সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট ডিপার্টমেন্টের রিটায়ার্ড সেক্রেটারি দীপ্তেন্দ্র মল্লিকের দাবা অন্ত প্রাণ। দিল্লীর অতিব্যস্ত কর্মজীবনে সময়ের অভাবে অতিপ্রিয় খেলাটির ওপর বিশেষ সুবিচার করে উঠতে পারেননি। অবসর নেওয়ার পর কোলকাতায় ফিরে এতো বছরের অনিচ্ছাকৃত অবহেলা পুষিয়ে নেবার চেষ্টায় রয়েছেন সর্বক্ষণ ।
এর মধ্যেই অভিজ্ঞ চোখে হঠাৎ আবিষ্কার করেছেন পাড়ার মুদিখানার দোকানে হেল্পার বয় কিশোর নশু-র দাবা খেলায় অসাধারণ প্রতিভা। এক বিকেলে বাইরের ঘরে বসে টেবিলে রাখা বোর্ডে একা একাই দুতরফের চাল দিচ্ছেন। নশুকে তার মালিক পাঠিয়েছে দীপ্তেন্দ্র বাবুর বাড়িতে হোম ডেলিভারিতে। সস্তা টি-শার্ট আর হাফপ্যান্ট-পরা নশু জিনিসপত্র বাড়ির ভেতরে পৌঁছে দিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে বোধহয় ট্যারাচোখে দাবার ছকের দিকে নজর রাখছিলো। দীপ্তেন্দ্রবাবুর একটা পালটা চাল দেখে আর সামলাতে পারেনি নিজেকে, তাড়াতাড়ি বোর্ডের পাশে এসে নিজেই কিস্তিমাতের চালটা দিয়েই বুঝতে পারলো লক্ষণরেখা পার করে ফেলেছে !
কিন্তু দীপ্তেন্দ্র মল্লিক একজন কমিটেড দাবাড়ু, অন্য জগতের মানুষ! একাগ্র মনোযোগের কারণে ঘরের মধ্যে অন্য কারুর উপস্থিতি আগে খেয়াল করেননি। এখন দাবার বোর্ডে কিস্তিমাতের চালটা দেখে চোখ তুলে প্রথমে অবাক দৃষ্টিতে নবীন খেলোয়াড়টিকে আপাদমস্তক দেখলেন,অবিন্যস্ত চুল, আধময়লা রঙিন টি-শার্টের দুতিন জায়গায় ছেঁড়ার আভাস,ঢোলা হাফপ্যান্ট,পায়ে হাওয়াই চপ্পল।তারপর উচ্ছ্বসিত প্রশংসার গলায় বললেন, বাঃ, বাঃ, তুই তো বেশ ভালো খেলিস…এই বয়সেই ! নাম কি তোর, কোথায় থাকিস ?
#
সেই থেকে রোজ সন্ধ্যেবেলায় দীপ্তেন্দ্রের দাবা খেলার সঙ্গী নশু। মুদির দোকানের মালিকের সঙ্গে পাড়ার অতীব সম্মানিত ব্যক্তি দীপ্তেন্দ্রবাবুর পাকা কথা হয়ে গিয়েছে, রোজ সন্ধ্যে সাতটার পর নশু পেয়ে যায় বাধ্যতামূলক ছুটি। ঘড়িতে সাতটা বেজে গেলেই চুলে জল চিরুনি বুলিয়ে নশু দৌড়োয় দাদুর বাড়িতে। বোর্ড সাজিয়ে বসে থাকেন দীপ্তেন্দ্র। খেলার সঙ্গে থাকে ভালোরকম টিফিন। সব কিছুই চলছে তো ভালোই। তবু বেচারা নশু বোঝে না এতো বড়ো মানুষটা ( দোকানের মালিক তাকে পই পই করে দীপ্তেন্দ্র বাবুর মান সম্মানের ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিয়েছে ) কি করে তার মতো একটা হাভাতে ছেলের সঙ্গে রোজ খেলতে বসে যান ! পাড়ায় তো দাবা খেলার অনেক বয়স্ক সঙ্গী পেতে পারেন দাদু…ব্যাঙ্কের ম্যানেজার, রিটায়ার্ড জজ, রেলের বড়ো অফিসার !
সাহস করে কথাটা একদিন জিজ্ঞেস করেই ফেললো সে। দীপ্তেন্দ্রবাবু নশুর কথায় শব্দ করে হেসে উঠলেন। হাসতে হাসতেই বললেন, তুই তো আর যেমন তেমন খেলোয়াড় নয় রে নশু। তুই তো জানিসই না যে তুই গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার জন্য জন্মেছিস ! আর তোর সঙ্গে আমার খেলার কথা বলছিস ! দাবার ঘুঁটির বাক্সটার দিকে একবার ভালো করে তাকিয়ে দ্যাখ । খেলা শেষ হয়ে যাওয়ার পরে রাজা, মন্ত্রী, বোড়ে সব একসাথে জড়াজড়ি করে ওই বাক্সে পড়ে থাকে। তাই না ? আমারও তো এখন খেলা শেষ রে নশু ! এখন আমার জন্য আর আলাদা বাক্স কোথায় পাবো বল !
তারপর হাসি থামিয়ে দীপ্তেন্দ্র মল্লিক ধীরে ধীরে যেন স্বগতোক্তির মতো বললেন, ফিউজ হয়ে গেলে আর কেউ দেখে না রে নশু বাল্বটা কতো ওয়াটের ছিলো, সব বাল্বেরই জায়গা হয় ওই ডাস্টবিনে ।
মুদি দোকানের সাদামাটা হেল্পার কিশোর নশু কি যে বুঝলো কে জানে ! বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়লো সে।
Tags: গল্প, দাবা, সিদ্ধার্থ সান্যাল
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।