08 Aug

ভূতের সিওপিডি

লিখেছেন:ত্রিদিবেশ বন্দ্যোপাধ্যায়


অফিসে গিয়েই ফোন পেলাম পিসেমশাই চলে গেছেন। রওনা দিলাম গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে। পৌঁছতে বিকেল, গিয়ে দেখি আমাদের খুড়তুতো, জাঠতুতো, পিসতুতো সব ভাইরা এসে গেছে বা আসার পথে। এখুনি এসে যাবে। শ্মশানযাত্রা হতে সন্ধে হবে।

পিসেমশাইয়ের মৃত্যুতে আমরা কেউ শোকস্তব্ধ নই। পরিণত মৃত্যু, তাছাড়া রাঙ্গাপিসি কয়েক বছর আগেই চলে গেছে। তাই আমরা মানে পিসেমশাইয়ের সব সন্তানরা তাঁকে পার করে দিতে চাই। পিসেমশাই ভালোই ছিলেন। কোভিড হয়েই শরীরটা ভেঙে গিয়েছিল। মানে কোভিড হলে যা হয় আর কি। ফুসফুসটা ড্যামেজ হয়ে যায়। এই বয়সে সেটা হলে আর সারে না। মানে সিওপিডি। সিওপিডির ‘সি’ মানে ক্রনিক। তাই মাঝে মাঝেই ঠান্ডা লেগে যাওয়া, মাঝে মাঝেই অক্সিজেন-এইসব চলছিল। 

এই গল্পটা বলার আগে পিসেমশাই রাঙ্গাপিসির পরিচয়টা একটু দেওয়া দরকার। এঁরা ছিলেন নিঃসন্তান, দাদু এঁদের টেনে এনেছিলেন, আমাদের বাড়ি সংলগ্ন বাগানে একটু জায়গা দিয়ে এখানেই বাস করতে বলেছিলেন। পিসেমশাই নিজের মতো ছোট্ট একটা বাড়ি করে নিয়ে এখানেই থেকে গিয়েছিলেন। এখান থেকেই যাতায়াত করে অফিস করতেন। তাঁর নিজের সন্তান না থাকায় আমরা খুড়তুতো জাঠতুতো ভাই বোনেরাই ছিলাম তাঁর ছেলে মেয়ে। এছাড়া আমাদের অন্য পিসিদের ছেলেরাও ছিল পিসেমশাই এর খুব প্রিয়। তাদেরও মাঝে মাঝে মামার বাড়ি আসার বাড়তি আকর্ষণ ছিল এই মেসো।

পিসেমশাই গল্প বলত জবরদস্ত। আমরা সব ভাইবোনেরা তাঁকে ঘিরে বসতাম, শুরু হোতো জমজমাট আসর। তাঁর অনেক গল্পই ছিল বিশ্বসাহিত্যের বা বিখ্যাত সিনেমার গল্প। পিসেমশাইএর মুখে ‘হাঞ্চব্যাক অফ নটরডেম’ বা ‘মারচেন্ট অফ ভেনিস’ আমাদের ছোটবেলাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। আর ছিল বিখ্যাত বিখ্যাত সিনেমার গল্প, সেগুলো আমাদের মতো করে বলতেন।  আর আমরা হাঁ করে গিলতাম। এ ছাড়া ছিল ভূতের গল্প। তাঁর মুখে ভূতের গল্প শুনে আমাদের গা ছম ছম করতো। মনে হোতো এ গল্প বুঝি বানানো বা কোথাও পড়া নয়। যেন পিসেমশাই এর নিজের অভিজ্ঞতা। ছোটবেলায় আমরা একশ ভাগ বিশ্বাস করতাম। তবে প্রশ্নও করতাম, “পিসেমশাই ভূত কি সত্যিই আছে?” 

পিসেমশাই শ্রীরামকৃষ্ণের মত বলতেন, “আছে কী রে? আমি তো দেখেছি, কথা বলেছি ভূতের সঙ্গে”। আমরা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতাম। বলতাম, “পিসেমশাই আরেকটা বলবে?” পিসেমশাই রহস্য জিইয়ে রেখে বলতেন, “নাঃ, আজ থাক। পরের শনিবার, তাড়াতাড়ি পড়ালেখা শেষ করে চলে আসবি”।

পিসেমশাই নানারকম ভূতের গল্প বলতেন। এক তান্ত্রিকের পোষা ভূতেরা রাত্তিরবেলা তান্ত্রিকের জমি চাষ করে ধান বুনে দিত। তারপর মুসলমান ভূত, যাদের জিন বলে। মুসলিম জিন সাধকরাও জিনকে পোষ মানিয়ে রাখে, তারপর তাদের দিয়ে কালা জাদু, জাদু টোনা এইসব করে।  একজন বিপদে পড়ে জিন সাধকের কাছে গেছে। সাধক সব শুনে জিনকে পাঠিয়ে দিল তার শত্রুকে শায়েস্তা করতে। জিন গিয়ে দমাদ্দম ঘুঁষি। যাকে মারছে সে কাউকে দেখতে পাচ্ছে না অথচ তার মুখে পেটে ঘুঁষি এসে পড়ছে। এঁদের এমন ট্রেনিং দেওয়া থাকতো যে এদের যতটুকু করতে বলা হতো এরা ততটুকুই করত। আমরা তখন বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলায়। প্রশ্ন করতাম, “ তুমি এতো জানলে কীকরে?” পিসেমশাই এই কঠিন প্রশ্নটা সহজ ক্যাচের মত লুফে নিয়ে বলতেন তার একজন মুসলিম জিন সাধক বন্ধু ছিল। সে বলেছে জিনদের  যদি বলা হয় একটু আধটু ভয় দেখিয়ে ছেড়ে দিতে ওরা তাই করবে। দুচারটে চড়-চাপড় কিল-ঘুঁষি দিতে বললে ওরা তাই করবে। প্রাণে মারতে বললে মেরেও দেবে। কিন্তু জিন সাধকরা এই কাজ করে না। “কেন, কেন করে না? পুলিশ তো ধরতে পারবে না। জিন তো অদৃশ্য ভাবে কাজ করে”। পিসেমশাই বুঝিয়ে দিত। তা ঠিক। কিন্তু সাধকদের সব শক্তি তো ভগবান বা আল্লার থেকে পাওয়া। সেই শক্তি দিয়ে যা খুশি করলে ভগবান বা আল্লা তো ছাড়বে না। তাই এই সব ক্ষমতা বুঝে সুঝে ব্যবহার করতে হয়। তান্ত্রিক বা জিন সাধকরা এসব মেনে চলে। আমাদের মুখে আর কথা থাকত না।   এরপর আছে সাহেব ভূত- কোট,প্যান্ট, টাই, হ্যাট পরা ভূত,মুখে চুরুট। টুপিটা সামনের দিকে ঝোঁকানো, মুখটা বোঝা যায়না।  হঠাৎ হাওয়ায় টুপি উড়ে গেলে দেখা যেতো মুখটা কঙ্কাল আর তার মুখে চুরুট।

সাহেবরাও ভূত হয়? আমাদের অবাক প্রশ্ন। 

পিসেমশাই বলে, “হয় বইকি। লন্ডনের রাস্তায় লাল রঙের ডাবল ডেকার বাসের মাঝে মাঝে কালো রঙের বাস দেখা যায়। ঐ বাসগুলো শহরের হন্টেড হাউস গুলো ঘুরিয়ে দেখায়। তাহলে বুঝে দেখ, শহরে কত ভূত থাকলে শুধু ভূতের বাড়ি দেখাবার জন্যে বাস সারভিস থাকতে পারে!  

তারপর আরেকটু বড় হয়ে পিসেমশাইএর কথা গুলো ঠিক ছোটবেলার মতো মেনে নিতাম না। বলতাম, “তুমি প্রমাণ দিতে পারবে?” “আমাদের একদিন ভূত দেখাতে হবে”, ইত্যাদি ইত্যাদি। হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই প্রমান দেব। তবে আমার তো আর পোষা ভূত নেই। তাই একটু সময় দিতে হবে আমাকে। … তারপর আরো বড় হলাম, আমাদের ভূতের গল্প শোনার নেশা কেটে গেল। কিন্তু ছোটবেলার সেই পিসেমশায়ের কাছে গল্প শোনার স্মৃতি রয়েই গেছে।

আমরা ত্রিবেণী শ্মশানঘাটে চলেছি। একটা ছোট ট্রাকে পিসেমশাইয়ের সঙ্গে পাড়ার ছেলেরা, আমরা, ভাইয়েরা গাড়িতে। আমরা সকলে পিসেমশাইয়ের গল্পই করছিলাম, যাকে বলে স্মৃতিচারণ। কেমন করে আমাদের সাঁতার শিখিয়েছিল, আমাদের ফুটবল টীমের ম্যানেজার হয়ে আমাদের সঙ্গে যেতো, ফেরার সময় সকলকে ঘুগনি পাঁউরুটি খাওয়াতো। এবং অবশ্যই গল্প শোনার স্মৃতি, ভূতের গল্প শোনার স্মৃতি। যার যা মনে আছে, যার স্মৃতিতে যেটা দাগ কেটে আছে আমরা তাই বলছিলাম।

শ্মশানে পৌঁছে দেখি পর পর পাঁচ টা বডি শোয়ানো। তার মানে আমাদের পালা আসতে মাঝ রাত্রি। কাল অফিস যেতেই হবে। তা ছাড়া এই শীতের রাতে গঙ্গার ধারে এতক্ষন ……। আমাদের মধ্যেই কেউ একজন বলল আমরা যদি কাঠের চুল্লীতে কাজটা সেরে নিই? এখানে তো দুটো অপশানই আছে…। আমরা মুখ চাওয়া চায়ি করছি, প্রস্তাবটা মন্দ নয়। হঠাৎ আমাদেরই একভাই, পিসেমশাইয়ের কাছে বসেছিল, হন্তদন্ত হয়ে এসে বলে হঠাৎ মেসো কথা বলে উঠেছে। 

তার মানে? 

আমি স্পষ্ট শুনলাম মেসোর গলা। মেসো বলছে, “আমি সিওপিডি র পেশেন্ট। ধোঁয়ায় আমার খুব কষ্ট। ঐ কাঠের চুল্লীতে আমি যেতে চাই না। তোরা একটু কষ্ট কর, আমাকে ইলেকট্রিক চুল্লীতে দিবি”।

সকলে এক বাক্যে বলে উঠলো, শ্মশানে এসেই খেয়ে নিয়েছিস একটু?

বিশ্বাস কর আমি তো তোমাদের সঙ্গেই ছিলাম। আমি স্পষ্ট শুনেছি, মেসোর গলা। আমি মেসোর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, একই রকম। কিন্তু গলা আমি স্পষ্ট শুনেছি।

আমরা সবাই হন্তদন্ত হয়ে পিসেমশাইএর কাছে গেলাম। কখনও কখনও তো এমন হয় যে ডাক্তার ভুল সার্টিফিকেট দিয়েছে, মরা মনুষ শ্মশানে গিয়ে উঠে বসেছে। শরীর ছুঁয়ে, পাথরের মত ঠান্ডা হাতটা নাড়াচাড়া করে সেই ভাইটার দিকে তাকালাম।

“যত খ্যাপামি। মরা মানুষের  সিওপিডি! আমি অফিসে কাঠের চুল্লীর জন্যে টাকা দিয়ে বুক করে আসছি”। এক ভাই গট গট করে অফিসের দিকে এগিয়ে গেল। আমি ছোট ভাইটার পিঠে হাত দিয়ে তাকে নিয়ে পিসের কাছে বসলাম। “হ্যাঁরে তুই ঠিক শুনেছিস?” “বিশ্বাস কর মেজদা। আমি মেসোকে নিয়ে মিথ্যে কথা বলব? মেসো বলল ধোঁয়ায় আমার খুব কষ্ট”। 

ঠিক তখনই আমাদের ভাই অফিস থেকে ফিরে এসে বলল, “কাঠের চুল্লী আজকের মতো বন্ধ। সকাল থেকে কাজ করে ডোমেরা ক্লান্ত। দুজনেই ছুটি করে বাড়ি চলে গেল”। আমাদের আর কিছু করার থাকলো না। আমি মনে মনে বললাম, ভালোই হয়েছে।  মানুষটা করোনার পর নিশ্বাসের কষ্ট তো পেয়েছে ! 

 শীতের রাতে গঙ্গার হাওয়ায় বহুদিন পরে আমাদের ভাইদের পূনর্মিলন হল। পিসেমশাই শুধু নির্বাক, শুয়ে। একসময় পিসেমশাই বলতো, আমরা গোল হয়ে ঘিরে বসে থাকতাম। আজ উল্টোটা। আজ আমরা সবাই বলছি পিসেমশাই শ্রোতা। একটু তন্দ্রা এসে গিয়েছিল। এক ঝটকায় তন্দ্রাটা ভেঙে গেল। আমিও শুনলাম পিসেমশাইয়ের গলা, স্পষ্ট। 

“কীরে বলেছিলাম না একদিন? ভূত আছে প্রমাণ দেব? এবার বিশ্বাস করলি তো?” 

[মতামত ও বানানবিধি লেখকের নিজস্ব ] 

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ