13 Apr

বয়েলিং ফ্রগ

লিখেছেন:দেবাশিস সাহা


বয়েলিং ফ্রগ দেবাশিস সাহা

।।১।।

দিনটা ২২-শে মার্চ, ২০২০, রাত তখন আড়াইটে। অর্ণবের ফোনটা বেজে উঠল।

হ্যাঁ অঞ্জন বল।

তুই জেগে ছিলিস?

প্রতিবার তোকে মিডনাইটে উইশ করি। দু’ঘণ্টাও যায় না, সেই তোরই ফোন চলে আসে। হ্যাবিট হয়ে গেছে। বল, এবারের স্টোরি কী?

স্টোরি? আমার কথাগুলো তোর বানানো গপ্প মনে হয়? আচ্ছা রাখ তাহলে!

এই না না ! সরি সরি, বল। উম, আই মিন, পাঠা টেক্সট টা। এবার আবার কি এসেছে দেখি। সকালে আসছি তোর বাড়ি। ঘাবড়াস না। গুডনাইট।

গুডনাইট ভাই!

।।২।।

তুমি সিওর তুমি আবার ওই ডিভাইস ইউস করবে?

জেফারসনের কথায় কান না দিয়ে নিঃশব্দে নিজের কাজ করে যেতে লাগল অজিত। নিঃশব্দে কারন সেল – এর সারভেইলেন্স সিস্টেমে বছরের এই সময়টা দু’-তিন ঘণ্টা ডাউনটাইম থাকে। হয়তো অজিতের জীবনে দেখা শেষ ডাউনটাইম। জেফারসন, তার সহবন্দি আবারো বলে উঠল –

দেখ অজিত, লাস্ট দু’বার অন হিউম্যানিটারিয়ান গ্রাউন্ডস তোমাকে ছাড় দেওয়া হয়েছে। এবারে কিন্তু তোমাকে অবশ্যই ফ্লোট করে দেওয়া হবে। তুমি চাইছ কি? এই টেক্সট গুলো তোমার-আমার, আমাদের সবার অতীতকে বদলাতে পারবে? যে কোনো মুহূর্তে সাইবটস চলে আসবে।

জেফারসন, অসংখ্য সম্ভাবনা অসংখ্য বাস্তবিকতার জন্ম দেয়। তোমারই পেপার ছিল তুমি ভুললে কি করে?

হ্যা, আর সেজন্যেই আমি এখন এই অরবিটাল সেল – এ সাজা কাটছি, এই শূন্যে, কংক্রিটের খাঁচায়, আমার বাড়ি, আমার শহর, আমার পরিবার থেকে ত্রিশ হাজার কিলোমিটার দূর! জানিও না তারা কেমন আছে। তুমিও এক ভুল করো, আমি চাই না।

ভুল না জেফারসন। ভুল না – বলে নিজের কানে লাগানো ট্রান্সলেটারের বাটনটা অফ করে দিল অজিত।

টেক রেস্ট বাডি! – বলে রেকর্ডারটা অন করল।

“হাই অঞ্জন! হ্যাপি বার্থ ডে! আমি তোমার নাম, টাইমলাইন আর ব্লাডলাইন ছাড়া অন্য কিছু তো এই ডিভাইসে ট্র্যাক করতে পারি নি, তবে এটুকু আমার মন বলে যে তুমি প্রতিবছর আমার কথা শোনো বা পড়ো, তখনকার পৃথিবীর প্রযুক্তি ঠিক কতটা আমার কথা গুলো তোমার কাছে পৌঁছে দিতে পারবে তা জানিনা,  কিন্তু এটা আমার বিশ্বাস যে আমার গ্র্যান্ডপা কিছু না কিছু তো ফিগার আউট করেই নেবে আমার কথাগুলো শুনবার আর বুঝবার জন্য।

আজ আমি ফ্লোট হব। হ্যাঁ জেফারসন ঠিকই বলছে আজই আমার মহাশূন্যে মিলিয়ে যাবার দিন। তাই কিছু না বলা কথা তোমাকে বলে যাওয়া দরকার।”

কিন্তু কথা শেষ হল না। সেলের দরজা খুলে গেল, আলো-আঁধারি ভেদ করে দুটো সাদা স্ফটিকের মত চোখ অজিতের সামনে আসতে লাগল। ধাতব হাতে শকওয়েভারটা উঁচিয়ে এগিয়ে এল সে। জেফারসন চেঁচিয়ে উঠল – অজিত! কেয়ারফুল! সাইবটস!

কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। অজিতের চেতনাহীন দেহটা নিয়ে দুটি লৌহ কলেবর যেমন নিঃশব্দে এসেছিল, তেমনই নিঃশব্দে চলেও গেল।

।। ৩।।

অজিতের চোখ খুলল যখন, সে দেখল একটা বড় হলঘরের একদিকে সে বসে রয়েছে। ঘরের অন্য প্রান্তে রুপোলী পোশাকে তিন-চার জন মানুষকে যেন দেখল সে। অবশ্য এত দূর থেকে মানুষ কিনা বোঝাও দুস্কর, সারা গ্রহ যখন অধিকাংশই প্রাণহীন, নির্বোধ, কৃত্রিম বুদ্ধিজীবীদের আওতায়। তাদের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠল –

অজিত সেন। সিরিয়াল নম্বর সেভেন থ্রি ওয়ান টু, সেল টু ফোর এইট জিরো, ক্রাইম ‘থ্রেট অফ এ. আই. ইভোলিউশন থিসিস পাবলিশড ইন দ্য ইয়ার টোয়েণ্টি সেভেনটি ফাইভ’, তুমি কোড অফ অরবিটাল এ. আই. কনডাক্ট ২৭২ – ইল্লিগাল কমিউনিকেশন টু পাস্ট টাইমলাইন – ভায়োলেট করেছ! তুমি কি নিজের হয়ে কিছু বলতে চাও?

যেখানে আইনের নামে কিছু যন্ত্রের অস্তিত্ব রক্ষার প্রোটকলকে চালানো হয়, যেখানে মানুষ হয়ে নিজের আপনজনের সাথে যোগাযোগ করা অপরাধ হিসেবে গন্য হয়, সেখানে নতুন করে আমার আর কিই বা বলার থাকতে পারে মাই লর্ড?

কুড ইউ প্লিস ইলাবোরেট মিঃ সেন?

কিছুক্ষন দম নিয়ে অজিত বললো –

তবে শুনুন, হ্যাঁ আমি অপরাধী! আমি সেদিন থেকে অপরাধী যেদিন থেকে মানুষ নিজেকে যন্ত্রে ও যন্ত্রকে মানুষে রুপান্তর করার পরিকল্পনা করেছে। যেদিন থেকে ডিজিটাইজেশানের নামে অনলাইন শিক্ষা, অনলাইন বাজার আর অনলাইন সমাজের আড়ালে মানুষকে একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া, সামাজিকভাবে সিধান্ত গ্রহনের ক্ষমতাকে বিলুপ্ত করে দেওয়া, মানুষের ইছা-অনিচ্ছা, সহমর্মিতা, ভালোবাসা – সমস্ত অনুভুতিকে ট্র্যাক করে নিজের ইচ্ছেমতো চালনা করা – এই সবকিছুর একটা বিরাট চক্রান্ত রচনা হয়েছে। যেদিন থেকে মানুষের ভবিষ্যতের রুটি-রুজিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাত্রাহীন প্রয়োগে ছিনিয়ে নেওয়ার চক্রান্ত হয়েছে। যেদিন থেকে প্রকৃতি ম্যান মেড গ্লোবাল ওয়ারমিং, ডিফরেস্টেশন আর সমাজ সিভিল ওয়ার, কার্ণিভোরাস অ্যাপোক্যালিপ্স থেকে শুরু করে চূড়ান্ত ডিসটোপিয়া অবধি আর সবশেষে এ. আই. ও কর্পোরেট স্টেট শাসনের এক চক্রান্তের শিকার হয়েছে।

কিছুক্ষণ আবারো এক নিস্প্রান নীরবতা। হলঘরের ঘড়ির টিক টিক শব্দ যেন বর্তমান ও ভবিষ্যতের কাছে অতীতের বিচারের প্রহর গুনছে। তারপর –

অলরাইট দেন। তাহলে তুমি নিজেই স্বীকার করছ তুমি অপরাধী?

ইয়েস স্যার। যন্ত্রের দুনিয়ার “সারভাইভাল অফ দি ফিটেস্ট” এর খেলায় তো বটেই!

রুপোলী পোশাকের ছায়ামূর্তিটি কয়েক মুহূর্ত নিঃশব্দ হয়ে রইল। তারপর তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কাউকে আদেশ দিল –

টেক হিম টু দ্য আইসোলেশন চেম্বার অ্যান্ড ফ্লোট হিম অ্যাট ফিফটিন হ্যান্ড্রেড আওয়ার্স ডট।

নিমেষে আবার সেই শকওয়েভ। সব অন্ধকার।

।। ৪ ।।

চেতনা ফিরতেই আইসোলেশন সেলের ঘড়িতে অজিত দেখল তার হাতে সময় বেঁচে রয়েছে আর মাত্র পনেরো মিনিট। মোজার ভিতর লুকিয়ে রাখা ভয়েস ট্রান্সফরমার চিপ টা পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের আন্দাজে স্টার্ট দিল, তারপর বলতে লাগল সে –

“ইতিহাস বইতে পরেছিলাম ২০২০ এর প্যানডেমিকের ব্যাপারে। পৃথিবীতে যে কত বড় বিপদ নেমে এসেছিল, ভেবে কষ্ট হয়। কিন্তু অঞ্জন, সেই কষ্ট আজকের পৃথিবীবাসীর কষ্টের তুলনায় নগন্য। মানুষের হাতে মানুষের সাময়িক লকডাউন যন্ত্রের হাতে আমৃত্যু লকডাউনের চেয়ে ঢের ভালো হয়তো।“ কিছুক্ষন শ্বাস নিয়ে অজিত আবার বলতে শুরু করলো –

“কোভিড ১৯, সহস্র আসন্ন বিপদের একটা ছোট্ট সূচনামাত্র, অঞ্জন!

একটা ভিডিও কলে উৎসব পালন করছ? হাতে-হাত মিলিয়ে, গলা মিলিয়ে আলিঙ্গন করছ কই? একই শহরে থেকেও টেক্সট করে শুভেচ্ছা জানাচ্ছ? তার কাছে গিয়ে তার খবর জানতে চাইছ কই? মনের বেদনা ভাগ করার ফুরসত নেই তাই স্ট্রেস-ইটিং, ড্রিংকিং, পার্টি, ক্লাব আর অনলাইন জুয়া? কোনো আপনজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছ কই? অনলাইন গেম, ভারচুয়াল রিয়েলিটির আসক্তির দাসত্ব করছ? খোলা আকাশের নীচে সবুজ ঘাসে ফুটবল নিয়ে ছুটছ কই? আমাদের জন্য অনেক দেরি হয়ে গেছে! তোমাদের এখনও সময় আছে। ডোন্ট বি এ বয়েলিং ফ্রগ!

আমরা জন্মেছি যখন দেশ বলে কিছু না থাকলেও ভিনগ্রহে বসতি আছে, যখন নিজের পরিবার বলে কিছু না থাকলেও বিশ্ব নাকি একটি গ্রাম, যখন সোনার আভুষণে নিজেকে মুড়ে রাখলেও ভিতর থেকে তুমি প্রযুক্তির কাছে নগ্ন ভিখিরি মাত্র, যখন মানুষ খুঁজে পেলেও মনুষ্যত্ব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আর যখন মৃত্যুর ঠিক আগে একটু চোখের জল ফেলতে চাইলেও সে জল চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসতে পারবে না।

এখনও সময় আছে। ডোন্ট বি এ বয়েলিং ফ্রগ!”

বলামাত্রই একটি প্রাণহীন হাত আইসোলেশান চেম্বারের ‘ইজেক্ট’ বাটনটা টিপে দিল। বিশ হাজার কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টার বেগে আরও একটি প্রান মহাশূন্যে বিলীন হয়ে গেল।

।। ৫।।

সকালবেলা ঝড়ের বেগে দৌড়ে অঞ্জনের বাড়ি ঢুকল অর্ণব। অঞ্জন তখনও বিছানায় বসে গালে হাত দিয়ে একদৃষ্টে পড়ে চলেছে বোল্ড হরফে লেখা শেষ শব্দগুলো – “ডোন্ট বি এ বয়েলিং ফ্রগ!”

………………………

(‘বয়েলিং ফ্রগ’ বা ‘ফুটন্ত ব্যাঙ’ সিন্ড্রোমের সারমর্ম হল যে যখন আমাদের জীবনযাত্রার অবস্থা ধীরে ধীরে খারাপ হতে থাকে, তখন আমরা এগুলি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার পরিবর্তে এই অবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে নিই, যতক্ষণ না আমরা আর পালানোর মতো শক্তিশালী না থাকি।)/ লেখক  (সুত্রঃ গুগল)

মতামত ও বানানবিধি লেখকের নিজস্ব 

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ