গল্প আছে ?- রিষড়ার বাঙ্গুর পার্কের ফ্ল্যাটের সান্ধ্য দ্বিপাক্ষিক আড্ডার মধ্যেই হটাৎ প্রশ্নটা ছুড়েছিল কলকাতার একটি নামী সংবাদপত্রের সাব এডিটর পীযুষ আশ।
গল্প তো আছেই ? খাস্তা, বাসি, টাটকা কোন গল্প শুনতে চাস বল?- চটজলদি পালটা প্রশ্ন ছুঁড়লো লেখক সদানন্দ।
সবেমাত্র আই বি- র লার্জ পেগটা শেষ করে গ্লাস নামিয়েছে। সন্দিপনীয় ভাষায় উৎসব শুরু হয়েছে শরীরে। রিষড়ার ফ্ল্যাটের পানাড্ডার মজাই আলাদা। প্রেস ক্লাবের আড্ডা থেকে ফিরতে হলে একটা চাপ থাকে সবসময় ।কোথায় সেই অক্ষর শহর – আর কোথায় চার্ণক সিটি ? আজ ফেরার তাড়া নেই। সিগারেট ইদানিং ছেড়েছে সদানন্দ। রক্তের চাপ আর টান বড় মারাত্মক। কাউকে পরোয়া করে না।
নতুন লার্জ পেগটা বানাতে বানাতে ঠোঁটের কোণে সিগারেটটা চেপে নিয়ে মুখে রোমান্টিক হাসি ছড়িয়ে দিল সাংবাদিক – অনেক হয়েছে। এখানে ওখানে প্রচুর ঘুরেছ লেখা নিয়ে নিয়ে।নতুন একটা পেজের দায়িত্ব পেয়েছি। শনিবাসরের গোটা পেজের।ওখানেই একটা গোটা সেকশান আছে – আস্ত একটা গল্প। মাসে একটা করে অন্তত গল্প দাও। সিরিয়াসলি বলছি। নো বাজারি- অনেক ভাল গল্প হাবিজাবি নানা জায়গায় দিয়েছ।এবার আমাদের দাও।
গল্প তো দেবই।কোন গল্প চাস বল? মাতালের পাতাল প্রবেশ থেকে চাতালে মাতালের নৃত্য সব দেব ।- হাতে গ্লাস তুলে নিতে নিতে কথার ককটেল মেলাতে চাইল যেন লেখক।
বাহ্, চার্জ ভালো হয়েছে দেখছি।শোনো, এখনই গ্লাস হাতে কমিট করো-বলে লেখকের সামনে থেকে গ্লাস তুলে নিল অমৃতের ছাই।
ইদানিং তাকে এ নামেই সাংবাদিককে ডাকে লেখক। সবার নামের অর্থ খুঁজে আরেকটা নাম দেওয়া সদানন্দর বহু পুরোনো অভ্যেস।
অবশেষে আচ্ছা চেষ্টা করবো বলে জলপথে ডুব মারার চেষ্টা।সবশেষে ডুব সাঁতারে বহু দূর ভেসে যাওয়া।এভাবেই ভাসতে ভাসতে লেখক সদানন্দ মিত্র ভেসে উঠলো বিকেলের প্রতিদিনের আস্ত একটা গল্পের ভূখণ্ডে। নগদ কিছু পয়সা হাতেও এলো। তারপর মনে হলো কবিতা নিয়ে কখনো এভাবে টাকাপয়সা দেয় নি কেউ। তবে এটাই বা মন্দ কি!! টানাটানির সংসারে লিখতে লিখতে অনেকটা- বোঝা গেল, সত্যি সত্যিই গল্পের মধ্যেই যখন গল্প আছে তখন গল্পের ভূখণ্ডেই খোঁজ করে দেখা যাক কিভাবে গল্প আছে?
২
এখন কেউ আর করে না। আগে করত। বাড়িতে বা পাড়ায় পাগলা পাগলা অ্যাব টাইপের লোক থাকলে দূরের টিকিট কেটে ভুলিয়ে ভালিয়ে পকেটে টিকিট গুঁজে দিয়ে ট্রেন ছাড়ার আগে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসত। সাংবাদিক প্রায় তাই করেছিল লেখককে। সেই গাড়ি ছাড়ার আগে শুধু বলেছিল -উঠে পড়। গল্পের গাড়িতে। গাড়িই তোমায় নিয়ে যাবে গল্পের দেশে। সেখানেই পাবে রসদ। তুলে আনো আমাদের জন্য।
কথা শেষ হওয়ার আগেই গাড়ি দিল ছেড়ে।
গাড়িতে উঠে লেখক দেখল যাত্রীরা সবাই গল্প পড়ছে বা শুনছে। হঠাৎ ভোরের দিকে গাড়ি দাঁড়াল এসে একটা স্টেশনে, নাম অক্ষর-শহর।প্ল্যাটফর্মে আলাপ হল মেদহীন লম্বা শরীরের একটা দাড়িওয়ালা ছেলের সাথে।সিগারেট মদ খায় না।লেখক তো বেশ অবাক। লেখকের আরেক অগ্রজ কবি বন্ধু রবীন চট্টোপাধ্যায় যৌবনে শিখিয়ে ছিল – ফার্স্ট আলাপ করতে হবে।চেনা অচেনা সবার সাথে।সব সময়। কথা বলতে হবে। পথেই দেখবে কত গল্প ঘুরছে। কত রকম সকম।জানবি চার্লস ডিকেন্স শুধু রাতে পথে পথে হাঁটতেন, আলো আঁধারির গল্প শুনবেন বলে।বলতেন, রাতের আঁধারে নাকি চরিত্রদের গল্প ভাল বোঝা যায়।লেখকও তাই আলাপ জমালো আগন্তুকের সাথে। জানল – ওর নাম সমীর,গল্প-গাড়ির চালক চিন্ময় আর পার্থর পুরোনো বন্ধু।ওদের ডাকে সাড়া দিয়েই সওয়ারী হয়েছে।
লেখক তার স্বভাব দোষেই ওকে বলল তুমিই তো গল্পের দুনিয়ায় খোলা বাতাস গো।তুমিই পারবে গল্পের ফাঁক-ফোকড়ের শূন্যস্থান ভরাট করতে।
আড্ডা আর গল্পের মধ্যেই গাড়ি ছুটছে। আর বাঘা বাঘা স্টেশনে থামছে। শিমুলতলা, ধূলভূমগড়, রাজাভাতখাওয়া – সব পছন্দের স্টেশন।কোনো রুট নেই। কারো কোনো চিন্তাও নেই। শুধু যেন এক গল্পের ভূতে পেয়েছে।মাঝে মাঝে চা ,কফি, জল,খাবার দিয়ে যাচ্ছে নানা লোক কোথা থেকে কে জানে।
অবাক হয়ে লেখক জিজ্ঞেস করল-এখানে সব সময় কি তাহলে গল্পের সময়?
সমীর বলল – তাই তো দেখছি। তুমিও গল্প বল।সবাই বলছে।
লেখক বলল- কিভাবে?
সমীর বলল – যেভাবে আমরা বলি গাছে গাছে পাতায় পাতায় ফুলে আর ফলে – ঠিক সেই ভাবে।
সদানন্দ বলল – আমরা কারা?
সমীর বলল- এই গাড়ির সওয়ারীরা।সবাই তো গল্পেই আছি।গল্পের সময়ের গাড়িতেই যাচ্ছি।
লেখক বলল – কোথায়? কেন? তেপান্তরের মাঠের শেষে সেই মন কথার দেশে।
সদানন্দ মোহিত হয়ে গেল ওর কথা শুনে।ওখানে কি আছে?
তোমার খোঁজ।তোমার গল্পের ফর্মুলার খোঁজ।মানে গল্পের রেসিপি।
-কারা যায় গো সেখানে?
-সারা বিশ্বের বাঙালি। ঠিক আমাদের মতন।
অবাক লেখক জিজ্ঞেস করল – গোটা বিশ্বের বাঙালি?
অবশ্যই।এ গাড়িই হয়ে যায় এক গল্পের উঠোন।
আর এ গাড়ি চালায় কে?-বিষ্মিত সদানন্দর প্রশ্ন।
কেন? আমাদের চালক চিনু দা, চিন্ময়।
লেখক দেখল পাশে দাঁড়িয়ে একজন হাসছে।ছোট্ট মানুষ চিদানন্দময় চিন্ময় তাহলে ইনিই।মিষ্টি হাসিমুখে যেন লেগেই আছে।বলল-এসো তোমাকে এই গল্পের গাড়িতে স্বাগত।
লেখক অবাক।ছোট্ট মানুষ চিন্ময়ের পেছনে মহাকাশ যাত্রীর মত উড়ন্ত সাদা চুল ভর্তি মাথায় জট ছাড়াবার মতন হাত বোলাচ্ছে একজন। দেখতে অনেকটা আইনস্টাইনের মতন।
কবির সন্দেহ হল- এ গাড়িটা নিশ্চয়ই যাদু গাড়ি।বা সময় গাড়ি। সময় বোঝা যাচ্ছে না তাই। ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে না।
চিন্ময় সাদা চুলের ভদ্রলোককে দেখিয়ে বলল- ইনি এইগল্পের গাড়ির প্রধান চালক, আমাদের গুরু – অর্জুন। ড্রাইভারের পাশে বসে গাড়িটাকে ঘোরাচ্ছে এগোচ্ছে, পিছোচ্ছে।অসাধারণ কন্ঠে অর্জুন বলল – না না আমি পার্থ ওরা ওরকম বলে।
ঠিক সেই সময় পাশের কোচ থেকে চোখে চশমা দিয়ে এগিয়ে এল এক মহিলা।একটু হেসে বলল – আমি এ গাড়িতে বন্ধুত্বের গল্প শোনাই।তাই মিতালি।
লেখক দেখল তার পাশে চশমা পরা খোঁচা খোঁচা দাড়ির বিপ্লবী চেহারার একটা ছেলে ওকে মাপছে। চোখে চোখ পড়তেই বলল- আমি এ গাড়ির যান্ত্রিক ত্রুটি বিচ্যুতি দেখি। আর অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা দেখি।
লেখক ওর নাম জানতে চাইল।
চিন্ময় জানাল- ও অগ্নি দেবতার বরপুত্র অগ্নিশ্বর।আরও বলল- ওর সঙ্গে আর একজন আছে।এ গাড়ির যাত্রীদের দেখভাল করে বিবেক ও মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে রাখে।তার নাম জাগরণ পরে আলাপ হবে জাগরণদার সঙ্গে।এখন লাস্ট কমাপার্টমেন্টে গেছে,একটা কাজে।
লেখকের খুব ভাল লাগল। নানা বিভাগের দায়িত্বে নানা লোক। বেশ একটা পরিবার -পরিবার ফিলিংস হল।সব কিছু দেখে প্র্যাকটিক্যালি ভেবলে গেছে সদানন্দ। হঠাৎ গাড়িটার গতি বেশ কমে এল। পাহাড় ঘেরা একটা মিষ্টি স্টেশনে ঢুকছে।অবশেষে থামল গাড়ি।
পার্থ মাথার চুলে হাত বুলিয়ে বলল – চল চা খাই।ঐ তো স্টেশনে বিমল দা।
লেখকও নামল মন্ত্রমুগ্ধের মতন।স্টেশন সহজপুর।আগের স্টেশন গেছে ঘাটশিলা।
সদানন্দ জিজ্ঞেস করল – কতক্ষণ দাঁড়াবে? কিভাবে আসছে স্টেশনগুলো?
পার্থ বলল – যতক্ষণ তুমি বা আমরা চাইব।আর যেভাবে চাইব।
বিস্মিত লেখক প্রশ্ন করল – সে কি! এ গাড়ির টাইম টেবিল নেই; সময় মানে না?
পার্থ হাসতে হাসতে বলল – না গো। এটা তো গল্পের গাড়ি।গল্পের গাড়ির কোনো সময় জ্ঞান থাকে না।এখানে তাই সব সময় গল্পের সময় হয়।গল্প অনুযায়ী আর গল্পের মর্জি অনুযায়ী সময় দৌড়ায়। গাড়ি চলে গল্পের খেয়ালে। প্রত্যেকের ইচ্ছার গল্প মেনে যে কোনো দিকে যায়। আর তার পছন্দের স্টেশনে দাঁড়ায় তার মনের গল্প বলতে বা শুনতে।
সদানন্দ বলল – বাহ দারুণ তো।
সমীর বলল – কি করবে? অনেকে নেমে হাঁটছে পাহাড়ের দিকে। গাড়ি তো দাঁড়িয়ে যাবে।
পার্থ বলল – চলো আমরাও হাঁটি, ঐ পাহাড়ের পাশের লেকের দিকে।
লেখক বলল – এই এতক্ষণ এই গাড়ি দাঁড়ালে অসুবিধা হবে না। অন্য গাড়ির যাতায়াত আটকাবে না?
পার্থ বলল – গল্পের গাড়িতে অসুবিধা হয় না।
লেখক বলল – কেন?
পার্থ বলল – এখানে সবাই গাল-গল্পের সওয়ারি।তাই এখানে শুধুই গল্প আছে।
৩
হাঁটতে হাঁটতে লেকের ধারে ওরা গেল।কত পাখি।লেকটার এধার ওধার দেখা যায় না।অনেকটা মংলাজুলির মতন।বার্ড-স্যানচুয়ারি যেমন হয়।গাড়ির থেকে নেমে ওখানে অনেকে ফটোগ্রাফি করছে।দূরে ছোট ছোট টিলার মতন পাহাড়ের সারি।সমীর বলল – দেখো,এখানেই রয়েছে কত পাখিদের অজানা অচেনা গল্প।
সদানন্দ জিজ্ঞেস করল – এভাবে সব সুন্দর স্টেশনে দাঁড়াবে?
পার্থ বলল – বেশির ভাগ যাত্রীর পছন্দ মিলে গেলে দাঁড়াবে।
কিভাবে বুঝবেন?
ওখানেই তো গল্প। মনের গল্পগুলো সব জানাজানি হয়ে যায় এ গাড়িতে উঠলে পরে।
ফেরার পথে ট্রেনটায় ওঠার আগে স্টেশনে দাঁড়িয়ে ট্রেনটাকে লক্ষ্য করছিল লেখক সদানন্দ। অনেকটাই মিটার গেজ ছোট ট্রেন গুলোর মতন দেখতে। অনেকটা যেন কু ঝিকঝিক টয় ট্রেন। ছটার মতন কূপ। প্রত্যেক কূপে আলাদা আলাদা গ্রুপ। আলাদা আলাদা বন্দোবস্ত। কোনো কূপে গল্প পাঠ হচ্ছে অডিওতে।কোনটাতে আবার লেখকরা বা পাঠকরা গল্প বলছে নিজেরাই। কোনটাতে শুধুই বই পড়ছে লোকে।লাইব্রেরির মতন শান্ত নীরবতা।প্রত্যেকটা কূপের যোগাযোগ থাকলেও বেশ সাউন্ডপ্রুফ।এ কূপের আওয়াজ ও কূপে যায় না।ভারি সুন্দর বন্দোবস্ত। গাড়িটার কূপগুলোতে ঘুরতে লাগলো লেখক। সবাই প্রায় ওর পরিচিত। সব গল্পখোররাই এই গাড়িতে উঠেছে।
কেবল ওদের মতন গল্পের লোকেদেরই দেখা গেল, তা নয়।একটা কূপে উঠে অবাক হয়ে দেখল উজান নাট্যদলের তপন মোদককে।লাইব্রেরিতে বসে গল্প থেকে নাটক লেখার মত্ত।হাত নাড়ল।
আর একটাতে উঠে দেখল অডিও স্টোরি চলছে।তাতে গল্প পাঠ করছে সদানন্দের অডিও গল্পের অন্যতম পাঠিকা পিয়ালি।ওর পুরো প্রোডাকশন টিমের সবাই প্রলয়,সৌমেন,সুমিত সবাই নানা কাজে ব্যস্ত।
পরের কোচে ঢুকতেই দেখে কম্পিউটারে নানা গল্প কম্পোজ হচ্ছে। কম্পোজের কাজ করছে আনন্দসঙ্গী অরিন্দম।যাকে ও মজা করে বলে কুম্ভমেলায় হারিয়ে যাওয়া ভাই।সবাই আছে ওকে ঘিরে।মেঘের ভেলা, সন্দীপ, কৌস্তুভ, অঙ্কুশ, তমোজিত সবাই।সবাই হই হই করে উঠল – এসো এসো।এ গাড়ি আমাদের।
অচেনা কাউকেই দেখছে না।বেশিরভাগই ওদের শহরের সুশীল সমাজ।কূপ বদল করছে আর চেনামুখ এগিয়ে আসছে।একটা কূপে ঢুকেই দেখল ওর দাদা আশিস সান্যাল বিখ্যাত লেখক মৃদুল দাশগুপ্ত সহ ত্রিদিবেশদা, অনিলেশ দা, রামকিশোর দার মতন লেখক কূলকে নিয়ে আসর বসিয়েছে।
এ গাড়ি গল্পের। ঠিকই তো সব গপ্পোবাজরাই সব উঠে পড়েছে। কিন্তু সদানন্দের মনে হল – এরা সব খবর পেল কি করে?
পার্থদা বলল – ওখানেই তো গল্প। তুমি যেভাবে এ গাড়িতে উঠলে, ওরাও সেভাবেই গল্প আছে ভেবে উঠে পড়েছে। হাঁটতে হাঁটতে পাশের কূপে উঠতেই চোখ ছানাবড়া। দেখে পাশের কূপে মৃন্ময়, পার্থসারথিদা, পঙ্কজদা, প্রসেনজিৎ, মোহিত, গৌতম সবাই। মৃন্ময় বলল – উঁকি দিয়ে লাভ নেই। চলে এস। জল-জঙ্গল-পাহাড় প্রকৃতির লুটের রাজনীতি নিয়ে বিতর্ক জমে গেছে।বসে যাও। চা আসছে।পরেরটায় বৌদি আছে।
এবার বেশ ঘাবড়ে গেল সদানন্দ। ওর বউ আবার উঠে পড়ল ওকে না বলে।
এক মিনিট আসছি বলে পাশের কূপে ঢুকিয়ে অবাক। ঠিক। বিশাল জমায়েত। ভ্রমণ আড্ডার সবাই আছে চন্দননগরের।সঙ্গে অশোক, স্বাতী, জয়ন্ত সোমারাও।এবার জানলার দিকে চোখ ফেরাল। কি সুন্দর দৃশ্য। উত্তরবঙ্গের কোন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে ওরা। মাথাটা বেশ ঝিমঝিম করছে। সব চেনা, আড্ডাবাজ, গপ্পোবাজ লোকেদের তুলে দিয়েছে কে? আর কিভাবে? প্রশ্নটা সরাসরি ছুঁড়ল পার্থকে।
পার্থ মাথার চুলে হাত বুলিয়ে বলল – শোনো, এটা সময়ের গাড়ি।এগিয়ে যায়,পিছিয়ে যায়। তোমার মন যা চায়, যাকে যাকে, যেখানে চায় সেই ইচ্ছাকে পূরণ করে গল্প বলতে বলতে।আর এই গল্পগুলো নিজেদের স্বার্থেই প্রয়োজনের লোকগুলোকে ডেকে নিয়ে আসে। আসলে এটা এক টাইম ট্রাভেল- ইন বিটুইন দ্য স্টোরিলাইন।
সদানন্দ বুঝল- সমস্ত গল্পের দুনিয়াটাই যেন ছুটছে ওর পাশে পাশে।বিশাল দুনিয়ার সমস্ত গল্পই যেন ওর সঙ্গী হতে চাইছে। কিন্তু এই এত লোকের এত বৈচিত্র্যের গল্পের মধ্যে থেকে ওর গল্প নেবে কি করে?
পার্থ হাসছে। তারপর চুলে হাত বুলিয়ে বলল – প্রত্যেক কথার পেছনে যেমন গল্প থাকে, তেমনি প্রত্যেকটা ঘটে যাওয়া ঘটনা দেখা আর শোনার পেছনেও যে আর একটা গল্প আছে। তাই তো টাইম ট্রাভেল যেখানে হয়,সেখানে সত্যি সত্যি- ই ধরে নেওয়া হয়-গল্প আছে।
৪
এ তো মহা ফ্যাসাদে পড়ে গেছে সদানন্দ।সবার কাছেই গল্প আছে।সবাই গল্প দিচ্ছে গাড়িতে তুলে।কিন্তু,টাইম ট্রাভেলের আসল গল্পটা কি? কে শোনাবে লেখককে সেই গল্প। কূলকিনারা পাচ্ছে না সদানন্দ।
হঠাৎ খুব টয়লেট পেল সদানন্দের।একটা কূপের টয়লেটে ঢুকে গেল।মাইনাস করে একটু হালকা হল।দরজা খুলে বেরিয়ে এসেই অবাক।
একটা বড় হলঘরের জাফরির কাজ করা জানলায় পড়ন্ত বিকেলের আলো এসে পড়েছে।দূরে লম্বা একটা মেহগনি কাঠের টেবিলের ওপর মুখ গুঁজে বই পড়ছেন মাথায় লেনিন-টুপি পরা, চেককাটা ব্লেজার গায়ে দেওয়া সাদা চুল আর সাদা দাড়ির এক বুড়ো।ইশারায় সদানন্দকে কাছে ডাকলেন।
হতভম্ব সদানন্দ সামনে যেতেই সামনের ছোট গার্ডেন চেয়ারটাতে ইশারায় বসতে বললেন।
সদানন্দ বসতে বসতে বলল – এ কি! আমি তো গাড়িতে ছিলাম। ঘরে এলাম কি করে?
বুড়ো মিটিমিটি হাসছে – গল্পের খোঁজে ঘুরছো। টাইম ট্রাভেল করছো। টাইম ট্রাভেলস’এ তো আসা যায়।
মানে? এসব কি আজগুবি কথা? – সদানন্দ অবাক।- আপনি কে?
আমিও এক টাইম- ট্রাভেলার। ঘুরছি কিছু একটা খুঁজতে। বা কাউকে কাউকে খুঁজতে। ঠিক তোমার মতন।
সদানন্দ তাকাল ঘরটার চারদিকে। সারি সারি বই।নানা পুঁথি, বড় বড় কম্পিউটার স্ক্রিন।দামি দামি ছবি ঝুলছে। ছবিগুলোর স্ক্রিনের দৃশ্য দ্রুত বদলাচ্ছে।থতমত খেয়ে গেল সদানন্দ।
বুড়ো হাসছে।একইভাবে।হাতে একটা গোল মতন ডিবে।খুলে তাকাল।তারপর দু আঙুলে টোকা দিল ওর ভেতরে।মুহূর্তে বদলে গেল ঘরের পরিবেশ।
চারদিকে তৈরি হল মিশরীয় পিরামিডের ভেতরের প্রাচীন ঠান্ডা পরিবেশ।সেবার ইজিপ্টে বেড়াতে গিয়ে এই পরিবেশেরই মুখোমুখি হয়েছিল।নানা লোক পিরামিডের ভেতর কাজ করছে।
সদানন্দ শক্ত হয়ে আছে চেয়ারের সাথে। হঠাৎই হাসতে হাসতে বুড়ো টোকা দিল হাতের ডাব্বায়।
মুহূর্তে ভরশূন্য হয়ে গেল সদানন্দ।কোনো ওজন নেই যেন শরীরের।মনে হল মহাকাশ স্পেস স্টেশনে ভাসছে।হাত পা ছুঁড়ল দু’একবার।বুড়ো বলল – মৃত্যুর পরের অবস্থা।এটাও তো এক অজানা গল্প।কি বলো?
সদানন্দ চেঁচাতে গিয়েও পারল না।হাতটা ছুঁড়ল দুবার।সব ফাঁকা ফাঁকা ঠেকল।
সামনের বুড়ো লোকটি হাসতে হাসতে আবার হাতের তালুর ডিবেতে টোকা দিতেই বদলে গেল সব।আবার সব হয়ে গেল আগের বাড়ি ঘর।
দূরে তাকিয়ে দেখল ঘরের মধ্যে অনেকগুলো ঘর তৈরি হয়েছে। কিসের যেন এক্সজিবিশান হচ্ছে।বুড়ো ওকে লক্ষ করে বলল – প্রাচীন যুগের চিত্রকলার।তোমার বন্ধুও আছে ওখানে।
কথা শেষ না হতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এল ওর শিল্পী বন্ধু অধ্যাপক গোস্বামী।দেবরাজ গোস্বামী।বোতলের মতন মোটা কাঁচের চশমা পরে হাসছে – যাক এসে গেছ। আমিও এসেছি ছবির খোঁজে।
তারপর বুড়োকে বলল- আচ্ছা প্রফেসর, অজন্তা, ইলোরায় একবার যেতে চাই।
বুড়ো বলল – যাও,বাঁদিকে খুলে যাবে।
যাওয়ার আগে দেবরাজ হাত নেড়ে ইশারায় বুড়োকে দেখিয়ে বলে গেল – ধরে রাখো। গল্প জানে। আসলি গল্প।এবার সম্বিত ফিরল সদানন্দর।
লেখক এবার ঘুরে গেল সাদা দাড়ি বুড়োর দিকে। মুচকি মুচকি হাসছে লোকটা।
সদানন্দ দেখেই বুঝল – এই লোকটাই গল্পে আছে। আর এর কাছেই গল্প আছে। প্রশ্ন করল – ট্রেনটা বাড়ি হল কি করে? ট্রেন থেকে বাড়িতে ঢুকলাম কি করে? ট্রেনের সাথীরা কোথায়?
বুড়ো আগের মতন হেসেই যাচ্ছে ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে।
সদানন্দ বেশ উত্তেজিত – বললেন না তো? এলাম কি করে?
কেন ঐ গাড়ীতে চেপে।
বাকিরা কোথায়?
ফিরে গেছে।
কেন?
ওটাই তো গল্প। ঝাক্কাস গল্প।
আশ্চর্য গল্প। চাপলাম গাড়ীতে হঠাৎ পৌছলাম বাড়িতে।
ওটা ছিল গল্পের গাড়ি।ওটাতে ইচ্ছা হলেই যে কেউ চাপতে পারে।কিন্তু এই গল্পের বাড়িটাতে ঢুকতে হলে আমার মতন বুড়োর ইচ্ছা অনিচ্ছার ব্যাপার আছে বুঝলে কিনা?
তুমিই তাহলে গল্প বুড়ো!
হাসছে বুড়ো। বুড়ো হাসলে চোখ দুটো প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ভারি মিষ্টি লাগে সাদা দাড়িতে আর সাদা চুলে ঢাকা মুখটা দেখতে।
হাসতে হাসতেই আস্তে করে বলল – কারেক্ট। এখানেই গল্প আছে। সদানন্দ ছটফট করছে – এবার আমি পাগল হয়ে যাব।গল্পের খোঁজেই ঘুরে মরছি।ঘুরতে ঘুরতে গল্পের গাড়িতে উঠে পড়েছিলাম।ছোটবড় গপ্পোবাজদের দেখতে পেলাম।গল্পও হল প্রচুর।সবাই বলছে – গল্প আছে,গল্প আছে। আমি পাচ্ছি না।কেন?
বুড়ো বলল, ঠিক। পাবে না। পায় না সবাই।
সদানন্দ নাছোড়বান্দা। হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল – প্লিজ। বলো আমায়।কোথায়, কিভাবে গল্প আছে।
৫
এবার বুড়ো উঠে দাঁড়াল।বলল – এসো,আমার সাথে।
কোথায়?
ওদিকে।
সদানন্দ যেন হিপনোটাইজড। অনুসরণ করে হাঁটতে হাঁটতে মুহূর্তেই পৌঁছে গেল পাশের একটা বড় ঘরে। কি আলো। চারদিকে শুধু দুষ্প্রাপ্য সব পুঁথি সাজানো।আর একদিকে বড় বড় স্ক্রিনে কয়েকটা লোক কিসব কম্পোজ করে যাচ্ছে।নানা ছবি ফুটে উঠছে। আবার মিলিয়ে যাচ্ছে।একটা স্ক্রিনের দিকে তাকাতে ওর চোখ আটকে গেল – ওর খুব পছন্দের জায়গা – চিসাং ভ্যালি – সেই হিল টপ ভিউ। ডেভিডের হোম স্টে।ওখানেই তো ছিল ওরা।থ্রি সিক্সটি ডিগ্রি ভিউ দেখা যেত। শুধু হাওয়া আর মেঘ কুয়াশার খেলা।একটু নেমে এগিয়ে গেলেই একটা রাস্তা।ওটা ধরে হেঁটেছিল সামনের উঁচু খাড়া পাহাড়টার দিকে।ওরা হাঁটছিল।একজন পাহাড়ি আদিবাসী নেমে আসছিল। ইশারায় বারণ করেছিল ওদের ওদিকে যেতে।সন্ধে নেমে আসে পাহাড়ে তাড়াতাড়ি। হাওয়ার দাপট বাড়ে।
সদানন্দ শুধু জিজ্ঞেস করেছিল – কিঁউ?
লোকটা বলেছিল – মত যাইয়ে।জঙ্গল হ্যায়।শের হ্যায়।
সেদিনের দেখতে না পাওয়া গুহাটাই যেন ক্লোজ আপে আস্তে আস্তে খুলে যাচ্ছে স্ক্রিনে। ভেতরটা লাইব্রেরি ঘরের মতন।সারি সারি বড় আলমারি।নানা পুঁথি থরেথরে সাজানো।আর একদিকে বসে আছেন অনেক ধ্যানস্থ মানুষ।যেন যোগনিদ্রায় মগ্ন যেন।ওনাদের দেখে সদানন্দর অরোভিলের কথা মনে পড়ল।
বুড়ো বলল – এটাই আমার আসল গল্প ঘর।আমার সঙ্গে দোস্তি বাড়লে,পরে নিয়ে যাব। সবাইকে নিই না। কখনও কখনও কাউকে কাউকে পছন্দ হলে –
সদানন্দ বোকার মতন অবস্থা তখন।
বলল – আমাকে পছন্দ হয়েছে?
গল্পবুড়ো হাসতে হাসতে বলল – না হলে মূল জায়গা দেখাব কেন? আর এ বাড়ি গল্প বাড়ি। এ জায়গা সবার নয়। তাই সবার হাত আমি ধরি না।
সদানন্দ বলল – আপনি যখন গল্পবুড়ো, তাহলে আপনার হাত ধরলেই তো গল্পে আসতে পারা যায়। কিন্তু আপনার হাতে ওটা কি? যেটা খুলে মাঝে মাঝে দেখছেন ওটা কি?
ওটা একটা মিরর। আয়না।
এত ছোট? গোল পানের ডিবের মতন।
হ্যাঁ,ওই টুকুই যথেষ্ট।
আমাকে দেখতে দেবে?
না। নিয়ে কিছু করতে পারবে না। বুঝতেও পারবে না।
কেন?
ওটা চালাবার কায়দা তুমি জানো না।সবার জন্য নয়।তাই নিয়ে কিছু হবে না।মনে হবে পেতলের ডিবের মধ্যে রাখা একটা আয়না।
তুমি খুললেই সব দেখতে পাও বুঝি।
কারেক্ট।
ওখানেই কি গল্প দেখতে পাও?
না,না।শুধু এইসবে হয় না।আরও কিছু লাগে।তবে অনেক অজানা সূত্র পাই মাঝে মাঝে।
তাহলে সেগুলো কিভাবে আসে?
শুধু একটা বিন্দুতে ভর করে।
সেকি? বিন্দুতে কি হবে?
বিন্দুর মতন একটা ভাবনা বা মুখ বা চরিত্র যা প্রাসঙ্গিক তা ফুটে ওঠে।
তারপর?
তারপর যে দেখল যাকে দেখাল তাকে নিয়ে তৈরি হবে ভাবনা।তোমার হাতটা দেখি।
সদানন্দ হাত বাড়াল। বুড়ো নরম তুলতুলে হাত দুটো দিয়ে ওর হাতের তালু দুটো টেনে নিল নিজের দিকে।এক দৃষ্টে তালুটা পড়ছে জ্যোতিষের মতন।সদানন্দর শরীরের মধ্যে দিয়ে একটা স্রোত যেন বয়ে যাচ্ছে। কিরকম হচ্ছে যেন মাথার মধ্যে। মাথাটা ভার ভার লাগছে।জোর করেই প্রশ্ন করল – কি দেখছ? তুমি কি হাত দেখতে পারো?
না– না। আমি তোমার হাতের মধ্যের শক্তিটা পরখ করছি। কারোর কারো হাতে থাকে।
মানে?
হাতের জোরটা দেখছি।ওখানেই তো আসল গল্প আছে।হাতের মধ্যেই তো সব গল্প আছে।আর থাকেও।ওটাই তো মিরর।
সে কি?জানতাম না তো।
জানবে কি করে? না জানালে।যারা জানতে পারে না ঘুরে মরে।
আর কি গল্প জানতে চাও বলো – বুড়ো বেশ উদার।
‘গল্প আছে’ বলে সবাই। অথবা জানতে চায় অনেকে।
ঠিক।
আমার কথা – গল্প আছে কোথায়? যেখানে আছে সেখানে আমাকে নিয়ে চল বা অ্যাড্রেসটা বা ঠিকানাটা দাও।
মুখে হাসি লেপটে তাকিয়ে আছে বুড়ো।
লিখে নাও – গল্প আছে – বিন্দু বিসর্গের মধ্যে।
হেঁয়ালি করবেন না – রেগে গেছে সদানন্দ।
বুড়ো অটল – বলছি তো, বিন্দু-বিসর্গের মধ্যে।
কিসব বলছ আজেবাজে কথা।বিন্দু-বিসর্গ শুধু কয়েকটা চিহ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়। সেখানে থাকবে গল্প।
হ্যাঁ। ওটাই তো সূত্র।ভাঙো।ভেঙে দেখো।
কিভাবে ভাঙবো আর কিভাবে দেখব?
ঐ যে হাত দুটোর মধ্যে। বলে সদানন্দর হাত দুটো বুড়ো টেনে নিল নিজের হাতের তালুর মধ্যে। দুটো হাতে হাত ঘষতে লাগল। আর খুব হাসতে লাগল বুড়ো।সদানন্দর হাত, শরীর সব যেন তড়িৎ চুম্বকীয় শক্তির মধ্যে ধাক্কা খাচ্ছে।- কোনমতে বলল – হাতের তালু দেখছো আর ঘষছো কেন?
টেল মিররটাকে পাওয়ার ফুল করছি।
সেটা কি?
ওটাও একটা আয়না। ওই আয়নায় আছে আসল গল্প। ওটাতেই ধরতে হয়। ওটাতেই ধরা পড়ে সব।ওটা থেকেই মুক্ত হয় সব। ওটা ছাড়া বিন্দু-বিসর্গও বসাতে পারবে না।আর বিন্দু-বিসর্গর সূত্রও খুলবে না।
বিস্মিত সদানন্দ বলল,সবার থাকে?
না।থাকার কথাও নয়।কারো কারো থাকে।
কি করে বুঝলে?
ফান মিরর দিয়ে।
বুঝেছি।আপনি গল্প বুড়ো।তাই ফান মিরর এর মতন আয়না ফায়না চালাতে পারেন।
কিছুটা।পুরোটা নয়।পুরোটা পারলে এই ব্রহ্মাণ্ডের অনেক অজানা গল্পই জানা যেত ওই ফান মিরর দিয়ে।
ওটা কি জাদু আয়না? মানে ম্যাজিকাল মিরর।
জানি না।ওই গবেষণা এখনও শেষ হয় নি।চলছে।তবে বিচিত্র ক্ষমতা।
কিভাবে চালানো হয়?
পরে জানবে।টেল মিরর রপ্ত হলে।
টেল মিরর মানে তো হাতের তালু?
কিছুটা। আর বাকিটা মনের আয়নায় ফুটে ওঠা ছবি।
কিভাবে পাব।
অভ্যাসে।নিত্য অভ্যাসে।যোগ সাধনার মতন।
যদি চালাতে না পারি।
আমি চলে আসব।
আপনি কি করে জানবেন।
ফান মিররে খবর পাব।
ফান মিরর আর টেল মিররের যোগ আছে তাহলে।
অবশ্যই।
হাতটা তুলে নিল লোকটা।তড়িৎ আবেশ যেন কেটে গেল, সদানন্দর শরীর থেকে।
থামছে না সদানন্দ।- বললেন না কিন্তু, বিন্দু-বিসর্গের সূত্রটা।
তোমার হাতেই দিয়ে গেলাম।টেল মিররে।
চোখ রাখ আর মনের আয়নায় ছবি আসবে।
পুরো বোকার মতন তাকিয়ে আছে সদানন্দ।
গল্প বুড়ো হাসছে।- ভাবো,ভাবা প্র্যাকটিস করো।হাতে দিয়ে দিয়েছি টেল মিরর।না পারলে আছি আমি। চলে আসব।না হলে তুমিও চলে আসতে পারো আমার কাছে।
কি করে?
টেল মিররকে বলবে। গল্প আছে। আমি খবর পাব – ফান মিররে।
থতমত খেয়ে সদানন্দ বলল, মানে বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন।
হাসতে হাসতে বুড়ো বলল, এইতো কি সুন্দর বুঝেছো।
সদানন্দর মাথায় একটা কি যেন ঝিলিক দিল। তারপর মন দিয়ে নিজের হাতের তালুটার দিকে তাকাল। হঠাৎ মনে হল – গল্প বুড়োর ঠিকানাটা তো নেওয়া হল না।
হাত থেকে চোখ বুড়োর দিকে সরাতেই দেখল বুড়ো চেয়ার ছেড়ে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দুবার দ্বিধা নিয়েও পেছু ডাকল – আপনি কি চলে যাচ্ছেন গল্প বুড়ো?
হ্যাঁ।আপাতত।তোমার সন্ধান তো পেয়ে গেলাম।আর তুমিও পেলে তোমার প্রশ্নের সন্ধান।
বুঝলাম। কিন্তু আপনাকে পাব কি করে?
সময় হলেই আর প্রয়োজন পড়লেই।
আপনাকে তো এতক্ষণ গল্পবুড়ো বলেই ডাকলাম। আপনার নামটা তো –
এগোতে এগোতেই বুড়ো বলল – তুমিই তো বললে গল্প বুড়ো। তাছাড়া আমি কেউ নই। আই অ্যাম নো ওয়ান।
বলেই চোখের পলক পড়তে না পড়তেই বেমালুম মিলিয়ে গেল লোকটা। ঘরের দরজাটা দরাম করে খুলে গিয়ে বন্ধ হয়ে গেল।
সদানন্দ মনে মনে হাসল – ঠিক ধরেছি, ওই প্রফেসর নান।ওর কাছেই গল্প আছে।
৬
প্রফেসর নানের যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ভাবছিল – মিরর স্টোরি আর বিন্দু-বিসর্গের সূত্রটা। হঠাৎ ঝড়ের গতিতে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল ওর স্ত্রী।ঢুকেই স্বভাবগত কণ্ঠেই বলল- ওমা এভাবে হাঁ করে দরজার দিকে তাকিয়ে আছ কেন?
ভাবছি। আয়নার গল্পটার কথা।
কি সব বলছ একা একা।
না গো না । শুধু সূত্রটাই পরিষ্কার হল না।
কিসের সূত্র? কিসব বলছ পাগলের মতন।বাইরের বড় গেটটা হাট করে খোলা কেন? কেউ এসেছিল?
হ্যাঁ।এসেছিল।
কে গো?
প্রফেসর নান।
সে আবার কে?
তাকে দেখো নি কখনও।
কে সে? কি করতে এসেছিল?
কিছুই না।গল্পের গরুকে গাছে ওঠাতে।
যত সব আজগুবি কথা কিসব বলছ? পাগল টাগল হয়ে গেছ নাকি!
ওর সাথে গেলে বুঝতে।
তুমি গিয়েছিলে নাকি?
হ্যাঁ।
কোথায়?
অবাক অভিযানের গল্প আছে যেখানে।
কি করে?
আয়নার মধ্যে দিয়ে।
অ্যাঁ! থতমত খাওয়া স্ত্রীর ভুরু কোঁচকানো মুখের দিকে তাকিয়ে রইল সদানন্দ ফ্যালফ্যাল করে। তারপর কানে এল সোনালির কণ্ঠস্বর- এখানে বসে বসে ঘুরে এলে অন্য একটা অজানা লোকের সাথে আর আমি তার বিন্দু-বিসর্গও জানতে পারলাম না। কতক্ষণ ঘুমোচ্ছিলে ঠিক করে বলোতো? দরজা এভাবে খোলা রাখলে যে কেউ তো ঢুকে যেতে পারে, নাকি?
আর তখনই হাতে তালি দিয়ে লাফিয়ে উঠল সদানন্দ – ঠিক ঠিক।ধরে ফেলেছি। বিন্দুতেই জন্মে বিসর্গের বিষ্ময়ের মধ্যেই শেষ হয়।
স্ত্রীর স্বগোতক্তির কথাগুলো মিরর্ রিফ্লেকশনের মতন প্রফেসর নানের অবাক অভিযানের গল্প সূত্রটা যেন খুলে দিল।
[মতামত ও বানানবিধি লেখকের ব্যক্তিগত]
Tags: গল্প, দেবাশিস মজুমদার, বিন্দু বিসর্গ
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।