27 Jan

কলমিক

লিখেছেন:সুভাষ ভৌমিক


এক

শীতঘুমের আস্তানা থেকে উচ্ছেদ হয়ে সরীসৃপটা রাত থাকতেই এই জনপদ পার হয়ে গেছে। তার পুরোনো জংলী করিডরে এখন কংক্রীটের অবরোধ। আনুভূমে বিছিয়ে থাকা শিউলি ফুলের মাঝ দিয়ে পিচের রাস্তায় রেখে গেছে হিলহিলে শরীরের সর্পিল দাগ। নতুন গাছের শিউলি ফুল, পাঁপড়িগুলো টোপা টোপা, আর এই পাড়াটাও নতুন। ছ-সাত বছরের বেশি পুরোনো নয়। বিত্তশালী মানুষদের পাড়া। আধুনিক ইন্টিগ্রেট নির্মাণশৈলীর নানান বাড়ি, বাড়িগুলোর রঙচঙ, নির্মাণে ভিন্নতা। বাড়িগুলোর কাচের জানলা দিয়ে বাইরেটা দেখা যায়, কিন্তু বাইরে থেকে বাড়ির ভেতরটা দেখা যায় না। প্লট করে জমি বেচার ছকের মতো পাড়াটার রাস্তাগুলো সোজা সোজা। সটান রাস্তার শরীরে কোথাও আঁকাবাঁকা নেই, উঁচুনিচু নেই, নিটোল সোজা।

…“কিন্তু, মানুষের আনুভূমিক দৃষ্টিপাত দিয়েইবা শুধুমাত্র দেখা কেন? বার্ডআই-এর ফিল্ড-অব-ভিউ, ভার্টিক্যালি দৃষ্টিনিক্ষেপ দিয়ে দেখা–– সেটাও তো হতে পারে। মানুষ এই দেখাও আয়ত্ত করেছে, প্রযুক্তির সাহায্যে। বার্ডআইয়ের দৃষ্টিনিক্ষেপে দেখলে টেরেসের সার্থকতা অনেক। তাতে একটি বাড়ির ছাদে অন্য অনেককিছুর সাথে ছাদবাগানের গুরুত্ব থাকে। তাই বাড়ির ছাদটাকে আকাশের দিকে উন্মুক্ত রাখতে হবে। তা না-হলে ঐ ভিউপয়েন্টে, নীল-সেডে ঢাকা বাড়ির ছাদগুলোকে দেখে মনে হবে যেন, রাস্তার ধারে-ধারে স্তুপ-স্তুপ নীল-নীল গোবর পড়ে রয়েছে। এভাবে যদি কেউ কখনো না-ও দেখে, তবুও এভাবেই ভাবতে হবে।”

ফোনের উল্টোদিকে থাকা বন্ধু সুপ্রিয়কে কথাগুলো একটানা ব’লে থামে অভিষেক। কিছুক্ষণ থেমে তারপর আবার বলে, “বল তুই কি বলছিলিস!”

“আমার নীল জবার কী হবে? অত সাধ করে তোর বাড়ি থেকে নিয়ে এলাম গাছটা, টবে বসালাম, তোর ব’লে দেওয়া পদ্ধতি মতো! একটাও নীল ফুটছে না; সবই লাল। হরাইজনটাল হিউম্যান-ভিউতে ট্র্যাডিশনাল লাল সবাই দেখতে পায়, কিন্তু তোর কথা মতো ননট্র্যাডিশনাল নীল কবে হবে?” সুপ্রিয় বলে।

“সেজন্যই প্রথমে তোকে আমি ‘ফিল্ড-অব-ভিউ’-এর যে-একটা গুরুত্ব রয়েছে, সে-কথা বললাম। লাল ফুল কোথায় ফুটছে?”

“গাছের ডালে।”

“ফুল, গাছের ডালে না-ফুটে মোবাইলের অ্যান্টেনায় ফুটবে, এত দূর পর্যন্ত আবিষ্কার বিজ্ঞানীরা এখনো ক’রে উঠতে পারেননি। ভবিষ্যতে হয়তো সেটাও সম্ভব হতে পারে। যাইহোক, তাই আপাতত আমি জানতে চাইছি, গাছের কোন ডালে ফুটছে?”

“গাছের কোন ডাল মানে! আমি সব ডালকে তো একই বুঝি। গাছের কাণ্ড থেকে বেরনো ডাল।”

“ফুল সমেত ডালগুলো ছেঁটে দে।”

“তারপর।”

“গোড়ার মাঝখান থেকে যে-ডালটা সোজা ওপরমুখে উঠে গেছে, সেই ডালে নীল ফুল ফুটবে। জোড়কলমের পদ্ধতিতে রুটস্টক হিসাবে পুরোনো লাল ফুলের গাছ নেওয়া হয়েছে, ফলে সেখান থেকে বেরনো ডালে লাল ফুলই ফুটবে। মাঝখানের ডালটা উপজোড়, নীল ফুলের ডাল। গোড়ার ডালগুলো ঠিকঠাক ছেঁটে না-দিতে থাকলে, উপজোড় ডালটাতে আকাঙ্ক্ষিত ফুল ফোটার জোর আসবে না। দিস্‌ প্যাটার্ন অব ইনভেস্টমেন্টে নিজেদেরই ঠিক ক’রে নিতে হবে কোনটা রাখবো, আর কোনটা ছাঁটবো।”

“তাহলে এক্ষেত্রে শেল কোম্পানী কোনটা?” রসিকতার ঢঙে সুপ্রিয় প্রশ্নটা করে।

“অবশ্যই রুটস্টক।” অভিষেক উত্তর দেয়।

“তার মানে কি স্টক ম্যানিপুলেশান!”

“নিশ্চিতভাবে।”

“গ্রাফটিংয়ের ক্রিয়াপদ অর্থে ‘ইল্‌লিসিট গেইন’কেও বোঝায়।”

“আরেক ক্রিয়া, ‘সফলতার অর্জন’––অ্যাকুইজিশন অব গেইন, অর্থটাই যথার্থ। যার দ্বারা সফলতার শিখর স্বর্গ ছুঁতে পারে।”

“তাইজন্য আকাশের দিকটা উন্মুক্ত রাখতে হবে?”

“সফলতা অর্জনও একধরনের আর্ট। আধুনিক জীবনধারার পরিবেশে আধুনিক শিল্প হল ইন্টিগ্রেটেড আর্ট। এটা কেউ না বুঝলে, সেটা তার সরলতা।”

অভিষেক ও সুপ্রিয় পরস্পরের পুরোনো বন্ধু। প্রায়দিন সকালে ওদের মধ্যে বেশ সময় ধরে ফোনস্ক্রিয়া চলে–– তাতে থাকে তর্ক, মজা, পরিকল্পনা, সবকিছু। নিয়মমতো প্রত্যেকদিন সকাল ছ’টা থেকে আটটা পর্যন্ত আভিষেক বাড়ির ছাদে থাকে, ছাদ ভর্তি মরসুমি ফুল ও ফুলগাছগুলোর পরিচর্যা করে। বাড়িময় ফুল আর ফুলগাছ। ফুলের বাড়ি। আটটার পর ছাদ থেকে নিচে নামে। তারপর দোতলার ব্যালকনি, শেষে বাড়ির উঠোনে লাগানো গাছগুলোর পরিচর্যা করে। সেখানে ঘন্টাখানেক, কখনো-সখনো তা পার হয়ে যায়।

যে-প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল–– গ্রাফটিং। গ্রাফটিং, গ্রাফটেজ, গ্রাফ্ট, গ্রাফ, গ্রাফিতি, এমনকি পেন–– এমন সমস্ত শব্দের শিকড় একই–– আঁচড় কাটা। স্বাভাবিকতার বাইরে গিয়ে এই ব্যুৎপত্তি খুঁজতে হয়। খুঁজে দেখা জরুরি; তবে তার থেকেও জরুরি আঁচড়ে আঁচড়ে তাড়নাগ্রস্তের মতো জটিলতা খুঁড়ে বের করা। কাচের জানলার ওপারে কি আছে!

মুশকিল হল, গল্পের শুরুতে যদি গল্পটার উদ্দেশ্য প্রকাশ পেয়ে যায়, সেক্ষেত্রে গল্পটা আর গল্প থাকে না। দীপ্ত-পাঠক গল্পের পৃষ্ঠা থেকে চোখ ঘুরিয়ে নেয়। মুশকিল আসানের উপায় হিসেবে এক্ষেত্রে আমরা গল্পটার রুট ম্যানিপুলেশন করবো। শিকড় আরো চাড়িয়ে দেবো।

 

দুই

ঐদিনের মতো কাজ শেষ ক’রে অভিষেক ছাদ থেকে নিচে নামে। দোতলায় সুমনা ঘরের কাজকর্ম সারছে। সে হাউজওয়াইফ। তবে, নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে লিখে রাখে–– হোম মেকার। ‘হাউজওয়াইফ’ শব্দটা সেকেলে। ঘর-সংসারের অভ্যন্তরে দাসী-বাঁদী বউগুলো নিজেদের অদৃষ্টে প্রলেপ লাগিয়ে বহিরঙ্গে রঙিন থাকার চেষ্টা করে। অভিষেক কিছুক্ষণ আগে ঠিক কথাই বলেছিল–– ‘নিজেদেরই বুঝে নিতে হবে কোনটা রাখবো, আর কোনটা ছাঁটবো।’

প্রিয়া আজও ফিরতে দেরি করছে। এই সময় অভিষেক ও সুমনার মধ্যে কথাবার্তা হয় না, বিশেষ দরকার না পড়লে। অভিষেক থাকে ফুলগাছ নিয়ে মশগুল, আর সুমনা ঘরের কাজে। প্রিয়া ফিরল আরও মিনিট পনেরো পর, অভিষেক ও সমুনার একমাত্র মেয়ে ঋতুকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে। সকালে ঘুম থেকে উঠে এটা প্রিয়ার প্রতিদিনের কাজ। অভিষেক মেয়ের জন্য স্কুলভ্যান অ্যালাও করেনি। বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব আধ-কিলোমিটার, তবে আধ-কিমি হোক বা পাঁচ কিমি, সেটা বড় কথা নয়, ওর যুক্তি–– ‘দঙ্গলে থাকলে জঙ্গলের স্বভাব হবে’। হরাইজনটাল লাইন নয়; ভার্টিক্যাল লাইন অভিষেকের আইডিয়াল। সেটা ও নিজের মুখে নানান সময়ে, নানান পরিবেশে স্বীকারও করে। টোটো ঠিক করা আছে। টোটো ক’রে ঋতুকে রোজ স্কুলে দিয়ে আসবে, প্রিয়া হেঁটে ফিরবে, স্কুল থেকে নিয়ে আসার সময় প্রিয়া হেঁটে যাবে, ঋতুকে নিয়ে ঐ টোটো ক’রে ফিরবে–– এটাই ব্যবস্থা।

প্রিয়া ফিরলে, সুমনা, প্রিয়াকে ডাক দেয়।

“কি বলছো বৌদি?” প্রিয়া, সুমনার কাছে এসে জিজ্ঞেস করে।

“ঘরগুলো ঝাঁট দিয়ে দে। পূর্ণিমা এখনি চলে আসবে, ও এসে বাসন মেজে নেওয়ার পর ঘরগুলো মুছে দেবে।”

“আচ্ছা ঠিক আছে।”

“তোর ঘরের বিছানা তুলেছিস?”

“হ্যাঁ।”

প্রিয়াকে কাজে রাখা প্রধানত ঋতুর দেখভালের জন্য। প্রিয়া এ-বাড়িতে সর্বক্ষণ থাকবে। থাকা-খাওয়া, পোশাক-আসাক, অসুখ-বিসুখের চিকিৎসার ব্যবস্থা, মাসমাইনে, সব বহন করবে অভিষেক–– এটাই চুক্তি। বিনিময়ে, ঋতুকে খাওয়ানো থেকে ঘুম পাড়ানো, ঋতুর স্কুলের ব্যাগ বওয়া থেকে জামাকাপড় কাচা, ঋতুর খেলার সাথী হওয়া–– সমস্ত কাজই করবে প্রিয়া। বাকি সময় বৌদির কাজে সাহায্য করবে। কাজে গাফিলতি বরদাস্ত করা হবে না।

সুমনা নিচে রান্নাঘরে এসে টোস্টারে পাউরুটি সেঁকে নিচ্ছে। গাছের কাজ শেষ হলে অভিষেক এসে সকালের খাবার চাইবে। তারপর বসবে ট্রেডিং-এ। এটাই এখন ওর অন্যতম কাজ। নিজের পরিচয়ে বলে ইনভেস্টমেন্ট প্রো। আগের দশ বছর কাজ করেছে একটি খ্যাতনামা আইটি ফার্মে–– অতিভদ্রস্থ আইটি ইঞ্জিনিয়ার পদে, মাসমাইনে সহ অন্যান্য সুবিধেও ছিল তেমন। স্বেচ্ছায় ঐ পেশা থেকে অবসর নিয়েছে এই পঁয়ত্রিশ বছর বয়সেই। ও বলে–– ‘কোম্পানির মাসমাইনের প্রফেশনাল থাকার চেয়ে কোম্পানিগুলোর ইনভেস্টর হওয়া ভাল, সেটা আরও বেশি সম্মানের ও লাভের। এখানে ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে পয়সা।’ কোলকাতা শহর ছেড়ে থাকে শহরতলীতে। নিজের গাড়িতে ঐ শহরতলী থেকে কোলকাতার দূরত্ব এখন পঁয়তাল্লিশ মিনিট। তবে, কোলকাতায় থাকার ব্যাপারে সুমনা মাঝেমধ্যে জেদাজেদি করে। যেমন সেদিন––

“কোলকাতায় একটা ফ্ল্যাট রাখার বিষয়টা কিছু ভাবলে?”

অভিষেক তখন নিজের ঘরে বসে ওর ক্লায়েন্টদের পোর্টফোলিয়ো হ্যান্ডেল করছিল। কাজে মগ্ন থেকেই উত্তর দিল, “কোলকাতায় একটা ফ্ল্যাট রাখা যেতে পারে, এবং সেখানে গিয়ে মাঝেমধ্যে থাকাও যেতে পারে। খোঁজখবর নেওয়া শুরু করবো এবার। তবে, আমার কাছে এই জায়গাটাই বেস্ট।”

“বেস্ট, আমার কাছেও। তবুও কোলকাতায় একটা ফ্ল্যাট থাকা দরকার।”

“তুমি বললে আমার সমস্ত ভালবাসা তোমার জন্য উজাড় করে দিতে পারি।”

“বেশ!”

“ভেবে দেখো, আমরা থাকি কোলকাতা থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের ডিসপ্লেসমেন্টে, অর্থাৎ বিষয়টা S=vt দিয়ে বিচার করা যাক। ভেলোসিটি ও টাইমের ঐকিক-সম্পর্কের নির্মাণটা যত নিঁখুতভাবে গড়ে উঠবে, তার উপরেই নির্ভর করবে এই দূরত্বটা। কোলকাতার ধোঁয়া-ধুলো-কোলাহলের চেয়ে এই ডিসপ্লেসমেন্টের খোলা হাওয়ায় থাকা বেশ মনোরম। আরও প্রত্যন্তের দিকে চলে যাওয়াও সম্ভব, যদি সেখানে সরণের নির্মাণটা ঠিকঠাক গড়ে ওঠে।”

“ফ্ল্যাটের বিষয়টা তোমার স্মরণে থাকলেই যথেষ্ট।“

ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখ রেখে অভিষেক বলতে থাকে, “যথেষ্টর কোনোপ্রকার সীমা আমি রাখতে চাই না। ‘পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা’ ভূমির আনুভূমিক ডিসটেন্স একটি অ্যাবজার্ড ধারণা। পাথর পিচ সিমেন্ট ইস্পাত–– কংক্রিটের উল্লম্বিক নির্মাণে মানুষের নিজেদের প্রয়োজন মতো দূরত্ব নির্মাণ সম্ভব। উল্লম্বিক নির্মাণ বাড়ালে দূরত্ব পঁয়তাল্লিশ মিনিট থেকে কমিয়ে পনেরো মিনিটে নামিয়ে আনাও সম্ভব। আর, এই নির্মাণ ভালো ইনভেস্টমেন্টের পক্ষেও সহায়ক। খোলা হাওয়া এবং খোলা বাজার উভয়ের পরিপূরক।”

সকালের দ্বিতীয় চায়ের খালি কাপটা অভিষেকের টেবিল থেকে তুলে নিয়ে চলে যায় সুমনা।

এমন শহরতলীতে এমন ফুলের বাড়ি সযত্নে গড়ে তোলা যায়–– সপ্তাহের কাজের দিনগুলোতে বাড়িতে বসে কাজ, মেয়ের স্কুল শেষে উইকএন্ডে ছোটোখাটো ড্রাইভ–– শপিং, রেস্টুরেন্ট। কখনোসখনো লঙ্‌ ড্রাইভ। বছরে দু’বার লঙ্‌ ট্যুর। স্ত্রীর সাথে প্রেম-আদরের ঐকান্ত অনুরাগ।

 

তিন

শীতের সূর্য বড় ঢলানি। মানুষজনও সেই ঢলানি সূর্যের ঢলানি রোদের সাথে গা-ঢলাঢলি করতে বেশ ভালবাসে। কিন্তু এই বিত্তশালী নব্য-পাড়াটায় কতক্ষণইবা শীতের শুকনো ঝরঝরে রোদ পাওয়া যায়! সকাল শেষ হতে না হতেই সূর্য দক্ষিণ দিকে ঢলে গেলে, উঁচু উঁচু বাড়িগুলোর ফাঁকফোকড় দিয়ে ত্যাছড়া রোদ এসে মানুষজনের গায়ে পড়ে বটে, তবে সেই লুকোচুরি প্রেমে মন ভরে না।

প্রিয়া, জগদীশকে বলেছিল, “আমরা এখান থেকে চলে যাব।”

জগদীশও চায় প্রিয়াকে নিয়ে এখান থেকে চলে যেতে। বিয়ে করতে। দু’জনেরই বাড়ি বিহারের কোনো গ্রামে। দু’জনে মিলে ওখানেই চলে যাবে।

জগদীশের আছে সব্জি বেচার ঠেলাগাড়ি, আর প্রিয়ার আছে ঐ বাড়িতে কাজ। স্কুলে যাবার পথে পরস্পরের জোড়া চোখ, একসময় দু’জনে প্রেমের যুগলে বন্দি। প্রেম বলতে, নিজের স্কুল দূর-অস্ত, অন্যকে স্কুল পৌঁছে দেওয়ার পথে, জগদীশের সকাল-বিকেল সব্জি বেচার সময়। মুখোমুখি কথা হয় দু’চারটি–– বাকিটা সম্বল, দাদাবাবুর কিনে দেওয়া কমদামি ফোন, জগার কাছে দামি স্ক্রিন টাচ। জগার কাছে প্রিয়া একদম ফুলের মতো। প্রিয়ার ঘর ফুলের বাড়ির এককোণ। রাত্রিবেলা ফুলের বাড়ির আলো নিভে গেলে, ফোনের বোতাম টিপে কথা বলার আয়োজন। গত শীতে যে-প্রেম গড়া, সে-প্রেম গভীর হয়েছে এখন, এই শীতে তার উষ্ণতা বাড়ে।

যেমন সেদিন–– সকালে ঘুম থেকে উঠতে প্রিয়ার একটু দেরি হয়েছিল। বৌদি, মালকিনি ঢঙে বকা দিয়েছিল ওকে।

“এত দেরি করে ঘুম থেকে উঠলে, ঋতুকে সময়মতো স্কুলে পৌঁছে দেবে কে?”

প্রিয়া এইসব বকাবকি বিশেষ গায়ে মাখে না। নিজে চটপট তৈরি হয়ে নিয়ে, ঋতুকে স্কুলের ড্রেস পড়িয়ে, খাইয়ে, স্কুলে ঠিকঠাক পৌঁছে দিয়েছিল। জগদীশের সাথে দেখাও হয়েছিল। ফিরতে একটু দেরিও হয়েছিল।

 

চার

ল্যাম্পপোস্ট থেকে উজ্জ্বল আলো সরাসরি ঠিকরে পড়েছিল নিশ্চয় তার গায়ে। হয়তো চিকচিক করে উঠেছিল তার কালো শরীর। কিন্তু কেউ দেখেনি তা। ফুলের বাড়ির পিছনের দিকটায় মাঠ ঝোপঝাড়। একদা ছিল চাষের জমি, এখন সেই মাঠ জুড়ে কাশের ঝোপ। সাপ ব্যাঙ ইঁদুরের পুরোনো আস্তানা। কয়েকটি নতুন বাড়ির কনস্ট্রাকশান চলছে। প্রিয়া, জগদীশকে বলেছিল, “প্রায়দিন রাতে এভাবে আসা-যাওয়া কোরো না। তাছাড়া মাঠের দিকে সাপখোপের উৎপাত বেড়েছে। একদিন ঠিক আমরা দু’জনে চলে যাব।”

শীতঘুমের আস্তানা থেকে উচ্ছেদ হয়ে সরীসৃপটা আজ আর এই পথ দিয়ে যায়নি। রেখে যায়নি শিউলিফুলের মাঝ দিয়ে পিচের রাস্তায় হিলহিলে শরীরের দাগ। পিচ কংক্রিট বেলোয়ারি পাথরের চাদর উপড়িয়ে খুঁজে নিয়েছে তার পুরোনো মেঠো জংলী করিডর। সজীব আঁকাবাঁকা সেই অপর-পথ দিয়েই হয়তো ফিরে গেছে।

আজকের সকালের গাছ-পরিচর্যা মাথায় উঠেছে অভিষেকের। বেশ বিচলিত হয়ে রয়েছে সে। ধীরে ধীরে ভাবনার বিচলন কাটিয়ে ওঠে। এইসময় কাকে ফোন করা যায়?–– অবশ্যই বাবলু বাবুকে। বাবলুবাবু, অভিষেকের ওয়ার্ডের দাপুটে কাউন্সিলার। অভিষেক ওনার সাথে প্রয়োজন মতো সখ্যতা বজায় রেখে চলে। আপদে-বিপদে তিনি অভিষেকের রক্ষাকর্তা। বাবলু বাবুকে ফোন করে ঘটনাটার কথা খুলে বললে, বাবলু বাবু আশ্বাস দেন, বলেন, “ঘন্টাখানেকের মধ্যে থানায় চলে আসুন, আমিও পৌঁছে যাচ্ছি।”

অভিষেককে সাথে নিয়ে ডিউটি অফিসারের ঘরে ঢোকে বাবলু। বাবলুই ঘটনার কথা দিয়ে শুরু করে। বাবলুর পাশের চেয়ারে বসে অভিষেক।

“মেয়েটা কত দিন হল আপনার বাড়িতে কাজ করছে?” অফিসার, অভিষেককে জিজ্ঞেস করে।

“মার্চ মাস এলে দু’বছর হবে।”

“বাড়ির সব জিনিস ঠিক আছে কিনা দেখেছেন?”

“দেখেছি, সব ঠিক আছে। আমার কিনে দেওয়া ফোনটাও রেখে গেছে।”

“তাহলে বলছেন, প্রেমঘটিত কারণেই আপনার বাড়ি থেকে মেয়েটা পালিয়েছে।”

“সম্ভবত, তাই। আমার স্ত্রী প্রেমের ব্যাপারটা আগেই কিছুটা অনুমান করেছিল।”

“মেয়েটাকে কাজে রাখার যোগাযোগ কীভাবে হয়েছিল?”

“ফেসবুকের রিজিওনাল গ্রুপগুলোতে আমার স্ত্রীর দেওয়া কাজের লোক চাই সংক্রান্ত একটা পোস্টের মাধ্যমে। প্রিয়া, এখানে ওর মাসির বাড়িতে থাকতো। পোস্টের রিপ্লাই দেখে আমরা যোগাযোগ করি।”

“মাসির বাড়িতে খোঁজ নিয়েছেন, সেখানে গেছে কিনা?”

“খোঁজ নিয়েছি, সেখানে যায়নি। ওরাও কিছু জানে না।”

“কার সাথে পালাতে পারে, অনুমান?”

“সেটা জানি না।”

থানার ডিউটি অফিসার বলেন, “মেয়েটার মাসির বাড়ির ঠিকানা ও ফোন নম্বরটা দিন।”

অভিষেক চাইছে, প্রিয়ার খোঁজটুকু পাওয়া যাক, তাহলেই যথেষ্ট। আর, লোক জানাজানি যতটা কম হয় ততটাই ভালো। কোনো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে অভিষেক চায় না। বাবলু ও অফিসারের কায়দাকানুনে অভিষেককে জিডি পর্যন্ত করতে হয়নি। পুলিশকে যথার্থ ‘ভালবাসা’ দিলে, পুলিশ আপনজনের থেকেও বেশি সহানুভূতিশীল হয়ে কাজ করে। সন্ধ্যার মধ্যে বিহার লাগোয়া একটি জংশন স্টেশনে প্রিয়াকে খুঁজে পাওয়া যায়, সঙ্গে একটি ছেলে, নাম, জগদীশ রাম। অভিষেক নিশ্চিন্ত হয়।

নিশ্চিন্তের রাত। ঘুমিয়ে পড়া কিংবা ফুটতে থাকা ফুলেদের নিয়ে ফুলের বাড়ি নিস্তব্ধ। অভিষেক, সুমনার হাতটা নিজের বুকের ওপর নেয়, বলে, “দু’জন পরস্পরকে কতটা ভালবাসি, একটা শব্দ দিয়ে বলা যাক।”

সুমনা বলে, “ফুল”।

অভিষেক বলে, “প্রজাপতি”।

প্রেম, রাত-প্রজাপতির চক্ষু হয়ে ফুলের রসভাণ্ডার খুঁজে নেয়।

পরদিন সকালে অভিষেক ছাদে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। গতকালের ঝঞ্ঝাটে গাছগুলোর দিকে একদম নজর দেওয়া যায়নি। সুমনা ঘরে ঢুকে বলে, “বাবুল বাবু তোমার ফোনে ফোন করেছিলেন। তখন তুমি বাথরুমে ছিলে, আমি ফোনটা ধরেছিলাম। উনি জানতে চাইছিলেন–– প্রিয়াকে কি আমাদের বাড়িতে পৌঁছে দেবে?”

অভিষেক কিছু উত্তর দেয় না, শুধু বলে, “ছাদের কাজটা সেরে এসে বলছি।”

ছাদে গিয়ে গাছের পরিচর্যা করতে করতে দেখে, মাসদেড়েক আগে যে জলপাই গাছটার জোড়কলম করেছিল সে, সেই কলমের আদিজোড় থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত কুশি বের হতে শুরু করেছে। অভিষেক গ্রাফটিং টুলবক্স থেকে ধারালো ব্লেডের প্রুনিংটা নেয় এবং কুশিগুলো ছাঁটতে শুরু করে…

[ বানানবিধি ও মতামত লেখকের নিজস্ব]

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ