( গল্পকার সঞ্জয় খাতির জন্ম ৮ এপ্রিল ১৯৬২ আলমোড়া, উত্তরাখণ্ড। দিল্লির হিন্দি দৈনিক ‘নব ভারত টাইমস’-এর সম্পাদক।তাঁর প্রকাশিত গল্পের বই দুটি ‘পিন্টি কা সাবুন’, ‘বাহর কুছ নহি থা’। অনূদিত গল্পটি ১৯৯০ সালে প্রকাশ মাত্র সাড়া পড়ে যায় পাঠকদের মধ্যে।গল্পটি হিন্দি থেকে অনুবাদ করেছেন বিখ্যাত অনুবাদক অনিন্দ্য সৌরভ।)
এমন ঘটনা আমাদের গ্রামে প্রথম ঘটেছিল। গ্রামের কেউ কেউ সাবানের কথা শুনলেও মুষ্টিমেয় মানুষই সত্যিকার সাবান চোখে দেখেছিল। বস্তুত, সাবান কী— তা আমরা
সেনাবাহিনীর মাধ্যমেই জেনেছিলাম। এছাড়া কিছু মহিলা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের মেয়ে পিন্টির কাছে সাবান দেখেছিল।
শোনা যায় ওর সাবান থেকে বেরোনো ফুলের মতো গন্ধ মাইলের পর মাইল ছড়িয়ে পড়ত। পনেরো বছর পরেও লোকে পিন্টিকে সাবানের জন্য মনে রেখেছে। ওর সাবানের প্রসঙ্গ সেই রকমের উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে উত্থাপন করা হত যেমন পারফিউম, আতরের করা হত।
পিন্টি নিঃসন্দেহে অন্য জগতের মানুষ। গ্রামের কারও কাছে সাবান ছিল না। প্রকৃতপক্ষে আমিই সেই ছেলে যে প্রথম সাবান পাবার সৌভাগ্য লাভ করেছিল, আর তা হঠাৎ করেই ঘটেছিল কারণ এর কোনো সম্ভাবনা ছিল না।
আজও মনে আছে, দিনটা ছিল সম্ভবত পনেরোই আগস্ট। সেদিন স্কুলে ছুটি ছিল। কাকু আর আমি কয়েক মাইল দূরের শহরে আলু বিক্রি করতে গিয়েছিলাম। কাকু আমার চেয়ে মাত্র পাঁচ-সাত বছরের বড়ো বলতে গেলে দুজনে বন্ধু ছিলাম। মাঝে মাঝে ও নিজের অভিভাবকত্ব জাহির করলেও আমি মোটেই গ্রাহ্য করিনি।
শহরের জাঁকজমকে দিশেহারা হয়ে আমরা উদ্দেশ্যহীন ঘুরছিলাম। লজেঞ্চুস মুখে নিয়ে হঠাৎ করে ভিড় আর কোলাহলমুখর একটা মাঠে এসে পৌঁছোলাম। সেখানে মেলায় হুইল বাজছিল, লাউডস্পিকারে একজন চিৎকার করছিল।
ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছে গেলাম ভিড়ের মাঝখানে। হঠাৎ মনে হল, আমাকে যেন টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমার হাত ধরে কেউ লাইনে দাঁড় করিয়ে দিল। একভদ্রলোকআমার সমবয়সি কিছু ছেলেকে সাদা দাগের সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন, ছেলেরা এক পা এগিয়ে দৌড়োনোর জন্য প্রস্তুত।
প্রথমে একটু ঘাবড়ে গেলাম। কাকুকেও কাছে দেখতে পেলাম না। সম্ভবত লাঠিধারী পুলিশ ধাক্কাদিয়ে ওকে পেছনে সরিয়ে দিয়েছিল। লাউডস্পিকারে গণনা শুরু হল-
এক, দুই, তিন…
-দু-পাশের ছেলেরা ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো দৌড় শুরু করল, আমিও তাদের সঙ্গে ছুটলাম। গোড়ার দিকে বুঝতে পারিনি— ঠিক কী হচ্ছে। যখন দেখলাম পাশের ছেলেটিসরু সরু পায়ে দৌড়ে আমাকে ছাড়িয়ে গেছে, তখন আমিও পুরো শক্তি দিয়ে দৌড়োলাম। জ্ঞান ফিরে পাবার পর নিজেকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখলাম- লাল ফিতেয় জড়ানো অবস্থায়।
আমার হাঁটু ছড়ে গিয়েছিল। উঠে দাঁড়ানো মাত্র হাততালির শব্দের মধ্যে আমার হাতে একটা ঝকঝকে লাল কৌটো তুলে দেওয়া হল।
ভিড়ের মধ্যে থেকে কাকু বেরিয়ে এল, ওর মুখে হাসি। ওকে দেখে আমিও হাসলাম। ফের দৌড়োতে ইচ্ছে করায় দৌড়োতে লাগলাম, পেছন পেছন কাকু। আমরা গ্রামের দিকে দৌড়োচ্ছিলাম পেছন থেকে কাকুর ডাক কানেএল। আমি থামলে হাঁপাতে হাঁপাতে ও পাশে এসে দাঁড়াল— ‘জিনিসটা কী রে?’ জানবার জন্য ও ব্যগ্র হয়ে উঠেছিল। লাল কৌটোটা কেড়ে নিয়ে কাকু উলটে-পালটে দেখছিল। ও-ই প্রথম বুঝতে পেরেছিল— ওতে সাবান আছে। ক’বার নাকের কাছে এনে গন্ধ শুঁকল—ওর মুখে আনন্দে উজ্জ্বল। আমি হাত বাড়ালে খুব বিরক্ত হল, ‘এটা খেয়ে ফেলব না কি!’ ওর ভাবভঙ্গি মোটেই ভালো লাগছিল না। কিছু একটা করা দরকার। সাবানটা আসলে আমার। ছোঁ।মেরে কেড়ে নেবার চেষ্টা করেও পারলাম না। দ্রুত মোড়কটা খুলে ও গোলাপি রঙের দামি সাবানটা বের করল। নিরুপায় হয়ে নিজের শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করলাম— নদীর ধারে বালিতে শুয়ে জোরে জোরে কাঁদতে লাগলাম, মাকে সব বলে দেব।’ প্রতিবারের মতো এবারও অস্ত্রটি কাজে দিল। কাকু কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল— ‘যা, মরগে’, বলে আমার দিকে সাবানটা ছুড়ে মারল। ঝট করে ওটা লুফে নিলাম।
বললাম—’ভেতরের কাগজ আর মোড়কটা কোথায় গেল?’ কাকু সেগুলো আমার দিকে ছুড়ে দিল। বাড়ি ফেরার সময় মনের আনন্দে সারা রাস্তা ওটা শুঁকতে থাকলাম।
কাকুর সঙ্গে শত্রুতার সূত্রপাত তখন থেকে। তখন আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। সাবানের সুগন্ধে এমন আপ্লুত ছিলাম যে ওর দিকে নজর দিইনি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা বেড়ে স্থায়ী শত্রুতা গড়ে উঠল। বাড়িতে পৌঁছেই বিদ্রুপাত্মক হেসে কাকু ঘোষণা করল,‘হরিয়া ভাবছে আমরা ওর যোগ্য নই, কারণ ওর কাছে
সাবান আছে।’ মা গোবর তুলছিল। কথাটা শুনে দাঁড়িয়ে পড়ল,
‘সাবান! কোত্থেকে পেয়েছিস? কেমন দেখি।’
‘ওটা আমার।’ সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলাম। মা ভালো করে।
হাত মুছে কাছে এল, ‘কেমন সাবান দেখি?”
এতক্ষণে সবার প্রতি আমার সন্দেহ হতে শুরু করেছে। অনেকক্ষণ ‘না না’ করার পর সাবানটা হাতছাড়া করলাম। মা প্রদীপের কাছে নিয়ে গিয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখল। দু-তিনবার গন্ধ শুঁকে বলল, ‘এটা দিয়ে আমি চান করব।’
আমি চিলের মতো ছোঁ মেরে সাবানটা তুলে নিলাম। ওটা পকেটে পুরে দুরে গিয়ে দাঁড়ালাম। মা রীতিমতো ক্ষিপ্ত, চোখ পাকিয়ে বলল, ‘চুলোয় যাক তোর সাবান।’ বলেই হনহন করে চলে গেল। এভাবে মা আমার দ্বিতীয় শত্রুতে পরিণত হল।
দুই
সাবানটির গুরুত্ব বুঝতে যথেষ্ট সময় লাগল। আমি বোধহয় তখনও বড়ো হইনি। তথাপি শীঘ্রই মনে হল, শত্রুরা আমাকে ঘিরে ফেলেছে। বুঝতে পারলাম, কাকু আমার জিনিসপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করেছে। সমস্ত বাক্স আর কৌটোয় সাবান খুঁজেছে, এমনকি গোয়ালঘরের খড়ের গাদার নীচেও। শুধু আমিই জানতাম ওটা কোথায় লুকিয়ে রেখেছি। ও শেষ পর্যন্ত খোঁজা বন্ধ করে আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতানোর চেষ্টা করল। ওর চালাকি বুঝতে অবশ্য আমার সময় লাগেনি।
বাবার কথা বলতে গেলে, সাবানটা ওঁর চোখে দেখারও সৌভাগ্য হয়নি। সাবান নিয়ে এত বিরক্ত ছিলেন যে প্রসঙ্গটা কানে এলেই হাতে ছড়ি তুলে নিতেন। ততদিনে আমার বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল, কেউ যদিএকবার সাবানটা দেখে ফেলে, তাকে আর বিশ্বাস করা যায়।
না। তাই ঠিক করেছিলাম, ওটা কাউকে দেখাব না। নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকলাম। অবশেষে বাবা আমার পিঠে দুটো কিল মেরে বললেন- ই, এর আতরের শখ হয়েছে। গোরুমোষ চরাতে পাঠাও। ওতেই উচিত শিক্ষা হবে।’ শুনে আঁতকে উঠলেও কাদিনি। তবে মনে সন্দেহ জন্মাল, আমি কি সত্যিই ওঁর ছেলে। বোন কুন্তী সাবানটা ছুঁয়ে গন্ধ শুঁকতে পেল, অবশ্যই আমার উপস্থিতিতে। সাবান ছোঁয়ার পর ও সারাক্ষণ আমার ল্যাজ হয়ে পেছন পেছন ঘুরত– ওকে কাটানোর একটাই উপায় ছিল— গালে সপাটে একটা চড় কষিয়ে দেওয়া। শত্রুতা আর সন্দেহের পরিবেশে সাবানটাকে চোখে দেখাই দুর্লভ হয়ে পড়েছিল। কোনোরকমে দিন কাটছিল। অবশেষে এক রবিবার সিদ্ধান্ত নিলাম। সাবান বের করে গরম জলে স্নান করতে বসলাম।
তিন
সাবান ব্যবহার করার প্রথম দিন। সতর্কতার সঙ্গে মোড়ক খুলে রোদে রাখলাম। ধীরে ধীরে ভেজা চুলে সাবানটা ঘষলাম।সাবানের গায়ে কিছু ইংরেজি অক্ষর খোদাই করা, আমি তা পড়তে পারিনি। যাই হোক, অক্ষরগুলোর জন্য সাবানটাকে আরও সুন্দর দেখাচ্ছিল। খেয়াল রেখেছি ওগুলো যেন মুছে না যায়। কাকু ঘরে বসে পড়াশোনা করছিল, তবে মাঝেমাঝেইজানলায় ওর মাথা চোখে পড়ছিল। মা খেতের দিকে যাচ্ছিল, আমাকে দেখেই উঠোনে দাঁড়িয়ে পড়ল।কয়েক মুহূর্ত মা জড়বৎ দাঁড়িয়ে রইল, পরে ক্ষুব্ধ মনে চলে গেল। তবে কুন্তী দাঁড়িয়ে রইল কয়েক পা দূরে। আমার চুলে সাবানের ফেনা আর রামধনু রঙের বুদবুদের রোদে ঝলমল করে ওঠা— এ সবই ওকে আকৃষ্ট করছিল। দেখে চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘পালা এখান থেকে!’ কুন্তী পীড়াপীড়ি করতে লাগল— ‘দাদা, আমাকেও ওটা দিয়ে চান করতে দাও।’
কুন্তীকে ভালো করে চিনি, ও বিড়ালের মতো ধূর্ত। তাড়িয়ে দেওয়াই ভালো। ওর গায়ে তাই জল ছিটিয়ে দিলাম। এর পরেও না গেলে ভেজা হাতে ওর গালে চড় মারলাম।
কুন্তীর কান্নার আওয়াজ শুনে কাকু সিঁড়ি ভেঙে ছুটে এল, ‘তোর এত সাহস ওকে মারলি। তোর আর রক্ষে নেই।’ চেঁচিয়ে বললেও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আড়চোখে আমাকে দেখতে থাকল। আমি ফেনা তৈরি করতে লাগলাম। ওদিকে কাকু বিড়বিড় করছে।
অনেকক্ষণ পর অনিচ্ছাসত্ত্বেও সাবান মাখা গা ধুয়ে ফেললাম। এরপর ওটাকে সযত্নে মোড়কে মুড়ে দিলাম। ওটা এখনও নতুন দেখাচ্ছিল। কাকুর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সাবানের গন্ধে ওর নাক কুঁচকে গেল। সে কী সুগন্ধ! নিজেকে বেশ তরতাজা লাগছিল। মাথারচুল চকচকে আর নরম হয়ে গিয়েছিল। চট করে গায়ে জামা দিলাম— ভয় করছিল, গন্ধটা উড়ে না যায়!
চার
বারকয়েক ছাদের সবচেয়ে উঁচু জায়গা থেকে ঝাঁপ দিয়ে উড়ে গেলাম। চিলের মতো উঁচু উঁচু পর্বত আর ঘন জঙ্গলের ওপর দিয়ে উড়লাম— অনেক নদী আর গ্রাম পেরিয়ে। শরীরে যেন বিদ্যুৎ প্রবাহিত হচ্ছিল। এ সবই আসলে স্বপ্ন। লোকে বলে, উঠতি বয়সেরছেলেরা প্রায়ই ওড়ার স্বপ্ন দেখে। তবে স্বপ্ন তো সত্যিও হতে পারে। প্রথম যেদিন সাবানে স্নান করলাম, মনে হয়েছিল, আমি সত্যি সত্যি উড়তে পারব। সেদিন স্কুল ছিল। সাবান দিয়ে ভালো করে স্নান করার পর শরীরটা বেশ উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। সবচেয়ে ভালো জামা গায়ে দিলাম, নতুন স্টাইলে চুল আঁচড়ালাম। স্কুলে যেতে যেতে সমস্ত রাস্তায় হাত দুটোশুঁকতে থাকলাম— গন্ধটা উড়ে যায়নি তো!
ক্লাস ঘরে ঢুকতেই হইচই শুরু হল। কিছুক্ষণের মধ্যে সবাই অস্থির হয়ে উঠল যে মিষ্টি গন্ধটা কোত্থেকে আসছে। খানিকক্ষণ তামাশার আনন্দ উপভোগ করলাম। আমার মুখে মুচকি হাসি। একটা ছেলের কাছে গিয়ে তার নাকের কাছে হাত রাখলাম।
‘উরে বাবা! তুই কী মেখেছিস?’ বিস্মিত হয়ে সে লাফিয়ে উঠল। এরপর যা হল, তাকে বলে হুড়োহুড়ি। সব ছেলেই গন্ধ নেবার জন্য একে অপরের গায়ে উঠে পড়ছিল। কেউ কেউ লাফ দিচ্ছিল যাতে তাদের নাকেও গন্ধটা এসে লাগে। যে সৌভাগ্যবানরা গন্ধ শুঁকতে পেরেছিল তারা আরও বেশি জানবার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল, ‘এটা কী? আমাদের বলো না।’ ওরা মিনতি করছিল। সমস্ত ঘটনা বিস্তারিত বর্ণনা করলে ক্লাসের সবাই আনন্দে লাফিয়ে উঠেছিল, ‘সত্যি? সাবান দেখতে কেমন?ওটা বিশেষ ধরনের কাগজে মুড়তে হয়। ব্যবহার করতে করতে একদিন ফুরিয়ে যাবে। একটু দেখা না। শুধু একবার।’ওদের উত্তেজনা তখনই শান্ত হল যখন মাস্টারমশাই ক্লাসে এলেন। পড়ায় কারও মন ছিল না। ছেলেরা আড়চোখে আমাকে দেখছিল। আমি হাওয়ায় উড়ছিলাম। ইচ্ছে করলে সেদিন নিজেকে ক্লাসের মনিটর ঘোষণা করতে পারতাম— সবাই এক বাক্যে মেনে নিত। ওরা বাপ-ঠাকুরদার মুখে পিন্টির সাবানের গল্প শুনেছিল। সর্বদাই যা স্বপ্ন মনে হত আজ তার শরিক হয়ে ওরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাচ্ছিল। টিফিনের ঘণ্টা বাজতেই অন্যদিনের মতো ছেলেরা বাইরে ছুটছিল। তবে এদিন হঠাৎ মাঝপথে থেমে গেল। আমি চুপ করে বসেছিলাম। ‘তুইও চল’, ওরা ডাকল। সবাই
আমার কাছাকাছি থাকতে চাইছিল। তারাও, কৃশকায় হওয়ায় যারা আমাকে সুযোগ পেলেই জ্বালাত। অতীতে আমার জন্য কেউ অপেক্ষা করেনি। ‘‘তুই আমাদের দলে’, কয়েকজন বলল, কিছু ছেলে বলল, ‘না, আমাদের দলে’। আমি কোন পক্ষে এ নিয়ে রীতিমতো ঝগড়া বেধে গেল। আমার মানস চোখে ভেসে উঠল সারা গায়ে মাটি মেখে খেলতে থাকা ছেলেরা।
‘আমার খেলার ইচ্ছে নেই’, ওদের জানালাম। ‘কেন? কী হল?’ সবাই একসঙ্গে জিজ্ঞেস করল। পরে ওরা নিজেরাই কারণ বুঝতে পারল, ‘ঠিক আছে, তুই রেফারি হবি। বসে বসে খেলা দেখবি।’ একে একে সবাই বেরিয়েগেল। খবরটা গ্রামে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল। সবাই সাবান দেখতে চায়। অনেকেই আমাকে পথে থামিয়ে দিত কিংবা কোনো অজুহাতে দেখা করতে আসত। দু-চারটেমামুলি কথার পর সাবান দেখানোর দাবি করত। আমি অগ্রাহ্য করলে ওরা অসন্তুষ্ট হত। কেউ কেউ বকাঝকাও করত। যাই হোক, আমার গা শুঁকেই ওদের ফিরতে হত।
সাবান না দেখানোর ব্যাপারে আমার জেদ বাড়ির লোকেদের কাছে লজ্জার কারণ হয়ে উঠল। ফলে ওরা আমাকে সারাক্ষণ কড়া কথা বলত। কাকু আমাকে দেখতে পেলেই শাসাত। একবার ও আমার গলা টিপে ধরার চেষ্টাওকরেছিল। কুন্তী মুখ গোমড়া করে ঘুরত। কখনও ওর সঙ্গে মারামারি হয়ে গেলে বাবা নিজের ভারী হাত দিয়ে দুমদাম করে আমাকে মারতেন। আমাকে দেখে মা বিরক্তি প্রকাশ
করত। ওরা সবাই শকুন হয়ে আমার সামান্য আনন্দটুকু কেড়ে নেবার সুযোগ খুঁজত। লক্ষ করেছি, লোকে প্রথমে সম্ভ্রম দেখিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলত। তবে সাবান দেখাতে আপত্তি করলে মুহূর্তের মধ্যেই আমার বিরুদ্ধে চলে যেত। এভাবে বেশির ভাগ লোক আমার শত্রু হয়ে গেল। লোকজন আমাকে ‘পিন্টি’ ডাকতে শুরু করল। এটা নিছক কৌতুক নয়—আমার প্রতি শত্রুতা প্রকাশের একটা পদ্ধতি। ‘পিন্টি, পিন্টি’ বলে ছোটো ছেলেরা আমাকে উপহাস করত। ওরা এভাবে খেপানোয় অবশ্যই খারাপলাগত, তথাপি আমি পিন্টি মেয়েটির সম্পর্কে প্রায়ই ভাবতাম। কল্পনা করার চেষ্টা করতাম ও এখন কোথায় আর কেমন অবস্থায় আছে। মনে মনে আমি ওর একটা ছবি তৈরি করেছিলাম, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে তাতে রংলাগাতাম। আমার কল্পনায় ও আমাদের ক্যালেন্ডারের মা লক্ষ্মীর মতো। সুন্দর, রঙিন কাপড়ে জড়ানো- রাতের অন্ধকারকে যে আলোয় ভরে দিত। ওর গায়ে ধুলোর লেশমাত্র ছিল না। খেলতে যাওয়া ছেড়ে দিলাম। গোড়ার দিকে কিছু ছেলে আমার সঙ্গে ছিল- ওরা অচিরেই অন্যদের সঙ্গে যোগ দিল। ছেলেরা যখন দুষ্টুমিতে মেতে থাকত, আমি দূরে বসে পা নাচাতে নাচাতে ওদের দেখতাম। ওরা কবাডি খেলত। চোরাবালিতে কাকুড় খুঁজত, লেবু চুরি করত, নদীতে সাঁতার কাটত, পরনের কাপড় ছিঁড়ে যেত আর ধুলো কাদা মেখে, চোট-আঘাত নিয়ে বাড়ি ফিরত। বসে বসে আমি ওদের এইসব কাণ্ড দেখতাম। সত্যি বলতে গেলে, ক’বার আমারও ইচ্ছে করেছিল ওদের সঙ্গে যোগ দিতে। তবে প্রতিবারই এক ধরনের সংকোচ আমাকে বিরত করত। ইচ্ছে করত, কেউ আমাকে জোর করে কবাডি খেলতে নিয়ে যাক। তেমন কিছু অবশ্যঘটেনি। পরে ওরা জিজ্ঞেস করাও ছেড়ে দিল। ওরা মনে করত, পিন্টির শুধু বসে বসে খেলা দেখতেই ভালো লাগে। ওদের চোখে এখন আমার যেন অস্তিত্বই নেই।
পাঁচ
কিছুদিন পর কাকু শহরে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছিল। ও সেখান থেকে বাড়ির টুকিটাকি জিনিস কিনে আনার জন্য থলে জড়ো করছিল। নিজেকে সামলাতে না পেরে বললাম,’আমিও তোমার সঙ্গে যাব।’
‘না, তুই যাবি না।’ কাকু কড়া গলায় জানাল।
‘না, আমিও যাব।’
‘বউদি!’ কাকু চেঁচিয়ে উঠল, ‘যা যা চাই একে বলে দাও। আমি যাব না। মা আমার ওপর বাঘিনির মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল। কান টেনে মাটিতে ফেলে দিল, ‘আয় তোকে দেখাচ্ছি!… দিনদিন ডানা গজাচ্ছে।’ আমার পিঠে কিল মেরে মা ফুঁসে উঠল। কাকু এবার আনন্দে আনন্দে আত্মহারা, বলল আচ্ছা করে দাও ওকে।’ মা এমন ভাবে টেনে হিঁচড়ে বাইরে নিয়ে গেল যেন আমি একটা মরা ইঁদুর। জোর করে বিছুটি গাছের ঝোপে আমাকে ঠেলে দিল।
‘না, না, না…।’
আমাদের মধ্যে ভালোবাসার শেষ সুতোটুকুও ছিঁড়ে গেল। পরদিন টিফিন পিরিয়ডে দেয়ালে পিঠ দিয়ে বসেছিলাম। বিছুটির কাঁটায় ছড়ে যাওয়া জায়গাগুলোতে তখনও জ্বালা করছিল, চুলে জমা কাদা। সজল চোখে ছেলেদের খেলা দেখছিলাম। সেদিন স্নান করলেও গা থেকে সুগন্ধ বেরোচ্ছিল না।
ডুকরে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। সব ছেড়ে চিরকালের জন্য চলে যেতে চাইছিলাম। যেখানে পিন্টি থাকে, যেখানে অন্য ধরনের মানুষ বাস করে। সেখানে কোনো বিদ্বেষ,অকারণ প্রহার নেই। ঠিক করলাম, সুযোগ পাওয়া মাত্র শহরে পালিয়ে যাব। সেখান থেকে দূরের কোনো জায়গার বাস ধরব। এখানে
কোনো দিন ফিরব না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমার সিদ্ধান্ত আরও জোরালো হতে থাকল। সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জামাকাপড় বাছলাম, সেইথলেও, যাতে করে নিজের জিনিসপত্র নিয়ে যাব। কিছু আখরোট লুকিয়ে রাখলাম। খোঁজ নিলাম, টাকাকড়ি কোত্থেকে জোগাড় করতে হবে। এবার কেবল একটা সুযোগের অপেক্ষা।
একদিন সেই সুযোগ এসে গেল। স্নান করছিলাম। প্রতিদিনই করতাম— যতই শীত পড়ুক। জানতাম না যে কাকু ওঁত পেতে ছিল। সাবানটা নীচে রাখতেই ও আমার ওপর বিড়ালের মতো ঝাপিয়ে পড়ল। ওর পাতা ফাঁদে ধরা পড়লাম। কাকু সাবানটা নেবার জন্য ঝাঁপালে ওর হাত থেকে সেটা পিছলে পড়ে গেল। আমি তক্ষুনি পিতলের ভারি ঘটিটা ওর মাথায় সজোরে ঠুকে দিলাম। কাকুর মুখ দিয়ে চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে এল। মাথায়হাত দিয়ে ধীরে ধীরে মাটিতে পড়ে গেল। আমি ততক্ষণে সাবানটা তুলে নিয়েছি। ঘটিটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। কাকু তবু নড়ল না। আমার পা দুটো ভয়ে কাঁপতে লাগল, ‘কাকু…. ও কাকু!’ ওকে নাড়াবার মরিয়া চেষ্টা করলাম। যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে ও মাথা তুলল। মাথাথেকে রক্ত ঝরছিল, ‘তুই আমাকে মারলি…।’ ও বিড়বিড় করছিল। মাথাটা চেপে ধরে কোনোরকমে চলে গেল। কিছু দূরে গিয়ে আমার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। ওর মুখ ফ্যাকাশে,
দু- গাল বেয়ে রক্ত আর অশ্রুর ধারা বইছে। কান্না জড়ানো গলায় এবার বলল- শালা, একদিন তো তোর সাবানটা ফুরোবেই।’
অবাক হয়ে গেলাম। হাতের মুঠো খুলে দেখি- সাবানটা সরু হয়ে গিয়েছে। আগের মতো গন্ধও নেই। আমার ভয় করছিল। কান্নাকাটির আর সময় নেই। কাপড় গায়ে দিয়েইওপরে ছুটলাম। থলেতে কিছু জামাকাপড় ঠেসে দিলাম। আখরোট নেবার সময় নেই। বড়ো থলের দরকার নেই। টাকা পয়সা?
ততক্ষণে কাকুকে মা-র সঙ্গে কথা বলতে শুনলাম যে গোবরে পিছলে যাওয়ায় গোয়ালঘরের দরজায় ওর মাথা ঠুকে গিয়েছে।
শুনে বিস্ময়ে ধপ করে খাটে বসে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর, কিছুটা সাহস ফিরে এলে পুরোনো জায়গায় সাবানটা লুকিয়ে রাখলাম। ফিরে এসে অন্ধকারে শুয়ে পড়লাম। সারা সন্ধ্যা সেভাবেই শুয়ে থাকলাম। সবাইকে বলেদিয়েছি, আমার পেট ব্যথা করছে। সকালে যখন ঘুম ভাঙল চারপাশে অদ্ভূত ধরনের সাদাআলো ছড়িয়ে ছিল। সারা রাত বরফ পড়েছে। দেখে খুব ঘাবড়ে গেলাম। খালি পায়েই ছুটলাম গোয়ালঘরের দিকে। খড়ের গাদায় চার আঙুল পুরু বরফ জমেছে। তার নীচে সাবানটা লুকিয়ে রেখেছিলাম। বরফ সরিয়ে সেটা পেলাম না। কোথায় রয়েছে? ততক্ষণে আমার হাত ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ আঙুলে একটা মসৃণ জিনিসের স্পর্শ পেলাম। গোলাপি রঙের কাদার ঢেলা–সুগন্ধ ছাড়ছে। বিস্ময়েকাঁপতে কাঁপতে সেটা মুঠোয় চেপে ধরে বরফের ওপর পড়ে গেলাম।
‘হরিয়া!’
মা দাঁড়িয়ে। গোরুর দুধ দুইতে এসেছিল। মাথা তুলে তাকালাম। ঢেলাটা হাত থেকে পিছলে পড়ল। ‘হরিয়া!’
মায়ের কণ্ঠস্বর অত্যন্ত কোমল আর উদাস।
শরীরে কাঁপুনি ধরে গেল। ভেজা হাতে মাকে জড়িয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলাম। পাশে বসে মা আমাকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরল— সেই আগের মতো। মায়ের কোলের উষ্ণতায় আমি কাঁদতে থাকলাম। মনে হল যেন বরফের কোনো পাহাড় গলে যাচ্ছে। বুকটা তুলোর মতো হালকা লাগছে। সেই সময় বাতাসের
কোনো ঝাপটা এলে হয়তো আমি উড়েই যেতাম।
Tags: অনিন্দ্য সৌরভ, অনুবাদ গল্প, গল্প, পিন্টির সাবান, সঞ্জয় খাতি
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।