28 Sep

ভেজা খড়ের গন্ধ

লিখেছেন:হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়


ভেজা খড়ের গন্ধ হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

চামড়ার ওপর এসে পড়ে এক ফোঁটা ঠাণ্ডা জল। কেমন যেন কুঁচকে যায়। ঠিক কুঁচকে যাওয়া নয়, নিজেকে কেমন যেন গুটিয়ে নেয়। শুকনো বালির মধ্যে এক ফোঁটা জল এসে পড়লে যেমন হয়, চারপাশের পাড়ায় কেমন যেন একটা ধ্বস নামে। পাড়ায় পাড়ায় চাউর হয়ে যায় জল পড়ার খবর। তারপর শক্তির দিকে আস্তে আস্তে ঘেঁষে যাওয়া।  কিছুতেই মুখ সরিয়ে নেওয়ার উপায় নেই।

বুঝতে পেরেছে পিজান। কিন্তু এখনও চোখ খোলেনি। এই চোখ না খোলা পর্যন্ত পিজানের মনে হয় তার শরীরের ওপর কে যেন ঠাণ্ডা একটা হাত বুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। একবার দুবার নয়, একটা প্রবাহ। এইরকম একটা স্পর্শেই তার শরীর জেগে ওঠে। হাত পা নাড়াচাড়া করতে পারে না। গোটা শরীরটাই কেমন যেন অবশ হয়ে আসে। কিন্তু বেশিদূর এগোতে পারে না পিজান। পাশেই বাবা শুয়ে। ঠিক এমন সময়েই ইচ্ছে করে পুরো শরীরটাকে বিছানায় ছড়িয়ে দিতে। পোশাক নিয়েও এইসময় সে বেশি ভাবতে চায় না। কিন্তু উপায় নেই। এক একদিন বাবাই আগে উঠে পড়ে পিজানকে ঠেলা দেয়। ব্যাস, মুহূর্তে সবকিছু তাসের ঘরের মতো ভেঙে যায়। যদিও আজ একফোঁটা দুফোঁটা করে পরিমাণ বাড়তেই পিজান এক লাফে উঠে পড়ে বাবাকে ঠেলা দিয়ে মশারি খুলতে শুরু করে দেয়।

পরপর কাজগুলো করে যায় পিজান। মশারির চারটে কোণ খুলে একটা গোল পাকিয়ে দেওয়ালের দিকে ছুঁড়ে দেয়। তারপর বিছানাটাকে রোল করে একেবারে দেওয়ালের কাছে নিয়ে আসে। বাবা রোল করা বিছানার ওপর পেছন রেখে দেওয়ালে হেলান দেয়। এমনিতেই খুব কম কথা বলে। একবার শুধু দেওয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে বলে। জেগে থাকে অথচ কথা বলে না। প্রথম প্রথম পিজানের খুব অস্বস্তি হতো। এখন সব অভ্যাস হয়ে গেছে।

পিজান দেখে একটু পরেই বাবার চোখ বুজে আসে। সেটাই স্বাভাবিক। প্রতিটা দিন সকাল ছ’টায় অটো নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া। মাঝে ঘন্টাখানেকের জন্যে বাড়ি এসে চান খাওয়া সেরে আবার বেরিয়ে পড়া। তারপর বাড়ি ফিরতে ফিরতে সেই রাত ন’টা। বিছানার ওপর অদ্ভুত কায়দায় বাবা বসে থাকে। ঠিক যেন ড্রাইভারের সিটে বসে অটো চালাচ্ছে। ঘন্টার পর ঘন্টা পা মুড়ে বসে থাকতে একটুও কষ্ট হয় না। আসলে সবই অভ্যাস। পিজান এইভাবে বসে থাকতে পারে না।  পা ছড়াতেই হয়। কখনও কখনও পায়ে এসেও ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ে। তবুও পা ছড়িয়ে দেওয়ালে হেলান দিতেই হয়।

পিজান ঘুমোয় না। ঘুম আসে না। মাটির দেওয়াল আর খড়ের চালের ওপর বৃষ্টি পড়লেই ঘরের ভেতরের পরিবেশটাই সম্পূর্ণ বদলে যায়। এটা আজ বলে নয়। পিজানদের দুটো ঘরই মাটির দেওয়াল খড়ের চাল। শুধু তার নয়, বাবার জন্মও এঘরেই। দাদুই এই ঘর দুটো করেছে। একেবারে শেষ বয়সে দাদুর কোলে বসে এসব গল্প শুনেছে পিজান। নয় নয় করে ঘর দুটোর বয়স একশ কুড়ি ত্রিশ বছরের বেশি তবু কম হবে না। এমন পুরোনো ঘরের গন্ধটাই আলাদা। বৃষ্টি পড়লে এই গন্ধ যেন আরও গভীর হয়ে ওঠে। পিজান দেখেছে, বর্ষাকালে তাদের ঘরে কোনো বছরই জল পড়ার কোনো কামাই নেই। এমনকি যে বছর নতুন খড়ে ঘর ছাওয়া হয় সেই বছরও। আসলে ঘরের গায়েই একটা বড় আমগাছ। গাছের প্রায় সব ডালপালাই ঘরের চালের ওপর এসে পড়েছে, যার ফলে বেশিরভাগ অংশটাতেই রোদ হাওয়া লাগে না, ভিজে থাকে — একটা আওতার মতো। তাই নতুন খড় হলেও খুব তাড়াতাড়ি পচে গিয়ে জল পড়তে শুরু করে দেয়। কিন্তু তবুও খড়ের ঘরের বিরুদ্ধে একটা কথাও কোনোদিন বলেনি পিজান। সে ভাবতেও পারে না খড়ের চাল সরে গিয়ে টালির চাল বা পাকা ছাদ।

পিজান একটা ব্যাপার খেয়াল করেছে, গোটা বর্ষাকাল জুড়ে এই যে রাতের পর রাত কখনও ঘুমিয়ে কখনও জেগে বসে থাকা এর জন্যে বাবা কখনও তার কাছে দুঃখ প্রকাশ করেনি। অক্ষমতার কারণে যেকোনো বাবার মনেই এর উদয় হতে পারে, সে তার ছেলেকে অতি সামান্য স্বাচ্ছন্দ্যটুকুও দিতে পারছে না। কিন্তু পিজান তার বাবাকে কোনোদিন এসব নিয়ে একটা কথাও বলতে শোনেনি। কোনো কথা না বলেও মানুষটা বুঝিয়ে দিয়েছে, এটাই জীবন। জীবনের প্রতি পদক্ষেপে এমন লড়াইয়ের সুযোগ সকলের ভাগ্যে ঘটে না। সত্যি বলতে কি, বছরের পর বছর দাঁতে দাঁত চেপে এমন লড়াই তাকে জীবনে অনেক কিছু দিয়েছে।

বর্ষারাতে বাইরে মুষলধারায় বৃষ্টি নামলে সবাই যখন পায়ের বালিশ আঁকড়ে গভীর ঘুমে ডুবে যায়, ঠিক সেই সময়েই পিজানের উঠে পড়ার সময়। কারণ খড়ের চাল ফুটো হয়ে বৃষ্টির জল মশারির চাল ভেদ করে পিজানের গায়ে এসে পড়ে। অন্য যে কেউ হলে মাথা গরম করে ফেলত। শুধু তাই নয়, বাবাকেও হয়ত দু’চার কথা শুনিয়ে দিত। কিন্তু পিজানের এসব কিছুই মনে হয় না। খড়ে বৃষ্টির জল পড়লে এমন একটা গন্ধ উঠে আসে যেন নেশা ধরে যায়। গন্ধটার একটা বৈশিষ্ট্য আছে। একবার গন্ধটা নাকে এলেই ছড়ানো মনকে গুটিয়ে নিয়ে একটা বিন্দুতে চলে আসে। তখন কিছুতেই আর সরিয়ে আনতে পারে না পিজান। এসব প্রথম দিকের কথা। এখন আর অত সময় লাগে না। এখন ভেজা খড়ের গন্ধ নাকে এলেই পিজান হারিয়ে যায়।

কেমন একটা মদের নেশার মতো গন্ধ। সঙ্গে হালকা একটা আঁশটে গন্ধও থাকে। নারী শরীরের উত্তাপ। এখনও স্পষ্ট মনে আছে পিজানের। ভাদ্র মাসে অরন্ধনের দিন মা উঠোন নিকোবে। চালতা পুকুর থেকে জল আনতে গেল পিজান। ঘাটের পাশেই খড় ভিজিয়েছে রমজান চাচা। মাদু কাকাদের ঘর ছাওয়া হচ্ছে। চাচার মা মরা মেয়ে খড় তুলে এনে বাপকে দিচ্ছে। দুজন একই সঙ্গে ঘাট থেকে উঠে আসছে। মেয়েটা খড় নিয়ে টাল সামলাতে না পেরে হাঁড়ি মাথায় পিজানের ওপর এসে পড়ল। অল্প বয়সের মেয়ে, নিজের শরীরের চারপাশ সবদিক ঠিকঠাক গুছিয়ে উঠতে পারেনি। তাই নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়াবার আগেই অগোছালো শরীরের অনেক কিছুই পিজানের চোখ মুখ হাতের ওপর গড়িয়ে এলো। তার সঙ্গে ভেজা খড়ের গন্ধ।

ঘর ছাওয়া শেষ হওয়ার পর প্রথম একমাস রাতে পিজানের চোখে ঘুমই আসতে চায় না। তখন তো আর বর্ষাকাল নয়। ভয়ঙ্কর ঠাণ্ডার কামড়ে সবাই তখন রীতিমতো জড়োসড়ো। কোনো কোনোদিন শুয়ে পড়েই প্রথম একঘন্টা ঘুম হয়ে যায়। তারপর হঠাৎ করেই ঘুমটা ভেঙে গেলে নাকে আসে ভেজা খড়ের গন্ধ। এই একটা গন্ধই তাকে বারবার মনে করিয়ে দেয়, এই ঘরসংসার তার জন্যে নয়। সে যেন এক বাঁধনছেঁড়া মানুষ। ধুলো ওড়া পথে সে হেঁটে চলেছে মাইলের পর মাইল। কোথাও কোনো গন্তব্য নেই। ওই ঘোরের মধ্যে সে কোনো পথও চিনতে পারে না। দেখে শুধু চিনতে পারে একটা বটগাছ। আসলে রোজকার জীবনে এতবার সে বটগাছটার পাতায় পাতায় নিজেকে ধরেছে যে, যেকোনো ভাবনার শুরুই যেন বটগাছ দিয়ে। এ যেন সেই রাস্তা, যেখান দিয়েই যাও বটগাছটিকে একবার ছুঁয়ে যেতেই হবে।

পিজান দেখেছে খড়ের ওপর জল পড়লে ধোঁয়া ওঠে। মনে হয় তৃষ্ণার্ত খড় কতদিন পর যেন জলের আশ্রয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। খড়ের সঙ্গে পিজানের অনেক দিনের সম্পর্ক। সেই কোন ছোটবেলায় লুকোচুরি খেলতে গিয়ে মাঝে মাঝেই হারিয়ে যেত। সবাই জানত হয়ত বাড়ি চলে গেছে। আসলে তা নয়। খড় ঝেড়ে যে কুটি পাওয়া যেত সেগুলো মাঠের এক কোণে স্তুপাকার করা থাকত। ওর মধ্যে গিয়ে পিজান লুকোতো। ছুটে গিয়ে ওর মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়লে অনেককানি ভেতরে ঢুকে যেত। ওপর থেকে কেউ বুঝতেই পারত না। পিজান কুটির ভেতরে ঢুকে শুকনো খড়ের গন্ধ নিত।

চালতা পুকুরের ওই ঘটনার পরে পিজান অনেক জায়গাতেই লোকের চোখ এড়িয়ে রমজান চাচার মেয়েকে খড় ভিজিয়ে দেয়। নিজেদের ঘর ছাওয়া হলে তো কথাই নেই। পিজান যখন খড় ভেজায় তখন খুব কাছেই দাঁড়িয়ে থাকে মেয়েটা। নামটাই জিজ্ঞাসা করা হয়নি। আসলে কাছে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় শরীরের গন্ধ নাকে এলেই পিজান অনেককিছুরই খেই হারিয়ে ফেলে। অনেক জিনিসই আগে পরে হয়ে যায়। কোনোকিছুরই মাথামুণ্ডু থাকে না। ভেজা খড়ে হাত রাখলে এমন একটা ঠাণ্ডা, যার হাত ধরে পৌঁছে যাওয়া যায় শরীরের অনেক গভীরে। যেদিন নিজের শরীরের ওপর মেয়েটার শরীর গড়িয়ে এসেছিল সেদিন থেকেই বুঝেছিল এ যেন এক ঠাণ্ডার সীমান্ত। সামান্য কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেই গরমের হলকা এসে গায়ে লাগে।

এখন তাই রাতে ভেজা খড়ের গন্ধের ভেতর মেয়েটার শরীরের গন্ধও ঢুকে পড়ে। তাই আগের থেকে খড়ের গন্ধ অনেক বেশি মাদকতায় ভরা।খড়ের গন্ধের হাত ধরে আরও অনেক অনেক গভীরে যেতে ইচ্ছে করে পিজানের। নিজেকে আরও মেলে ধরতে। এমন অনেক দিন গেছে অভাবের সংসারে  সারাদিনের ভাত অনেক বেলা করে খেয়েছে যাতে রাতে আবার কিছু খেতে না হয়। মাঝরাতে খিদে যে পায়নি তা নয় কিন্তু খড়ের গন্ধে সে সব কোথায় গেছে উবে। এমন নয় যে, ঘর ছাইবার পর প্রথম দু’এক মাস গন্ধ খুব তীব্র হয়। সারা বছরই গন্ধ পায় পিজান। বিশেষত বর্ষাকালে, খড়ে জল পড়লেই যেন গন্ধ পাক খেয়ে খেয়ে ওঠে। আর সেই গন্ধের ভেতর ডুব দিলেই শরীর এলিয়ে যায়। সামান্যমাত্রও নিয়ন্ত্রণ থাকে না। সম্বিত ফিরলে দেখেছে প্যান্টটা কেমন যেন ভিজে ভিজে গেছে। ঠিক যেমন পাড়ায় সিনেমাহলের নতুন সিনেমার খবর রিক্সা করে মাইকে প্রচার করতে এলে হ্যাণ্ডবিলের জন্যে রিক্সার পিছনে ছুটতে ছুটতে যেভাবে একসময় প্যান্ট ভিজে যেত। অনেকক্ষণ শরীর গরম হয়ে থাকত। হাত পা নাড়ানোরও ক্ষমতা থাকত না।

এখন তো মাঝে মাঝেই শরীরে কেমন যেন সে ভিন্ন হয়ে যায়। তখন মোটেই ভালো লাগে না পাশে বাবার শুয়ে থাকা। লজ্জায় কেমন যেন গুটিয়ে যায়। অন্য পৃথিবীর দিকে আর হাত বাড়ানো হয় না। খুব ইচ্ছে করে তার জন্যে একটা আলাদা ঘর থাকুক। সারারাত জেগে বসে থাকবে। হয়ত মশারি টাঙাবে না। সারা শরীর দিয়ে ভেজা খড়ের গন্ধ নেবে। শরীর ছেড়ে দিলে গা থেকে খসে পড়ে যাবে জামা প্যান্ট। নিজেকে গুছিয়ে নেবার কোনো তাড়া থাকবে না। কিন্তু এই আলাদা ঘরের ইচ্ছেটাকে মনে মনে বাড়তে দিতে পারেনি। গত প্রায় দশ বছর ধরে মা একটুকরো রান্নাঘরে রাত কাটিয়ে আসছে। সারাটা দিন যে মানুষটা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে সে যেন রাতটা একটু ভালোভাবে ঘুমোতে পারে — মা বেছে নিয়েছে রান্নাঘর।

ঘুমের ভেতর পিজান প্রায়ই হারিয়ে যায়। কেউ কোথাও তাকে খুঁজে পায় না। অনেক অনেক দূরে চলে গেলেও নাকে ভেজা খড়ের গন্ধ লেগে থাকে। এই কারণেই সে আর ফিরে আসতে চায় না। এইটুকুই শুধু তার। তার কাছে আর কোথাও কোনো কিছুর অর্থ নেই। মাঝে মাঝেই নিজেকে কেমন যেন ভারশূন্য মনে হয়। কোথাও যেন তার কিছু পড়ে নেই নিজের মনে করে হাতে তুলে নেবার মতো। তাই ঘুম ভাঙতে চায় না। বাইরের মুষলধারায় বৃষ্টি খড়ের চাল চুঁইয়ে মশারির চাল পার হয়ে নাইকুণ্ডুলে এসে জমা হয। দুই পাড় ভাসিয়ে দিয়ে নদী যখন বসতি অঞ্চলে ঢুকে পড়ে তখন হঠাৎ করেই ঘুম ভেঙে যায় পিজানের। পুরো প্যান্ট ভিজে গেছে। নাইকুণ্ডুলে হাত ডুবিয়ে সারা গায়ে জল মেখে নেয়। গরম শরীরে এমন ঠাণ্ডা জলের ছোঁয়া হাত পায়ে খাল ধরিয়ে দেয়। ভেজা খড়ের গন্ধ নাকে নিয়ে যেদিকেই হাত বাড়ায় সবটুকুই ভিজে।

[ বানানবিধি লেখকের নিজস্ব]

Tags: , , , , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2025 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ