বন্দুক
রিভলবারটা হাতে তুলে নিলেন স্মৃতিময়। নেড়েচেড়ে দেখছেন। বেশ ছিমছাম। ছোটবেলা থেকেই এমন একটা বন্দুকের শখ ছিল। আসলে সেনেদের সুরজিৎ খেলার ঝগড়ার মুহূর্তে তার দিকে এয়ারগান তাক করে কর্কশ গলায় ওদের বাড়ি থেকে চলে যেতে বলেছিল। অপমানটুকু গিলে নেওয়া ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। ইচ্ছেটা তখন থেকে, এতখানি বয়েস পর্যন্ত তা পূরণের কোনো উপায় হয়নি।
বিপত্নীক স্মৃতিময় একাই থাকেন। একমাত্র ছেলে টোটোন স্টেটসে সেটলড্, তার মতে একজন মানুষের জন্য তেতলা বাড়ির এতবড়ো স্পেস পুরোটাই ওয়েস্টেজ্। স্মৃতিময় জানেন তিনি চোখ বুজলে বাড়িটা আর থাকবে না। এখনই কত লোক কিনতে চলে আসছে, পাড়ার চেনালোকেরাও ঠারেঠোরে বাজিয়ে দেখছে। সকলকেই তিনি আর ক’টা দিন সবুর করতে বলেন। ছেলের জেটগতির জীবনে এসব ওল্ড ফুল সেন্টিমেন্টের কোনো দাম নেই। একদা গর্বিত বাবা এখন ভাবেন ছেলেকে বড় করে তোলার পর্বে ভুল হয়ে গেছে বিলকুল।
ব্যাপারটা হয়েছিল এমন, রাত তখন ন’টা, বেল বাজতে রোজকারের হোম ডেলিভারির ছেলেটা খাবার দিতে এসেছে ভেবে দরজা খুলেছিলেন তিনি। আর তাঁকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে জোর করেই ঘরে ঢুকে পড়েছিল পাড়ার উঠতি মস্তান পল্টু আর তার শাগরেদ ছোট্টু। তারপর নিজেরা সোফায় বসে পড়ে তাঁকেও বসতে বলছিল। ওদের ঔদ্ধত্য দেখে স্মৃতিময়ের তখন বাক্যিহারা অবস্থা। তাঁর চোখের সামনে আঙুল নাড়িয়ে পল্টু বলছে ‘শোনেন মেসোমশাই, নখরাবাজি অনেক হয়েছে, এখন একটাই কথা, আপনি ঠিক করুন কি করবেন।’ এক পকেট থেকে এক বাণ্ডিল টাকা অন্য পকেট থেকে রিভলবার বের করে টেবিলের ওপর রাখে, মুখে তার যুদ্ধজয়ের আনন্দ! কি যেন ভেবে নাকি কোনো কিছুই না ভেবে স্মৃতিময় রিভলবারটা তুলে নেন। নিষ্প্রাণ যন্ত্রের গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বলেন ‘মরতে তো একদিন হবেই ভাই!’ মুখটা হঠাৎ ফ্যাকাশে হয়ে যায় পল্টুর। একচোখ বন্ধ করে এবার যেন তার দিকে টিপ করেন স্মৃতিময়। দৌড়ে পালাতে পালাতে পল্টু বলে যায় ‘কাজটা কিন্তু ভালো করলেন না’। পরীক্ষায় প্রশ্ন সাজেশান অনুযায়ী না এলে ছাত্রছাত্রীদের আত্মবিশ্বাস যেমন তলানিতে গিয়ে ঠেকে তেমনই শোনায় তার কথাগুলো।
কম্পাসহারা
‘এই পৃথিবীর পাখিগুলি আসলে মৃত বহুকাল। তাদের মৃত শরীরে বসানো কৃত্রিম যন্ত্র। ওরা আমাদের পেছনে নজরদারির দায়িত্বে’ – একথা ফিসফিসিয়ে বলেছে যে সুবেশ যুবা, কোনো নেশা বা পাগলামির চিহ্নমাত্র নেই তার চোখে মুখে।
‘আপনি কি টের পান না চতুর সভ্যতা এই বিশ্বজগতকে কারাবন্দী করে রেখেছে? আচ্ছা, আপনি কি মেধাহীন, নাকি স্পর্শরহিত?’ কম্পাসহারা নাবিকের চোখে প্রশ্ন তার।
কিছুই হল না জানা একঘন্টার সহযাত্রায়। তবু প্রথম আলাপেই জগতের এতবড়ো রহস্য যে অকুণ্ঠে জানাতে পারে তার সারল্যকে মনে মনে প্রণাম জানাই, পাশে বসে অনুভব করি আমাদের মধ্যের অদৃশ্য কাঁটাতারটিকেও।
[বানানবিধি ও মতামত লেখকের নিজস্ব]
Tags: অণু গল্প, গল্প, দেবাশিস মল্লিক, বন্দুক ও অন্য গল্প
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।