29 Jan

শেষের আগে

লিখেছেন:নন্দিতা সিনহা


কোর্ট থেকে বেরিয়ে দুজন দুদিকে হাঁটা লাগালো । আর্য একবার মুখ ঘোরালো, বীথি উঠে যাচ্ছে সাদা বাসে । ও এখন চলে যাবে সলপ । আশা করেছিলো আর্য একবার যদি তাকায় । না । বাসটা ভিড় সাঁতরে বেড়িয়ে যাচ্ছে দক্ষ সাঁতারুর মতো । চকিতে মনে পড়ে গেলো কোচিং এর দিনগুলো । দুজনার-ই মা জেনে গিয়েছিলো তাঁদের মধ্যে চোরা প্রেমের কথা । কোনও অতি উৎসাহী বন্ধু বলে দিয়েছিলো হয়তো । তুমুল শাসন জারি হয়েছিলো । কিন্তু একেবারে মাধ্যমিক পরীক্ষা সামনে । তাই টিউশান ছাড়ানো হয় নি । দুজনের মা-ই ভেবেছিলো ছাড়াতে হলে ও ছাড়াক, আমি ছাড়াবো না । কাজেই দুজনেই রয়ে গেল টিউশানে । সারাক্ষণ কেউ কারোর সাথে কথা বলতো না  । কিন্তু সাইকেল টা বাঁক নেবার আগে ঠিক একবার তাকাতো । সেই মুহূর্তটার জন্যে আর্য অপেক্ষা করে থাকতো উদগ্রীব হয়ে । চকিত দৃষ্টিপাত তারপর আবার পরের বুধবারের অপেক্ষা । কি যে ছিল সেই তাকানোতে ! হঠাৎ খেয়াল হলো আর্যর, সে কোর্টের গেট ছেড়ে এক পাও এগোয় নি । চারপাশে ব্যস্ত ভিড় । কেমন যেন অসুখী অসুখী মুখের ভিড় । হাসপাতাল আর কোর্ট এই দুই জায়গাতে গেলেই কেমন যেন বিষাদের গন্ধ পায় সে । বুকে চাপ ধরে ।

সচরাচর এসময় বাসে বসার জায়গা পাওয়া যায় না । কিন্তু আজ বেশ ফাঁকা জানলার ধারে একটা সিটে বসে ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে কোলে রাখলো বীথি । শীতলপাটির ওপর শান্তিনিকেতনী কাজ করা এই বাহারি ব্যাগটা মামনি দিয়েছিলো বিষ্ণুপুর মেলা থেকে কিনে । যেখানেই যেত মামনি তার জন্যে কিছু-না-কিছু আনতো । এমন কি শিবপুরের কোনো শপিং মলে গেলেও তার জন্যে একপাতা টিপ অন্তত আনত । প্রথম দিকে খুব খুনসুটি হতো সে সব নিয়ে । মামনি বলতো – বিকি, তুই এতো হিংসুটে কেন রে ? ওর জন্যে কিছু আনলে এমন করিস কেন ? তুই কি টিপ পরবি ? না কি ক্লিপ লাগাবি ?                                                                                            অবুঝ অভিমানে সে বলতো – তা জানি না, তবু কিছু আনবে হাতে করে । যা হোক কিছু । প্রথম প্রথম এ সবে মজা পেত বীথি । রাতে মজা করে আদর করে মুড ঠিক করতো আর্যর । কিন্তু পরে ধীরে ধীরে তার স্বার্থপরতা প্রকট হতে থাকে । মামনির জন্যে হঠাৎ ভীষণ কান্না পেল বীথির । দাঁতে দাঁত চেপে গিলে নিল কষ্টটা । আসবার সময় তাকে জড়িয়ে হাউহাউ করে কাঁদছিল মামনি । বাপি বসে ছিল চেয়ারে মুখ গুঁজে । খবরের কাগজে জলের ফোঁটা পড়তেই ডাইনিং স্পেস থেকে উঠে ঘরে চলে গেলো । সেটা খেয়াল করে বীথি ডাকতে যাচ্ছিল । কিন্তু আর্য ওপর থেকে নেমে বাবার ঘরে গিয়ে গলা তুলে বলে, — এসব নাটক করা বন্ধ করবে তোমরা ?

মামনি বললো – তুই সত্যি চলে যাচ্ছিস রুনু ? তারপর সে কি কান্না । – দেখছ তো তোমার ছেলের কাছে এসব নাটক ? ও যে আর চাইছে না আমি এ বাড়িতে থাকি । আমি ও আর পারছি না মামনি ।                                                                                         – কোথায় থাকবি রুনু ? মায়ের কাছে ?                                                                                                                                  – মায়ের কাছে যে থাকার উপায় নেই তা তো জানো। আপাতত যাই, তারপর খুঁজে নেব কোনো লেডিজ হোস্টেল বা পেয়িং গেস্ট ।

– তোর যে কষ্ট হবে রুনু ?                                                                                                                                                          – তোমার কাছে এই ক’বছরেই যা জেনেছি, আরাম কাকে বলে । তার আগে তো শব্দটার সাথে পরিচয় হয়নি । এখন অনেক অভ্যাস ছাড়তে হবে আবার । কষ্ট হবে, তবু…..

– মাঝে মাঝে ফোন করিস মা । রুনু আর দাঁড়াতে পারেনি । এক ছুটে উঠে পড়েছিল ওলাতে । পায়ের ব্যথা নিয়ে মামনি সুটকেসটা তুলে দিলো গাড়িতে ।

– পৌঁছে জানাস রুনু ।

দু চোখের অবাধ্য জলটা মোছে বীথি । ব্যগটাতে পরম মমতায় হাত বোলাতে থাকে । ফোনটা হাতে নিয়ে ফোন করতে যায় । থমকে যায় একটু ……কি বলবে মামনি কে ? আমরা এবার আইনত ভাবে আলাদা হয়ে যাবো ?

জজ সাহেবের ভারি গলা এখনো কানে বাজছে আর্যর । থার্টিন বাই বি হিন্দু ম্যারেজ এক্ট অনুযায়ী আপনাদের ডিভোর্স ফাইল করা হলো । এরপর আপনারা ছ মাস সেপারেট থাকবেন । তারপর ডেট পড়লে এ্যপিয়ার হবেন ।তারপর…..দুজনার দুটো উকিল একসাথে বেরিয়ে গেলো এজলাশ থেকে । আর্য তাকিয়ে দেখে দুই উকিল চা খেতে খেতে কিছু একটা আলোচনা করছে বেশ মনোযোগ দিয়ে । সে বুঝতে পারে তাদের-ই কথা আলোচনা হচ্ছে । যা সবাই আলোচনা করে, এতো ভালো মেয়ে বীথি, এতো ভালো চাকরি করে, এতো হাসিমুখ, তাও কেন থাকতে পারলো না আর্য ? বীথির বন্ধুরা প্রশ্ন করে, কি লড়াই করলি বিয়েটা করার জন্যে, আর টিকিয়ে রাখতে পারলি না ।

বীথির ঠোঁট নড়ে শুধু । যন্ত্রণাগুলো শব্দদের পিষে মারে । কষ বেয়ে ফেনা ওঠে শব্দ দের । মরে যেতে যেতে শেষবার উচ্চারণ করতে চায় আমি বুঝতে পারিনি, বুঝতে পারিনি একটুও । বুঝতে পারিনি, ধরতে পারিনি একটুও ওর মানসিক বিকার । কতদিন হাতে হাত ছুঁয়েছি, নিরালা পার্কের সন্ধ্যায় তার আঙুল নিয়ে খেলেছি । শরীরের প্রতি কোষে তখন আগুনের গোলা ছুটছে বীথির । আরেকটু ঘনিষ্টতা চেয়েছি, একটু বেপরোয়া । কিন্তু আর্য যেন মনের কথা বুঝতে পেরে ছিটকে উঠে পড়ত । রাগ হতো বীথির, সাথে অহংকার ও হতো আর্যর মানসিকতার জন্যে । আত্মশ্লাঘা বোধ করতো । তার আর সব বন্ধুরা যখন ইউজ এ্যন্ড থ্রো সম্পর্কে ভাসছে তখন নিজের প্রেমের প্রতি কত শ্রদ্ধাশীল আর্য । নিজেকে সংযত করে নিত বীথি । বাড়ি ফিরে শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে একটু একটু করে নিভিয়ে দিত শরীরে জ্বলে ওঠা শিখাগুলোকে । কিন্তু বিয়ের পরে সমস্যা বাড়তে থাকে । বুঝতে পারতো না বীথি । কেন এতো শীতলতা আর্যর । সে যখন অস্থির কামনায় উত্তাপ বিনিময় করতে চেয়েছে, মিলতে চেয়েছে প্রতি কোষে কোষে তখন কেন আর্য সপসপে ভিজে যাওয়া পোশাকের মত ঠাণ্ডা । কারণ খুঁজতে চাইতো মরিয়া হয়ে । অসহায় লাগতো নিজেকে । স্বয়মাগতা হতে চেয়েছে কতবার । কিন্তু বরফ গলে না কিছুতেই ।  তারপর একদিন রাতে ধরে ফেলে বীথি ।

সেদিন ছিল শনিবার । সিনেমা দেখে এসে দুজনেই ক্লান্ত ছিল খুব । কিন্তু তবু ভেতরে ভেতরে এক অদম্য অভীপ্সা নিয়ে শুতে এলো বিছানায় বীথি । বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল আর্য । আর দেখছিল বীথির রাত পোশাক পরা শরীরে কিভাবে নিজেকে প্রস্তুত করছিলো । ক্রিম মেখে চুল বেঁধে বিছানায় যাবার আগে ডাকলো আর্যকে । আর্য বড় অসহায় বোধ করে এই সময় গুলোতে । ধিক্কার দেয় নিজেকে এই কু-অভ্যাস টা ধরার জন্যে । সিনেমার গল্পে, নানা কেজো অকেজো কোথায় নিবৃত্ত করতে চাইলো বীথিকে । পারলো না ।গভীর আশ্লেষে জড়িয়ে নিল বীথি শরীরের সাথে শরীর কে । তীব্র চুম্বনে সে এক নিশ্বাসে পান করতে চাইলো সব টুকু । সাড়া দিল আর্য, কিন্তু প্রাণহীন । তীব্র অতৃপ্তি নিয়ে উঠে গেল আর্য । বীথিরও ক্লান্তি লাগছিলো । কান্না আসছিলো, যেমন আসে প্রতিবার । কোথায় সেই তীব্র তৃপ্তির অনুরণন, যা এতদিন গল্পে শুনেছে বিবাহিত বান্ধবীদের কাছে । একটু পরেই সারাদিনের ক্লান্তি আর অবসাদে ঘুমিয়ে পরে বীথি । মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখে আর্য মোবাইলে পর্নোগ্রাফি দেখছে । সারা মুখে জ্বলজ্বল করছে এক আলো, যার কিছুটা ফোনের, কিছুটা কামের কিছুটা বা বিকৃতির । বীথি উঠে বসে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে । কি করবে এখন ? সারা শরীরে যেন চাবুক পড়ছে সপাসপ । আর মিলে যাচ্ছে যন্ত্রণার উৎসমুখ । গলগল করে বেরিয়ে আসে ধিক্কার, অপমান, যন্ত্রণার পিণ্ড পাকানো দলা দলা লাভা । তাই, তাই আর্য টাকে সবটা দিতে পারে না । তাই এড়িয়ে যেতে চায় বিছানায় । ঘুমের ক্লান্তির ভান করে । কি করবে এখন সে । কেড়ে নেবে মোবাইলটা । নাকি অপেক্ষা করবে আর্যর তন্ময়তা ভাঙার । মনে পড়ে যায় মনোবিদ বন্ধু কল্যানীর কথা । প্রায়-ই বলতো আমরা সম্পর্কের মাঝে ফাঁক টুকু রাখতে ভুলে যাই বলেই একে অন্যের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ি । প্রত্যেকের একটা নিজস্ব জগত থাকবে তো !

নিশ্চয় থাকবে ।  সেটা বিশ্বাস করে বীথিও । তাবলে সেটা এমন অপমানের, লাঞ্ছনার । তার অন্য বন্ধুরা যখন শেয়ার করে তাঁদের উদ্দাম অভিজ্ঞতা, বীথি কুঁকড়ে থাকে । সবাই তাকে পীড়াপীড়ি করে – কি রে তুই কি সেফ ডিপোজিট ভল্ট থেকে কিছু ছাড়বি না ? হাসে বীথি । আর কারণ খোঁজে । ভাবে, কি নেই তার ? যার জন্যে আর্য কোনো আকর্ষণ খুঁজে পায় না তার শরীরে । অথচ তাকে কি অসম্ভব ভালোবাসে সেটা বোঝা যায় । তবে কি শরীর আর মন দুটো আলাদা আলাদা কায়া ?  এই মুহূর্তে উত্তরটা জ্বলজ্বল করছে স্ক্রিনে । কোনো সাড়া দেয় না বীথি । নিঃশব্দে শুয়ে পড়ে । এসির একটানা যান্ত্রিক আওয়াজ গ্রাস করে তার সব অভিমান লজ্জার বোবা কান্নাকে ।

বন্ধুদের প্রশ্নটা আর্য কে ঘুণ পোকার মতো একটানা কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে গত পাঁচ মাস । জজ সাহেবের দেওয়া সময় আর মাত্র এক মাস হাতে আছে । এই পাঁচটা মাসের প্রতিদিন প্রতিক্ষন সে পূর্ণ মনোযোগে কোনো কাজ করতে পারেনি । বুঝতে পেরেছে বীথির যন্ত্রণা কষ্ট । কিন্তু সে বেরিয়ে আসতে পারেনি তার বদভ্যাস থেকে । ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় থেকে এর শুরু । হঠাৎ করে মোবাইলে একটা ছবি চলে আসে । ক্লিক করে একটু দেখার পরই থেমে যায় ভিডিওটা । ফুটে ওঠে একটা এ্যাপের নাম, একটা লিঙ্ক । নির্দোষ কৌতূহলে সে ক্লিক করে ছবিটি দেখে । সাড়া শরীরে আগুনের ছোটাছুটি আর মনে তীব্র অপরাধ বোধে জারিত হতে হতে স্নানঘরের নির্জনতায় সে প্রথম পুরুষত্বের উপলব্ধি পায় । তীব্র আনন্দে সে যুবক হয়ে ওঠে । কিন্তু অপরাধ বোধে সে পরে কিছুদিন মায়ের দিকে তাকাতে পারতো না । বীথির সাথে কথা বলতে পারতো না চোখে চোখ ফেলে । মা বারবার জেরা করতো – কি হয়েছে তোর বিকি ? উত্তর দিত না । বীথি অভিমান করতো – আর বুঝি আমাকে ভালো লাগে না ? আর্য কি করে বোঝাবে তখন যে এক গোপন রন্ধ্রপথে সে দেখে ফেলেছে এক রোমাঞ্চকর দুনিয়া । সময় তো আগুনের মতো সর্বগ্রাসী । ক্রমে কমে গেল অপরাধ বোধ । আসক্তি বাড়লো । আগে যে সময় গুলো ভরে থাকতো বীথির রোজনামচার ছন্দে, এখন সেখানে জায়গা করে নিল অন্য নারীরা । কতবার ভেবেছে সে সব বলে বীথিকে । কিন্তু পারে না । এ যে তার একান্ত নিজস্ব আনন্দ ।

সাত-আট বছরের মেলামেশার পর বিয়ের কথা আসতে প্রথমে আর্য রাজি হয়নি । একটু ভয় যে ছিল না তা নয় । বারবার ভেবেছে যদি বীথি বুঝে ফেলে, যদি ধরে ফেলে তার গোপন অভিসার । তাহলে ভালো ছেলের যে ইমেজটা বয়ে বেড়াচ্ছে এতকাল সেটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে । কিন্তু ঘটনাটা যে এভাবে মোড় নেবে তা সে স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারে নি ।

সেটা ছিল একটা বন্ধের দিন । বিরোধী পক্ষের বন্ধ । অতএব সরকারি নির্দেশে বীথিকে অফিসে যেতেই হবে । তার দুদিন আগে পায়ে চোট লাগায় আর্য ছুটি নিয়েছিলো চার – পাঁচ দিন । বীথিও দুদিন ছুটি নিয়ে ডাক্তার, প্যাথোলজি ল্যাব সব করেছে আর্যকে নিয়ে । কিন্তু সেদিন অফিস না গেলেই নয় । কিন্তু অফিসে হাজিরা দিয়েই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পরে । সাড়ে তিনটে নাগাদ নিঃশব্দে বাড়ি ঢোকে বীথি । আর্য ঘুমাচ্ছে ভেবে তাকে না ডেকে ঘরে আসে । কিন্তু নীচে তাকে দেখতে না পেয়ে ভয় পেয়ে যায় বীথি । দুবার ডেকে নিচ থেকে সাড়া পায় না । তারপর ওপরে এসে স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে পড়ে । ল্যাপটপের স্ক্রিনে তখন কালো মেয়ের নগ্ন উল্লাসের মোহময় অঙ্গভঙ্গি । আর্য তুমি ? এতো নোংরা ! তাই আমাতে তুমি তৃপ্ত নও ? তাই এড়িয়ে যাও আমাকে ! ছিঃ ! ছিঃ আর্য ! চমকে ওঠে আর্য । তাড়াতাড়ি ল্যাপটপ বন্ধ করে উঠে দাঁড়ায় ।                                                                                                                    তারপর থেকে একটা কথাও আর বলেনি বীথি দৈনন্দিন কাজের কথাটুকু ছাড়া । রাতে শুয়েছে ডাইনিং স্পেসের সোফাতে । অনেক বার ডাকতে গেছে আর্য, আত্মপক্ষ সমর্থন করে আর্য ভাবে এটা তো হতেই পারে । এটা আমার ব্যক্তিগত ভালোলাগা । বীথি যেমন গান শুনতে ভালোবাসে, ওয়েস্টার্ন গান, আমি তেমনই এটা দেখতে ভালোবাসি । আমি তৃপ্তি পাই । এতে এতো ছিছিক্কার করার-ই বা কি আছে ? এড়িয়ে চলবো সেও ভালো কিন্তু পর্ণোগ্রাফি ছাড়বো না । ওদের হাতেই তো আমার কৌমার্যের সমর্পণ ।  কিন্তু বীথির স্থির দৃষ্টি আর ব্যক্তিত্ব দেখে সে যেন তাড়াতাড়ি শামুকের শক্ত খোলসের ভেতর ঢুকে গেছে । যে ব্যক্তিত্বকে একদা ভীষণ পছন্দ করতো আর্য, এখন সেটাই তার বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায় ।

বীথিকে কাঁদার সময় দিল কল্যাণী । বীথি যে নেচারের মেয়ে, তাতে ও এভাবে কান্নায় ভেঙে পরতে পারে ভাবতেই পারে না কল্যাণী । কোনোদিন কোনো কারণে ওর চোখে এমন বন্যা আসেনি । কল্যাণী একবার চেম্বারের বাইরে থাকা মোহনা কে বলে দিল, এখন যেন কোনো পেশেন্ট না পাঠায় । তারপর ঘরে এসে বীথির পিঠে হাত রাখতেই বীথি জড়িয়ে ধরলো কোমরটা । মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে কল্যাণী —

কি হয়েছে ? কিসে এতো কষ্ট পাচ্ছিস ?  আমি বুঝতে পারিনি, বুঝতে পারিনি রে একটুও । এমন পারভার্টেড ও ।                                কল্যাণী ওর মাথায় হাত রাখে ।

প্রেম পর্বে কখনো মনে হয়নি ও ব্যতিক্রমী?

– ও আমাকে সেভাবে কখনো স্পর্শ করতো না । আমি ভাবতাম ওর নৈতিকতা ।                                                                            – কিন্তু শোন বীথি, পর্ণোগ্রাফিতে আসক্ত হতেই পারে কেউ । সেটা মানেই পারভারসান ধরে নিচ্ছিস কেন ?                                       – না তো সেটা ধরছি না । আমিও জানি হতেই পারে । কিন্তু তা বলে ওর নিজের ক্ষমতা                                                                   – কি হলো থেমে গেলি কেন ?                                                                                                                                             – মানে, আমি ঠিক ঠাক বলে উঠতে পারছি না রে ।                                                                                                                      – তোদের নৈশ সম্পর্কটার কি ব্যঘাত হচ্ছে কিছু ?                                                                                                                            – আসল সমস্যা তো সেখানেই ।

চুপ করে যায় কল্যাণী । এই সেদিনই একটা জার্নালে পড়েছে পর্ণোগ্রাফির প্রতি আসক্তির জন্যে পুরুষদের জননতন্ত্রে কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে । নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির পুরুষ প্রজনন স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক ও ইউরোলজির অধ্যাপক জোসেফ এ্যালুকাল বলেন, ‘ স্ক্রিনে দেখা উদ্দীপক দৃশ্য কখনো নারী পুরুষের যৌন উত্তেজনা বাড়িয়ে দেয় ঠিকই, কিন্তু কেউ যদি পর্ণোগ্রাফিতে নিয়মিত অভ্যস্ত হয়ে পড়েন, তাহলে বাস্তব জীবনে তিনি শারীরিক সংসর্গের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারেন।

– কি রে, কি ভাবছিস ?  – ভাবছি তুই যদি নিজেকে একটু মানে.., আর একটু খোলামেলা ভাবে তোর

– তা কি করে হবে ? একটা প্রেমের ফসল আর একটা প্রফেশানালিজম । আর তাছাড়া ও মন থেকে নিতেই পারে না আমাকে । গ্রহন করে না ওর শরীর ও । তাই ব্যর্থতার পর রেগে যায়, বিরক্ত হয় আমার প্রতি । যা ওকে একটু একটু করে স্বার্থপর তৈরি করেছে  ব্যবহারিক জীবনে ।

– তোরা একঘরেই থাকিস তো রাতে ?                                                                                                                                     – না । সেদিন দুপুরের পর থেকে আমি রাতে ডাইনিং স্পেসের ডিভানে শুই ।

– আর্য ডাকতে আসে না ? – না, ও নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে । সব থেকে কষ্ট হয় মামনির জন্যে । শনি রবিবার কুন্তিঘাটের বাড়িতে গেলে কি আদর যত্ন করে ভাবতে পারবি না । মাঝে মাঝেই বলে, এবার একটা নাতি নাতনি দে মা, আমাদের শরীরে ক্ষমতা থাকতে থাকতে মানুষ করে দিই ।

– তুই আর্যকে বলেছিস সে কথা ? – না, বলিনি । কি বলবো ? ওগো আমাকে একটা নতুন প্রাণ দাও । আমাকে একটু…দয়াকরো…. ছিঃ । চেয়েই যদি নিতে হয় বরের কাছে কেন ?  কেন দশ বছরের প্রেমিকের কাছে ?  আর শরীরের আগুন নেভানোর জন্যে জিগালো আছে তো কতো এই শহরে ।

– শোন বীথি, এতো এ্যাডামেন্ট হলে চলে না । এই সময়ে আর্যর সাথে দুরত্ব তৈরি না করে ওর পাশে দাঁড়া , সমস্যাটা নিয়ে আলোচনা কর ।                                                                                                                                                                                        – বাঃ অপরাধ ওর, বিকৃতি ওর , আর কথা শুরু করতে হবে আমাকে । ও আমার কাছে স্বীকার করুক । আমি তারপর ….

– কি সিদ্ধান্ত নিচ্ছিস এখন তাহলে ?                                                                                                                                              – সেপারেশান । কোথাও রেখটার স্কেলে এক চুলও কম্পন ধরা পড়েনি এই বিশাল ভূখণ্ডে । শুধু মনের কারবারি কল্যাণীর ভেতরটা কেঁপে উঠলো ভয়ংকর ভাবে । কি লড়াই করে প্রতিষ্ঠা করা এ সম্পর্ক এভাবে ….?

ঘুম থেকে উঠে ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টাতে গিয়ে থমকে গেল আর্য । নিশ্চিত জানে পাঁচমাস শেষ হয়েছে । তবু ছোটবেলার মতো কর গুনে গুনে নিশ্চিত হলো । আজ ছ মাসে পড়ে গেল । সেই গমগমে গলাটা তার পিছু ছাড়ে নি । পথেঘাটে চোখ রাঙিয়েছে, কাজের টেবিলে কাজ ভুল করিয়েছে । কুন্তিঘাট যাবার রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে । রাতের ঘুম নিয়ে চলে গেছে । তার জন্যে রেখে গেছে অপরাধ বোধ আর ধিক্কার । মা ব্যকুল হয়ে যখন জিজ্ঞাসা করে, কি হয়েছে তোদের ? কি করেছে রুনু ? কি করেছিস তুই ? কেন তোরা ডিভোর্স চাইছিস ? সে বোবা হয়ে যায় । ঘাড় ঝুলে পড়ে । তুই না হয়তো অন্য মেয়ে বিয়ে করবি আবার । কিন্তু আমি রুনুর মতো মেয়ে পাবো কোথায় ?  মায়ের প্রশ্ন আর বাবার কঠিন দৃষ্টি সাড়া শরীরে সপাসপ বেত্রাঘাত করেছে, করেই চলেছে । কতোবার বীথির নম্বরটা বের করেও ফোনটা করতে পারছে না । তার নিজের দোষে এভাবে একটা প্রেম, একটা সংসার ভেঙে যাবে ? একটা সম্পর্কের গায়ে লেগে যাবে ডিভোর্সের তকমা ?

মিটিং সেরে বেরিয়ে ফোনটা নর্মাল মোডে আনার সময় দেখে চারটে মিসড কল । আর্যর । এই পাঁচ মাস পরে মনে পড়লো । বিরক্ত বোধ করলো । নম্বরটা ব্লক করে দেওয়াই তো উচিত ছিল । ছ মাস শেষ হলে কোর্ট থেকে ডেট নিয়ে আসবে উকিল । এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই একটা ছোট্ট মেসেজ । প্লিজ কাল দেখা করো পাঁচটা নাগাদ হাওড়া স্টেশানে বড় ঘড়ির নীচে । প্লিজ বীথি ….

কল্যাণীকে ব্যাপারটা বলতেই লুফে নিল । এই সুযোগটা ছাড়িস না । ওর সাথে একটু আলোচনা কর, বোঝা । দরকার হলে আমার কাছে আন । আমরা সেই এক কোচিং এর বন্ধু । ও আমার সাথে বেশ খোলামেলা ভাবে কথা বলতে পারবে ।                                      – কিন্তু তোর কাছে আনার প্রস্তাবটাও কি আমি দেবো ?                                                                                                              – দিয়েই দেখ না । প্লিজ বীথি একটু ইগোর খোলসটা ছেড়ে বেরিয়ে আয় । একটু অন্যরকম করে কাটাবার কথা ভাব এবারের দেখা হওয়াটা । ও হয়তো বেরিয়ে আসতে চাইছে । ও তো নিজেও ভালো নেই । আর তোর শাশুড়ির কথাটা একবার ভাব । কিভাবে যত্ন করে তোকে উনি অফিস পাঠাতেন, সত্যি বলতে তোর মা সেভাবে কখনো তোকে —-। আমার সব মনে আছে বীথি ।                        – তাহলে দেখা করি ?

হাওড়া ব্রিজ ধরে হাঁটতে হাঁটতে ওদের মনে পড়ছে ওরা কতোবার প্ল্যান করেছে, কিন্তু হয়ে ওঠেনি । এখন ওদের পাশ দিয়ে জনস্রোত, আর নীচে দিয়ে জলস্রোত । মাঝে টুকটাক কথায় ওরা দ্বিখণ্ডিত প্রেম নিয়ে । বড় ঘড়ির তলায় ওকে দেখে বীথি চমকে গেছিলো । কি চেহারা হয়েছে ? মায়ের কাছে থেকেও এ চেহারা হয় কিভাবে ? তবু নিজেকে সামলে নিয়েই বলে কেমন আছো ?                                   – ভালো । তুমি ?

– ভালো আছি । অন্তত সসন্মানে । বলেই সামলে নেয় নিজেকে । কল্যাণী বলেছে সহজ থাকতে ।                                              – মামনি কেমন আছে ?  বাপি ?  মামনি কি এখনো ?

হ্যাঁ সব অভ্যাসই এক আছে । শুধু প্রথম প্রথম দুটো টিফিন বক্স রেডি করে ফেলত অভ্যাসে । তারপর …                                             মা কথা বলে না ভালো করে আমার সাথে ।

ওরা যে ঠিক করেছিলো ব্রিজ ধরে হাঁটবে এমনটা নয় । এমনিই টুকটাক কথা ওদের স্টেশানের বাইরের জনস্রোতে মিশিয়ে দিয়েছে । এখন আপাতত কথা নেই । হাঁটছে চারটে পা একসাথে । গায়ে গা লেগে গেলে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছে বীথি, যেন পথচলতি পুরুষ । আর্য ভাবে – কি ভাবে সেই নিস্পাপ কৈশোরের মন্ত্র শেখা যায় ? বীথি ভাবে –কিভাবে একটা মানুষ পারত নিজের শুধু নিজের তৃপ্তির পর এতো নির্লিপ্ত থাকতে । ভাববে না একটুও যে পাশে শুয়ে থাকা যুবতী মেয়েটির ও কামনা আছে । সেও একটু আদর চায়, নিবিড় সান্নিধ্য চায় স্বামীর, আর পাঁচটা মেয়ের মতো । মা দিব্যি বাবার সাথে ডিভোর্স নিয়ে বাবার বন্ধু তরুন কাকুর সাথে লিভ টুগেদারে আছে । সে কখনো মা কে সাপোর্ট করতে পারেনি । মাকে বোঝাতে গিয়ে মায়ের সাথে দুরত্ব বেড়েছে । এখন সে আর মায়ের কাছে যেতেই পারে না । মাকে সে প্রশ্ন করেছিলো একটা কাগজের সই দিয়েই মুছে দিলে বাবাকে তোমার জীবন থেকে ? পারলে ? বাবার কি কোনো ভালোত্ব তোমাকে বিচ্ছেদ থেকে সরাতে পারতো না ? তুমি বিকল্প পেয়ে ভুলে গেলে বাবাকে ? আজ সে কি করতে চলেছে ? নিজের অপ্রাপ্তিকেই বড় করে দেখছে সে । অথচ সম্পর্কের আটটা বছরে ছায়ার মতো তাকে সান্নিধ্য দিয়েছে, গাইড করেছে আর্য । সেও কি মায়ের জিন দ্বারা প্রভাবিত তবে ?

পায়ে পায়ে ব্রিজ শেষ হতে চমকে গেল যেন একসাথেই । তাঁদের প্রেমপর্বে অনেক না-ফলপ্রসু হওয়া পরিকল্পনার মধ্যে একটা ছিল হাওড়া ব্রিজ হেঁটে পার হওয়া । আজ ভাগ্যচক্রে তা হয়ে যেতে দুজনেই সহসা ই যেন অতীতে ডুবে গেল । আর্য ভাবতে থাকে কি বেশি আর ক্ষতি হতো এর চেয়ে যদি সমস্যাটা আড়াল না করে ওর কাছে কনফেস করতাম । বলতাম আমি ডুবে যাচ্ছি রুনু, বাঁচা যেভাবে হড়কা বানে ভেসে যাওয়া আমাকে বাঁচিয়ে ছিলিস নিজের জীবন তুচ্ছ করে । কেন বলিনি, রুনু, আয় না দুজনে একটু পথ খুঁজে নিই….

এরপর কোথায় যাবো ? বীথির প্রশ্নে চমকে গেল । তারপর হঠাৎ মনে পড়লো গঙ্গার বুকে নৌকায় চড়ার সখ বীথির বহুকালের । জীবনে আর সুযোগ আসবে কিনা জানি না । ফোনটা বের করে ওলা ডাকতে গিয়েই আবার ঢুকিয়ে ফেললো । একটা হলুদ ট্যাক্সি ছিল সামনেই । উঠেই বলল – আউটরাম ঘাট — । আমরা কেউ সাঁতার জানি না, বলেই থমকে যায় বীথি । কি হবে নৌকাডুবি হলে ? মরে যাবে ? — এই তো ? এখন কি সত্যিই তারা বেঁচে আছে !

গঙ্গায় ওরা দুজন শুধু নৌকায় । শীতল হাওয়া এসে লাগছে । বীথির কুর্তির ওপর রাখা হাত অনেকদিন পর নিল আর্য । এই প্রথম রক্তে রক্তে প্রেমজ কামনার বোধন হচ্ছে বুঝল আর্য —  । আমাকে কল্যাণীর কাছে নিয়ে যাবে বীথি?

মতামত ও বানানবিধি লেখকের নিজস্ব

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ