19 May

উন্নয়ন

লিখেছেন:শিপ্রা মৈত্র


গল্পের সময়

দুর্গাপুর থেকে বিষ্ণুপুর যাচ্ছিলাম সপরিবারে। সাত বছরের মেয়ের চোখে অপার বিস্ময়, অসীম আনন্দে চিকচিক করছে দুটো চোখ-মা দেখ কি সুন্দর গাছ, মা, কত সবুজ! মা কি পাখি ডাকল? প্রকৃতি প্রেমীর প্রশ্নবাণ থেকে বাঁচবার জন্য মেয়ের বাবা খবরের কাগজের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ফেলেছেন। আশা করছেন আড়াই ঘণ্টার পথ এই ভাবেই কাটবে। পুজোর আগমনী বার্তা জানিয়ে রাস্তার দুধারে কাশফুলের চামর দুলছে। সাদা ফ্রক পরা কন্যাকে গাড়ির ভেতরে প্রজাপতির মতো লাগছিল— বারবার উড়ে কাশফুলে গিয়ে বসতে চায়, গাড়ি থামানো যাচ্ছে না, তাহলে গন্তব্যে পৌঁছতে দেরী হয়ে যাবে। তৃণা গাড়ির কাঁচে চোখ চেপে রেখে সবুজে ডুবে রইল, একটুকু দেখাও যেন চোখের ফাঁক দিয়ে গলে না যায়। আমিও বাঁচলাম, প্রশ্নবাণের হাত থেকে—-উত্তর না জানার অস্বস্তি গাম্ভীর্যের ফাঁকে লুকিয়ে রাখার ফাঁকিটা বোধ হয় মেয়েটা ধরতে পারল না।

জয়পুর বনের মধ্যে দিয়ে পাকা রাস্তায় গাড়ি চলছে— সবুজের সমুদ্রে দুচোখ ডুবে যাচ্ছে—মা, জঙ্গলের মধ্যে রাস্তা কি করে তৈরি হলো? বলা যাচ্ছে না অনেক কিছু গড়তে গেলে অনেক কিছু ভাঙ্গতে হয়। আমাদের ড্রাইভার বোধ হয় আমাদের বোকামীতে অধৈর্য হয়ে উঠল-

-গাছ কেটে ফেলে রাস্তা হয় দিদিমণি।

-এত এত গাছ কাটতে হলো এত লম্বা রাস্তা তৈরি করার জন্যে?

-রাস্তা না হলে তোমাদের বেড়াতে নিয়ে আসতাম কি করে?

-তাই বলে এত গাছ কাটা কি ভাল ড্রাইভার আঙ্কেল-পাখিরা কোথায় থাকবে?

-গাছ না কাটলে আমরা কোথায় যাব দিদিমণি? গাড়ি না চালালে আমার বাচ্চারা কি করে স্কুলে পড়বে?

এত বড় জটিল সমস্যার ভেতরে ঢোকার আগেই আমাদের গন্তব্যস্থল এসে গেল-বনলতা রিসর্ট। গাড়ির দরজা খোলার অপেক্ষা—তৃণা পাখা মেলে উড়তে থাকল হোটেল চত্বরের মধ্যে—-আমরাও চমৎকৃত! প্রকৃতির কোল কথাটার মানে বোঝা যাচ্ছে—প্রকৃতিকে এমনি ভাবে বিনোদনের কাজে লাগানোর কল্পনা খুবই মনোহারী লাগল, যদিও আমার স্থপতি স্বামীর চোখে প্রচুর অসঙ্গতি ধরা পড়তে লাগল।

 

কুঁড়েঘরের মতো বাইরের চেহারা ভেতরে অজস্র কাঠের ব্যবহার আধুনিক আরামের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। মাঝে মাঝে দু-একটা ব্যাঙ লাফাতে দেখা গেল ঘরের মেঝেতে—এত প্রকৃতি প্রেম তৃণার সহ্য হলো না—লাফিয়ে বাবার কোলে! রিসর্টের কর্মচারীরা বললেন দরজা জানলা খোলা যাবে না—-এসি চালিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে বাইরে প্রকৃতির শোভা দেখাই দুস্কর। একটু গুছিয়ে বাইরের বারান্দায় চা নিয়ে বসতেই দেখা গেল সামনে বসে দুজন সাঁওতাল মেয়ে মুড়ি ভাজছে!

চায়ের সঙ্গে সদ্য ভাজা গরম মুড়ি খেতে খেতে তাদের সঙ্গে গল্প শুরু করলাম।

আশেপাশের গাঁ থেকে আসি দিদি-সকাল ছটা থেকে সন্ধ্যে আটটা পর্যন্ত ডিউটি করি। গাড়ি নিয়ে আসে ছেড়ে দিয়ে যায়।

কতদিন কাজ করছ?

-যতদিন থেকে এই হোটেল হয়েছে—খাওয়া দাওয়া মাইনে পত্তর ভালই — আমাদের সকলেরই এখানে চাকরি— চলেই যায়।

-আমাদের ছেলেরাও এখানে কাজ করে, কেউ কেউ দূরে শহরে চলে যায়।

-এখানে কাছে পিঠে তো কিছু নেই দিদি-শুধুই জঙ্গল। জঙ্গল কেটে স্কুল, হাসপাতাল হলে আমাদের কষ্ট কমে। আগে তো কাঠ কেটে, ফল বেচে দিন চলত—এখন হোটেলটা হয়ে দুটো পয়সার মুখ দেখছি। বেশি টাকা দিয়ে কি হবে দিদি, আমাদের জীবন এই হাটে বাজারেই কেটে যাবে—জঙ্গলে কি আর টাকা খরচ করা যায়।

চমকে উঠলাম! কত অনায়াসে বলে দিল জঙ্গল পরিষ্কার না করলে আর কিছুই হবে না!

তৃণা আর তার বাবা লালমাটির পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে কপি ক্ষেতে গেছে। এদের নিজস্ব ফার্ম, নিজস্ব পোলট্রি— হাঁস, মুরগী খরগোস, কোয়েল, টার্কি, এমু পর্যন্ত আছে। গাড়িতে মেয়ের একটাও প্রশ্নের উত্তর দেয়নি—এখন মেয়ে সুদে-আসলে পুষিয়ে নিচ্ছে। প্রচুর ফল ফুল সব্জির চাষ হচ্ছে জৈব সার দিয়ে।

 

তৃণা নিজের স্কুলের প্রজেক্টের অনেক মালমশলা পেয়ে গেল।

— মা, মা জানো এই খরগোস গুলো আমাকে চিনে গেছে—পরের দিন সকালে আনন্দে কলকল করে উঠল তৃণা। আমি ওদের খেতে দিলাম তো—-পাঁচটা খরগোস একটা খাঁচায়—আমাদের দেখেই লাফাতে থাকল।

চারদিন এখানে থাকার প্ল্যান। তৃণার মন বসে গেছে দেখে নিশ্চিন্ত হলাম। বিষ্ণুপুরের বিভিন্ন দ্রষ্টব্যস্থান দেখে বেড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে খরগোস বন্ধুদের গল্প চলতে থাকল—-হ্যারি একটু দুষ্টু, সমানে ম্যাক্সের পেছনে লাগে, পিটারের সঙ্গে ইলিনার ভীষণ ভাব—তাইতে মেরীর বোধহয় একটু মন খারাপ—ও ভাল করে খায়নি আজ—-আমি বলে দিয়েছি, সকলে ভাব করে থাকবে—-ইলিনাটা খুব ভালো—আমার কাছে এসে একদম ধারে বসে থাকে—মা, পিটার আর ইলিনাকে কলকাতায় নিয়ে যাব।

—-না সোনা, এখানে ওদের বাড়ি, ওদের মন খারাপ লাগবে না, তুমি কি আমাদের ছেড়ে এখানে থেকে যেতে পার?

—-এখানেই ওরা ভাল থাকে মা? ঠিক আছে, আমরা কিন্তু next vacation এ ওদের দেখতে আসব।

 

হ্যারি, পিটার, ইলিনাদের সঙ্গে চারদিন কোথায় কেটে গেল! আজ বিকেলে যাবার পালা। এখানে দুপুরে special lunch আছে — হোটেলের ম্যানেজার এসে বলে গেল, বেড়ানো শেষ করে অবশ্যই যেন দুপুরে চলে আসি। তৃণার মন খারাপ, কিন্তু স্কুলের ছুটি শেষ, আর পরের vacation-এ এখানে আসতেই হবে

বাবার কাছে এই কথা আদায় করে নিজের স্যুটকেস গোছাতে গেল।

দুপুরের খাওয়াটা সত্যিই খুব ভাল হলো, বিশেষ করে মাংসের পদটা। এই কয়দিনে অনেকের সঙ্গেই বেশ হৃদ্যতার সম্পর্ক হয়ে গেছে, বিশেষ করে ম্যানেজার বাবুর সঙ্গে। তৃণাকে একটা বিরাট পুতুল উপহার দিয়ে বললেন আবার আসতেই হবে। এই সব বিদায় সম্ভাষণ আর গাড়িতে মাল তোলার ফাঁকে তৃণার দিকে আর মন দিইনি। হঠাৎ ছুটতে ছুটতে এসে তৃণা জানাল হ্যারি, ইলিনা আর পিটার cage- এ নেই। আশেপাশে কোন ভাইয়াকেও দেখতে পেল না—–

-প্লীজ ম্যানেজার uncle-কে জিগ্যেস করো—-ওদের bye না করে কি করে যাব?

-ম্যানেজারের খোঁজে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি—তৃণার বাবা অত্যন্ত ব্যস্ত হাতে তৃণাকে গাড়িতে ঢুকিয়ে দিলেন, বাবা ওদের bye করিনি।

-তৃণার, we are getting late, next time।

এই অস্বাভাবিক রূঢ়তায় অবাক হয়ে গেলাম।

-ড্রাইভার-তাড়াতাড়ি!

তৃণা চোখে জল। মুখ ঘুরিয়ে বলতে গেলাম এত তাড়ার কি আছে — মেয়েটা—

ক্যান্টিনের দরজায় আজকের মেনু টাঙানো কয়েকটা খরগোসের ছবি-আজকের বিশেষ আকর্ষণ।

গলার মধ্যে গা গুলিয়ে ওঠা বলগুলোকে সামলাতে সামলাতে মনে হলো-ভাগ্যিস মেয়েটা বাংলা পড়তে পারে না।

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2025 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ