02 Oct

বুঝিনি সে নিরুচ্চার ভালোবাসা ছিল নিরন্তর

লিখেছেন:অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়


বুঝিনি সে নিরুচ্চার ভালোবাসা ছিল নিরন্তর / অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়

এক

দুপুর থেকে একা একা কফি হাউসে বসে দু’তিন রাউন্ড ইনফিউশন শেষ কোরেও একটা লাইনেই আটকে থাকল পদ্যটা, ‘বুঝিনি সে নিরুচ্চার ভালোবাসা ছিল নিরন্তর’। আগে পরে আর কিছুই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। নাহ্, আজ আর হবে না। বিকেলের দিকটায় উঠব উঠব করছি, এমন সময় দেখলাম প্রফেসর সাহেব ঢুকছেন, অনেকদিন পরে! আমার অনেক দিনের পরিচিত জন। জমে গেলাম আবার।

শহর তথা দেশের পাঁচতারা এক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক (ডক্টর) অভ্রজ্যোতি মুখোটির সঙ্গে কফি হাউসে জমাট আড্ডা হল সেই সন্ধ্যায়। বললাম, ‘বাবু, তোমাকে নিয়ে তো তোলপাড় করে দিল খবর ওয়ালারা’!

-‘আর বোলো না। অল রাবিশ। ওই ভুলভাল খবর গুলো দেবার আগে আমার সঙ্গে তো কথা বলার প্রয়োজন ছিল একবার। তা না, যত্ত সব মনগড়া…। এদিকে আবার কি হোয়েছে জান? সেই কবে স্কুল পাশ কোরেছি। সেই স্কুলের ক্লাস সেভেনে একজন দিদিমণি সংস্কৃত পড়াতেন আমাদের। আজ এই প্রায় বিশ বছর বাদে আমাকে হঠাৎ ডেকে পাঠিয়েছেন তাঁর বাড়ীতে। ঠিক বুঝতে পারছি না,  কেন’?

বললাম, ‘হ’য়ত খবরটা দেখেছেন তিনিও। তাই কিছু উদ্বেগ, আশঙ্কা আর ভালোবাসায়’!

-‘বাদ দাও। এত যে ভালোবাসা ছিল আমার জন্যে সেটাই তো জানতাম না ভায়া! কথাও তো ত্যামন বলতেন না কোন দিন। চিনতেন কি না তাই বা কে জানে?!’

‘তুমি যতই মজা কর আর যাই বল না কেন, ঘটনা কিন্তু সিরিয়াস। অনেকেই বোলছে, আলোচনা শুনছি চারদিকে। তবে ঘটনাটা কাগজে পোড়েই যা জেনেছি। তুমি বোলছ এসব বক্ওয়াশ? ত্যামন্ কিছু না?’

-‘ঘটনা তো ঘটেছেই একটা। সেটা যথেষ্টই সিরিয়াস। কিন্তু আমাকে যে ভাবে হেকল্ করার কথা লিখেছে, ত্যামনটাও নয়।’

‘বাবু, আমাকে বোলবে ডিটেইলস-এ, ঠিক কি হোয়েছিল? একটা ভালো স্কুপ করি। ইদানিং সম্পাদক-দের দপ্তরে যাচ্ছি খালি হাতে। মাঝে মধ্যে একসাথে পাবে বসে মাল খাচ্ছি আর শুনতে হচ্ছে মাতাল আর মুরগীরা কখনও রাজপথে চাপা পড়ে না! মানে হ’য়? এই দেখ না, আজ সারাদিন এই একটা লাইনেই আটকে আছে এক পদ্য। লিখতেই পারছিনা’।

-‘শুনবে বলছ? তাহলে শোন…।’

এরপর অধ্যাপক মুখোটি পর পর য্যামনটা বলে গেলেন, তাঁর মুখেই শুনতে থাকি সেইসব কথা।

বুঝিনি সে নিরুচ্চার ভালোবাসা ছিল নিরন্তর

 

দুই

মুখোটি বলে চললেনঃ

সেদিন মনটা ভালো ছিল না মোটেই। ক’দিন ধরেই যা সব ঘটে চলছে। ইন্টিগ্রেটেড বিল্ডিং-এর দোতলায় প্রায় চল্লিশ ফুট লম্বা ঘরটার শেষ মাথায় বসি আমি। অধ্যাপক দীপক লাহা বসেন দরজা দিয়ে ঢুকেই ঠিক সামনের এক ছোট্ট কাচের কিউবিকল-এ। ব্যাস, এই গড়ের মাঠে তৃতীয় আর কোন ব্যক্তি নেই। আঁটো সাঁটো কাচঘর আমার না পসন্দ। আমার সামনে বিরাট বিরাট জানালার বাইরে বিশাল খেলার মাঠ। গাছেদের সারি। অনেক দূরে, প্রান্তর পার কোরে রেল লাইন। ওয়ার্থ সিন! তবে আজ সেদিকে তাকাচ্ছিলাম না। টিফিন আওয়ার চলছে। চেয়ারে শরীর টান টান করে দিয়ে, চোখ বন্ধ করে মটকা মেরে পড়ে আছি। কোথাও অজানা পাখীদের কলরব নিঃস্তব্ধতা খান খান কোরে দিয়ে যাচ্ছে।

-‘আসব’?

একটা মেয়ের কন্ঠস্বরে সম্বিত ফেরে। দরজার প্রান্তে দাঁড়িয়ে এক কিশোরী। কোনও ছাত্রী হ’বে হ’য়ত। তবে আমার না। এই মুখ তো দেখিনি কোনও ক্লাসে!

‘ইয়েস প্লিজ’।

হন হন করে ঢুকে আসে সেই মেয়ে। শরীরী বিভঙ্গ বোলছে তার অনেক তাড়া। আমার কাছে কেন?

‘আপনি প্রফেসর অভ্র …’।

‘মুখোটি, অভ্রজ্যোতি মুখোটি। বসো। বলবে কিছু’?

‘আপনাকে চিত্রাদি একবার দেখা কোরতে বোলেছেন’।

‘চিত্রা দি? কোন্ ডিপার্টমেন্ট? নাকি অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিং-এর কেউ? কি ব্যাপারে’?

‘না। দমদম সি আই টি স্কুলের দিদিমণি’।

বজ্র নিনাদ যেন! টান টান হোয়ে বসলাম। কার কথা বলল? বিশ বছর পরে স্কুলের কোনও দিদিমণি আমাকে দেখা করতে বলছেন কেন? টাইম মেশিনে পিছিয়ে গেলাম বিশ বছর। হ্যাঁ, চিত্রা দি – চিত্রা সেন, আমাদের সংস্কৃত পড়িয়েছিলেন বটে। সেও তো ক্লাস সেভেনে। তারপরেও অবশ্য মাঝে মধ্যে দেখা হোয়েছে কচিৎ কদাচিৎ, যখন স্কুলে গিয়েছি। কথা বলেননি। বেশ স্টাইলিশ ছিলেন। সব সময়ে ঠোঁটের কোণে যেন চিলতে তাচ্ছিল্যের হাসি। আমি অন্তত ত্যামনটাই দেখতাম। আমাকে চেনার কোন কারণও তো নেই। খুব জোর তো মুখ চেনা। এই ধারণাটাও ভুল হতেই পারে। তবে তাঁকে নিয়ে আমার যথেষ্টই মাথা ব্যথার কারণ ছিল। ওই দুরূহ শক্ত সাবজেক্টে পাশ করব কি ভাবে? সেই চিন্তা ক্লাস সেভেনের পরেই শেষ হোয়ে গ্যাছে। তিনি আমাকে চেনেন না, আমি তাঁকে চিনি, তাঁর চটকদারিতে মজে যাই আর হাহাকারে বুক ভরাই! ব্যাস, এর বাইরে আর কিছুই নেই। দিদিমণিরা ছাত্রের সঙ্গে কথা বলেন না কেন? কিছু তো বলতে পারেন!

‘তুমি’?

-‘আমি এখানে সেকেন্ড ইয়ার সিভিল। আমিও ওই স্কুল থেকেই পাশ করেছি। দিদি আমাকে বললেন আপনার কথা’।

‘আমার কথা? বলেছেন? আমি তো দিদির বাড়ী চিনি না। ক্যামন আছেন তিনি? কোথায় থাকেন? কন্টাক্ট নাম্বার আছে? দেখা করতে বলেছেন? কেন’?

অনেক প্রশ্ন। একসাথে। সব উত্তর মাথার ওপর দিয়ে একে একে বেরিয়ে যাচ্ছে। কিছুই শুনছি না। বিসমিল্লায় ততক্ষণে অন্য সুর লেগে গ্যাছে! চিত্রাদি আমাকে এতদিন পরে দেখা কোরতে বোলেছেন! ক্যানো?  ভাগ্যিস ল্যান্ড লাইনের কন্টাক্ট নাম্বারটা স্লিপ প্যাডের কাগজে নোট করে নিয়েছি। দিদি আমাকে ডেকেছেন? আজকে সূর্‍্য কোন্ দিকে উঠেছে? প্রত্যেক দিন অনেক বেলায় ঘুম থেকে উঠে দেখতে ভুলে যাই সূর্য কোন দিকে উঠল!  কোনও দিনই সূর্য ওঠা দেখিনি আমি। একদিন খুব ভোর বেলায় ঘুম থেকে উঠব। দেখেছ কান্ড! এলোমেলো চিন্তায় মেয়েটার কি যেন নাম বলল, ভুলেই গেলাম। কোথায় থাকে তাওতো জানলাম না। জানলেই বা কি লাভ হ’ত!

কথাটা শুনে আনন্দও হয়েছে খুব। নাথুদা-র ক্যান্টিনে এক কাপ চা আর একটা গজা বেশীই খেয়েছি আজ! মেয়েটা ভুল করেনি তো? আমার সঙ্গেই দেখা করতে বোলেছেন কি? সেটা কি করে হবে? কি জন্যে ডেকেছেন?

বিকেলে ফিরবার পথে কপাল ঠুকে শেয়ালদা স্টেশনের পাবলিক বুথে পয়সা ফেলে দিদির বাড়িতে ফোনটা করেই ফেললাম। এক মেয়ে ধরেছে। জানাল, ‘দিদি এখন পায়চারি করতে বেরিয়েছেন। ফিরতে সন্ধ্যা হ’বে। পরে করুন’। নাম ধাম, কি উদ্দেশে ফোন কিছুই জিজ্ঞেস করল না। আচ্ছা তো! একটা ছেলের সঙ্গে একটু কথা বোলতেও ইচ্ছে হ’ল না?

আজ আর ফোন করতে পারব না, ভয় করছে খুব। আবার যদি সেই মেয়েটাই ধরে? কাল সকালে কাজে আসার পথে নেত্র সিনেমা হলের সামনের বুথটা থেকে কোরে নেবখ’ন। অত আর্জেন্সির কি আছে?

বুঝিনি সে নিরুচ্চার ভালোবাসা ছিল নিরন্তর

 

তিন

সকাল ৯টা। নেত্র হলের গেট সংলগ্ন পে-বুথের রিসিভারের ওপ্রান্তে নারী কন্ঠ, ‘ক্যামন আছিস? একদিন আসতে পারবি? আজই চলে আয়না’।

মনে হল বহু যুগের ওপার থেকে চেনা কোনও আপনজন! আমি তো চিনি না! তবুও চোখ ভিজে যাচ্ছে আমার।

‘আজ যাব? কেন? ঠিকানাটা? কিভাবে যেতে হ’য়? আপনি ভালো আছেন তো’?

-‘বয়েস হয়েছে। বিকেলটায় একটু পায়চারি কোরতে যাই। সন্ধ্যে বেলায় আয়।… শেয়ালদা হয়ে আসবি? তুই এন্টালী পোস্ট অফিস থেকে…। কম্পাউন্ডের গেটে সিকিওরিটি আটকাতে পারে তোকে। আমার ঠিকানা বলবি’।

ছবির মতন বাড়ীর দিশা। ভুল হবার নয়। দিদি কি ছবি আঁকতেন?

আমাকে ডেকেছেন খোশগল্প করবেন বলে? চিত্রাদি? হতেই পারেনা! তবে খুব ভালোও লাগছে আজ! দিনটা হঠাৎই খুব ভালো হয়ে যাচ্ছে যেন!

দিদির সেই ঠোঁটের কোণে বাঁকানো চিলতে হাসির কথাটা মনে পড়ল! ওটা কি কৌতুক, তাচ্ছিল্য না মোনালিসা? মাঠ সংলগ্ন দোতলার ক্লাস ঘরের জানলা দিয়ে দেখছি। প্রেয়ার শুরু হবে একটু পরেই। বাস স্টপে নেমে দূর থেকে আসছেন তিনি। চোখে সান গ্লাস। কাটা কাটা চেহারা। নির্মেদ। গ্ল্যামার চুঁইয়ে পড়ছে। আমি দেখছি (সু)চিত্রা সেন আসছেন! প্রেয়ার শুরু হতেই তিনিও দোতলায়। তাঁর দিকে চোখ চলে যাচ্ছে। প্রার্থনার কথা গুলো এলোমেলো!

‘দাদা প্লাটফর্মের ধার থেকে সরে দাঁড়াতে পারছেন না? দেখছেন তো গাড়ী ঢুকে গ্যাছে’। সমস্বরে হইহই। খোয়াব দেখার ফাঁকেই কখন যে ট্রেণ ঢুকে গ্যাছে! কেউ বলল, ‘অকালে মরার শখ হোয়েছে বোধহয়’। কেউ আবার, ‘সকাল বেলাতেই গাঁজা টেনে এসেছেন নাকি মশাই’? এক আতাক্যালানে, ‘কোথাকার মাল, দাদা’! সাত সকালেই অফিস গোয়ার্সরা হুড়োতাড়ায় থাকলেও একই সঙ্গে বেশ রসেও থাকেন! অনেক বাবুরাই বাড়ীতে বউদের লাথি ঝ্যাঁটা খেয়ে এসেছেন এই মাত্র। এরপর সারাটা দিন অফিসে ব’সের কাঁচা খিস্তি খাবেন। এইটাই তাঁদের একটু সোয়াস্তির সময়। সমস্বরে গুচ্ছের সব টিপ্পনী, গালিগালাজ। সব রাগ, ঝাল, অভিসম্পাত আমার ওপর। মনে হচ্ছে পৃথিবীর এক এবং একমাত্র ‘দি মোস্ট স্কাউন্ড্রেল’ আমি-ই! রেল যাত্রা এক অদ্ভুত জগৎ! হঁশ ফেরে। আমি গায়ে মাখছি না। চিত্রাদি আমায় ডেকেছেন! আজ আমার মন ভালো হয়ে গ্যাছে!

বুঝিনি সে নিরুচ্চার ভালোবাসা ছিল নিরন্তর

 

চার

“নীল পৃথিবী” মেশিন শপের সিনিয়ার মেকানিক রহমান দা জিজ্ঞেস করলেন, ‘টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন থেকে আপনার ব্যাপারটা নিয়ে কোনও মুভমেন্ট হল না কেন? কাউকে পিঁপড়ে কামড়ালেও তো ওরা মিছিল করে’!

‘জানি না। ঠিকই আছে’।

-‘আমরা জানি। আপনি কোনও লবিতে নেই। কে বলবে আপনার জন্যে? আমাদের ইউনিয়ন থেকে আমরা কিন্তু ঘটনার নিন্দে করেছি’।

রহমান দা নন-টিচিং অ্যাসোসিয়েশনের একজন হর্তাকর্তা। ঠিকই জানেন। আমি কোনও লবিবাজি করিনা। টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের মেম্বারশিপ খারিজ করে দিয়েছি। মাতব্বরি আমার সহ্য হ’য় না।

-‘ব্যাপারটা কিন্তু অত সহজে মিটবে না। জল কিন্তু ঘোলা হচ্ছে’।

খুব ভালো জানি। জল নিজে ঘোলা হ’য় না। কেউ ঘোলায়। বললাম, ‘ছেড়ে দিন’।

‘আহার ক্যান্টিন’-এর সামনে বকুলতলায় জটলা। ছেলে মেয়ে রূপান্তরিত মাস্টার নন-টিচিং স্টেক হোল্ডার গার্জেন সাপ্লায়ার প্রেমিক প্রেমিকা মায় নিছক শহুরে নকশাল। এক জায়গায় বীরেন বাবু আর সুতীর্থ, আমার বিভাগের। লোকে বলে বীরেন বাবু ল্যাংটা বয়েস থেকে রাজনীতি কোরেছেন। অতিবামেদের কালে তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যুঝে একজন তাবড় বামপন্থী শিক্ষক নেতা। সুতীর্থের ‘ইজম’ আলাদা হলেও মানবাধিকার কর্মী-দের দলে সে। আমার ঘটনায় এরা সব এক! আসলে ঘাপলাবাজি। বীরেন বাবু ডাকলেন, ‘মুখোটি, তুমি ব্যাপারটা সামলাতে পারবে না। ছেলেটার কাউন্সেলিং-এর ব্যাপারটা সুতীর্থকে দেখতে বলেছি। ওর এসব ব্যাপারে এক্সপিরিয়েন্স আছে’। আমি বক্তা নই। একতরফা শুনে গেলাম।

বন্ধু সুবেশের সঙ্গে দেখা। নামেই বন্ধু! এমনি সময় চিনতেই পারেনা। ঘ্যাম দেখায়। আজ পারছে।

-‘কি রে, পাতাখোরটার খবর কি’?

ভালো লাগে না। এড়িয়ে যাই, ‘কিচ্ছু না। আর কিছু’?

চিত্রাদি-র বাড়ী কখন যেতে পারব? কেন ডেকেছেন তিনি এতদিন পরে? এত আর্জেন্সির কি আছে? দিনটা বেশ ভালোভাবেই শুরু হোয়েছিল আজ। শালা শুয়োরের বাচ্চা, ক্যাম্পাসে পা রাখতে না রাখতেই কূট কচালি শুরু হোয়ে গ্যাছে। ডিসগাস্টিং। মাথাটা বড্ড ধরে উঠেছে। চা খেয়ে আসা যাক বরং। চা নয়, কফিই নিলাম একটা। অল্প চিনি ব্ল্যাক এক্সট্রা স্ট্রং।

বুঝিনি সে নিরুচ্চার ভালোবাসা ছিল নিরন্তর

 

পাঁচ

দিদি দারুণ ভালো ডাইরেকশন দিয়েছেন। এন্টালী পদ্মপুকুর লিন্টন। এটা কোলকাতার খুব দামী অঞ্চল। কয়েক জনকে জিজ্ঞেস করে সহজেই পৌঁছে গেলাম কম্পাউণ্ডটায়। চত্বরের শেষ মাথায় যে বিল্ডিংটা, তার দোতলায় ফ্ল্যাট। কলিং বেলে চাপ দিই।

-‘আয় আয়। একটু আগেই ফিরলাম। বিকেল বেলাটায় একটু লেডিস্ পার্কে ঘুরতে যাই। চিনতে অসুবিধে হ’য়নি তো’?

আগের সেই স্কুলের দিদি কে দেখতে পাচ্ছি না। আমিও তো আগের নেই। প্রণাম কোরলাম। মাথায় ডান হাত আশীর্বাদের মত নেমে আসছে। স্পর্শ করল। এত কাছাকাছি কোনও দিন হইনি। তাঁর নিঃশ্বাস শরীরে পড়ছে! শরীর থেকে খুব ‘আপনজন’-এর চেনা ঘ্রাণ! ভেতরের ঘরে এক খাটে ধুতি লুঙ্গির মতন করে পরে, গেঞ্জি গায়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে আধ শোওয়া হয়ে আছেন যে রোগা ভদ্রলোক তিনি মিস্টার সেন।

-‘উনি অল ইন্ডিয়া রেডিওতে ছিলেন। অবসর নিয়েছেন।… ইউনিভার্সিটি থেকে এলি তো?…কি খাবি’?

বড় রাস্তার একটা সুন্দর দোকান থেকে কিছু মিষ্টি নিয়ে এসেছি। ফল নিলে ভালো হত? প্রথমবার এলাম। কম আনা হোয়ে গেল কি? ফর্মালিটির ব্যাপার স্যাপার গুলো ভালো বুঝি না। কিছুই কি বুঝি?

-‘ভালো আছিস তো তুই?… আবার মিষ্টি আনতে গেলি কেন’? ভুরু কোঁচকালো একটু। কপট রাগ। আসলে স্নেহ।

ভেতরের ঘরে এসে বসেছি। প্রথমটায় কিছু মামুলি কথাবার্তা। ইতিমধ্যেই একজন মেয়ে গরম চা নিয়ে এসেছে।

‘আমার মেয়ে’।

তাহলে এই মেয়েই বোধহ’য় কালকে ফোনটা ধরেছিল। এত বিমর্ষ কেন? সেই মেয়ে আমাকে ‘তুমি’ সম্বোধন করল। নিঃসঙ্কোচ, অকপট। মেয়েদের দিকে সরাসরি মুখ তুলে কথা বলার সাহস নেই আমার। একে হঠাৎ খুব আপনার জন বলে মনে হল! চা-এ চুমুক দিই।

‘তোকে ছেলেটা খু-উ-ব মেরেছে – নারে? খবরটা কাগজে দেখার পর থেকেই মনটা খুব খারাপ হোয়ে আছে’। সেই মেয়েটির নাম করে বোললেন, ‘ওকে বোললাম তোর কাছে গিয়ে আমার কথা বোলতে’।

চিত্রা দি আমাকে ডেকেছেন। বিশ বছর বাদে আজ হঠাৎ কেন? দিনের আলোর মতন কারণ পরিষ্কার হোয়ে যাচ্ছে এখন। এখানেও সেই বিরক্তিকর প্রসঙ্গ। তা সত্ত্বেও খু-উ-ব ভালো লাগছে হঠাৎ! পেটের   কথা মুখে আসছে না। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। চোখ ভিজে যাচ্ছে।হাজার হাজার ছাত্র ছাত্রীর মধ্যে আমার নাম ধাম হাল হদিশ মনে থাকল কি কোরে? সবারির ঠিকুজি-ই কি এমন ভাবেই নখ দর্পণে রাখেন তিনি? কি ভাবে? কোথাকার কোন্ খবরের কাগজে, কার না কার খুচরো খবরে তাঁর চোখ আটকায় কি করে? কি এসে যায় তাতে? এ তো কোনও চাঁদ বা মঙ্গলের বুকে পা রাখার মতন মহান খবর নয়! এ তো কোনও সাহিত্যে নোবেল পাওয়ার ঘটনা নয়! কোনও সমাজ সেবার মহান কাহিনীও নয়! তবে কি ভালোবাসা ছিল নিরন্তর? খুব ছোট্ট কিছু পাওয়ার জন্যেও মরে যেতে পারি আমি! আমি বুঝিনি? হোতে পারে, কিছুই বুঝিনা। তাঁর উদ্বেগ আন্তরিক! সন্তানের স্নেহ য্যানো! কান্না ভেজা স্বরে  বলি, ‘না দিদি। ভালো আছি আমি। অতটা কিছু নয়। কাগজে একটু বেশীই লিখেছে। বেশীটাই ঠিক নয়’।

‘হবেই বা কেন এমন ঘটনা? কি হোয়েছিল’?

চায়ের পেয়ালায় শেষ চুমুক দিয়ে কাপটা নামিয়ে রখলাম। ‘ধুয়ে দিই’? ‘হাঁ হাঁ’ কোরে উঠলেন। দিদির দোতলার ফ্ল্যাটের একেবারেই প্রায় গায়ে গায়ে মসজিদ। কিছু সময় পর পরই মাইকে আজান।

‘অসুবিধে হ’য়না’?

-‘অভ্যেস হোয়ে গ্যাছে। পাশের ওই টিনের চালওয়ালা মস্ত বাড়িটা দেখছিস? ওটা একটা আস্তাবল ছিল  এক সময়ে। অনেক ঘোড়া। নবেন্দু চ্যাটার্জির ‘মনসুর মিঞার ঘোড়া’-র শুটিং হোয়েছিল ওখানে। এই আস্তাবলের কাহিনী’। আজান থেমে গ্যাছে। আমি সেদিনকার ঘটনা বোলতে শুরু কোরলাম।

বুঝিনি সে নিরুচ্চার ভালোবাসা ছিল নিরন্তর

 

ছয়

ক্লাসে ঢুকেই অ্যানাউন্স করে দিই ক্লাস টেস্ট দেবার নিয়ম কানুন। কোন রকম আনফেয়ার মিনস্ চলবে না। পরীক্ষা হ’লে প্রফেসর মুখোটি মানে কোনও চোতা বেরোবে না। ঘাড় ঘুরবে না। হুইশপার হ’বে না। বাঘের বাচ্চারাও এখানে মিইয়ে থাকে! ভদ্রলোকের মত পরীক্ষা দিয়ে ভদ্রলোকের মত বেরিয়ে যাও। নচেৎ কপালে দুঃখ থাকবে। অনেক সিনিয়ারেরা, সমসাময়িক কলিগেরা বলেন, ‘এটা প্রফেশনল কোর্স। নাম্বারটাই সব। এভাবে কর কেন? কোম্পানিতে চাকরী পাবে। তারাই শিখিয়ে পড়িয়ে নেবে। তোমার কি আছে’?

কিছুই কি নেই? দায়বদ্ধতা নেই? থাকতে হ’বে না? একবার একটা জোক শুনেছিলাম। এক স্কুল মাস্টার পরীক্ষার দিস্তে দিস্তে খাতা গুলো বাড়ীতে এনে লাইন দিয়ে সাজিয়ে দিলেন। বউকে ডেকে বোললেন, ‘নাও, এবার একেক কোরে লাথি মার ওগুলোয়’। বউ ভাবল, বুড়োটা সারা জীবনে অনেক জ্বালিয়ে মেরেছে। কোনও স্বাদ আহ্লাদ মেটায়নি। এবার শেষ বয়সে কি ভীমরতিতে ধরল নাকি?

‘হাঁ কোরে দেখছ কি? নাও, শুরু কর’।

‘তোমার মতলবটা কি বল তো’?

‘বুঝলে না? লাথি কষানোর পরে যে খাতাটা সব থেকে কাছে পড়বে, সেটা সব থেকে ভারী, সব থেকে বেশী লেখা – সেটা হায়েস্ট মার্কস। আর যেটা সব থেকে দূরে গিয়ে পড়বে, সেটা সব থেকে হাল্কা, কিছুই লেখেনি – লোয়েস্ট মার্কস। বাকী গুলোর গ্রেডেশন ওই ভাবেই হবে। ভেতরের অপাঠ্য, অবোধ্য হাবজি গুবজি কালিঝুলি গুলো দেখার দরকার নেই। বুঝলে কিছু’?

আমি, মুখোটি, ওই পাঠশালায় পড়িনি। প্রতিটা নম্বরের জন্যে কল্জে ছিঁড়ে গ্যাছে, হাড় পাঁজরা ভেঙে গ্যাছে। পারব না। চোতাবাজদের সব ফন্দিফিকির জানি। তারা আবার আরও ওপর দিয়ে যায়। নিত্য নতুন পদ্ধতি বার করে। আবার ধরে ফেলি সেসব। ইদানিং একটা নতুন কায়দা হোয়েছে। আগে থেকেই লিখে আনা কিছু কাগজ নিপুণ ভাবে সাঁটিয়ে দেওয়া।

আজ ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল ম্যানেজমেন্ট’-এর ক্লাস টেস্ট। পরীক্ষা শুরু হোয়ে গ্যাছে। কয়েকটা মক্কেল ওই ভাবে আগেই লিখে আনা কিছু কাগজ চালিয়ে দেবার চেষ্টা কোরছে। কাছে গিয়ে ছানবিন করে খাতা দু’আধলা কোরে ছিঁড়ে ফেলে দিচ্ছি। তাড়িয়ে দিচ্ছি না। আবার শুরু করাচ্ছি প্রথম থেকে। ‘রা’ কাড়ছে না কেউই। মাঝামাঝি সারিতে এক ছেলে চুপচাপ বসে। কিছু পরেই দেখি বেশ ক’পাতা সাজানো লেখা। এই ছেলেকে কস্মিন কালেও ক্লাসে দেখেছি বোলে মনে হচ্ছে না। কাছে গিয়ে যাচাই কোরে ছিঁড়ে ফেললাম যথারীতি। এতক্ষণ যেন ঝিমিয়ে বসে ছিল। হঠাৎই সে লাফিয়ে ওঠে তেজিয়ান ঘোড়ার মত!

‘খাতা ছিঁড়লেন কেন’?

‘বাকীদের যে কারণে ছিঁড়েছি, তোমারটাও সেই কারণে’। কথা শেষ হ’য় না। সপাটে তলপেট লক্ষ্য কোরে ডান হাতের সাঙ্ঘাতিক পাঞ্চ উড়ে আসে ক’টা। তুই তামারি। ‘ম’-কারান্ত, ‘ব’-কারান্ত খিস্তিখামারি। অশ্রাব্য। বাঘের গর্জন যেন! প্রতিবর্তী ক্রিয়ায় শরীরটাকে ধনুকের মতন পিছনে টেনে  সামান্যর জন্যে পাঞ্চগুলো এড়িয়ে যাচ্ছি। আলতো ছুঁয়ে যাচ্ছে শুধু। বলা যায় চুমু খেয়ে গ্যাছে জাস্ট।  জায়গা মতন পড়লে এসব ভাবার অবস্থায় থাকতাম না। নির্ঘৎ সোনা হোয়ে যেতাম! কয়েক পা পিছিয়ে আসি। আরও ক্ষেপে ওঠে সে। বেঞ্চ টপকে লাফিয়ে বেরিয়ে আসছে। দু’হাতে খুলে ফেলছে কোমরের মোটা চামড়ার বেল্ট। সিক্সথ সেন্স বোলছে এবার বেধড়ক পিটবে আমাকে। চকিতে সব ঘটনা ঘটছে। এধার ওধার থেকে এবার উঠে আসছে আরও বেশ কিছু ছেলে। আমার কোনও বোধ কাজ কোরছে না আর। এহ বাহ্য! যারা উঠে এল, তাদের একদল তাড়াতাড়ি আমাকে আড়াল কোরে নিয়ে গেল ক্লাস ঘরের বাইরে। বোলল, ‘আপনি এখন এখান থেকে চলে যান স্যার। পরে আমরা সব বোলব আপনাকে’। আরেক দল ওই উন্মত্তটাকে সামলাচ্ছে। পারছে না। সে আরও গালাগাল দিতে দিতে চেয়ার টেবিল ধাক্কা দিয়ে ফেলে তিন তলার করিডর পেরিয়ে ছুটে নামছে সিঁড়ি ধরে। শান্ত বিল্ডিং-এ সহসা খন্ড প্রলয় যেন! হড়পা বাণ বা সুনামি। ডিপার্টমেন্টাল লাইব্রেরির থেকে লাইব্রেরিয়ান দিদি বেরিয়ে এসেছেন। ওপাশের ল্যাবরেটরি থেকে বীরেন বাবু। তপন বাবু বেরিয়ে এলেন তাঁর সিটিং রুম থেকে। চার তলা থেকেও নেমে এসেছেন অনেকে। উঠে এসেছেন দোতলা থেকে কেউ। আরও, আরও মুখ। ঘটনার আকস্মিকতায় ছায়া ছায়া সব। ক্লাস টেস্ট ভেস্তে গ্যাছে। কিছু ছাত্র নিজেদের মধ্যে আলোচনা কোরছে, ‘যেভাবে বেরিয়ে গেল – মায়াঙ্ক কিন্তু দলবল নিয়ে এক্ষুণি ফিরে আসবে’। আমি জানি, আসবে না। মেরুদন্ডহীনেরা প্রকাশ্য দিবালোকে আসেনা। পেছন থেকে ছুরি মারে।

কেউ কেউ বলল, ‘আপনি আর এখানে থাকবেন না স্যার’।

মাঠ পেরিয়ে ওপারে আমার ঘর। একা যাব? স্কুল কলেজে পড়ার সময়ে বেহালায় মামার বাড়ীতে ভাই ফোঁটার বিরাট আয়োজন হত। সেখানে দেশপ্রিয় পার্ক সংলগ্ন মনোহর পুকুর রোডের বাড়ী থেকে আসত মেযো মামীমার ভাই। তার বুকনি ছিল কিছু বেশীই। একবার বোলেছিল, ‘সান্টুদা যখন রাস্তায় হাঁটেন, আগে পরে দশ জন চলে। তার রেলাই আলাদা’! সেই সান্টুদা আসলে পাড়ার দাদা, বকলমে নেতা। এই মুহূর্তে আমার আগে পরে দশ বারোজন। শ্লাঘা হোচ্ছে। ভয়ও। ছেলেরা বোলছে, ‘ক’টা দিন বেশ সাবধানে থাকবেন। মায়াঙ্ক-এর দলটা খুব খারাপ। যা কিছু কোরতে পারে’। বড় ঝিলের পাশ দিয়ে  যাচ্ছি, ‘এইখানে খুব সতর্ক থাকবেন’। সেন্ট্রাল লাইব্রেরির পাশ দিয়ে যাচ্ছি, সতর্ক বার্তা। আরও অনেক, অনেক জায়গায়। ‘রাতের বেলায় এসব দিকে আসবেন না। আপনি টার্গেট হোয়ে যেতে পারেন’। ইউনিভার্সিটিটা হঠাৎ এত অচেনা হোয়ে যাচ্ছে কেন?

বুঝিনি সে নিরুচ্চার ভালোবাসা ছিল নিরন্তর

 

সাত

পরদিন বোর্ড অব স্টাডিজ-এর ইমার্জেন্সি মিটিং। প্রথমেই আমি ব্রিফ কোরছি। কাল ঘটনার পরে ছেলেরা য্যামনটা বোলেছে – মায়াঙ্ক একটা বাজে চক্রে পড়ে গ্যাছে। স্কুল লাইফে সুইমিং চ্যাম্পিয়ন,  লেখাপড়াতেও ভালো। ইংলিশ মিডিয়াম। চৌখশ ছেলে। সেকেন্ড ইয়ার পর্যন্ত দারুণ না হলেও, ভালো রেজাল্ট। তল্লাটে একটা ড্রাগ র‍্যাকেট চলে। স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটি সোসাইটির সফ্ট বয়রা ফার্স্ট টার্গেট। মেয়েরাও আছে। উঁচু মহলের ছেলে মেয়েরা যেচে আসে। এটা তাদের বিলাসিতা। বোঝে না, এই বিলাসিতা একদিন তাদের ইহের মায়া কাটিয়ে দেবে। অকালেই। সেটা খুব দ্রুত হ’য়। বন্ধুর ভাই কালু আর তার বন্ধু চন্দ্র কে দেখেছি। দুজনেই আমাকে ভীষণ ভালোবাসত, পছন্দ কোরতো। আমার সঙ্গে খুব ভাব ছিল। দু’জনেই নামী কলেজের সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। পাশ কোরেই চাকরী। ভালো ঘর। পাল্লায় পড়ে ক্রমে ক্রমে একদিন তারা মুখে রক্ত তুলে ইঁদুরের মতন ঘাড় গুঁজে তালতলার নর্দমায় শব হোয়ে পড়ে থেকেছে! এমনটা তো কথা ছিল না? কে দায়ী? কেউ কিচ্ছু জানে না! সবাই সব জানে। করার কিচ্ছু নেই। ইচ্ছেই নেই। উপায়ও নেই। একমাত্র উপায়, “সে নো টু ড্রাগস [Say No To Drugs]”। জ্বলজ্বলে ওই পোস্টারের কঙ্কাল খুলিটা কি ভীষণ বিদ্রুপ কোরছে!

মিটিং-এ বললাম, ‘ছেলেটা ইচ্ছাকৃত কিছু করেনি। অ্যাডিক্টেড। হ্যালুশিনেশন দেখছিল। কোরে ফেলেছে। আমার তেমন আঘাত লাগেনি। ছেড়ে দিচ্ছি’।

চিন্তা যারা করেনা বা কোরতে পারেনা তারা বিচার করে! বিচারকের সংখ্যা অনেক বেশী। কঠোর শাস্তির বিধান ছাড়া যেন এই অপরাধের বিহিত হবে না।

তাবড় টিচাররা বোলছেন, ‘ক্লাসে কে কখন ড্রাগ নিয়ে বসে আছে, কে কখন হ্যালুশিনেশন দেখবে, কখন কি ঘটনা ঘটাবে এই সব ভেবে আমরা ক্লাস নিতে পারব না। আজ যা হোয়েছে, কাল আমাদের সঙ্গেও যে সেটা হবে না তার গ্যারান্টি কোথায়? বিহিত না হলে আমরা ক্লাস করাব না’।

টিচার-কাম-নেতারা বোলছেন, ‘ক্লাসে বসে ছেলে শিক্ষক মারছে এই ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রথম। দৃষ্টান্ত মূলক ব্যবস্থা নিতে হবে’।

ভাবলাম, ইতিহাসে প্রথম কোথায়, শ্রদ্ধেয় অধাপক গোপাল চন্দ্র সেন মহাশয়-ও তো এখানেই খুন হোয়েছিলেন। তাঁর শহীদ বেদি-র পাশ দিয়ে আমি নিত্য দিন যাওয়া আসা করি।

কেউ বোলছেন, ‘সেটা একটা ইজম-এর ঘটনা। একটা বিশেষ সময়ের ঘটনা। এই বিষয়টা আলাদা’।

কেউ বোললেন, ‘তোমাকে একটা জোরদার কমপ্লেইন্ কোরতেই হ’বে’।

মন থেকে চাইছিলাম না। কোরলাম। বাধ্য হ’য়ে। তবে ‘নোট অব ডিসেন্ট’-ও দেওয়া থাকল একটা। আমার কোনও অভিযোগ নেই। ঘটনা কাকতালীয়। কোনও শাস্তি চাইছি না।

বুঝিনি সে নিরুচ্চার ভালোবাসা ছিল নিরন্তর

আট

ক’দিন পরে সকাল থেকেই বিনতা দেবী ডিপার্টমেন্টে। মায়াঙ্ক-এর মা। ছেলের গুণপণার খেসারত দিচ্ছেন। নানান জনের সঙ্গে মিটিং। অভিযোগই বেশী শুনছেন। শেষে সাবজেক্ট টিচার, আমার, মুখোমুখি। মাস খানেক আগে একদিন এই চেহারা আমি দেখেছি ক্লাস রুমের বাইরে। সেদিন তাঁর পরিচয় জানতাম না। এক জন বলেছিল একটি ছাত্রের মা। ছেলের হাল হদিশ জানতে আসেন মাঝে মধ্যেই। তিনি কি তাহলে জানতেন তাঁর ছেলের এই বেহাল দশা?

মুখোমুখি হলাম। বলি, ‘চলুন একটু ফাঁকায় বসা যাক’। শহরে ফাঁকা কোথায়? ক্যাম্পাসের বাইরে একটু দূরেই স্টুডেন্টস হস্টেলের আলাদা ক্যাম্পাস। সেখানে একটু ছোট বাগান গোছের পাওয়া যাবে। এক সময়ে সুপারের দায়িত্ব সামলেছি। খতরনাক, বেয়াড়া ধরণের কাজ। হাজার বদমায়েশির জায়গা। পাশাপাশি পাড়ার গেরস্থদের সঙ্গে নানান ঝামেলা, স্থানীয় মেয়েদের আওয়াজ দেওয়া, টিকা টিপ্পনী, অশ্লীল কথাবার্তা, থানা পুলিশ। ছেড়ে দিয়েছি। আজ গেলাম। দারোয়ান, পাম্প ম্যান, হস্টেলের অনেক কর্মচারী আসছেন যাচ্ছেন। আমি পুরনো নুন! সালাম পাচ্ছি। তবে সবাই ভাবছে সঙ্গে আবার মহিলা কেন? মহিলাটি কে? ছাত্ররা ভাবছে না। বুঝলাম মায়াঙ্ক-এর মা তাদের অচেনা নয়।

-‘আপনি জার্নালিস্ট’? ভূমিকা নেই। সরাসরি প্রশ্ন করে বসেন তিনি। আমাকে।

‘না। আমি টিচার। তবে ফ্রি-লান্স করি। হার্ড-কোর নিউজ না। অন্য ধরণের’।

-‘তাহলে কাগজে খবরটা কে দিয়েছে’?

‘শুনেছি একটা বেরিয়েছে। পড়েছি। আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করে লেখেনি। গাল গল্প। ‘মা’ হিসেবে আপনিও তো ওদের জানিয়ে থাকতে পারেন। ভুল বোললাম’?

হাসেন মহিলা। বেশ কিছু মুক্তো রঙের দাঁত। ঠোঁটে চড়া লাল। হাসছেন কেন? আমাকে বেশ একপ্রস্থ ঝাড় দিয়ে শুরু কোরবেন এমনটাই ভেবেছিলাম!

-‘আপনি দমদমে থাকেন’?

‘হ’য়ত’।

আবার কয়েকটি মুক্তো ঝরে পড়ে। ‘হ’য়ত কেন বোলছেন? বন্ধু হিসেবে আপনাকে যদি একটা সেল ফোন দিই, নেবেন’?

কোন্ দিকে জল গড়াচ্ছে? বোললাম, ‘বুঝলাম না’।

-‘আপনার তো ফোন নেই, তাই বোললাম। তাহলে যোগাযোগের সুবিধে হ’য়। ছেলের ব্যাপারে আমাকে তো এখন মাঝে মধ্যেই আসতে হ’বে’।

‘হুঁম্; অফিস আওয়ারে আমাকে পাবেন’।

-‘কেন, আমি ফোন দিলে মা বকবেন? রাগ কোরবেন’? চোখে পরিষ্কার কৌতুক!

‘তার দরকার নেই। আমি যোগাযোগ কোরে নেব’।

-‘একদিন তাহলে আপনাদের বাড়ী গিয়েই দিয়ে আসব’।

হাসি আমি। বুঝতে পারছি, ছেলের ঘটনাটা হঠাৎ গজিয়ে ওঠা আকস্মিক কোনও ব্যাপার নয়। তাই আকাশ থেকে পড়ছেন না।

বলি, ‘আমার ব্যাপারে এত সব জানলেন কি কোরে’?

চামড়ার সুদৃশ্য ভ্যানিটি ব্যাগ হাতড়ে একটা ‘আই কার্ড’ বের কোরে আনেন। নানান কিছু লেখা। ওপরের দিকে লোগো। মাঝে তাঁর নামের নীচে ল্যাজ – অ্যামেচার জার্নালিস্ট। তবে আমার এই সব ঠুনকো খবর গুলো জোগাড় করার জন্যে ‘জার্নালিস্ট’ হোতে হ’য় না।

বললাম, ‘তাহলে তো আপনিই ছেলের ব্যাপারটা কাগজে জানিয়েছেন। লিখেছেনও কি’?

-‘একেবারেই না। শুনেছি আপনি লেখালিখি কোরেন, তাই আপনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম’।

‘ছেলের ড্রাগ অ্যাডিক্শনের ব্যাপার আপনারা জানতেন না’?

-‘জানি। ক’য়েকবার রি-হ্যাবেও দেওয়া হোয়েছে। সেখানে থাকেনি। কাজ হ’য়নি’।

‘বাড়ীতে কি করে’?

-‘সবটা বোলতে পারিনা। বাবার সঙ্গে গ্রে স্ট্রীটের বাড়ীতে থাকে। তিন তলায়, আলাদা ঘরে। আমি ছোট ছেলেকে নিয়ে হাওড়ায় আমার বাপের বাড়ীতে থাকি’।

‘ভালো বুঝলাম না’।

-‘আমাদের সেপারেশন হোয়ে গ্যাছে। ওর বাবা ড্রাংকার। শুনেছি ইদানিং ড্রাগস্ও নেয় সম্ভবত, খুব সিওর নই। পুরনো দিনের জমিদারি স্টাইল। অশ্লীল গালিগালাজ করে আমাকে। ছেলেদেরও। মারধোরও হয়েছে। গ্রে স্ট্রিটের বাড়ীর ঢিল ছোঁড়া দূরেই সোনাগাছির রেড লাইট এরিয়া। প্রস্ কোয়ার্টারেও যায় নিয়মিত। ওই বাড়ীর পরিবেশ একদম ভালো নয়। দুটো ছেলেই দারুণ ভালো ছিল। বড়টা পাল্লায় পড়ে গ্যাছে। ছোট ছেলে হায়ার সেকেন্ডারি দেবে। ওকে এই পরিবেশ থেকে বাইরে নিয়ে এসেছি। বড় ছেলের রাগ আমার ওপর’।

এক নিঃশেষে অনেক কথা। একজন মহিলা, তারও ওপর একজন মায়ের মুখে এই সব প্রসঙ্গ শুনতে একদম ভালো লাগছে না। অস্বস্তিও হোচ্ছে। কিন্তু বাস্তব বড়ই কঠিণ। কথা ঘোরাই।

‘শুনেছি আপনার ব্যবসা। কিসের’?

কিসের ব্যবসা জেনেছি আগেই। বীরেন বাবুই বোলেছিলেন সে কথা। লোহা লক্কড়ের কারবার করেন মহিলা। গোদা বাংলায় কালোয়ারনী। কোন একটা এক্সপেরিমেন্টের কাজের জন্যে পুরনো মডেলের একটা মিলিং মেশিনের বেড জোগাড় করে দেবার বরাত দিয়ে রেখেছেন বীরেন বাবু। তবুও না জানার ভান করি।

বললেন, ‘বাবার ব্যবসা ছিল। তিনি মারা যাবার পরে সেই ব্যবসাটাই দেখি। পু্রনো লোহা কেনা বেচা’।

‘শুনেছি লোহার কারবারে ব্যবসায়িক ঝুঁকির বাইরে জীবনেরও ঝুঁকি থাকে খুব। কি কোরে সামলান? আর্মস রাখেন’?

হাসেন মহিলা। সাজানো দাঁতের সারিতে মুক্তোর উদ্ভাস। চোখের তীক্ষ্ণ চাহনির পেছনে পরিষ্কার বেদনার ছাপ। ভারী চেহারা। শ্যাম বর্ণ। কিছু রঙ আছে শরীরে। চটকদার না হলেও আকর্ষণীয়া! সম্ভ্রমকারী উপস্থিতি।

-‘এতদিন কাজ করছি। সবারির সঙ্গেই স্নেহের সম্পর্ক হোয়ে গ্যাছে। অসুবিধে নেই। আর্মস রাখতে হ’য় না’।

আমাদের বিভাগের দীপক স্যার একবার বোলেছিলেন, ইউনিভার্সিটিতে যখন জাঙ্ক মেশিনারির বিড হ’য়, তখন অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিং-এর আনাচে কানাচে কালোয়ারদের মাসল ম্যানরা ঘুরে বেড়ায়। তাদের প্যান্টের ওপর দিয়ে ঝুলতে থাকা শার্টের নীচেই কোমরে গোঁজা থাকে আগ্নেয়াস্ত্র। একটু এদিক ওদিক হলেই শুরু হোয়ে যেতে পারে ফায়ারিং, ক্রশ ফায়ারিং। ভাগ্য প্রসন্ন, এমনটা দেখতে হ’য়নি এতাবধি।

হস্টেল থেকে কিছু ছেলে বেরিয়ে আসছে। বোললাম, ‘ইনি মায়াঙ্ক-এর মা। এটা অফিশিয়াল বলা। তবে আমার বলার প্রয়োজন হত না। কারণ এই মহিলা তাঁর ছেলের কারণে তার নানান সহপাঠীদের কাছে আগেই এসেছেন। তারা তাঁকে চেনে। তবুও আমার কর্তব্য। তাদের বোললাম, ‘মায়াঙ্ক-এর ব্যাপারটা তো জানোই। তোমরা সব কিছু ইনফর্মেশন ওনাকে শেয়ার কোরবে’।

বেলা পড়ে আসছে। উঠে পড়ি।

-‘আমি কিন্তু মাঝে মধ্যেই এসে আপনাকে বিরক্ত কোরে যাব’। আবারও মুক্তো ঝরে পড়ছে! চাহনির তীক্ষ্ণতার আড়ালে বিষাদ। সূর্য আরো একটু পশ্চিমে হেলল।

‘মাই প্লিজার। অলওয়েজ ওয়েলকাম’।

বুঝিনি সে নিরুচ্চার ভালোবাসা ছিল নিরন্তর

 

নয়

-‘ তাহলে তো ব্যাপারটা কিছুটা মিটেই গ্যাছে বল্’। কিছুটা আশ্বস্ত হওয়ার সুর দিদির গলায়!

‘না, মেটেনি। বরং জট আরও কিছুটা বেড়ে গ্যাছে’। আরেকবার আজান শুরু হয়ে গেল। মাইকের ওপরে গলার আওয়াজ উঠবে না। চুপ করে যাই।

-‘আরেকবার চা খাবি’?

চা-এ আমি না বলি না। মেয়েটি রান্না ঘরে চলে যায়।

বুঝিনি সে নিরুচ্চার ভালোবাসা ছিল নিরন্তর

দশ

চা এলে আবার শুরু করি। সবারির বিবেচনা মোতাবেক কঠোর শাস্তি বিধানের ওপরে আমার ‘নোট অব ডিসেন্ট’ থাকার ফলে ছেলেটার শাস্তি কিছুটা কম হতে পারে। নাহলে রাস্টিকেট হতে হত। এখন হ’য়ত কয়েকটা সিমেস্টারের জন্যে সাসপেন্ড হবে। কিন্তু ছেলেটাই তার ভবিতব্যকে খাদের কিনারে নিয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন! কয়েকদিন আগেই আরেক কান্ড বাধিয়ে বসেছে। সেদিন সন্ধ্যা বেলায় ক্লাস শেষের পরে হাইড্রলিক্স বিল্ডিং-এর ল্যাবে সুকৃত বাবু ছিলেন একা। অনেক সিনিয়ার প্রফেসর। ‘লাথ্থি মেরে ক্লাস থেকে বার কোরে দেব’ বা ‘তোমার মুন্ডু কাটব’ বলে হরবখত তম্বি কোরলেও দিলচাস্ মানুষ! তো, তাঁর সঙ্গেও ল্যাব সংক্রান্ত কোনও ব্যাপারে ছেলেটার ভুল বোঝাবুঝি হোয়েছে। কিছু কারণে সুকৃত বাবু তাকে বোলেছেন, ‘লাথ্থি মেরে বার কোরে দেব’। ব্যাস; অ্যাডিক্শন মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে আবার। সন্ধ্যার নিঃস্তব্ধতাকে খান খান কোরে দিয়ে হঠাৎ ঝন ঝনাৎ শব্দে চার ফুট বাই তিন ফুট নোটিশ বোর্ডের মোটা কাচের পাল্লা চুর চুর হোয়ে ভেঙে পড়েছে। ছেলেটার ডান হাতের কনুই থেকে কব্জি, হাতের তালু পর্যন্ত কেটে কুটে রক্তারক্তি! তার পরেও ধমকি দিয়েছে, ‘সুইসাইড কোরে তোর নাম দিয়ে যাব শালা’। বেজায় ঘাবড়ে গ্যাছেন স্যার। স্বাভাবিক। আবারও ইমার্জেন্সি মিটিং, আবারও জল ঘোলা। সেই মিটিং-এ আমি অ্যাবসেন্ট। স্যার ছাড়ান দেননি। মেজরিটি মাস্ট বি গ্রান্টেড।

রহমান দা একদিন বললেন, ‘এক্সিকিউটিভ কমিটির মিটিং-এ সবাই একযোগে উঠে দাঁড়িয়ে আপনাদের সাপোর্টে বলেছে। তবে আপনার ক্ষমা থাকার ফলে ছেলেটার চারটে সিমেস্টারের ওপর দিয়েই গেল। না হলে হ’য়ত তাড়িয়ে দিত’।

বেশ বুঝতে পারছি, এই ছেলে শুধরোনো খুবই মুশকিল। বাড়ীর পরিবেশ নেই। এই শাস্তি তাকে আরও না বিপথে ঠেলে দেয়! মা-কে সে পছন্দ করে না। পরিস্থিতি তাঁরও অনুকূলে নেই। নিজেই জীবনের ভীষণ লড়াই লড়ছেন একটা! তিনি কিন্তু আপ্রাণ করছেন। হাজার হলেও, ছেলে তো!

এর পরে অনেকেই কখনও কখনও দেখেছে ক্যাম্পাসে একটা ছেলে এক মহিলাকে বেদম মারধোর করছে বা ধাক্কা দিতে দিতে গেটের বাইরে বার কোরে দিচ্ছে। ছেলেটার সারা হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা ইত্যাদি। মহিলার হাসি মুখ কিন্তু আমি দেখেছি অনেকদিন!

বুঝিনি সে নিরুচ্চার ভালোবাসা ছিল নিরন্তর

 

এগারো

কফি হাউসে বসে বেশ ক’রাউন্ড ইনফিউশন শেষ কোরেছি আমরা। প্রফেসর মুখোটি থামলেন। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি হল ছেলেটার’?

-‘খুব ভালো জানি না। বিনতা দেবী আসেন মাঝে মধ্যে। খুব পজিটিভ তো কিছু শুনি না। ওই ‘হচ্ছে’ ‘হবে’ গোছের কথাবার্তা। আমার ওপর রাগ করেননি, এই যা। বরং বেশ বন্ধুত্বেরই সম্পর্ক হোয়ে গ্যাছে একটা। এক সময়ে নাকি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতেরও তালিম নিয়েছেন। বোলেছেন, একদিন সপাট তান শোনাবেন’!

শেষ বাক্যটা বোলে হাসেন তিনি।

প্রফেসর সাহেব কথা গুলো টান টান বোলে গেলেন। সব পয়েন্ট নোট রাখতে পারিনি। অনেক জায়গায় শুধু ‘হাঁ’ কোরে গিলেছি। তবে মগজে সেঁধিয়ে নিয়েছি সব কিছু। রাতে বাড়ী ফিরেই লিখে ফেলতে হবে সেসব।

বললাম, ‘বাবু, রাত হল। এবার উঠতে হ’বে তো। আবার কবে দেখা হবে আমাদের? ও হ্যাঁ, ভালো কথা, আমার পদ্যটা কিন্তু ইতিমধ্যেই লেখা হোয়ে গ্যাছে। নাম দেব ভেবেছি ‘বুঝিনি সে নিরুচ্চার ভালোবাসা ছিল নিরন্তর’। তুমি কি বল, ঠিক হবে না’?

বুঝিনি সে নিরুচ্চার ভালোবাসা ছিল নিরন্তর

 

বারো

ওই ঘটনার পরে কেটে গেছে আরও বহু বছর। এই, মাত্র কিছুদিন আগেই আমার এক খুব প্রিয়জন, মনে হ’য় যেন কতদিনের এক আপনার জন, এক আত্মার আত্মীয়ার বাড়ীতে সান্ধ্যকালীন হাজিরা দিয়েছি। সেটাই প্রথম বার। জানি না, শেষ বারও কিনা! শহরের এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নন- টিচিং) বিভাগ থেকে অবসর নেওয়া আমার এক পরিচিত মানুষও ছিলেন সেই সন্ধ্যায়। তাঁর মাধ্যমে ক’দিন আগেই এক মুখ বন্ধ খামে কিছু পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করেছিলাম আমার ওই প্রিয়জনের কাছে। সেই কারণে দু’তরফ থেকেই মানুষটি আমন্ত্রিত ছিলেন সেই সান্ধ্য আসরে। নিঁখুত আলপনা দেওয়া সিঁড়িপথ ধাপে ধাপে সন্ধ্যার ছাদে উঠে যায়। সবুজের মধ্যে এসে পড়ি আমরা! সারা  ছাদ জুড়ে সাজানো সবুজ, হরেক কিসিমের গাছ গাছালি। দোলনায় দোল খাওয়ার আয়োজন। নানান খাদ্য সম্ভারের সঙ্গেই আমার প্রিয়জনের নিজ হাতে তৈরি ফিশ ফ্রাই। অসাধারণ! আড্ডায় যেমন হ’য়, বহতা নদীর মতই ঘুরে ফিরে আসে নানান প্রসঙ্গ – প্রাসঙ্গিক অথবা অপ্রাসঙ্গিক, প্রয়োজনীয় অথবা অপ্রয়োজনীয়। এমনি কি একটা যেন কথার খেই ধরে অতিথি মানুষটি এক ঘটনার উল্লেখ করলেন। বহুদিন আগে তিনি নাকি তাঁর কর্মস্থলে দেখেছিলেন এক ছেলে, হাতে তার ব্যান্ডেজ বাঁধা, প্রচন্ড মারধোর করছে এক মাঝ বয়সী মহিলাকে। ধাক্কা দিতে দিতে তাঁকে বার কোরে দিচ্ছে রাস্তায়।

সেই কথা থামিয়ে দিয়ে বলি, ‘জানি সেই ঘটনা। এ আমার পরিচিত এক অধ্যাপকের কাছে শোনা, তাঁরই কাহিনী। তাঁর কাছে শুনে লিখেওছি সেই কথা। মায়ের কাছে আর মাসীর গল্প করার দরকার নেই’।

অনেকদিন পরে খুব ভালো সেই সন্ধ্যেটা কাটিয়ে ফিরে আসি বাড়ীতে। আকাশে আজ অনেক তারা! পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল তারা আমাকে। জানিনা, ওই রকম সন্ধ্যে আবারও কখনও ফিরে পাব কি না!

[মতামত ও বানানবিধি লেখকের ব্যক্তিগত]

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ