মানুষের মনের ভিতরের যে অন্ধকার, যে আসুরিক প্রবৃত্তি তাকে দমন করবার ভেতর দিয়েই এগিয়েছে আমাদের সভ্য হওয়ার ইতিহাস। কিন্তু এই সভ্য হয়ে ওঠবার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করতে যে এখনো বহু যোজন পথ পাড়ি দিতে হবে তা বুঝতে কোন অসুবিধা হয় না। অতি সাম্প্রতিক কালের ভয়ানক নারী নির্যাতনের ঘটনা এক নিমেষে সভ্যতার আপাত পরিশীলিত মুখোশকে ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে ভেতরের কদর্য, ভয়ঙ্কর, আসুরিক চেহারাটা সবার চোখের সামনে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। সভ্যতার বড়াই করা অন্তঃসারশূন্য সমাজের আসল মুখটা প্রকাশ করে দিয়েছে জনসমক্ষে। এমতাবস্থায় কোন সত্যিকারের সভ্য মানুষের পক্ষে আয়নার সামনে চোখ তুলে তাকানোর অধিকার থাকে না। আর সবথেকে বড় কথা হল যতই গণতন্ত্রের বড়াই আমরা করি না কেন, শেষ পর্যন্ত ওই অসুররাই ক্ষমতা দখল করে আমাদের মাথার ওপরে চড়ে বসেছে এইকথা আজ দিনের আলোর মত স্পষ্ট। আমাদের পরম আরাধ্যা দেবী দুর্গার সৃষ্টিও এই অসুরকে বিনাশ করবার জন্যই। কিন্তু মানুষের ভিতরের এই যে অসুর, তারা আছে দেশে দেশে, কালে কালে। গ্রীক পুরানে এই অসুরদের নাম টাইটান। সেখানেও তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন এক নারী। তাঁর নাম দেবী এথেনা।
দেবরাজ জিউস অসুর বা টাইটানদের বন্দী করে রেখেছিলেন টারটারাসের অন্ধকূপে। সেখান থেকে মুক্ত হয়ে টাইটানেরা আক্রমন করল দেবদেবীদের আবাসস্থল অলিম্পাসের ওপর। দেবদেবীরা সেই আক্রমনের মুখে কোণঠাসা হয়ে পড়লেন এবং স্বর্গ অর্থাৎ অলিম্পাসের অধিকার হারাতে বসলেন। এই সময় আবার দেবী হেরা ভবিষ্যবাণী করলেন যে এই অসুরদের নিধন করা দেবতাদের সাধ্য নয়। এক সিংহচর্ম আবৃত মানব সন্তান পারবেন টাইটানদের দমন করতে যার নাম হারকিউলিস। এই অসুরের দল অমৃতের সন্ধানে যখন মর্তের বুকে অভিযান চালাবে, সেই সময় তাদের আক্রমন করে পরাস্ত করতে হবে। এই কথা শুনে বিপন্ন দেবরাজ জিউস দেবী এথেনার স্মরনাপন্ন হলেন। এথেনা সেই সিংহ পুরুষের সহায় হয়ে তাকে নিয়ে টাইটানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামলেন । দেবী এথেনার বর্শার আঘাতে নিহত হল মহা পরাক্রমশালী অসুর এনসেলাডাস। তার দেহ সমুদ্রে মিশে গিয়ে তৈরি হল সিসিলি দ্বীপ । এদিকে সিংহ চর্ম পরিহিত বীর হারকিউলিস বধ করল অ্যালসিয়োনিউস, পোরফাইরিয়ন ইত্যাদি টাইটান বা অসুরদের। দেবরাজ জিউস তাঁর বজ্রের আঘাতে বধ করলেন অন্য অসুরদের। এইভাবে টাইটানদের পরাজিত করে স্বর্গ বা অলিম্পাসের অধিকার ফিরে পেলেন দেবতারা। গ্রীস দেশের এই পৌরাণিক দেবদেবী এবং টাইটানদের যুদ্ধের কাহিনী নিয়ে প্রগমনের মন্দিরে তৈরি হল হাই রিলিফ ভাস্কর্যের অল্টার। যীশুর জন্মের দেড়শো বছর আগে। দুহাজার বছর পরে সেই ভাস্কর্যের প্যানেল যখন মাটি খুঁড়ে আবার আবিস্কার করা হল, সেখানে আমরা দেখতে পেলাম এই যুদ্ধের দৃশ্য। দেবী এথেনা চুলের মুঠি ধরে বধ করছেন অসুর এনসেলাডাসকে। দেবীর সাপ নাগপাশে আবদ্ধ করেছে এই টাইটানকে । সে হাঁটু মুড়ে দেবীর পায়ের কাছে বসে পড়েছে এবং মুক্তি পাওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। তার শরীরের প্রতিটি মাংসপেশি টানটান হয়ে রয়েছে।
পুরাণের গল্প এক আশ্চর্য বিষয়। দেবরাজ জিউসের কাতর আবেদনে সাড়া দিয়ে দেবী এথেনা যেমন সিংহ চর্ম পরিহিত বীর হারকিউলিসকে নিয়ে বধ করেছিলেন এনসেলাডাস, অ্যালসিয়োনিউস, পোরফাইরিয়ন ইত্যাদি টাইটানদের এবং দেবতাদের ফিরিয়ে দিয়েছিলেন অলিম্পাসের অধিকার ঠিক সেইভাবেই আমাদের দেবী দুর্গা তাঁর সিংহ বাহনকে সঙ্গে নিয়ে মহিষাসুর নিধন করে দেবতাদের স্বর্গে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। ভারতীয় প্রাচীন মূর্তিকলায় যেসব মহিষাসুরমর্দিনীর মূর্তি বা ছবি পাওয়া গেছে সেখানে কোথাও পেশীবহুল অসুরের চেহারা দেখা যায় না। কিন্তু আমরা সাধারন ভাবে এখন বারোয়ারী পুজোমন্ডপে যেসব দেবী মূর্তি দেখি তাঁর পায়ের কাছে হাঁটু মুড়ে বসে থাকা নাগপাশে আবদ্ধ যে পেশীবহুল মহিষাসুর অবস্থান করে সে তাহলে কিভাবে এল ? এদেশে ব্রিটিশদের আগমনের পরে তাদের সঙ্গেই প্রাচীন গ্রীক, রোমান এবং অনান্য ইউরোপীয় শিল্পের নমুনা সহ বইপত্র কলকাতা শহরে আসতে শুরু করে। গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুল তৈরি হওয়ার পরে ভারতীয় শিল্পীদের অনেকেই ইউরোপীয় ধারায় অসাধারন দক্ষতা অর্জন করেন। এরপরে কিভাবে একদিন গ্রীক শিল্পের শ্রেষ্ঠ উদাহরনগুলি পৌঁছে যায় আমাদের মৃৎশিল্পীদের কাছে। তাঁদেরই কারোর হাতে ঘটে যায় দেবী এথেনা আর টাইটানদের সঙ্গে দেবী দুর্গা আর মহিষাসুরের আশ্চর্য শৈল্পিক সংশ্লেষ। প্রগমনের মার্বেল খোদাই রিলিফ ভাস্কর্য আর আমাদের কুমারটুলিতে নির্মিত কৈলাসবাসিনী দেবী দুর্গা মিলেমিশে এক হয়ে যান। এইভাবেই দেশে দেশে, কালে কালে চলতে থাকে আনন্দময়ী মহামায়ার চিন্ময়ী কে মৃন্ময়ীতে আবাহন।
[মতামত ও বানানবিধি লেখকের ব্যক্তিগত]
Tags: অ্যালসিয়োনিউস, গল্প, দেবরাজ গোস্বামী, দেবী আছেন ওদেশেও
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।