20 Oct

নিশাচর

লিখেছেন:পূষন


গল্পের সময়ের গল্প

ঘটনাটা বছর তিনেক আগেকার। সে’বার আমরা কয়েকজন পশ্চিমের দিকে বাঙালীর অতি পরিচিত এক হাওয়া-বদলের ডেস্টিনেশানে বেড়াতে গিয়েছিলাম দু’-তিন দিনের জন্য। যে ক’জন আমরা গিয়েছিলাম তাদের মধ্যে মূলত আমি, টুকাই আর ভুলুদাকে ঘিরেই এই কাহিনী। বাকীরা কিছু আগে-পরে জানতে পেরেছিল বটে, তবে সবটা নয়।

আমাদের মধ্যে টুকাই এই ধরনের ঘুরতে-যাওয়ার প্ল্যান অর্গানাইস করে থাকে। ছেলেটার আর যত-ই দোষ-ত্রুটি থাক না কেন, যেখানে যাচ্ছি সেখানকার কোথায় সবচেয়ে সস্তায় অথচ মোটামুটি ভদ্রলোকের মত থাকা-খাওয়া করে দিন কাটানো যায় — এই ব্যাপারে খোঁজ-খবর করতে সে সত্যি খুব পারদর্শী। সে’বারেও আমাদের থাকা-খাওয়ার জন্য সে-ই এক আশ্রমের সাথে নিজস্ব এক সোর্স মারফৎ যোগাযোগ করেছিল। নামমাত্র খরচ, সাথে শান্ত আশ্রমিক পরিবেশ। আমি শুরুতে একটু আপত্তি করেছিলাম, কিন্তু বাকি সবাই ওই ব্যবস্থায় রাজী থাকায় সেই আপত্তি আর বেশী সময় টিকল না। আমি-ও মেনে নিলাম। দুটো রাতের তো ব্যাপার ……

এইবারে ভুলুদার কথা একটু বলে নি’ ছোট্ট করে। ভুলুদা আমাদের চেয়ে বয়সে কিছুটা বড়, মাঝারি গড়ন, উল্টো-পাল্টা বকে, বুদ্ধি কম, এক গাল দাড়ি , অনর্গল ফালতু প্রশ্ন করে যায় আর মাথা পুরো ঝকঝকে সাফ। আসলে ওর মাথায় চুলের ঘনত্ব এতটাই কম যে রাখার চেয়ে না-রাখা ভালো। ভুলুদা তাই সারা বছর আগাগোড়া গোল-গলা টি-শার্ট আর ঢলঢলে হাফ-প্যান্টস পরে সাইকেল চেপে ন্যাড়া সেজেই ঘোরে। লোকটা এমনি ভালো, কিন্তু ব্যালেন্সের বড়-ই অভাব। যে খেয়াল মাথায় চাপল’, সেটা একরকম করে-ই ফেলবে। সেই জিনিস থেকে যে ক্ষতি হতে পারে, কোনো অজানা জিনিস থেকে যে কখনও-সখনও ভয় পাওয়া উচিত — এই অনুভূতিটাই ওর নেই। আগেরবার তো এক পূর্ণিমার বিকেলে সমুদ্রে নেমে প্রায় চল্লিশ গজ এগিয়ে যাওয়ার পরে ওর মনে পড়েছিল যে ও সাঁতার জানে না। সাঁতারে অপারদর্শী এই আমি পাড়ে দাঁড়িয়ে ভাগ্যিস সেই কথাটা রীতিমত চিৎকার ক’রে ওকে আর বাকী বন্ধুদের মনে করিয়ে দিয়েছিলাম! না হলে আমাদের এই ট্যুরটাও হ’ত না, আর এই ঘটনাটাও ঘটত’ না। যদিও সেই বার হোটেলে ফিরে ভুলুদা আমায় বলেছিল,“ওহ, তা সাঁতার নাহয় জানি না, তাতে কি হয়েছে শুনি? … আরে এত ভয় পেলে চলে?! … সমুদ্রে বেড়াতে এসে যদি সমুদ্রে-ই না নামি তাহলে আর করলাম কি? নিজেও ভয়ের চোটে নামলে না, আমাকেও সবাই মিলে চেঁচামেচি করে উঠিয়ে আনলে … নাহ, তোমাদের সাথে আর কোথাও আসব না ঘুরতে … ”

যা-ই হোক, মূল গল্পে ফিরে আসা যাক।

তখন মার্চের মাঝামাঝি। রোদের তেজ সামান্য বেড়ে উঠলেও ওই সব পাহাড়ী, রুক্ষ এলাকায় বসন্ত তখনও যাই-যাই করেও পুরোপুরি বিদায় নিতে পারেনি। ফাঁকা প্রান্তর, ধুলো-ওড়া শুকনো রাস্তা, দু’পাশে ঘন সবুজ শালের জঙ্গল, টুকটাক লোকালয়, এখানে-ওখানে পলাশের ছোটো-বড় বনানী। পথে যেতে যেতে প্রায়-ই চোখে পড়ে বন্ধ-পড়ে-থাকা বড়-বড় সব পোড়ো বাড়ি। বাড়িগুলো যে এককালে খুব সাজানো-গোছানো ছিল সেটা বুঝতে কষ্ট হয় না। শুনেছি কলকাতা এবং অন্যান্য এলাকার শৌখিন বাবুরা এইসব বাড়িতে ‘চেঞ্জ’-এ আসতেন, কাটিয়ে যেতেন বেশ কয়েকটা দিন, কখনও-কখনও তো বেশ কয়েকটা মাস-ও। এখন আর কেউ আসে না, কার্নিশে অশ্বত্থের সুবিশাল ঝুরিওয়ালা ফাঁকা বাড়িগুলোর প্রায় ভেঙে পড়ার অবস্থা। খালি সাদা মার্বেলের ফলকে লেখা নামগুলো এখনও চোখে পড়ে — অমুক আবাস, অমুক ভিলা, তমুক ভবন … এ’সবের মধ্যে-মধ্যে দিগন্তের কাছাকাছি কখনও ঢালু টিলা তো কখনও বা অল্প উঁচু পাহাড়ের অতি সংক্ষিপ্ত শ্রেণী দেখা যায়, আর দেখা যায় তাদের আশে-পাশে কৃষ্ণচূড়া কিংবা সেই পলাশের ছোটো-বড় সারি। দুপুরের হালকা উত্তপ্ত বাতাসে কি-এক ফুলের খুব হালকা একটা গন্ধ টের পাওয়া যায় …… সব মিলিয়ে মন্দ লাগে না চারপাশটা।

আমরা যে আশ্রমটায় উঠেছিলাম সেটা এমনি ছিমছাম হলেও পরিবেশটা কিন্তু খুব ইন্টারেস্টিং। বিরাট লোহার গেটের ভেতরে বিশাল একটা পাঁচিল-ঘেরা জায়গার মোটে ছয় ভাগের এক ভাগ অংশে মূল আশ্রম, তার একপাশে দোতলা অতিথিনিবাস, অন্য ধারে ছোটো এক মন্দির। মন্দিরে আশ্রমের আরাধ্য দেবতার অধিষ্ঠান, সেখান থেকে প্রায় সারাবেলা-ই হিন্দি ভজনের কলি ভেসে আসে। ওদিকে অতিথিনিবাসের লাগোয়া একখানা লম্বা একচালা ঘর, সেটা হল কিচেন-কাম-ডাইনিং রুম। অতিথিশালা থেকে ওই ডাইনিং রুমে যাওয়ার রাস্তাটা এবং প্রায় গোটা আশ্রমটাই নানারকম সুন্দর সুন্দর ফুলগাছ দিয়ে সাজানো, একপাশে খুব ছোট্ট একটা মাঠের মত জায়গায় দুটো দোলনা-ও দেখেছিলাম। আশ্রমের ভেতরে-ই একটা এক কামরার স্কুল রয়েছে, সেখানে গুটিকয়েক স্থানীয় গরীব আর আবাসিক অনাথ শিশুরা লেখাপড়া করে। তা ওই ছোট্ট মাঠ আর দোলনার আয়োজন নিশ্চই তাদের সামান্য মনোরঞ্জনের জন্য-ই। মন্দিরে সকালে ও সন্ধ্যায় আরতি হয়, ছেলেরা প্রার্থনাসঙ্গীত গায়। সবটাই ঘটে অত্যন্ত ঘরোয়া, শান্ত আর অনাড়ম্বর পরিবেশে।

কিন্তু আসল মজাটা শুরু হয় এইসবের পরে। আশ্রমের যে তিনটে অংশের (মন্দির, আশ্রম আর অতিথিনিবাস) কথা বললাম সেগুলো মোটামুটি সমান্তরাল এবং এদের পরস্পর আলাদা করেছে দুইখানা মোটামুটি সরু গলিপথ। এই দুটো গলিপথের একখানা শেষ হয়ে গিয়েছে সে-ই ডাইনিং রুমের দরজায়, কিন্তু অন্য গলিটা দিয়ে সোজা হেঁটে গেলে আশ্রমের পিছনদিকের একটা খোলা জায়গায় গিয়ে পৌঁছানো যায়। ওই জায়গাটা আশ্রমের পাঁচিলের মধ্যে-ই, সেই ছয় ভাগের বাকী চার ভাগ। কিন্তু ওখানে আশ্রম প্রসারিত হয় নি। যেদিন আমরা সেখানে গেলাম, আশ্রমের প্রধান সচিব আমাদের সাথে দেখা করতে এলেন। মাঝবয়সী লম্বা, সুপুরুষ চেহারা, গায়ের রং ফর্সার দিকে। গেরুয়া বসন; চুল, গোঁফ-দাড়ি কামানো। ভদ্রলোক সম্ভবত অবাঙালী, হিন্দীর টানে বলা বাংলাতে এ’কথা-সে’কথার পরে তিনি নিজেই এক সময় বললেন যে আশ্রমের পেছনদিকটায় আমরা যেন সন্ধ্যের পরে না যাই। ভুলুদার তো অত কম কথায় কাজ হবে না, তাই ও ফস করে বলে বসল, “ কেন? কি আছে ওখানে? কেন যাওয়া যাবে না? … গেলে কি হবে? ” সচিব সংযমী পুরুষ, তিনি মৃদু হেসে উত্তর দিলেন, “দেখুন, প্রথমত ওদিকটায় আলো নেই।আমরা দু-একবার আলো লাগিয়েছিলাম, কিন্তু একরাতের বেশী টেকেনি। তারপর থেকে আর আলোর ব্যবস্থা করা হয় নি। তাছাড়া ওই দিকটায় পুরনো বিল্ডিং রয়েছে কিছু, সব ব্রিটিশ আমলের। কেউ যায় না, বহুদিন কেউ সেইসব ব্যবহার করে নি … ঝোঁপ-জঙ্গল আর পোকা-মাকড়ের আড্ডা। এখন শীত পার হয়ে গরম পড়ছে, এই অবস্থায় রাতের অন্ধকারে যদি একটা-দুটো সাপ-খোপ বের হয় তাহলে নিশ্চই আপনি খুব আশ্চর্য হবেন না …”

আরও কিছুক্ষণ বাদে সচিব মহাশয় চলে যাওয়ার পরে আমরা ঠিক করলাম যে আশ্রমের ওই অংশে আমরা একবার অন্তত যাব-ই, কিন্তু সেটা ভোর কিংবা দিনের বেলায়। সচিব মহাশয় খুব ভুল বা আজগুবি কিছু তো বলেন নি।

পরের দিনটা বিভিন্ন মন্দির ঘুরে আর সাইট-সিয়িং করে-ই কাটল। তার পরের দিন বেশী কিছু দেখার ছিল না, তাই সন্ধ্যের একটু পরেই আমরা আশ্রমে ফিরে আসলাম।  পরের দিন বেলা এগারোটার একটু পরে আমাদের ফেরার ট্রেন।

ডিনারের আগে আমরা নীচে এসে পায়চারি করছিলাম। ভুলুদা হঠাৎ বলল, “আরে, কাল তো ফিরে যাব। আশ্রমের ওই পেছন দিকটায় তো যাওয়া হল না!”

টুকাই চটজলদি বলে উঠল, “হুম, তবে চিন্তার কিছু নেই। কাল তো দশটার পরে আমরা বের হব এখান থেকে, তার আগে, মানে এই আটটা-ন’টা নাগাদ একবার গেলেই হবে … তেমন কিছু তো নেই শুনলাম … ওই সব পোড়ো বাড়ি, পোকার আড্ডা ……”

ভুলুদা ওকে শেষ করতে না দিয়েই অধৈর্যভাবে বলে উঠল, “এখন গেলেই তো হয়! চলো!”

এবার আমি বললাম, “একদম না। দ্যাখো ভুলুদা, যাঁরা এখানে থাকে তাঁরা নিশ্চই এই এলাকাটা আমাদের চেয়ে বেশী জানে। তাঁদের কেউ যখন না করছে, নির্ঘাত কোনো কারণ আছে। সেটাকে আমাদের মানা উচিত। কাল সকালেই যাব।”

টুকাই আমার কথায় সম্মতি দিল। ভুলুদা কিন্তু গজগজ করতে লাগল। এত ভয় পেলে নাকি চলে না ইত্যাদি ইত্যাদি।

ডিনার অতি সাধারণ মানের, কিন্তু এই এলাকার জলের গুণে হজম এত জলদি হয় যে খিদে পেতে সময় লাগে না। তাই সাধারণ খাবারও মোটামুটি সুস্বাদু ঠেকে। তাছাড়া খাবারের মূল দায়িত্বে থাকা মনোতোষবাবুর আন্তরিকতাও অসামান্য। ভদ্রলোক যথেষ্ট প্রবীণ, কিন্তু খিটখিটে নন। এবং বাঙালী। কথা বলে মনে হয়েছে, ভদ্রলোক যথেষ্ট জ্ঞানী অথচ সুরসিক, মানে হাসি-মজা করতে ভালোবাসেন। তিনি নাকি এখানকার-ই লোক, তাঁর গত ছয় পুরুষের বাস এই তল্লাটে। আগে রাঁচীতে একটা অফিসে কাজ করতেন, পরে অবসরগ্রহণ করে জন্মভিটেয় ফিরে আসেন।সাত বছর আগে আচমকা বিপত্নীক হয়ে পড়ার পরে যোগ দেন এই আশ্রমের সেবাকার্যে। কাছেই বাড়ি, দিনে অন্তত একবার, প্রধানত দুপুরের আহারান্তে, সাইকেল চালিয়ে তিনি বাড়িতে যান। রাতে অবশ্য আশ্রমেই থাকেন। এরকম উলটো ব্যবস্থা কেন সেটা আর জিজ্ঞেস করা উচিত বলে বোধ করিনি। তবে ভুলুদার পাল্লায় ভদ্রলোককে পড়তে হয়নি এই-ই রক্ষে! কোনো প্রশ্ন-ই বাদ যেত না।

খাবারের পরে ঘরে ফেরার পথে দেখা রামগুলামের সাথে। রামগুলাম সর্দার হল এই আশ্রমের রাত-প্রহরী। বয়স পঁয়ত্রিশ কি সাইত্রিশ হবে, মজবুত চেহারা, গায়ে হালকা কম্বল, এক হাতে টর্চ আর অন্য হাতে মোটা পাকানো লাঠি। ওর মুখে-ই শুনেছিলাম, এই এলাকায় নাকি পনের বছর আগেও ডাকাতের আনাগোনা ছিল, এখনও নাকি ডাকাতের দল পুরোপুরি নিকেশ হয় নি, সব ‘ঘাত লাগিয়ে’ আন্ডারগ্রাউন্ড হয়ে আছে, সুযোগ পেলেই হামলা করবে। এই জন্য-ই তো সে বহাল আছে এখানে! রোজ রাতে সে একা লাঠি হাতে পাহারা দেয় এই আশ্রম চত্বর।

রামগুলামকে দেখে-ই ভুলুদার মাথায় পোকা নড়ে উঠল, “আরে রামগুলাম, তুম তো ইধার … মানে, ইয়ে … পাহারা দেতা হ্যায় … কভি রাত কো পাহারা দেওয়ার সময় … উধার … পিছে নেহি গ্যায়া কেয়া?”

এই ভয়ংকর হিন্দি শুনেই হোক বা যে কারণেই হোক, রামগুলামের চোখ গোল-গোল হয়ে উঠল। সে গম্ভীর গলায় বলল, “নেহি সাহাব, নেহি গয়ে হাম। মানাই হ্যায় যানে কা। খাস কর রাত কো।”

কিন্তু ভুলু হ্যায় কি মানতা নেহি, ফের প্রশ্ন, “কেন … মানে, কিউ কিউ? কেয়া হ্যায় উধার? কিউ নেহি যাতা?”

এবার একটু বিরক্ত হল রামগুলাম, বলল, “নেহি মালুম কেয়া হ্যায়। লেকিন জিস দিন সে হাম কাম পে আয়ে, উসি দিন বড়া সাহাবনে হামসে কাহা কি উধার শাম কে বাদ মাত যানা, খাতরা হ্যায়। অওর ইয়ে ভি কাহা থা উনহো নে কি আগার তুমহে ম্যায় খুদ ইয়া হাম মে সে কোই অওর তুমহে অন্ধেরা হোনে কে বাদ আকে উধার যানে কো বোলে তো তুম তব ভি মাৎ যানা, উসকে মু পে বোল দেনা কি হাম উধার নেহি যায়েঙ্গে, আপ লওট যাইয়ে … তো হাম কভি ভি নেহি গ্যায়ে। মালিক জিস কামকো মানা করতে হ্যায়, হাম নেহি করতে।”

আমি একটু পাকামি করে বললাম, “কারেক্ট বাত রামগুলামজি … লেকিন এক বাত পুছে?”

— “জরুর পুছিয়ে সাহাব।”

— “হামনে শুনা হ্যায়, উধার কুছ পুরানা মাকান হ্যায়। কব কা হ্যায়, ইয়া কিসনে বানায়া থা উস বারে মে ……”

রামগুলাম আমার কথা বুঝে নিয়ে ডাইরেক্ট পয়েন্টে চলে আসল, “দেখিয়ে সাহাব, হামে তো সির্ফ ইতনা পাতা হ্যায় কি ইয়ে জাগাহ পে প্যাহেলে আংরেজ লোগোকা কা দফতর অওর কোঠি হুয়া করতা থা। লেকিন পুরানে লোগ কহেতে হ্যায়, উসসে ভি পহেলে ইধার ভিরানা থা … খালি মকানে থি, অওর ঘনা জাঙ্গল থা … ফির আয়ে আংরেজ। লোগ তো ইয়ে ভি বোলতে হ্যায় কি আংরেজো কে পহেলে, যব ইয়ে জাগাহ ভিরান থি তব ইধার ছলাওয়া কা বাস থা … পর দেখিয়ে, ওহ সব কহি-শুনি বাতে হ্যায় সাহাব; মানো তো ভগওয়ান, না মানো তো পাত্থার! ছলাওয়া হো ইয়া নেহি হো, পর উধার আবিভি থোরা জঙ্গল হ্যায়, অওর সাপ-বিচ্ছু-মাকোড়েঁ ভর-ভর কে হ্যায়। তো রাত মে নেহি জানা হি বেহেতর হ্যায় জি  … আপ ভি মৎ যানা সাহাব … কুছ হো গয়া তো ফির …”

আমি ওকে থামিয়ে বললাম, “নেহি নেহি সর্দারজি, রাত মে হাম নেহি জায়েঙ্গে। বেফিকার রহিয়ে আপ।”

এর একটু পরে-ই আমরা নিজেদের ঘরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ফেরার পথে ভুলুদা সেমি-প্রশ্ন করল, “এই ছলাওয়া ব্যাপারটা কি তা তো বুঝলাম না টুকাই …”

টুকাই বলল, “কে জানে … জন্তু-টন্তু হবে … তোমার মতন আর কী ……”

আমি হেসে বললাম, “ওসব নয়, ছলাওয়া হচ্ছে দেহাতের একটা লোককথা বা প্রবাদ-টাইপের … সেটা মোটামুটি এরকম যে এক ধরনের প্রেত বা অপশক্তি আছে যারা তোমার কোনো প্রিয়জনের বেশ ধরে এসে তোমায় নিজের সাথে নিয়ে যাবে কোনো শুনশান জায়গায়, তুমি টের-ও পাবে না। তারপরে অবশ্য তোমার লাশ পাওয়া যেতেও পারে, নাও যেতে পারে …”

টুকাই পাশ থেকে বলল, “ ‘ভুলোর ছলনা’ …”

আমি বললাম, “একদম।”

ভুলুদা কি বুঝল জানি না, খালি হে-হে করে একটা বোকার পন্ডিতি জাহির করার মত শব্দ করে হাসলো।

তখন রাত দশটা বেজেছে সবে, এত তাড়াতাড়ি আমরা কেউ-ই ঘুমাই না। তার উপর এই এলাকায় মোবাইল ইন্টারনেট প্রায় আসে না বললেই চলে। তাই আড্ডা মারার জন্য আমার ঘরে সবাই জড়ো হল। ওদিকে খালি টুকাই আর ভুলুদা নীচের তলায় টুকাই-এর ঘরে গিয়ে ঢুকলো। সারাদিন রোদে ঘুরে সন্ধ্যে থেকেই টুকাইয়ের নাকি বেজায় মাথা ধরেছে, তাই আর ও আড্ডায় এল না। আর ভুলুদার ফোনে নাকি চার্জ নেই, সে গেল টুকাই-এর ঘরে চার্জ দিতে। এটা ভুলুদার পক্ষে-ই সম্ভব।

আমার ঘরে আমি ছাড়াও আমাদের আরেক বন্ধুর থাকার ব্যবস্থা ছিল, ওর নাম মৈনাক। আমায় আর মৈনাককে রেখে বাকী সবাই যখন আড্ডা মেরে আমাদের ঘর থেকে বিদায় নিল, তখন রাত বারোটা বেজে গিয়েছে। আমি আর মৈনাক যে যার খাটে শুয়ে টুকটাক অল্প-স্বল্প কথা বলছি, ঘুম আসতে বেশী দেরী নেই, এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল। মৈনাক কিছু বলতে যাচ্ছিল, আমি ওকে ইশারায় থামালাম। আমি ভূতের গল্পের অভিজ্ঞ পাঠক, তাই রাতে দরজায় কম করে চারবার টোকা না পড়লে সাড়া দি’ না। পাঁচটা টোকার পরে বললাম, “কে রে?”

বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে টুকাই-এর উদ্বিগ্ন গলা শুনতে পেলাম, “আরে আমি টুকাই, বরদাগিরি না করে দরজাটা খোলো তাড়াতাড়ি …”

আমি দরজা খুলতেই ঘরের মধ্যে ঢুকে এল টুকাই। মাথার চুল সকালের সূর্যমুখীর পাপড়ির মত বিকশিত, চশমাটা লম্বা নাকে রীতিমত ঝুলছে, চোখ দুটো ফোলা আর হালকা লাল। বুঝলাম ব্যাটা ঘুম থেকে উঠে এসেছে তাড়াহুড়ো করে।

বললাম, “কি রে? কি হয়েছে?”

দু’-এক সেকেন্ড আমার দিকে তাকিয়ে রইল টুকাই। তারপর দুম করে বলে উঠল, “ভুলুদা ভ্যানিশ!”

“অ্যাঁ?! … কি বললি?!” ওদিকে মৈনাক-ও বিছানায় উঠে বসেছে।

ওর দিকে ফিরে টুকাই বলল, “ভুলু ভ্যানিশ! ভুলুদাকে পাওয়া যাচ্ছে না। কোনো ঘরে নেই। সব খুঁজে এসেছি।”

বললাম, “তোর ঘরেই তো গেল লাস্টে … ফোন করেছিস? …”

— “আরে ধুর! ফোন চার্জে বসিয়ে বকবক করছিল। আমি ওষুধ গিলে শুয়েছিলাম। অল্প পরে-ই ঘুমিয়ে পড়ি। একটু আগে ওর রুম পার্টনার রানা এসে আমায় ডেকে তোলে, বলে ভুলুদা ঘরে যায় নি, তাই ওকে নিতে ও এসেছে। এদিকে ভুলুদা তখন আমার ঘরেও নেই। ফোনও নেই, চার্জারের তার মাটিতে লুটোচ্ছে। তারপরে আমি আর রানা সব ঘরে খুঁজে এসেছি, মাল কোথাও নেই! ফোন করছি, কখনও বলছে নেটওয়ার্কের বাইরে, কখনও বলছে সুইচড অফ! রানাকে ওর ঘরে বসিয়ে এসেছি, যদি ভুলুদা ফিরে আসে তাহলে ও আমায় ফোন করবে … রাত একটা বাজতে চলেছে … কি জ্বালা বলো তো! …”

আমি মৈনাককে বললাম, “তুই আমাদের দরজার সামনে বসে থাক চেয়ার টেনে, বুঝলি! ভুলুদা এখানে আসলে বা কোথাও ওকে দেখতে পেলেই আমাকে বা টুকাইকে ফোন করবি। দেরী করবি না। মনে থাকবে তো?”

মৈনাক ফোন হাতে উঠতে উঠতে বলল, “আরে হ্যাঁ … যাও তোমরা ……”

এরপরে আমি আর টুকাই চাপা স্বরে ভুলুদার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন অক্ষরের গালি বর্ষণ করতে করতে ঘরের বাইরে বের হতে যাব — এমন সময় চারপাশের সমস্ত আলো নিভে গেল এক নিমেষে। পাওয়ার কাট। মোক্ষম টাইমিং একেবারে।

আমরা থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম সিঁড়ির মুখে। টুকাইকে বললাম, “কি রে, যাবি?”

ও মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বালতে জ্বালতে বলল, “চলো … লাশটা তো লাগবে …”

এরপরে আর কথা চলে না। দুজনেই সিঁড়ি ভেঙে নীচে নামতে লাগলাম।

নীচে নেমে দেখি, চারপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার। বহু দূরে একটা দোতলা বাড়ির জানালা দিয়ে আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে, খুব সম্ভবত ইনভার্টার। মন্দিরের দিকে তাকাতে দেখি, একটা প্রদীপ টিমটিম করে জ্বলছে। যার সাথে প্রথম দেখা হবে ভেবেছিলাম, সেই রামগুলামের টিকিটাও দেখতে পেলাম না ধারেকাছে। আমি আর টুকাই মুখ বন্ধ রেখে ফ্ল্যাশ জ্বেলে এদিক-ওদিক ঘুরতে লাগলাম। কেউ নেই কোত্থাও। অন্ধকারে দু’-একটা জোনাকি জ্বলছে ফুলগাছগুলোর আনাচে-কানাচে। দূরে কোথাও ঝিঁঝিঁ ডাকছে, হালকা হাওয়ায় খসখস শব্দ হচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেবদারুগাছের পাতায় পাতায়। ভুলুদা ভ্যানিশ।

দোলনা, ডাইনিং রুমের চত্বর ঘুরে আমরা এসে হাজির হলাম মন্দির আর আশ্রমের মাঝের সেই গলিপথটার সামনে। আমি উলটো দিকে মুখ করে রাস্তার দিকে দেখছিলাম যদি ভুলুদাকে মেইন গেটের সামনে দেখতে পাই। অন্ধকারে তেমন কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না, তাও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ আমার টি-শার্টের হাতায় একটা টান লাগালো টুকাই। চমকে তাকালাম ওর দিকে। ওর মুখ আমার উলটো দিকে, মানে গলি বরাবর। মুখ না সরিয়েই ও খুব চাপা স্বরে আমায় বলল, “ওটা …… ভুলুদা না?”

আমি ওর চোখ লক্ষ্য করে গলিটার দিক বরাবর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। দেখতে পেলাম, অনেক দূরে, গলিটার একেবারে শেষে, হয়ত আশ্রমের ওই এলাকার শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে একটা সিলুয়েট মূর্তি, তার হাতে একটা মৃদু, মরা হলদেটে আলো। সেই আলোটা যে বলয় সৃষ্টি করেছে সেটার ব্যাকগ্রাউন্ডেই দৃশ্যমান হয়েছে সেই মূর্তিটা। চোখ-মুখ স্পষ্ট নয়, কিন্তু তার সেই আকার-আকৃতি দেখে তো পুরো ভুলুদার মতই লাগছে। ওইরকম হাইট, এও সম্ভবত হাফপ্যান্টস পরেছে, হাতের আলোটা হয়ত ফ্ল্যাশ। দূর থেকে দেখলে কি সবসময় ক্ষীণ আলোর রং বোঝা যায় ঠিকঠাক? ওটা কি তবে ভুলুদা-ই?

মূর্তিটা দূরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে, তার মুখের একটা সাইড আমাদের দিকে। যেদিকে তার দৃষ্টি প্রবাহিত হয়েছে সেদিকটা আড়াল করে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে আশ্রমটা। ও’পারে যে কি আছে এখান থেকে বোঝা যাবে না। স্থির হয়ে গলির শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে আছে লোকটা, গলির এই মুখে স্তব্ধ হয়ে রয়েছি আমরা। কেউ নড়ছি না একটুও।

টুকাই আমায় ফিসফিস করে বলল, “একটা ডাক দেব পাগলাটাকে? … কি বলো?”

আমি একটু সময় নিলাম, তারপর মূর্তিটার দিক থেকে চোখ না সরিয়েই বললাম, “উঁহু, চুপচাপ থাক। দ্যাখ না কি করে!”

এক সেকেন্ড, দুই সেকেন্ড, তিন, চার, পাঁচ … সব স্থির। আচমকা নড়ে উঠল আলোর বলয়টা , আর তার সাথে সাথে মূর্তিটাও যেন মৃদু গতিপ্রাপ্ত হল। তিন সেকেন্ডের মধ্যে  আমাদের হতবুদ্ধি করে দিয়ে সেই আলোর বলয়সমেত সিলুয়েট মূর্তিটা খুব ধীরে ধীরে চলতে চলতে আশ্রমের আড়ালের অজানার ভেতরে হারিয়ে গেল। আর তাকে দেখা গেল না।

টুকাই মরিয়া হয়ে বলল, “এই রে! চলে গেলো তো! … দাঁড়াও, ধরে আনি ব্যাটাকে!” এই বলে সে গলির দিকে ফ্ল্যাশ হাতে পা চালিয়ে দিল। আমিও যাব-কি-যাব না ভাবছি, এমন সময় আমাদের পেছন থেকে চাপা একটা কণ্ঠস্বর ভেসে আসল, “রুকিয়ে সাহাব, মাৎ যাইয়ে! রুকিয়ে!”

টুকাই থেমে গেল, আমিও পেছনে তাকালাম। দেখি, রামগুলাম সর্দার কখন যেন আমাদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। আমার হাতের ফ্ল্যাশ তার গায়ে পড়েছে, তাতেই দেখলাম, তার একহাতে সেই লাঠি, অন্য হাতে কিসের একটা বোতলজাতীয় প্লাস্টিকের ডাব্বা। ততক্ষণে টুকাই-ও আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। রামগুলামকে আমি বললাম, “আরে সর্দারজি, হামারা দোস্ত, ভুলুদা কাহি খো গায়া হ্যায়, মতলব রুম মে নেহি হ্যায় … আভি আভি উস গলিকে আন্দর হামনে কিসিকো দেখা উনকে য্যায়সা … ও আশ্রম কে উসপার, উধার চলা গয়া হাত মে রোশনি লেকে …” এই বলে আমি হাতের ইশারায় মূর্তিটা যেদিকে গিয়েছে সেই দিকটা নির্দিষ্ট করলাম।

টুকাই কিছু বলতে যাচ্ছিল, রামগুলাম তাকে আটকে দিয়ে বলল, “সাহাব, আন্ধেরে মে উধার যানা মানা হ্যায়। মাৎ যাইয়ে। ইস বাৎ কি কোই গারান্টি নেহি হ্যায় কি যো আপ কো দিখা, ও আপকা দোস্ত হি হো … আপ দো মিনিট রুকিয়ে ইধার … কাহি মাৎ যাইয়েগা মেহেরবানি সে … হাম আতে হ্যায় …” এই বলে সে মন্দিরের পিছনদিকটায় চলে গেল দ্রুত।

আমরা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। একটু পরেই প্রথমে একটা ঘরঘর যান্ত্রিক শব্দ উঠল মন্দিরের পেছন থেকে, তার দু’সেকেন্ড বাদেই সমস্ত দিকে একটা দুটো করে কয়েকটা আলো জ্বলে উঠল। জেনারেটর। অতিথিনিবাসের দিকে তাকিয়ে দেখি সেখানেও আলো এসে গেছে। আমার দোতলার ঘরের আলোর সামনে চেয়ার পেতে মৈনাককেও বসে থাকতে দেখলাম। যাক, তাও একটু স্বস্তি পেলাম আলো দেখে।

একটু পরেই রামগুলাম আমাদের সামনে হাজির হল। এবার তার হাতে শুধু লাঠি। সে বলল, “আরে সাহাব, লাইট চলে যানেকে বাদ হাম গয়ে থে জিনরেটর চালানে …  যাকে মালুম চলা কি তেল নেহি হ্যায় উসমে! তো ফির হাম ইস্টোর রুম গয়ে ডাব্বা ভরকে তেল লেনে কে লিয়ে। লওটে তো দেখা কি আপ লোগ খাড়ে থে হাত মে ফোন লেকে …”

টুকাই বলল, “ঠিক হ্যায়, লেকিন ভুলুদা …”

রামগুলাম খুব ব্যক্তিত্বের সাথে জবাব দিল, “দেখিয়ে সাহাব, উধার তো আপ নেহি যা সাকতে ফিলহাল … খতরা হ্যায় উধার। অওর আগার আপকে দোস্ত কা বাত হো তো হাম কহেঙ্গে, ইধার ভগওয়ান ভি বসতে হ্যায় সাহাব, উনকে উপার আস্থা রাখিয়ে , আপকে দোস্ত কো কুছ নেহি হোগা … আপ ঘর যাইয়ে… ম্যায় হু ইধার। আপ যাইয়ে, আপকে দোস্ত লওটতে হি হোঙ্গে … আপ যাইয়ে …”

দোনো-মনা করতে করতে আমরা ফিরলাম। আমি আর টুকাই নীচের ঘরেই রইলাম, রানা আর মৈনাককে ফোনে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিয়ে সজাগ থাকতে বলে দিলাম। কে যে তখন আলো-হাতে  চলে গেল আঁধারের অন্তরালে সেই কথা ভাবতে ভাবতে ভুলুদাকে গালি দিতেও ভুলে গেলাম আমরা। ওটা কি ভুলুদা-ই ছিল? নাকি অন্য কেউ? যদি তাই হয়, তাহলে কে? চেহারার তো বিশাল মিল ছিল … ছিল না? দু’জন মানুষ কি একসাথে ভুল দেখতে পারে?

টুকাই খালি মাঝখানে একবার লম্বা শ্বাস ছেড়ে বলল, “ব্যাটা পজেসড হয়ে না ফিরে আসে!”

রাত যখন প্রায় দেড়টা, হঠাৎ আমার ফোনটা বেজে উঠল। হাতে নিয়ে দেখি, ‘মৈনাক কলিং’। রিসিভ করতেই মৈনাক চিৎকার করে উঠল, “আসছে, আসছে! বাইরে দ্যাখো, কুত্তা আসছে!”

আমি ফোন রেখে টুকাইকে নিয়ে দৌড়ে বাইরে আসলাম, আর এসে দেখলাম, সামনের রাস্তা ধরে আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছে রামগুলাম আর ভুলুদা। কি জানি কথা বলছে দু’জনে।

ভুলুদাকে আমাদের জিম্মায় রেখে বিদায় নিল রামগুলাম। আমরা পড়লাম ভুলুদাকে নিয়ে।

টুকাই তো বাঙালীর গালাগালির এনসাইক্লোপিডিয়ার কোনো শব্দ-ই বাদ দিল না। আমি বললাম, “গেছিলে কোথায়? … ফোনটা অফ কেন? একটা কল করে তো মানুষের বলা উচিত, নাকি?”

ভুলুদা খুব-ই বিমর্ষভাবে হাই তুলে বলল, “আরে বাবা, আমি দূরে কোথায় আর গেলাম? … ওই তো পিছনের জমিটায় গেছিলাম … কত বড় বড় সব বাড়ি-ঘর …… আর আমার ফোন তো অফ নয়, ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে ঘুরলাম এতটা সময় … এই দ্যাখো না, দিব্যি চলছে …” এই বলে ফোনের পাওয়ার বাটান প্রেস করে আমাদের দিকে তুলে ধরল ভুলুদা। সত্যি-ই ফোনটা অন আছে, ব্যাটারি হাফ-এরও বেশী ফুল।

টুকাই বলল, “দাঁড়াও শালা, কাল তোমার খবর নেব … এক্ষুণি ঘরে যাও! সকালের ট্রেন, এখন আর নাটক বাড়াচ্ছি না। আর যেন বাইরে না দেখি বলে দিলাম! যাও ঘরে!”

এইসব তর্জন-গর্জন শুনে সেই হে-হে করে একবার হেসে নিয়ে ভুলুদা নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। যেতে যেতে বলতে লাগল, “এত ভয়ের কি আছে কে জানে বাবা … রাতে কি হবে বেরোলে? …নাহ, এদের সাথে আর ঘুরতে আসব না …”

বাকী রাত নির্বিঘ্নেই কাটল। আমি অবশ্য শুরুতে-ই দেখে নিয়েছিলাম যে ভুলুদার ছায়া পড়ছে, পায়ের পাতাও সোজা আছে।

পরদিন সকালে মোটামুটি সাড়ে আটটার পরে আমি আর টুকাই হাঁটা দিলাম সেই পিছনের জমিটার উদ্দেশ্যে। কি আছে ওখানে দেখা-ই যাক।

হালকা ঝোঁপ-ঝাড়ের ভেতর দিয়ে সাবধানে যেতে লাগলাম আমরা। কিছুটা পরেই লম্বা মম্বা ঘন ঘাসে ঢাকা একটা জমির মধ্যে এসে দাঁড়ালাম আমরা। আমাদের সামনে তখন দক্ষিণে মুখ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে সুবিশাল এক দোতলা অট্টালিকা। বাড়িটা যত না লম্বা, তার চাইতে বেশী চওড়া। প্রতিটা তলায় আন্দাজ পনের-কুড়িটা করে ঘর তো রয়েছে-ই। দেখেই বোঝা যায় বাড়িটার বয়স নেই-নেই করেও একশ’ বছর তো হবেই। কোনো দেওয়াল ভেঙে পরে ইটের কঙ্কাল বেরিয়ে পড়েছে, কোথাও বড়-বড় বট-অশ্বত্থের চারা বেরিয়ে পড়েছে , কোথাও আবার শ্যাওলা আর নোনা মিলেমিশে কালো আস্তরণের সৃষ্টি করেছে দেওয়াল জুড়ে। বাড়িটায় অনেক ঘর, অনেক জানালা-দরজা। জানালার সবগুলোই টেকনিকালি বন্ধ, কয়েকটার অবশ্য পাল্লা ভেঙে ঝুলছে, কয়েকটাকে আবার একটা করে পাল্লা লোপাট হয়ে গিয়ে অনেকটা বিদেশী ফিল্মে-দেখা সেই এক-চোখ-ঢাকা পাইরেটের মত দেখাচ্ছে। আমরা পায়ে-পায়ে এগিয়ে গেলাম বাড়িটার দিকে।

বাইরে থেকে একতলাটার এক চক্কর মারতেই বুঝে গেলাম, এই বাড়িতে লোক আসেনি বহুকাল। নীচের সব কয়টা ঘরের দরজায় বিরাট বড়-বড় তালা ঝুলছে, তালাগুলোর গায়ে পুরু ধুলো আর ঝুলের আচ্ছাদন। দোতলার বারান্দার কার্নিশ ভেঙে পড়েছে অনেক জায়গায়, সেই ভাঙা ইটগুলো-ও নীচের অংশে পড়ে আছে শ্যাওলা-মাখা অবস্থায়। একপাশে আমরা একটা প্রায় ভেঙে-পড়া সিঁড়ি আবিষ্কার করলাম, সেটা দিয়ে আর ওঠার উপায় আর নেই। এটা নিশ্চই দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। বহু পুরোনো আর অব্যবহৃত হলেও বাড়িটার মধ্যে যেন একটা আকর্ষণ করার ক্ষমতা আছে টের পেলাম। কোনো একটা রহস্য, কিছু একটা যেন আমাদের ( পরে সেটা টুকাই-ও স্বীকার করেছিল) ভেতরে ডাকছে, যেন ডেকে ডেকে বলছে, “এসো, ভেতরে এসো … দেখে যাও ভেতরটা … কত সব মজার জিনিস আছে , আসো … চলে এসো …”

বেশীক্ষণ আর ওখানে দাঁড়ালাম না। বড় ঘাস আর ঝোঁপের আড়ালে সাপ বা বিছে থাকা সত্যি-ই অসম্ভব কিছু নয়।

ফেরার পথে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল মনোতোষবাবুর সাথে। ওঁনার হাতে একটা সরু করে কাটা চ্যালা কাঠের মোটা বান্ডিল, মনে হয় রান্নার কাঠ এগুলো। আমাদের ওদিক থেকে আসতে দেখে ভদ্রলোকের মুখের হাসিটা মিলিয়ে গিয়ে কেমন যেন কালো আর থমথমে হয়ে উঠল। আমরা কাছে আসতেই উনি বললেন, “ওদিকে গিয়েছিলেন বুঝি? … আচ্ছা, চা রেডি আছে, ডাইনিং-এ চলে আসুন সকলে।” বলেই ভদ্রলোক পিছন ফিরে হাঁটা দিলেন সেইদিকে।

আমরা ফোন করে সকলকে ডাইনিং-এ আসতে বলে দিয়ে দু’জন মিলে চলে এলাম মনোতোষবাবুর পিছন পিছন। ডাইনিং রুমে এসে বসতেই মনোতোষবাবু নিজে আমাদের চা আর টোস্ট দিলেন, তারপর নিজেও এসে বসলেন আমাদের সামনে। ডাইনিং-এ তখন খালি আমরা তিনজন, বাকীদের কেউ তখনও এসে পৌছায় নি।

কথায়-কথায় আমরা জানালাম যে আমরা আজ-ই ফিরে যাচ্ছি। ভদ্রলোক যেন একটু নিশ্চিন্ত হলেন সেটা শুনে। তার একটু পরে-ই টুকাই সেই বাড়িটার কথা তুলল। ভদ্রলোকের মুখটা আবার একটু থমথমে হয়ে পড়ল। একসময় আমি বলেই ফেললাম, “আচ্ছা, ওই বাড়ির কোনো ইতিহাস আছে নাকি? … কিছু জানেন?”

ভদ্রলোক একটু থেমে গলাটা খাটো করে বললেন, “দেখুন, ইতিহাস তেমন কিছু তো নেই, খুব মামুলি ব্যাপার। আমার ঠাকুরদার মুখে শুনেছি খুব ছোটোবেলায়, এই বাড়িটায় ইংরেজ আমলে বড় অফিস ছিল। মানে যাকে বলে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিং। ব্রিটিশ তো চলে গেল, যাওয়ার পরে এটা এই আশ্রমের হাতে এল বেশ কিছু বছর পরে। ব্রিটিশদেরও আগে, বাড়িটা ছিল এ’ অঞ্চলের এক বড় জমিদারের বাগানবাড়ি। সেই জমিদারমশাই বন্ধু-বান্ধব নিয়ে ফূর্তি করতে আসতেন মাঝে-মধ্যে। ওই বাড়ির নীচের অংশটায় নাকি বড় জলসা বসত’, বাইরে থেকে ওস্তাদরা আসতেন, বাইজীরা আসতেন। এলাহী আয়োজন। তবে সে’সব দেড়শ’ বছরের-ও আগের কথা … লোকমুখে শোনা …… তবে ব্যাপার কি জানেন, জায়গাটার বদনাম আছে। নানারকম নিশাচর বেরোয় রাতের বেলায় … এ’ আশ্রম-ও তো ওদিকে আর বাড়ানো হয় নি, ওদিকটায় কেউ যাই-ও না। আপনারা আজ চলে যাবেন, তাই আপনাদেরও যাওয়ার আশঙ্কা নেই … হে হে … চা খান, ঠান্ডা হচ্ছে…”

আমরা আর গতরাতের ভুলুদার ব্যাপারটা বললাম না ওঁকে।

ট্রেন যখন যশিডি ছাড়ালো, তখন আমরা ফের ভুলুদাকে পাকড়াও করলাম। কি করেছে ও কাল রাত্রে সেটা এবার শুনি!

ভুলুদা চোখ আর হাত-পা নেড়ে বলতে শুরু করল, “আরে বাবা … যেই না গলি দিয়ে পেছনের জমিতে গিয়ে পড়েছি, সঙ্গে সঙ্গে লাইট অফ! হে-হে … ভাগ্যিস ফোন ছিল সাথে … তা আমি তো ফ্ল্যাশ জ্বেলে গেলাম সেই বাড়ির সামনে… বিরাট বিরাট সব ঘর … অন্ধকার, ঝিঁঝিঁ ডাকছে … গাছের পাতায়, ঘাসে-ঘাসে খসখস করে শব্দ হচ্ছে, কি সব যেন অতর্কিতে চলে যাচ্ছে আমার আশপাশ দিয়ে … আমি এগোলাম অন্ধকার বাড়িটার দিকে……

দোতলায় গেলাম প্রথমে … ওখানেও বড় বড় সব ঘর, টোক্কা খেলা যায় রীতিমত … ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম … কে বলবে এতদিনের পুরোনো, সব ঝকঝক করছে … পরিষ্কার মার্বেলের মেঝে, পালঙ্ক, বিছানা, আর্মচেয়ার … একদম নিট অ্যান্ড ক্লিন যাকে বলে … দোতলার সব ক’টা ঘর ঘুরে নীচের তলায় নামলাম। সেখানেও এক ব্যাপার। পেল্লায় সব ঘর, পরিষ্কার, আসবাবপত্র সব রয়েছে, কিন্তু লোক নেই … যেন আমাদের মত অতিথিদের জন্য কেউ সব সাজিয়ে রেখে এইমাত্র কোথাও গেছে, আমরা এসে বসে হাঁক দিলে-ই সবাই চলে আসবে …”

আমি বললাম, “তুমি সব ঘর ঘুরলে? … মানে ভেতরে ঢুকেছ ঘরগুলোর? …ওই আসবাবপত্র চোখে দেখেছ?”

ভুলুদা বিরক্তিভরে বলল, “দেখেছি তো! এই মোবাইলের ফ্ল্যাশের আলোয় সব দেখেছি! ঘরের ভেতরে না ঢুকলে কি এত সব দেখা যায় নাকি? … হে-হে … তুমিও কি সব যে বলো …… কিন্তু, একটা ভয়ানক ব্যাপার আছে ওখানে …”

টুকাই উত্তেজিতভাবে বলল, “কি? কি ব্যাপার?”

ভুলুদা খুব চাপা গলায় বলল, “ নীচের তলার পাঁচ-ছ’টা ঘর ঘোরার পরে পাশের একটা আরও বড় ঘরে যাব, কিন্তু ঢুকতে গিয়ে দেখি দরজা ভেজানো! … বাকী সব ঘরগুলোর দরজা সটান খোলা পেয়েছি, এটা এরকম কেন? দাঁড়িয়ে গেলাম। হঠাৎ একটা শব্দ আমার কানে এল দরজার ভেতর থেকে। খুব হালকা শব্দ, কিন্তু বুঝতে অসুবিধা হয় না। ছম … ছম… ছম … ছম ……… কেউ যেন খুব আস্তে আস্তে নূপুর পায়ে হাঁটছে ঘরের ভেতরে … তিন-চার সেকেন্ড দাঁড়িয়ে ছিলাম, ভেতরে ঢুকিনি। একটা সময় মনে হল, আওয়াজটাও ক্রমশ যেন আমার দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করেছে …… আর সেখানে থাকি নি … চলে এলাম … গলি থেকে বেরিয়েই দেখি রামগুলাম লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে … তারপর তো ……”

কিছুক্ষণ ট্রেনের আওয়াজ ছাড়া বাকী সব চুপ। কেউ কিছু বলছি না দেখে ভুলুদা অধৈর্যভাবে বলল, “ব্যাপার বুঝলে?”

টুকাই হাঁ করে বলল, “কি ব্যাপার?”

— “আরে ওই ছম-ছম শব্দটা … বন্ধ ঘরের ভেতর থেকে আসা সেই আওয়াজটা … বুঝলে না?”

— “না, মানে এসব পুরোনো বাড়িতে …” টুকাই কথা গুছিয়ে নিতে সময় লাগাচ্ছিল।

— “আরে ধুর! … হে-হে … তোমাদের বুদ্ধি-টুদ্ধি দেখছি একেবারে-ই নেই … বুঝলে না?! … আরে বাবা, র‍্যাটেল স্নেকের নাম শুনেছ? … এই র‍্যাটেল স্নেক যখন চলা-ফেরা করে তখন ওরকম ছম-ছম শব্দ হয় ওদের লেজের দিক থেকে … ওইঘরে নির্ঘাত ওই সাপের-ই আড্ডা … আমি আওয়াজ শুনেই বুঝেছি! তারপর যখন সেটা আমার দিকে, মানে দরজার দিকে আসতে লাগল, তখন আর দাঁড়ালাম না … কি দরকার বাবা, সাপের কামড় কে আর যেচে খেতে চায়? … হে-হে হে-হে …” ভুলুদা হাসতে লাগল। সে যে দুর্দান্ত বুদ্ধি খাটিয়ে, দারুণ বাহাদুরি দেখিয়ে একটা অভূতপূর্ব আবিষ্কার করেছে সেটার ইঙ্গিত সেই হাসির মধ্যে প্রকাশিত হতে লাগল।

আমি আর টুকাই মুখ-চাওয়া-চাওয়ি করলাম একবার। দোতলায় ওঠার সিঁড়ি যে পুরো ভাঙা, আর বাড়িটার অন্তত নীচতলার সমস্ত ঘরে যে আমরা সচক্ষে ঝুল-কালি মাখা বহু যুগ আগের পেল্লায় সব তালা ঝুলতে দেখে এসেছি — সে’কথা আর কাউকে বলে কাজ নেই।

আরেকটা কথাও অবশ্য ভুলুদাকে বলা হয় নি। সুস্পষ্ট ছম-ছম শব্দ-করা র‍্যাটেল স্নেক শুধুমাত্র ইউএস বা আমেরিকাতেই পাওয়া যায়। ভারতে ওই প্রজাতিটা কস্মিনকালেও পাওয়া গেছে বলে আমি তো কখনও শুনি নি। তাও আবার ও’ অঞ্চলে!

[বানানবিধি ও মতামত লেখকের নিজস্ব]

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ