কথা ছিল পুরুলিয়া যাব পলাশ দেখতে। কিন্তু যাবার আগের দিন হুজুক উঠলো তারাপীঠ । আমি প্রথমে রাজি হচ্ছিলাম না গন্তব্য পরিবর্তনে। শেষ পর্যন্ত লড়ে গিয়েছিলাম তারাপীঠ না যাওয়ার জন্য। কিন্তু মহিলা সদস্যদেরই জয় হলো। তারাপীঠ সম্পর্কে গল্প শুনে শুনে কেমন যেন একটা অনাগ্রহ তৈরি হয়েছিল আমার মনের মধ্যে। এই অনাগ্রহের কারণ বলতে গেলে আমাকে অরুণের গল্প বলতেই হয় কারণ ওর অভিজ্ঞতাতেই আমার তারপীঠ চেনা।
##
অরুণ আমার সহকর্মী, আমার চেয়ে অনেকটাই ছোট। ঝাড়খন্ডের এক ছোট জনপদ আমাদের কর্মস্থল। ও এসে জয়েন করলো চাকরিতে, আমার পাশেই ওর কোয়ার্টার হলো। স্মার্ট, সৌখীন, সুবেশ অরুণের কাছে আমি জেনেছিলাম পাওয়ার না বদলালেও কেউ চশমা বানায়, বিভিন্ন পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে চশমা পরে। আমাদের টাউনশিপ ছিল শহর থেকে দূরে, শহরে যাতায়াতও খুব সচ্ছন্দ ছিল না। ফলে নিজেদের মধ্যে মেলামেশাই আমাদের অবসর বিনোদন ছিল। ওর স্ত্রী প্রিয়া ছিল ততোধিক স্মার্ট। অল্পদিনেই সে আমাদের মধ্যে মিশে গেল। প্রিয়া আমার স্ত্রীর কাছে ছোট বোনের মতো সময়ে অসময়ে, সাংসারিক খুঁটিনাটি প্রয়োজনে আসতো।শনিবার আমাদের সান্ধ্য আসর বসতো এক একজনের ঘরে। বাড়িতে তৈরি হোতো চায়ের সঙ্গে ‘টা’। প্রিয়ার তৈরী সান্ধ্য স্ন্যাক্স আমাদের আড্ডায় আলাদা মাত্রা যোগ করত। সে ছিল প্রবাসী বাঙালী, বাংলার চেয়েও হিন্দী ইংরাজীতে স্বচ্ছন্দ ছিল। একটু অবাঙালী টাচ ওর চরিত্রে একটা আলাদা বৈশিষ্ট দিয়েছিল। খুব তাড়াতাড়ি সে একটা ইংরেজি স্কুলের চাকরি জুটিয়ে নিল। অরুণ নিজের স্ত্রীকে নিয়ে বেশ গর্বিত ছিল। সব মিলিয়ে ভালোই কাটছিল দিন। প্রতিবেশী হিসেবে আমরা ওদের পছন্দ করতাম। কিন্তু প্রিয়া অল্পদিনের মধ্যেই ঐ শান্ত, নিস্তরঙ্গ, গ্রাম্য জীবনে হাঁপিয়ে উঠলো। ক্রমাগত অরুনকে চাপ দেবার ফলে সে কোনো ভাবে প্রভাব খাটিয়ে কোলকাতা অফিসে বদলির একটা ব্যবস্থা করে নিল।
তারপর থেকে ওদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ কমে আসে। আমি ওদের খবর পেতাম লোকমুখে। ইতিমধ্যে ওদের একটা কন্যাসন্তান জন্মেছে। প্রিয়া কলকাতায় এসে নিজের গুণে একটা কর্পোরেট অফিসে চাকরিতে যোগ দিয়েছিল। আমি ওদের প্রতিদিনকার খবর আর পেতামনা। কলকাতা অফিসে কোনও কাজ এলে ওর সঙ্গে দেখা হোতো, আমরা উভয়ের পারিবারিক খবর নিতাম। আমি দেখতাম প্রিয়াকে নিয়ে ওর গর্ব আরও বেড়েছে। সে অফিসে দ্রুত উন্নতি করেছে, কোম্পানীর উচ্চ পদাধিকারীদের সঙ্গে কাজ করে। মাঝারি মাপের অফিসাররা ওকে খুব সমীহ করে। এসব গল্প আমার গর্বিত অরুণের কাছে শোনা। একটু আধটু মডেলিং ও শুরু করেছে। কী একটা প্রডাক্ট নিয়ে খবরের কাগজে ওর ছবি দেখাল গর্বিত স্বামী। যখন ওরা আমার প্রতিবেশী ছিল আমি ওদের একটু স্নেহ করতাম। ফলে ওদের উন্নতির খবরে আমি খুশিই হলাম।
এর কয়েকবছর পরে আমিও কলকাতা অফিসে বদলি হয়ে এলাম। এসে দেখলাম ওর স্বাভাবিক উচ্ছ্বাস, স্বতঃস্ফূর্ততা যেন একটু স্তিমিত। প্রিয়ার কথা আগে শেষ হত না। এখন প্রসঙ্গ উঠলে দুচার কথার পর , কোনও ভাবে পাশ কাটিয়ে মেয়ের গল্পে চলে যায়। এক সময়ে ওর আড়ষ্টতা কেটে গেল। ও আবার মন খুলে কথা বলতে শুরু করল। বুঝলাম ওঁদের দাম্পত্যে চিড় ধরেছে। বিবাহিত জীবনের প্রথমদিকের সেই সুগার কোটিং আর নেই। সেটা অবশ্য কারোরই থাকে না। তবে এক এক বয়সের এক এক আকর্ষণ ভিন্ন ভিন্ন মাধুর্য্য নিয়ে আসে যা যৌথ জীবনকে বেঁধে রাখে। কিন্তু অবিশ্বাস এসে গেলে জীবনের সব মাধুর্য্য শুষে নেয়। সেটাই হয়েছে ওদের জীবনে।
আমাদের সরকারী উদ্যোগের অফিসের নিয়ম-কানুনের সঙ্গে প্রিয়ার কর্পোরেট অফিসের মিল নেই। উচ্চাকাঙ্খা ওকে টেনে নিয়ে গেছে অন্যরকম জীবন দর্শনে। আমি যা বুঝলাম অরুণের কথা শুনে – প্রিয়ার অফিস থেকে ফেরার সময়ের ঠিক নেই। ও অরুণের অফিসে বেরোনোর সময় বিছানা ছেড়ে ওঠে না, অরুণ নিজেই কিছু ব্রেকফাস্ট তৈরী করে খেয়ে অফিস বেরিয়ে পড়ে। প্রিয়া কোনও রকমে মেয়েকে তৈরি করে স্কুলে পাঠায়। তারপর তৈরি হয়ে অফিস বেরিয়ে পড়ে। স্কুল থেকে ফিরে মেয়ে কাজের লোকের জিম্মায় চলে যায়। রোজ বাইরের খাবার। পোশাক আশাক, খেলনা, অন্যান্য দামি দামি জিনিস যথেচ্ছ কেনা হয়, সারা বাড়িতে ছড়িয়ে পড়ে পড়ে থাকে। অরুণ অসহায়ের মতো এসব দেখে, অপছন্দের খাবার খায় এবং এক শ্রীহীন সংসারে বাস করে। অসুখের ক্ষেত্রে যেমন হয় নিরাময় নতুবা রোগ বৃদ্ধি, কদাচিৎ এক জায়গায় স্থির থাকে। দাম্পত্যের ক্ষেত্রেও তাই। অরুণ-প্রিয়ার দাম্পত্যের সেই সুক্ষ্ম চিড় এখন ফাটলে পরিণত হয়েছে। অফিসের গাড়ি আজকাল তাকে বাড়ি পৌঁছে দেয়। অরুণ লক্ষ্য করে গাড়িতে থাকে আরেকজন । গাড়ি থেকে নেমে পিছন ফিরে হাত নাড়ে প্রিয়া, যুবক গাড়ির কাচ নামিয়ে হাসি মুখে রিয়াকে বিদায় দেয়।
“ তোমার এই সব গল্প শুনে আমার অবাক লাগছে, অরুণ। আমরা কি মানুষকে এতোটুকু চিনি না? তোমার বৌদিকে তাই বলছিলাম। এ সব শুনে ও অবাক হয়ে গেল। দেখ, অফিসের গাড়ি ওদের দুজনকে পৌঁছে দেয়। প্রিয়া যখন গাড়ি থেকে নামে তখন সৌজন্য বশতঃ সে পিছন ফিরে তাকায়, ওর সহকর্মী সহজভাবেই হয়তো ওর দিকে তাকায়। তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে না তো?”
অরুণ মানতে চায় না। এক কথায় উত্তর দেয় “পৃথিবীতে মানব চরিত্র সবচেয়ে রহস্যময়”।
আমি ওকে বোঝাতে চাইলাম, “দেখ, প্রিয়া যে সংসারটা ঠিক করে না, বেলা অবধি ঘুমোয়, তুমি অফিস বেরোবার সময় স্ত্রীর কর্তব্য করে না, যথেচ্ছ জিনিস কিনে টাকা নষ্ট করে এগুলো আমি মেনে নিচ্ছি। আমি যখন ওকে চিনতাম ওর মধ্যে এসবের বীজ আমরা দেখেছি। ও ঠিক আমাদের স্ত্রীদের মতো নয়। স্ত্রী যদি চাকুরিরতা হয় তাহলে তার ঘরের কাজে কিছুটা ঘাটতি হবেই। সেটাকে মেনে নিতে হবে। ঘরের কাজের অর্ধেক দায়িত্ব পুরুষ্কে নিতে হয়। তাঁর মধ্যে কেউ যদি একটু কম কাজের হয় তাহলে তো কথাই নেই। প্রিয়া, আমি যতদূর জানি এই রকমই। আমার বাড়িতে কজের লোক না এলে নিঃশব্দে সব কাজ করে নেয় তোমার বৌদি। কিন্তু প্রিয়া একটু অন্যরকম। কিন্তু প্রিয়া অন্য কারো সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে, এটা সত্যি নাও হতে পারে”। কিন্তু আমার পরামর্শে কোনো কাজ হয়না। উদভ্রান্তের মতো অরুণ অফিস আসে, কয়েকজনের সঙ্গে ব্যক্তিগত কথা বলে। আমি যদিও তাদের মধ্যে একজন ছিলাম, তবু সব কথা আমি জানতাম না।
-“অরুণ, আমার খুব খারাপ লাগছে তোমাদের সম্পর্কটা এইরকম জায়গায় চলে গেল। আমি তো তোমাদের একদম প্রথম থেকে জানি”। অরুণ চুপকরে থাকে। আমি আরও কিছু কথা বলতে গেলে ও আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, “ এসব আর আলোচনা করে লাভ নেই। আমাদের মিউচুয়াল ডিভোর্সের নোটিস দেওয়া হয়ে গেছে”।
“ঠিক আছে, ওর ফোন নং টা আমাকে দেবে তো ?”
প্রিয়াকে ফোন করে একদিন দেখা করলাম ওর অফিসে। অফিসের কাছেই একটা ক্যাফে তে বসে আমরা কথা বলছিলাম। প্রিয়ারও এক কথা। আর এক সঙ্গে থাকা গেল না। প্রিয়া একটু দূরে ওর বাবা মার ফ্ল্যাটের কাছেই একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে। একা থাকবে মেয়েকে নিয়ে তাই বাবা মার সাহায্য খুব দরকার।
“ ব্যাপারটা কী জানেন, আমার চাকরিটা ঠিক আপনাদের মতো নয়। ঘড়ি ধরে ছুটি হয়না। বিকেলের দিকে মিটিংগুলো হয়, আমাকে সেগুলো অ্যারেঞ্জ করতে হয়। এই নিয়ে অশান্তি। আমাকে অফিসের গাড়িতে বাড়িতে ছেড়ে দেয়, এই দিকে চারজনের বাড়ি, দুজন পুরুষ, দুজন মহিলা, আমরা একসঙ্গে আসি।আমি তিন নম্বর, আমাকে নামিয়ে চতুর্থজন বাড়ি যান। ঘটনাচক্রে তিনি পুরুষ। এইটা অশান্তির বা অবিশ্বাসের একটা বড় কারণ। অফিস থেকে ফেরা মাত্রই আমাকে জেরার মুখে পড়তে হোতো। আমি অনেক বুঝিয়েছি, কিন্তু কোনো ফল হয়নি।
আমি হেডঅফিসে বদলি হয়ে এসে তোমাদের সম্পর্কের অবনতির খবর পেলাম। আমার এতো খারাপ লাগলো। নতুন বিয়ের পর তুমি আমাদের প্রতিবেশী হয়ে এলে। রমা তো তোমাকে নিজের বোন বলে মনে করত। তোমাদের কথা শুনে ওর ও ভীষণ মন খারাপ।
আমি জানি। আমি যখন প্রেগন্যান্ট তখন রমাদি আমাকে বড় দিদির মতো যত্ন করিছিল সে কি আমি কোনদিন ভুলব? আমি শুধু আমার বিবাহিত জীবন, আমার হাসব্যান্ডকে হারিয়েছি তাই নয়, আমি আপনাদেরও হারিয়েছি। যে তিন বছর আপনাদের সঙ্গে কোয়াটার্সে ছিলাম সেটা আমার জীবনে সুন্দর সময়। আমি তো বড় শহরে বড় হয়েছি, এখন কোলকাতায় রয়েছি। এখানে মানুষে মানুষে সম্পর্ক তৈরি হয় না। আপনাদের সঙ্গে না থাকলে আমার জানা হতোনা যে মানুষ এতো আপন হয়। আমাকে কতজন সাধ খাইয়েছিল বলুন তো? কিন্তু আপনাদের সব আমি হারিয়ে ফেলেছি।
পিঙ্কি কেমন আছে? সে ব্যপারটাকে কীভাবে নিল?
এইরকম পরিস্থিতিতে পড়লে ছোটরা তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যায়। রোজ রাতে অফিস থেকে ফেরার পর আমরা যখন ঝগড়া করতাম তখন ও বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকতো অসহায়ের মতো। ওর মনের ওপর চাপ পড়ছিল। স্কুল থেকে আমাদের ডেকে পাঠিয়ে ছিল। আমাদের দুজনকেই যেতে হয়েছিল।
আমার একটু ভালো লাগলো। তাহলে এখনও যোগাযোগ আছে! সেকথা বলতেই অরুণ বলল, পিঙ্কির লেখাপড়া, শরীর খারাপ ইত্যাদি ব্যাপারে প্রয়োজন হলে ও কথা বলে।
অন্য কোনো কথা হয় না?
না। আমরা একসঙ্গে হলে পিঙ্কি খুব খুশি থাকে। ও মাঝখানে থেকে দুজনের হাত ধরে হাঁটে। প্রিন্সিপাল দুচার কথার পর পিঙ্কিকে ক্লাসে পাঠিয়ে জানালেন পিঙ্কির স্বভাবে একটু পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন টীচাররা। ইদানিং ও মনমরা থাকে, ক্লাস টেস্টে একটু কম নাম্বার পাচ্ছে।গেমস পিরিয়ডেও চুপচাপ থাকে। আমাদের কাছে সব জেনে বললেন এ বিষয়ে ওনার কিছু বলার নেই। পরামর্শ দিলেন যত বেশি সম্ভব মেয়েকে সময় দিতে। বুঝলেন দাদা, পিঙ্কিকে নিয়ে স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে আছি। বাবাকে দেখেই পিঙ্কি ছুটে গিয়ে বাবাকে হাত ধরে নিয়ে এসে এক হাতে বাবার হাত আর এক হাতে আমার হাত ধরে হাত দোলাতে দোলাতে স্কুলে ঢুকল।
তোমাদের কিছু মনে হলোনা, অপরাধী মনে হলোনা নিজেদের সন্তানের শৈশবটা নষ্ট করে দেবার জন্যে?
নিশ্চয়ই মনে হয়, সবসময় মনে হয়। কিন্তু আমি নিরুপায়, আমরা তো হঠাৎ একদিন এই জায়গায় এসে পৌঁছইনি। অনেক অশান্তির পর একদিন…। আমার এইসব গল্প বলতে ভালো লাগে না। আমি শেষদিনের ঘটনাটা আপনাকে জানাই। আপনার সঙ্গে যেরকম এই ক্যাফেতে বসে চা খাচ্ছি এরকম কখনও কখনও কারুর সঙ্গে চা কফি খেতে আসতেই পারি। সেটা প্রয়োজনে, বন্ধুত্বের খাতিরে বা নিছক সময় কাটানোর জন্যে হতেই পারে কখনও। তারমানে কি এই যে আমি কোনো নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছি?
দেখ, এসব তোমাকে হয়তো জিজ্ঞেস করা যায়না, তবু- সত্যিই কি এরকম কোনো সম্পর্ক…।
আমি এখন সিংগল, মধ্যতিরিশ, আমি একটা চাকরি করি, আমি স্বচ্ছলতার সঙ্গে নিজের সন্তানের প্রতিপালন করতে পারি। আমার তো মিথ্যেকথা বলার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি তো একজন মানুষ, আমি তো এখন কারোর সঙ্গে সম্পর্ক করতেই পারি। করলে সেটা অনৈতিক তো হবে না। আপনার কাছে আমি অনেক স্নেহ পেয়েছি। আপনাকে মিথ্যে কথা বলব না, বলার কোনো কারণও নেই। আমি কোনো সম্পর্কে জড়াই নি।
তবে যে ও নিশ্চিত হয়ে এসব বলে?
ও বলে না ওকে বলায়। আপনার অফিসে সুব্রত আছে, আপনি ওকে জিজ্ঞেস করবেন। কে ওকে এসব বলাচ্ছে, কেন বলাচ্ছে। আমি বেশি কিছু বলতে চাই না, আপনার তৃতীয় কারোর কাছে জনা উচিৎ। আর এককাপ কফি?
না না ধন্যবাদ। তোমাদের ব্যক্তিগত বিষয়ে মাথা গলালাম। কিছু মনে কোরোনা।
উদ্দেশ্য তো খারাপ ছিল না আপনার। আপনি আমাদের ভালোবাসেন, সেখানে ব্যক্তিগত বলে কিছু নেই। হ্যাঁ শেষ দিনের যে ঘটনাটা আমি বলব বলছিলাম- দাম্পত্যে যখন বিপর্যয় আসে, মনের কথা বলার মানুষটা দূরে সরে যায়, তখন কথা বলার তো একজন বন্ধু লাগে। অমল আমার তেমনই বন্ধু।আমার সব সমস্যায় আমি ওর সঙ্গে কথা বলি।ওর স্ত্রীও আমার বন্ধু। অমল আমাকে ওর জন্মদিনে রেস্তোরাঁয় খাওয়াবে বলল। আমি ওকে বললাম জন্মদিন পরিবারের সঙ্গে কাটাও। আমাকে অন্য একদিন খাইও। সেদিন ছিল সেই দিন।
আমরা রেস্তোঁরা থেকে বেরিয়েছি এমন সময় উদ্ভ্রান্তের মত হাজির হল আপনার ভাই। কোন ভূমিকা ছাড়াই অকথ্য গালাগালি দিয়ে অমলকে চড়,ঘুঁসি মারতে শুরু করল। অমলও সজোরে মারল ওর মুখে ঘুঁসি। গল্গল করে রক্ত বেরোতে লাগলো অরুণের মুখ দিয়ে। লোকজন জড় হয়ে গেল সবাই ধরাধরি করে ছাড়িয়ে দিল। রাস্তার লোকজন সকলেই ব্যস্ত, কে কী বুঝল জানিনা, একে একে ভীড় পাতলা হয়ে গেল। অরুণ আরও কিছু গালাগালি দিয়ে ভীড়ের মধ্যে মিশে গেল। আমি বাড়ি ফিরে দুটো সুটকেস নিয়ে মেয়ের হাত ধরে বাবা মায়ের ফ্ল্যাটে চলে গেলাম। আর ফিরি নি।
##
সুব্রতকে জিজ্ঞেস করতে সে জানালো যে অরুণ ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছিল সে আত্মহত্যার কথাও ভাবছিল। সুব্রত রামকৃষ্ণ মিশনে দীক্ষিত। ও অরুণকে একদিন বেলুড় মঠে নিয়ে গিয়ে একজন সন্ন্যাসী মহারাজের সঙ্গে দেখা করে সব কিছু খুলে বলে। এতে আশ্চর্য কাজ হয়। সন্ন্যাসী মহারাজ বললেন, “ দেখুন, আমি তো সংসারী মানুষ নই। তবু আশ্চর্যের কথা আপনি আপনার দাম্পত্যের সমস্যায় আমার পরামর্শ নিতে এসেছেন। আসলে আপনি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে এসেছেন। ঠাকুরের শিক্ষা ভালোবেসে মানুষকে আপন করতে হয়”। মহারাজ বললেন, “আপনি একটু ধৈর্য্য ধরুন, একটু ভালোবাসা দিয়ে অবিশ্বাসকে দূরে রাখতে চেষ্টা করুন। একটা কথা মনে রাখবেন জন্মের আগে এই পৃথিবীতে আমরা ছিলামনা, মৃত্যুর পরেও আমরা থাকবোনা। মাঝখানের এই সামান্য কদিন আমরা আছি। পৃথিবী থাকবে অনন্ত কাল। সুতরাং হটকারী হয়ে এই মানব জীবনটা অপচয় করবেননা। আমরা কিন্তু মন্ত্রবলে বা কোনো যাদু কাঠি দিয়ে আপনার ভাঙ্গা সংসার জুড়ে দিতে পারব না। আমরা আপনার মনে শক্তি যোগাতে পারব যাতে আপনি আপনার সংসারটা নিজেই জুড়ে নিতে পারেন। তা যদি নাও হয় একটা সার্থক জীবন কাটানোর আরও অনেক পথ আছে। আমরা আপনাকে সে দিশা দেখাতে পারি।। চলুন আমরা প্রেসিডেন্ট মহারাজকে একবার প্রণাম করে আসি। আপনি কথামৃত পড়েছেন? আপনাকে আমি কটা বই পড়তে বলছি, আপনি কিনে নিয়ে যান। নিয়মিত পড়ুন। রামকৃষ্ণ কথামৃত রোজ পড়ুন। যখনই সময় পাবেন যে কোনো পাতা খুলে পড়ুন। এই বইটি পড়ে শেষ করা যায় না। যত পড়বেন তত অমৃত উঠে এসে আপনার মনকে প্রশান্ত করবে আর শান্ত মনই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে”।
অরুণের মন অনেকটা শান্ত হয়। ও রামকৃষ্ণ মিশনে দীক্ষিত হয়। সন্ন্যাসী মহারাজের পরামর্শে ও ধ্যান শুরু করে নিয়মিত। চরম অবস্থা থেকে ও অনেকটাই ফিরে আসে।
তাহলে আবার কী করে এই জায়গায় চলে গেল?
সে আর এক গল্প। সুব্রত বলে, বেলুড় মঠে দীক্ষা নিয়ে ওর মন কিছুটা শান্ত হয় বটে কিন্তু অবিশ্বাস পুরো দূর হয় না। এক ছাদের তলায় ওরা থাকে, এই টুকুই ওদের সংসার। আর সেটা টিকে ছিল ওদের মেয়ের জন্যে। মেয়ের নিরাপত্তা, মেয়ের মানসিক স্বাস্থ্য ইত্যাদির কথা ভেবে ওরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। আমার আশা ছিল ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এই সময়ে প্রবেশ করল মূর্তিমান এক শনি। তারাপীঠের এক তান্ত্রিক, তারাপ্রসন্ন শাস্ত্রী। অরুণের তারাদা, তিনি ধ্যানে বসে দেখতে পেলেন প্রিয়া ওর অফিস কলিগের সঙ্গে সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। এরপর দ্রুত সম্পর্কের অবনতি হতে লাগলো। আমি অরুণকে প্রশ্ন করলাম,তুই রামকৃষ্ণ মিশনে দীক্ষিত, তুই কেন ঐ তান্ত্রিক ফান্ত্রিকের সঙ্গে মেলামেশা করছিস? অরুণ ভীষণ রেগে গিয়ে জবাব দিয়েছিল, “ হোয়াট ডু ইউ মীন বাই তান্ত্রিক ফান্ত্রিক?” আমাকে স্পষ্ট বলে দিল যা জানিনা তা নিয়ে আমি যেন কথা না বলি। আর ঠাকুর নিজেও তন্ত্র মতে সাধনা করেছিলেন। তান্ত্রিকের পরামর্শে প্রায় শনিবার অরুণ তারাপীঠে যেতে লাগলো। আর অমাবস্যা পড়লে তো কথাই নেই। অমাবস্যায় শ্মশানে যজ্ঞ করা হতো।এইগুলো হোতো সব অরুণের খরচায়।
এই তন্ত্র মন্ত্র বিষয়গুলোতে আমার খুব একটা আগ্রহ ছিলনা, আমি এই বিষয়ে অবিশ্বাসীই বলা যায়। এটা ওর জানা ছিল। ওর সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে বুঝলাম ও অবিশ্বাসীদের সঙ্গে এসব নিয়ে আলোচনাই করতে চায় না। ফলে ধীরে ধীরে আমাকে ওর আস্থা অর্জন করতে হোলো। আমি ওর সঙ্গে গল্প করে করে এক বিচিত্র জগতের সন্ধান পেলাম। আমি বিশ্বাস করি বা না করি বহু মানুষ এসব বিশ্বাস করে এবং এই তান্ত্রিকদের ওপর নির্ভর কোরে জীবনের নানা সমস্যার সমাধান করতে চায়। এটা জেনেই আমার আশ্চর্য্য লাগল।
কী ভাবে যেন এই তারাপ্রসন্ন নামের তান্ত্রিকের সঙ্গে অরুণের পরিচয় হয় এবং তারাদা অরুণের আস্থা অর্জন করতে সমর্থ হয়। তারাদা প্রতিদিন ধ্যানে বসেন এবং প্রিয়ার মনের খবর জেনে যান। সে কাদের সঙ্গে মেলা মেশা করছে, কার কার সঙ্গে হোটেল রেস্তোরাঁয় খেতে যাচ্ছে, ব্যাঙ্কে যেসব আমানত দুজনের নামে আছে সেগুলো ভাঙ্গিয়ে নিতে চেষ্টা করছে কি না এইসব খবর দিতে লাগলো। তারাদা এইসব গোপন খবর জানানোর সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতিকারের উপায়ও জানাতে লাগলো। প্রতিদিন পুজোয় ফুল চড়ানো হোতো তারাদার বাড়িতে, আর যজ্ঞ, মহাযজ্ঞ সব তারাপীঠে। প্রতি অমাবস্যায় হোতো মহাযজ্ঞ, আর শনিবার অমাবস্যা হলে তো এলাহি ব্যাপার। তারাপীঠের শ্মশানে বসে সারা রাত ধ্যান। এর সমস্ত খরচ অরুণের।
অরুণ আমাকে বলেছিল তারাপীঠের মাটি আলাদা মাটি। ওইমাটিতে পা দিলেই বোঝা যায় এ মাটির গুণ। দাদা তোমরা বুঝতে পারবে না, আমি কিন্তু সাধন ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়ে গেছি। অরুণ এসব যখন আমাকে বলে আমি ভক্তি ভরে শুনি। সুব্রত আমাকে বলে দিয়েছিল চোখে সামান্য অবিশ্বাস বা উপহাস দেখলে ও আর বলবে না। আমি প্রাণপণে চোখে মুখে ভক্তিভাবটা বজায় রাখি।
আমি অরুণের মনের ভাবটা পড়তে চেষ্টা করি। মানুষ জীবনে কিছু সফলতা চায়। সাধারণ মানুষ নিজের সংসারের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে পরিবারের সকলের সাফল্য ও পূর্নতার মধ্যেই নিজের জীবনের সার্থকতা খোঁজে। একটা সুন্দর সংসার আমি গড়ে তুলেছি, আমার ছেলেমেয়েরা জীবনে নিজেদের মতো কোরে সফল হয়েছে এই ভাবনাও মানুষকে একটা তৃপ্তি দেয়। বন্ধুরা যখন ছেলে মেয়েদের সাফল্যের গল্প করে, সপরিবারে বন্ধুরা মিলে বেড়াতে যায় অরুণের বুকটা নিশ্চয়ই হু হু কোরে কেঁদে ওঠে। ও একটা নিজের সাফল্যের জায়গা করে নিয়ে সেই খোলসের মধ্যে থেকে তৃপ্তি পায়। সেই সাফল্য হচ্ছে সাধনার ক্ষেত্রে ওর অগ্রগতি। তারাপীঠে যজ্ঞের সময় বা শ্মশানে বসে নানারকম অলৌকিক দর্শন। আর তারা পীঠের মাটি যে আলাদা সেটা সবাই বোঝে না কিন্তু ও বোঝে এই শ্লাঘা।
যজ্ঞের পর অরুণ ধ্যানে বসে, পাশে তারাদা। হঠাৎ কোলে কিছু একটা পড়তে ও চোখ খুলল। তারাদা চাপা গলায় বলল, অরুণ তোমার জীবন আজ সার্থক। তুমি মায়ের আশীর্বাদ পেয়ে গেলে। তুমি তো চোখ বুঁজে ছিলে তাই দেখনি। মায়ের গলা থেকে ফুলটা খসে পড়ে মায়ের পায়ে, সেখান থেকে লাফিয়ে তোমার কোলে। বিহ্বল অরুণ ফুলটা তুলে নিয়ে জোড়হাতে মাকে প্রণাম কোরে।
অথবা, তারাপীঠের শ্মশান, অমাবস্যার রাত। তারাদার সঙ্গে অরুণ ধ্যানে বসে। হঠাৎ একটা কুকুর, শ্মশানের আধপোড়া মাংস খেয়ে খেয়ে ভালুকের মত চেহারা হয়েছে। অরুণের পাশে এসে বসল। তারপর কোলে মাথাটা রেখে চোখ বুঁজে শুয়ে থাকলো। অরুণ ভয়ে একদম সিঁটিয়ে বাঁহাতে তারাদাকে খোঁচা মারল। তারাদা চোখ খুলে চাপা গলায় বলল, “ অরুণ একদম নড়বে না। এ মায়ের পাঠানো আশীর্বাদ। মা তারা এখানে কত রূপ ধরে আসেন যার চোখ আছে সেই বুঝতে পারে।এখানে এরকম অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটে। শুধু চিনে নিতে হয়। তোমার শ্মশানে ধ্যানে বসা আজ সার্থক”।
এই সব বিচিত্র গল্প আমি অরুণের কাছে শুনি, বিনা প্রশ্নে। বেচারা এসব নিয়ে যদি শান্তিতে থাকে তো থাক। কিন্তু শান্তি যে ওকে ছেড়ে চলে গেছে। আমি অরুনকে বোঝালাম, “দেখ তোমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে, প্রিয়া তোমার কাছে কোনরকম খোরপোষ চায়নি, মেয়ের জন্যেও না”।
“সেটা ঠিক। কারণ ও জানে মেয়ের যে কোনো প্রয়োজনে আমি বিনা প্রশ্নে খরচ করব”।
না তা হয়তো জানে, তবু মেয়ের প্রাথমিক দায়িত্ব তো তার। সে নিয়মিত টাকা চাইতেই পারত। ওর হৃদয় টা যে বড়, এখনও তোমাকে বিশ্বাস করে সেটা অন্তত স্বীকার কর।
আমার ধারনা তাই ছিল, কিন্তু এখন আর নেই।
কেন? কী এমন ঘটলো এর মধ্যে?
আমার যেসব ডিপোজিট গুলো আছে সব ওর সঙ্গে জয়েন্ট আছে। আমি সেগুলো চেংজ করিনি, পিঙ্কির আঠারো হলে একবারে চেঞ্জ করবো।কিন্তু ওর তর সইছে না। ও চায় আমি মারা যাই, তাহলে এখনই পেয়ে যাবে সব।
তুমি এতো বড় কথাটা বলে ফেললে? কী ভাবে জানলে তুমি?
আমার ইদানিং অদ্ভূত অদ্ভূত শরীর খারাপ হচ্ছে। সারা গা চুলকাচ্ছে, কিন্তু ওপর থেকে কিছু দেখা যাচ্ছেনা। আমার খাওয়া দাওয়া একদম নিয়মে, কিন্তু পেট খারাপ হয়েই চলেছে। ডাক্তার দেখাচ্ছি, ওষুধে কোনো কাজ হচ্ছে না। তারা দা পুজোয় বসে জানল যে প্রিয়া একজন তান্ত্রিকের কাছে যাচ্ছে আর তাকে দিয়ে আমাকে মারছে।
অনেক কষ্টে আমার অবিশ্বাস চেপে রেখে স্বাভাবিক গলায় ওকে বললাম, “তোমাকে মেরে ওর লাভ?”
“কী আবার? শত্রুর ক্ষতি মানে আমার লাভ। আমার যত ক্ষতি হবে তত ওর আনন্দ”।
“তুমিও কি এইরকম ভাবো?”
“ একদম না। ওর মধ্যে যে হিংস্রতা আছে সেটা আমার নেই। আমি চোখ বুঁজলে আগের প্রিয়াকেই দেখি যে আমার প্রিয় ছিল।“
“ তোমার সঙ্গে ওর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে, , তুমি ওকে ভুলে যাও, আর শান্তিতে থাকো। তুমি এত ডিস্টার্বড থাকছো, এখান থেকে তোমাকে বেরিয়ে আসতে হবে।“
“আমাকে বেরিয়ে আসতে দেবে না। তোমাকে আর একটা গল্প বলি। তুমি তো বামপন্থী লোক, তোমার এসবে বিশ্বাস নেই।তবু শোন।আমি তো একা হয়ে গেছি। আমার দাদা, দিদিরা সবাই নিজের মতো থাকে। কেউই আমার খোঁজ নেয় না। একমাত্র ছোড়দি, যে আমার পিঠোপিঠি। আমার খোঁজ নেয়, আমাকে ভালোবাসে। সেটা প্রিয়া জানে। ছোড়দিকে ডিস্টার্ব করা মানে আমাকে অশান্তিতে ফেলা। একদিন সন্ধেবেলা, জামাইবাবুর অফিস থেকে আসার সময় হয়েছে। ডোরবেল শুনে ছোড়দি দরজা খুলেছে, সামনে কেউ নেই। অথচ কেউ একজন ছোড়দিকে দমাদ্দম ঘুঁষি, চড়। জামাইবাবু এসে দেখে ছোড়দির জ্বর এসে গেছে। কিন্তু শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন নেই। তারাদা তো সব দেখতে পায়, পরিস্কার বলল ঐ তান্ত্রিক কে দিয়ে তোমাকে বা তোমার লোককে মারছে”।
আমি বুঝলাম অরুণ আধপাগল হয়ে গেছে। পুরোটা হতে বেশি বাকি নেই। কিন্তু তারাদা ওর মনকে যেভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছে ও অন্য কথা শুনবে না। তাই মনের ভাব প্রকাশ না করে ওকে বললাম, “ তারাদা যখন সব দেখতে পায় তখন কোন তান্ত্রিক এই কাজ করছে নিশ্চয়ই জানতে পারবে। চল, আমরা তার কাছে যাব। তাকে বলব প্রিয়ার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। সে ভালো থাকুক, আমিও ভালো থাকতে চাই। আমাকে ডিস্টার্ব করে তার কী লাভ? আপনি কেন তাকে এই কাজে সাহায্য করছেন? ”
দুদিন বাদে অরুণ জানাল তারাদা এককথায় এই প্রস্তাব বাতিল করে দিয়েছে। তারাদা দেখেছে অরুণের ফটো সামনে রেখে সেই তান্ত্রিক তার ক্রিয়া করে চলেছে। তারাদা প্রতিদিন পুজোয় বসে সেসব বাণ কেটে দেয়। তাই বড় ক্ষতি করতে পারেনি। সে যদি অরুণকে সামনাসামনি একবার দেখে নেয় তাহলে তার বাণ এতো জোরদার হবে তারাদা আর সামলাতে পারবে না। সুতরাং সেই তান্ত্রিকের কাছে মুখ দেখিয়ে লাভ নেই। বুঝলাম তারাদা ওকে ওর খপ্পর থেকে বেরোতে দেবে না।
এই ভাবেই চলছিল জীবন। একসময়ে আমার চাকরি থেকে অবসর হয়ে গেল। ফলে যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে এল। কিছুদিন পরে একদিন কী কাজে অফিস গেছি। কাজ মিটিয়ে পুরনো পরিচিতদের সঙ্গে দেখা করে অরুণের কাছে গেলাম। বয়স কিছুটা বাড়লেও ওকে বেশ উজ্জ্বল লাগলো। কেমন যেন চোখে মুখে একটা খুশী। আমি বসতেই আমাকে বলল দাদা আমি বিয়ে করেছি। আমি ভীষণ খুশী হলাম। সেকথা ওকে জানাতেই ও বলল আমি প্রিয়াকেই বিয়ে করেছি। আমি দ্বিগুন খুশী প্রকাশ করলাম। অনেক গল্প হল, পিঙ্কির খবরাখবর নিলাম। জানতে ইচ্ছে হল কীভাবে এটা সম্ভব হল। কিন্তু সে প্রশ্ন করতে পারলামনা।
একসময় জিজ্ঞেস করলাম তারাদার খবর। জানলাম তারাদা হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। কীভাবে ওদের সংসার জোড়া লাগলো সে প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলাম।
##
তারাপীঠে গিয়ে যা দেখলাম তারামা এর মন্দির এবং সেখানে পুজো দেওয়া ছাড়া আর কিছু দর্শনীয় নেই। অসংখ্য হোটেল, অসংখ্য মানুষ। হোটেলের ঘরেই পান্ডা যোগাড় হয়ে গেল। ছেলেটি মধ্য তিরিশের, চটপটে। আমি তার সঙ্গে গল্প জমালাম। তন্ত্র বিষয়টা বৌদ্ধ ধর্মের সাধন পদ্ধতি। কিছু বৌদ্ধ তান্ত্রিক চীন থেকে তন্ত্র শিখে এদেশে এসে বৌদ্ধতন্ত্রের দেবী ‘তারা’র সাধনা করেন। কালক্রমে এদেশে যখন বৌদ্ধ ধর্মের বিলুপ্তি ঘটে তখন চীন দেশের দেবী ‘তারা’ হিন্দু দেবী কালীর একটা রূপ ‘তারা মা’ হয়ে পুজিত হতে থাকেন। এই সেই তারাপীঠের ‘তারা মা’। এইসব কথা তাকে বলতে সে আমাকে বেশ বোদ্ধা বলে মনে করে একটু খাতির করতে লাগলো।
সে বোঝাল তারাপীঠে পুজো যখন খুশী দেওয়া যায়। আমরা যেন রাতেই কাজটা সেরে নিই।পরদিন সকালে ভীষণ ভীড় হবে। মহিলারা প্রশ্ন করলেন ভাত খেয়ে পুজো দেওয়া যায় কিনা। পান্ডার এক কথায় উত্তর তারাপীঠে কিছুই অশুদ্ধ হয়না। পরামর্শটা আমার ভালোই লাগলো। রাত নটায় আমাদের পুজো দেওয়া সারা। তারাপীঠ যাব ঠিক হতেই আমার অরুণের কথা মনে হয়েছিল। মনে মনে স্থির করে রেখেছিলাম তারাপীঠের শ্মশানটা দেখতে হবে, যেখানকার মাটি আলাদা, যেখানে অরুণের অলৌকিক দর্শন হোতো। আমি তাকে বললাম, “ভাই শ্মশানের রাস্তাটা আমাকে একটু দেখিয়ে দাওতো। আমার শ্মশানটা দেখার অনেক দিনের ইচ্ছে”। পান্ডা আমাকে বার বার শ্মশানে যেতে বারণ করতে লাগলো। সেখানে অনেক খারাপ লোক থাকে। আমার ক্ষতি হতে পারে। আমি ওকে বোঝালাম ,“আমার কোন ক্ষতি হবে না। তুমি বল”
যখন দেখল আমি যাবই, তখন বলল শ্মশানে সব ফ্রড। আমি বললাম, “বল কী?’ আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, “এখানে সব ফ্রড”।
আমি বললাম, “সব ফ্রড? বল কী?
-হ্যাঁ।
-তুমি?
হ্যাঁ। আমিও। এখানে একমাত্র তারা মা সত্যি।
##
সকলে হোটেলে ফিরে গেল, আমি একটু ঘুরে আসি বলে শ্মশানের পথ ধরলাম। লাল কাপড়, বড় বড় চুল, কপালে রক্ততিলক তান্ত্রিকদের রাজত্ব সেখানে। আমি ভাবছিলাম এখানেই অরুণ আসত তারাদার সঙ্গে অলৌকিক দর্শনের লোভে। আমি ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম কোথায় সাধক বামাক্ষ্যাপা বসে সাধনা করেছিলেন। দেখছিলাম এখনকার তান্ত্রিকদের, নরমুন্ড সাজিয়ে বসে আছেন ভক্তদের আশায়, তাদের মঙ্গলের জন্যে ক্রিয়াকর্ম করবেন। ফিরে আসছি, নজরে পড়ল এক তান্ত্রিক শ্মশানে প্রবেশ করছেন, পিছনে দ্বিধাজড়িত পায়ে, নতুন ধুতি গেঞ্জী পরে তান্ত্রিকের পিছন পিছন আসছে। মনে হল আজই হয়তো প্রথম দিন। আসন পাততে পাততে তান্ত্রিক বলছেন, এ মাটি আলাদা মাটি, ভক্তি ভরে মাকে ডাকো, মা নিজেই চিনিয়ে দেবেন। এখানে বসে প্রার্থনা করলে মা ঠিক শুনবেন।
আপনি বলেছিলেন যজ্ঞ করতে হবে?
কাল শনিবার, কাল যজ্ঞে বসব।
হোটেলের পথে ফিরতে ফিরতে মনে হলো আজ আর এক ‘অরুণ’এর দেখা পেলাম।
[মতামত ও বানানবিধি লেখকের ব্যক্তিগত]
Tags: গল্প, তান্ত্রিক, ত্রিদিবেশ বন্দ্যোপাধ্যায়
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।