16 Mar

শেষ কথা

লিখেছেন:দেবাশিস সাহা


।। ১ ।।

শেষ গ্লাসটা পান করে মোবাইলটা হাতে নিয়ে উঠে এসে আবার গাড়িটা বার করলো অমিত।রাত তখন পৌনে একটা মতন হবে। মায়ানগরীর আলো-আঁধারি পেরিয়ে এসে হাইওয়ে ধরে ঘণ্টা দুয়েক চালিয়ে এনে গাড়িটা দাঁড় করাল শহরতলি থেকে বহু দূরে নির্জন,পরিত্যক্ত একটি রিসার্চ সেন্টারে। আজ পাঁচ বছর হয়ে গিয়েছে রূপকথা এই দুনিয়ায় আর নেই, আর এই পাঁচ বছরে মৃতপ্রায় এই ল্যাবে বিজ্ঞানের এমন কিছু সত্যকে সে জন্ম দিয়েছে ও তিল তিল করে বাঁচিয়ে রেখেছে যা তার অবাস্তব প্রতিভা,অদম্য মনোবল নাকি প্রায়শই স্বপ্নে তাড়া করে বেরানো একটি অতীত কিনা তার জানা নেই, তবে বাকি দুনিয়ার কাছে উন্মাদ বিজ্ঞানী অমিত ভাদুরির পাগলামোর আরেকটি নমুনা মাত্র।

ল্যাবের ভিতর এসে আলোটা জ্বাললো সে। তারপর এক এক করে চালু করলো মেশিনগুলো। কাঁকড়ার জাত হামেশাই নিজেদেরকে টেনে-হিঁচড়ে নীচে নামিয়েছে; কৌতুক করেছে; অবহেলা করেছে; শেষে যখন অসম্ভবের সম্ভব হয়ে ওঠাকে মেনে নিতে পারেনি তখন হাতে না পারুক, ভাতে মেরেছে আর এনে ফেলে দিয়েছে এই পরিত্যক্ত ল্যাবে। সময়ের পরিহাসে পাঁচ বছরে অল্প অল্প করে জীবন্ত হয়ে ওঠা সময়ের জানা-অজানা অন্তরালে পাড়ি দেওয়ার পক্ষীরাজটার দিকে তাকিয়ে নিজের কল্পনায় পাঁচ বছর আগের সেই রাত্রির স্মৃতিচারণায় ক্ষণিক যেন হারিয়ে গেল অমিত।

।। ২ ।।

রূপকথা। অমিতের জীবনে একটি আবেগ, ভালবাসা, অবলম্বন হয়ে উঠেছিল রূপকথা। প্রথম আলাপ একটা আইসক্রিম পার্লারে।তারপর, সময়ের হাত ধরে আস্তে আস্তে বেড়ে ওঠা প্রেম ও তারপর বিয়ে। দেখতে দেখতে কেটে যায় সুখী দাম্পত্যের গোটা তিনটে বছর। তারপর, তাদের অ্যানিভারসারিতে ……

আরে হ্যাঁ; সিট বেল্ট বেঁধেছি রে বাবা! তুমি না সত্যিই; আর বার বার এক কথা বোলো না তো; রূপকথা ফোনটা রাখো; রূপকথা ফোনটা রাখো; আরে কিস্যু হবে না; আমার কথা বলতে বলতে ড্রাইভ করা অভ্যেস আছে। আচ্ছা ছাড়ো এসব কথা। এই শোনো না, তোমায় সকালে যে গুড নিউজটা দিয়েছি, রাতে মা-বাবাকে পার্টি থেকে আলাদা করে ডেকে আমরা ওদেরকেও নিউজটা দেব কেমন? আজকের চেয়ে ভালো দিন আর কবেই বা হবে বলো? ওরা যে এতগুলো বছরের অভিমান ভেঙে আমাদের ব্যাপারটা মেনে নিয়ে আসছে,এই তো অনেক –  বলো? …আরে হ্যাঁ, তোমার ফেভারিট পিজ্জা আনছি … আর আইসক্রিমও … এই শোনো না …

ব্যাস! তারপর সব অন্ধকার! তাদের শেষ কথোপকথনগুলো কাকতালীয়ভাবেই গাড়ি চালাবার সময় হাত পড়ে অমিতের ফোনে রেকর্ড হয়ে গিয়েছিল। একটা অভিশাপের মতই সেই শেষ কথাগুলো অমিতকে আঘাত করে যায় আজও। একটা ভীষণ সংঘর্ষের শব্দ! তারপর সব চুপ। ভোররাতের দুঃস্বপ্নের শেষটা যেমন থাকে না ঠিক সেইরকম!

চোখের জল মুছে নিজেকে কোনোমতে সামলালো অমিত। সত্যিই নিছক পাগলামি কিনা জানা নেই তার; তবে আজ কেন জানে না অমিতের মনে হতে লাগলো যদি সেই রাতে সেই সময়ে আরেকবার ফিরে যেতে পারে, তাহলে তার রূপকথাকে আবার ফিরে পাবে সে। সময়ের ওপারে।

মেশিনটায় স্টার্ট দিল সে।সময় বসাল – পাঁচ বছর আগের সেই রাত, সেই স্থান যেখানে অমিতের স্মৃতির অচল একটি খাঁদের কিনারায় এসে উপস্থিত হয়।একটি তীব্র উজ্জ্বল আলো এসে অমিতের চোখের সামনেটা নিমেষে ঢেকে দিল।

।। ৩ ।।

চোখ খুলল যখন, ল্যাবেই নিজেকে পেল সে। তবে কি সবই ভুল ধারণা? নিছক কল্পনা মাত্র? ছিঃ! রাগে – দুঃখে দৌড়ে ল্যাব থেকে বেড়িয়ে এল অমিত। গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিল। হাইওয়ে ধরে তীব্র বেগে ছুটে চলল গাড়িটা।

ঠিক তখনই আচমকাই এমন কিছু একটা ঘটল যার জন্য তৈরি ছিল না সে।

ফোনটা বেজে উঠল! রূপকথার ফোন! এ কি করে সম্ভব? আনন্দে চোখে জল এল অমিতের। সে বিশ্বাস করতে পারছে না। তার কাছে সবকিছু যেন কেমন এক মায়াবী জাদুখেলা বলে মনে হতে লাগলো। গাড়ি চালাতে চালাতেই ফোনটা রিসিভ করলো সে। তাড়াহুড়োয় রেকর্ডিং বাটন-টা কখন টাচ হয়ে গেল বুঝতে পারল না সে।

হ্যালো! রূপকথা? কোথায় তুমি? হ্যালো!

ওপারের কণ্ঠস্বরটি উচ্ছ্বসিত ধ্বনিতে বলে উঠল –

হ্যাপি ওয়েডিং অ্যানিভারসারি ডিয়ার!

অমিত হাতঘড়িতে দেখল বারোটা বাজছে। সব কিছু কেমন যেন গুলিয়ে গেল তার কাছে। তার জীবনের সমস্ত মেলা – না মেলা অঙ্ক গুলো এক মুহূর্তে যেন কেমন মিলে মিশে একাকার হয়ে গেল। আনন্দে আত্মহারা হয়ে ক্ষণিকের জন্য সেসব হিসেব ভুলে গিয়ে ওপারের কণ্ঠস্বরটির সাথে কথা বলতে লাগলো সে। তারপর একসময় –

রূপকথা! – বলে অঝোরে কেঁদে ফেলল অমিত।

কি হল অমিত? কি হয়েছে? তুমি ঠিক আছ? কোথায় এখন তুমি?

কিছু না। হ্যাঁ। সব ঠিক আছে। আমি বাড়ি ফিরছি। তুমিও ব্যাস জলদি বাড়ি ফিরে আসো রূপকথা!

আরে বলো!

না কিচ্ছু না! কিচ্ছু না! তুমি ফোনটা রাখো। ড্রাইভ করতে করতে কথা বলার দরকার নেই। ফোনটা রাখো! আর সিটবেল্ট বেঁধেছ তো তুমি?

আরে হ্যাঁ; সিট বেল্ট বেঁধেছি রে বাবা! তুমি না সত্যিই; আর বার বার এক কথা বোলো না তো; রূপকথা ফোনটা রাখো; রূপকথা ফোনটা রাখো; আরে কিস্যু হবে না; আমার কথা বলতে বলতে ড্রাইভ করা অভ্যেস আছে। আচ্ছা ছাড়ো এসব কথা। এই শোনো না, তোমায় সকালে যে গুড নিউজটা দিয়েছি, রাতে মা-বাবাকে পার্টি থেকে আলাদা করে ডেকে আমরা ওদেরকেও নিউজটা দেব কেমন? আজকের চেয়ে ভালো দিন আর কবেই বা হবে বল? ওরা যে এতগুলো বছরের অভিমান ভেঙে আমাদের ব্যাপারটা মেনে নিয়ে আসছে, এই তো অনেক বল?

চকিতেই অমিতের সারা শরীরে যেন এক শিহরণ খেলে গেল। এই কথা গুলো যে তার খুব চেনা! আর এর পরেই তো……

রূপকথা বলে যেতে লাগলো – আর হ্যাঁ, তোমার ফেভারিট পিজ্জা আনছি … আর আইসক্রিমও… এই শোনো না …

তারপর ? চৌমাথাটার লোডশেডিং আর অমিতের নেশাতুর চোখের অন্ধকারে নিমেষের মধ্যে তার গাড়িটা বাঁদিকের থেকে ধেয়ে আসা আরেকটি গাড়িকে সজোরে ধাক্কা মারল!

ভাগ্যের পরিহাস, সময়ের গোলকধাঁধা, নাকি অবিনশ্বর কোনো শক্তির বিধান; ফোনের ওপারে বলা রূপকথার শেষ কথা গুলো সময়ের এপারে এসেও একটুও বদলানো গেল না!

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ