শরীরটা কদিন ধরে বিশেষ ভালো যাচ্ছে না অনিল বাবুর। রাতে ভালো ঘুম হয়না, বুকের মধ্যে কেমন যেন অস্বস্তি! তপা অনেকবার ডাক্তারের কাছে যেতে বলেছে, শোনেননি। বিপত্নীক ও নিঃসন্তান অনিলবাবুর দেখাশোনা তপাই করে। বাজার করা, রান্না ও অন্যান্য ফাইফরমাশ খাটা সবই ওর দায়িত্ব। চেয়ারে বসে চোখটা লেগে গিয়েছিল অনিলবাবুর, সম্বিত ফিরলো তপার হাঁকডাকে। “এবার খাবে তো নাকি? কটা বাজে সে খেয়াল আছে? “, চমকে উঠে ঘড়ি দেখলেন, দশটা বেজে গেছে! রাতে দুটো রুটি আর একবাটি দুধ দিয়ে যেতে বললেন, জানালেন এখানে বসেই খাবেন তিনি।
পরদিন সকালে শরীরটা বেশ চাঙা মনে হল তাঁর। যা আরো প্রফুল্ল হয়ে উঠল বেলা এগারোটার পর। ওই সময় কয়েকটা অল্পবয়সী ছেলে এসেছিল তাঁর কাছে। তাদের ক্লাবের রবীন্দ্র নজরুল সন্ধ্যার অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করার আব্দার নিয়ে। এই একটি ব্যাপারে তাঁর বেশ দুর্বলতা আছে। বহুবছর ধরে তাঁর একটাই শখ, নেশাও বলা যেতে পারে। বিভিন্ন, সভা-সমিতি অনুষ্ঠানে চেয়ার অলঙ্কৃত করে বসে থাকা ও বক্তব্য রাখা। যখন শিক্ষকতা করতেন তখন তো বটেই, অবসর জীবনেও সেই ধারা বজায় রেখেছেন বা বলা ভালো বজায় রাখার চেষ্টা করেছেন। এরজন্য নিয়মিত অনুশীলন বা চর্চাও করেছেন। কোনো চেয়ারে গুরুগম্ভীর মুখ করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকার অভ্যাস তাঁর একদিনে হয়নি। এছাড়া বক্তব্য রাখার ব্যাপারেও তিনি নিয়মিত নিজেকে প্রস্তুত করেছেন। আজকালকার ভূঁইফোড় বক্তাদের মত সোস্যাল মিডিয়ার শরণাপন্ন হন না তিনি। যত্তসব! আজকাল লোকজনদের ধৈর্য্যও বড় কম। স্থির হয়ে বসতেও শেখেনি। সভা সমিতিতে বক্তব্যও বিশেষ কেউ শুনতে চায়না। তাই সকালে আসা ছোকরার দলকে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন অন্তত আধঘণ্টা বক্তব্য রাখবেন তিনি। সেটাও মূল অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার ঠিক আগে। চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে চেয়ারে বসে ভারতে লাগলেন সামনের রবিবারের অনুষ্ঠানটার কথা। আজ বুধবার। হাতে সময় বড়ো কম। প্রচন্ড গরমের পর এই বর্ষা শুরু হওয়ায় পরিবেশ একটু ঠান্ডা। আজ সকাল থেকেই অঝোর ধারায় বর্ষন হচ্ছে। যদিও তার অনুষ্ঠান “আষাঢ় সন্ধ্যা” একটা বড়ো হলে হবে তবু এই বৃষ্টি হলে লোকজন আসবে কী করে? এসব ভাবতে ভাবতেই সঞ্চয়িতাখানা পেড়ে নিলেন তিনি। সারাদিন প্রায় চেয়ারে বসেই কাটালেন আজ। সেগুন কাঠের এই চেয়ারটা তাঁর বড় প্রিয়। বড় শখ করে বানিয়েছিলেন রিটারমেন্টের পর। সারাদিনের অনেকটা সময় তাঁর এই চেয়ারেই কাটে। রাতে আজকাল ভালো ঘুম হয়না তার। হালকা একটা ঘুমের ওষুধ খেতে হয়। বিছানায় শুয়ে ঘুম না এলে চেয়ারে বসেই সারারাত ঝিমোন তিনি।
পরদিন সকালে তপা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকে দেখলো অনিলবার চেয়ারে বসে আছেন। মাথাটা পেছন দিকে হেলানো। কাপটা টেবিলে নামিয়ে বাবুকে ভাকলো, সাড়া না পেয়ে গায়ে আস্তে করে ঠেলা দিলো তপা। কোনো সাড়া নেই ! আবার গায়ে হাত দিতেই তপা লক্ষ্য করল বাবুর শরীর ঠাণ্ডা। চিৎকার করে বেরিয়ে পাড়ার লোক ডাকতে বেরিয়ে গেল।
হাঁকডাক শুনে ক্রমশ লোকজন জড়ো হল। ডাক্তারবাবু এসে সবকিছু দেখে জানালেন রাতের বেলা ঘুমের ঘোরে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হয়েছে অনিলবাবুর। চারঘণ্টা পরে ওনার চেম্বার থেকে ডেথ সার্টিফিকেট নিয়ে আসার কথা বলে বেরিয়ে গেলেন উনি।
নিকটাত্মীয়দের খবর দেওয়া হল। পাড়ার লোকজন বস্ত হয়ে পড়লো দাহকর্মের জন্য। ইতিমধ্যে ওনার দেহটা রাইগর মর্টিস সেট করে যাওয়ার জন্য চেয়ারে বসার ভঙ্গীতেই শক্ত হয়ে গেছে। ওই ভঙ্গীতেই ওনাকে শববাহী গাড়িতে শোয়ানো হল।
দুপুরবেলা শববাহী যান যখন শ্মশানে পৌঁছল তখন আকাশ ভেঙ্গে অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। আষাঢ় মাসের দুপুরবেলাকে সন্ধ্যা মনে হচ্ছে। শ্মশানযাত্রী দশবারোজন মত হবে। ওনার দূরসম্পর্কের এক ভাইপো এসেছে কাকার মুখাগ্নি করার জন্য। পাড়ার লোকজন শ্মশানে দাহকার্যের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কাঠের চিতা সাজানাে হল। গোল বাধলো চিতায় আগুন দেওয়ার সময়। কিছুতেই আগুন ধরেনা। বৃষ্টি কাঠ ভিজে গেছে বলে বোধহয়। কেরোসিন তেল ঢেলেও কাজ হলোনা। লোকজনও অধৈর্য হয়ে পড়ছে ক্রমশঃ। হঠাৎ তপা শ্মশান থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল। অনিলবাবুর বাড়ি থেকে শ্মশান দুই কিলোমিটারের মধ্যে। আধঘন্টার মধ্যেই তপা রিকসা নিয়ে শশানে হাজির। রিক্সা থেকে তপা যখন নামলো তখন ওর সঙ্গে অনিলবাবুর চেয়ারটা! সবাই মিলে ধরাধরি করে চিতা থেকে অনিলবাবুর দেহটা নামিয়ে চেয়ারে বসালো। চেয়ার সমেত দেহটা চিতার বসানো হল। এবার অগ্নিসংযোগ করতেই দাউ দাউ জ্বলে উঠল চিতাটা।
[মতামত ও বানানবিধি লেখকের নিজস্ব ]
Tags: গল্প, চেয়ার, সাগর কুমার পাঠক
email:galpersamay@gmail.com
» আষাঢ়ে গল্প on August 8, 2023
[…] চেয়ার […]
Rajat Chakraborty on August 9, 2023
এরকম আরও চাই।
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।