08 Jun

ক্রম বিন্যাস

লিখেছেন:জনা বন্দ্যোপাধ্যায়


ক্রম বিন্যাস   জনা বন্দ্যোপাধ্যায়

শাল পিয়াল মহুয়ার জঙ্গল ঘেরা অযোধ্যা পাহাড়ের পথে পথে শুকনো পাতার মর্মরতা আর লাল মাটির রুক্ষতা ছড়িয়ে আছে। ওখানকার বাঘমুন্ডি ব্লকের চড়িদা গ্রামের একনিষ্ঠ মুখোশ শিল্পী সমীরণ মাহাতোকে কে না চেনে! তাঁর সতেরো বছরের ছেলে সিধু ও পনেরো বছরের মেয়ে তরলা বাবাকে ছৌ নাচের মুখোশ তৈরির কাজে সাহায্য করে। কাদামাটি দিয়ে ছাঁচ বা কাঠামো বানিয়ে সিধু রোদে শুকায়। তরলা শুকনো ছাঁচে ছাই-এর গুঁড়ো মাখায়। বাবার কাছে ওরা এসব শিখেছে। সব শেষে সমীরণ আঠা দিয়ে ভেজানো কাগজের পরত কাঠামোয় লাগায়।

এই গ্রামের প্রায় প্রতিটি ঘরেই সারাদিন ধরে চলে শিল্পকর্ম, রুজি রোজগার, আর রাতে মহুয়ার নেশায় বেশীর ভাগ পুরুষরা হয় বেসামাল। বসন্তের ফাগুনবেলায় যখন পলাশ ফোটে, পর্যটকদের ভিড় হয়, তখন মুখোশ বিক্রি বেড়ে যায়। রাস্তার দুধারে সারি সারি মুখোশের দোকান চোখে পড়ে। প্রায় একশোর ওপর পরিবার মুখোশ শিল্পী। কালী, দুর্গা, নরসিংহ প্রভৃতি পুরাণের চরিত্রগুলো বাংলার নিজস্ব লোকশিল্প ছৌ নাচের উপযুক্ত মুখোশের রূপ পায়। এছাড়া সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সরল কুটিল নানান অভিব্যক্তিসহ মানুষের মুখও মুখোশের বিষয় হয়ে উঠেছে। শিব পার্বতীর কাহিনীও ছৌ নাচে পরিবেশিত হয়, তবে ছৌ নাচের মধ্যে বর্তমানে ধ্রুপদী নৃত্যশৈলী মিশেছে। সরকার ছৌ শিল্পীদের প্রতিমাসে হাজার টাকা ভাতার ব্যবস্থা করলে ছৌ-এর দল বৃদ্ধি পায়। সেই সঙ্গে ছৌ নাচের মুখোশের চাহিদাও বাড়ে। সমীরণ মাহাতো সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মুখোশ রঙ করা আর আঁকার কাজে ব্যস্ত থাকেন।

সমীরণ মাহাতোর স্ত্রী তুলসী কাকভোরে বুড়ো শিবতলা ছাড়িয়ে পুকুরে স্নান করতে যায়। বয়স আটত্রিশ ছাড়িয়েছে, দুই কিশোর ছেলে মেয়ের মা, তবু শরীরে যৌবনের ঢল, মুখের লাবণ্য কমেনি। পুকুর ধারে ছিপ হাতে বসে থাকে পার্বতীচরণ। তুলসীর সঙ্গে তার রোজই দৃষ্টি বিনিময় হয়। পার্বতীচরণ দুটো সোহাগের কথা বলে। সলজ্জ চাউনীতে মাথা নীচু করে থাকে তুলসী। প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ের ভঙ্গিতে চলে দুজনের প্রেম। তুলসীর সিক্ত শরীর মোহগ্রস্ত করে পার্বতীচরণকে। তার এই গ্রামে একটি মুদির দোকান আছে। শিল্প বোঝে না লোকটি। কিন্তু ব্যবসা ভালো বোঝে। পার্বতীচরণের স্ত্রী কয়েক বছর আগে নিউমোনিয়ায় মারা গেছে।

সমীরণ ও তুলসীর সংসারে বাজার, দোকান, সংসারের হিসেব রাখা তুলসীরই কাজ। সমীরণ মানুষ ভালো হলেও স্বামী হিসাবে বউ-এর শখ আহ্লাদ জানার চেষ্টা কোনদিনই করেননি। পার্বতীচরণ একদিন তুলসীকে জিজ্ঞাসা করে, “কেন আছিস এরকম মরদের সঙ্গে, যে তোর মনের কথা বোঝে না! তোর ইচ্ছের কথা ভাবে না! মরদ না যন্তর!”

তুলসীর দু চোখ জলে ঝাপসা হয়ে আসে। সত্যি কোন উত্তর নেই তার কাছে। সিধু আর তরলার মুখের দিকে তাকিয়ে তুলসী আজও পার্বতীচরণকে কোন প্রতিশ্রুতি দিতে পারেনি। শীতের দুমাস বাইরের লোকজন গ্রামে ঘুরতে আসে। তারা মুখোশগুলোর কদর করে,কেনে। আর কিছু কিছু ছৌ নাচের দল এসে পছন্দ করে কেনার বায়না দিয়ে যায়। কিন্তু অভাবের সংসারে অভাব থেকেই যায়। তবে সমীরণ আশাবাদী। স্ত্রীকে বলেন, ” দেখবি একদিন ঠিক অনেক টাকা ঘরে আসবে। তোদের মুখে হাসি ফোটাতে পারব। ”

পৃথিবীর সুখ দু:খের আবর্তের মাঝে মহামারীর প্রকোপ এক ভয়াবহ দু:স্বপ্নের মতো মানুষের জীবনকে ঘিরে ধরে। করোনা মানুষের অর্থনীতির  মূলে ঢুকে পড়ে। সেবার শীতে কলকাতা থেকে শিল্পমেলা আয়োজক অনুপম তালুকদার এসে বেশ কিছু মুখোশের অর্ডার দিয়ে যান।  অনুপমবাবু সমীরণ মাহাতোর মুখোশ তৈরীর ঘরে ঢুকে দেখেন বেশ কিছু কালী, কার্তিক, অসুর ও সিংহের মুখোশ দেওয়ালে টাঙানো,মাটিতে ছড়ানো রয়েছে। ছৌ নাচের সুন্দর অলঙ্করণ করা মুখোশগুলো দেখে তিনি মুগ্ধ দৃষ্টিতে বলেন, “এগুলো আজকাল দেশে বিদেশে ঘরের ড্রইং রুমেও সাজানো হয়। আপনার কাজের তারিফ করতেই হয়।”

সমীরণ মাথা নীচু করে হেসে বলেন, ” অনেক পরিশ্রমের কাজ, দাম তো সেরকম পাওয়া যায় না।”

“দাম পাবেন ভালোই। কিছু মুখোশ আমরা আগামী শিল্পমেলার জন্য কিনবো। কিছু পৌরাণিক চরিত্রের মুখোশ তৈরী করুন, এগুলোর গুরুত্ব আন্তর্জাতিক।”

অনুপম তালুকদার আশার আলো দেখান। উৎসাহ নিয়ে কাজ শুরু করেন সমীরণ। কিন্তু করোনার প্রভাবে কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। কিছু দিন পর অনুপম তালুকদার তাঁর অর্ডারগুলো ক্যানসেল করেন। সমীরণ নিরাশ হয়ে পড়েন। অর্ডারের কাজ শুরুর জন্য কিছু টাকা ধার দেনাও হয়ে গেছে। দিনের পর দিন কাজ করতে করতে নিজের শরীর স্বাস্থ্যের প্রতি কোন খেয়াল থাকে না সমীরণের। দুটি ছেলে মেয়ের  অন্ন সংস্থানের চিন্তাই তাঁর কাছে মুখ্য।

একদিন হঠাৎ করেই করোনায় আক্রান্ত হন সমীরণ মাহাতো। পরীক্ষা করানোর পর দুদিনের জ্বর সর্দিতে মৃত্যু হয় তাঁর। তুলসী মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ে। পাড়ার মেয়ে বউরা ‘সবই ভাগ্যের ফল’ বলে সান্ত্বনা দেয়। তুলসীকে সাদা থান পরতে দেখে মেয়ে তরলা কেঁদে ফেলে। সিধু খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দেয়। সমীরণের সংসার যেন শ্মশানের কালো ছায়ায় পরিণত হয়। ঘরে মাত্র চার হাজার টাকা পড়ে আছে। বিষন্ন, দিশাহারা, সাদা থান পরিহিত, এক ঢাল অবিন্যস্ত চুলে তুলসীকে দেখে পার্বতীচরণ  বলে, “তুই আর এভাবে থাকিস না। তুই আমার বাড়ি চল তুলসী। তোর যত্নের কোন ত্রুটি হবে না।”

পার্বতীচরণের প্রস্তাবে তুলসী কাঁদতে কাঁদতে বলে, “আমার ছেলে মেয়ে দুটোর কি হবে?”

“ওরা ওদের বাবার ভিটেয় থাকুক। ওদের যা টাকা লাগবে পাঠিয়ে দেব। তুই আমার বাড়ি চল। আমরা সংসার পাতবো।”

“তা হয় না” – তুলসী শেষ পর্যন্ত রাজী হয় না। গ্রামের অবস্থাপন্ন ঘোষদের বাড়িতে সে কাজে ঢোকে।

একদিন সমীরণের চৌকির তলা থেকে একটা ঠিকানা লেখা কার্ড পেয়ে সিধু মাকে বলে, ” এটা কলকাতায় অনুপম বাবুর ঠিকানা। ওখানে যাব মা? বাবার বানানো মুখোশগুলো নিয়ে যাব বিক্রির জন্য।এখন তো আর দেশে করোনা নেই। ওরা না করতে পারবে না।”

” কি বলছিস তুই? ওরা নেবে? ”

“কেন নেবে না? এগুলো বাবার শেষ কাজ। আমাকে চেষ্টা করতে হবে। বিক্রি হলে দাম পাওয়া যাবে। ঠিকানা চিনে ঠিক পৌঁছে যাব। বাবুদের পায়ে ধরে বলবো।”

মহামারী দেশকে শ্মশান করেছে। কত স্বামী সন্তানের মৃত্যু হয়েছে। তবু মানুষের মনে আশার আলো নেভেনি। সব কিছু শেষ হয় হয়তো নতুন কিছু শুরুর জন্য। সিধুর আত্মবিশ্বাস দেখে তুলসী অবাক হয়। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে তুলসী শক্তি পায়। তুলসী আর তরলা কিছু মুখোশ সহ সিধুর ব্যাগপত্তর গুছিয়ে দেয়। তুলসী ভাবে ঈশ্বরের কৃপায় সিধুর আশা পূর্ণ হলে সমীরণের অপূর্ণ সাধও পূর্ণ হবে। মহামারী মানুষকে ধৈর্য্য দিয়েছে, সাহস দিয়েছে। সিধু তরলার মতো পিতৃহীন ছেলে মেয়ের মধ্যেও জেগেছে প্রত্যয়। লাল মাটির বুকে ঝরা পলাশের মধ্যে বেঁচে থাকার প্রত্যয় ওরা খুঁজে নেয়। সমীরণ মাহাতোর পরিবার সমীরণের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল নষ্ট হতে দেবেনা। তরলা তুলসীকে বলে,” দেখো মা দাদা ঠিক ভালো খবর আনবে।”

মা বোনকে বিদায় জানিয়ে সিধু তার অদম্য ইচ্ছে পূরণের পথে পাড়ি দেয়। তুলসী ‘দুগ্গা দুগ্গা’ বলে বার বার প্রণাম করে।

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ