08 Jun

অন্য রূপকথা

লিখেছেন:অভিষেক ঘোষ


অন্য রূপকথা   অভিষেক ঘোষ

(১)

তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে স্বরূপকুমার চলেছেন নীল ঝিলের কোলে ফিসফিসানির বনে। সে বড়ো অদ্ভুত বন, সেখানে কারা যেন কথা কয় সর্বক্ষণ! মনে হয় কে যেন হঠাৎ নাম ধরে ডাকে, অথচ ফিরে তাকাও, দেখবে না কাউকে। তেমনি আশ্চর্য ওই নীল ঝিল, কত যে গভীর কেউ জানে না! শোনা যায় সেই ঝিলের কোথাও কোথাও নাকি দেখা গেছে তাজ্জব এক প্রাণীকে। সে যখন ভেসে ওঠে, তার বহুক্ষণ আগে থেকে ঝিলের নীল জল একজায়গায় পাক খেতে থাকে। তারপর সে আচমকা ভেসে ওঠে – পেল্লায় নীলচে রঙ্, পেটের কাছটা মসৃণ উজ্জ্বল, যেন ভিতরে আলো জ্বলছে। তার দেহে কোথাও কোথাও রয়েছে মাছেদের মতো আঁশ, মাথায় চোখের উপর ছোট্ট দুটো শিং, আর রয়েছে লকলকে এক লম্বা জিভ আর ইয়াব্বড়ো সব দাঁত-নখ। স্থানীয় প্রজারা নাম দিয়েছে, মায়াড্রাগন – তার নিঃশ্বাসে নাকি বিষ! যে বনে সর্বদা ফিসফিস্, সেইখানে আঁধার রাতে ঘুরে বেড়ায় সে – জলের মাছ আর ডাঙার প্রাণী, দুইই তার খাবার।

কিন্তু এমন ভয়ংকর বনে স্বরূপকুমার কী করছেন? আসলে রাজপুত্র স্বরূপকুমার দুঃসাহসিক অভিযানে যেতে বেজায় ভালোবাসেন। তাঁর পিতা স্বপনকুমার এখনও ষাট পেরোন নি, নিরোগ দেহ তাঁর, তাই তিনি এখনও বহুদিন রাজ্য শাসন করবেন এমনটা ধরে নেওয়াই যায়। পিতা সুস্থ দেহে বর্তমান থাকায় রাজকুমারের উপর তাই এখনও কোনো দায়ভার চাপে নি, তবে দু-দুবার রাজ্যের দুই প্রান্তে বিদ্রোহ দমনে গিয়ে তিনি নিজ-বীরত্বের প্রমাণ রেখেছেন। এছাড়া তাঁর বহু বিচিত্র অভিযানের মধ্যে অন্যতম স্মরণীয় জাদুকরী বিম্ববতীর প্রাসাদে গিয়ে, তাকেই পরাজিত করা। সে বার সেই প্রাসাদ থেকে তিনি মোটেও খালি হাতে ফেরেননি। তিনি নিয়ে এসেছিলেন, ছায়া-তরবারি! তা নেহাৎ যা-তা জিনিস নয় – ও জিনিস ব্যবহার করাও খুব শক্ত। কেবল সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের সময় যে তেরছা হলদেটে-লাল আলো, তাতেই কেবল ওই তরবারি চালানো সম্ভব – অবশ্য চালাবার হাত খুব পাকা হতে হবে। জ্যোৎস্না রাতেও অবশ্য কাজ করে সেই অলৌকিক ছায়া-তরবারি, তবে সেক্ষেত্রে চাঁদের আলোখানা তেরছা না হলেই নয়!

রাজকুমারের স্বভাবের কথা এতক্ষণ বলা হয় নি! স্বভাবে তিনি বড়ো একরোখা, নেশা তাঁর ওই একটাই… দুঃসাহসিক অভিযান। শরীরে গরম রক্ত ছলাৎছল, যেন কীসে তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় অনর্গল – কোনো কিছুতেই শান্তি পান না তিনি! এক অভিযান থেকে অন্য অভিযানে তাই ব্যস্ত রাখেন নিজেকে, তাতেই জ্বালা – তাতেই শান্তি। আর এভাবে দেশ দুনিয়ার হেথায়-হোথায় ঘুরে ঘুরে তাঁর দেহের রঙ্ হয়েছে তামাটে, চুলগুলি গেছে জট পাকিয়ে, নখগুলো হয়েছে বড়ো বড়ো, পোশাক হয়েছে মলিন, অযত্নের ছাপ শরীরের সবখানে। তবুও তিনি চলেছেন, মনপবনের নাও তাঁকে নিয়ে চলেছে কোন সুদূরে! দু-হাতে দাঁড়দুটি ধরে, পাল টাঙিয়ে শুধু অপেক্ষা… কারণ এ নৌকা আপনা থেকেই চলে! দু-ধারে সরিষার ক্ষেত সরে সরে যায়… হাওয়া বয় শনশন্! স্বরূপকুমার চলেন অভিযানে।

এভাবেই সাড়ে এগারো দিন পর তাঁর খাবার যখন প্রায় শেষ, রুপোলি জলের আহ্লাদী নদীতে ভেসে ভেসে তিনিও ক্লান্ত, ঠিক সেই সময় নৌকা সহসা খেল ঘুরপাক আর নিজেকে সামলে নিয়ে সামনে অগাধ নীল জলরাশির দিকে চেয়ে রাজকুমারও হলেন হতবাক।

নদী কখন গিয়ে মিশেছে নীল ঝিলের জলে! তার মানে ঝিলের চার দিকে মোটেও স্থলভাগ নেই! কিন্তু কী আশ্চর্য, একটিবার পিছন ফিরতেই রাজকুমার দেখেন নদী উধাও। ঝিলের চারিপাশে ঘন বাঁশবন আর সেই বনে কেবল ফিসফিস্ শব্দ! তিনি মনপবন থেকে নামতেই দেখেন, হাঁটুজল। ওদিকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামল বলে। এখন উপায়?

বাঁশবনে ঢুকে কিছু শুকনো ডাল-পাতা জড়ো করে তিনি সাবধানে আগুন জ্বালালেন চকমকি ঠুকে। চারদিকে এত পাতা পড়ে আছে যে চাইলেই চমৎকার এক পাতার বিছানা বানিয়ে নিয়ে, দিব্যি সুন্দর ঘুমিয়ে নেওয়া যায়। তাতে দেহের ক্লান্তিও দূর হয়। কিন্তু ভাবনাও আছে… যদি ড্রাগন উঠে আসে ঝিলের ওই ঘন নীল জল থেকে! একথা ভেবেই রাজকুমারের বুকের মধ্যেটা কেমন ছমছম্ করে ওঠে একেক সময়। যেন একটা গভীর চক্রান্ত চলছে ঝিলের চারপাশ ওই ঘন বন জুড়ে – কীসের, কে জানে!

রাজকুমার বরাবর রাজ্যে তাঁর পিতার ছায়ায় থেকেছেন। তিনি যতই যাই করুন না কেন, যত যুদ্ধেই জিতুন, কিছুতেই যেন পিতার অতীত কীর্তির পর্বত প্রমাণ ছায়া থেকে তিনি বেরোতে পারেন না। রাজধানীতে সকলেই বলে স্বপনকুমারের মতো রাজা হয় না। তাই রাজকুমার নিজেকে খুঁজে ফেরেন – পিতার মতো নয়, তিনি অন্যরকম হতে চান, অন্য কেউ। ওই সিংহাসনেও তাঁর লোভ নেই, কিন্তু তাঁর যে ঠিক কী চাই, আজ পর্যন্ত সেটাই তিনি বুঝে উঠতে পারেন নি! এসবই ভাবতে ভাবতে যেই দুই চোখে মৃদু তন্দ্রাভাব এসেছে, অমনি এক বিকট শব্দ। ঝিলের জলে তখন তোলপাড় চলেছে। একটা বিরাট নীল মাথা আধো অন্ধকারে উঁকি দিয়েছে যেন! এত অন্ধকার কেন! সূর্যাস্ত কি তবে হয়ে গেল? রাজকুমার ভালো করে তাকিয়ে দেখেন, আকাশে আলো প্রায় নিভে এসেছে আর চারপাশ থেকে বনের গাছগুলি যেন একে একে এগিয়ে এসে ঘিরে ধরতে চাইছে তাঁকে। তার মানে ছায়া-তরবারি এখন অকেজো, কৃত্রিম আলোয় কোনো জাদুই দেখাতে পারে না এই বিদঘুটে তরবারি। রাজকুমার মনে মনে প্রস্তুত হলেন এক অসম যুদ্ধের জন্য – মায়াবী ড্রাগন বনাম একা – তিনি।

কিন্তু অমন এক অতিকায় জানোয়ার যে অত দ্রুত পেল্লায় শরীরখানা জল থেকে প্রায় উড়িয়ে নিয়ে আসতে পারবে, কে ভেবেছিল! রাজকুমারের বুকে বর্ম আঁটা শেষ হতে না হতেই, সামনে এসে দাঁড়ায় চারপেয়ে বিশাল সেই প্রাণী – মায়াড্রাগন। কোমর থেকে নিজস্ব ইস্পাতের তরবারিটা টেনে নিয়ে প্রস্তুত হন রাজকুমার। সতর্ক দৃঢ়তা ছড়িয়ে পড়ে তাঁর গোটা শরীরে। কিন্তু প্রায়ান্ধকারে ড্রাগনের বুকে ততক্ষণে নীল আলোর ঢেউ উঠেছে – ধকধক্ করে যেন উজ্জ্বল একটা নীল আলোর তরঙ্গ পেট থেকে ঠেলে উঠে, বেরিয়ে আসতে চাইছে গলা দিয়ে। রাজকুমারের পা কেঁপে যায় আর ড্রাগনের বিশাল মুখখানাও ঠিক তখনই খুলে যায়। নীল রঙের একটা ঠান্ডা আর ভিজে বাতাসের ঢেউ তাঁর শরীর স্পর্শ করে। কিন্তু এ কী! কোনো দহন তো নেই! বরং একটা অকারণ পুলক ঘিরে ফেলে তাঁকে, তৃপ্তিতে চোখ বন্ধ হয়ে আসে! তারপর বহুক্ষণ পর তিনি চোখ খোলেন। অবাক হয়ে দেখেন, কোথায় সেই বন আর কোথায়-ই বা ড্রাগন! তিনি তাঁর নৌকাখানায় চিকচিকে হলুদ বালির জমিতে কোন্ বিদেশ বিভুঁইয়ে পৌঁছে গেছেন! অল্প দূরে দুই-মানুষ সমান উঁচু একটা ঝকঝকে আয়না খাঁড়া দাঁড়িয়ে আছে, তাতে পরিষ্কার তিনি নিজেকে দেখতে পাচ্ছেন। ইস্ কী অবস্থা হয়েছে তাঁর! রাজার ছেলের এমন কর্কশ ত্বক, দেখতে দেখতে আর ভাবতে ভাবতে আয়নাটার দিকে এগিয়ে যান তিনি। ওপারে কী আছে জানার জন্য মুখ বাড়াতেই তিনি অবাক। আরেকখানা আয়না কোনাকুনি দাঁড়িয়ে। এবারে সেটি পেরোতেই আরো একখানা, তারপর আরো একখানা। এ তো ভারি আশ্চর্যের! এত দেশ দেখলেন, এমন কখনও দেখেন নি! তাও এমন নির্জন মরুভূমিতে। সোজা কথায়, চারখানা পেল্লায় কাচে জোড়া লাগিয়ে বানানো একটা বিরাট চৌকো খোপ, যেন একটা কাচের বাড়ি। কিন্তু ওই কাচের দেওয়ালের মাথায় কী আছে, বন্ধ না খোলা, ছাত আছে কি নেই, তা বোঝা যাচ্ছে না। চরম বিস্ময় আর অদ্ভুত কৌতূহলে রাজকুমার উঁকিঝুঁকি মারেন। কিন্তু বারংবার নিজেরই প্রতিবিম্ব দেখে লজ্জিত আর বিব্রত হন। হতাশ হয়ে একসময় বসে পড়েন। তাহলে উপায়! এদিকে পেটও যে খিদেয় জ্বলছে। কিন্তু প্রশ্ন হল এখানে খাওয়া জুটবে কোথায়?

(২)

অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে অধৈর্য হয়ে অবশেষে স্বরূপকুমার উঠে পড়লেন। তাঁকে জানতেই হবে ওই আয়নাবাড়ির রহস্য। অন্য কিছু খুঁজে না পেয়ে তিনি গেলেন মনপবনের নাওখানির কাছে। মনপবনের নাও ইচ্ছাশক্তির জোরে চলে। ইচ্ছের জোর যত, নৌকার গতিও ততই – তার জন্য মুখে কিছুই বলতে হয় না, মনে মনে কেবল নিজের গন্তব্যের কথা ভাবলেই হয়, অবশ্য গন্তব্য সম্পর্কে মনে মনে নিশ্চিত হতে হবে। তবে অনেকেই জানে না, মনপবনের নাও একবার মাত্র তার প্রভুর ইচ্ছাপূরণের ক্ষমতা রাখে। কিন্তু ওই একবারই, একবারটি তার কাছে মুখ ফুটে কিছু চেয়ে ফেললে পরে আর কিন্তু কোনো মতেই নৌকাটি চলবে না। কিন্তু নিরুপায় রাজকুমার সেই ঝুঁকি নিয়েই মনপবনের নাও-এর কাছে হাঁটু পেতে বসে মাথা ঝুঁকিয়ে অনুনয়ের সুরে বলেন –

“করেছ কত উপকার মনে মনে জানি,

শেষ একটি ইচ্ছা পূরণ করো নাওখানি।

সুমুখে ওই যে আয়নাবাড়ি ওরই মধ্যে যাবো,

মনে বড়ো কৌতূহল, কী দেখিতে পাবো!”

কথা ফুরোতে না ফুরোতেই বালির জমি সহসা ফুলে উঠল আর মুহূর্তের মধ্যে তা উঁচু হয়ে আয়নাবাড়ির উঁচু কাচের দেওয়ালের মাথা ছুঁল। তখন রাজকুমারের মনে আফসোসের সীমা নেই। তিনি নিজেই এই কাজটি করতে পারতেন একটু চেষ্টা করলে, একটু বুদ্ধি খাটিয়ে চারিপাশের বালি এক জায়গায় জড়ো করে উঁচু করে তুললেই তাঁর কাজ হয়ে যেত – মিথ্যে মিথ্যে মনপবনের নাও-এর সবটুকু শক্তি খরচ করে ফেললেন। এরপর বালির টিলার শিখরে দাঁড়িয়ে তিনি দেখলেন, আয়নাবাড়ির ছাত বলে কিছুই নেই – চার দেওয়ালের মধ্যিখানে ফাঁকা চৌকো জায়গাটা তখন যেন তাঁকে পরিহাস করতে লাগল। তিনি সেই বালির টিলা থেকে পা রাখলেন মোটা কাচের দেওয়ালের মাথায়। তারপর দিলেন এক লাফ, এত উঁচু থেকে লাফ তিনি জীবনে দেন নি। নীচে বালির মেঝেতে গিয়ে পড়তেই পায়ে ব্যথা টের পেলেন, কিন্তু ওসব তিনি গ্রাহ্যই করলেন না। চারিদিকের আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বগুলি দেখতে দেখতেই তিনি বলে ফেললেন, “উফ্ যা খিদে পেয়েছে!”

ওমা! বলতে না বলতেই একটা ঝলমলে গয়না-পরা হাত সামনের কাচের দেওয়াল থেকে বেরিয়ে এসে, এক পাত্র আখরোট আর আঙুর রেখে দিল তাঁর পায়ের কাছে। বিহ্বল হয়ে পড়লেও তিনি পাত্রখানি তুলে নিলেন হাতে। একখানা আঙুর চিবোতেই যেন দেহে তিনি নতুন করে বল ফিরে পেলেন। এও কি জাদু নাকি! রাজকুমার গোগ্রাসে বাকি ফল আর বাদামটুকু খেয়ে ফেললেন। মুখে বললেন, “একটু জল যদি পেতাম!” বলতেই এক পাত্র শীতল জল পৌঁছে গেল তাঁর মলিন পায়ের কাছে। আবারও সেই চুড়ি-পরা হাত। সেই জল তিনি একটু খেলেন, চোখে-মুখে-ঘাড়ে-মাথায় একটু ছিটিয়ে দিলেন। আর সেইসময় সামান্য একটু জল বালি স্পর্শ করতেই, দুইখানা নারকেল গাছ দুই পাশ থেকে ঠেলে উঠে বড়ো হতে হতে একসময় তাঁর মাথার উপর সূর্যটাকে আড়াল করল। তখন আরামে তিনি ধন্য বোধ করলেন আর মনে মনে ভাগ্যকে কৃতজ্ঞতা জানালেন এমন অপূর্ব স্থানে তাঁকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। একটা চমৎকার তৃপ্তি থেকেই তাঁর মুখ থেকে বের হয়ে গেল… “এ সময় যদি একটু বাঁশি শুনতে পেতাম, ঘুমিয়ে পড়তাম।”

তখনই দুই কাঁকন-পরা হাত একখানা আড়বাঁশি নিয়ে দেওয়াল ভেদ করে দেখা দিল আর অমনি আপনা থেকেই বাজতে শুরু করল মোহন সুর। যেন বাতাস নিজেই সেই বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে বাজাচ্ছে সেটাকে। আহা! কী অপূর্ব সুর! সঙ্গে সঙ্গে ক্লান্ত রাজকুমারের দুই চোখ ঘুমে বুজে এল।

(৩)

ঘুম ভাঙতেই, তিনি দেখলেন তাঁর মাথার তিনপাশে ধবধবে সাদা আলখাল্লা-পরা তিনটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। শুধু মুশকিল হল তিনজনকে একইরকম দেখতে, একই পোশাক, একই বয়স, একই উচ্চতা – বলা যায় তারা যেন একে অপরের প্রতিবিম্ব। রাজকুমার স্বভাবতই জিজ্ঞাসু হলেন। অমনি তারা তিনজন একে অপরকে হাত তুলে তর্জনী দেখিয়ে “তুই বল্…”, “তুই বল্…” – করতে লাগল। অবশেষে একসময় তিনজনেই থামল। একজন আচমকা রাজকুমারকে বলল, “খাচ্ছ-দাচ্ছ-ঘুমোচ্ছ – আর কোনো কাজ নেই?”

রাজকুমার সে-কথার জবাব না দিয়ে বললেন, “তোমরা কারা?”

“আমরা হলাম তিন সত্যি…”

“তোমাদের একই রকম দেখতে কেন?”

“বোকা বোকা প্রশ্ন। সত্যিকে একই রকম দেখতে হবে না? আমাদের দেশে তো অন্তত হয়… আমাদের বয়সও বাড়ে না।”

“আচ্ছা, আমি কোথায় এসে পড়েছি তা বলতে পারবে?”

“এ হল শুখাসুরের রাজ্য। এখানে আগে অনেক লোক থাকত, কিন্তু এ-দেশের বুকে দুর্ভাগ্য নিয়ে এলো রাজকুমারী! রাজকুমারী জন্ম থেকেই ভারি দুঃখী, জন্মের সময় রাণীমা মরে গেলেন, সেই শোকে রাজামশাই মরে গেলেন; তারপর থেকে দুঃখকুমারী কেবলই কাঁদেন। তাঁর চোখের জলে যেন অভিশাপ, ক্রমে সব শুকিয়ে গেল চারিদিকে। প্রজারা জমি-ভিটে সব ছেড়ে পালাল। এরপর থেকেই রাজ্যটা শুখাসুরের কবলে চলে গেল – রাজকুমারী যতদিন দুঃখে কাঁদবেন, এ রাজ্য ততদিনই শুখাসুরের। একমাত্র যদি তাঁকে আনন্দ দেওয়া যায়, তবেই শুখাসুরের খেল-খতম্। আর সেটাই হল তোমার কাজ – তোমার শেষ অভিযান।”

রাজকুমার তো শুনে অবাক! কীভাবে রাজকুমারীকে আনন্দ দেবেন তিনি? বিশেষত যিনি আয়নায় বন্দি? তিনি নিজেও তো প্রায় বন্দিই বলা চলে! “তাহলে উপায়?” – রাজকুমার যেন প্রায় মনের কথাটাই মুখ ফুটে বলে ফেললেন।

“উপায় আছে। তোমায় নিয়ে আসতে হবে তিনজনকে খুঁজে।”

“কোন্ তিন জন? কারা তারা? তাদের খুঁজতে যাবোই বা কীভাবে?”

“বলছি দাঁড়াও… প্রথম জন হল মৃদঙ্গম্, তার কাছে আছে একটা জাদু-মৃদঙ্গ, সেটা বাজালেই যে কোনো বন্ধ জিনিস খোলে। আমাদের কথা বললেই সে আসবে। পরের জন মুখে-তালা-মদন, অসত্য বলেছিল বলে রাজামশাই তার মুখে প্রকাণ্ড একটি তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন। তাকে বলবে একটাই শর্তে তালা খোলা হবে, যেন সে এরপর থেকে কখনো মিথ্যে না বলে। সে-লোক চমৎকার গল্প বলে, তাই তাকে বড়ো দরকার। এরপর যার কাছে যাবে, তার নাম – বুকে-রত্ন-বদন… মূল্যবান রত্নের প্রতি প্রচণ্ড লোভ ছিল তার, তাই রাজামশাই তার বুকের ঠিক মধ্যিখানে বহুমূল্য রত্ন বসিয়ে দেন। কিন্তু সে রত্ন নিতে গেলেই তার প্রাণটা খরচ হয়ে যাবে। তাই বেচারার বড়ো দুঃখ, কিন্তু লোকটা বেজায় মজার, মন ভালো থাকলে তোমায় হাসিয়ে পাগল করে দেবে। কিন্তু ওই রত্ন ওর বুক থেকে খোলে কার সাধ্যি? তবে এর উপায় আমাদের জানা, কেবল তাকে আনতে হবে এইখানে। পারবে না?”

“কিন্তু যাওয়ার উপায়?”

“আছে… হয়বদন আছে। সে এক আশ্চর্য ঘোড়ামুখো মানুষ। দুরন্ত গতি তার, শুধু সে ঘোড়া হতে চায়, নাকি হতে চায় মানুষ – সেটা ঠিক করে উঠতে পারলেই সে যে-কোনো একটা হয়ে যাবে। অনেকটা তোমার মতো… তাই না?”

“মোটেই না… যাক্ গে, এখন এখান থেকে বেরোবার উপায় করো দেখি।” – বিরক্ত হয়ে বলে ওঠেন স্বরূপকুমার।

“দাঁড়াও… তাকে ডাকি। কোথায় গো হয়বদন? গেলে কোথায়! আয়নাঘরে চলে এসো দেখি ভাই…” – গলা তুলে তিন-সত্যি বলে উঠল এক সুরে।

অমনি একটা প্রচণ্ড চিঁহিহি শব্দ শোনা গেল। তারপরই দেখা গেল কাচের দেওয়ালের উপর থেকে লাফ দিচ্ছে এক আশ্চর্য জীব – পা-দুটো আর মুখখানা তার ঘোড়ার মতো, অথচ বাকিটা সবই মানুষের মতো! নিচে নেমে এসেই আবার বিকট স্বরে হ্রেষা… কিন্তু তার কথা বোঝা যায় না কিছুই! তিন-সত্যি তাকে তিন দিক থেকে ঘিরে ধরে কীসব বলে দিল কানে-কানে। তারপর রাজকুমারকে নির্দেশ দিল তাকে কায়দা করে জাপটে ধরতে। রাজকুমার তাকে জাপটে ধরা মাত্রই সে দিল এক লাফ, কাচের দেওয়াল টপকে বালিতে ঝড় তুলে সে মুহূর্তের মধ্যে রাজকুমারকে পৌঁছে দিল আঙুল-পাহাড়ের কোলে।

(৪)

আঙুলপাহাড় ভারী আশ্চর্য এক জায়গা! রাশি রাশি আঙুল দিয়ে তৈরি সেই পাহাড় – ছোটো বড়ো নানান মাপের। কোথা থেকে যে এত আঙুল এল, রাজকুমার ভেবেই পেলেন না! হয়বদন হাঁফাচ্ছিল তখন, অনেকখানি পথ দৌড়েছে সে। তার পা দুটো ঘোড়ার মতো হলেও হাত দুটো কিন্তু দিব্যি মানুষের মতো। সে তখন তার তর্জনী নির্দেশ করল পাহাড়ের এক কোণে এক দুঃখী মানুষের দিকে। তাকে দেখেই বোঝা যায় এ লোকটা মৃদঙ্গম্ না হয়েই যায় না। মৃদঙ্গমের বুকের সামনে গলা থেকে লাল দড়ি-বাঁধা অবস্থায় ঝুলছে পুরু লাল কাপড় দিয়ে মোড়া অপরূপ মৃদঙ্গখানা, কিন্তু সে সেটা বাজাচ্ছে না, সে যেন খুব অন্যমনস্ক। রাজকুমার তাকে গিয়ে প্রস্তাব দিলে –

“আমার সাথে যাবে নাকি ভাই?

চেয়ো না হয় তোমার যা চাই…”

লোকটা কিন্তু রাজকুমারের দিকে তাকালোই না। বরং বেশ উদাস সুরে বলল, “তাই নাকি? আমার কী লাগবে, তা জানো?”

“আমি না জানি, তিন-সত্যি জানে…” – রাজকুমার উত্তর দিলেন।

“এই মরেচে! তুমিও সেই আলখাল্লাওয়ালা তিন সত্যির পাল্লায় পড়েছ! ঘুরিয়ে মারবে… দেখে নিও। আমায় বলেছিল সেই কবে, এই আঙুলপাহাড়ে এসে অপেক্ষা করতে… তারপর কত মাস-বছর কেটে গেল অপেক্ষায়! সেই থেকে ঠায় গালে হাত দিয়ে বসে আছি।”

“কিন্তু কেন? কী চাই তোমার?”

“আরে সুন্দর কিছু চাই, সুন্দরী হলেও চলবে… এই যেমন ধরো অপরূপা এক রাজকুমারী! সন্ধান জানা আছে নাকি?”

রাজকুমার ধন্ধে পড়লেন, কারণ তিনি সুন্দর দুটি হাত দেখেছেন বটে, কিন্তু রাজকুমারীর মুখ তো দেখেননি। তাই প্রশ্ন হল, তিনি আদৌ সুন্দরী তো? রাজকুমারী হলেই যে সুন্দরী হবে… এমন কোনো কথা নেই। এই যেমন প্রতাপগড়ের রাজকুমারীর কুলোর মতো কান, দরাজপুরের রাজকুমারী মৃদু খুঁড়িয়ে চলেন… ওইরকম হলে তো মুশকিল! তবু তিনি প্রশ্ন করলেন, “তা দাদা সুন্দরী কন্যে নিয়ে তোমার কী কাজ? বিয়ে-টিয়ে করতে চাও নাকি?”

কিন্তু সেই কথায় লোকটা ভারী রেগে গেল! পাহাড়ের গা থেকে একমুঠো আঙুল তুলে নিয়ে রাজকুমারের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, “খবরদার আমার পিছনে লাগবে না, বলে দিচ্ছি। আমায় দেখতে খারাপ বলেই না তুমি এমন করে বলতে পারলে! কিন্তু আমার মৃদঙ্গ শুনলে বুঝতে… দেখতে খারাপ হলেই কেউ মন্দ বাজিয়ে হয়ে যায় না।”

“তা দাদা, বাজিয়ে শোনাও না হয় একটুখানি…”

“অত সহজ না… সুন্দর কিছু না দেখলে, ভিতর থেকে সুর আসবে কোত্থেকে?”

“তাহলে চলো দাদা… রাজকুমারীকে একবার দেখেই আসি। তবে গিয়ে একটিবার তোমায় মৃদঙ্গটি বাজাতেই হবে… নইলে বন্ধ কাচের দেওয়াল যে খুলবে না!” – এভাবে অনেক বুঝিয়ে-সুজিয়ে, রাজি করিয়ে, তাকে নিয়ে চললেন রাজকুমার। তিনি হয়বদনের সামনে ও মৃদঙ্গম্ তার মৃদঙ্গ-সহ পিঠের দিকে ঝুলে পড়লে – তবে শক্তিশালী বটে হয়বদন, এতটুকুও কাহিল হল না দু’জনের ভারে। মৃদঙ্গম্-কে আয়নাবাড়ির ভিতরে তিন-সত্যির হেফাজতে রেখে আবার পাড়ি।

এবার হয়বদন রাজকুমারকে নিয়ে গেল টাপুর-টুপুর নামক এক স্থানে। সেখানে সর্বক্ষণ মেঘ করে থাকে। আকাশ মেঘলা কিন্তু কখনো জোরে বৃষ্টি হয় না, বড়ো জোর ওই টাপুর-টুপুর। বৃষ্টির জল সব সময় রঙিন। সেখানে একটা দোকানে ছাতা মাথায় কালো জোব্বা পরে, বসেছিল মুখে-তালা-মদন। রাজামশাইয়ের হুকুমে তার মুখে তালা পরানোর পর থেকে তার খাওয়া-দাওয়া সব বন্ধ। তাই বেচারা শুকনো মুখে বসে ছিল। তালা খুলে দেওয়া হবে শুনে তো সে এক কথায় রাজি। তাকে আয়নাবাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আবার যাত্রা… এবার গন্তব্য হাতিমপুর। হাতিমপুরে রয়েছে বিরাট এক টাঁকশাল, যাকে বলে টাকা তৈরীর কারখানা। সেখানে সোনা গলানোর জ্বলন্ত হাপরের দিকে তাকিয়ে কাঁদো-কাঁদো মুখে বসেছিল বুকে-রত্ন-বদন। দেখেই চেনা যায়, কারণ বেচারার বুকের মধ্যিখানে ঝুলছে ঢাউস একখানা নীলকান্তমণি। তার ভারে সে নিজেই বোধ করি ভালো করে নড়তে পারে না। রাজকুমার তাকে প্রশ্ন করল, “বদনদাদা দেখছি যে… তা যাবে নাকি আমার সাথে আয়নাবাড়িতে?”

“কেন? সেখেনে আবার কী?”

“যে ভারখানি আছে চেপে, এতটাকাল তোমার বুকে

সে ভার থেকে মুক্তি পাবে, এবার থাকবে মহা সুখে।”

“ও… ও’রকম অনেক শুনেছি। বিশ্বেস নেই।”

“তিন-সত্যিকেও বিশ্বাস করো না?”

“এই মোলো যা… আবার তারা! তাদেরই জন্য আজ আমার এই দুর্দশা। অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ ওই তিন সত্যির ফাঁদে পড়ে গেছে গো…” – বলেই লোকটা ভেউ ভেউ করে কাঁদতে বসে গেল। তারপর তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে মাথা ঠান্ডা করে, কোনো মতে আনা গেল আয়না বাড়িতে। ততক্ষণে রাত হয়ে গেছে। ফুটফুটে চাঁদের আলো চারিদিকে, কারো চোখে বিন্দুমাত্র ঘুম নেই।

তিন-সত্যি বলল, “কৈ মৃদঙ্গম্ এদিকে এসো দেখি, বদনদাদাও এসো। আজ তোমাদের মুক্তি।” – এই বলেই তিন জনে তিন দিক থেকে মৃদঙ্গম্-কে ঘিরে ধরে কী সব পরামর্শ করল। কথা আর শেষ হয় না, মৃদঙ্গম্ ও চট করে রাজি হবার লোক নয়। অবশেষে সে রাজি হয়ে মৃদঙ্গ বাজাল… আহা সে যে কী অপূর্ব তাল আর ছন্দ – ভাবা যায় না! মনটাকে যেন কোন্ সুদূরে চাঁপার বনে নিয়ে গিয়ে ফেলে! কয়েক পলকের মধ্যেই বদনের বুক থেকে খসে পড়ল সেই অতিকায় রত্নখানি। এরপর মুখে-তালা-মদনের পালা। সে মৃদঙ্গের সামনে এসে দাঁড়াতেই খসে পড়ল তার মুখে লাগানো খাঁচা ও পেল্লায় তালাখানি। দু’জনেরই তখন হাউ হাউ করে কী কান্না! কিন্তু মৃদঙ্গম্ যেন ঈষৎ মনক্ষুণ্ন। সে বলল, “এবার আমার উপকারটা করো দেখি…”

তিন-সত্যি তখন রাজকুমারকে বলল, “এবার তোমার পালা স্বরূপকুমার। তোমার ওই ছায়া-তরবারি এতদিনে কাজে লাগবে। এখন এই চাঁদের আলোয় চালাও দেখি তরবারি। ঘুঁচে যাক কাচের কেরামতি।”

(৫)

রাজকুমার তখন খাপ-মুক্ত করলেন তরবারিখানা। সত্যিই তখন চাঁদের বাঁকা আলোয় মায়াজগৎ তৈরি হয়েছে। সে তরবারি একটা ছায়ামাত্র, বাতাসের মতো, সঠিক সময়ে সঠিক হাতে দেখায় তার ভেলকি। রাজকুমার পিতা-মাতা ও অস্ত্রগুরুকে স্মরণ করে চাঁদের তেরছা আলোয় কৌশলে তরবারি চালনা করলেন আয়নার এক দেয়ালে। অমনি ভয়ংকর জোরে কাচ চূর্ণ হওয়ার শব্দ হল। পরক্ষণেই কোথায় সেই কাচের দেওয়াল আর কোথায় কী! কিন্তু রাজকুমারীকে কোলে নিয়ে একখানা প্রকাণ্ড পাথরে বসে আছে ওটা কী? রাক্ষস নাকি! কী ভয়ংকর দেখতে! এই তবে শুখাসুর! কিন্তু রাজকুমারীও যে কেমন নিশ্চিন্ত! তাঁর কি তবে কোনো অভিযোগ নেই? ওদিকে তখন মৃদঙ্গমের মুখখানা হয়েছিল দেখার মতো। রাজকুমারীর অমন কড়ির মতো মুখ আর সোনা-রঙের চুল, মুখের ওই লাবণ্য – নিখুঁত, অপরূপ রাজকুমারীকে দেখে সে আবার আপনমনে বাজাতে শুরু করল তার মৃদঙ্গ। সে আলাদা সুর – আলাদা তাল – সে সুর মুক্তির, সে তাল আবেগের। মনে হয় যেন আকাশের বুক ফাঁক করে ওই মৃদঙ্গের তাল সুরের হাতে সূর্যখানা বের করে আনবে!

ওদিকে রাজকুমারের দৃষ্টি গেছে তিন-সত্যির দিকে – তারা আর আগের মতো নেই, কখন বদলে গেছে! একটি ছেলে কেবলমাত্র আগের বয়সেই রয়ে গেছে। বাকি দু’জনের একজন হয়ে গেছে জোয়ান, আরেকজন থুত্থুড়ে বুড়ো। রাজকুমার বুঝলেন, এই হল তিন-সত্যির প্রকৃত রূপ – অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের রূপ – আয়নাবাড়ির মায়ার বলে তা গোপন ছিল, এখন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। বুড়ো মানুষটি বললেন, “সত্য কখনও একই রকম হয় না… তারও রূপভেদ আছে রাজকুমার। আমাদের কখনো কখনো লঘু মিথ্যাও বলতে হয় বই-কী – কারণ আজ যা মিথ্যা, কাল হয়তো তাই সত্য। তবে এখন তোমার এখানকার কাজ শেষ, এইবার তোমার ফিরে যাওয়ার পালা।” – এই বলে ছেলে-জোয়ান-বুড়ো তিনজনে একযোগে রাজকুমারের কপালে তাদের তিন জোড়া হাত ছোঁয়ালেন। সাথে সাথেই উজ্জ্বল সাদা আলোয় রাজকুমার মুছে গেলেন সেই বালুকাময় ভূ-ভাগ থেকে।

তাহলে প্রশ্ন এসে পড়ে, বাকিদের কী হল! রাজকুমার উধাও হয়ে যেতেই মৃদঙ্গম্ গিয়ে ধরল তিন-সত্যিকে। বুড়ো বলল, “দাঁড়াও বাপু, একটু সবুর করো। আগে রাজকুমারীর দুঃখ ঘুঁচুক।” সেই কথা শুনে রাক্ষস আর রাজকুমারী দু’জনেই একসাথে ছুটে এল… শুখাসুর হেঁড়ে গলায় বলে উঠল –

“কও কী! কও কী বুড়ো!

কিছুই বুঝি না – ল্যাজা-মুড়ো।”

রাজকুমারী বলল, “আমার দুঃখেই যে বেচারা খেয়ে-পড়ে বেঁচে আছে। দুঃখ যদি ঘোচে, তবে যে শুখাসুর না খেয়ে মরবে!”

“রাজকুমারীর মনের দুঃখে চোখ বেয়ে যত জল ঝরে, সবই যে আমি ঘটিতে রাখি ভরে! সে-সব ছাড়া বাঁচবটা কী করে?” – ভয়ানক দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বলে ওঠে শুখাসুর।

রাজকুমারী তাকে সান্ত্বনা দেয়, তার খসখসে ত্বকে হাত বুলিয়ে দিয়ে। তখন তিন-সত্যি ভাবনায় পড়ে। এমন যে গোলমাল হবে, কে জানত! অনেক ভেবে বুড়ো সমাধান বাতলায়, “আগে শোনো গল্প আর মজার রসিকতা। মদন-বদন এদিকে আয় ভাই, তোরা ছাড়া যে আর উপায় নাই!”

তখন মদন শোনায় গল্প, সত্যিকারের দুঃসাহসিক অভিযানের গল্প। আর বদন শোনায় মজার মজার ধাঁধা আর নিমেষে আসর জমিয়ে তোলে। তখন ভোর হয় হয়। সেই সব কাহিনি শুনে রাজকুমারী দুঃখ ভোলে। এক বুড়ি মায়ের হারিয়ে যাওয়া ছেলেকে খুঁজে পাওয়ার সত্য কাহিনি আর মজার একটা রসিকতা শুনে রাজকুমারীর মনে অদ্ভুত ভাবের উদয় হয় – একবার আবেগে, আর একবার খুশিতে, রাজকুমারীর চোখ থেকে ঝরে পড়ে জল! আনন্দেও যে চোখ থেকে জল পড়ে, এতদিন রাজকুমারীর অজানাই ছিল। অমনি মরুভূমিতে মরুদ্যান জন্মায়, তাতে টলটলে জল। কত গাছপালা জন্মায়, মরুভূমি আবার বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। তখন শুখাসুর মাটিতে শুয়ে হাত-পা ছুঁড়তে থাকে – বলে যে দিকে দু-চোখ যায় সে চলে যাবে। তখন রাজকুমারী কী করে! মায়া পড়ে গেছে যে বড্ড ওই বিকট অসুরের প্রতি। তখন এগিয়ে আসে মৃদঙ্গম্। সে বলে, “যখন যখন লাগবে চোখের জল, এই মৃদঙ্গমকে ডেকে নিও রাজকুমারী। তোমায় না পাওয়ার যে কষ্ট, তাতেই আমার মৃদঙ্গে বাজবে দুখ-জাগানিয়া সুর-তাল, সে সুর শুনে পুরোনো কথা ভেবে দুঃখ পাবে তুমি। আর তোমার দুঃখ নিয়ে বেঁচে থাকবে শুখাসুর… শুধু এই অভাগাকে তোমার মিষ্টি মুখখানি প্রতিদিন প্রাণ ভরে দেখতে দিও…”

রাজকুমারীর আহ্লাদ তখন দেখে কে! আনন্দে তার দু’চোখ দিয়ে নামে জলধারা। আর মরুদ্যান প্রসারিত হয়। তখন বুড়ো বাকি দুই সত্যিকে ডেকে নিয়ে, তাদের সাথে একযোগে বলে – “এভাবেই তোমরা সুখে-দুঃখে থেকো…

দরকার পড়লে আমাদেরও ডেকো।”

এই বলে মদন-বদন আর হয়বদনকে নিয়ে তিন-সত্যি রওনা দেয় ভোরের আলোর দিকে… বিরাট গোল থালার মতো সূর্যটার একফালি তখন দিগন্তে উঁকি দিয়েছে তেরছা আলো নিয়ে। হয়বদন তখন বুড়োর কানে কানে জানিয়ে দেয়, সে আবার মানুষ হতে চায়, এ জগৎ এখনও বড্ড সুন্দর। মানুষ হলে তবেই সে জগৎটাকে প্রাণ ভরে অনুভব করতে পারবে।

(৬)

ওদিকে তখন ভোরের তেরছা আলোয় রাজকুমারের হাতে দেখা দিয়েছে ছায়া-তরবারি। সামনে অতিকায় নীল ড্রাগন। মরুভূমির রাত যেন একটা স্বপ্ন ছিল, এখন তিনি আবার বাস্তবে। কিন্তু রাজকুমার কী করেন! স্বরূপকুমার যে আয়নায় দেখে ফেলেছেন নিজেকে। বুঝেছেন, বন্ধু নেই বান্ধব নেই, আসলে তিনি কতটা একলা! পিতা রাজা – তাঁর ব্যস্ততা, মাতা রাণী – তাঁর দায়িত্ব – এ সবই তাঁকে দূরে ঠেলে দিয়েছে।

তিনি এও দেখেছেন, জগতে সুন্দর-অসুন্দর কেমন মিলেমিশে থাকতে পারে। জেনেছেন, সত্য আসলে মিথ্যেরই সহোদর। তিনি বুঝেছেন, জগতে যা কিছু অন্যরকম, তাকে বুক দিয়ে আগলাতে হয়। অমন যে ভয়ানক শুখাসুর, সেই বিকট-দর্শনকেও অপরূপা রাজকুমারী নিশ্চয় বুক দিয়ে আগলাবেন। তাহলে তিনি কী করে হত্যা করবেন এই আশ্চর্য ড্রাগনকে?

রাজকুমার ভিতরে ভিতরে যে অস্থিরতায় ভুগছিলেন, কখন যেন তা শান্ত হয়ে আসে। অভিযানে তিনি আনন্দ পেতেন, কিন্তু সে আনন্দ বাইরের। কিন্তু এই অভিযানে যাদের সঙ্গে তাঁর সখ্যতা হল, তারা তাঁকে এনে দিল প্রাণের আনন্দ, সেই আনন্দ অন্তরের। আয়না-ঘরে স্বরূপকুমার নিজেকে চিনলেন। এখন এই মায়া-ড্রাগনের দন্ত-বিকশিত বিশাল মুখখানার দিকে চেয়ে তাঁর মনে জাগল মায়া – অদ্ভুত এক মন-কেমন-করা মমতা।

(৭)

রাজকুমারের হাত থেকে খসে পড়ল ছায়া-তরবারি। কে জানে জগতে এমন জীব হয়তো এই একটিই আছে! তাকে মেরে ফেললে বিরাট অন্যায় করা হবে। তিনি এগিয়ে গেলেন ড্রাগনের কাছে। তার শীতল নিঃশ্বাসে গা ডুবিয়ে, তার বিশাল মাথায়, নীল গায়ে হাত বুলিয়ে দিলেন। আরামে চোখ বুজল ড্রাগন, ভয়ংকরকে ভালোবাসলেন স্বরূপকুমার, তিনিও খুঁজে পেলেন সত্যিকারের শান্তি।

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ