27 Jan

বৈশালী পাড়ার প্রতিমারা

লিখেছেন:শাশ্বত বোস


বৈশালী পাড়ার প্রতিমারা

মফস্বলের ঝিম ধরা বিকেলের চলন্তিকা রোদ, প্রিজম তর্জনীর বর্ণালী ছাড়িয়ে, রাহুরেখা বেয়ে তির্যক ভাবে আলো আঁধারির মায়াজাল বুনেছে পাড়াটায়। আদুর গায়ের ছায়া শরীর আর গলনাঙ্কে ফুটতে চাওয়া তেঁতুল বিচির আঠার রং, যেন কুলহারী বেদব্যাসের স্বমেহ পিন্ডদানের আবহে, খড় –মাটি-রোদ-বৃষ্টির গল্প বলে চলেছে নিরন্তর। গলিটার গা বেয়ে তখন উদলা কাঠামো, নিটোল স্তন আর উর্বীমুখি নিতম্বের সারি। এটা স্থানীয় “কুমোরপাড়া”। আশেপাশের প্রায় তিন চারটে ছোটোখাটো শহরের মাঝে, প্রান্তিক, ক্লেদাক্ত, কস্তুরীয়, ম্রিয়মান প্লবতার নামাবলী গায়ে জড়িয়ে, রক্তাভ ঈশানে, এখানে এক শ্রেণীর মনুষ্যসম জীব, খড়কুটো দিয়ে কাঠামো বাঁধে, সেই বৈরী নগ্নতার গায়ে মাটি চাপায়, বানায় “প্রতিমা”। শাড়ি-গহনা-ডাকের সাজের আড়ালে, নিজের শিল্পসত্তার ফ্যালাসিকে কবর দিয়ে, মূর্তি বিক্রির মৈত্রী চুক্তিতে সায় দিয়ে, দূরে দাঁড়িয়ে যন্ত্রনার সুরহারীর ছেঁড়া তারে, আগমনীর সুর তোলে, আর অনাড়ম্বর সম্যক দৃষ্টির স্থিতিস্থাপকতায় অনুভব করে, সেই প্রতিমার পৃথু দেহজুড়ে লেপন হতে চলেছে, নির্জিত প্রাণপ্রতিষ্ঠার অনশ্বর অসিয়তনামা। আমাদের গল্পটা শুরু হয় এই পাড়াটারই কোনো এক মৃৎশিল্পীর গোলা থেকে। অশীতিপর ভূতবৈরল্য আকাশের শরীরের উপর দাঁড়িয়ে, স্বয়ম্বরী সন্তাপের মেটাফিজিক্যাল অঙ্ক কষে, ঠাকুর বানায় “মধু কুমোর”, প্রতিমার মুখ গড়ে, চোখ আঁকে নিজে হাতে। হতে পারে সেটা আগত আশ্বিনের আগের বর্ষার কোনো এক সর্বাশী বিকেল কিংবা ওই একই দিনের শুরুর বিবসন ভোরের কাল। সময়ের তফাৎ খোঁজা নিরর্থক। কারণ কাহিনীটার শুরু কিংবা শেষ, আবাহন কিংবা বিসর্জন, যাবতীয় গল্পগুলো সবই আবহমান।

“এবারে ওই দাঁবাল পার্টি এখনও এলুনি, মধুদা? বরাত দেবেনি এইবার?” একতাল এঁটেল মাটিকে দুহাতে চটকাতে চটকাতে, নিজের বুনো চট ধরা চুলগুলোকে চোখের উপর থেকে সরিয়ে প্রশ্ন করে “হাঁদুল”।

মধু কুমোর কথাগুলোয় বিশেষ আমল করে না। তাঁর ধ্রুপদী হাত তখন অস্তিত্ব-শুণ্যবাদের পদাবলী রচনায় ব্যস্ত পিশাচসজ্জার এই ঈশ্বরনগরীতে।

আগের কথার উত্তর না পেয়ে হাঁদুল আবার প্রশ্ন ছোঁড়ে, “ও পাড়ার মাটি কবে লিবে বলবেক, আগে থেকে। আমি একবারেই যাবক, সবাইলে লিয়ে এসে দিবোক।”

মধু হালকা সুরেলা গলায় ফিনফিনে পর্দায় উত্তর দেয় এবার, “লাগিবে নি।”

কথাটা শুনে চমকে ওঠে হেঁদো, “লাগিবে নি কি গো?”

মধু কুমোর আবার হাতের ছাঁচগুলোতে মাটি মাখাতে ব্যস্ত। সবে ঠাকুরের খড় বাঁধা হয়েছে এবার। অন্যবার এতদিনে একমেটে হয়ে যায়। এবার বয়সের প্যাঁচটা বেশ একটু বাগিয়েই ধরেছে তাকে।

মুখ তুলে, ঘাড়খানা বামেতর বেঁকিয়ে, হাঁদুল মধুর দিকে ফিরে, ঝাঁঝালো হয়ে ওঠে, “লাগবেনি কি গো? ভীমরতি ধরসে নাকি? ছিষ্টি ছাড়া হইলা নাকি বুড়ো!”। মধু কথাটা শুনে ঋষভ ভঙ্গিতে তাকায় হেঁদোর দিকে। তার অমিত্রাক্ষর চোখ দুটো, নির্বাক শূণ্যতায় তাকায় হেঁদোর খোলা পিঠে। সেই নিস্পলক দৃষ্টির দিকে বেশীক্ষণ তাকিয়ে না থেকে, হেঁদো আবার নিজের কাজ করতে থাকে। রিক্ত, বস্তুবাদী বিরক্তিতে এবার সে বলে ওঠে “তোমায় যে কয়েছিলাম, আমার মজুরী বাড়াইতে, কি হইলো?” এই পহায় আমি আর কাজ করবুনি, পত্যেকে বাড়ায়েছে একেনে।”

প্রতিমা তৈরীর কাজে এক বিশেষ শ্রেণীর জোগাড়ের লোকের দরকার হয়, সৃষ্টির আদিকাল থেকেই। গঙ্গা থেকে কাঠামো তুলে আনে, স্থানীয় হিন্দুস্তানী পট্টির ছেলেপুলেরা। সেই অস্থিসার কশেরুকার উপর, মাটির প্রলেপ মাখানো চলে। একমেটের জন্য ক্ষেতের আঠালো এঁটেল মাটির জোগান দেওয়া থেকে শুরু করে, সেই মাটি তুশ দিয়ে মেখে, মৃৎশিল্পীর হাতের কাছে ধরা কিংবা এঁটেল আর বালি মাটি মিশিয়ে মুখের ছাঁচে ফেলে, মুখ বানিয়ে দেওয়া, দোঁমেটের জন্য গঙ্গা থেকে বালি মাটি তুলে আনা, দোমেটের পর প্রতিমার গা ফাটলে, এঁটেল মাটিকে জল দিয়ে গলিয়ে পাতলা করে, ন্যাকড়া দিয়ে সেই ফাটলের গায়ে মেরে দেওয়া, এঁটেল মাটিতে মেশানোর জন্য দা দিয়ে পাট কুচিয়ে দেওয়া, এসবই এপাড়ায় বেশ অনেকবছর ধরে একসাথে বেশ কিছু গোলায়, অনুমেয় গুলজারী ধারায় করে আসছে এই হাঁদুল। এই করেই ওর পেট চলে। সারা বছর এই কুমোরপট্টির বিভিন্ন ঘরে, ওর দিন কাটে। কাজের পরিবর্তে মজুরী আর দুবেলা খাওয়া, এই হল ওর রোজনামচার ঋণাত্মক সোপান। রাতে মধুর সাথে সস্তার মদ আর নিকোটিনে চুবোনো নির্কষ সন্তুষ্টি, কাব্যিক গূঢ়তার দিগম্বরী স্পর্ধায় হাঁদুল ভাবতে শুরু করে, সেও “শিল্পী”।

এই গলিটার শেষে, যেখানে অন্ধকার চুঁইয়ে নামছে, পোড়ো বাড়ির গায়ের, নোনা ধরা দেওয়ালের খসে পরা পলেস্তারার মতো, সেইখানটাতে শর্বরীর শরীর হাতড়ে পাওয়া যায়, কিছু নির্বস্ত্র শরীর। অবাধ পৃথু দেহ জুড়ে যেন তন্দ্রাতুর অশ্লীলতার ছাপ, চোখগুলো জুড়ে অমোঘ নেশা, আর কিছু সবুজ হলুদ শাড়ি-চুমকি-অভ্র। এই গলিতে ভদ্র লোক যায় না। শুধু এই রাস্তার শেষে কসাইয়ের দোকান, আর সেই দোকানের মতো এই গলিতেও দরজায় দরজায় মাংস বিক্রি হয় অবাধে। খদ্দের এসে হাত বাড়ায় বুক, পেটে, ঠোঁটে। দরদাম করে সবশেষে কিনে নিয়ে চলে যায়, এ ঘর থেকে ও ঘরে। পুরো খুললে পাঁচশো, আঁচল সরালে তিনশো, ঘন্টা প্রতি হরেক রকম রেট চলে এখানে। বলার অপেক্ষা রাখে না এটাই “বেশ্যা পাড়া”। পাশাপাশি দুটো পাড়া জুড়ে প্রতিমা আর পতিতা দাঁড়িয়ে থাকে পাশাপাশি। পাড়ার মোড়ের কালীমন্দিরটায়, অম্বুবাচিতে প্রতিমার মুখ ঢাকা হয়। পোয়াতি বর্ষার অবাধ ধারায় বেশ্যারাও রজঃস্বলা হয়। ভয়, লজ্জা আর প্রার্থনার ঐতিহাসিক সন্ত্রাস চলে এই কদিন। হেঁদো ও এই বেশ্যা পট্টির ফসল, তবু সেই প্রেষিত, কলুষ, ইমারতি জন্মস্রাবের স্মৃতিকে, নিজের একমাত্র পরিচয় না করে, বেশ্যা পাড়ার দালাল বৃত্তি ছেড়ে এই কুমোর পাড়ায় জোগাড়ের কাজ নিয়েছে হেঁদো। এই জন্যই হয়তো বৈবস্বত নগরে বোকা দের অনিবার্য্য জন্ম হয়, বুদ্ধি মত্তার ক্লীবতার স্বার্থে।

তবু হেঁদো দিনে একবার ছুতোনাতায় ঘুরে আসে ও পাড়া থেকে। পুরোনো আধভাঙা সব বাড়ি, অশুচি দেওয়াল ,বায়ুভুক উঠোন, যেন সারা শরীরে সেপ্টিসেমিক রক্ত আর কামব্যবসার ভেজা শীৎকারে ডুবে যাওয়া, অন্তঃসত্ত্বা অঘোরকামিনীর অনুসর্গ টেনে বাঁচতে চাওয়া, প্রসেনিয়ামের সজল এপিটোম। কোনটা একতলা, ব্রাত্যজনের দরজা ঠেলে, এঁটো উঠোনের আঁশটে গন্ধটা গায়ে মেখে, হয়তো বাঁ পাশে একটা লম্বচ্ছেদী সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। ক্রাফ্টেড মেঘের গা থেকে চুঁইয়ে পরা নিমমাজনের এঁটো থুতুর মতো, মরা উপন্যাসিকের নালবেষ্টিত ঘরগুলো সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মৃত প্রিয়ম্বদার এরোটিক যৌনতার মহাকাব্য হয়ে। ঘরের এককোণে একটা তক্তপোষ, আরেক কোণে হয়ত একটা জল খাবার কুঁজো, সাথে উপুড় করা গ্লাস। ঘরের দেওয়ালের কুলুঙ্গিতে, পর্দা ঢাকা ঠাকুরের ছবি যেন লিপি ধর্মঘট টানে, পতিতার রোমান্টিক শ্রাবণী সঙ্গমে। এই ঘরেরই আরেক কোণে, নীরব চারুকলার সাক্ষী হয়ে ঝুলতে থাকা একটা মাদুর, পরকীয়ার তত্ত্ব বোনে। তার ঠিক পাশটাতেই, মেঝেতে ইট দিয়ে ঘেরা ছোট একটা জায়গার ভেতর, একটা নর্দমা, পাশে মগ আর বালতি। ওটাই গণিকার সঙ্গমের পর যোনিপথ সাফ করার জায়গা। বাড়িগুলোর সামনে মহাকাব্যিক দরজা কিংবা রোয়াকে শোভা পায় অপর্ণা, অর্চিতা, মৌসুমী, শোভনার দল। এইরকমই কোনো এক ঘরে জন্মেছিলো হেঁদো। আবঝা আবঝা এখনো মনে পড়ে তার। ঘরে লোক ঢুকিয়ে ওর মা ওকে বাইরে বার করে দিতো। ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে ও শুনতে পেত মায়ের গোঙানি আর খদ্দেরের অবিরাম খিস্তিখেউড়। এক এক দিন অনেক রাতে ওকে কাছে টেনে নিতো ওর মা। আধো ঘুমের মাঝেও ও টের পেত ওর মায়ের নিঃশব্দ কান্নার উপস্থিতি। আর গাল বেয়ে গড়িয়ে পরা পরিশ্রমী ঘাম, অভিশাপের চুমু ছুঁড়ে দিতো ওর কপালে। সময়ের স্রোতে বদ্ধ ডাস্টবিনে জমা প্লাস্টিক আর আবর্জনার মতো পচতে থাকে সে সব, হেঁদোর অন্তরালে। একদিন বাইরে থেকে খেলে ফিরে, হেঁদো দেখলো ওদের ঘরের সামনে অনেক ভিড়। ছোট্ট দু হাতে একে ওকে সরিয়ে, ঘরের ভেতর বিছানার দিকে এগিয়ে যেতে গিয়ে, একটা সজোরে ঝটকা খেল হেঁদো। বিশাল চর্বির একটা থলি যেন ওকে চেপে ধরল সজোরে। গদার মতো দুটো হাত দিয়ে ওর ছোট্ট শরীরটা, নিজের পৃথুলা শরীরে চেপে ধরেছিলো “নমীমাসি”। হেঁদোর মা টা মরে গেলো, কোন কাস্টমার নাকি কাজ করার সময় বেশি চড়ে গিয়ে, গলা টিপে মেরে ফেলেছিলো ওর মাকে। তারপর থেকে নমীমাসির কাছেই থাকতো হেঁদো, পাড়ার মেয়েদের ফাইফরমাশ খাটতো। মাঝে মাঝে মাঝরাতে জোরালো হাসি কিংবা কান্নার শব্দে, ঘুম ভেঙে যেত ওর। তখন দেখতো ষণ্ডামার্কা একটা লোক, খদ্দের নিয়ে এসে ঢোকাচ্ছে অন্য মেয়েদের ঘরে। আগে এই লোকটাকে ও দেখেছিলো, ওর মায়ের ঘরে লোক নিয়ে আসতে। লোকটাকে আড়ালে খুব ভয় পেত হেঁদো। ওকে দেখলেই লোকটা যেন আরো ষণ্ডাপনা দেখাতো, চোখ পাকিয়ে তেড়ে আসতো মাঝে মাঝে,মারধরও করতো। একদিন আর থাকতে না পেরে, একটা আধলা তুলে লোকটাকে ছুঁড়ে মেরেছিল হেঁদো। পাশের ঘরের বিন্নি, হাত ধরে ওকে টেনে নিয়ে যায় নিজের ঘরে। মাথায় হাত বুলিয়ে, পাইরিয়ার ক্ষত চিহ্ন শোভিত দাঁত গুলোয় অষ্টকি হাসি তুলে বলে, “অমন করে না মানা, ওটা কে জানিস? তোর বাপ্”। তারপর থেকে একটা মনোক্রমী ভয়, মাথা থেকে নেমে, চোখ, নাক পেঁচিয়ে গলা টিপতে আসতো হেঁদোর। দেহজ পাপ, শুকিয়ে আসা আসঞ্জক আর ক্রমে বন্ধ হয়ে আসা নিঃশ্বাসের শ্রেণীবদ্ধ বিন্যাসে এক ঋণাত্মক উপলব্ধি জাগছিল তার ভেতর, এই অপার বিশ্বে সে অবাঞ্ছিত, তাঁকে কেউ চায় না। একদিন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো ও, আর ফেরেনি, গিয়ে জুটেছিল এ পাড়ার “মধু কুমোরে” র কাছে। বৌ, ছেলে মেয়ে নিয়ে মধুর তখন ভরা সংসার। সরকার থেকে পুরস্কারও জুটেছে তার শিল্পকর্মের জন্য। বড় বড় খবরের কাগজের লোক, তখন হত্যে দিয়ে পড়ে থাকে “মধুসূদন পাল শিল্পালয়” এর সামনে।

“মধু খুড়োটার কিছু ভীমরতি হইছেক, দুগ্গা ঠাকুর গড়তে মাগীবাড়ির মাটি লাগব নি?”, জৈবিকতার শ্রাবণী মেঘের জংঘা বেয়ে নেমে আসা, একটা ধ্রুপদী নৈরাশ্য গ্রাস করে হেঁদোকে। তবে বছর কয়েক আগে, নিজের স্ত্রীর অকালমৃত্যুর পর থেকে, সত্যিই বদলে গিয়েছে মধু। জীবনের সব উচ্ছাস কেড়ে নিয়েছে, পৈশাচিক সন্তাপের দহন। সে এখন কাঁপা কাঁপা হাতে ঠাকুর গড়ে না, যেন দার্শনিক অঙ্ক কষে লিখে রাখে দপ্তরী ঔপন্যাসিকার শেষটুকু। ছেলেটাকে আর্ট কলেজে পড়িয়েছিলো, অল্প বয়সে বাপের মদের নেশা গিলে খেয়েছে ছেলেটাকেও। সে এখন দুগ্গার বাঁ পাশে লক্ষ্মী আর ডান পাশে সরস্বতী গড়ে, পৃথিবীর অভিকর্ষকে অগ্রাহ্য করতে চায়। সত্যি পাগলামো আর খামখেয়ালিপনা এদের রক্তে।

তবু আজও, এই মাঝ বয়সে পৌঁছেও দিনে একবার না একবার ও পাড়া থেকে ঘুরে আসে হেঁদো। বয়ঃসন্ধির কোনো এক নান্দনিক বিকেলের, অস্থির মেঘের তছরূপী ছায়াপথ বেয়ে, প্রেম এসেছিলো ওর জীবনে। যদিও এ পাড়ায় প্রেম আসে না, খোলা পথে আসতে গিয়ে, কুলোটা দময়ন্তীদের লাল ব্লাউজের ফাঁকে খাঁড়া আপিনে অদুগ্ধতার আশ্লেষে ধাক্কা খেয়ে পালিয়ে যায় চোরাপথে। তবুও হেঁদোর এই মাধুর্য্যহীন, অমানুষের জীবনে, ভালো লাগা এসেছিলো, এই বেবশ্যা পাড়াতেই, নিয়মমাফিক দেহস্রাবের বীর্যে পোয়াতি হওয়া, শুঁয়োপোকার মতো।

কদিন ধরেই হেঁদো এ পাড়া দিয়ে যাওয়ার সময় লক্ষ্য করেছে, চার নম্বর বাড়ির দরজার সামনে একটা ফর্সা পানা নতুন মেয়ে, গায়ে ব্লাউজ আর সেমিজ চড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু মেয়েটা আর চার পাঁচটা মেয়ের চাইতে কোথায় যেন আলাদা। ঋতিচূর্ণতার ত্রাসে নত সূর্য্যাস্তের মতো অসম্ভব শান্ত দুটো চোখ, এক ঢাল আলু থালু চুল, তাতে রঙিন ফিতে দেয় না, কিন্তু চুলে একটা অদ্ভুত জেল্লা আছে। মেয়েটার মুখটা কি অসম্ভব মায়াময়। এ মুখ হেঁদো আগে কোথাও দেখেছে, হয়তো মধুর গড়া লক্ষ্মীঠাকুরের মতনই মুখের গড়ন। তাই মেয়েটাকে হেঁদোর এতো চেনা লাগে। মেয়েটা একএকদিন এক এক রঙের ব্লাউজ আর সেমিজ পরে। এখনকার মেয়েগুলোর মত জিন্স আর টপ ও পরে না, আবার নিজে থেকে কাউকে ডাকেও না। রাস্তা দিয়ে লোক গেলে “এই যে হিরো শোনো, যাবে?” বলে সিটি মারে না। এমনকি পড়তি গতরের মাগীদের মত হাত ধরে টানাটানিও করে না, চুল্লুর পাউচটা কেটে মুখে পুরে, দরজার সামনের রাস্তাটায় দাঁড়িয়ে, ঠোঁটে সিগারেটে অঙ্গার আত্তীকরণের ধোঁয়া তুলে, জটলাও করে না। খদ্দের এসে সামনে দাঁড়ালে, চুপচাপ নিয়ে ঘরে ঢোকে। হাতে করে টাকাটা এনে মাসির হাতে দিয়ে দেয়। পাড়াটাকে ভালো করেই চেনে হেঁদো, এই বাড়িটাতেই ওরা থাকতো। এদিকটা এখন অনেক বদলে গেছে, পুরোনো অনেক লাইন বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাটও উঠেছে। এলাকায় যারা পোড় খাওয়া ক্রিমিনাল, পলিটিকাল লিডারদের ডান হাত, বাঁ হাত, বেনামে তারা ফ্ল্যাটগুলোকে কিনে ধান্দা চালাচ্ছে। তবু এই দরজাটা হেঁদোর ভীষণ চেনা, এই জায়গাটাতেই ওর মা দাঁড়াতো। হাঁ করে মেয়েটাকে দেখতে থাকে হেঁদো। এ দৃষ্টিতে কামরসের দেহি উপসর্গ নেই, বরং মেয়েটির এই অমলিন সুন্দর দেহাবয়ব, এই বৃষ্টিমেদুর অন্ধকারে, প্লেটোনিক উষ্ণতায়, হেঁদোর শরীরে এঁকে দিতে চায় সমাবেশী মনন-শূলানির পদাবলী। মেয়েটাও নিস্পলক দৃষ্টিতে দেখতে থাকে হেঁদোকে। হঠাৎ বাঁ পাশে একটা ছোট্ট ধাক্কা খায় হেঁদো, সাথে হাতের চুরির ঠুনঠুন শব্দ শুনতে পায়। চোখ ফিরিয়ে সে দেখে, নধর শরীর দুলিয়ে, সারা গায়ে মূর্ছনার হিল্লোল তুলে, হেঁটে যায় পাড়ার ঝুম্পা বৌদি। ভদ্র কাপড়ের আঁচলটা আলতো করে গুটিয়ে কাঁধে জড়ো করা। ঠোঁটের কামিনীঘন কামুক লাল রং, চোখের উরোগামী উনুন আঁচ আর সুডৌল আপিনের সমকোণের আবেদন, হেঁদোর শরীর অববাহিকায় ঢেউ তোলে, ওর মনে অজ্ঞেয় কাম জাগে।

মিসেস দুলারী ব্যানার্জী, আসলে দুলারী পাসোয়ান, এ পাড়ায় সবাই চেনে ঝুম্পা বৌদি নামে। সেই কোন কালে বিহারি জুট মিলের লেবারের ঘর ছেড়ে, মেয়ে কোলে করে, জুটমিলেরই কেরানী “নিমুবাবু”র হাত ধরে, এ পাড়ার কোণের ঘরটাতে এসে উঠেছিল। তাঁর স্বামী পালিয়েছিলো এক ছিনালের সাথে। মরদবিহীন যুবতী শরীর, সাথে ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের অভাব, সব থেকে বেশি দুলারীর উঠতি যৌবনের অতলস্পর্শী কস্তুরী, উন্নিদ্র পৃথিবীর যে কোনো পিপাসী পুরুষমন, হয়তো নিমেষে এই নষ্ট শরীরী গুহ্যতায় মজে যেতে বাধ্য।

বিগত যৌবনা বারবনিতার মতো পাংশু, পলেস্তরা খসা, লাইনবাড়িগুলোর কোণের একটা ঘরে, মা মেয়েতে থাকতো দুলারী। জুটমিল বন্ধ হওয়াতে নিমু বাবু, বাইরে সেলস এর চাকরি নিলেন। প্রথম দিকে, ন মাসে-ছ মাসে বাড়ি এলেও, ইদানিং এ বাড়িতে তাকে আর কেউ দেখতে পায় না। যদিও মাসের মাঝখানে, অনলাইনে দুলারীর একাউন্ট এ টাকা এসে যায় ঠিকই। হয়তো বা সে মৃত মাছের, আঁশ না ছাড়ানো, চৈতন্যবাদী টগরবোষ্টমী আর অক্ষৌহিনী নীল শৃগালের, কোমল স্বরযন্ত্রের সান্দ্র মেদুরতায় বোনা, নির্মোক এক প্রায়শ্চিত্তের আখ্যান। দুলারীর মেয়ে “পিউ”, ভালো নাম “অস্মিতা ব্যানার্জী”। নিমুবাবুর পদবীটাই মেয়ের স্কুল কলেজে ব্যবহার করেছে দুলারী, নরম তরুনাস্থি কিংবা অস্থিসন্ধি আড়াল করার জন্য, সাদা চামড়ার একটা পিতৃপরিচয় এর লোভে। বয়সের নরম সমানুপাত বেয়ে, যৌবন খেলা শুরু করেছে পিউ এর শরীর জুড়ে, ঠিক যেন যৌবনের দুলারী। অস্থিসার সেই লাইনবাড়ির, অর্ধেকের বেশিটাই আজ আর নেই, ভেঙে ফ্ল্যাট উঠেছে। ছোট খুপরির মতো নিরক্ষীয় প্রকোষ্ঠগুলোর অধিকাংশটাই, বেনামে কিনে নিয়েছে পলিটিক্যাল পার্টির লিডার কিংবা তাঁদের চেলাচামুন্ডারা। সেগুলোতে এখন দিনে রাতে, দিব্যি শরীর ব্যবসা চলে। একটা ফ্ল্যাট ঝুম্পারাও পেয়েছে। সবটাই অবশ্য লোকাল M.L.A “টেঁপা দা” আর তার রাইট হ্যান্ড “মদনা”র কল্যাণে। ঝুম্পা বৌদিতে মজে না, এমন মরদ এখনও জন্মায়নি এই দেবীপুরে। পিউ এর এখন ক্লাস টুয়েলভ, কমার্স নিয়ে পড়ছে এখানকার মালতী হাইস্কুলে। সকাল বিকেল শাড়ি পরে স্কুলে যাওয়ার পথে, তার শরীরটা হাঁ করে গেলে মোড়ের মাথার মদনারা। পিউ এর সেটা বেশ লাগে, সাধ হয় কিশোরী দেহের খোলস ছেড়ে আদিম, অসভ্য এক নারী হতে। মদনা দা যদি হাতটা ধরে, একবার ওর বাইকে তুলে নেয়, বেশ হয়। ওর সব বন্ধু, কল্পনা, মৌসুমী, স্বেতা, সোমা, সবাই তো মদনাদার সাথে খেপে খেপে ঘুরেছে।

এইজায়গাটাতে থাকতে আর মন চায় না ঝুম্পার। মেয়েটা বড় হচ্ছে, নতুন করে আবার ঘর পাততে ইচ্ছে হয় ওর। পিউ কে ছেড়ে ঝুম্পার হাত ধরবে না মদনা কিংবা কেউটে। হাজারহোক এরা এন্টি সোশ্যাল, এই বয়সে নতুন করে অনিশ্চিত জীবনের দগদগে পোড়া ঘা চায় না দুলারী। পিছনের জীবনের ঝলসানো কালবেলা, এখনও ওর স্মৃতিতে টাটকা। পিউকে একাউন্টেন্সি পড়াতে, একটা বছর চব্বিশের ছেলে আসে ওদের ফ্ল্যাটে। ফর্সা, সুন্দরপানা চেহারা, নাম “সুমন”। কয়েকদিন হলো ছেলেটা MBA পাস করে ক্যাম্পাসিংয়ে একটা ভালো কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছে। সেদিন সন্ধ্যেবেলা পিউ বাড়ি ছিল না, হাতকাটা শিফন নাইটিটা পরে জলখাবার দিতে যাবার ছুতোয়, সুমনের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল দুলারী। ঊষর কবিতায়, শব্দপোকার আখরে ফুঁটে থাকা, প্রান্তিক যতিচিহ্নের তীব্র আশ্লেষে, নিজের ঈষৎ চর্বিল শরীর, গতযৌবনা আপীন কিংবা মাংসল সুউচ্চ নিতম্ব, সমন্বয়ী বর্ষামঙ্গলে ভেজা দেহানলের উত্তাপটুকু, পুরো চেপে ধরেছিলো ওর গায়ে। হাইবারনেশনের পাঁচিল টপকে সুমনের শ্বাস প্রশ্বাস কি একটুও গভীর হয়নি? ফেনিল সাগরের জৈবিক নিয়মানুবর্তীতায় কি উদ্যাপিত হয়নি ওর পৌরুষ?

মধু কুমোর ঠাকুর গড়ে, একমেটে শেষ করে দোমেটে করার প্রস্তুতি নেয়। ফাঁকে অসুর আর দেবীমুখ তৈরী করে পাশাপাশি নির্বাণি ছাঁচে, দপ্তরী হিসেবী আঙ্গুল চালায় প্রতিমার কটিদেশ, নিতম্ব কিংবা বক্ষদেশ জুড়ে। স্থূল থেকে স্থূলতর হয় দেবীকুলের বক্ষ বিভাজিকা, মধুর নিপুণ হাতের টানে। নাগাড়ে বালি মাটি আর এঁটেল মাটি মিশিয়ে চটকে দেয় হেঁদো। দুপুরে খেতে বসে, খাওয়ায় মন থাকে না মধুর। পোষা বেড়ালটা এসে, পাতে মুখ দেয়। পাতটুকু চেটেপুটে শেষ করে গিয়ে, শুয়ে পড়ে প্রতিমার কাঠামোর নীচে। মধুর মন পরে থাকে ঠাকুরে, এখনও কত কাজ বাকি! ঠাকুর গড়া, ঠিক জীবন গড়ার মতো। দুপুরে মনে হয় সামনের রাতটাই বুঝি শেষ। তারপর পোয়াতি যামিনীর জঠর চিরে, প্রত্যয়ী ভোর হয়। আবারও একটা দিনের শুরু। সিংহের কেশর, মহিষাসুরের পেশী, দেবীর স্তন, সব মিলেমিশে জমা হয় বৈতরণীর কূলে।

সেদিন সন্ধ্যে থেকে মদটা একটু বেশি খাচ্ছিলো মধু। হেঁদোটা বার বার বলছিলো, “আরে খেওনি মধুদা, রাত জাগতি হবেক, কাল তো মহালয়া, ঠাকুরের চোখ দেবেনি?” মধু কান দেয়নি ওসবে। ও জানে শুধু আজকের রাতটা, ব্যস তার পরেই গভীর ঘুমের ঘোরে, শস্যের মঞ্জুরি বেয়ে ঢুকে পরবে, আবেগ পোকার ডানা। আর কোনো নির্জিত যন্ত্রনা কিংবা পাতাবাহার পারবে না মধুর রাতের ঘুম ভাঙাতে। ভোর রাতে চোখ আঁকবে মধু, দেবীর ত্রিনয়ন, ঈষৎ অনল আভার সাথে কৌমুদী আবেশ মাখানো থাকবে সেই চোখে। মধু পাল রাষ্ট্রের সম্মান পেয়েছিল দেবীর চোখ এঁকে। সেই চোখ আবার আঁকতে হবে তাকে। আশাবরী রাগে খাম্বাজ মিশে যাবে। তারপর আহিরভৈরবীতে অনুষ্টুপ ছন্দে বিষণ্ণ ভোর, মৃন্ময়ী মূর্তিতে প্রাণ এনে দেবে। টলতে টলতে, নিজের গোলায় ঢুকে যায় মধু। বাইরের চৌকিতে আজ আধজাগা থাকবে হেঁদো। হাতের তুলিটা রঙের তুবড়িতে ডুবিয়ে গভীর শ্বাস নেয় মধু। এবার সেই অমৃতক্ষণের প্রতিক্ষা। আজ বিকেল থেকেই লাইনের ওপারের মুসলমান পাড়ায় ঝামেলা বেঁধেছে। দফায় দফায় লোকাল থানা থেকে ভ্যান দৌড়োচ্ছে সেদিকে। রাত বাড়লে গন্ডগোল বাড়তে পারে। অমাবস্যার গুমোট অন্ধকারে, বাইরের ল্যাম্পপোস্টের নরম আলোয়, বৃষ্টি ভেজা আধপোড়া রাস্তার ম্যানহোলে, দৌর্মনস্যতার জালবুনে নিঃসাড় গলনাঙ্কে, সাবধানী কান পাতে হেঁদো। মাথার কাছে রেডিওটা আঁকড়ে নেয়। আর কিছুক্ষন, মধু ঠাকুরের চোখ দেবে মহালয়ার ভোরে। মৃদঙ্গ ভৈরবী রাগে, উদাত্ত কণ্ঠে চন্ডীপাঠের আবহে, পাড়াটার অসাড় দেহে জেগে উঠবে, অনুচিন্তক মননশীলতা।

খুব ভোরবেলা, চারমাত্রিক নির্লিপ্ত বাতাসে, ভগ্নাংকের পূর্ণজন্মে, ঘুম ভাঙে পাশাপাশি দুটো পাড়ার। দূরের একান্নবর্তী কোঠাগুলোর রংচটা দেওয়ালে, এসে ধাক্কা খায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণের “নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমৌ নমঃ”, সাথে ত্রিদিবি সংলাপে, কারুবাসনার ছবি আঁকে, ইসলামী অনিন্দ্য আজান। রাতের নিস্তব্ধতা ভাঙে, দিনের শুরুয়াতি পাখির আলাপে। কুমারপাড়ায় মধু কুমোরের গোলার সামনে, ভিড়টা জমাট বাঁধে। বাইরের খাটিয়ায় তখন গোলাপের জীবাশ্মের মতো পরে আছে হেঁদোর থ্যাঁতলানো দেহটা। প্রচন্ড আক্রোশে গলায় ধারালো অস্ত্রের কোপ বসিয়েছে যেন কারা! গোলার দরজাটা সজোরে ভেঙে দিয়ে গেছে কেউ। ভিতরের প্রায় সম্পূর্ণতার কোঠায় পৌঁছানো মূর্তিগুলো, আসুরিক উন্মাদনায় দুরমুশ করেছে। পাশবিক যৌন উল্লাসে, প্রতিমার পরণের কাপড় করেছে ছিন্নভিন্ন। বিবস্ত্র, বিকৃত মুখ মূর্তিগুলো যেন নির্লিপ্ত দেহভৃত অবয়ব, ভগ্ন বাহুদ্বয় সম্মুখে বিস্তৃত করে, নিজেদের বিপন্নতার কথা ব্যক্ত করে চলেছে নিরন্তর। একটু দূরে মাটিতে উপুড় হয়ে পরে রয়েছে মধুর নিথর দেহ। মাথার পিছনে গভীর আঘাতের চিহ্ন। প্লাজমিক শোণিতধারা ক্ষীণ রাস্তা বেয়ে, গিয়ে মিশেছে দূরে উল্টানো রঙের বাটিতে, যেন রক্ত আর রঙের অব্যয় হোলিখেলা। ঠিক পাশটাতে পরে আছে, একটি দেবীমূর্তির খন্ড মস্তক দেশ। দেখে বোঝা যায়, কাল সারারাত ধরে এই নির্দিষ্ট মূর্তিটির মুখাবয়ব, রঙের পরতে, নিপুণ তুলির চক্ষুদানে, পরিপূর্ণ করেছে মধু। তার ঠিক পাশটাতে পড়ে রয়েছে, একটি অষ্টাদশী কিশোরীর পাসপোর্ট সাইজের ছবি। হয়তো বা শিল্পী মনের, নৈসর্গিক সংবেদ আর কুদরতী অতীন্দ্রিয় প্রবৃদ্ধতায়, একেই ফুটিয়ে তুলছিল মধু। গোলার সামনে জটলা থেকে কেউ আর ভিতরে ঢোকার সাহস করে না। শুধু ভেসে আসে ফিসফাস শব্দ “ওই ও পাড়ার মালগুলারই কীর্তি, ক্ষারটো এইভাবে মিটাইলেক! আশেপাশের গোলাগুলার দরজা গুলান খুলতে পারেকলাই, মধুদার গোলার দরজাটো দরমা বেড়ার, কতবার কয়েছিলুম সারাইতে, সারাইলেনি। এবার লাও।

-ওই ছবিটা কার গো? আহা কি সুন্দরপনা মুখখানা!

-আরে ওইটাই ত মধুদার সেই হারিয়ে যাওয়া মেয়েটা গো, ওর শোকেই তো মধুদার এমন পাগলপানা দশা!”

বেলা গাঢ় হতে একটা পুলিশভ্যান ঢোকে পাড়াটায়। তবে সকলের প্রত্যাশামতো, সেটা মধুর গোলার সামনে না থেমে, সোজা চলে যায় গলির শেষপ্রান্তে, ৪ নম্বর লাইনবাড়িতে। বাড়ির সামনে তখন মেয়েদের ভিড়। স্থূল চর্বির বাতুলতায়, শরীরে দোল তুলে, পৃথুলা “মাসী” এগিয়ে এসে থানার আইসি কে নিয়ে যায় কোণের ঘরে। সে ঘরে তখন রক্তারক্তি কান্ড! কাল রাতে এ পাড়ার দালাল, “বিষ্টু”, দুটো ষণ্ডা মার্কা লোককে, জোর করে ঢুকিয়েছিল পাড়ার নতুন, সেই সুন্দর মুখের মেয়েটির ঘরে। মেয়েটি নরম গলায় আপত্তি করেছিল, কেউ শোনেনি। রাত বাড়লে লোকদুটো মদের ঘোরে চড়াও হয় মেয়েটির উপর, জোর করে যৌন লালসা পরিতৃপ্ত করতে চায়। মেয়েটি সহ্য করে প্রথমে, এ লাইনে এটাই তো তাদের জৈবিক নিয়ম। এইরকম প্রতিরাতের শেষেই তো, প্রেমহীন অভাবী ভোরে তারা গান গেয়ে ওঠে, ঠিক যেন আলোর নীড়ে শিস দেওয়া হামিং বার্ড। কিন্তু কালরাতে অত্যাচার চরমে উঠেছিল, আঁচড়ানো কামড়ানোর সাথে চলে বিবস্ত্র করে মারধর। একটা লোক তো ধারালো ছুরি বার করে, মেয়েটার শরীরটাকে ক্ষতবিক্ষত করতে চাইছিল। আর চুপ থাকেনি মেয়েটা, হাত থেকে ছুরিটা কেড়ে নিয়ে বসিয়ে দেয় একটার গলায়, অন্যটা দ্বিগুণ হিংস্রতায় এগিয়ে এলে সজোরে ছুরিটা বসিয়ে দেয় তার শিশ্নাগ্রে। ফিনকি দেওয়া রক্ত ছিটকে এসে লাগে মেয়েটির সীমন্তপথে। গ্রহণের জোয়ার ভাঁটায়, রোহিণী ভাদ্রপদদের বুক শুকিয়ে, কোমল বিটপীসম শরীরটায় যেন দৈবী রজঃসঞ্চার হয়।

লেডি কনস্টেবলরা, মেয়েটির দুহাতে হাতকড়া পরিয়ে, ধীরে ধীরে প্রিজন ভ্যানে তোলে। মেয়েটির মুখ জুড়ে, তখনও নির্বিকার মৃতবৎসা, ছড়িয়ে ছিটিয়ে লেগে রয়েছে, শুকনো রক্তের দাগ। ভ্যানটা কুমোর পাড়া হয়ে, মধুর গোলার সামনে দিয়ে, মিলিয়ে যায় গলির শুরুর চোরাপথে।

ভিড়ের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা, ঝুম্পা বৌদির দিকে, চোখ যায়নি কারও। আলুথালু চুল, গায়ে নাইটির উপর ওড়না জড়ানো চোখে, ভীত মাতৃত্বের স্বতঃপ্রবৃত্ত সন্তাপ। সকালে মেয়ে পিউয়ের ঘরে, টেবিলের উপর রাখা, চিঠিতে লেখা ছিল “মা আমরা চললাম, তুমি ভালো থেকো। আমি আর সুমন ভালো থাকবো, আমাদের খোঁজ করো না।”

বৈশালীর নগরবধূ আম্রপালীর, চিকুরী শরীর জুড়ে তখন, অনসূয়া ঢাকের শব্দ।

[বানানবিধি ও মতামত লেখকের নিজস্ব]

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • পীযূষ কান্তি দাস on March 22, 2024

    বৈশালী পাড়ার প্রতিমারা অনবদ্য লেখা।

    মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ