পথ চলছিল একা। আধা শহরের মধ্যবিত্ত পথ। আধা শহরের মধ্যবিত্ত পথ। রাজপথ তাকে পাত্তাই দেয় না। গলি পথেরা তাকে হতচ্ছেদ্দা করতে পারেনা। এঁকে বেঁকে বড় মেজ ছোটো বাড়ির পাশ দিয়ে চলতে চলতে এই রোদে বড় কষ্ট হচ্ছিল। সেই সকাল থেকে আকাশটা বদলে যাচ্ছে বারবার। এরকম চোখ পাকানো আকাশটাকে একদমই সহ্য করতে পারেনা সে। অথচ ভোরবেলায় কি সুন্দর আহীর ভৈরব গাইতে গাইতে আকাশ এগিয়ে চলেছিল তার সঙ্গে। আকাশের এই ক্ষণে ক্ষণে চরিত্র বদল পথের একদম না পসন্দ। সবুজমাঠগুলো মাথা দুলিয়ে পথের যাওয়ার তালে তাল দিচ্ছে। হঠাৎ চোখে পড়ল দূরে একটা বড় বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটার পর একটা বুদবুদ উড়িয়ে দিচ্ছে একটা কুড়ি-একুশ বছরের মেয়ে। আর আপন মনে হাসছে। কথা বলছে। পাশে কেউ নেই। বুদবুদগুলো নিয়ে হাওয়ায় সে কি খেলা। আজকাল মাঝবয়সের হাওয়াগুলো কেমন বদলে গেছে। মেয়েদের দেখলে তাদের খেলার আনন্দটা যেন বেড়ে যায়। আগে চুল নিয়ে আঁচল নিয়ে খেলা করতো, এখন দেখ কাজ ফেলে বুদবুদগুলো নিয়ে কি কাণ্ড করছে। একবার মনে হল দাঁড়িয়ে দেখবে। কিন্তু তার উপায় নেই। তবু একটা বাঁক নিলো ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার জন্যে। কোথায় যেন দেখেছে মেয়েটাকে। মনে করার চেষ্টা করে। মুখের গড়ন অনেকটা ………. দূরে চলে যাচ্ছে বাড়িটা।
একটা বিশাল জিলাবি গাছের নিচে একটা চায়ের দোকান…..
খৈনি মুলতে মুলতে একটা বুড়ো পাশের দোকানের লোকটাকে বলে উঠলো
– আজ পাড়ঘাটে একটা মরা ভেসে এসেছে।
একটা সাইকেল হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। চা খেতে খেতে বলে
– একটা জোয়ান ছেলের লাশ। কেউ মেরে ফেলে দিয়েছে হয়তো।
– পুলিশ এসেছে। দেখেছো একটুও ফোলেনি মড়াটার শরীর।
– হুম একদম টাটকা মরা …
তারপর লোকটা আর যে কি বলল তা শুনতেই পাওয়া গেল না। যে লোকটা বলছিল তার গলাটা ফ্যাসফ্যাসে। কাদের বাড়ির ছেলে, কেন মারা গেল এসব ভাবার সময় কই। ওপাশে একটা পুরোনো গোরোস্তান। একদল আগাছা জড়িয়ে ধরেছে তাকে। খেয়ালই নেই কারও। তার পাশ দিয়ে বাঁক নিতে গিয়ে পথের মনে পড়ে গেল তার গায়ে যখন ক্ষত হয়েছিল, জল জমে হাড় বেড়িয়ে সে কি যন্ত্রণা। এই গোরোস্তানেরই একজন নিজের পয়সায় তাকে সারিয়ে দিয়েছিল।
এখন আকাশটা কেমন কৃষ্ণকলি সাজছে। ঈশান কোনটা দেখে পথ একটু অন্যমন হয়।
প্রতিদিন এ সময়ে পথের বেশ আনন্দ হয়। একদল স্কুল ফেরত সাইকেল হৈ হৈ করে যায়।
পথও তাল ফেলে ছোটে ………… চল চল ছোট ছোট … চল চল ছোট ছোট …..
হঠাৎ কানে এলো –
– এবার একটা পার্মানেন্ট সেটেলমেন্ট করতেই হবে। এভাবে চলতে পারে না। অনেকদিন হয়ে গেল। আমার কথাটা এবার ভেবে দেখো অতুলদা। টাকাটা না দাও বদলে যেটা ম্যানেজ করে দেবে বলেছিলে সেটা ….. শুনলাম ওর নাকি ……
এরকম কত শুনেছে, কত কাণ্ড হয়েছে তার বুকে। কত কান্না, অনুনয় বিনয়, রক্তে মাখামাখি শরীর … এই তো কয়েকদিন আগেই রাত্রিবেলায় একটা মেয়েকে ট্যাক্সি থেকে …
চমকে ওঠে … আরে ওই বড় বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে বুদবুদ ওড়াচ্ছিল ওই সেই মেয়েটাই …
পথের মনে পড়ে যায় সেদিনের সব কথা। টিপ টিপ বৃষ্টির মধ্যে মেয়েটাকে গাড়ি থেকে যখন ফেলে দিল কেউ ছিলনা আশেপাশে। একটু আঁতকে উঠলেও কি হল দেখার সময়ও ছিল না। এখন নিশ্চিন্ত মেয়েটা মরেনি। বেশ আনন্দ হল।
দূরে চৈতন্যপুর গ্রামের হাল্কা সিঁদুর রঙের জামদানি পরে সন্ধ্যা নামছে। হাজার রকমের পাখি উড়ে এসে বসেছে দু’পাশের গাছগুলোয়। ওই বুড়ো অশ্বত্থ গাছটা দু’হাত বাড়িয়ে তাদের বাড়িঘর সামলায়। পথ দেখেছে কত রঙের পিঁপড়েও থাকে ওই বটের গায়ে। এই বয়েসে সহ্য করতেও পারে বুড়ো গাছটা। একদল শালিক তর্ক করছে নিজেদের মধ্যে। মনে মনে ফিকফিক করে হেসে গড়িয়ে যায় সে। এই তর্কই একসময় ঝগড়ায় পরিণত হবে। তারপর ঘটাপটি। ঠিক মানুষদের মত। কুব…কুব…কুব একটা প্রলম্বিত মোটা গলার ডাক কানে আসছে। এসময় শরীরে কোষে কোষে ক্লান্তি আসে পথের। অথচ ওই দূরে মাথা দোলানো মাঠের পাশ দিয়ে যে রেলপথটা গেছে তার বয়স ওর চেয়েও বেশি, জন্ম থেকেই শুনছে রেলপথের জন্ম ব্রিটিশ আমলে। কিন্তু দেখ এখনও ছুটছে যেন জোয়ান ঘোড়া। একটু হিংসেই হয়। ধর ধর ছাড় ছাড় … ছাড় ছাড়, …ধর ধর। ছুটেই চলেছে। কাকে যে ধরবে আর কাকেই বা ছাড়বে কে জানে! হা হা করে হাসতে হাসতে একদল হাওয়াও চলেছে তার সঙ্গে। এগুলো তার চেনা ফচকে হাওয়া। সুযোগ পেলেই বাচালতা করা এদের অভ্যাস। সব সময় ওদের মনে দুষ্টুমি খেলা করে।
ঘন লতাগুল্মের আস্তরণে ঢাকা একটা জীর্ণ ঘর বলে ওঠে
– অ ন্যাপাল কোথায় চল্লিরে এই ভর সন্ধ্যায়? আকাশটা আজ আবার কালো করে আসছে।
আবার কি ভেসে যাব নাকি রে! ভগবান আমার এত পিছনে নেগেছে কেন কে জানে।
– হ্যাগো খুড়ো টিভিতে দেখলাম তো একটা নিম্নচাপ আবার চাপ দিতে আসছে। কি জানি গো কি লেখা আছে কপালে। তুমি হারুদের বাড়িতে থাকোনা কেন? এক কোণে থাকবে।
– ওর বড় মেয়েটা কত কথা শোনায়। বলে এত বয়সে হল তবু জঞ্জাল্টার এত বাঁচার ইচ্ছে কেন রে বাপু।
পথ জানে গত সাতদিন ধরে একনাগাড়ে বৃষ্টি হয়ে আশেপাশে অর্দ্ধেক গ্রাম ডুবে গেছে। এই আধা শহরগুলো এখনও সে রকম অসুস্থ হয়নি। মনডোবা গ্রামে পথের শৈশব বান্ধবী নদীটার এখন কী দাপট। সেই কবে থেকে বন্ধুত্ব দানা বেঁধেছে দুজনের।
মাঝে মাঝে এ নদীর আচরণ দেখে মনে হতে পারে সে সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত।
এমনিতে রোগা। সারা বছর নিস্তেজ হয়ে শুয়ে থাকে। যেন কাউকেই সে কোনো দিন চেনে না। পাশ দিয়ে যেতে যেতে পথ যখন কথা বলে গলার আওয়াজটাই শোনা যায় না। আর এখন তার কী দাপট। ভয়ঙ্করী তার চেহারা। দেখলে চেনাই যায় না। গায়ের রঙ গেছে বদলে। আগে এরকম ভয়ঙ্কর চেহারা ওর দেখা যায়নি। খাউ খলাৎ খাউ খলাৎ গর্জেই চলেছে সারাক্ষণ। একটা দীর্ঘশ্বাস বুক কাঁপিয়ে বেরিয়ে আসে। কতবার শীর্ণকায়া নদীটার পাশ দিয়ে যেতে যেতে ফিসফিস করে বলেছে – তোকে খুব ভালবাসিরে। তোকে – ‘ও বউ’ বলে ডাকতে ইচ্ছে করে। হাওয়ায় অল্প অল্প জলকণা ঠিক চুলের মত উড়ে এসে গায়ে লেগেছে পথের। বুকের ভিতরে একটা ঢেউ খেলে গেছে। বৃষ্টি হলে রোগা নদী যখন বেশ তন্বী হয়ে ওঠে তখন পথের খুব আনন্দ হয়। ওর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ছোট ছোট ঢেউ নিয়ে খেলা করে। তখন জলের রং নানারকমের হয়। যেন পথের মনের রংগুলো সব একাকার হয়ে নদীর জলে মিশে যায়।
ঘন হয়ে আসছে রাত। ঝিঁঝিঁর আসরে আজ কয়েকটা ব্যাঙও গলা ছেড়েছে। খানিক এগুতেই একটা ব্যাঙের আর্ত গোঙানির আওয়াজ শোনা গেল। কঁক কঁক কঁক। তারপর চুপ। এবার একদল ভয়ঙ্কর অচেনা হাওয়া আছড়ে পড়লো পথের গায়ে। পাশ দিয়ে গড়িয়ে গেল জঞ্জাল ফেলার কয়েকটা ড্রাম। মেঘের গায়ে আলোর রোশনাই চোখ ঠিকরে দিচ্ছে। পথ শুনতে পায় একটু দূরেই ওর বান্ধবী নদীর ভয়ঙ্কর গর্জন। ও জানে এই গর্জনের মানে। আজ কত বাড়িকে খেয়ে ফেলবে রাক্ষসী। কিম্বা কোনো বড় গাছের আজ শেষ দিন। আকাশ কালো হয়ে বৃষ্টি নামলে যে কেন নদী এমন রাক্ষসী হয়ে ওঠে বুঝতে পারেনা সে।
আকাশ থেকে নেমে আসা জল নুপূরের তাল আরো দ্রুত হয়। অচেনা হাওয়ারা চেনা হাওয়াদের কখন খেয়ে ফেলেছে বুঝতেই পারেনি সে। এবার নদীটাও কাছে এসে যায়। আরে এত কাছে এসে গেল কী করে! ভেবে পায়না পথ। নদী আজ পথের বুকের ওপরে এসে পড়েছে। কত দিন স্বপ্ন দেখেছে ও নদীকে বুকে নিয়ে আদর করবে। সেই নদী আজ তার বুকের উপরে। আকাশটা আবার ঝলসে উঠলো। চলার সমস্ত হিসেব হারিয়ে ফেলছে সে। কোথা থেকে এসেছে কোথায় যাবার কথা। একদিকের কাঁধে কি যন্ত্রণা। ধমনীতে জল ঢুকছে। এবার মাথাটা ….. উফ। ও বউ আর পারছি না রে।
গুরুক গুরুক ঝপাস ….. ও পাশের একটা বাড়ি ঝাঁপিয়ে পড়লো।
পথের বুকের ভিতরে একটা বাঁশ ফাটার মত আওয়াজ। তারপর কড়কড় কড়কড়। হা হা হা হেসে ওঠে নদী। নাচতে নাচতে এগিয়ে চলে খাউ খলাৎ খাউ খলাৎ…..
Tags: গল্প, পথ, রামকিশোর ভট্টাচার্য
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।