়তো নাম-যশ-প্রশংসা জুটতো না। হয়তো একজন লো-প্রোফাইল আটপৌরে মানুষ হয়ে জীবন কাটাতে হত। আজ মনে হচ্ছে সেটাই বুঝি ভাল ছিল।
জীবনপথের আজ এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে এসে মনে হচ্ছে, বিগত জীবনটা যেন ভুলের পাহাড়ে ঢাকা। ভুল, ভুল আর ভুল। দু’কুল উপচানো ভুল। একবারও নজরে পড়েনি সে ভুলের কায়া ও ছায়ার দিকে। তখন একটাই নেশা… একটাই প্যাশন … একটাই লক্ষ্য — খবর, খবর, খবর আর খবর। দেশের খবর… দশের খবর… ভালো খবর… মন্দ খবর… লঘু খবর… গুরু খবর… শব্দের অতলান্তিক সাগর থেকে তুলে আনা গরম গরম খবর …।
সেই মরীচিকার পিছনে ছুটে চলা অকৃতদার প্রতাপ সরকার আজ বুঝালেন, “মহাকালের’ চেয়ার খোওয়ানো প্রতাপ সরকার আজ নিজেই খবর হয়ে গেছেন।
Tags: গল্প, মিউজিক্যাল চেয়ার, মিঠু মাইতি
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।