পারমিতা আর সৈকতের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিলো কিছুটা কাকতালীয় ভাবে। কলকাতা থেকে হাজার কিলোমিটার দূরে ।
ষাটের দশকের শেষদিকে আমি কর্মসূত্রে মাঝেমাঝে তদানীন্তন মধ্যপ্রদেশের বেলাডিলায় যেতাম সেখানকার আকরিক লোহার একটি বৃহৎ প্রকল্পে যুক্ত থাকার কারনে। তখনও ভিজাগাপত্তনম অর্থাৎ ভাইজ্যাগ থেকে কিরান্ডুল পর্যন্ত রেলপথ তৈরি হয়নি। সেখানে পৌছোবার একমাত্র উপায় ছিলো ভাইজ্যাগ থেকে বাসে কোরাপুট রেঞ্জ পেরিয়ে প্রথমে বস্তারের জগদলপুর, তারপর সেখান থেকে অন্য একটা বাসে বেলাডিলা। রায়পুর থেকেও জগদলপুর বাস চলতো। সেখানে একবার পৌঁছে যাবার পর অবশ্য আর কোনো কষ্ট নেই। প্রোজেক্ট অফিসের গাড়ি থাকতো, সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে যেতো চড়াইউৎরাই পেরিয়ে পাহাড়ি পথে ঘুরে বেশ উঁচুতে যে গেষ্ট হাউস যার নামটাই ছিলো “হিলটপ গেষ্ট হাউস”। খুব সাজানো গোছানো কেতাদুরস্ত।
আমি প্রতিবার পাঁচ ছয় দিন থেকে ফিরে আসতাম। আবার মাসখানেক পর যাওয়া। এইরকমই চলছিলো।
সৈকত ব্যানার্জী ওখানেই একটা ছোটখাটো ঠিকাদারের অফিসে সাধারণ কিছু কাজ করতো। আমার সঙ্গে তার পরিচয় হবার কোনো সুযোগ ছিলনা। তবু আলাপ হয়ে গেলো এবং সেই আলাপে অন্তরঙ্গতার ছোঁয়া লাগতে বেশি দেরি হয়নি। এর একটা কারণ অতোদূরে একজন বাঙ্গালী আর তাছাড়া তার চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ, ঝকঝকে উজ্জ্বল বুদ্ধিদীপ্ত মুখ দেখে তার সঙ্গে আলাপ করার ইচ্ছে হয়েছিলো। আমার অনুমানে এই ছেলে এই পরিবেশে বেমানান। পেছনে অন্য কোনো গল্প আছে ।একদিন তাকে অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিজেই উপযাচক হয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলাম। কিন্তু প্রাথমিক পরিচয়পর্ব শেষ হবার পর মনে হলো যেন তার গোপন বৃত্তের মধ্যে হঠাৎ করেই এক বহিরাগতের অনুপ্রবেশে সে একটু বিব্রত বোধ করছে।
আবার কয়েকদিন পর দেখা হতে বললাম, আপনি আমাকে দেখলেই সরে যাওয়ার চেষ্টা করেন কেন। এতোদূরে এসে আপনাকে যখন প্রথম দেখলাম আমার মনে হয়েছিলো আপনি যেন একটু আড়ালে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে ভালোবাসেন।
এইভাবেই কিছুদিন চলছিলো। ইতিমধ্যে আরো তিন চারবার দেখা হলো। তারপর একটু একটু করে বরফ গলতে লাগলো। হয়তো ততদিনে সে আমাকে তার বন্ধু বা দাদার মতো ভাবতে শুরু করেছে। বেশ মনখুলে কথা বলতো। একদিন আমাকে তার বাড়ি নিয়ে যেতে চাইলো। বললো, দাদা, আপনি মাঝেমাঝে যখন এখানে থাকেন, তখন তো গেষ্ট হাউসের গাড়ি ব্যবহার করেন। কাল রবিবার, ঐ গাড়িটা নিয়ে চলুন আমার ডেরায়। গাড়ি থাকলে ভালো হয় কারণ জায়গাটা খুব কাছে নয় আর পথটাও যেমন পাহাড়ি পথ হয় আরকি।
আমি রাজী হলাম। এর কারণ সৈকতকে তখন আমার ভালো লাগতো আর সেইজন্যই তাকে আরো একটু কাছ থেকে জানার ইচ্ছে হচ্ছিলো।
বাড়ি ঠিক বলা যায় কিনা জানিনা। এ্যাসবেষ্টাসের ছাদ, হালকা প্লাষ্টার করা শুধু ইঁটের দেয়াল, মাটি আর ইঁট দিয়ে তৈরি ঘরের মেঝে। ঘরের মাঝখানে একটি কাঠের তক্তাপোশ, বসার জন্য একটিমাত্র কাঠের চেয়ার। ঘরের বাইরে ছোট্ট একফালি বারান্দার কোনে একটা জনতা ষ্টোভ।
ঢুকতেই চমক। ওর প্রায় সমবয়সী একটি মেয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। সৈকত পরিচয় করিয়ে দিলো, দাদা, এর নাম পারমিতা। আমার বন্ধু।
মনে মনে একটু হোঁচট খেলাম।স্ত্রী না বলে বললো বন্ধু ।যাইহোক কারো ব্যক্তিগত পরিসরে উঁকি মারার কৌতুহল আমার রুচিবিরুদ্ধ ।
কিন্তু পারমিতাকে দেখে খুব ভালো লাগলো। ছিপছিপে গড়নের চেহারা, একটু মাজা রং , সুন্দর মুখের ওপর চোখদুটো ভাসাভাসা, হাসির ঝিলিক। মনে হলো এই মেয়ে সবসময়ই হাসে।
জিজ্ঞেস করলাম, সৈকত, তোমাদের কতোদিনের পরিচয়, একই পাড়ার ?
– না দাদা, আমরা সহপাঠী ছিলাম।
– কোথায় ? স্কুল থেকেই ?
একটু চুপ করে থেকে সৈকত বললো, না, আমরা দুজনেই প্রেসিডেন্সী কলেজে ইংরেজি অনার্সের ছাত্র ছিলাম।
বুঝলাম সৈকতকে দেখে আমার অনুমান খুব ভুল ছিলোনা। এই পরিস্থিতিতে সামান্য এই মামুলি চাকরি তার জন্যে হতেই পারেনা। এ বাতাবরণে ওরা দুজনেই সম্পূর্ণ বেমানান। আমার কৌতুহল আরো বেড়ে গেলো যখন সৈকত নিজে থেকেই বললো, তবে ফাইনাল পরীক্ষা আমাদের শেষপর্যন্ত দেওয়া হয়নি।
আরো একটু জানার জন্য আমি ওকে উস্কে দিলাম, কেন ফাইনাল পরীক্ষা দিলেনা ?
– সে অনেক কথা দাদা। সেসব শুনতে আপনার ধৈর্যে কুলোবেনা।
আমি চেপে ধরলাম, তুমি আমাকে দাদা বলেছো। তোমার সব কথা মনখুলে বলতে পারো অনায়াসেই। তোমাকে প্রথম দেখার পর আমার মনে হয়েছিলো কলকাতা থেকে এতোদূরে এই পান্ডববর্জিত জায়গায় এক ঠিকেদারের অফিসে মামুলি একটা চাকরি করতে তুমি আসতে পারো না। হয়তো অন্য কোনো বিশেষ কারণে এসে পড়েছো। ব্যাপারটা জানতে ইচ্ছে করছে অবশ্য তোমার কোনো আপত্তি থাকলে বলতে হবেনা।
সৈকত তক্তাপোশে আর আমি চেয়ারে বসে আছি, পারমিতা বললো, দাদাকে আমাদের সব কথা বলো , আমি ততক্ষণে চায়ের ব্যবস্থা করি।
সৈকত শুরু করলো, তাহলে একটু আগে থেকেই শুরু করছি। দাদা, আমার বাড়ি বরানগরের গোপাললাল ঠাকুর রোডে।বাবা বেশ উচ্চপদস্থ সরকারী অফিসার ও খুব উদার মনের প্রগতিশীল মানুষ। আমার মা কিন্তু গভীরভাবে ধর্মপ্রাণ ও রক্ষণশীল। তাই হয়তো মায়ের সঙ্গে আমার কোনোদিন ঠিক মনের মিল হয়নি যদিও তাঁকে আমি খুব ভালোবাসি। খুব ছোটবেলার একটা ঘটনা মনে আছে। আমাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি একদিন গঙ্গাস্নানে গিয়ে ফেরার পথে রাস্তার দুধারে বসে থাকা ভিখারী ও কুষ্ঠরোগীদের খুচরো পয়সা দিতে দিতে গেলেন।
আমার কাছে এটি অতি পরিচিত ছবি তার সঙ্গে অনেকেই ছেলেবেলার স্মৃতি মেলাতে পারে।
সৈকত বলে চললো, আমি মাকে জিজ্ঞেস করলাম কেন এদের এতো কষ্ট । মা নির্দ্বিধায় বলেছিলেন এরা সবাই আগের জন্মে অনেক পাপ করেছিলো তাই ভগবান এজন্মে শাস্তি দিয়েছেন। আমি বিভ্রান্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম – মা তুমি কি এদের পাপ করতে দেখেছিলে ? মা খুব রেগে বললেন – বাপঠাকুর্দার কাছে যা শিখেছি সেসব মিথ্যে নাকি ?
আমি বললাম, সৈকত, তোমার মা একা নন কোটি কোটি মানুষ এই বিশ্বাস নিয়েই গোটা জীবনটাই কাটিয়ে দেয় কোনো প্রশ্ন ছাড়াই।
– হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন । কিন্তু যতোই বড়ো হতে লাগলাম মানুষের রক্ষণশীল চিন্তাধারা , সংকীর্ণ গন্ডি পেরিয়ে মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন উঁকি মারতে শুরু করলো । প্রচলিত সব ধারণা যুক্তি দিয়ে বিচার করা একটা অভ্যাসে পরিণত হলো। চোখের সামনে পথেঘাটে মানুষের চরম দুর্দশা দেখে ভাবতাম এদের কি কখনো কোনো উন্নতি হবে না ,এর উপায় কি ? সত্যি বলতে কি, প্রেসিডেন্সী কলেজে যাওয়ার পরই বন্ধু ও কিছু দাদাদের সংস্পর্শে এসে আমার চিন্তার আমূল পরিবর্তন হয়ে গেলো। এব্যাপারে দাদাদের সাথে দিনের পর দিন তর্কাতর্কি,আলোচনা আর বিখ্যাত চিন্তাশীল মানুষদের লেখা পড়ে এই শোষনভিত্তিক সমাজের আমুল পরিবর্তন করে দিনবদলের স্বপ্ন দেখতে তাদের সঙ্গে আমিও শুরু করলাম। এইসব ব্যাপারে পারমিতা কলেজে আমার সঙ্গে প্রথম থেকেই ছিলো। ধীরে ধীরে আমরা দুজনেই বুঝতে পারছিলাম আগামী জীবন আমরা একসাথেই পথ চলবো।
এমন আরো অনেক কথা চলছে। মনে হলো অনেকদিন কারো সঙ্গে মনখুলে কথা বলতে না পেরে সে হাঁপিয়ে উঠেছিলো। এরমধ্যে পারমিতা দুটো কাপ আর একটা গেলাসে চা নিয়ে হাজির। তারপর সে নিজেও আমাদের কথাবার্তায় যোগ দিলো। লক্ষ্য করলাম এই পরিবেশে মুখের অমলিন হাসি আর প্রাণবন্ত উপস্থিতি তার চেহারায় আর ব্যক্তিত্বে অন্য মাত্রা যোগ করেছে। আমি বললাম, কিন্তু যে সমাজের ঠিকানা তোমরা খুঁজে চলেছো আর তার জন্য মরণপণ লড়াইতে নেমে এসে নিজেদের সুখ শান্তি ও ভবিষ্যৎ জলাঞ্জলি দিয়ে কতোদিন একটা শক্তিশালী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে ?
পারমিতা এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিলো। হঠাৎ বেশ দৃঢ়প্রত্যয়ের সঙ্গে বলে উঠলো, দাদা, এই ঘূণ ধরে যাওয়া শোষণের সমাজ যেখানে মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিমূহুর্তে দলিত মথিত করে রাজত্ব করছে কায়েমী শক্তি সেখানেই শ্রমিক-কৃষকের মিলিত বাহিনী শ্রেণীশত্রুদের খতম করে একদিন প্রতিষ্ঠা করবে সেই সমাজ।
আমার মনে হয়েছিলো এদের আবেগ হয়তো বেশি তবে তাকেও সম্মান করতে হবে ।যেকোনও আত্মত্যাগের পেছনে সবসময়ই আবেগের একটা ভূমিকা থাকে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই।
কথায় কথায় সন্ধে গড়িয়ে গেছে রাতের দিকে। এমনিতেই নির্জন পাহাড়ি এলাকা আরো নির্জন হয়ে গেলো। পরে আবার একদিন আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে উঠে পড়লাম। আমার গাড়ি হিলটপ গেষ্ট হাউসের সর্পিল পথে রওনা দিলো।
কলকাতা অফিসে আমার ব্যস্ততা সবসময়ই খুব বেশি । একদিন প্রোজেক্ট রিপোর্ট লিখছি , হঠাৎ একটা ফোন এলো যে বেলাডিলায় পাঁচ নম্বর বেল্টকনভেয়ারে এ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। অনেকের সঙ্গে আমাদের তিনজন লোকের চোট , আপাতত তারা হাসপাতালে ভর্তি। সদ্য কমিশনিং হওয়া প্ল্যান্টের কোথায় ড্যামেজ আর আমাদের লোকেরাই বা কেমন আছে এইসব অজস্র চিন্তা মাথায় নিয়ে পরের দিন সকালে রওনা হয়ে গেলাম। বেলাডিলা এমন একটি জায়গা যেখানে তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাবার উপায় নেই। তবু সময় কিছুটা বাঁচাতে এবার জগদলপুর থেকে একটা গাড়িতে টানা সফর করলাম।
সবকিছু ঠিকঠাক করতে এবার ওখানে দশবারো দিন থাকতে হলো। লোকজনের আঘাত খুব গুরুতর ছিলোনা তাই দুতিন দিন পরেই সবাই কাজে যোগ দিতে পারলো। কন্ট্রোল সার্কিট মেরামত করা হয়ে যাবার পর আমারো নিশ্চিন্ত লাগছে।
কয়েকদিন পর সৈকত দেখা করতে এলো। বললো, এখনতো সব ঠিক হয়ে গেছে। আজ সন্ধ্যায় আসুন। পারমিতা বলছিলো দাদাকে এবার একদিন নিয়ে এসো। আপনাকে ওর ভীষণই ভালো লাগে।
সেদিন সন্ধ্যায় সৈকতকে সঙ্গে নিয়ে গেলাম। দেখা মাত্রই পারমিতার সেই উচ্ছল হাসিমুখে অভ্যর্থনা। আমি বললাম, দেখো ঠিক চলে এসেছি। কেমন আছো পারমিতা ?
আবার তিনজনের মিলিত আড্ডা । একটু পরে পারমিতা উঠে বারান্দায় গেলো। একটু কেরোসিনের গন্ধ নাকে আসতে বুঝতে পারলাম স্টোভ ধরালো। সৈকত কাছাকাছি কোথায় একটা সমোসার দোকানে যাবার তোড়জোড় করতে আমি বাধা দিলাম।
সেদিন দুজনের সঙ্গেই অনেক গল্প হলো। লক্ষ্য করলাম ঘরের কোনে বহু পুরোনো কাগজপত্রের মধ্যে নক্সালাইটদের কিছু পত্রিকাও রয়েছে যেমন ‘ দেশব্রতী’। বললাম, আচ্ছা সৈকত, তোমরা এখানে এসে গেলে কীভাবে ?
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে সৈকত শুরু করলো, দাদা, আপনাকে বলেছিলাম আমি কলেজে ফাইনাল পরীক্ষায় বসতে পারিনি। তার আসল কারণ ততদিনে আমি পার্টির কাজে অনেকটা জড়িয়ে পড়েছি। দুতিনটা এ্যাকশনে আমার থাকার খবর পুলিশ জানতে পারে। এরপর আমাকে ধরবার জন্য তারা খোঁজাখুঁজি শুরু করে। আমি গাঢাকা দিলাম। আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিলো বলে পারমিতাও আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যায়। আরো চারজনের সঙ্গে পুলিশ আমাদের ধরার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। তখন আমাদের লিডার অসীম চ্যাটার্জী যাকে সবাই ‘কাকা’ বলে ডাকতো ,আমাদের দুজনকেই পশ্চিমবঙ্গের বাইরে কিছুদিনের জন্য পালাতে নির্দেশ পাঠালো। সামনে যদিও আমাদের ফাইনাল পরীক্ষা ছিলো কিন্তু তখন এসব নিয়ে ভাবার সময় ছিলোনা আর তাছাড়া ততদিনে বুর্জোয়া শিক্ষাব্যবস্থার ওপর থেকে আমাদের মোহ চলে গেছে। চোখে তখন অন্য স্বপ্ন, অন্য এক লড়াই।
এই পর্যন্ত বলে সৈকত একটু থামলো। পারমিতার বাড়িও বরানগরে কিনা আমি জানতে চাইলে পারমিতা বললো, না দাদা, আমার বাড়ি বালীগঞ্জে। কলেজে সৈকতের সঙ্গে আলাপ হবার পর অবশ্য বেশ কয়েকবার ওদের বরানগরের বাড়িতে গিয়েছিলাম।
জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা বলোতো তোমরা যে সশস্ত্র কৃষিবিপ্লবের কথা বলছো সেটা কি আদৌ কোনোদিন সম্ভব ? এটা একধরণের ইউটোপিয়া নয়তো ? এর বাইরেও মানুষ কিছু সেবামূলক কাজ কি করছেনা বা ইচ্ছে থাকলে করতে পারেনা ? যেমন ধরো..
মাঝখানে আমাকে থামিয়ে দিয়ে পারমিতা বলতে লাগলো, না দাদা, তোমার ধারণা ভুল।
ততদিনে পারমিতার সাথে আমার সম্পর্ক অনেকটা সহজ হয়ে গেছে। সে আমাকে অনায়াসেই ‘তুমি’ বলে কথা বলে। কেউ কেউ খুব সহজেই কাউকে কাছে টেনে নিতে পারে, পারমিতাও সেইদলের। সে বলে যেতে লাগলো, সহমর্মিতা কারো ভেতরেই নেই। এই আধা-সামন্ততান্ত্রিক বুর্জোয়া সমাজে সুবিধাভোগী শ্রেণীর মানুষরা শোষিত মানুষের কোনো খোঁজ রাখেনা। ফুটপাতের বাসিন্দা, রাস্তার ঠেলাওয়ালা, লকআউটে বন্ধ কারখানার গেটের সামনে বসে থাকা নিরন্ন মানুষ, ভূমিহীন ক্ষেতমজুরদের তারা জানতেও চায়না। বঞ্চনার এই চেহারা কেউ কল্পনাও করতে পারবেনা। বুর্জোয়া পন্ডিতরা এদের জন্য দিস্তে দিস্তে কাগজে থিসিস লেখে, উন্নয়নের অনেক ফর্মূলা বানায় , অনেক সেমিনারে বক্তব্য রাখে কিন্তু কোনো কিছুই ভুখা মানুষের কাছে পৌঁছতে পারে না। আজ নয়, অন্য একদিন এই নিয়ে কথা হবে।
কথার মধ্যে ওদের দৃঢ় প্রত্যয় , ভালো লাগছিলো শুনতে।
সৈকত এতক্ষণ ধরে খুব মনে দিয়ে শুনেছিলো। চায়ের খালি গেলাস পাশে নামিয়ে রেখে সে বলতে লাগলো, তারপর বুঝলেন দাদা, আমার নেতাদের পরামর্শ মতো ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিলাম আর সঙ্গে সঙ্গে একটা পরিকল্পনা তৈরি করে ফেললাম। আমার এক দূরসম্পর্কের দিদি মধ্যপ্রদেশের রায়পুরে থাকতো। আমাকে বেশ পছন্দ করতো। অনেক কষ্ট করে ঘুরে ঘুরে আমি আর পারমিতা দুজনে আলাদা আলাদা রুটে মোটামুটি একই দিনে রায়পুর স্টেশনে পৌঁছে গেলাম। কীভাবে সেটা সম্ভব হয়েছিলো সেসব ডিটেলে আর যাচ্ছিনা। পারমিতাকে আমার সঙ্গে দেখে দিদি খুব একটা খুশি হলোনা । আমি বললাম কয়েকদিন পরেই চলে যাবো। কিন্তু তখনো পর্যন্ত আমরা জানতামনা কোথায় যাবো। কোনো গন্তব্য নেই শুধু জানতাম এমন জায়গায় পালাতে হবে যেখানে কেউ নাগাল পাবেনা। আমরা তখন মরিয়া।
শুনলাম সবটাই, কিছুটা পরিস্কার হচ্ছে রহস্য। বললাম, কিন্তু এটা তো অন্ধকারে ঝাঁপ দেওয়া। তাছাড়া বেঁচে থাকার জন্য কিছু টাকাপয়সার প্রয়োজন হয়, ওখানে তোমাদের কেউ চেনেনা। কে কাজ দেবে ?
সৈকত হাসতে হাসতে বললো, হ্যাঁ দাদা ঠিকই। একজনের সাথে কাকতালীয়ভাবে ওখানে আলাপ হয়। সেই মানুষটি খুব সাহায্য করেছিলো। তারই সূত্রে এই জায়গাটার খবর পেয়ে দুদিন পরেই চলে এলাম। ভাবলাম এতো বড়ো একটা কর্মকাণ্ড যেখানে চলছে সেখানে কিছু কাজকর্ম ঠিক পেয়ে যাবো।
এখানে এসে কাজ পেতে দেরি হলোনা। এখানে স্থানীয় মানুষরা খুব ভালো। আমি যাদের কাছে কাজ করছি তারাই এখানে থাকার এই ব্যবস্থাটা করে দিয়েছে।
সেদিন আরো অনেক ব্যক্তিগত আলাপচারিতা করে সময় কাটলো। পারমিতা বললো, দাদা, আজকে রাতে তুমি এখানেই খেয়ে যাও। আবার কবে দেখা হবে ঠিক নেই। দেখোনা বোনের আনাড়ি হাতের রান্না কেমন লাগে।
হেসে বললাম, নারে বোন । আজ একটু তাড়া আছে। সোজা যাবো গেষ্ট হাউসে, দুজন আসবে দেখা করতে।
পারমিতা আপত্তি করলোনা। আমার হাতটা চেপে ধরলো,দাদা, একবার যখন বোন বলে ডেকেছো তখন কথা দিতে হবে এর পরের বার একদিন রাতে আমার কাছে খাবে।
প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা টলটলে সুন্দর হাসিমাখা মুখের দিকে তাকিয়ে এমন আন্তরিক অনুরোধ ফেলতে পারলামনা। ওর হাতটা ধরেই বললাম, পরের মাসে প্রথমেই আসতে হবে। তখন নিশ্চয়ই তোমার কথা রাখবো।
– ঠিকতো ? কথা দিচ্ছো কিন্তু।
– কথা দিলাম।
রাত বাড়ছিলো। নির্জন পাহাড়ি এলাকা যেন ঘুমে আচ্ছন্ন। দেরি না করে আমি গাড়িতে উঠলাম।
পরেরবার আসার পর আমি একদিন ওদের গেষ্ট হাউসে নিয়ে গেলাম। অনেক গল্প হলো। পারমিতা বললো, দাদা, তোমার বাড়ির ফোন নম্বরটা দাও। আমরা ভেবেছি দিন পনেরো ছুটি নিয়ে একবার কলকাতা যাবো। তখন তোমাকে ফোনে আমাদের কাছে আসতে বলবো। এখানে চলে আসার পর কলকাতার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই।
আমরাও ইচ্ছে করে কাউকে এই ঠিকানা দিইনি। ওদিকটায় কী পরিস্থিতি জানার উপায় নেই। বহুদূরে একটা পাবলিক ফোন বুথ আছে বটে তবে সেটা বেশিরভাগ সময় খারাপ হয়ে থাকে।
আমি আমার বাড়ির ফোন নম্বরটা একটা কাগজে লিখে ওকে দিলাম। ওর বাড়ির নম্বর চাইলে বললো, আমি নিজেই তোমাকে ঠিক ফোন করবো।
তারপর পাশে ডেকে নিয়ে এলো। গলা নামিয়ে একটু লজ্জায় লজ্জায়, দাদা, কলকাতায় পৌঁছে আমাদের রেজিস্ট্রিটা করে নেবো। তখন যতোই কাজ থাকুক তোমায় কিন্তু আসতেই হবে দাদা। কথা দাও।
পরেরবার ওখানে পৌঁছে খবর পেলাম পনেরো দিনের ছুটি নিয়ে সৈকতরা কলকাতা গিয়েছে।
ইতিমধ্যে অনেক কিছু ঘটে গিয়েছে। উত্তাল রাজনৈতিক আবহে নকশালদের ধরপাকড় চলছে এমন খবর মাঝেমাঝে পাচ্ছি। উল্টোদিকে ওরা যাদের শ্রেণিশত্রু বলে দাগিয়ে দিচ্ছে তাদের খতম অভিযান
বন্ধ নেই। শহরে ও মফস্বলের বিশেষ কিছু অঞ্চলে সাধারণ মানুষ যেতে ভয় পায়।
এবার মাসদুয়েক পরে বেলাডিলায় গেলাম। আমাদের কাজটা শেষের দিকে। ওখানে খবর নিয়ে জানতে পারলাম সৈকত ব্যানার্জী সেইযে ছুটিতে গেছে তারপর থেকে কোনো খবর নেই। বাড়ির ফোন নম্বরটা জানায়নি তাই তারা কোনো যোগাযোগ করতে পারেনি। ঠিকানা যা দিয়েছিলো বোধহয় ভুল ,কারণ চিঠিও ফিরে এসেছে।
দেখতে দেখতে অনেকগুলি মাস পেরিয়ে তিনটে বছর চলে গেলো। ওদের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। আমার বাড়িতে বহুকাঙ্খিত পারমিতার ফোন এলোনা।
ওদের কথা মনে পড়লে খারাপ লাগে। ওরা দিনবদলের স্বপ্ন দেখে কিন্তু স্বপ্নবিলাসি নয়। ওদের আদর্শ ও বিশ্বাস অনুযায়ী একটি বিকল্প পথের সন্ধানে নিবেদিত দুটি বেপরোয়া জীবন আমার খুব কাছে চলে এসেছিলো। চেষ্টা করেও ওদের কথা ভুলতে পারছিলামনা ।
তিনবছর পরে হঠাৎ একদিন হাজরা রোডের ক্রশিংএ দাঁড়িয়ে আছি। রাস্তা পার হবো। পাশে দাঁড়ানো এক মহিলাকে দেখে খুব চেনা লাগছে। ভাবলাম এ কেমন করে হবে। সেই ঢলঢলে মুখের ওপর দুটি আয়ত চোখ যা দেখলেই ভালো লাগে, তার বদলে রোগা রোগা , চোখের কোল বসা যেখানে নেই উচ্ছল হাসির দীপ্তি । না না এ সেই মেয়ে নয়। আমার বিভ্রান্ত ভাব লক্ষ্য করে মেয়েটি নিজে থেকেই বললো, দাদা, চিনতে পারছো ? আমি সেই পারমিতা ।
আমি অবাক। এ কী দেখছি !
– কতদিন সময় পেরিয়ে এলাম বলো। তুমি অনেক বদলে গেছো পারমিতা। তুমি একটা ফোন করেওতো দাদার খোঁজ নাওনি। আমার কি অভিমান হয়না ? যাক তোমাদের খবর বলো। সৈকত কেমন আছে।
– সেসব অনেক কথা, অনেক ঘটনা। বলতে সময় লাগবে, তোমার ধৈর্য থাকবেনা।
আমার মনে অনেকগুলি প্রশ্ন । হাতে কিছুটা সময় ছিলো। ওকে প্রায় জোর করেই হাজরা মোড়ের প্যারাডাইস কাফেতে নিয়ে এলাম। ঐ সময় বেশ ফাঁকা। একটা কোনে গিয়ে আমরা মুখোমুখি বসার পর বললাম, তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে ভালো লাগছে পারমিতা। সৈকত এখানে থাকলে আরো ভালো লাগতো । সামনের রবিবার তোমরা দুজনেই আমার বাড়িতে আসবে, ঠিক আছে ?
চুপ করে শুনলো পারমিতা। একটু ম্লান হাসি, নির্লিপ্ত, কোনো তাপউত্তাপ নেই। ধীরে ধীরে কথা বলছিলো, দাদা, ওখান থেকে একসাথে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। বাড়ির লোকজন, বন্ধুবান্ধব সবার সঙ্গে বেশ কিছুদিন পরে দেখা হবে। আমাদের রাজ্যের কোনো খবর জানার উপায় ছিলোনা। আমাদের নিজেদের পত্রিকা ‘ দেশব্রতি ‘ পেতামনা।
আমি ওকে থামিয়ে দিলাম, সেসব আমি জানি। তারপর কী হলো সেইটা জানতে চাই।
পারমিতা বলে যেতে লাগলো, হাওড়া স্টেশন থেকে সৈকত সোজা চলে গেলো ওদের বরানগরের বাড়িতে। আমারও আমার বাড়িতে পৌঁছে বেশ ভালো লাগছিল। তারপর…
– তারপর কী পারমিতা ?
ওর দুচোখে নেমে এলো ক্লান্ত বিষাদের ছায়া। আরো বেশি চুপচাপ হয়ে ভাবনার গভীরে ডুব দিলো। তার পাঁজর ভেদ করে যে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার মৃদু শব্দ আমি শুনতে পেলাম।
– দাদা
আবার সব চুপ। আমার হাতটা নিজের দুহাতে শক্ত করে ধরে তার গালে চেপে ধরে সে হাউহাউ করে কেঁদে উঠলো। আস্তে বললো, সৈকতের সঙ্গে সেটাই আমার শেষ দেখা।
এক কঠিন ধাক্কা লাগলো মনে। ভাবলাম কী এমন ফাটল দেখা দিলো ওদের সম্পর্কের মধ্যে যে দুজনের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলো । মনটা খুব খারাপ লাগছিলো। পারমিতা বলতে লাগলো, দাদা, আমরা যখন ধরা পড়ে যাবার ভয়ে অতদূরে পালালাম সেখান থেকে এদিককার খবর না পেলেও এটুকু জানতাম যে সত্তরের দশক মুক্তির দশক করার শ্লোগান চালু ছিলো ও কমরেডদের কাজও চলছিলো। কিন্তু ১৯৭১ সালের বারোই আগষ্ট কাশীপুর রোড ও রতনবাবু রোডের মোড়ে কংগ্রেসের জনপ্রিয় নেতা নির্মল চট্টোপাধ্যায়কে হত্যা করা হয়। আমি আজো জানতে পারিনি ওটা আমাদের পার্টির নির্দেশ ছিলো নাকি বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে খুনটা করানো হয়েছিলো কারণ খবরটা রটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক গুন্ডারা সাধারণ মানুষদের সঙ্গে নিয়ে ক্ষোভে ফুঁসে উঠে দলবদ্ধভাবে বরানগর কাশীপুরে খুঁজে খুঁজে নকশালদের বাড়ি থেকে বের করে খুন করে গঙ্গায় লাশ ভাসিয়ে দিলো। সৈকত বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছিলো এগারোই আগষ্ট রাতে। পৌঁছেই আমার বাড়িতে ফোনে জানিয়েছিলো। দাদা, সেদিন পর্যন্ত সে ছিলো সৈকত , মানে আমার সৈকত। তার চব্বিশ ঘণ্টা পরে সে শুধুই একটা দলাপাকানো রক্তাক্ত লাশ যাকে ঘাতকের বাহিনী অনেকের সঙ্গে গঙ্গায় ছুঁড়ে ফেলে দিলো।
অনেকক্ষণ ধরে চুপ করে রইলাম। মুখে কোনো কথা আসছিলোনা। দুপুরে নির্জন প্যারাডাইস কাফেতে বেশিরভাগ চেয়ার ফাঁকা। মাথার উপর ঘুরতে থাকা সিলিং ফ্যানের একটানা আওয়াজ।
পারমিতা উঠে পড়লো। মনে হচ্ছে সে যেন একটা ট্রমার ভেতরে তখনো রয়েছে। সব আশা, জীবনীশক্তি যেন শেষ। সে বেরিয়ে গেলো। আমি কোনো বাধা দিলামনা। কোনো প্রশ্নও করলামনা। ওর একদা সুন্দর মুখের ওপর বিদ্ধস্ত স্বপ্নের ছাপ।
পারমিতার সঙ্গে আর দেখা হয়নি।
ওর বাড়ির ঠিকানা বা ফোন নম্বর চাইতে গিয়েও পারিনি।
সত্তরের সেই উত্তাল সময় এখন বেশ ঝিমিয়ে পড়েছে। তরতাজা মেধাবী যেসব তরুণ তরুণী একদা দিনবদলের স্বপ্ন দেখতো তারা আজ অনেকেই মৃত অথবা পঙ্গু ।
মাসছয়েক পরে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে একদিন কাশীপুর বরানগর এলাকায় যেতে হয়েছিলো।কাজ শেষ হবার পর হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো চারপাশের ছবি কেমন বদলে গেছে। আমি নিতান্তই অকাব্যিক মনমরা ফ্যাকাশে এক গোধূলি পেরিয়ে গঙ্গার ধারে চলে এলাম। হুহু করে গায়ে লাগছে বাতাসের ঝাপটা। মনের ভেতর শুরু হলো তোলপাড়। সব ভাবনা আমাকে টানতে লাগলো অতীতের দিকে। জলের দিকে তাকিয়ে মনে পড়লো একটি কবিতার লাইন:
ভাবো, ভাবো সেদিনের উৎসব
বরানগরের গঙ্গার জল থেকে
আবার এসেছে উঠে
তিনশো তরুণ
আমি কল্পনাপ্রবণ হয়ে যাচ্ছিলাম। শুধু ভাবছিলাম কতো হাজার হাজার সৈকত সেদিন লাশ হয়ে ভেসে গেলো গঙ্গায় আর অগণিত পারমিতাদের কান্না আজও ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে ভোরের বাতাসে।
Tags: অনিলেশ গোস্বামী, গল্প, স্বপ্নের ঠিকানা
email:galpersamay@gmail.com
Sravani. on July 4, 2023
গল্পের সাবলীল বহমানতা ,মরমী আখ্যান আমাকে মুগ্ধ করেছে ৷ রাজনৈতিক পটভূমিও স্পষ্ট, ঝরঝরে এবং দায়িত্বপূর্ণ ভাবে চিত্রিত ৷ আগাগোড়া আকর্ষণের সাম্যতা লেখা ও লেখকের প্রতি শ্রদ্ধা আদায় করে নেয়৷
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।