তাহলে আমরা যাচ্ছি কি না লাস্ট শো-এ ? তাড়াতাড়ি ঠিক করে বল, টিকিট বুক করবো তো !
প্রমথ দুই বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বললো।
তিনজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু কানপুর ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে ইলেকট্রনিক্সের ছাত্র, প্রমথ ডে স্কলার, বাকি দুজন হোস্টেলবাসী ।
শনিবারের দুপুর থেকে প্রমথর বাড়িতে এসে খাওয়া দাওয়া আর জোর আড্ডা দিচ্ছে সুজন আর অনন্ত।
ওদের দুজনের বাড়ি কোলকাতায় আর প্রমথর বাবার বদলির চাকরিতে ইউপির বিভিন্ন শহরে ঘুরে ফিরে ওদের পরিবার আপাতত কানপুরে থিতু হয়েছে ।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল কেটে গিয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেছে কিছুক্ষণ।
তিনজনে এখন কথা হচ্ছে কার্নিভাল হলের লাস্ট শো-এ ‘এ বিউটিফুল মাইন্ড’ দেখতে যাওয়া নিয়ে । কালেভদ্রে এখানে টপ ক্লাস ইংরেজি ছবি আসে । বেশ নামকরা ছবি ‘এ বিউটিফুল মাইন্ড’, তিনজনেই তাই উৎসাহিত ।
সুজন আর অনন্তর অসুবিধে কিছু নেই, হোস্টেলের মেসে একটা ফোন করে নো মিল করে দিতে হবে, ব্যস ! রাত্রে থাকার গেস্টদের জন্য প্রমথর বাবার সরকারি বাংলোতে দু-তিনটে এক্সট্রা কামরা রয়েছে ।
কেবল সিনেমা দেখতে বেরোবার আগে এবাড়ির কুককে দুজনের জন্যে বাড়তি রান্না করতে বলে যেতে হবে।
অনন্ত মন দিয়ে ইন্ডিয়া টুডে পড়ছিলো। প্রমথর কথা শুনে ম্যাগাজিনটা মুড়ে টেবিলে রেখে দিয়ে সুজনকে বললো,
– সিনেমাটা অবশ্য খুব ভালো হয়েছে। চারটে অস্কার পেয়েছে, ইনক্লুডিং বেস্ট পিকচার। চল, দেখেই আসি।’
-ওকে ! রাসেল ক্রো-কে তো আমার দারুণ লাগে। গ্ল্যাডিয়েটর দেখেই আমি ওর ফ্যান হয়ে গেছি । সুজনের মন্তব্য ।
প্রমথ টেবিল থেকে মোবাইলটা তুলে নিয়ে অনলাইন টিকিট কাটতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
#
শো-এর শেষে তিনজনে হল থেকে বেরিয়ে এলো ।
সুজন বললো, বেস্ট অ্যাকটরের প্রাইজটাও পাওয়া উচিত ছিল রাসেল ক্রোয়ের । কি অভিনয়ই করেছে, চরিত্রের থেকে একেবারে আলাদা করা যাচ্ছে না, মনে হচ্ছে ওই যেন জন ন্যাশ, যাকে বলে স্কিনডিপ অ্যাকটিং!
প্রমথ পার্কিং এরিয়ার দিকে গেলো, বাইকটা আনতে।
অনন্ত সুজনের কথায় মাথা নেড়ে বললো, সে তো ওর বৌ অ্যালিসিয়ার রোল-এ জেনিফার কনেলি-ও দারুণ করেছে । তবে একাডেমী এখন স্মার্ট হয়ে গেছে । নমিনেশন থাকলেও একটা ছবিকে তিন-চারটের বেশি প্রাইজ দেয় না। বেনহুর, গান্ধী, লরেন্স অফ অ্যারেবিয়ার সেসব দিন গেছে !
প্রমথ বাইক নিয়ে বেরিয়ে আসতেই দুজনে পিলিয়ন সিটে চেপেচুপে বসে পড়লো ।
রাত এগারোটা বেজে গেছে কিছুক্ষণ আগে। রাস্তা নির্জন হতে শুরু করেছে ।
কার্নিভাল অডিটোরিয়াম থেকে প্রমথদের বাড়িটা প্রায় দশ কিলোমিটার হবে। রাস্তা ফাঁকা দেখে প্রমথ অ্যাকসিলেটরে চাপ দিলো ।
রাতের হালকা কুয়াশায় রাস্তার লাইটপোস্টগুলো আবছা আলো দিচ্ছে, দুপাশের আলোর পিলারগুলো দ্রুত পেছনে চলে যাচ্ছে ।
পেছন থেকে সুজন বললো, প্রমথ তোর বাইকের হেডলাইট তো কাজ করছে না, কেবল পারকিং লাইট। একটু দেখেশুনে চালা ভাই।
এই কথা বলতে বলতেই মাঝখানে বসা অনন্ত বলে উঠলো, এই এই প্রমথ, সাবধান ! স্পিড কমা, স্পিড কমা। সামনে ব্যারিয়ার, নাকাবন্দি ! উইক-এন্ড চেকিং হচ্ছে নিশ্চয়ই ।
সামনে প্রায় একশো মিটার দূরে, একটা ক্রসিং। রাস্তার এদিক থেকে ওদিক ব্যারিয়ার, মাঝখানে ফাঁক, ব্যারিয়ারে লাল আলো জ্বলছে নিভছে ।
ব্যারিয়রের এদিকের রাস্তায় তিন চারটে গাড়ি দাঁড়িয়ে।
কয়েকজন পুলিশ কর্মী কাছেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । ব্যারিয়ারের কাছেই, রাস্তার ওপাশে একটা লাইটপোস্টের তলায় দাঁড়িয়ে একটা পুলিশের পেট্রলিং জীপ, উইন্ডস্ক্রিনের ওপরে লালনীল আলো এদিক থেকে ওদিক খেলে বেড়াচ্ছে।
প্রত্যেকটা গাড়ির ড্রাইভারের দিকের দরজার পাশে একজন কনস্টেবল গিয়ে চালকের মুখের কাছে ব্রিদিং মেশিন ধরছে, তারপর গাড়িটা যেতে দিচ্ছে ।
ওদের বাইকটা দূর থেকে দেখে একজন তো একেবারে রাস্তার মাঝখানে চলে এসে হাতের টর্চটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাইক রাস্তার সাইডে করতে ইশারা করতে লাগলো ।
সুজন পেছন থেকে ফিসফিস করে বললো, প্রমথ, এবার কি হবে রে ! এ তো দেখছি কড়া চেকিং । একে তো তিনজন চেপেছি, তার ওপর আবার দুজনের মাথায় হেলমেট নেই ! শালা, তোর বাইকের হেডলাইটটাও জ্বলছে না!
অনন্তও ফিসফিস করলো, এই মাঝরাত্তিরে কি হ্যাপা রে ! কি রে প্রমথ, বাইকের কাগজপত্র সব ঠিক আছে তো ? পল্যুশন ?
– সব ঠিক আছে । তোরা চুপ করে থাক তো ! বলে প্রমথ বাইকটা রাস্তার বাঁদিকে এনে ব্যারিয়ারের থেকে একটু দূরে দাঁড় করালো।
সঙ্গে সঙ্গে একজন কনস্টেবল একটা ব্রিদিং অ্যানালাইজার এনে প্রমথর মুখের কাছে ধরে বললো, চলো হিরো, ফুক লাগাও ইধার ! বাইক তো ভাগা রহে থে আশশি মে !
প্রমথ বললো, না জি, ষাটের নীচেই ছিল। আমার বাইকে সাইলেন্সার থেকে আওয়াজটা একটু বেশি হয়। বলে জোরে জোরে দুবার ফুঁ দিলো মেশিনে ।
মেশিন তো সবুজ দেখাচ্ছে । কনস্টেবলের বোধহয় একটু আশাভঙ্গ হলো।
হাতের ব্যাটনটা উঁচিয়ে গলার আওয়াজ এবার কড়া করে বললো, উতরো, আভি উতরো, তিনো উতর যাও।
তিনজনে তাড়াতাড়ি বাইক থেকে নেমে দাঁড়ালো ।
প্রমথ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো, রাস্তা খালি হয়ে গেছে, দাঁড়িয়ে থাকা সব গাড়িগুলো বেরিয়ে গেছে ।
কনস্টেবলটা তেড়ে প্রমথকে বললো, উধার কেয়া, ইধার দেখো । বাইককা পেপার, তুমহারা লাইসেন্স দেখাও।
কাগজপত্র, লাইসেন্স সব ঠিকঠাক।
ওদের মনে হলো কনস্টেবলের রাগ আরও বেড়ে গেলো, গরগর করে বলে উঠলো, তিন আদমি সওয়ার, দোনো কা হেলমেট নহি হ্যয়, হেডলাইট নহি জ্বলতা ঔর বাইক আশশি সে ভাগাতা ?
– ষাট ! আপ কো বোলা থা না, মেরা বাইক কা সাইলেন্সার…
– চোপ ! আভি তু-উ-ম একদম সাইলেন্ট ! সাইলেন্সার দেখাতা হ্যয় । তিনো আও হামারা সাথ । জ্বলন্ত চোখে পুলিশ বললো।
কনস্টেবলের সাথে সাথে তিনজন গুটি গুটি জীপের কাছে গেলো।
ড্রাইভারের পাশের সিটে পুলিশের উর্দি পরে যে বসে ছিল, কনস্টেবল কাছাকাছি যেতেই সে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট ।
প্রমথ দেখলো পুলিশের সার্টের হাতায় তিনটে ভি সেলাই করা, মানে হেড কনস্টেবল বা হাবিলদার ।
– ইয়ে লোগো কা কেয়া বাত হ্যয় ভবানী ?
কনস্টেবল পুলিশটা একটা স্যালুট করে বললো, সাব, এ তিনো…বাইক মে লাইট নহি, হেলমেট নহি…স্পিড ভি…
হাবিলদার সাব হাত তুলে ওকে থামিয়ে দিয়ে সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে প্রমথর দিকে তাকিয়ে বললো, কহা সে আ রহে হো ?
প্রমথ বললো, কার্নিভাল থিয়েটার সে, লাস্ট শো কা ফিল্ম দেখা।
হাবিলদার সাব একবার হাতের ঘড়ির দিকে তাকালো । তারপর প্রমথর দিকে ডানহাতটা বাড়িয়ে দিলো ।
পেছন থেকে ফিসফিস করে অনন্ত বললো, তোর কাছে টাকা চাইছে নাকি রে !
প্রমথও হকচকিয়ে গিয়েছিলো । বোধহয় ওর মুখ দেখে সেটা বুঝেই হাবিলদারের পরের প্রশ্ন, টিকট ? শো কা টিকট দেখাও ।
এবার প্রমথ তাড়াতাড়ি পকেট হাতড়ে সিনেমার টিকিটটা বার করে দিলো।
হাবিলদার টিকিটটা ভালো করে দেখতে লাগলো। সেই ফাঁকেই প্রমথ দেখে নিয়েছে ওর বুকের নামের ব্যাজ…রামশরণ সিং ।
ও বললো, রামশরণজি, হামলোগ স্টুডেন্ট হ্যয়। সিটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, থার্ড ইয়ার । ইয়ে দোনো হোস্টেল মে রহতে হ্যয় । হামারা ঘর শহরমে…
প্রমথর কথার মধ্যেই বাঁ হাতটা তুলে হাবিলদার রামশরণ ডান হাতটা আবার প্রমথর দিকে বাড়িয়ে দিলো।
পেছন থেকে এবার সুজনের ফিসফিস আওয়াজ শোনা গেলো, এই রে…আবার! কতো চাইবে কে জানে রে !
রামশরণ সিং হাতটা বাড়িয়ে রেখেই এবার বললো, আঃ ভবানী ! তিনোকা ফোন নিকাল লো ।
কনস্টেবল ভবানী এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। হুকুম পেয়েই অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে তিনজনের পকেট থেকে মোবাইল তিনটে বার করে বসের হাতে দিয়ে দিলো ।
ফোনগুলো পকেটে চালান করে রামশরণ সিং বললো, চলো, তুমলোগ গাড়ি মে উঠো।
প্রমথ বললো, লেকিন কিউ জি ? কিধর যানা হ্যয় ?
প্রমথর কথা শেষ না হতেই কনস্টেবল ভবানী ওদের জোরদার আপত্তির মধ্যেই ঠেলেঠুলে তিনজনকে জীপের পেছনে একদিকের সীটে তুলে দিয়ে নিজে বসে পড়লো অন্যদিকের সিটে ।
হাবিলদার রামশরণ ঘড়ি দেখলো তারপর ড্রাইভারের পাশের সিটে উঠে বসতে বসতে রাস্তার দিকে জোরে বলে উঠলো, শুনো সব, থানেমে পৌঁছকেই হাম দুসরা গাড়ি ভেজ দেঙ্গে। তব নাকাবন্দী খতম করকে সবলোগ ওয়াপস আ যানা। আভি এক বান্দা য়েহি বাইক লেকে পিছে পিছে আ যাও ।
২
– এবার কি হবে বলতো !
বেশ আওয়াজ-টাওয়াজ করে সরকারি জীপ চলছে । তার মধ্যে ফিসফিস করে অনন্ত প্রমথকে বললো।
– ফোনগুলোও নিয়ে নিয়েছে ! প্রমথ যে বাড়িতে একটা ফোন করবে তারও উপায় নেই ! ফিসফিস করে এবার সুজনের আওয়াজ ।
– এই প্রমথ, কিছু টাকা দিয়ে দিলে বোধহয় আমাদের ছেড়ে দিতো।
অনন্ত খুব গলা নামিয়ে বললো।
তিনজনে ঠেসাঠেসি করে পেছনে একদিকের সিটে বসে আছে । কনস্টেবল ভবানী উলটোদিকে বসে, তার চোখ বাইরের দিকে, অন্ধকারে ।
প্রায় সব দোকান বাজারের ঝাঁপ পড়ে গেছে । রাস্তায় লোক প্রায় নেইই ।
– থানায় নিয়ে যাচ্ছে…না রে প্রমথ ? সুজন ফিসফিস করে বললো।
প্রমথ চুপ করে বসে ছিলো।
এবার বিরক্ত হয়ে একটু গলা তুলে বললো, নাহ, এনকাউনটার করতে নিয়ে যাচ্ছে ! আর শোন অনন্ত, আমি ঘুষ দোব কি রে ! তোরা একটু চুপ করে থাকবি ।
এবার কনস্টেবল ভবানী ঘাড় ঘুরিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে, হাতের ব্যাটনটা ঠুকে বললো, হেই বাঙ্গালি হিরো, চুপচাপ ব্যয়ঠো ।
সামনের সিট থেকে রামশরণ সিংয়ের মুখ থেকে কথা আর ধোঁয়া একসঙ্গে বেরিয়ে এলো, শুনো হিরো লোক, ডরো মত। মারপিট কুছ নহি হোগা । আভি ইস রাত হাওলাত মে রহোগে । হামারা বস ডিপটি থানেদার দয়াল কুমার সাব আজ নাইট ডিউটি মে হ্যয় । ওহ সাব তো মাকখন সে বনা হুয়া হ্যয় । হাওলাত ঔর মুচলেকা কা বড়ে শৌকিন হ্যয়। হামারা থানামে তো মুচলেকা কা মোটা ফাইল বন গিয়া হ্যয় ! সুবে তুমহারা পাপালোগ আ কে মুচলেকা মে সাইন করকে তুম লোগোকো ছুড়াকে লে যায়েঙ্গে। এক রাত থানেকা হাওলাত মে রহোগে তো কভি হেলমেট লেনে মে ভুল নহি হোগা, ঔর বাইক কা হেড লাইট ভি ঠিক হো জায়েগা ! কিউ ভবানী ?
কথার শেষে অন্ধকারে রামশরণের খুকখুক হাসির আওয়াজ ভেসে এলো ।
– জরুর সাব…আপ ভি না…হা হা হা । এবার কনস্টেবল ভবানীর কান এঁটো-করা হাসি। আর ড্রাইভারও হাসতে হাসতে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষে গাড়িটা থামিয়ে দিলো। কল্যাণপুর থানা এসে গেছে ।
#
রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে ।
কল্যাণপুর থানার মেজবাবুর অফিস টেবিল দেখে মনে হচ্ছে একটু আগেই তার ওপরে ডিনার শেষ করেছেন। থালার ওপরে ভুক্তাবশিষ্ট, বাটি, গ্লাস টেবিল থেকে এখনও সরেনি ।
মেজবাবু দয়াল কুমার এখন একটা পায়রার পালক দিয়ে চোখ বন্ধ করে একমনে কান খোঁচাচ্ছিলেন। একটা কনস্টেবল এসে এঁটো বাসনগুলো তুলে নিয়ে গেলো।
রামশরণ টেবিলের সামনে গিয়ে পা ঠুকে স্যালুট দিয়ে বললো, জয় হিন্দ সার ।
দয়াল কুমার চোখটা খুলে দেখলেন, রামশরণ একা নয়, তার পেছনে তিন সদ্যযুবক দাঁড়িয়ে রয়েছে।
অপাঙ্গে তিনজনের দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে তিনি ধীরেসুস্থে পালকটা টেবিলের ওপরে রাখা কলমদানিতে গুছিয়ে রেখে একটা হাই তুললেন, তারপর রামশরণের দিকে তাকিয়ে বললেন,
– এরা কারা ?
– স্টুডেন্ট সার…এক বাইকমে তিন বান্দা, দোনো কা হেলমেট গায়েব…বাইক মে হেডলাইট নহি…আউর স্পীড ভি তেজ…নাকাবন্দি মে পাকড়া…তিনো ফিল্ম দেখকে ওয়াপস আ রহে থে…কাগজ বগারা সব সহি হ্যয় সার…
রামশরণ সংক্ষিপ্ত প্রশ্নের যথাসম্ভব সংক্ষেপে উত্তর দিলো।
ডিপটি থানেদার আবার একবার তিনজনকে ভালো করে দেখলেন।
তারপর ডানহাতটা বাড়িয়ে দিলেন রামশরণের দিকে ।
রামশরণ ঝটিতি নিজের পকেট থেকে প্রমথদের মোবাইল তিনটে বার করে দয়াল কুমারের প্রসারিত হাতে দিয়ে দিলো ।
প্রমথ বুঝলো, প্রথমেই আইনভঙ্গকারীদের মোবাইল নিয়ে নেওয়াটা এই থানায় একটা চালু ড্রিল এবং সেটা বেশ নিয়মিতই ফলো করা হয়!
তিনটে মোবাইলই সুইচড অফ হয়ে টেবিলের ড্রয়ারে চালান হয়ে গেলো। তারপর দয়াল কুমার এবার বাঁ হাতটা তুলে পিছন দিকে চলে যাওয়ার মতো ইঙ্গিত করলেন আর মুখে বললেন, লক আপ !
– জরুর সাব ! জয় হিন্দ !
বলে হাবিলদার রামশরণ ঘুরে উদ্ভাসিত মুখে তিনজনকে ঠেলে নিয়ে যাবার উদ্যোগ নেওয়ার আগেই প্রমথ এগিয়ে এসে বললো, থানেদার সাব, এক ছোটিসি রিকোয়েস্ট। অনেক রাত হয়ে গেছে, বাড়িতে যদি সারারাত একটা খবর না যায় তাহলে কিন্তু সকলে খুব চিন্তা করবে। হয়তো বাবা থানায়, হাসপাতালে লোক পাঠাতে শুরু করবেন। আমি ফোন করতে চাই না, আপনি বরং ফোন করে সকালে থানায় আসতে বলে দিন। আপ একদম খবর নহি দেঙ্গে তো…প্রমথ থেমে গেলো। .
দয়াল কুমার বাস্তবিক এই থানার থানাদার নন, উনি, যাকে বলে, সেকেন্ড অফিসার।
অনেক বছর প্রমোশন হয়নি, এ নিয়ে বেশ চাপা দুঃখও আছে ।
তাই প্রমথর সম্বোধনে কিছুটা কাজ হলো।
রামশরণকে ডেকে টেবিল থেকে এক টুকরো কাগজ আর পেন্সিল দিয়ে বললেন, তিনো কো সেকেন্ড লকআপ মে লে যাও আর ইস লড়কা কা ঘর কা নাম্বার লিখ লো। হাম ফোন কর দেতে হ্যয় । অগর ঘরবালে রাত মে হি আনা চাহতা হ্যয় তো হামারা কোই দিক্কত নহি । হমে কেবল মুচলেকা মে সিগনেচার চাহিয়ে ।
প্রমথ কাগজে টেলিফোন নাম্বার লিখে দিলো ।
তারপর ভবানী কনস্টেবল তিনজনকে নিয়ে লকআপে ঢুকিয়ে দিয়ে সশব্দে গেট বন্ধ করে তালা লাগিয়ে দিলো ।
ফাঁকা লকআপ। বোধ হয় চল্লিশ ওয়াটের একটা বাল্ব জ্বলছে ।
বিবর্ণ দেওয়ালে সেই কমজোর আলোর জন্য ঘরটার মধ্যে একটা বিষণ্ণ ভাব ।
এক কোণে লম্বা একটা সিমেন্টের ধাপি করা আছে।
তিনজনে ধাপিটাতে বসতে গিয়ে অনন্ত আর সুজন প্রায় একসঙ্গে বলে উঠলো, সারারাত এইখানে থাকতে হবে ?
সুজন বলল, যাই হোক, আমার কিন্তু খুব খিদে পেয়েছে মাইরি । পপকর্ণ কখন হজম হয়ে গেছে । এই প্রমথ…লকআপে খেতে দেয় না রে ? কি রে…বল না ?
– দেয় । ওই হাল্লারাজার লকআপেও তো দিয়েছিলো, মনে নেই ? প্রমথর উত্তর।
অনন্ত প্রমথর কথায় এবার রেগে গেলো, এই সময় তুই ঠাট্টা করছিস ! একটা কিছু তো কর তুই !
– ওই তো! লিখে দিলাম তো বাড়ির ফোন নাম্বার। ওই যে অফিসার, দয়াল কুমার নাম, সে ফোন করবে তো বললো। এখন সুজন বল…তোর কি খেতে ইচ্ছে করছে ?
অনন্ত বোধহয় আরও খেপে গেলো, প্রমথকে ভেঙ্গিয়ে বললো, হ্যাঁ, কি খেতে ইচ্ছে করছে! শালা ! কেন, পিৎজা খাওয়াবি, পিৎজা ? উইথ এক্সট্রা চিকেন টপিংস ?
– তথাস্তু ! প্রমথ জবাব দিলো।
৩
– রামশরণ, ইয়ে তো ল্যান্ডলাইন নাম্বার হ্যয় !
দয়াল কুমারের হাতে প্রমথর বাড়ির ফোন নাম্বার লেখা কাগজ ।
– হাঁ সার। শায়েদ ইন কা ঘর কা পাস নেটওয়ার্ক ঠিক নহি হ্যয়। স্মার্ট বান্দা, উনকো মালুম হ্যয় যে আপ তো বারবার ফোন নহি করেঙ্গে ! ইস লিয়ে মোবাইল নাম্বার কা রিস্ক নহি লিয়া।
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রামশরণের সুচিন্তিত জবাব।
– তাই হবে । ঠিক আছে, এই নম্বরটা-ই লাগাই ।
ডিপটি থানেদার দয়াল কুমার কাগজটা বাঁ হাতে ধরে টেবিলে রাখা ফোনের বোতাম টিপতে লাগলেন।
দুবার রিং হতেই ওদিক থেকে একটা ভারী গলার আওয়াজ, ‘জয় হিন্দ সাব, কলেকটার সাব কা বাংলা !’
দয়াল কুমার ভীষণ হকচকিয়ে গিয়ে ঝপাং করে ফোনটা রেখে দিলেন ।
বাঁ হাতের আঙুলের ফাঁক গলে নাম্বার লেখা কাগজটা বেরিয়ে উড়ে পড়লো গিয়ে মেঝেতে।
হাবিলদার রামশরণ তাড়াতাড়ি কাগজটা তুলে এনে টেবিলে একটা পেপারওয়েট চাপা দিয়ে বললো, কি হল সার ? ফোন লাগলো না ?
দয়াল কুমার সামলে নিয়ে বললেন, কিছু না ! তুমি ওই ছেলেটাকে লকআপ থেকে নিয়ে এসো তো…এক্ষুণি।
দুমিনিটের মধ্যে প্রমথ এসে ডিপটি থানেদারের টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে গেলো, পেছনে রামশরণ সিং ।
দয়াল কুমার একবার প্রমথর মাথা থেকে পা অবধি দেখলেন ।
তারপর পুলিশোচিত গাম্ভীর্যের সঙ্গে বললেন, থানায় ধরে আনার পর পুলিশ অফিসারের সঙ্গে ইয়ার্কি হচ্ছে ?
কিছু না বুঝেই রামশরণ পেছন থেকে বললো, ইতনা বেয়াদবি ?
প্রমথ অবাক হয়ে বললো, আমি আবার কি ইয়ার্কি করলাম স্যার ?
দয়াল কুমার এবার গলা তুলে বললেন, আমাকে উলটোপালটা ফোন নাম্বার লিখে দিয়ে চালাকি হচ্ছে ? ওই কোণায় মুরগি করে রেখে দেবো সারারাত ।
তারপর টেবিল থেকে কাগজটা তুলে নিয়ে প্রমথর সামনে বাড়িয়ে ধরে কড়া গলায় বললেন, এটা তোমার বাড়ির নাম্বার ?
প্রমথ একটু ঝুঁকে কাগজটাতে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললো, হ্যাঁ, ঠিকই তো আছে । এই নাম্বারটা আমার বাড়িতে সবসময় তোলা হয়, সেইজন্যই এটা দিয়েছি । এছাড়া আরও দুটো নম্বর আছে ।
দয়াল কুমার কাগজটা টেবিলে রেখে এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন ।
তারপর টেবিলের ওপাশে ঘুরে গিয়ে প্রমথকে এপাশ ওপাশ থেকে ভালো করে, যাকে বলে পর্যবেক্ষণ করলেন।
পুলিশের চোখ। ব্রান্ডেড সার্ট, অ্যাসিক্সের স্নিকার, হাতের দামি ঘড়ি কিছুই চোখ এড়াল না। তাঁর মনে পড়লো, ড্রয়ারে রাখা তিনটে ফোনের মধ্যে একটা তো অ্যাপল-এর ফোন ছিল ।
দয়াল কুমার ইঙ্গিতে রামশরণকে বললেন প্রমথকে লকআপে রেখে আসতে।
রামশরণ কাজ সেরে এসে বললো, সার, কোন প্রব্লেম ?
দয়াল কুমার চিন্তিত মুখে রামশরণকে ইঙ্গিত করে বসতে বললেন ।
একটু ইতস্তত করে রামশরণ সামনের চেয়ারে বসে উৎসুক চোখে বসের দিকে তাকিয়ে থাকলো ।
দয়াল কুমার সংশয়ের গলায় বললেন, ওই ফোন নাম্বার ! রামশরণ, ওটা কলেকটর সাহাবের বাংলার নাম্বার !
রামশরণ অবিশ্বাসের গলায় বললো, ইয়ে ক্যসে হোগা সার ! নহি হো শকতা। জরুর আপনার ডায়াল করতে কোন গলতি হয়েছে ! আপনি আর একবার ঠিকসে দেখকে ডায়াল করিয়ে না সার !
– বলছো ? আর একবার করবো ?
দয়াল কুমারের স্বরে বেশ সংশয়। তারপর বললেন, তুমনে শুনা ? ইনকা ঘর মে তিন ল্যান্ডলাইন নাম্বার হ্যয় বোলা ! অগর ওহ লেড়কা সচমুচ কলেকটর সাব কা কোই রিলেশন মে হ্যায় তো…
বলতে বলতে দয়াল কুমার আবার কাগজটা তুলে নিয়ে এবার চোখে চশমাটা পরে নিলেন । তারপর কাগজটা চোখের সামনে ধরে সাবধানে থেমে থেমে নাম্বারটা ডায়াল করলেন ।
– জয় হিন্দ সাব ! কলেকটর সাব কা বাংলা ! গম্ভীর গলায় উত্তর ।
– ভেরি সরি, রঙ নাম্বার ।
তাড়াতাড়ি ফোনটা নামিয়ে রেখে ডিপটি থানেদার দয়াল কুমার হেড কনস্টেবল রামশরণ সিংয়ের দিকে তাকিয়ে হতাশ ভাবে মাথা নাড়লেন ।
তারপর একটা বড়ো নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ছেলেটার নাম কি বলেছিল ? বাবার নাম জিজ্ঞেস করেছিলে ?
– নাম ! নাম তো জিজ্ঞেস করিনি সার! লাইসেন্স কা ফটো ম্যাচ হো গিয়া তো…
এবার দয়াল কুমার রেগে গেলেন। গলা চড়িয়ে বললেন, নাম জিজ্ঞেস করোনি, ঠিকানা, বাবার নাম কিছুই চেক করোনি, আর তুলে নিয়ে চলে এসেছো ! আশ্চর্য তোমার বুদ্ধি ! এরা সব বাঙ্গালি তো…তাই না ? কানপুরের সব থানা জানে আভি ইহাঁকা কলেকটার সাহাব বঙ্গাল সে হ্যায় ! মাথাটা খাটাও রামশরণ। তুমি তো দেখছি হেড কনস্টেবল হয়েই রিটায়ার করবে !
– সার তিনজন ছিল…আর নাকাবন্দির টাইমও শেষ হয়ে গেছিলো…তভি জলদি মে…
– একদম চুপ ! যাও, আভি উন লোগোকো লে কে আও । ছি ছি ছি ! কেয়া গজব কি বাত ! আগে কলেকটর সাহেবের সঙ্গে এদের কি সম্পর্ক সেটা জেনে নাও। যাও ।
দু মিনিটের মধ্যে রামশরণ দেঁতো হাসি হাসতে হাসতে তিনজনকে নিয়ে ঢুকলো, সার, আমাদের খুব ভুল হয়ে গেছে, এই প্রমথবাবু হচ্ছেন কলেকটর সাহাবের একলৌতা বেটা আর দুই দোস্ত, তিনোই ইঞ্জিনীয়ারিং স্টুডেন্ট হ্যয়। আমার তো প্রথম থেকেই মনে হচ্ছিলো এরা সব বড়ো ঘরের স্মার্ট ছেলে। কিতনা আদব…কিতনা কায়দাদুরস্ত !
দয়াল কুমার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হেসে বললেন, আরে, রামশরণ কা কিতনা ভারি গলতি ! আও আও বেটে, তুমলোগ ইধার ব্যয়ঠো। বড় পরিবারের ছেলেরা সব…আগে তো শানদার ইঞ্জিনিয়ার বনোগে । দেখো তো, আমার হাবিলদারের কতো বড়ো ভুলের জন্য তোমাদের কতো তকলিফ হলো।
প্রমথ পেছনে অনন্ত আর সুজনের দিকে ফিরে চোখটা টিপলো ।
তিনজনে চেয়ারে বসার পর দয়াল কুমার আবার বললেন, আরে, তোমরাও তো নিজেদের নাম ঠিকানা বলোনি। তাই তো এই ভুল…বড়া গজব…হা হা হা…নয়া কমেডি অব এররস ! জুতসই একটা কথা বলতে পেরে দয়াল কুমার একটু হালকা বোধ করতে লাগলেন ।
– আপনার হেড কনস্টেবল রামশরণজি তো কিছু বলার সুযোগই দিলেন না । ঠেলেঠুলে জীপে উঠিয়ে নিলেন ।
প্রমথ পেছনে একবার রামশরণ হাবিলদারের দিকে তাকিয়ে বললো।
রামশরণের মুখ দেখে তখন মনে হচ্ছে নিজের নামকরণের সার্থকতা প্রমাণ করার জন্য প্রয়াস করছে !
দয়াল কুমার হাত নাড়িয়ে উড়িয়ে দেবার ভঙ্গি করে বললেন, আরে ভুলে যাও ওসব। রামশরণের থেকে আমি পরে একটা জবরদস্ত মুচলেকা নিয়ে নেবো, যাতে ও ভবিষ্যতে পুরো পরিচয় না জেনে কখনও কাউকে জীপে না তোলে । ঠিক তো, রামশরণ ?
– জরুর সার । বেটে, হামারা বেওহার সে ম্যয় বহত শরমিন্দা হু, সচমুচ !
রামশরণ প্রায় হাতদুটো জড়ো করে ফেলে আর কি !
– ব্যস ব্যস ! এই তো সব ঠিক হয়ে গেলো ! রামশরণ, এখন তো এদের ডিনারের সময় পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ । নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে তোমাদের ? কি খাবে বলো ?
শেষ দুটো প্রশ্ন দয়াল কুমার প্রমথর দিকে তাকিয়ে করলেন।
প্রমথ ঝটিতি একবার পাশে-বসা সুজনের দিকে তাকিয়ে নিলো । তারপর বললো, পিৎজা পাওয়া যাবে তো…না ? এই এতো রাতে এখন ওটাই…
প্রমথর মুখের কথা প্রায় কেড়ে নিয়ে দয়াল কুমার বললেন, হাঁ হাঁ, জরুর ! কিউ নহি…কিউ নহি ! তোমাদের বয়েসে এখন ওটাই বেস্ট খাবার। রামশরণ ?
রামশরণ দাঁড়িয়েই ছিল । হাতের ঘড়িটা দেখে নিয়ে বললো, এই সময়ে ওই আসরা মল-এই কেবল ফুড কোর্ট খোলা থাকবে সার।
– তবে ভবানীকে এক্ষুণি পাঠাও, গাড়িটা দিয়ে । তিনটে নন-ভেজ পিৎজা, মিডিয়াম সাইজ । না, এক মিনিট, ভবানীকে দিয়ে হবে না, রাত হয়ে গেছে, তুমি নিজেই যাও । ফুড কোর্টের ফোন নাম্বার থাকলে কাউকে বলো ফোনে আগে অর্ডার করে দিতে। তুমি বেরিয়ে যাও।
– জি সার।
রামশরণ স্যালুট করে হল থেকে বেরোতে যাবে, এমন সময় অনন্ত চেয়ার থেকে উঠে বললো, রামশরণজি !
রামশরণ ঘুরে দাঁড়িয়ে গেলো ।
– বলবেন তো পিৎজাতে যেন চিকেনের এক্সট্রা টপিংস দিয়ে দেয় !
৪
কল্যাণপুর থানার স্টেশন হাউস অফিসার, মানে লোকাল ভাষায় থানেদার, তাঁর চেম্বারেই কেবল এয়ারকন্ডিশনার আছে ।
ঠাণ্ডা ঘরে বসে তিনজনে একটু আগে গরম গরম পিৎজা শেষ করেছে ।
– থিনক্রাস্ট পিৎজা ! বেশ কিছুদিন বাদে খেলাম । একেবারে জমে গেছিলো রে ! ঘরের লাগোয়া বাথরুমটা থেকে বেরিয়ে রুমালে হাত মুছতে মুছতে সুজন বললো।
– হ্যাঁ, টপিংসও ছিল ভালোরকম, ইন্টেন্স । আফটার অল, থানার অর্ডার ! অনন্তর মন্তব্য ।
প্রমথ কোক-এর ক্যানটাকে মুখের কাছে উঁচু করে ধরে শেষ করে ফেললো ।
তারপর বললো, থিন ক্রাসটের ব্যাপারটা কাকতালীয় হবে। মনে হয় না ওটা রামশরণের মস্তিষ্কপ্রসূত। সে যাকগে যাক । আমাদের নৈশ অ্যাডভেঞ্চার এবার শেষ করতে হবে । চলো এবার উঠে পড়ি । এখন আবার এই গভীর রাতে সাত-আট কিলোমিটার বাইক ঠ্যাঙ্গাও!
তিনজনে থানেদারের চেম্বারের বাইরে আসতেই হলের মধ্যে দয়াল কুমার হাঁক দিলেন, রামশরণ, গাড়ি লাগাতে বলো।
দূর থেকে আওয়াজ এলো, জি সার ।
প্রমথরা তিনজনে চোখ চাওয়াচাওয়ি করছে ।
দয়াল কুমার ওদের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা বোধহয় বুঝতে পেরে অপ্রস্তুত হাসি হেসে বললেন, বেটে, আমাদের একটা বড়ো ভুলের জন্যে তোমাদের অনেক তকলিফ হলো । এখন তোমাদের ঠিকঠাক বাড়ি পৌঁছে দেওয়াটা আমার কর্তব্য । তিনজনেই কলেকটর সাহাবের বাংলাতেই যাবে তো ?
বলে ড্রয়ার থেকে দয়াল কুমার মোবাইল তিনটে বার করে ওদের হাতে দিলেন ।
প্রমথ মোবাইলগুলো যে যার হাতে দিয়ে বললো, হ্যাঁ ওরা তো আজ রাতে আমাদের ওখানেই থাকবে। কিন্তু আপনি আবার কেন…আচ্ছা ঠিক আছে, আপনি যখন ইনসিস্ট করছেন । কিন্তু আমার বাইকটা ?
– ও তো আমার কোই ভি স্টাফ গাড়ির সাথে সাথে নিয়ে যাবে । লেকিন এক রিকোয়েস্ট আছে বেটা।
শুনে তিনজনেই ডিপটি থানেদার দয়াল কুমারের মুখের দিকে একসাথে তাকালো ।
দয়াল কুমার একটু ইতস্তত করে বললেন, আজকে রাতের পুরো ঘটনাটা যদি একেবারে গোপন রাখো তাহলে সকলের জন্যই ভালো হয়। আর ওই কারণেই থানার গাড়ি বাংলার কিছু আগেই তোমাদের নামিয়ে দেবে…মানো ইয়ে শ গজ পহেলে ! সমঝ রহে হো না বেটা ?
প্রমথ দুই বন্ধুর দিকে একবার তাকালো । তারপর একটু হেসে বললো, জরুর। আপ চিন্তা মত করিয়ে…এহসাহি হোগা ।
#
জীপ চলছে । এবার চালকের আসনে হেড কনস্টেবল রামশরন । পাশের সীটে প্রমথ।
পেছনে বসে অনন্ত আর সুজন ।
নির্জন ফাঁকা রাস্তায় হু হু করে পুলিশের গাড়ি চলছে ।
জীপের পেছন পেছন আসছে প্রমথের বাইক।
বাইকের হেডলাইটের আলো কেঁপে কেঁপে জীপের ভেতরে পড়ে একরকম আলোছায়ার খেলা খেলছে।
কানপুর শহরের কলেকটারের বাংলা বোধহয় সব পুলিশের চেনা ।
যেরকম স্পিডে জীপটা যাচ্ছে তাতে দুতিন মিনিটের মধ্যেই গন্তব্যস্থান এসে যাবে।
অনন্ত প্রমথর কানের কাছে মুখ নামিয়ে বললো, সব তো হলো, বাড়িতে কি বলবি ? – বাইকের টায়ার পাংচার আর ফোনের ব্যাটারি শেষ ! প্রমথর সংক্ষিপ্ত উত্তর ।
– সহি আইডিয়া সার! ড্রাইভারের সিট থেকে রামশরণের মন্তব্য ।
ওর মুখে এই প্রথম সার সম্বোধন শুনে প্রমথ মনে মনে হাসলো।
বাংলো থেকে একটুখানি দূরে এসে রামশরণ জীপটা রাস্তার বাঁদিকে এনে দাঁড় করিয়ে নীচে নেমে দাঁড়ালো । সকলে এক এক করে নেমে এলো ।
বাইকটা পেছনে কিছুটা দূরে এসে দাঁড়িয়ে গেছে । কনস্টেবল বাইকটা স্ট্যান্ডে সাবধানে দাঁড় করিয়ে চাবিটা স্টার্টিং স্লটে ঢুকিয়ে দিলো । তারপর জীপের ড্রাইভারের সিটে এসে বসলো ।
অনন্ত আর সুজন এগিয়ে গেছে বাইকের দিকে । প্রমথ রামশরণকে থ্যাঙ্ক ইউ বলে এগোতে যাবে, রামশরণ বললো, একটা কথা বলবো সার ।
প্রৌঢ় মানুষ, প্রমথ দাঁড়িয়ে গেলো, বলুন না ।
– আপনারা তো ইংরেজি ফিলিম দেখতে গিয়েছিলেন ?
– হ্যাঁ । কেন ?
– না…মানে আমরা তো ইংরেজি ফিলিম দেখি না, হিন্দি দেখি । তাই ওই হিন্দি ছবির মতো বলছি আর কি…আল ইজ ওয়েল সার !
প্রমথ এবার একটু চমৎকৃত হোল, বললো, হ্যাঁ, ইংরেজিতে বলে, অল ইজ ওয়েল দ্যাট এন্ডস ওয়েল ! ঠিক আছে । বলে হাতটা নেড়ে প্রমথ বাইকের দিকে এগিয়ে গেলো ।
রামশরণ গাড়িতে উঠতেই জীপটা স্টার্ট দিলো ।
প্রমথ বাইকের কাছে আসতে অনন্ত জিজ্ঞেস করলো, কি অতো কথা তোকে বলছিলো রে রামশরণ ?
প্রমথ হেসে বললো, পার্টিং সারমন…বললো, হিন্দি ছবির মতো হলো সার, অল ইজ ওয়েল !
অনন্ত শুনে এক মুহূর্ত কি যেন ভাবলো ভুরু কুঁচকে। তারপর বললো, ওই রামশরণ এই কথা বললো ?
– হ্যাঁ তো !
– হুম ! শোনো, এখানকার লোকেদের এতো সোজা মানুষ ভেবো না, ডবল মিনিং-এ কথা বলতে এরা খুবই ওস্তাদ । হোস্টেলে সবসময় শুনছি। অনন্তর মন্তব্য ।
– কেন ? কি আবার হোল ! প্রমথ কিছুটা অবাক।
– ‘আল ইজ ওয়েল’ ! শালা ! ওই গানের ফিল্মটার নামটা কি ?
– ফিল্মের নাম ? কেন, থ্রি ইডিয়টস ! থ্রি…ওহ, তাই তো…আমরা তো তিনজনই !
– তবেই বোঝো ! পারটিং সারমন মাই ফুট !
প্রমথ ভুরু কুঁচকে কিছুটা অবিশ্বাসের চোখে দূরে পুলিশ জীপটার অপস্রিয়মান লাল আলোটার দিকে তাকিয়ে থাকলো ।
[মতামত ও বানানবিধি লেখকের ব্যক্তিগত]
Tags: কৃকলাশ, গল্প, সিদ্ধার্থ সান্যাল
email:galpersamay@gmail.com
ত্রিদিবেশ বন্দ্যোপাধ্যায় on October 5, 2024
চমৎকার গল্প। নাকা চেকিং, পুলিশের কথোপকথন, থানার পরিবেশ এবং ডিটেলের কাজ লেখক সুন্দর ফুটিয়েছেন। গল্পটা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ঊঠেছে। পড়ে মজা পাওয়া গেল।
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।