ঝন্টু মামাকে যে আপনারা চেনেন না সে ব্যাপারে আমি একশ শতাংশ নিশ্চিত। কারণ ঝন্টুমামা এমন কোন বিখ্যাত ব্যক্তি নন যে তাঁকে সব্বাই চিনে রাখবেন। আসলে আজ পর্যন্ত তাঁর কথা আপনাদের কোনদিনই বলিনি।সে যাই হোক আসুন আজ আমি তাঁর সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিই।
আজ আমি প্রায় মধ্যবয়স ছাড়িয়ে বার্ধ্যকে পৌঁছে যাওয়া এক মানুষ আর এটা আমার সেই ছোটবেলা অর্থাৎ যখন আমার বয়স ওই দশ – বারো বচ্ছর তখনকার কথা। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার পাথর প্রতিমা থানার অন্তর্গত ‘G’ প্লট যা আবার ‘বুড়ো -বুড়ির তট’ বলে সমধিক প্রসিদ্ধ সেই দ্বীপে আমাদের বেশ কয়েক বিঘে চাষের জমি ছিল। আমার বাবা যে কি কারণে বা কিসের লোভে সেই জায়গায় গিয়ে জমি কিনে ছিলেন সে গপ্প আর একদিন সবিস্তারে আপনাদের বলবোখন। আজ আর ‘ ধান ভানতে গিয়ে শিবের গীত’ নাইবা করলাম। তা সেই সে জমিতে বছরে চাষের কাজের জন্য আমাদের মেদিনীপুরের বাড়ি থেকে বাবা ও মাকে বছরে অন্ততঃ দু দুবার যেতেই হতো, একবার সেই ধান লাগানোর সময় আর একবার কাটার। আমি যেহেতু মায়ের ‘কোলচুষা’ তাই স্বাভাবিক ভাবে আমাকেও সেখানে তাঁদের সঙ্গেই যেতে হোত, ওই সুদূরে নির্বান্ধব দেশ যেখানে আবার নো কারেন্ট নো টেলিভিশন বা নট এনি আমোদ প্রমোদের কোন উপকরণ। তাই কার বা যেতে ইচ্ছে যায় বলুন সেই জায়গায়। স্বাভাবিক কথা হিসেবে আমার তো যাওয়ার ইচ্ছে জাগার কথাই নয়। কিন্তু তা নয়, আমি বরং লাফিয়ে উঠতাম প্রতিবারেই সেই লাটে যাওয়ার জন্য। তার আগে অবশ্যই মায়ের কাছে কায়দা করে জেনে নিতাম যে সেবারের চাষের কাজে কাকে কাকে মুনিষ রাখা হয়েছে। যখনই জানতাম যে ঝন্টুমামাকে কাজে রাখা হয়েছে সেদিন থেকেই ভিতরে ভিতরে অস্থির থাকতাম কবে যাবো সেই নির্বান্ধব ধ্যার ধেরে গোবিন্দপুর অর্থাৎ সেই বুড়ো-বুড়ির তটে। তাহলে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে আমার সেই শৈশবের দিনগুলির শিশু মনে ঝন্টুমামা কতখানি ছাপ ফেলেছিলেন।
ঝন্টুমামা আসলে যে আমার নিজের কোন মামা নন সেটা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার কোন দরকার পড়ে না। ঝন্টুমামা আদতে আমাদের বাড়ির মুনিষ। কিন্তু সেকালের রীতি অনুযায়ী তাদের মামা কাকা জ্যেঠা বলে সম্বোধন করা হত। আজকালকার ছেলে ছোকরাদের বললে আড়ালে মুখটিপে যে হাসাহাসি করবে আর বলবে ‘ঢঙ’ – তাতে কোন সন্দেহ নেই। তা তারা যাই খুশি বলুক তাতে আমার ভারি বয়েই গেল। আমি আমার আমলের শিষ্টাচার কেন বর্জন করব ?
চাষের কাজে মা- বাবার সঙ্গে আমার যাওয়ার আসল আগ্রহ যে ঝন্টুমামা তা আশাকরি আপানাদের বোঝাতে পেরেছি। আসলে কাজের শেষে সন্ধ্যে বেলায় ঝন্টু মামা চা তামাক খেতে খেতে যে সকল গল্প গুলো বলতেন সে গুলোকে আমি গোগ্রাসে গিলতাম।
ওই অঞ্চলটা যে তথাকথিত ‘সোন্দরবন’ আর সুন্দরবন মানেই শিশুকালে পড়া কালো হলুদের ডোরাকাটা সেই বিখ্যাত বনবিবির বাহন বা রয়েল বেঙ্গল টাইগার, কুমির, হরিণ, সাপ- খোপ আর নানান রকম জীবজন্তু আর রোমহর্ষক শিকারের গপ্প থাকবে তা কি আর বলে দিতে হবে নাকি! ঝন্টুমামা এমন ভাবে সেই গল্পগুলো বলতেন তা যেন চোখের সামনে ঘটছে বলেই মনে হোত।
সেবারে গেছি ধানকাটার চাষের সময় মা-বাবার সঙ্গে।প্রথম দুদিন ঝন্টুমামা কাজে না আসায় আমি তো মন মরা। মায়ের কাছে গিয়ে বারবার জিগ্গেস করছি – মা ও মা, ঝন্টুমামা কেন আসছে না কাজে। মা কোন কিছু একটা বলতেন,কিন্তু মায়ের উত্তরে মন কি ভরে? শেষে গিয়ে অবনীদাদু, যে আবার সম্পর্কে ঝন্টুমামার কাকা তাঁকে জিগ্গেস করায় জানলাম যে ঝন্টুমামা নাকি হরিণ শিকারে গেছে।যদিও হরিণ শিকার বেআইনি, তবুও ওই অঞ্চলের লোকেরা সব্বাই বনরক্ষীদের ফাঁকি দিয়ে প্রায়ই তখন শিকারে যেত এবং তাদের শিকার করে আনা হরিণের মাংস বেশ কয়েক বার আমি খেয়েছি। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি,সেই মাংস খেতে আমার এমন কিছু সুস্বাদু বলে মনে হয়নি। বরং শিকার করে তা আনতে বেশ কিছুটা সময় অতিবাহিত হওয়ায় কারণে মাংসের কেমন একটা টক টক স্বাদ লাগত আমার কাছে। তথাপি কেন যে মানুষ এই মাংসকে দেহ শুদ্ধকারী মাংস বলে অবিহিত করে সে প্রশ্নের উত্তর আজও আমি খুঁজে পাই নি। আপনাদের যদি কারুর জানা থাকে তবে তা আমায় জানাতে ভুলবেন না কিন্তু।
সেই চাষ বাড়িতে যাওয়ার চতুর্থদিনে যথারীতি দুপুরে খেতে বসেছি, দেখি মাংস ভাত। তখনই বুঝে গেলাম যে ঝন্টুমামা শিকার থেকে ফিরে এসেছেন।পরের দিনই যে ঝন্টু মামা কাজে আসবেন সে ব্যাপারে আন্দাজ করলাম, কিন্তু সন্ধ্যে বেলায় ঝন্টু মামাকে না দেখতে পেয়ে অবনীদাদুকে জিগ্গেস করে জানলাম যে ঝন্টুমামা পাশের দ্বীপ L প্লটে তার বোনের বাড়িতে মাংস দিতে গিয়েছেন এবং সন্ধ্যেয় বাড়ি ফিরে আসবেন। আগামীকাল থেকে ঝন্টুমামা অবশ্যই কাজে আসবেন।
পরেরদিন সন্ধ্যাবেলায় ঝন্টুমামাকে দেখে আমি কি আর তাঁর পেছন ছাড়ি! শুধুই ঘুর ঘুর আর ঘ্যানর ঘ্যানর করতে লাগলাম গপ্প বলার জন্য।শেষমেশ চা খেতে বসেছেন ঝন্টুমামা আর আমি ঠিক তার পাশটিতে। মামা তাঁর সদ্য ফেরা শিকারের গল্প শুরু করলেন।
এবারে দলে ছিল মোট আটজন লোক আর ছয়গাছা বন্দুক। আমি সঙ্গে সঙ্গে বলি -মামা গাছা বন্দুক আবার কি ? রিভেলভার শুনেছি,গাদা বন্দুক শুনেছি গাছা বন্দুক তো কই শুনিনি কোনদিন।
আরে বুদ্ধু এখানে গাছা বলতে এক একটা বলা হয়।যেমন চারটে বন্দুককে চারগাছা বন্দুক, পাঁচটাকে পাঁচ গাছা বন্দুক বলাই রেওয়াজ।
তা সেই আটজন লোক, ছয়গাছা বন্দুক আর চার -পাঁচ দিনের জল ও খাবারদাবার নিয়ে নৌকা করে কলস দ্বীপে গিয়ে নামলাম।গতবারে শিকারে গিয়েই পশুরা যে পথ দিয়ে পুকুরে জল খেতে যায় তার পাশে একটা ভারা গাছকে চিহ্নিত করে এসেছিলাম। আমি সঙ্গে সঙ্গে বলি, ভারাগাছ? সেটা আবার কি গাছ মামা?
মামা বল্লেন – কেয়াগাছ চিনিস?
আমি বললাম- হাঁ হাঁ। ওই যে গাছের ঠেস মূল থাকে, যে গাছের ফুল সাদা সাদা আর পাতা করাতের মতো তাইতো?
ভারাগাছ হল সেই রকমেরই এক ধরনের জঙ্গলের গাছ। এই গাছের বৈশিষ্ট্য হল এর কাণ্ড বা গাছের গুঁড়ি মাটি থেকে খাড়াই উঠে যায় প্রায় পনের-কুড়ি ফুট আর প্রায় দশ – বার ফুট উপর থেকে কেয়াগাছের মতো ঠেসমূল গুলো বেরিয়ে গাছের গোড়া থেকে প্রায় ছ-সাত ফুট দূরে গোল করে পাঁচ-ছ ইঞ্চি ছাড়া ছাড়া মাটিতে শক্ত ভাবে ঢুকে গিয়ে একটা চক্রাকার নিরপত্তা বলয় তৈরি করে।শিকড়গুলো ও বেশ শক্ত আর বেশ মজবুত ।
এবারে গিয়ে প্রথমেই সেই ভারাগাছে একজন উঠে উপর দিয়ে এক -দুটা শিকড় কেটে দড়ির মই দিয়ে নিচে নেমে, নিয়ে যাওয়া খড় আর চট বস্তা পেতে বসার জায়গা তৈরি করল। তারপর আমরা সব্বাই উপরে চড়ে সব রসদ বন্দুক নিয়ে দড়ির মই বেয়ে নিচে নেমে শিকারের আশায় জাঁকিয়ে বসলাম।এই সময় কথাবার্তা বলা বা পান -বিড়ি সিগ্রেট খাওয়া একেবারেই বন্ধ।
আমি বলে উঠলাম – কেন কেন কেন ?
আরে বোকা জঙ্গলের জীবজন্তুদের ঘ্রাণশক্তি প্রবল তা কি তুই জানিস নে ?
জানি জানি –
তবে ? ওই সবের গন্ধ পেলে তারা আমাদের উপস্থিতি টের পেলে আর কি আসবে ?
আমি মাথা হেঁট করে বলি – তারপর ?
-তারপর এভাবে আনুমানিক দু – তিন ঘন্টা বসে। হঠাৎ জহিরূল ইশারায় সব্বাইকে বন্দুকের ট্রিগারে আঙুল রেখে সতর্ক হয়ে বসতে বললে।তার কথা যে সত্যি তা অচিরেই টের পেলাম। দেখলাম এক দঙ্গল হরিণ নাচতে নাচতে সেই পথ দিয়ে জল খেতে আসছে। চোখে চোখে কথা বলে আমি, জহিরুল, কদম আর আনসার একটা বড় দেখে সিঙ্গারকে তাক করে ট্রিগার টানলাম। আমি বললাম – চারজনে মিলে একটাকে কেন মামা?
মামা বললেন – চুপ করে শোন না। তখন থেকেই শুধুই বকরবকর করছিস। শুনলেই বুঝতে পারবি।
যাক আমার আর জহিরুলের গুলি টার্গেটে লাগল আর সিঙ্গারটা লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। গুলির শব্দে বাকি সব ছত্রভঙ্গ, নিমেষে কে কোনদিকে উধাও হল কে জানে।
আমি ব্যগ্র ভাবে বললাম – তারপর ?
তারপরই তো আসল গপ্প !
আমি বললাম – আসল গপ্প! মানে ?
ঝন্টুমামা বললেন – গুলি চালানোর সঙ্গে সঙ্গে কোনদিনই শিকার কে তুলে আনতে যেতে নেই।পনের- কুড়ি মিনিট অপেক্ষা করতে হয় ।
আমি আবার বললাম- কেন কেন ? প্রতীক্ষা করতে হয় কেন ?
মামা বিরক্ত হয়ে বললেন – আঃ চুপ করে শোন না। দেখলাম কি মিনিট চার -পাঁচ পরেই ইয়া বড় এক বনবিবির বাহন এসে হাজির সেখানে। প্রথমে তো সিঙ্গারটাকে দেখে তার কি আনন্দ ! সামনের পা দুটো দিয়ে পড়ে থাকা হরিণটাকে যেন হাত বুলিয়ে আদর করছে মনে হল।
তারপর তার গোঁফ নাচিয়ে পেছন নাচিয়ে কি তার আনন্দ প্রকাশ তা যদি কেউ দেখতে ! কিন্তু একটু পরেই সে নাচ থামিয়ে আমাদের গাছের দিকে তাকালে। আসলে এতক্ষণে ভগবানের শ্রেষ্ঠ জীবের গায়ের গন্ধ তার নাকে পৌঁছে গেছে। তার সেই হাড়হিম করা দৃষ্টি যদি কেউ হার্টের রুগী দেখত তার যে তত্ক্ষণাৎ হার্ট অ্যাটাক করে পরলোকের পথে পাড়ি দিতে হত তা নিশ্চিত।
যাই হোক সেই মূর্তিমান প্রলয়ংকর শয়তান তখন ধীর পদক্ষেপে রাজসিক চালে আমাদের দিকে আসতে লাগল। আমরা সব্বাই এক্কেবারে চুপচাপ গাছের গুঁড়ির সঙ্গে লেপ্টে গেলাম। তিনি তো এলেন। শিকড়ের বাধা থাকায় গোল হয়ে গাছের চারিদিকে ঘুরতে লাগল আর মাঝে মাঝে শিকড়ের ফাঁক দিয়ে থাবা বাড়িয়ে আমাদের ধরবার নিষ্ফল প্রয়াস চালিয়ে যেতে লাগল। কথায় বলে বাঘের দেখা পেলে তার হাত থেকে নিস্তার পায় না। সেই বাঘ রেগে অস্থির।শিকারকে সে দেখতে পারছে অথচ কিছুই করতে পারছে না। রাগে সে সেই শিকড়গুলোকেই কামড়াতে লাগল। এভাবে প্রায় আধ ঘন্টা কেটে গেল ।
আমি থাকতে না পেরে বললাম – তারপর ।
তারপর আর কি।কিছুতেই যাচ্ছেনা দেখে আমরা বাধ্য হয়ে গুলি চালালাম।
সেকি ! তোমরা বাঘটাকেই মেরে ফেললে? জানো না বাঘ বিরলপ্রায় প্রাণী ?
না না। বাঘটাকে গুলি করিনি। আমরা ফাঁকা গুলির আওয়াজ করলাম আর সেই গুলির আওয়াজেই বাঘ বাবাজি পালিয়ে গেল৷
আমি বললাম – মামা মামা! তুমি জঙ্গলে শিকারে গিয়ে কোনদিন জ্যান্ত বাঘের বাচ্চা এক – দুটো পেলে আমার জন্যে …।।।
কেন রে? পুষবি নাকি ?
আমি মাথা চুলকাতে লাগলাম।
মতামত ও বানানবিধি লেখকের নিজস্ব
Tags: গল্প, ঝন্টু মামা ও তাঁর শিকারের গল্প, পীযূষ কান্তি দাস
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।