কয়েকদিন ধরেই একটা নিম্নচাপ জমে আছে মাথার ওপর। সকাল হাঁকছে দুপুর হাঁকছে।মাঝরাত্তির থেকে তুমুল লাফালাফি, ঝাপাঝাপি । হুংকার গর্জন শেষে। এখন শুধুই ধারাপাত।আজ একটু বেলাতেই ঘুম ভেঙেছে রূপসার। কিন্তু উঠতে ইচ্ছে হচ্ছিল না ।ইস্কুল যেতেও একটুও মন চাইছে না। আজ একটা সিএল যাবে যাক। শুয়েই থাকে সে ।
তার একা এই একফালি জীবনে ওঠা নামার সিঁড়িগুলো খুবই অন্যরকম। লাবন্য বাজে খুব কম।বন্যতাকেই বেশি দেখতে পায় সে। কত কিছু যে তার ভিতর মুক্তো হয়ে জমে আছে তারহিসেব নেই। কিন্তু সেই মুক্তরা অলংকার হতে পারবে না কখনও।
জানলা দিয়ে বাইরে চোখ যায় মেঘেরা ডাল বিছিয়ে রেখেছে। ভোেরজল ঝমঝম, পাশ ফেরে।হঠাৎ খেয়াল করে বালিশটা বেশ ভেজা। অবাক হয় সে। বালিশে জল এলো কোথা থেকে।তাহলে কি সে ঘুমের মধ্যে কেঁদেছে! কিন্তু মনে পড়ছে না তো সে রকম স্বপ্ন কিছু তার আসেপাশে এসেছিল বলে!
এবার উঠে বসে রূপসা। সে অবাক হয়ে যায় বালিশটাকে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখে। ঘুম চোখটাএকটু রগড়ে নেয়। ঘুমের রেশটা পালিয়েছে। রুপসা হাত বোলায় বালিশের গায়ে।
বালিশটা তার মায়ের ছিল। বহুদিন আগের শিমুল তুলোর বালিশ। কিছুদিন আগে একবার নতুন তুলো ভরিয়ে ছিল, কিন্তু সেই থেকেই সে বুঝতে পারে কোথাও একটা তফাৎ হয়ে গেছে।বালিশটা যেন সেই আগের মতো আর আরামদায়ক নেই। একটু শক্ত, উঁচু-নীচু, একটু একপেশে, কোথাও বদলে গেছে যেন।
বালিশের গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে হঠাৎ রূপসা অনুভব করে বালিশটার ভিতরে একটা মৃদু স্পন্দন। এবার একটু ঘাবড়ানোর পালা। হাতটা তুলে নেয় সে। গা ছমছম করে ওঠে সাতসকালেই। এবার বেশ বুঝতে পারে বালিশের ভিতর থেকে একটা মৃদু আওয়াজ ভেসে আসছে।
– ভিতরে ভিতরে অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে রে। এটা বড্ড কষ্ট দিচ্ছে, আমার ভিতরে যে গাছের তুলো ছিল, সে বড় পবিত্র নির্মল তুলো। নতুনদের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছে নামোটেই। ভিতরে ভিতরে ব্যথা থই থই করছে।
রূপসা ভাবে এভাবে তো কোনোদিন ভাবেনি সে। মায়ের এই বালিশের কাপড়টা বদলায়নি কারন তার মনে হয় শুলে এখনও মায়ের গন্ধ পায়। প্রতিদিন যেসব স্বপ্নময় ঘুমগুলো আসে যায়, গন্ধ লেগে থাকে বালিশের গায়ে। মায়ের গন্ধের সঙ্গে স্বপ্নের গন্ধ মিলে একটা নতুন ইক্যুয়েশন তৈরি হয় ।
সে ইক্যুয়েশনে ঢি ঢি ছোটবেলাগুলো ফিসফিসিয়ে ওঠে। নক্সির মায়া মাখা কলেজদিনের কথারা জমা হয় মনের আনাচে কানাচে। আরতের শুভদা এসে গালটিপে দিয়ে যায়। এই নিয়ে মায়ের বকবক, বাবার মেজাজে গম্ভীর আবহাওয়া, সব সব।
তার বারো বছরের সাদা মনে কোনও কাদা ছিল না সেদিন। বিশুদা একটু আদর করেছিল।খারাপ লাগেনি বটে। সেটাই এসে মাকে বলেছিল। আর বড় চকোলেটটাও দেখিয়ে ছিল। আজ মনে হয় বিশুদা সেদিন যেন একটু বেশিই গলে গিয়েছিল। নাকি সে নিজে।
বাইরে বৃষ্টিটা একটু ক্লান্ত হয়েছে। নাকি পরের রাউন্ডের জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না।রূপসার মনে পড়ে যায় তন্ময়ের কথা। এই বালিশটায় শোয়া নিয়ে কত কান্ড করেছে। নানা রকমের শয়তানি।
বিয়ের আগে একটা পদ সে বারবার বলতো- পিয়া যব আওব এ মুঝ গেহে / মঙ্গল যতই করবনিজ দেহে / বেদী করব হাম আপন অঙ্গনে / ঝাক্কু করব তাহে চিকুর বিছানে।…
বিয়েটার পর কয়েকদিন বেশ কাটছিল হঠাৎ – তার মনে হয় সক্কালবেলা এসব কি ভাবছে সে ! যে সংসার ভেঙে গেছে তার অবশিষ্ট নিয়ে ভাবার কি আছে ? শরীরের ধুকপুকুনিটা যে আছে এই যথেষ্ট এত টানা হেঁচড়ার মধ্যেও সে চেষ্টা করেছে ওপাশে সরিয়ে রাখা বালিশটাকে এটার পাশে রাখতে। পাশবালিশ দুটোকে মাথার বালিশ দুটোর দু’পাশে রাখতে। কিন্তু কখন যে পাশবালিশ দুটো এই বালিশটার দু’পাশেই স্থায়ী হয়ে গেল দেবা ন জানন্তি ।
বালিশটা চুপচাপ হয়ে গেল ? রূপসা তাকায় বালিশের দিকে, যেন গুনগুন করে বাজছে বালিশের মনটা। ভেবেই নিজেই ফিক করে হেসে ফেলে । বালিশ, তার আবার মন ।
– কেন ! থাকতে নেই বুঝি ? এবার চমকে ওঠার পালা। ব্যাপারটা আর হালকা করে নেওয়া যাচ্ছে না। তার ভাবনাটাও বালিশ বুঝতে পারছে ! বাইরে ঘনমেঘের অন্ধকার ঘরের ভিতরেও। সেই আঁধারে সে তার ভ্যাবাচ্যাকা চোখটা এগিয়ে নিয়ে যায় বালিশের দিকে। পিটপিটে দুটো চোখ একবার স্পষ্ট হচ্ছে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। দু চোখ কচলে নিয়ে আবার তাকায়, একই ঘটনা আবার !
এবার সে উঠে হাত বাড়িয়ে বেড সুইচটা অন করতেই একটা মৃদু আর্তনাদ। বালিশের চোখ দুটো অদৃশ্য হয়ে গেল।
সাড়া শব্দটিও নেই। যেন এতক্ষণ যা ঘটছিল সবই অলীক।
আলোটা নিভিয়ে দিতেই মিনমিন করে কে যেন বলে ওঠে – নতুন তুলোগুলোকে আমার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারছি না রে। বড্ড কষ্ট হচ্ছে তুই যেমন তন্ময়ের সঙ্গে চেষ্টা করেছিলি সে রকম আমিও এ-কদিন খুব চেষ্টা করলাম, পারছি না। এ তুলোগুলো বড্ড ভারি। চাপ সহ্য হচ্ছে না। ভিতরে ভিতরে ফালাফালা হয়ে যাচ্ছি।
আবার ফুঁপিয়ে ওঠে বালিশ।
জানলার কোনে একটা ছোট্ট পাখি ভিজে জাব হয়ে বসে আছে। মৃদু মৃদু শিসিয়ে উঠে যেন তার অবস্থানটা জানিয়ে দিচ্ছে ঘরের মালিককে। তার চেহারায় স্পষ্ট—
আচ্ছা কি স্পষ্ট ! আজ এই বৃষ্টিমাখা অন্ধকার আবছা সকালে সবই যখন অস্পষ্ট, তখন এইছোট্টো একরত্তি পাখিটার মধ্যে কী আর স্পষ্ট হতে পারে !
প্রশ্নটা উঁকি দিয়েই মিলিয়ে গেল। বালিশটা ফিসফিসিয়ে ওঠে – কত দুঃস্বপ্ন জমে আছে রে ভিতরে, সেই সব ফোঁটা ফোঁটা জল। সে সবই অস্পষ্ট হলেও স্পষ্ট । পৃথিবীর এত্ত মানুষ, কেউ আপন হয় না । তাহলে এই নতুন তুলোগুলোকে কিভাবে আপন করি বল । কিস্যু ভালো লাগে না। রোপনযাপান জানে না কেউ ।মায়া হয় রূপসার।
বাইরে মেঘ গুরগুর করে ওঠে।বালিশ বলে চলে- একটা মেঘ পারেনা আরেকটা মেঘকে মানিয়ে নিতে। কাছে এলেই গর্জায়,গায়ে লাগলেই চিৎকার ! আমি নতুন তুলোগুলোর সঙ্গে কিভাবে এক সংসারে থাকি। দেখ কেমন এক ধারে এলিয়ে পড়েছি। সেই কথাগুলো তোর মনে নেই ?
-দাঁড়াও মনে করে দেখি,বলেই রূপসা ভাবে কি মনে থাকার কথা বলছে বালিশ ! কোন কথাটা তার মনে নেই ! সে মনেমনে বলতে থাকে। ছড়িয়ে ছড়িয়ে যাওয়া মনে না থাকা কথাগুলো এসো এসো। সেই সব গুপ্তহত্যার কথারা সবাই আরও একটু কাছাকাছি এসো। আলসে রঙের এই সাতসকালের ঘরে,এই বালিশের পাশে এসো। পালতোলা ভাবনারা এসো।
রূপসার মনে মনে বলা কথাগুলো শুনে বালিশটা হেসে ওঠে, একটা ফিকফিক আওয়াজ হয় ।এবার আর রূপসার ভয় জাগে না।
কিছুক্ষণ একটা স্তব্ধতার মধ্যে বসে থাকে এবার আবার হাত বোলায় বালিশের গায়ে। হাল্কা নীল ওয়ারটা তো গতকালই বদলেছে। তাইভিজে ছাপটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এবার ঘুমমাখা ডাববুস চোখে একটু ভালো করে তাকায়বালিশের দিকে।
আস্তে আস্তে ফুটে উঠছে একটা মুখ । নিঃসঙ্গ একটা মুখ ।
[বানানবিধি ও মতামত লেখকের নিজস্ব]
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।