সে হেসেছিল যখন তখন হাওয়ায় মঞ্জরীর বাস। ফাগুয়ায় রাঙা মধ্যদিন। পুকুরের জলে নিদাঘের ছায়া। সারা গায়ে তাপ নিয়ে ঘুরেছি পথে পথে, আর সেই পথ এমন করে রূপনগরে এসে মিলবে যদি জানতেম! অজানাকে জানব বলেই তো মনভাসির টানে পাড়ি দিয়েছি অচেনায়। দিনের আরশিতে নিশুতরাতের শোভা দেখলে এক জীবনে পরম রতন মেলে, মানুষ রতন গো, তাই তো পরম। এত তীর্থ, এত নৈবেদ্য, এত পুণ্যস্নান কীসের তরে বলো দেখি! কত হাহাকার নিয়ে হাত পেতেছি তোমার তরে নাথ, ফিরিয়ে দিও না প্রভু। দেবতা আমার অলক্ষ্যে হাসেন মুচকে, মানত পূরণ করেন। কিন্তু আরও যে চাই, আবারও সেই চাওন-মাগন। আমার এই কামনাটি মিটিয়ে দাও গো…দয়াল আমার আবারও হাসেন, বাঞ্ছাকল্পতরু কৃপাকণা দিলেন ফের। কিন্তু আমি যে বললেম, মানুষরতন চাই হে আমার…এমন মানুষ যাকে পেয়েও ফুরিয়ে ফেলব না কোনওকালে। মাথানত করেছি তোমার চরণতলে পূর্ণ কর হৃদয়তল। এই চাওয়া জন্মের চাওয়া বলেই বুঝি নিঠুর দরদী আমার ঘর হতে পর করেছেন। আমার কেবল ফেরা। তোমাদের সক্কলের কাছে আমার অনন্ত মাধুকরী।
রূপনগরে চৌত বেলায় তাকে আমায় পাইয়ে দিলে জীবনদেবতা। তার সঙ্গ নিয়েই বসেছি এই শ্রীপাটের মাটির দাওয়ায়। চেনা-জানা নেই তাও সই সে নিয়ে এসেছে সঙ্গ করে সঙ্গীবিহীন আমায়। আমি তাকে শুধিয়ে ছিলেম, – ‘কোথায় পাব তারে?’
উত্তাপ উধাও হচ্ছে, মধুবায়ু ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। সে হাসছিল, মুখে তার টুকুন পানের খিলি, এলো চুল, টিকালো নাকটিতে রসকলির চিহ্ন, সাদা শাড়ির আঁচলখানি গায়েতে ঢাকা। কলাপাতায় সাজিয়ে দিয়েছে মাধবের প্রসাদ। সেই যে সে তাকিয়ে আছে, হাসছে মধুর আর বলছে, — ‘আমি পূজো জানিনে যে, গানেই আমার পুজো, রীতি-নিয়মের মন্ত্র জপে দেবতাকে অর্ঘ্য দেবে পুরুতঠাকুর। আমি যে ওই নিয়ম জানিনে। আমি জানি গান। শ্রীরাধার দাসীরও দাসী মেনেছি আমি নিজেকে। মাধবকে গানের অর্ঘ্যে সঁপেছি বাসনা। পথের ধূলায় আমি খুঁজে পাই আমার প্রেম। আমিও ফিরি তাই, তোমাদের লগে।’
বিনোদ বোষ্টুমী আমায় বললে, –‘ খুইয়েছ কাকে ঠাকুর? যাকে খুইয়েছ সে আবার ধরা দেবে আপনি তোমার কাছে এই ধরাতেই।’
প্রসাদ যেমনকার তেমন পড়ে থাকে, মাটির দাওয়ার এককোণে বিড়াল হাই তুলে তাকিয়ে থাকে পাতের দিকে। ফাগুনের কোকিল ডাকে মরিয়া হয়ে। বাতাস কথা শোনে তার, আমিও শুনি। সে হাসে ফিরে ফিরে, বলে, — ‘অন্নসেবায় বসো যখন, তখন কেমন করে সেবা নাও বলো তো ঠাকুর? ধীরে ধীরে অন্ন ভেঙে বিভিন্ন পদের সাথে মেখে নাও কিনা? একে যদি অন্যভাবে ব্যাখ্যান কর তবে কী মানে হয় জানো? সংসারের সকল বাসনাকে এভাবে চাখতে চাখতে আরও চেখে দেখার লোভে মানুষকে বদ্ধ করেছে মাধব আমার। নিত্যদিন। তৃষা মিটে নাই তাও গো! ভেবে দেখো তো ঠাকুর আমার, মনের ঘরটিতে কতদিন রোদ ঢুকতে দাওনি? দোর-কপাট খুলে দাও। আলো আসুক। সেই আলোয় দেখবে কত-শত ছায়া চলাচল করছে ঘরখানিময়। সব ছায়াকে ভাললাগতে হবে তার মানে নাই ঠাকুর। কিন্তু এর ভেতরেই কয়েকটি ছায়া ঠিক বসত ঢুঁড়ে নেবে মনের বাসায়। আগলে রেখো তাদের।’
বেলা ফুরিয়ে আসতে থাকে রূপনগরে। গোধুলির লাল ধূম্র ঝড় উড়িয়ে গরুর পাল নিয়ে বাথানে ফিরছে রখালের দল। আমি তাকে বলি, — ‘তুমি পেরেছ সেই অকিঞ্চিতের ভিতর থেকে অরূপরতনের ছায়াটিকে স্থির ধরে রাখতে?’
বিনোদ বোষ্টুমী হাসে, তার চোখের তারায় জলের কাঁপন, হাসে কেবল আর তাকায় আমার দিকে, বলে — ‘বাধা যে ছিন্ন হয় নাই ঠাকুর, যাকে পেলেম মনে মনে ভাবলেম এই বুঝি আমার সেই দোসর, কিন্তু সময় কেমন বুঝিয়ে দিলে, না না এ নয়, অন্য কেউ, আমার পরম তো এত দীন হতে পারে না ঠাকুর! এত দাবি আর কামনা নিয়ে সে আমার মনের ঘরের আসনখানিতে বসবে কেমনে! সেই যে বেরিয়ে পড়লেম আর ফিরিনি। ফিরে দেখতে সাধ জাগে না। এখন দুয়ার খুলে তোমাদের দেখি ঠাকুর। তোমাদে অন্তরগুলি দেখি। ভিতর ঘরগুলি খুলে দিই গানে গানে। প্রথম দেখায় তুমি আমায় শুধিয়েছিলে, – ‘কোথায় পাব তারে?’ এবার আমি একটা
কথা শুধাই ঠাকুর? বলো তো, কোথায় সে জন আছে?
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।