02 Jul

বাসা বদল

লিখেছেন:রূপা সেনগুপ্ত


আমার জন্ম ওপার বাংলার মানিকগঞ্জের  এক গ্রামে। আমাদের গ্রাম থেকে আধ ঘন্টা লাগত কালিগঙ্গা নদীর কাছে পৌঁছতে। আমার তো তখন বয়েস কম , এই দশ কী এগারো । তাই পায়ে জোরও কম। দাদুভাই খুব তাড়াতাড়ি হাঁটতেন। তিনি ছিলেন পূজারী ব্রাহ্মণ। তাঁর নারায়ণশিলাখানি সঙ্গে  নিয়ে গ্রামের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ঘুরে ঘুরে পুজো সারতেন। দিন শেষে পাওয়া আতপ চাল, ফল সবজি দিয়ে গুছিয়ে ঠাকুমা সংসার চালাতেন। একটু টানটান ছিল সংসারটা। দাদুভাই বলতেন,

– বড় যজমানরা তো সব দেশ থিকা ইন্ডিয়ায় চইল্যা গেল বড়বউ। এখন তো পেট চালানোই মুশকিল।

– আমরাও চলো যাই গিয়া। বলতেন ঠাকুমা।

– তা হয়ত একদিন আমাগো স্টিমার ধরতে লাগব। যাইতে মন চায় না যে। কিন্তু প্যাটে টান পড়ে যদি।

এই রকম কথাবার্তা শুনে আমি অভ্যস্ত ছিলাম। তবু এই গ্রাম ছেড়ে যেতে একটুও মন চাইত না। গ্রামের সরু মেঠো রাস্তা। এ রাস্তায় বৃষ্টি পড়লে  জল কাদায় পিছল হয় , তবু এই আকাবাঁকা সরু রাস্তায় কত ভালোলাগা যে ছিল! আমাদের গ্রামের মাঠ, মাঠের বুড়ো বটগাছ, পাশে কালীমন্দির। আমি আর আমার সই বীণা ওই মাঠে বসে বসে নসুদের বাছুরের নাচ দেখতাম। রানীদিদার কমলা গাইয়ের বড় বড় কাজল চোখে তাকিয়ে থাকা দেখতাম। রানীদিদারা দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। যাওয়ার আগে সে কী কান্না! গরুটা নসুর মাকে দিয়ে গেছেন। জলিল চাচাকে বাড়ির দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে একদিন ভোর ভোর কালিগঙ্গায় নৌকোতে চড়লেন তাঁরা। শুধুমাত্র টুকিটাকি কিছু জিনিস আর নিত্যপূজার গোপালকে  দিদা কোলে করে নিয়ে গেলেন। এই রকম বিদায় দৃশ্য আমরা দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছিলাম। কেউ না কেউ তো টুকটাক করে দেশ ছাড়ছিলই।

প্রতি রাসপূর্ণিমায় রাধেবৈষ্ণবী আসতেন। আমাদের কীর্তন গান শোনাতেন। ওনার নাকি বাড়ি গোপালদি। বলতেন, নামগান করতে করতে, ভাসতে ভাসতে কত জায়গায় যে চইল্যা যাই!

আমাদের বাড়িতে একটা পিতলের গৌরাঙ্গ ছিল। উনি এলেই ঠাকুমা ভোগ চড়াতেন। সে যে কত নিরামিষ পদ! তারপর বৈষ্ণবী গান ধরতেন। সবটা মনে নেই। খানিকটা যেন ছিল এই রকম,

‘বিধাতা সংসারে রাজা

আমায় করে রাখলেন প্রজা ;

কর না দিলে দেয় গো সাজা

কারও দোহাই মানে না।”

সে বৈষ্ণবীরও আসা বন্ধ হয়ে গেল। তিনিও নাকি নবদ্বীপে চলে গেছেন। এসব শুনলে ঠাকুমার খুব মন খারাপ হয়ে যেত।

হরিদাসী পিসি ছিলেন আমাদের প্রতিবেশী। বাল্য বিধবা। সর্বদা সাদা নরুণ পাড় কাপড় পরতেন। প্রত্যেকের আপদেবিপদে সবার আগে এই পিসির দেখা মিলত। বিশেষ করে প্রসূতি মেয়েদের যত্ন আর দাই মায়ের কাজে তাঁর মতন ওস্তাদ এ পাড়ায় আর কেউ ছিল না। এ কাজের জন্য আসেপাশের গ্রামেও তাঁর ডাক পড়ত। মানুষটা ছিল একটু অন্য ধরনের। সেসময় বাংলায় ঘরে ঘরে স্বদেশী আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়ে। বিলাতি জিনিস বর্জন ও স্বদেশী জিনিস ব্যবহারের একটা হিড়িক পড়ে যায়। এই আন্দোলনে বাংলার মেয়েরাও যোগ দিয়েছিল। অনেকগুলি মহিলা সংগঠন তখন বাংলায় গড়ে ওঠে। এক মুঠো চাল জমা রেখে সে চাল বিপ্লবীদের হাতে মেয়েরা তুলে দিত। হরিদাসীপিসি রাতের বেলায় বিপ্লবীদের জন্য চাল জোগাড় করতেন। বিপদের খবর পেলে আগাম জানিয়ে দিতেন। আমার তাই হরিদাসী পিসিকে খুব ভালো লাগত। পিসি এলে গা ঘেঁষে বসতাম। এই পিসিরাও নাকি সবাই ইন্ডিয়ায় চলে যাচ্ছে। এ খবর কানাঘুষোয় শুনে ঠাকুমা খুব ভেঙে পড়লেন। বার বার বলতে লাগলেন,-  আর কাগো ভরসায় থাকুম?

তবু যেতে প্রাণ চায় না। এ যেন শেষ খড়কুটো ধরে বাঁচার চেষ্টা। অবশেষে একটা সুযোগ দাদুভাইয়ের সামনে দয়াল কাকা এনে দিলেন।

খোশখবর’ পড়তে ক্লিক করুন এখানে www.khoshkhobor.blogspot.com

দয়াল কাকা আমাদের গ্রামেই থাকতেন। আমাদের গ্রাম থেকে সাত কী আট গ্রাম পার করে, দূরে এক মাঝারি মাপের জমিদার সত্য চৌধুরীর বাড়িতে লেঠেলের কাজ করতেন। দয়াল কাকা মাসে একবার করে গ্রামের বাড়িতে আসতেন। আমাদের ছোট ছেলেমেয়েদের খুব ভালোবাসতেন। আমাদের গ্রামের কালীমন্দিরের দাওয়ায় আমরা ছোটরা দয়াল কাকাকে ঘিরে বসতাম। কাকা বলতেন যে, মা ঠাকুরণ যখন পালকি চেপে তেনার বাপের বাড়ি যেতেন তখন দুই লেঠেল দয়াল আর পূর্ণ সর্বদা তাঁর সঙ্গী হতেন। সে যুগে খুব ডাকাতের ভয় ছিল। মা ঠাকুরণ গায়ে অনেক সোনার গয়না পরতেন যে! একবার তো নদীর পুবপারের ওই বিরাট জঙ্গলে ডাকাত পড়েছিল। তখন দয়াল কাকাই তো লড়াই করে ডাকাত তাড়ান!

এসব গল্প আমরা হাঁ করে শুনতাম। আমাদের আবদারে কাকা মালকোচা মেরে কাছা গুটিয়ে লাঠি চালিয়ে দেখাতেন। তাঁর মাথার ওপর লাঠি বনবন করে ঘুরত। শুধু শব্দ পেতাম! চোখে যেন আর লাঠি দেখতে পেতাম না!

শুনেছিলাম, কাকার আমার বয়সী একটা বোন ছিল। সে নাকি অজানা কোন অসুখে একদম ছোট্টবেলায় মারা যায়। কাকা তাই আমায় বড্ড স্নেহ করতেন। নসুদের ওই উঁচু তেঁতুলগাছ থেকে আমায় তেঁতুল পেড়ে দিতেন। গঞ্জে গেলে আমার জন্য চুড়ি, ফিতে আর অবশ্যই এক শিশি আলতা কিনে আনতেন। ঠাকুমা মাঝে মাঝে কপট ধমক দিয়ে বলতেন, “দয়াল ওরে এত আস্কারা দিও না।” দয়াল কাকা আমাদের সকলেরই খুব প্রিয় ছিলেন।

কাকা একদিন এসে খবর দিলেন যে জমিদার বাড়ির কুলপুরোহিত ইন্ডিয়ায় চলে গেছেন। যদি দাদুভাই চান তো এই কাজটা পেতে পারেন। বাড়ির নিত্য পূজা আর অন্যান্য পার্বণ যা কিছু হিন্দু বাড়িতে হয় তার সবটাই করতে হবে। সপ্তাহে একটা দিন গ্রামেও ফিরতে পারবেন। দাদুভাইয়ের তখন বেশ অর্থাভাব। এ প্রস্তাবে তিনি রাজি হলেন। দয়াল কাকার সঙ্গে দাদুভাই রওনা দিলেন তাঁর নতুন কাজের জায়গায়।

জমিদার বাড়ির মন্দিরের কাজে দাদুর মন বসে গেল। চৌধুরীদের মন্দিরটা বেশ পুরনো। একটা শিবলিঙ্গ আর একটা রক্ষাকালীর মূর্তি ছাড়াও ছিল রাধাগোবিন্দ ও লক্ষ্মীঠাকুরের বিগ্রহ। আমার দাদুভাই নিষ্ঠার সঙ্গে পূজা করতেন।

এদিকে জমিদার বাড়ির মেজ নাতিটিকে নিয়ে প্রায়ই নানান গোলমালের কথা দাদুভাইয়ের কানে আসত। এই ছেলেটি অকালপক্ক, নেশাভাঙ করত। বেশ একটু বিপথে চলে গিয়েছিল বলে সকলে জানত।

দাদুভাই পরিবারটির থেকে একটু তফাৎ রেখেই চলতেন। একদিন ওই দুস্টু ছেলেটি জমিদারের ক্যাশবাক্স ভেঙে টাকা চুরি করতে গিয়ে দয়াল কাকার হাতে ধরা পড়ে যায়। রাতের অন্ধকারে দয়াল কাকা চোর ভেবে লাঠির বাড়ি মেরে পা ভেঙে দিলে এক অনর্থ ঘটে গেল! এতে হলো হিতে বিপরীত।

জমিদারের আদরের নাতি হাতেনাতে ধরাও পড়ে গেল, আবার পা-ও ভেঙে গেল। তাই জমিদার বাবু খুব রেগে গেলেন। আর সব রাগ গিয়ে পড়ল দয়াল কাকার ওপর। একই গ্রামে বাস করার জন্য এই রাগ খানিকটা দাদুভাইয়ের ওপরও গিয়ে পড়ল। তিনি দয়াল কাকাকে তো খুবই ধমকালেন সঙ্গে দাদুভাইকেও বললেন,

– কেমন পূজা করছেন, মা কালী রুষ্ট হইল ক্যান? এত অমঙ্গল তো আগে হয় নাই।

– আমি খুব তাড়াতাড়ি শান্তি স্বস্ত্যয়ন করে দেব। খোকাবাবুও সেরে উঠবেন। বলেছিলেন দাদুভাই।

পরদিন সন্ধ্যায় দাদুভাইয়ের ডাক পড়ল। গিয়ে দেখেন জমিদারবাবুর চোখ লাল। নাতির ধুম জ্বর এসেছে। মেজাজ ভালো নেই তাই। অন্য লেঠেল পূর্ণচন্দ্রও সেখানে হাজির। এই পূর্ণচন্দ্র আর দয়াল কাকা এক সঙ্গেই ওঠা বসা করতেন। সকাল বিকাল মুগুর ভাজতেন আর লাঠি তো খেলতেনই। দুই জনেরই লেঠেল হিসেবে খুব নাম ডাক ছিল।  জমিদারবাবু নির্দেশ দিলেন যে কোন অজুহাতে পূর্ণচন্দ্র যেন দয়াল কাকাকে নিয়ে গিয়ে খুন করে বিলের জলে ভাসিয়ে দেন। দাদুভাই থাকবেন সঙ্গে সাক্ষী হিসেবে।

দয়াল কাকা ছিলেন স্বভাবে সরল ও অত্যন্ত প্রভুভক্ত। দাদুভাই বেজায় ঘাবড়ে গেলেন। তিনি ছিলেন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ। পুজো অর্চনা নিয়েই থাকতেন। জীবনে একটা ব্যাঙও মারেন নি। তিনি দেবেন মানুষ খুনের সাক্ষী!

পূর্ণচন্দ্রও খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। দয়াল কাকা যে তার প্রাণের বন্ধু!

পরদিন ভোর ভোর তিনজনে নৌকায় চড়ে নদীতে ভেসে পড়লেন। কিছুদূর যাওয়ার পর দাদুভাই আর পূর্ণচন্দ্র দয়াল কাকাকে সব কথা খুলে বললেন। দুজনে মিলে পরিকল্পনা করে  পালিয়ে যেতে সাহায্য করলেন।

দাদুভাই নাকি বলেছিলেন – তুমি যেদিকে দুচোখ যায় চইলা যাও। কোনদিনও আর  আইস না। তোমারে জমিদার বাবু দেখতে পাইলে আরো দুইটা প্রাণ যাইব।

সেই দিনই দাদুভাই গ্রামে ফিরে আসেন। এবং খুব কম সময়ে হাতের সামনে যা পান তাই নিয়ে সপরিবার গ্রাম ছাড়েন। এই লুকিয়ে গ্রাম ছাড়তে গ্রামের হিন্দু মুসলমান সবাই সাহায্য করেছিলেন। এই ছিল আমাদের প্রথম বাসা বদলের গল্প। এরপর তো আরো কত বার বুকে ভয় নিয়ে এদিক সেদিক। অনেকটা সেই ‘রাধে বৈষ্ণবীর’ মত আমরাও এ জেলা থেকে ও জেলায়  ভাসতে লাগলাম।

গ্রামছেড়ে  মাদারিপুর হয়ে বরিশাল আর তারপর তো সব ছেড়ে ইন্ডিয়ায়।

এর মাঝে আমরা এও চিন্তা করেছি যে ওই দুই লেঠেলের শেষ পর্যন্ত কী হয়েছিল? ওঁরা বেঁচে আছেন তো?

তারপর বেশ  ক’বছর কেটে গেছে। আমরা এখন ইন্ডিয়ায় পাকাপাকি ভাবে থাকি। শুনেছি হাওড়ার কাছে কে নাকি কবে দয়াল কাকাকে দেখেছিলেন।

দাদুভাই শুনে বলেছিলেন যে, ও বাঁইচ্যা থাকলে ঠিক একবার আমার কাছে আইব। আমিও বিশ্বাস করি কাকা বেঁচে আছেন আর ঠিক আমাদের সঙ্গে দেখা করবেন। মনে মনে কাকার অপেক্ষায় থাকি।

বানানবিধি ও মতামত লেখকের নিজস্ব  

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ