04 Dec

পচা শাকের জন্যে

লিখেছেন:কুমুদ লাহা


– ‘মাসি, পচা শাকগুলো আজ কত করে দিচ্ছ?’

রোববারের সকালে বাজারের থিকথিকে ভিড়ে ঢুকে পড়ে এমনিতেই মাথাটা গরম। গলাটা চেনা লাগতে মুখ ঘুরিয়ে দেখি পাড়ার সেই খিটখিটে বুড়োটা। মা আজ সকালে চা নিয়ে আসতে দেরী করায় আয়নায় নিজের মুখ দেখে ফেলেছিলাম। সকাল সকাল নিজের মুখ দেখলেই দিনটা খারাপ যায়, সেজন্য মা না ডাকা অবধি বিছানা ছাড়ি না, আজ বাজার যাবার তাড়ায় কেন যে উঠতে গেলাম! মুখে মাস্ক থাকলেও চিনতে অসুবিধা হচ্ছে না কিপটে আর বাতিকগ্রস্থ বুড়োটাকে যাকে পাড়ার কেউ পছন্দ করে না। পাড়ার লোক তো বটেই, যারাই কোনো কাজে ওর বাড়িতে ঢোকে তারাই খুব বিরক্ত হয় ওর ব্যবহারে। এইতো সেদিন মাইক্রোওয়েভ ওভেন সারাতে আসা লোকটার সঙ্গে কি ঝগড়া! রোজকার কাজের মহিলাটা সারাদিন থাকে আর সারাটা দিন তার সঙ্গে গজর গজর চলতেই থাকে, কিন্ত অদ্ভুত একটা ব্যাপার, মহিলা এতো কচকচির পরেও গত প্রায় ২০ বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছেন। লকডাউনে কিছু দুঃস্থ মানুষকে সাহায্য করার জন্য লোকটার কাছে চাঁদা চাইতে গিয়েছিলাম, অনেকক্ষণ রকমারি জ্ঞান দান করার পর ৫০টাকা ঠেকিয়েছিল। অথচ ব্যাঙ্কের অফিসার ছিলেন, দোতলা ঝকঝকে বাড়ি আছে। একটা দামী গাড়িও আছে। ছেলে জার্মানিতে বড় চাকরি করে। মেয়ের বিয়ে হয়েছে লন্ডনের এক ডাক্তারের সঙ্গে। কাকিমার বাবা হাওড়া কোর্টৈর জজ ছিলেন, বনেদী পরিবারের মেয়ে। অথচ, বুড়োটা..

-‘কি, মাসি বললে না তো শাক কত করে? আর হাঁসের ডিম কত করে আজ?’

একটু সরে গিয়ে জায়গা করে দিলাম, যাতে আগে জিনিস নিয়ে চলে যায়। বুড়োটা কাছাকাছি থাকলেও কেমন অস্বস্তি হতে থাকে।

-‘মাসি, দুটো আঁটি পচা নটে দাও, ছ’টা হাঁসের ডিম, ছ’টা মুরগির ডিম, একটু কুমড়ো। ফুলকপিগুলো তো আগের সপ্তা’র মনে হচ্ছে, দাও দু’টো। নাও এবার হিসেব করো।’

এতো কিছুর পরেও, মাসি কিন্তু চুপ। দাম‌ও বলছে না, কোনো উত্তর‌ও দিচ্ছে না। শুধু বুড়োটা যা যা বলল তুলে ওর ব্যাগে ভরে দিল।

– ‘তাহলে নটে চল্লিশ, হাঁসের ডিম নব্ব‌ই, মুরগির ডিম ষাট, কুমড়ো পঁচিশ আর ফুলকপি দুটো একশো দশ। কতো হলো? আর আগের দিন কত যেন বাকী ছিল? মনে পড়ছে না। এই নাও। সব মিটিয়ে দিয়ে গেলাম। পরের দিন আবার বোলো না যেন বাকী আছে।’ এই বলে মাসীকে চারটে একশো টাকার নোট ধরিয়ে হনহন করে চলে গেল বুড়োটা।

এইবার আমি ধরলাম মাসীকে। কি ব্যাপার বলোতো, লোকটা তোমার সাথে এতো বিচ্ছিরিভাবে কথা বললো, জিনিসগুলো খারাপ বললো, নিজের মতো দাম ধরলো, নিজেই হিসেব করে দাম দিয়ে চলে গেল, আর তুমি কিছু বললে না? তুমি জানো লোকটা আমার পাড়ায় থাকে, আর ওর ব্যবহারের জন্য কেউ ওকে পছন্দ করে না?

চশমা খুলে আঁচলে চোখটা মুছে মাসী বলল ‘বাবা, একবার বলেছিলাম, সেদিনও আজকের মতো এক‌ইরকম ভাবে হিসেব করার পর আগের দিনের বাকী টাকার হিসেব বুঝিয়ে টাকা দিয়ে চলে যাচ্ছিল। উত্তরে আমাকে ক্যাঁটক্যাঁট করে বলেছিল ‘আমি ব্যাঙ্কের ম্যানেজার ছিলাম তুমি আমাকে হিসেব বোঝাচ্ছ?” তুমিই একবার হিসেব করে দেখোনা বাবা, নটে পনেরো টাকা করে আঁটি, হাঁসের ডিম বারো টাকা আর মুরগির ডিম আট টাকা করে। কুমড়ো কুড়ি টাকা আর ফুলকপিগুলো চল্লিশ করে। কত হয় দেখো। তোমাদের মতো অত হিসেব না বুঝলেও জিনিস বেচতে বসে সেগুলোর দামের হিসেব না পারলে কি চলে? আর আগের কোনো বাকীও থাকে না তবু প্রত্যেক দিন কি হিসেব বুঝিয়ে যায় তা আমি বুঝিনা, তবে একেবারেই কি বুঝি না, বল? একদিন বাদ দিয়ে আসে আর এইভাবেই.. বাড়িতে তো শুনি দু’জন মানুষ, এতকিছু লাগে? নিশ্চয়ই অন্য কাউকে বিলোয়।

বাকি বাজার অন্যমনস্ক ভাবে শেষ করে বাড়ি ফেরার সময় বুড়োর বাড়ির পাশ দিয়ে আসার সময় শুনতে পেলাম কাজের মাসীর সঙ্গে গজর গজর করছে ‘যত্তসব আমার কপালেই জোটে। পচা শাক, ডিমগুলোও খারাপ, ফুলকপিটা দেখে নিইনি, ব্যস ঠকিয়েছে। মনার মা এইগুলো আজ বাড়ি নিয়ে যেও, পরেরদিন বাজারে গিয়ে বুড়িটাকে দু’কথা শোনাতে হবে দেখছি’।

কেন জানিনা, মনটা আজ শরতের আকাশ হয়ে গেল, এই আকালেও ঢাক বেজে উঠল মনে ..।

[ বানানবিধি ও মতামত লেখকের নিজস্ব]

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • Tripti Chaudhuri on December 23, 2023

    খুবই ভালো লেখার স্টাইল। টানটান লেখা। মন ভালো হয়ে গেল।

    পীযূষ কান্তি দাস on March 22, 2024

    দারুণ আর টানটান গল্প, পচা শাকের জন্য।

    মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ