সূর্যটা যেখানে শেষ ঝরে যাচ্ছিল সেখান থেকে একটা রঙিন ঢেউ উঠতে উঠতে ক্রমশঃ রামধনু হয়ে ঢুকে এল ক্লাস ঘরে!
স্বপ্নের মাত্র দু’ একটা টুকরো ছবিই ক্যাচ লাইনের মতন থেকে যায় সারাটা জীবন জুড়ে। তার আগে বা পরে ঠিক কি ঘটে মনে রাখা যায় না। সেবার ক্লাস নাইনের ফাইনাল পরীক্ষার পরেই এমনি এক স্বপ্নে তখন ভেঙেচুরে যাচ্ছিল ছেলেটা। এক কুয়াশা ঘেরা আবছা সময়। সেটা দিন, না রাতের কোনও অংশ, এমন কিছুই স্পষ্ট নয়। মনোরমা এক কিশোরী কন্যা যেন কি একটা চাইতে বা কিছু একটা বলতে এসেছিলো তাদের ক্লাসে। মেয়েটির মুখও অস্পষ্ট। ক্লাসের দিদিমণি কি যেন এক নামে ডাকছিলেন তাকে। স্বপ্নে কথাও তো শোনা যায় না! মেয়েটি কিসের জন্যে এল এইসব যখন দিদিমণিকে বলছে বা বলতে যাবে সেই মুহূর্তেই স্বপ্নটা এলোমেলো। রামধনুটা বেবাক মিলিয়ে গেল হাওয়ায়! সেই স্বপ্নের একটাই ক্যাচ লাইন থেকে গিয়েছিল, হাতে বোনা এক রামধনু রঙের ওপেন ব্রেস্ট ফুল হাতা সোয়েটার। টাল মাটাল হওয়ার পালাটা শুরু হ’ল তারও কিছুদিন পর। স্কুল শুরু হওয়ার আগে, একদিন প্রার্থনার লাইনে এক ধাপ উঁচু ক্লাসের এক দিদিকে দেখেছিল সে। পরনে তার ঠিক সেদিনের স্বপ্নে দেখা ওই রামধনু সোয়েটার, হাতে বোনা ওপেন ব্রেস্ট ফুল হাতা। একটা দমকা হাওয়ায় সব কিছু যেন ওলট পালট হয়ে যাবার সেই শুরু। কিন্তু বুক ফাটে তো মুখ ফোটেনা। তার সম্বন্ধে অনেক কিছুই জানার থাকে, কিছুই জানতে পারেনা সে। জানাতেও পারেনা। এই রকম চলতে চলতেই শীতটা চলে গিয়ে ক্রমশঃ কাছে এসে পড়েছিল বসন্ত পঞ্চমী।
জীবনে কখনও কখনও সমাপতনও হ’য়। ক্লাস টিচার মণিকা দি ক্লাসে এক দিন বললেন, ‘ক্লাস টেনের ছেলে মেয়েদের কিন্তু পুজোয় বেশি দায়িত্ব নিতে হ’য়। তোমাদের সবাইকেই কিছু না কিছু একটা কাজের ভার নিতেই হবে এবার। মাতব্বরেরা সব সময়েই সব ব্যাপারে এগিয়ে থাকে। একেবারেই যারা অগাবগা তাদের জোর জবরদস্তি এলেবেলে করে কোথাও একটা গুঁজে দিয়ে সমীকরণ মিলিয়ে দেওয়া হ’য়। এটাই জগতের নিয়ম। এখানেই বা তার অন্যথা হবে কেন? যথারীতি গালভরা সব কমিটির দায়িত্ব গুলো বাটোয়ারা হয়ে গেল কয়েক কদম এগিয়ে থাকা বলিয়ে কইয়েদের মধ্যেই। বাকীদের এবারে এদিক ওদিক গুঁজে দেওয়ার পালা। দিদিমণিই সে সব ঠিক করে দিলেন। তার জায়গা হল চাঁদা আদায়কারীদের দলে। সেখানে মাথার ওপর আরো উঁচু ক্লাসের অশোক দা।আরও কেউ কেউ ছিলো বোধহ’য়। তবে কে আছে, না আছে, তার আর দেখার দরকার নেই — স্বপ্নের মতনই ঘটনা, স্বপ্নের সেই মনোরমা দিদি আছে দলে! ছুটির পরে কাছাকাছি যেতেই অবশ্য সেই কাজেরই কথা। কোনো এক ক্লাস ঘরের উল্লেখ করে দিদি বলল, ‘কাল টিফিনের সময় চাঁদার খাতা নিয়ে বসতে হবে’। কেজো হোক বা বাজে, কথা তো! কিছু বলা না হোক, এটাই তো প্রথম শোনা কথা। যেন বর্তে গেল সে।
তখন তো শরীরের রক্ত ফুটছে লোহা গলার উষ্ণতায়! পৃথিবীর সামান্যতম বেচালও তাকে রক্তাক্ত করে। কিন্তু বুক ফাটে তো মুখ ফোটেনা। দাঁতে দাঁত চেপে সয়ে যেতে হয়েছে অন্যায়ের পাহাড়। সহ্য করতে হয়েছে কত কি। চাঁদার আশায় সেদিন ক্লাস ঘরে সে বসেছিল একা। সামনে ছিল জাব্দা খাতা। কিন্তু টিফিন আওয়ারে ছেলেপিলেরা কানু-র বুনো কুল, হজমি গুলি, চিট গুড়, কারেন্ট অথবা সস্তার রঙচঙে আইসক্রিমে মজে গিয়ে চাঁদা মুখো আর হ’য় না। এরই এক ফাঁকে টুপুন এসে বলে গেছিল, ‘কি রে, তীর্থের কাকের মতন হা পিত্তেশ করে বসে আছিস কেন রে’! তীব্র সেই শ্লেষ আশপাশে উপস্থিত অনেক বালখিল্য বালিকার রিন্ রিনে বিদ্রুপের হাসি হয়ে পাক খেতে খেতে উঠে যাচ্ছিল তখন আকাশে। কানের মধ্যে দিয়ে যেন হঠাৎ গরম সীসার নিরবচ্ছিন্ন স্রোত বহতা নদীর মতন তির তির করে বয়ে চলল শিরা উপশিরায় অনেকক্ষণ। অপমানে মাথাটা অজান্তেই ঝুঁকে এসেছিল লাভ ক্ষতির হিসাবশূন্য জাব্দা খাতার বিলকুল সাদা পাতায়। তবে সেদিন চোখের জলে বালিশ ভেজার দিন ছিল না তার। পৃথিবী তাকে যতই একা কোরে দিক না কেন, কোনো এক অদম্য জেদ গুণগুনিয়ে শুনিয়ে যেত, ‘হবে, এক দিন কিছু না কিছু একটা হবে নিশ্চয়ই’। এই সব ছেলে ভুলোনো ছড়া গুলোর মধ্যে দিয়েই কোথা দিয়ে যে চলে যেত গোটা এক একটা সরস্বতী পুজো! কোনও দিনই তার দেখা হ’য়নি স্কুলের আলপনা। তবুও একটা জেদ ছিল, ছিল এক অহেতুক আশা কিছু একটা হবে, কোনো দিন হবে নিশ্চই! সেদিন স্বপ্নের মধ্যে দিনের আলো এতটাই প্রকট হ’য়নি যাতে বোঝা যায়, পৃথিবীর কোনও অংশেই বা কারও কাছেই তার কোনও গ্রহণযোগ্যতা নেই। নেই কোনও ভালোলাগা বা ভালোবাসার বিষয়।এই সার সত্যটা বুঝতেই যে একটা গোটা জীবন চলে যায়, জানা তো ছিল না সেটাও!
এতদিন পরে আজ সেই পুরনো স্কুলের পাশ দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎই তার চোখের কোণায় জল আসে কেন? কোনও দিনই তো তাকে কেউ দেখায়নি স্কুলের রঙিন আলপনা।এখানে তো তার বন্ধন ছিল না কখনও কোনো দিনও।তবুও? বাস্তব ছেঁচে এতটা পথ পেরিয়ে এসে আজ সে জানে এখন ব্যাঙেও তাকে কষিয়ে মারবে লাথ, ঠোক্করে ঠোক্করে অস্তিত্ব জর্জর করে দেবে নিরীহ ঘাস ফড়িং-এর দল। সেই অধিকার তাদের আছে। মেনে নিতে হবে তাকে। সাজিয়ে রাখতে হ’বে সৌজন্যের চওড়া হাসি! এটাই নিয়ম। তীব্র চড়া আলোয় এখন আর কোনও রামধনু নেই আকাশে। এখন সারাটা দিনের হেনস্থা, অপমান, ঘাত প্রতিঘাত, প্রেম অপ্রেমগুলো রাত গভীরে চোখের জলের ধারা হোয়ে নেমে ভিজিয়ে দেবে বালিশ। মাথায় তীব্র যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে দু’চোখের পাতা জুড়ে নিজস্ব নিয়মে অজান্তেই কখন নামবে প্রগাঢ় ঘুম। তারপর, আবারো ভোরের প্রথম আলোয় ঝরা সোনা ভুলিয়ে দেবে যাবতীয় সব ক্লেদ। আরেকটা নতুন দিন। সবাই দেখবে পৃথিবীর সবচেয়ে (অ)সুখী এক মানুষের হেঁটে চলে বেড়ানো জিন্দা লাশ!
মতামত ও বানানবিধি লেখকের নিজস্ব
Tags: অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়, গল্প, জিন্দা লাশ
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।