সাদা মার্বেল পাথরে মোড়া সিঁড়ি। নিশ্চয়ই সাদাও একটা রং — তবে তফাত এই যে, এই সাদা বকের পালকের মতো। তার উপর দিয়ে নরম কালো একটা রং এলোমেলোভাবে এঁকেবেঁকে নেমে এসেছে— যেন একচিলতে একটা নদীর স্রোত। ওঠার মুখেই সৌমিত্রর চোখে পড়ল বনেদি আমলের একটা শ্বেতপাথরের কানাউঁচু থালা। জলে ভরতি — জলের উপর ভাসছে কচুরিপানা। সৌমিত্রর ডান-চোখের কোণে কালো-ভ্রুর শেষে একটা বিস্ময়রেখা ফুটে উঠল। হায়াসিন্থ ! রুচির তারিফ করতে হয়। কর্পোরেটের ভাষায় একে হয়তো বলা যেতে পারে হোম ডেকরে ইনোভেশন। অভিনবত্ব!
পত্রার্ক বলল — আমার ওয়াইফ, উর্বীর ক্রিয়েশন। বারো-মন্দিরের কাছে গঙ্গার ধারে বেড়াতে গিয়েছিল তুলে নিয়ে এসেছে। এই রকমই খেয়াল।
দু’জনে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছে। এই বাড়িতে প্রথম এলেও সৌমিত্র সিঁড়ি দিয়ে আগেই উঠছে, পত্রার্ক ঠিক তার পিছনে। উঠতে উঠতে শেষ ধাপে এসে পত্রার্ক বলল, সামনের সোফাটা দেখিয়ে বলল—আপনি বসুন সৌমিত্রদা, আমি আসছি।
দেড় কাঠার একটু বেশি জমির উপর ছোট্টো একটা দোতলা বাড়ি করেছে পত্রার্ক। মাস কয়েক হল এসেছে, বাইরের রংয়ের কাজ এখনও শেষ হয়নি। নিচে একটা বড় বসার ঘর। সামনে এক-টুকরো গ্রিল আর শার্সি ঘেরা বারান্দা, তার পাশ কাটিয়ে সিঁড়ি উঠেছে অনেকটা আচমকাই। সিঁড়ির নিচে একটা ফ্যাশানেবল বাথরুম। নিচের ঘরে একটা পিয়ানো, কয়েকটা দামি ইন্ডোর প্ল্যান্ট। সাদা দেওয়াল, একটা দুটো পেন্টিং। তাক ভরতি বই, সাজানো গোছানো। বেশিরভাগই লিটারেচারের বই, কিছু পেন্টিং-এর বই।
এসে প্রথমে নিচের ঘরেই বসে ছিল সৌমিত্র। জানলায় সিল্কের পরদা, শেষ-শ্রাবণের হালকা ভিজে হাওয়ায় উড়ছে। সব কিছু খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছিল সে। কারণ দেখতে তার ভালো লাগছিল। ট্রেন থেকে নেমে, একপশলা বৃষ্টির পর জলকাদার রাস্তা ধরে বাজারের কোলাহলের মধ্যে দিয়ে মানুষ ঠেলে, রিকশর পাশ কাটিয়ে, অটো-টোটোর ‘ও-দিকে যাব না’, ‘রিজার্ভ করতে হবে’ এইসব ঝামেলায় পড়ে সৌমিত্রর মেজাজাটা খিচড়ে গেছিল।
এখন ভালো লাগছে। বৃষ্টি নেই তবে বাতাসে তার পরশটুকু আছে। কে বলবে এই ঘরটা ম্যান্ডেভিলা গার্ডেন্সে বা লেক রোডে নয়! এই মফস্বল শহরে, মনে না-হতেই পারে যদি ভাবনা তেমন জোরাল হয়।
—পিয়ানো কে বাজায়? তুমি?
— নাহ্, ছেলে শিখছে। শনিবার শনিবার নিয়ে যাই তো কলকাতায় ওয়াসিম খানের স্কুলে। খুব ভাল হাত। অ্যাকচুয়ালি ওর সেন্সটা খুব ভাল। অনেক খরচ, কিন্তু উর্বীর ইচ্ছে! এক সময় নিজে পিয়ানো বাজাত। নিজের কিছু হয়নি— আর এখন তো বাজায়ই না, অন্তত ছেলেটার যদি হয়… সেই ভেবে…
— কত বয়স তার, তোমার ছেলে…
— নয়-এ পড়ল।
— তারা কোথায়, দেখছি না তো?
— আপনি একটু বসুন, পাশেই আছে, আঁকার স্কুলে। এই এসে পড়ল বলে।
এই বলে পত্রার্ক দরজা খুলে অদৃশ্য হল। সৌমিত্র একা মিনিট কয়েক চুপচাপ বসে থেকে এদিক-ওদিক তাকিয়ে বইয়ের র্যাকের দিকে এগিয়ে গেল। এটা তার ছোটোবেলার অভ্যাস, বই দেখলেই হল। কল্লোল যুগের কবি-লেখক প্রেমেন্দ্র মিত্র বলতেন লাইব্রেরি গিয়ে বই দেখা উচিত, কত রকমের বই হয়, কত তার বিষয়। বিদ্যাসাগর কী কী বই পড়তেন সে নিয়ে গবেষণা করা উচিত। শোনা যায় বিলেত থেকে বিদ্যাসাগরের বই বাঁধিয়ে আসত। রুচিতে বাধে তবুও, বিনা-অনুমতিতেই সৌমিত্র একটা গল্পের বই বার করে নিল— মুলকরাজ আনন্দ! সেই সময় বাইশ বছরে আন্তর্জাতিক লেখক! আরেকটা বই তারপর, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’-র ইংরেজি অনুবাদ। অনুবাদক হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। রেয়ার বই। ১৯৪৮ সালে প্রথম প্রকাশিত। মাত্র আটচল্লিশ বছর বেঁচে ছিলেন মানিক— তাতেই অমর। মানুষটার দুঃখ-দুর্দশার শেষ ছিল না, প্রায় বিনা চিকিৎসায় না-খেতে-পেয়ে মারা গিয়েছিলেন মানিক। টাকা না-নিয়ে লিখতেন না, তবুও পারেননি সংসার প্রতিপালনের জন্য যেটুকু অন্তত প্রয়োজন তা জোটাতে। সাহিত্য-জীবনের প্রথম দিকের ব্যর্থতায়, টাকা-পয়সার অভাবে তারাশঙ্কর আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন বলে কথিত আছে। সৌমিত্র এসব কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ভেবে ফেলল। আর বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়? তিনিও তো মাত্র ছাপান্ন বছরের জীবন পেয়েছেন। হাতে পড়ল ‘আম আঁটির ভেঁপু’— পথের পাঁচালির কিশোর সংস্করণ।
কীভাবে এ বই বাজারে রইল এত দিন? কত যে ভুল! সম্পাদনার নামে বিভূতিবাবুর সাহিত্যকে ওরা মার্ডার করেছে, কেউ দেখেনি— কফিহাউসের আড্ডায় এমন অভিযোগ তুলে শিশু সাহিত্যিক সুকান্ত সেন খুব তর্ক জুড়ে দিত। মনে পড়ছে, সুকান্ত বলত— তুমি বল সৌমিত্র, এটা কী ঠিক হয়েছে? ‘পথের পাঁচালী’-র ওই জায়গাটা মনে কর দেখি, দুর্গা মারা যাচ্ছে— সেই সিচুয়েশন! মূল কাহিনিতে বিভূতিভূষণ লিখছেন : …. ‘সর্বজয়া ভাসুর সম্পর্কের প্রবীণ প্রতিবেশীর ঘরের মধ্যে উপস্থিতি ভুলিয়া গিয়া চীৎকার করিয়া উঠিল— ওগো , কি হোল, মেয়ে অমন করচে কেন?
দুর্গা আর চাহিল না।’
পথের পাঁচালী-র মূল অংশ ‘আম আঁটির ভেঁপু’ পড়— চমকে উঠবে ওই একই জায়গাটায় গিয়ে। সম্পাদনার বাজারিকরণ আর কি! ‘দুর্গা আর পৃথিবীর আলোয় চোখ চাহিল না।’ দু’রকম— একী হয় সৌমিত্র? সৌমিত্র বলল, এতো গবেষণার বিষয় দাদা! সুকান্ত জোর দিয়ে বলল, পৃথিবীর আলোয় চোখ চাহিল না এমন কথা বিভূতিবাবু কখনোই লিখতে পারেন না। বিশ্বাস করি না, —এই বলে কফির কাপটা ঠক করে টেবিলের উপর নামিয়ে, ঝট করে উঠে, হনহন করে বেরিয়ে গেল সুকান্ত। এরকমভাবেই একদিন সুকান্ত কবি ও কবিতার আসর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। আলোচনা হচ্ছিল অনেক কিছুরই। উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়, অসংযত চটুল কথায় একে-অপরকে আক্রমণ— সবই নিয়ম মতো চলছিল। তার মধ্যে জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কবিতাটির প্রসঙ্গ যখন উঠল। সংযমের বাঁধ আর রক্ষা হল না। কবি অজয় গঙ্গোপাধ্যায় বলল, কবিতাটি জীবনানন্দ বহু বার কাটাকুটি করেছেন। ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে এর পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়। কিন্তু শুধু এই একটি কবিতা দিয়েই বাঙালি জীবনানন্দকে চিনবে কেন? এ আমাদের দুর্ভাগ্য। সুকান্ত বলল— জীবনানন্দ মানেই তো ওনলি বনলতা সেন নয়— ‘বনলতা সেন’ বরং জীবনানন্দের একটি সিগনেচার কবিতা। ‘আট বছর আগের একদিন’, ‘যেই সব শেয়ালেরা…’ পড়েছেন? আরে তাঁকে বুঝতে গেলেও একটা হৃদয় আর মেধা চাই! দুর্ভাগ্য…
দুর্ভাগ্য কাকে বলে ? ‘পথের পাঁচালী’ সিনেমা হওয়ার পর উপন্যাসটার পরিচিতি হল সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালি’। কই রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’ তো সত্যজিতের ঘরে বাইরে হয়ে উঠল না। ‘গণশত্রু’ ছবিতে পথের পাঁচালী-র সত্যজিৎ-কে চেনা যায়? ওটা তো নাটুকে ছবি। একটা কোথাও থামতে হয়। নইলে নিজের প্রতি অবিচার হবেই।
সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক পিনাকী সেনগুপ্ত কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন, তাকে থামিয়ে দিয়ে অজয় গঙ্গোপাধ্যায় বলল— ‘চুপ করুন, ওকে বলতে দিন। আপনার কথা পরে শোনা যাবে।’ সমর্থন পেয়ে সুকান্ত বলল, জীবনানন্দকে এখনও বাংলাভাষার পাঠকের বেশিরভাগই চিনতে পরেনি। তাঁকে চিনতে আমাদের আরও একশো বছর লাগবে। এই মহাকবি জীবিতকালে পলিটিক্সের শিকার হয়েছিলেন। ওই বুদ্ধদেব বসু, সঞ্জয় ভট্টাচার্য না-থাকলে তাঁকে চিনিয়ে দিত কে? বনলতা সেন কবিতাটিকে নীরেন্দ্রবাবুরা বুঝতে না-পেরে দুর্বল বলেছেন, ‘পাখির নীড়ের মতো’ শব্দটি নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করেছেন। মানুষটা মরোণোত্তর রবীন্দ্র-পুরস্কার ছাড়া আর কিছু পাননি। এবার কবি অজয় গঙ্গোপাধ্যায়ের দিকে তীব্র ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফস করে শিবাশিস ঠাকুর বলল, তোমার পুরস্কার তো ভাই চটি চেটে। নিজেদের মধ্যে পুরস্কার ভাগবাটোয়ারা কর, নির্লজ্জ-বেহায়া, আর হবে না কেন একালে মন্ত্রী-আমলা সবাই ‘পুরস্কৃত’ কবি লেখক গায়ক শিল্পী হয়েই জন্মাচ্ছে যে! মেধা, প্রতিভা উপেক্ষিত হলে, তার সামাজিক সম্মান না-থাকলে, অপমৃত্যু হলে এমনই হয় বোধহয়! পলিটিকাল র্যাকেটিয়াররা অতিনিম্ন-মেধার হ্যাংলা অলেখক, অশিল্পী, স্তাবকদের ডেডিকেটেড পুরস্কার দিয়ে থাকেন। ইটস্ পারফেক্টলি এ টিম ওয়ার্ক। পলিটিক্স প্রিভেলস্ এভরিহোয়ার! হাওয়া দেখ, ঘুরে যাও! পিঠ চুলকাও, চাপড়াও— লাইনে থাক এমনিই সব আসবে! ডু পলিটিক্স! আমার চামচা হও, তোমাকে আমি অমৃত-পাত্রে মুখ ঠেকাতে দেব। আই লাইক ইউ! লাইক কর।
শিবাশিস ঠাকুর একটু থেমে ফের বলতে থাকল—আমরা কারোর কাছে তো পুরস্কার ভিক্ষা করতে যাইনি। মেয়েও সাপ্লাই দিইনি! তুমি কি নিজেকে শক্তি-সুভাষ ভাব নাকি? কোথায় রাম আর কোথায় রামছাগল?
অজয় উঠে গেলে, সুকান্ত আর এক মুহূর্ত সেখানে দাঁড়ায়নি। সভার মাঝখান থেকে কে যেন বলল, সুবোধ গোস্বামী-দের বলে দিও, তোমরা কেউ জীবনানন্দ-বিভূতিভূষণ নও! তোমাদের মনে রাখার দায় তাই কালের হাতে নেই। ইউ আর দ্য প্রোডাক্টস অফ দিস ডেজস ওনলি। ডু জাসস্টিস টু ইয়োরসেল্ফ!
আজকাল যে কী হয়েছে, বইপত্রর উলটোলেই সৌমিত্রর এই সব ঘটনার কথা মনে পড়ে। পত্রার্ক দেরি করছে কেন? মোবাইল দেখল সৌমিত্র, দশ পনরো মিনিট সে এভাবে বসে আছে।
পত্রার্ক পত্রনবিশ তার বন্ধু নয়, কয়েক মাসের পরিচিত। সৌমিত্রর চেয়ে বয়সে বেশ ছোটোও। পত্রার্ক কেন্দ্রীয় সরকারের ডাক বিভাগের কলকাতা অফিসের স্টেনো। ইংরেজি সাহিত্যের ছেলে। যাদবপুরে পড়েছে। শাস্ত্রীয় সংগীতের ভক্তশ্রোতা। তবে বেশ ভালো ছবি আঁকে, মডার্ন আর্ট নিয়ে গভীর পড়াশোনা আছে তার। পেন্টিং-ই তার ধ্যানজ্ঞান। চাকরি সে না-করলেই যেন বেঁচে যেত। বালুরঘাটের ছেলে। বনেদি বংশের সন্তান। বাবা-মা দু’জনেই অধ্যাপনা করতেন। বাবা নিয়মিত সাহিত্য চর্চা করতেন— উত্তরবঙ্গে তাঁর বেশ নামডাক আছে, দেবেশ রায়, সমরেশ মজুমদারেরা তাঁকে ভালো মতন চিনতেন।
সৌমিত্রর সাম্প্রতিক উপন্যাসটা পড়ার পরই পাবলিশারের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে তার খবরের কাগজের অফিসে গিয়ে নিজে থেকে আলাপ করে এসেছিল পত্রার্ক। ছেলেটার মেধা আছে, চিন্তা শক্তি প্রখর। অন্যভাবে ভাবতে পারে, ব্যক্তিত্বে ব্যতিক্রমী। সৌমিত্রকে যে পত্রার্ক অসম্ভব শ্রদ্ধা করে তা তার আন্তরিক ব্যবহার দেখেই বুঝতে পারা যায়। খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে তাদের মাঝের দূরত্ব কমে এসেছে। কিছু দিন ধরে বারবার পত্রার্ক অনুরোধ করছিল, সৌমিত্রদা একদিন বাড়িতে আসুন। আপনি আসলে কী যে আনন্দ পাব! উর্বী বিশ্বাস করতে চায় না যে লেখক সৌমিত্র চক্রবর্তী আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ট মানুষ। আমার বাবাও আপনার খুব প্রশংসা করেন। একবার আপনাকে বালুরঘাটে নিয়ে যাব। বাবা আলাপ করতে চান…
একদিন-নিশ্চয়ই-যাব করতে করতে আজ এসে পড়েছে সৌমিত্র।
গ্রিলের-গেট খোলার আওয়াজ হল। একটি বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে একটি অল্প বয়েসি মহিলা ঢুকলেন। সৌমিত্র বুঝতে পারল ইনি উর্বী। হাসি মুখে উর্বী তাকে অভ্যর্থনা করল। প্রতি-নমস্কার জানিয়ে সৌমিত্র বলল, পত্রার্ক কোথায় গেল?
— আসছে, আপনি ভালবাসেন, গরম রসগোল্লা আনতে গেছে।
— কী মুশকিল!
প্রসঙ্গ পালটে সলজ্জ-ভঙ্গিতে সৌমিত্র উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলল, পিয়ানো বাজান না কেন?
— পত্রার্ক বলেছে বুঝি? ওকে নিয়ে আর পারি না! আমি আর ক’দিন বাজিয়েছি। একদিন শখ হয়েছিল। ওই তো জোর করে শিখতে বলেছিল। পিয়ানো এখন আর আমার মোটেই পছন্দের নয়। ছেলেটা এখন শিখছে এই যা!
সৌমিত্র ছেলেটির হাতে একটা লজেন্স-এর বাক্স তুলে দিয়ে বলল— তোমার নাম কি?
— ডোডো।
ডোডো তখন সারা ঘরময় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। খুব ছটফট করছে। মায়ের শাড়ি ধরে ঝুলে পড়ছে। কী চাইছে ও তা বোঝা দায়।
সৌমিত্র বলল, এস আমার কাছে এস। ক্যাডবেরিটা খাও না।
—‘খাব না’ বলেই সে হাতের প্যাকেটটা ছুড়ে দিল মায়ের দিকে। সেটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পিয়ানোর উপর গিয়ে পড়ে একটা বিকট আওয়াজ করল।
কেন করলি , কেন করলি এমন— বলে উর্বী ছেলের গালে ঠাস করে এক চড় কষিয়ে দিল। তাতে ডোডো আরও ভয়ংকর হয়ে উঠল। সৌমিত্র হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া এমন ঘটনার জন্য অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। ডোডো তখন মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি দিচ্ছে।
উর্বী ছেলেকে সেখান থেকে তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল। বলতে বলতে গেল, যেটা না-বললেই হয়তো তখন ভাল হতো— ‘লোক দেখলেই এমন করে। বাইরের কাউকে ওর পছন্দ নয়… কেন ? কেন?।’ ডোডোকে প্রথম দেখেই একটু গোঁয়াড় গোছের মনে হতে পারে। চঞ্চল, দুরন্ত এবং আনপ্রেডিকটেবল! উর্বী সুন্দরী, ছিপছিপে। কাটাকাটা নাক চোখ মুখ। দামি চশমা তার ব্যক্তিত্বকে শার্প করেছে। মুখে স্থায়ী একটা চাপা হাসি লেগে থাকে সব সময়, তাতে মনের ভাব বোঝা যায় না। বাড়তি ভদ্রতাও যেমন নেই, তেমনই সংযত প্রায়- নিরুত্তর আবেগ। তাই আলাপ বেশি দূর এগোনোর উপায় নেই। তাকানোর ভঙ্গিমা রহস্যময়। কম কথা বলে, প্রতি কথার স্বাভাবিক উত্তরও দেয় না, সেটা সৌমিত্র আগেই বুঝতে পেরেছে। ঠিক খোলামেলা নয়। নিজেকে পত্রার্কর অনুপস্থিতিতে অযাচিত মনে হচ্ছিল, আর সেটাও উর্বীর নিস্পৃহ আপ্যায়নের জন্যই।
কিছু সময় পর পত্রার্ক এল। এসেই বলল, সৌমিত্রদা আপনার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। একজন আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসছেন। আপনি নাকি তাকে চেনেন। এক সঙ্গে ডিনার করবেন। তারপর বলল, চলুন, উপরে যাই। পরে ছাদে নিয়ে যাব আপনাকে, কত গাছ লাগিয়েছি দেখবেন। ছাদটা একটু ভিজে থাকবে, তাহলেও বেশ হাওয়া দিচ্ছে। এই এনভায়রনমেন্টে দার্জিলিং চা জমে যাবে দেখবেন!
সৌমিত্র সিঁড়ি দিয়ে উঠছে, পত্রার্ক ঠিক তার পিছনে।
ঘরের ভেতর অনেক বাহারে গাছ, ক্যাকটাস, বনসাই, মানিপ্ল্যান্ট আছেই, পত্রার্কর ইন্ডোর প্ল্যান্ট কালেকশনও বেশ রুচির পরিচয় দেয়। উপর তলায়, ডাইনিং স্পেসে, ব্যালকনিতে পত্রার্ক গাছ লাগিয়েছে। সৌমিত্র ভাবল, সম্ভবত উর্বীর শখ দামি ইন্ডোর প্ল্যান্টে, পত্রার্কর শিকড় যে হেতু গ্রামের, তাই সে ব্যালকনিতে বেগুন, লংকা, খেরো, কাকরোল টবে বসিয়েছে, পুঁই মাচা দিয়েছে। ডোডো লিভিংরুমের দেওয়ালে কাক, পেঁচা, পাখি এঁকে দেওয়ালটাকে ক্যানভাস করে রেখেছে। উপরের ঘরে ঢুকে সৌমিত্র দেখল, ডোডো মাটিতে ট্রেন চালাচ্ছে। নানা রকমের নানা সাইজের খেলনা-হাতি ঘরে ছড়ানো। এখন ও শান্ত। পত্রার্ক বলল— নিচে কী দুষ্টুমি করেছে আপনার সঙ্গে, ওর মা বলল। ও কিন্তু ওরকম করে না। আপনাকে দেখেও করার কথা নয়। আপনার কথা ও জানে। অন্য কোনও রিঅ্যাকশন হয়তো… একটু ইরিটেশন আছে। ডোডোর অঙ্কতে দারুণ মাথা। ক্লাসে তো ফার্স্ট হয়েছে এবার। ও যখন আপনার সঙ্গে মিশবে, একবার পছন্দ হলে— দেখবেন কী মশুকে, ইন্টেলিজেন্ট! অ্যামিয়েবল। সৌমিত্র একটু অবাকই হল, ছেলের জন্য অকারণে বিব্রত-বোধ করছে পত্রার্ক। কিছু যেন আড়াল করার চেষ্টা করছে সে।
উর্বী এল উপরের বসার ঘরে। পাশেই ওপেন কিচেন। হাতে চায়ের সরঞ্জাম। পত্রার্ক বলল, নিন ফার্স্ট রাউন্ড! পিয়র দার্জিলিং। উর্বী আনিয়েছে , ফ্রম মকাইবাড়ি। সৌমিত্র বলল, এই চায়ের ভক্ত ছিলেন সত্যজিৎ জানো বোধহয়।
উর্বী স্থির ক্রুর দৃষ্টিতে পত্রার্কর দিকে তাকিয়ে, সঙ্গে এক চিলতে হাসি হেসে বলল, ‘ঠিক তা নয়! বিলাসিতা সব এ বাড়ির বাবুর জন্য! আমি শুধু আজ্ঞা বহন করি। আঁকার সময় চা-কফি একটু বেশি খায়। সারা দিন একা থাকে, থাকতে ভালবাসে। খেয়ালখুশি মতো চলে।’ বর্ষার মেঘ হঠাৎ করে সূর্যকে ঢেকে দিলে দিনের আলো যেমন নিস্তেজ হয়ে পড়ে তেমনইভাবে পত্রার্কর মুখে হাসি ম্লান হয়ে গেল। সে কিছু বলবার আগেই, ডোর বেল বাজল। পত্রার্ক বলল— ওই এল আপনার… অনিন্দিতাদি…
সৌমিত্র বলল, কে অনিন্দিতা?
— এই তো! ভুলে গেলে চলবে?
কথাটা শেষ না-করেই দ্রুুত সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল পত্রার্ক।
উর্বী আর এক কাপ চা তৈরি করতে মন দিল। মুখে হাসি, সৌমিত্র বুঝল ওটাই ওর কমিউনিকেশন স্টাইল। হাসিটা বুঝিবা নকল, সাজানো গোছানো।
— আপনাকে আরেকটু চা দিই…
— অল্প! চিনি কম। আপনিও তো ছবি আঁকেন তাই না?
— ওমা কুকিজ পড়ে রইল যে, নিন… চানাচুর…
সন্ধে সাড়ে ছ’টা বাজল। বাইরে শাঁখের আওয়াজ। বাড়ির পাশেই মন্দিরে ঘণ্টা বাজছে। ফের টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করল।
উর্বী বলল, আমার ছবি আঁকার কথা আপনি জানলেন কী করে?
—পত্রার্ক বলেছে। খুব প্রশংসা করছিল আপনার। দুঃখ করছিলও আপনি আঁকা ছেড়ে দিয়েছেন বলে। বুক ইলাস্ট্রেশনে, কভার পেন্টিং-এ বেশ তো অভিজ্ঞতা হচ্ছিল।
— আমি ছাড়িনি তো, ছাড়তে বাধ্য হয়েছি, সংসারের চাপে। সময় পাই কোথায়? আমি তো এক সময় ওরই মতো এগজিবিশন অ্যাটেন্ড করতাম। ছোটোবেলায় বালুরঘাটে একই স্যারের কাছে আমরা আঁকা শিখেছি। পরে আর্ট স্কুলে…
— তাহলে?
— সব মেয়ের যা হয় আমারও তাই হয়েছে। অনেক স্বপ্ন ছিল। অনেক স্বপ্ন দেখানো হতো। ভাবতাম একদিন অনেক নাম হবে। সেলেব্রিটি হব! বিয়ের অনেক পরে, এক সময় অনেক দূর এগিয়ে এসে মনে হল ও চাইছে না। ও হয়তো চায় আমি ওর ক্রিয়েটিভিটিকে প্যাম্পার করি, অনর্থক সাপোর্ট করি, সমালোচনা না-করি। নিজে চাকরি না-করি। আই শ্যুড বী মেন্ট ফর হিম ওনলি! ও চায় অ্যা হোলটাইম অ্যাটেনডেন্ট।
উর্বী সৌমিত্রর দিকে ফের একবার তাকিয়ে নিয়ে মাথা নিচু করে বলল, আমি জানি এভাবে আপনাকে বলা প্রথম দিনের আলাপে মোটেই উচিত নয়। কিন্তু আপনি পত্রার্কর খুব মনের মানুষ। তাই… আমি জানি ভালো কিছু একটা আঁকলেই ও কাগজটা ছিড়ে ফেলে দেবে। লোকে আমার ছবির প্রশংসা করলে ও ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে উঠবে। আমি আর আঁকি না…
যে কোনও কারণেই হোক উর্বীর সঙ্গে সৌমিত্রর আলাপটা চায়ের টেবিলে বেশ জমে উঠছিল। উর্বীর পুরাতন ইচ্ছেগুলো হঠাৎই ডানা মেলে বেশ ঘরময় স্বচ্ছন্দে উড়ে বেড়াচ্ছিলযেন।
কথার মাঝেই পত্রার্ক তুমুল হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকে পড়ল, বলল— ভালো করে চেয়ে দেখুন তো চিনতে পারেন কিনা?
পত্রার্কর মুখে হাসি, উর্বী আড়-চোখে দেখছে, সৌমিত্রর মুখে লাজুক হাসি, চোখে পরম বিস্ময়। পত্রার্ক মুগ্ধ-নয়নে তাদের দেখছে।
ভালো আছেন সৌমিত্রবাবু?
সৌমিত্র অবাক হল না একটুও। যাক্, অনিন্দিতা তাকে আড়ালে রেখেই আলাপটা শুরু করল তাহলে।
— ওহ্ ইয়েস, ইয়েস। কেমন আচ তুমি? কতদিন পর দেখলাম।
— অ…নে…ক দিন পর! তাই না? ওয়ান্স আপন এ টাইম…
ইচ্ছে করেই কথাটা এমন করে টেনেই বলল অনিন্দিতা। সৌমিত্র খেয়াল করল, একটু যেন মুটিয়েছে। তেমনই ফর্সা রয়েছে। নিটোল পুরুষ্টু বুক আরও ভারী, আকর্ষণীয় হয়েছে। চেহারায় সুখের ছাপ স্পষ্ট। বেশ বোঝা যায় আগের মতোই অনি সৌন্দর্য সচেতন আছে। বডি ল্যাংগুয়েজে প্রফেশনাল অ্যাটিটিউড বেশ রিফ্লেক্ট করছে। বয়স তেমন চোখে পড়ছে না।
চেয়ার টেনে বেস পড়ল দু’জনেই।
— অনিদি, সৌমিত্রদার ‘কুসুম কুমারিকা’ উপন্যাসের জন্য স্টেট লিটারেরি অ্যাওয়ার্ড এবার পাওয়া উচিত ছিল, কী বলো? ফার্স্ট এডিশন শেষ। পাঠকরা রিয়্যাক্ট করছে। রিভ্যু হয়েছে, সর্বত্র প্রশংসিত, কিন্তু দেখ ওরা দিল সুমন্ত দে-কে। কোন পত্রিকার যেন সম্পাদক। আদৌ স্পার্কিং কিছু লেখেন না। একজন তৃতীয় শ্রেণির লেখক।
অনিন্দিতা বলল,— ছাড়ো। এখন যোগ্য কে শুধু লেখার জন্য পুরস্কার পায় বলো তো? এক পাবলিশারও তো সম্প্রতি লেখার জন্য কী যেন একটা পুরস্কার পেয়েছেন। শুনেছি তিনি নিজেই নাকি সেই পুরস্কার কমিটির সদস্য। শাসক দলের স্নেহভাজন। সব নিজেদের মধ্যে যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ… বুঝলে? আমি তো গতবার অ্যাকাদেমিটা একটুর জন্য মিস…
সৌমিত্র এবার মনে মনে একটু হাসল। হাসল এই কারণে যে, সে জানে অনিন্দিতা চৌধুরি পরিবর্তনের ঠিক আগেই পার্টি-লাইন বদলেছিল শুধু ওই একটি কারণে। পুরস্কারের মোহ। ভীষণ মেগালোম্যানিক। নাট্যকার সম্রাট সেনের সঙ্গে লিভ-টুগেদারের পর্ব চুকিয়ে থাকত গিয়ে গড়িয়াহাটের সেই বিখ্যাত বাড়িতে, নতুন সঙ্গী তার থেকে বার বছরের ছোটো চিরদীপ চক্রবর্তী, এনআরআই ব্যবসায়ী। তার আগে একটা বিয়ে ভেঙে সম্রাট সেনের কাছে গিয়েছিল। ততদিনে কাজের জায়গাও বদলে গেছে, কাগজের রবিবারের পাতার দায়িত্ব, অফিশিয়াল ক্ষমতার বাড়-বাড়ন্ত,হাতে মাথা কাটার পূর্ণ সুযোগ, অ্যাবিউস অফ পাওয়ার— সবই দেখেছে সৌমিত্র। ওই কাগজ ছেড়ে তার চলে যাওয়ার অন্যতম কারণ এই অনিন্দিতা, তার ঔদ্ধত্য। অনিন্দিতা চাইত সৌমিত্র তার কথায় উঠুক বসুক— এক কথায় গোলাম হয়ে থাকুক। অনিন্দিতা তাকে ইচ্ছে মতো ব্যবহার করবে। সৌমিত্রর থেকে একদিন সে তার নিচে ছিল ঠিকই, তার কাছে কাজও শিখেছে প্রথম দিকে, তাতে কী? এখন সে মাথার উপরে যে! কর্পোরেটে বয়স, অভিজ্ঞতা, সিনিয়রিটি কিচ্ছু ম্যাটার করে না। পাওয়ার,পজিশন, ম্যানিপুলেশন, হাসতে হাসতে ছুরি চালিয়ে কার্যসিদ্ধ করারই আসল পারফরমেন্স। তখন তার মালিকগোষ্ঠীর একজনের সঙ্গে খুব ওঠা-বসা, সব মিলিয়ে হাইপ্রোফাইল পারসোনালিটি।
সৌমিত্রর প্রতি অনিন্দিতার অন্যখানে বেশ আকর্ষণ ছিল। তার পৌরুষ, তার উচ্চতা, তার বিদ্যা এবং লেখক হিসেবে তার জনপ্রিয়তা। তবে সম্পর্কের এক জায়গায় এসে সৌমিত্রকে থামতেও হয়। অনিন্দিতার শারিরীক চাহিদাটা অপূর্ণ থেকে যাওয়ায়, সৌমিত্র তেমন সাড়া না দেওয়ায়, বন্ধুত্বে চিড় ধরে এবং তা বিদ্বষে পরিণত হয়। চাকরি বদলানোয় সৌমিত্র অনিন্দিতার মুঠোর বাইরে চলে যায়।
‘আমি তো গতবার অ্যাকাদেমিটা একটুর জন্য মিস…’ কথাটা যখন অনিন্দিতা বলল, শুনে উর্বী একটু মুচকি হাসল। ও রান্না করছে ওভেনে। ঠিক সেই সময়, ডোডো একটা হাতিকে বলল, চ্যাল চ্যাল মেরে হাতি… চালি আ ধাক্কা মার্…
পত্রার্ক বলল, ডোডো স্টপ!
উর্বী ঘাড় ঘুরিয়ে পত্রার্কর দিকে তাকিয়ে বেশ ঝাঁঝিয়ে বলল— ওকে বকছ কেন? থাক না একা নিজের মতো আছে। ওই তো হাতি আর রেলগাড়ি নিয়ে পড়ে থাকে…ছুটির দিনে আমাদের একটু চাইবে বইকি!
পত্রার্ক বলল, ডোডো কাম হিয়ার। চিপস আছে। জানেন তো সৌমিত্রদা ডোডো ভাল রবীন্দ্রসংগীত গায়! একটু সেট করে যাক নিজেই এখানে আসবে।
ডোডো কোনও উত্তর করল না।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সৌমিত্র অনিন্দিতার দিকে তাকিয়ে পত্রার্ককে বলল, এঁকে পেলে কোথায়? বহু দিন কোনও খবর পাইনি।
— এখন তো দিদি উত্তরপাড়াতেই থাকেন। সেদিন এক জায়গায় আপনার কথা বলছিলাম। সেখানে ঘটনাচক্রে অনিন্দিতাদি উপস্থিত ছিলেন। পরে আমাকে ফোন করে আপনার টেলিফোন নম্বর চাইলেন, আমি তখন বললাম আসচে রোববার উনি আমাদের বাড়ি আসচেন। আপনারা বোধহয় কোনও সময় একসঙ্গে কাজ করেছেন, তাই না?
অনিন্দিতা বলল, সে অনেক আগের কথা, আমি দুবাই যাওয়ার কয়েক বছর আগে…
সৌমিত্র বলল, একসময় কিছু দিনের জন্য উনি আমার বস ছিলেন…
সৌমিত্রকে থামিয়ে দিয়ে অনিন্দিতা বলল, তার আগে উনি আমার বস ছিলেন।
বলে দু’জনেই যেন কষ্টের হাসি হাসল।
পত্রার্ক বলল, এমন একটা চকরি ছেড়ে দিলেন? এখন আপশোস হয় না?
—হয়, আবার হয়ও না! চিরদীপ তখন বল চল লন্ডনে থাকবে। লেখালেখি তো রইলই। ওখানে প্রবলেম হচ্ছিল। দুম করে ছেড়ে দিলাম। বিদেশে গিয়ে আমার অভিজ্ঞতা বেড়েছে। তারপর তো কত লিখলাম সে সব নিয়ে?
সৌমিত্রদা একটা কথা জিগ্যেস করব, যদি কিছু না-মনে করেন তো? শুনেছি, কানাঘুসো আলোচনা হয়, চিত্রাঙ্গদা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনেক লেখাই নাকি নিজের নয়? একজন দুঃস্থ অনামী লেখকের লেখা তিনি টাকা দিয়ে কিনে নিতেন? এমনকী তার শেষ যে লেখাটা পুরস্কার পেল সেটাও…
সৌমিত্র বলল, জানিনা ভাই। দেখতে হবে কোনও প্রতিহিংসা থেকে কেউ গুজব ছড়াচ্ছে কিনা?
অনিন্দিতা যেন জ্বলে উঠল। বলল, ও তো শুয়ে পুরস্কার। পত্রার্ক নিচু গলায় প্রায় ফিসফিস করে উর্বী যেন শুনতে না পায় এমনভাবে, বলল— চিত্রা তো শমীকবাবু কেপ্ট ছিল। সবাই জানে। ও বাড়ির কথা আর বলো না, টেবিলে টেবিলে কেচ্ছা। মালিক কর্মচারীর বউকে রক্ষিতা বানাচ্ছে, একে তুলছে ওকে ফেলছে, আবার কর্তাভজা কৃতদাসরা তাদের উচ্ছিষ্ট নিয়ে যায় প্রসাদ মনে করে।
সৌমিত্র বেশ ইমোশনাল হয়ে পড়েছে, সে বলছে— আমার কথাই ভাব না! সুদীপ্তার মেয়ে তখন পাঁচ বছরের, ও বেরিয়ে এল। ওকে ভালোবেসেছি, বিয়ে করলাম। মেয়ে আমায় বাবা বলে চিনল। ওকে ওর পুরোনো সব কিছুই ভুলিয়ে দিতে চাইলাম। দারুণ সম্পর্ক। সেই মেয়ে যখন ক্লাস টেনে পড়ে আমাকে হেয় করার জন্য লেখালেখি হল ‘ও আমার মেয়ে নয়’। লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে গেল। স্কুলের বন্ধুরা ওকে দেখে হাসতে লাগল। কী অবস্থা ভাব? একদিন ওকে নিয়ে গিয়ে সোজা অন্য স্কুলে ভরতি করে দিলাম। কারা আমার পিছনে সে সময় ষড়যন্ত্র করেছিল পরে তা শুনে আশ্চর্য হয়েছি।
এবার অনিন্দিতা চুপ করে গেল। প্রসঙ্গ পালটাতে বলল, কী ছবি আঁকছ দেখালে না তো? এগজিবিশন করবে বললে… চল আমরাই উদ্বোধন করে দেব। নভেম্বরে তো?
সৌমিত্র বলল, উর্বীর পেন্টিং দেখাও না পত্রার্ক…
উর্বী সেই শুনে বলল, না, না একদম না। বাজে… বাজে…ছবি হয়নি কিছু…
হঠাৎই উর্বী বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়ল।
অপ্রস্তুত পত্রার্ক বলল, ডিনার করার আগে চলুন ছাদে যাই… গাছ দেখবেন চলুন।
সৌমিত্র ঘড়ি দেখে বলল, আমাকে এবার উঠতে হবে। ডিনার সেরেই উঠব। পত্রার্ক বলল, আরে বাবা চিন্তা করবেন না, স্টেশন পর্যন্ত আপনাকে পৌঁছে দেব তো। অনেক গাড়ি আছে।
পত্রার্ক বলল, অনিন্দিতাদি তোমার লেটেস্ট খবরটা বলি সৌমিত্রদাকে?
— কোনটা কোনটা রে?
— সৌমিত্রদা জানেন তো অনিন্দিতাদি এবার রাজ্যসভার সদস্যা হতে পারেন…
— নাইস। আমরা সেলিব্রট করব।
ডিনার খেতে খেতে সৌমিত্র উর্বীর খুব প্রশংসা করছিল— তোমাকে পুরস্কার দেব। কী সুন্দর চিকেন রেঁধেছ… একসেলেন্ট। কাবাবটাও অসাধারণ! নিজের হাতে এত সুন্দর রেঁধেছ… আমরা রেস্ট্রুরেন্ট করলে কেউ দাঁড়াতে পারবে না।
উর্বীকে খুশী করার জন্যই সৌমিত্র এইটুকু প্রশংসা করছিল। উর্বী মিটি মিটি হাসছে।
সব শেষে সৌমিত্র বলল, তোমার ‘কচুরিপানা’-র আইডিয়াটা এক্সসেলেন্ট! গুড, ভেরি গুড।
পরদিন সাত সকালে অনিন্দিতা চৌধুরির ফোন। সৌমিত্র একবার আসতে পারবে?
— কেন ? কী হল?
— পত্রার্ক হাসপাতালে।
— সেকী, কেন?
— সে পরে বলব।
— ওর স্ত্রী রাতে ঝগড়া-অশান্তির সময় কাচের গ্লাস ছুড়ে পত্রার্ককে মাথায় হিট করেছে, আর তাতেই… সিরিয়াস কনডিশন! পুলিশ কেস হওয়ার চান্স আছে…
— কিন্তু… এমন কেন হল? হঠাৎ…
ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সৌমিত্র হাসপাতালে পৌঁছে গেল।
পেশেন্ট আইসিইউ-তে। বাহাত্তর ঘণ্টা না গেলে কিছু বলা যাচ্ছে না, ক্ষতি কতটা হয়েছে।
অনিন্দিতা সৌমিত্রকে নিয়ে হাসপাতালের বাইরে একটি চায়ের দোকানে এল। তারপর খুব ধীরে বলতে থাকল— উর্বী আসলে সিজোফ্রেনিক পেশেন্ট। এমনি দেখলে তুমি কিছু বুঝতে পারবে না। কালও বুঝতে পারনি। দেখলে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক মনে হবে। তবে কোনও অ্যাটাক হলেই বিপদ। পত্রার্ক বহু চেষ্টা করেছে। ছোটোবেলার প্রেম— দু’জনে একসঙ্গে ছবি আঁকা শিখত। তারপর পত্রার্ক পড়তে চলে আসে কলকাতায় জেইউ-তে। উর্বী পড়াশোনায় ভীষণ ভালো ছিল কিন্তু চেষ্টা ছিল না। হাই অ্যাম্বিশন ছিল কিন্তু পরিশ্রম ছিল না। স্বপ্ন দেখত, সে পৃথিবীর বিখ্যাত শহরে ছবির এগজিবিশন করবে। লিমুজিন চেপে ঘুরবে। টাকা হবে প্রচুর। বড়ো বাংলো… একদিন সে ভাবল রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী হবে… একদিন ভাবল আইএএস হবে। কিন্তু কাজের কাজ সে কিছুই করে না। পত্রার্কর অনুপস্থিতির সময় মাঝখানে সে একটি ছেলেকে ভালবেসে ফেলে। তার সঙ্গে সে সম্পর্ক টেকেনি। ছেলেটি ওকে ফেলে দুবাই চলে যায়। আর ফেরেনি। শোনা যায় সে বেঁচে নেই। এই ডোডো জন্মানোর আগেই পত্রার্কর কাছে ও ফিরে আসে। বাড়ির কাউকে কিছু না বলে পত্রার্ক কলকাতায় উর্বীকে বিয়ে করে। কিন্তু উর্বীর সমস্যা কমল না। ছেলে বড়ো হলে খালি তার মনে হয় ডোডোকে পত্রার্ক ভালবাসে না। অবজ্ঞা করে। উর্বী অ্যাবরশান করাতে চেয়েছিল কিন্তু পত্রার্ক তা করতে দেয়নি। দায়িত্ব সে নিজেই নিয়েছে। উর্বীর এক সময় মনে হল পত্রার্কই তার এই দুঃসহ জীবনের জন্য দায়ী। পত্রার্ক তাকে চাকরি করতে দেয়নি। পত্রার্কর জন্যই সে ছবি আঁকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। পিয়ানো-শিল্পী হতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। সব দোষ তারই। পত্রার্ক ছবি আঁকতে গেলেই ও বাধা দেবে। আঁকলে ছিড়ে দেবে। ওকে ঘুমোতে দেবে না। সন্দেহ করবে, কোনো মহিলার সঙ্গে কথা বলতে দেখলেই জ্বলে উঠবে।
— মাই গড। তার মানে আমার মেয়ের গল্প শুনে ও রিয়্যাক্ট করল?
— নট অনলি দ্যাট। আমি, এবং ওর সঙ্গে আমার সখ্যতা— তাছাড়া শুনলাম, পাশের বাড়ির মহিলাটি বলছিল, উর্বী কাল রাতে টেঁচামেচির সময় বলেচে, ‘আমি কি এ বাড়ির রাঁধুনি? আমাকে কেন ওত প্রশংসা… চিকেন চিকেন করে মাথা খেল… আমার কি অন্য কোনও যোগ্যতা নেই?’
আইসিইউ এইট, স্পিকারে ডাক পড়তেই একটি লোক ছুটে এসে অনিন্দিতাকে জানাল ডাক্তাররা ডাকছেন।
Tags: কচুরিপানা, কল্যাণ মৈত্র, গল্প
email:galpersamay@gmail.com
Asadharon bolleo kom bola hobe
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।