29 Jan

নোলা

লিখেছেন:রূপা সেনগুপ্ত


এখন বিকেল । বৃষ্টি পড়ছে। আজ সকাল থেকেই শুরু হয়েছে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি। বিকেল গড়িয়ে গেলেও  বৃষ্টি থামেনি। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামছে। ননিবালা আজ  বাড়িতেই কাটিয়েছেন গোটা দিন।

ঘুলঘুলি আর জানালা দিয়ে  গড়িয়ে আসা স্ট্রিট লাইটের হলুদ আলো দেখছিলেন তিনি। এই ঘরটায় মাত্র একটা ছোট জানলা আর একটাই মাত্র দরজা । বড্ড বদ্ধ  বদ্ধ লাগে তাঁর।

ঘরের স্যাঁত স্যাঁতে গন্ধ আর বৃষ্টির শব্দ মিলে মায়াবী করে তুলেছে পরিবেশটাকে। একটা টিকটিকি মাঝে মাঝে ডেকে উঠছে টিক টিক।

দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নামল। মাঝে মাঝে দূর থেকে কয়েকটি শিয়াালের ডাক ভেসে আসছে। বড় অদ্ভূত এই গ্রামটা। মূল শহরের থেকে খুব বেশি দূর নয়। আবার এই গ্রামের পরে আরো দুটো গ্রাম, ছবির মতো গ্রাম্য পরিবেশ নিয়ে জেগে আছে। বেশিরভাগই রিফিউজি মানুষের বাস। এঁরা সব ঝোপ জঙ্গল কেটে সাফ করে টালির ঘর তুলেছিলেন তিরিশ চল্লিশ বছর আগে।

ওইদিকে এখন আবার কৃষ্ণপক্ষ চলছে। বড় ছেলে সতীশ এই বাড়িটা বিক্রি করার তালে আছে। প্রমোটারকে ডেকে এনে দেখাচ্ছে। কিন্তু রফা হচ্ছে না তেমন।

ননিবালার তিন ছেলে আর তিন মেয়ে। এর মধ্যে মেজ মেয়ে সীমা কোন ভাগেযোগে নেই তা জানিয়ে দিয়েছে। বাকি দুই মেয়ে এসে ইনিয়ে বিনিয়ে জানিয়ে গেছে ভাগের টাকা কটা তাঁদের বড্ড দরকার। দূরে কোথাও কাঁসার ঘন্টার আওয়াজ শুনতে পায় ননিবালা। ও হো! আজ তো তারামা সংঘের রক্ষাকালি পূজা। ক্রমে রাত নামে আর সেই সঙ্গে খিদে চাগার দিয়ে ওঠে তাঁর। আজকাল তাঁর বড্ড খিদে পায়। একসময় কত খিদে সহ্য করেছেন তিনি। সেই যে বার ছোট ছেলে  বাবলু হল সেবার তো খুব আকাল চারদিকে। ঘরে চাল তেল নুন সব বাড়ন্ত।  ইংরেজির ১৯৪৩ সন সেটা।  গ্রামের সবাই আলোচনা করছিল বার্মা থেকে চাল আসা বন্ধ হয়ে যাবে। যুদ্ধ লেগেছিল । বিশ্ব যুদ্ধ। জাপানিরা আক্রমন করবে এবার। চারদিকে শুধু নেই নেই। তখন শাশুড়িমা তেল চাল মেপে রান্না করতেন । চার সন্তানের জননী   ননিবালা পঞ্চমবার আবার মা হতে চলেছেন। বছর পঁচিশেক বয়স তাঁর। খিদে তৃষ্ণা ভুলে তিনি তখন ছেলেমেয়ের জন্য খাবার গোছাতেন। সেই সময় তিনি ওই লেবু পাতা দিয়ে জল ঢালা ভাত খেয়ে কত দুপুর যে কাটিয়েছেন!

তাঁর ঘরের লাগোয়া বারান্দার কোনে, উঠানে নবীন ঠাকুরপোর দেওয়া একটা গন্ধলেবুর গাছ ছিল। তাঁর যে খুব গাছের শখ ছিল। এখনও আছে বললে অবিশ্যি ভুল বলা হবে না। নবীনই গাছপালা সম্পর্কে একটা কৌতূহল তাঁর ভিতর জাগিয়ে তুলেছিল। তারপর উনি দেশছাড়া হবার পর থেকে ক্রমে সে শখটা আপনা থেকেই অনেকটা উবে গেছিল–যেমন অন্য শখগুলোও গেছে। এখন ঘর সংসার নিয়েই থাকেন । তবু এদেশে এসে, এ গ্রামে যখন ঘর তোলেন তখন পুকুরপাড়ে একটু গাছ লাগান তাঁরা।

রাত কত হলো কে জানে। বৃষ্টি থেমে গেছে ।সাড়ে সাতটার স্থানীয় সংবাদ কে যেন পড়ে গেল রেডিওতে। বড় বউমা শোভনাকে তিনি ডাকবেন কি না ভেবে ঠিক করে উঠতে পারেন না । আটটার মধ্যেই তাঁর জন্য বরাদ্দ দুধ রুটি নিয়ে এঘরে রেখে যায় শোভনা।

অনেক খুঁজেপেতে এই মেয়েকে এনেছিলেন তিনি বেআক্কেলে ছেলেটাকে বাঁধবার জন্যে। এরকম সুন্দরী সচরাচর চোখে পড়ে না, ব্যবহারটিও ভারি মিষ্টি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সেই মাঝরাতে টলতে-টলতে বাড়ি ফেরা যে একটুও বন্ধ হয়নি তাঁর বড় ছেলের। তবে আজকাল যেন সতীশ একটু চুপচাপ হয়ে গেছে। বোধহয় ওর হাতে তেমন টাকা পয়সা নেই। কদিন আগে তিনি দেখেছেন শোভনার গায়ের ব্লাউসটা ছেঁড়া। বেচারি আঁচল দিয়ে ঢেকে রাখার চেষ্টা করেছিল। ননিবালার দুঃখ হয় , চুপ করে থাকেন ।

আজকাল তাঁর ঘুমের যেন কোন নির্দিষ্ট সময় নেই। ভর দুপুরেও চোখের পাতা টানটান থাকে ।  আবার বিকেল হলেই দুচোখে ঘুম নামে। ঘরের সামনে যে লম্বা বারান্দা, এটায় এসে বসেন তিনি। সতীশের বাবার কাছে এই লালরঙা সানবাঁধানো বারান্দার বায়না করেছিলেন তিনি । তখন একটু একটু করে বাড়িটা তুলছেন তাঁরা। গরমকালে পাটি পেতে বাচ্চাদের নিয়ে শুতেন। বেশ কয়েকবছর পরে, একটু টাকা পয়সার সুসার হলে সিলিং ফ্যান লাগানো হল। ঠাকুরঝি আর ঠাকুরজামাইও এসে মেঝেতেই শুয়ে পড়ল সেবার। তারপর সারারাত আকাশের দিকে তাকিয়ে কত গল্প ! তাঁর স্বামী ঠাকুরঝি ঠাকুরজামাই সব একে একে গত হলেন। রইলেন পড়ে তিনি একা।

ভাবনাচিন্তায় বাদ সাধলো নাতনি সোনাই। হাতে তাঁর রাতের খাবার। ফ্রকটা গুছিয়ে বসে পড়ল মেঝেতে। এঘরে একটা পিতলের কলসি আছে। বড় কাঁসার গ্লাসে একগ্লাস জল, বাটিতে রুটি ও দুধ সুন্দর করে বেড়ে দিয়ে ডাক দিল, “ঠাকুমা নীচে নেমে এসে বস।” একটা পিঁড়ি পেতে বাম হাত দিয়ে মুছে দিল খানিক।

– তা তোর মার কী হলো রে? সে তো দেখলাম সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালালো !

– হুঁম , একটু আগে দু বার বমি করল।  পেট গরম করেছে। ওবেলায় চিংড়িমাছ খেয়েছিল। বোধহয় হজম হয় নি।

– মাথায় বেশ করে তেল জল লাগিয়ে দিস তো। বড্ড পেট রোগা মেয়েটা। এই আমাকে দেখ , তিনকুড়ি-দশ পার করেও লোহা হজম করে ফেলি!

খাওয়ার পাট চুকলে ননিবালা ধীরে ধীরে বারান্দার পুব কোনে খাওয়ার ঘরের দিকে যান। দেখেন নাতনি বসে সরু সরু করে আলু কাটছে। তাঁর দিকে ফিরে অল্প হেসে বলল , “রাতে আলুভাজা আর ডাল ভাত খাব ঠাকুমা।”

ননিবালার জিভে জল আসে। সর্ষের তেলে ভাজা মুচমুচে আলু আর মরিচ পোড়া দিয়ে ভাত খেতে তাঁর বড্ড সাধ হয়। তিনি সরে আসেন। আসার পথে বড়বৌমার ঘরের কাছে থমকে দাঁড়ান,একবার খোঁজ নেবেন ভাবে। দরজা অবধি যেতেই কানে আসে ওদের কথাবার্তা।

– তুমি একটু বুঝে খেতে পারো না ?

– অল্পই তো খেলাম। মাত্র চারটে ছোট চিংড়ি পড়েছিল পাতে।

– আজ রাতে স্রেফ জল মুড়ি খেয়ে থেকো।

– অথচ দেখো, মা দু বার চেয়ে খেল। দিব্বি হজম …

– মায়ের তো নোলা একটু বেশিই , তা তো তুমি জানো। তবু বলছি চাইলেও দিও না। শেষে রোগে পড়লে বিপদ।

– চাইলে না দিয়ে পারা যায় নাকি?

ননিবালা সরে আসেন। নিজের বিছানায় শুয়ে জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকেন। কৃষ্ণপক্ষের কালো আকাশ তাঁকে আরো দুঃখী করে তোলে। রাত বাড়ে । খুব যে একটা লোডশেডিং হয় তা নয় , তবু আলো নিভিয়ে একটা লন্ঠন মৃদু জ্বালিয়ে রাখা হয় তাঁর ঘরে। বার দুই উঠে জল পান করেন তিনি। বার দুই লন্ঠন নিয়ে পেচ্ছাপ করতে যান।

 

বাড়ি শুদ্ধ সবাই ঘুমে। নিশুতি রাত কথা বলে ঝিম ঝিম ঝুম ঝুম খস খস শব্দে । ননিবালার খিদে পায়। বোঁদের লাড্ডু খান দুই তিনি বাটিতে প্লেট চাপা দিয়ে রেখেছিলেন। ওদুটো খুঁটে খুঁটে সময় নিয়ে খান। এতে সময় কাটে খানিক, পেটও ভরে খানিক।

এখন কত রাত কে জানে ! দূরে একটা শিয়াল ডেকে উঠল। খানিক বুঝি চোখ লেগেছিল। ঢাকের শব্দে ঘুম ভাঙল তাঁর। মন্দিরে পূজা হচ্ছে। সতীশের পরে ১৯৩৮ সনে তাঁর দ্বিতীয়  পুত্র জন্মে ছিল , নাম ছিল রমাপতি। সেদিনও ছিল কালীপুজো। তবে এবারের মতো ভাদ্রের কালীপুজো নয়। কার্তিক মাসের কালীপুজো ছিল সেটা। একটু রুগ্ন মতোন ছিল সেই ছেলেটি। শাশুরিমা বড্ড আদর যত্ন করতেন তাঁর এই দ্বিতীয় নাতিটিকে। অত বড় আকাল গেল ‘৪৩ সনে ! তারপর  রোগব্যাধিতে দেশের মানুষ পড়ল এক আতান্তরে। বেঁচে থাকাই যেন দায়। সেসব সামলে উঠেছিল ওই রুগ্ন ছেলে। কিন্তু পরে এগার বছর বয়সে,  সামান্য জ্বর বমি সামলাতে পারল না! চলে গেল  সে।

মাথায় দেশ ভাগ নিয়ে দেশ স্বাধীন হলো। তবু তাঁরা রয়ে গেলেন। বর্ষায়  টিনের চালের ফুঁটো টিন বদলে নিলেন নিয়ম মাফিক। কিন্তু দেশে গোলমাল একটা রয়েই গেল। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক যেন চিনতে পারল না এই বাংলার মানুষের মন।   তারপর হঠাৎ বছর এগারো বয়সে  রমাপতির মাত্র দুদিনের জ্বরে চলে যাওয়ায়  বাকি পাঁচটি সন্তান থাকা সত্বেও ননিবালা কেমন যেন ভেঙে পড়লেন। এদিকে রাজনৈতিক পরিস্থিতিও দিনযাপনের জন্য প্রতিকূল হয়ে উঠছিল, তার ওপর এতবড় একটা শোক! তাঁদের পরিবারটি যেন খুব সমস্যায় পড়ে গেল। কী করবেন তাঁরা? পাড়া প্রতিবেশীর মতো তাঁরাও কি দেশ ছাড়বেন? এসব ভাবতে ভাবতে  মানসিক ভাবে ভেঙে যাওয়া পরিবারটি  তবু কয়েক বছর কাটিয়ে দিল ।

আজ একটু ঘুম ভাঙতে দেরি হল। উঠোনে গোবরের বালতিটা খালি দেখে বুঝলেন হয় শোভনা নয় সোনাই গোবর-ছড়া দিয়ে উঠোন ঝাঁটিয়ে রেখেছে। ননিবালার একটু লজ্জা করল। ইস, তিনি তো মাত্র  দুএকটা ছোটখাট কাজ করে সংসারে সাহায্য করেন । তাও আজ পারলেন না ! যদিও এসংসারে তাঁকে অভিযুক্ত করার তেমন কেউই নেই।

সে ছিল তাঁর কম বয়সে। দেশের বাড়ির ওই বিরাট উঠোন ! কম করে সত্তর পঁচাত্তর জন পাত পেড়ে বসে খেতে পারে! সে উঠোন তিনি আর তাঁর জেঠতুতো ননদ ঊষা পরিষ্কার করতেন। একটু ময়লা, শেওলা এসব থাকার উপায় ছিল না। জেঠি শাশুড়ি কত বকতেন। নিজের মেয়েকেও ছেড়ে কথা বলতেন না। দেশভাগের আগেই ওরা দেশ ছেড়ে ঊষার মামার দেশ পাটনায় চলে গেল।

তখনো তাঁর এত খিদে পেত না । মুখ ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে রান্নাঘরের সামনে একটা পিঁড়ি পেতে বসলেন তিনি । ছোট নাতিটা কী রকম কেঁচোর মতো দেখতে সাদা সাদা চাউমিন না কি একটা খাচ্ছে। দেখে বেশ লোভ হলো। নাতি বললে,

– একটুকু খাবা নাকি ?

– দিবি তো দে একটু খানিক।

– পিঁয়াজ দেওয়া কিন্তু।

– আজ তো রবিবার। আজ আমি আমিষ খাই।

হাত পেতে দুচামচ চাউমিন নিয়ে খেতে খেতে তিনি ভাবেন, তিনি সব খেতে পারেন। ঘন ঘন খিদে পায় তাঁর। পেটের ভিতরে বুঝি অগ্নিদেব বসে থাকেন। আড়ালে আবডালে সবাই তাঁর খাওয়া নিয়ে হাসাহাসি করে। তিনি সব জানেন কিন্তু কিছুই করতে পারেন না। তাঁর খিদে মোটেও তাঁর শাসন মানে না। এরপর তিনি চা খেলেন। দুধ ছাড়া চিনি চা আর আদা থেঁত করে ফুটিয়ে দেওয়া। সঙ্গে এক বাটি মুড়ি। বেশ লাগে তাঁর। তারপর বেলা দশটা নাগাদ আবার হয় চিড়ে মুড়ি কিছু একটা, সঙ্গে  খানিকটা গুড় খাবেন।  আজকাল দুধের দাম বেশ একটু বেশিই। বাড়িতে একটা পোষা গাই আছে। শোভনা তাঁর রাতের জন্য আর ছেলে মেয়ে দুটোর জন্য পোয়া দুই দুধ রেখে বাকিটা বিক্রি করে। এখন এদের টাকা পয়সার দরকার। ছেলে তাঁর ছোটখাট চাকরিতে তেমন কুলিয়ে উঠতে পারছে না। শহর থেকে তিন মাইল দূরের এই গ্রামেও সম্প্রতি প্রমোটারের নজর পড়েছে। চাকরির সুবাদে আসা ভিন্ন জেলার মানুষ ফ্ল্যাট বাড়ি কিনে থাকতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে । এসব তিনি শুনেছেন , বুঝেছেন। তিনি অরাজি নন। ছেলে যেখানে তিনিও সেখানে, এ ভবিতব্য তিনি মেনে নিয়েছেন।

পুকুরপাড়ে দক্ষিণদিক ঘেঁষে কাঠাখানেক জমি আছে। ওখানে আম পেয়ারা নারকেল সুপারি গাছের সঙ্গে বেশ অনেক আগাছা জন্মেছে। ননিবালাদের একটা পেয়ারা গাছ আছে। তিনি সকালের জল খাবার খেয়ে একটু পুকুরপাড়ে যান। এটা সেটা খুঁজে পেতে আনেন। কখনো কলমি তো কখনো গিমা শাক। বউমা রান্না করে দেয়। আজো তিনি গুড় মুড়ি খেয়ে আধ ঘন্টা বিশ্রাম নিয়ে ঘাটপাড়ে চললেন। তাঁর যে খুব খিদে , তাই বাগানে ঢুকে  কখনো পাকা করমচা, আমের দিনে আম বা আতা এক আধটা খেয়েও ফেলেন। দুদিন আগে তো কাজের মেয়ে লক্ষ্মী দেখে বলেই ফেললো , হ্যাঁ গো ঠাকুমা, এই তো ঘন্টা খানেক আগেই চিড়ে দই খেলে ! এ বাপু তোমার চোখের খিদে। তারপর গলা নামিয়ে বললো, বড্ড নোলা বুড়িটার। পেয়ারা গাছ তলায় এসে দেখলেন ফুল ধরেছে গাছে। পেয়ারার জাতটা বেশ ভালো তবু তাঁর বাপের দেশের মতো নয়।

স্বরূপকাঠি বরিশাল জেলায় ছিল তাঁর বাপের দেশ। স্বরূপকাঠির পেয়ারা ছিল সেযুগের বাংলাদেশে বিখ্যাত।   গোলাকার, ফলের উপরিভাগ অমসৃণ এবং শাঁস সাদাটে, খুব কম  বীজ আর খুব  মিষ্টি।

এসব ভাবতে ভাবতে আমড়াগাছের নিচে এসে দেখেন ক’টা পাকা আমড়া পড়ে আছে। একটা তুলে খেয়ে ফেলেন তিনি। বেশ টক-মিষ্টি আমড়াগুলো। বাকিগুলো কোচড়ে ভরে ঘর মুখে চললেন ননিবালা।

 

আজ বৌমার বাপের বাড়ি থেকে বেশ কয়েকজন আত্মীয় স্বজন আসবে। তাঁরা নাকি থাকবে দিনকয়েক । এ গ্রামে ভদ্রমাসে একটা মেলা বসে। আজ থেকে শুরু, শেষ সেই সংক্রান্তিতে। ধুমধাম করে মনসা পুজো হয় সেদিন। এসব দেখতে প্রতিবারই দুচার জন আত্মীয়স্বজন  এসে থাকে। টেনেটুনে চলেও যায় তাঁদের।  বরং আনন্দ হয় বেশ খানিক। সন্ধ্যায় পাঁপড় জিলাপি এসব টুকটাক খাওয়া হয় এ ক’দিন।

বিকেলে বউমা শোভনার খুঁড়তুতো বোন  রিনা তাঁর দুই ছেলে নিয়ে এসে হাজির। ছেলেগুলো এই ছ সাত বছরের। ভারী দুস্টু আর মিষ্টি। এসেই  হৈ হৈ করে বাড়ি মাথায় তুললো। দিদিমা দিদিমা করে ননিবালাকে  অস্থির করে তুলল। বেশ কাটছিল সময়টা।

এখন যেন আকাশের মুখে হাসি ফুটেছে। বৃষ্টি আর নেই। আকাশে কত সাদা সাদা মেঘ। রাতে তিনি বারান্দায় এসে বসেন । একটা ঝুমঝুম শব্দ আর ব্যাঙের ডাকের মাঝে শরৎ এর গন্ধ পান তিনি। গেটের গোড়ায় লাগানো শেফালিগাছ থেকে শেফালিফুলের গন্ধ নাক টেনে নেন। কেমন যেন একটু খিদে খিদে পায় তাঁর। বারান্দার বাদিকে কোনে একটা ছোট্ট ভাড়ার ঘর আছে। আলোটা জ্বেলে ওঘরে ঢোকেন। দেখেন ঘরের এক ধারে জানলার নীচে একটা বোঁদের লাড্ডু পড়ে আছে। ভাবলেন হয়ত বয়ামে রাখতে গিয়ে পড়ে গেছে। তুলে ফুঁ দিয়ে ধুলো ঝাড়লেন। কে জানে ধুলো গেল কিনা! তিনি তো সবই হজম করে ফেলেন। তাই লাড্ডুটা একটা ছোট বাটিতে নিলেন সঙ্গে চারটি মুড়িও নিলেন। এসে বারান্দায় পা মেলে বসে খুঁটে খুঁটে খেতে শুরু করলেন। রিনার বাচ্চাটা ঘুম চোখে উঠে এসে বানান্দায় দাঁড়িয়ে উঠোনের দিক মুখ করে পেচ্ছাপ করল । চলেও যাচ্ছিল, কিন্তু ননিবালাকে দেখে এগিয়ে এসে বললো,

– কী গো এখানে বসে আছো যে ? ভুতের ভয় করে না তোমার ?

– না ভাই। আমি যে হইলাম গিয়া বুড়া মানুষ। বুড়া মানুষরে ভুতে ধরে না।

– ওমা তাই ! তা তুমি কী খাচ্ছ ?

– লাড্ডু । খাবা ?

– তা দাও একটু ।

একটু ভেঙে তাকে খেতে দিলেন তিনি। তারপর ধীরে ধীরে নিজের বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লেন।

পরদিন খুব সকালে হৈ চৈ শুনে ঘুম ভাঙল ননিবালার। রিনার ছেলে বিল্টুর খুব পেট ব্যথা আর বমি হচ্ছে। ছেলেটা একদম কাতর হয়ে পড়েছে। তিনি শুনেই দোর গোড়ায় গিয়ে দাঁড়ালেন , শুনলেন রিনা জিজ্ঞেস করছে,

– কী রে লুকিয়ে উল্টোপাল্টা কিছু খাস নি তো

– রাতে দিদিমার থেকে অল্প একটু লাড্ডু খেয়েছিলাম তো।

– লাড্ডু!

শোভনা ঘুরে তাঁর দিকে ফিরে জানতে চাইল যে তিনি লাড্ডু কোথায় পেলেন। এই প্রথম শোভনা সব শুনে রেগে দুঃখে কেঁদে ফেললো। ঝাজ মেশানো গলায় বললো, মাটিতে পড়ে থাকা খাবারও আপনার নজর এড়ায় না। সত্যি বাপু নোলা বটে আপনার !

তারপর জানা গেল, ওই লাড্ডুতে ইঁদুর মারার বিষ মাখানো ছিল। ইঁদুরের উপদ্রব খুব বাড়ায় সতীশ এই ব্যবস্থা নিয়েছে। বিল্টুকে নিয়ে সতীশ স্থানীয় স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ছুটে গেল।

ননিবালা ঘন্টা তিনেক চুপ করে বসে রইলেন। সোনাই এসে খবর দিল বিল্টু এখন অনেকটা ভালো। তবু ওকে আর একটু দেখে তারপর ছুটি দেবে। অল্প লাড্ডু খেয়েছিল তাই রক্ষা।

আচ্ছা তিনিও তো বাকি লাড্ডুর সবটা খেলেন। কই তাঁর তো কিছু হলো না! কেউ তো তাঁর খোঁজ নিল না! তাহলে কি আর  তাঁর জীবনের কানাকড়িও দাম নেই। ধীরে ধীরে উঠলেন। নিত্যকার মতো কলসিটা হাতে নিয়ে পুকুরের দিকে হাঁটা দিলেন ননিবালা।

মতামত ও বানানবিধি লেখকের নিজস্ব 

Tags: ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ