পাড়ার প্রদীপ বোধহয় পটাই হয়ে যাওয়ার পর থেকেই বদের গাছ হয়েছে একখানা। হেন দুষ্কর্ম নেই যে পটাই করে না। তোলাবাজি মস্তানি গুন্ডামি মেয়েদের টিজ করা সব কাজে সে সিদ্ধ হস্ত। এহেন পটাই কে সবাই এড়িয়ে চলবে এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু চলবো ভাবলেই তো আর চলা যায় না। বিশুর চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে ঘুম চক্ষুটি খুলেই ব্রাশে মাজন লাগিয়ে নিয়ে পটাই এসে হাজির হয়। তারপর সারাটা দিন চলে চেনা অচেনা মানুষদের সঙ্গে ডেকে ডেকে কথা বলা। পাড়ার সবার ভালো-মন্দ সবার নাড়ী নক্ষত্র ওর নখ দর্পনে। কে একলা থাকলো, কার মেয়ের বিয়ে ভেঙে গেল , কার বউটা অনেক বছর পরে এইবারে পোয়াতি হয়েছে, কোন ছেলেটার বাপের সঙ্গে ঠিক বনিবনা হচ্ছে না, কোন মাসিমা একলা থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছে, এই সমস্ত গ্রামীণ সংবাদ ও নিজেই বলে যায় আপন খেয়ালে। মানুষজন ও গরম চায়ে চুমুক দিয়ে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করে তার এই সমস্ত খবরাখবর। পটাই অবশ্য নিজেই বলে বিশুদার চায়ের ঠেকে আমার অবস্থান ধর্মঘট।
আশু গোসাইয়ের মাঠ বাঁদিকে বেঁকে গেলেই যে মস্ত বড় তিনতলা হালকা গোলাপি রঙের বাড়িটা সেটা হচ্ছে সেন বাড়ি । একসময় ওই বাড়ির তুমুল রমরমা ছিল। সে বাড়ির ছেলেরা এক একজন এক একটা দিকপাল। একজন ডাক্তার তো আর একজন ইঞ্জিনিয়ার। একজন জাহাজের ক্যাপ্টেন, একজন বিদেশে বসবাসকারী বৈজ্ঞানিক । বলা যেতে পারে সেদিক থেকে সেন বাড়ির গিন্নিরা রত্নগর্ভা। বাড়িটি তৈরি করেছিলেন যিনি, তিনি ছিলেন বিদেশী জাহাজের ক্যাপ্টেন। বাড়িটাকে তৈরি করেছিলেন জাহাজের আদলে। সেন বাড়ি কে সবাই তাই জাহাজ বাড়িই বলে।
প্রদীপরা যখন ছোট ছিল তখন তারা দেখেছে সেন বাড়ির গৌরব শহর রাজ্য দেশের মধ্যেই আর আলো বিচ্ছুরন করত। কিন্তু বড় হতে হতে তারা দেখলো বাড়ির ছেলেরা একে একে বড় বড় চাকরি নিয়ে বড় পড়াশোনা করতে দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে পাড়ি জমালো। গমগম করা সেই বাড়ি একসময় শুন্যতার মাস্তুল উড়িয়ে একাকিত্বের প্রতীক হয়ে দাঁড়ালো।
অনাদি সেন মারা যাওয়ার পর রত্না শিবরাত্রির সলতে হয়ে ওই বাড়িতে টিকে রইলেন। ষাটোর্ধ্ব রত্না সেনের ব্যক্তিত্ব এবং আভিজাত্য তাঁকে ভিড়ের মধ্যেও সতন্ত্র রাখতো। কথা বলার সময় সকলেই বেশ সমীহ করে কথা বলতো। একমাত্র পটাই সে সবের ধার ধারত না। রত্না মাসীমাও পটাই কে যেন একটু প্রশ্রয়ের চোখেই দেখতেন।
কখনো আধার কার্ড আপডেট করা, কখনো রেশন কার্ড মডিফাই করা কখনো বা মোবাইল ফোনের ছোটখাটো প্রবলেমে রত্না সেন ও চোখ বুজে ভরসা করতেন পটাই এর উপর। উল্টোদিকে পাড়ার প্রত্যেকটা পরিবার ছিল পটাইয়ের আলোচনার বিষয়বস্তু। শুধু মাত্র সেন মাসীমার কথা সে কক্ষনো প্রকাশ্যে তুলতো না।
ছেলেদের ঔদাসীন্য, বাড়ি ফেরার অনীহা, এমনকি ফোনে মায়ের সঙ্গে যোগাযোগও ক্রমশ কমে আসার যে যন্ত্রনা রত্না মাসিমা পটাইয়ের কাছে তা নির্দ্বিধায় গল্প করতেন। বাপে তাড়ানো মায়ে খেদানো পটাইয়ের উপর তাঁর স্নেহ নির্বিচারে বর্ষিত হতো । তাঁর কাছে এসে পটাই বাড়িতে পাওয়া দুঃখ যন্ত্রণা লাঞ্ছনার কথাও প্রাণ খুলে বলতো। আভিজাত্যের মোড়ক খুলে কুড়িয়ে নেওয়া মায়ের স্নেহটুকু তারও গোপন অহংকারের জায়গা ছিল।
পটাই একদিন মাসিমা কে বলে, তোমার ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট নেই কেন গো?তোমাকে আমি ফেসবুক খুলে দেবো।
ফেসবুক খুলে আমার কি হবে?
কেন ? কত নতুন নতুন বন্ধু হবে, তাদের সঙ্গে গল্প করবে। তারা ছবি দেবে,তুমি দেখবে। আমি তোমার ছবি তুলে পোস্ট করে দেব। সবথেকে বড় কথা তুমি তোমার ছেলে বৌমাদেরকেও দেখতে পাবে।
না বাবা ,আমি ওসব সামলাতে পারবো না। তারপর কি হতে কি করে ফেলব, আমার ফোনটাই খারাপ হয়ে যাবে।
আরে তুমি এত ভাবছো কেন? ফোন খারাপ হলে তো কি হলো? ঘাবড়াও মাত, ম্যায় হু না ?
তারপর থেকে ফেসবুকই এখন রত্না সেনের অনেকটা সময় সুন্দরভাবে জুড়ে আছে। পটাই এদিকে লেখাপড়া না শিখতে পারে,কিন্তু ইংরেজি হরফে পটাপট মেসেজ করে মাসীমার খবরা খবর নেয়। ছেলে বউমারা তো অবাক! তারা এখন তাদের মায়ের ফেসবুক ফ্রেন্ড।
এই ফেসবুকেই রত্না দেখেন ছেলেমেয়েদের জন্মদিন সেলিব্রেট হচ্ছে কত হাসি , আনন্দ আর বন্ধুবান্ধব নিয়ে। তিনি ফোনেও যেমন শুভেচ্ছা জানান তেমনি ফেসবুকে হ্যাপি বার্থডে লেখেন, কেকের ইমোজি পাঠান। পটাই বেশ পোক্ত করে ফেলেছে মাসিমাকে কয়েক মাসের মধ্যে।
একদিন পটাই খুব উত্তেজিত ভাবে মাসিমার বাড়ি আসে । আরে ফেসবুক দেখাচ্ছে কালকে নাকি তোমার জন্মদিন ?
হ্যাঁ, তুই যখন ফেসবুক খুললি তখন বলেছিলাম তো। ধুর অত কি আমার মনে থাকে ?
ফেসবুকের দৌলতে ছেলে বৌমা এদের সাথে দূরত্ব যেন একটু কমেছে বলে মনে হয় রত্নার। কিন্তু ব্যাপারটা যে ভার্চুয়াল সেটা তো তাঁর স্বপ্নের মধ্যেও নেই। ফেসবুকে নতুন বন্ধুদের কাছে রত্না শোনেন তাদেরও প্রবাসী ছেলেমেয়েরা কেউ কেউ মায়ের জন্য ভীষণ ভাবে। মায়ের জন্মদিনে তারা নাকি সেই বিদেশ থেকে কেকের অর্ডার দেয় আর জন্মদিনের দিন সেই কেক চলে আসে। কখনো রাত বারোটার পর কখনো ভোর বেলায় কখনো বা জন্মদিনের সন্ধ্যায়। ভার্চুয়াল ঘনিষ্ঠতায় সেই অলৌকিক আনন্দের স্বপ্ন মনের গভীরে পোষণ করেন তিনি।
জন্মদিনের দিন সকালে মেসেঞ্জার খুলে অবাক রত্না। কত মেসেজ কত শুভেচ্ছা ! তিন ছেলে বৌমাও মেসেজ করেছে। তিনি খুশি। আগে তো কারো মনেও থাকতো না, যে মা নামের মানুষটাও জন্মেছিলেন কোনো না কোনো একটা দিনে। তিনি মনে মনে পটাই কে ধন্যবাদ দেন।
তবু সারাদিন ধরে তিনি একটা কলিং বেলের অপেক্ষায় থাকেন। নিশ্চয় একটা কেক আসবে। যতবার বেল বেজেছে তিনি দৌড়ে গেছেন। কিন্তু কখনো কাজের মেয়ে কখনও দুধের দাম নিতে কখনও বা সুইপার। প্রত্যাশার উল্টো দিকে হতাশা যে এত সর্বগ্রাসী অন্ধকার নিয়ে বসে থাকে তিনি আগে জানতেন না।
সন্ধেবেলায় আবার বেল বাজে। অবসন্ন পায়ে দরজা খুলেই তিনি দেখেন ডেলিভারি বয়ের হাতে ছোট একটা জিনিষ। জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই সে বলে, কেক আছে।
মুহূর্তে যেন শুকিয়ে যাওয়া নদীতে নামে জলের প্লাবন।তিনি ঘরে এসে পটাই কে ফোন করতে যাবেন,আমার বেল। সে স্বয়ং এসে হাজির।
তারপর সে একাই সাজিয়ে ফেলে টেবিল। কেক রাখে,মোমবাতি রাখে। উল্টোদিকে ফোনের ক্যামেরা রেডি করে বলে এইবার খোলো। হাসি হাসি মুখে কাটবে কিন্তু। আজই পোস্ট দেব আমি।
হাসবে কী মোড়ক খুলেই স্তম্ভিত রত্না!
গাঢ় চকলেট রংয়ের ওপর লেখা ‘ মাসিমা’
তাহলে ছেলে মেয়ে নয়, পটাই…..
উল্টো দিক থেকে ভেসে আসে মৃদু ধমক, ভুল হচ্ছে , চোখের জলটা ডিলিট অপশন হবে
Tags: গল্প, ডিলিট, নন্দিতা সিনহা
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।