আমাদের এই মফস্বল শহর থেকে ভারতের সীমান্ত খুব কাছে। প্রচুর লোকজন প্রতিনিয়ত এপার-ওপার করে। তাদের অধিকাংশই এদেশের। চোরাকারবারি, বৈধ ব্যবসায়ী, চিকিৎসা ও লেখাপড়ার জন্য যায় এমন লোকজন, আর আছে সেইসব মানুষ, যাদের খুব কাছের আত্মীয়স্বজন ওপারে আছে। আমাদের এই শহর ও এর আশপাশের গ্রামগুলোতে এরকম মানুষের সংখ্যা এখনও অনেক।
ওপারের লোকেরাও মাঝে মাঝে এপারে আসে। তবে এপার থেকে যত লোক ওপারে যায়, ওপার থেকে তত আসে না।
সাধারণভাবে বিদেশিদের সম্বন্ধে আমাদের মনে যেসব কৌতূহল কাজ করে পশ্চিমবঙ্গের লোকদের সম্বন্ধে তা করে না। তারা তো ইউরোপীয়দের মতো শাদা চামড়ার বা ভিন্ন ভাষার লোক নয়, তারা সব দিক থেকেই আমাদেরই মতো দেখতে। তাই তাদেরকে আমাদের বিদেশি বলে মনে হয় না। অতি-পরিচিত প্রতিবেশীদের সম্পর্কে কি কৌতূহল থাকে?
তাই, একজন ভারতীয় নাগরিক আমাদের শহরে এসেছেন, এই খবর আমাদের মনে কোনো চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেনি। কিন্তু আমরা যখন শুনতে পেলাম যে ওই ভদ্রলোক এখানে এসেছেন মরতে, তখন ভীষণ কৌতূহলী হয়ে উঠলাম। এমন উদ্ভট কথা আমরা এর আগে কখনো শুনিনি।
কথাটা বলে আমাদের বন্ধু তপন। ওই ভদ্রলোক ওদের বাড়িতেই উঠেছেন। কিন্তু আমরা তপনের কথা বিশ্বাস করিনি, ভেবেছি সে রসিকতা করছে। সে বার বার বলে এটা রসিকতার বিষয় না, আর আমরা তা শুনে হাসি। কারণ আমাদের এই বন্ধুটা সত্যিই রসিক। সে ‘ইয়ার্কি করিচ্ছি না কিন্তু’ বলেই অবলীলায় ঠাট্টা-রসিকতা করে যায়।
গল্প-উপন্যাসের চরিত্র নয়, সত্যিকারের একজন মানুষ নিজের মৃত্যুর দিনক্ষণ ঘোষণা করেছেন। তিনি তাঁর মৃত্যুকে দর্শনীয় একটা অনুষ্ঠান করে তুলবেন-এ রকম রসিক লোকের কথা শুনে আমরা তাঁকে দেখতে তপনদের বাড়ি ছুটে যাই। কিন্তু সেখানে তাঁর সাক্ষাৎ পাই না। তপনের মা আমাদের বলেন, তাঁদের এই অতিথি খুব ভোরে প্রায় অন্ধকারের মধ্যেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান, ফিরে আসেন সন্ধ্যার অনেক পরে। সারাদিন কোথায় থাকেন, কী করেন কিছুই বলেন না।
তপনদের বাড়িতে আমাদের দেখা হয় ভদ্রলোকের নাতির সঙ্গে। সে হাসিমুখে আমাদের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করতে করতে বলে যে তার নাম অভিজিৎ চক্রবর্তী, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে অনার্স পড়ে।
আমাদের একজন তাকে জিজ্ঞাসা করে সে এর আগে কখনো বাংলাদেশে এসেছিল কি না। সে বলে, ‘আসা হয়ে ওঠেনি’। কথাটা বলার সময় তাকে কুণ্ঠিত দেখে আমরা আনন্দ পাই। আমাদের একজন তাকে বলে যে আমরা প্রত্যেকেই অন্তত একবার পশ্চিমবঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলাম। কিন্তু কথাটা সত্য নয়। আমরা কেউই ভিসা নিয়ে ইমিগ্রেশন পার হয়ে পশ্চিমবঙ্গে যাইনি; কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে আমরা পা রেখেছিলাম, কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরিও করেছিলাম, এমনকি ওপারের রাখালদের সঙ্গে আমাদের গল্পগুজবও হয়েছিল।
আসলে, আমরা একবার পিকনিকে গিয়েছিলাম এমন এক শালবনে, যার অর্ধেক বাংলাদেশ, অর্ধেক পশ্চিমবঙ্গ, এবং দুই দেশের মাঝখানে তখন কোনো বেড়া ছিল না, ছিল শুধু কয়েকটা কংক্রিটের পিলার, খুব জোর হাঁটুসমান উঁচু। শালবন ফুরালে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ, কিন্তু সে সময় মাঠে কোনো ফসল ছিল না; ধান কাটা শেষ হয়ে গিয়েছিল, পড়ে ছিল বিরান প্রান্তর। সেই প্রান্তরের পুব দিকটা বাংলাদেশ, পশ্চিম দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আমরা ‘ইন্ডিয়া’ খুঁজছিলাম, কিন্তু খুঁজে পাচ্ছিলাম না, কারণ ওই প্রান্তরে হাঁটুসমান উঁচু কোনো পিলার ছিল না। রাখাল ছেলেরা গরু চরাচ্ছিল; আসলে গরুরা নিজেদের ইচ্ছামতো চরে বেড়াচ্ছিল আর রাখালেরা মনের সুখে ডাংগুলি খেলছিল। আমরা তাদের কাছে গিয়ে জানতে চেয়েছিলাম ‘ইন্ডিয়া’ কত দূরে। ছেলেগুলি আমাদের কথা শুনে হাসতে হাসতে বলেছিল যে আমরা ইন্ডিয়ার মাটিতেই দাঁড়িয়ে আছি। প্রথমে ওদের কথা আমাদের বিশ্বাস হয়নি, আমরা ভেবেছিলাম ওরা রসিকতা করছে। আমাদের একজন রাখালদের উপর রেগে গিয়ে তুই-তোকারি শুরু করেছিল: ‘তোরা আমাদের সাথে ইয়ার্কি মারিচ্ছিস?’ মানে, সে বোঝাতে চাইছিল, গেঁয়ো রাখাল হয়ে কলেজে পড়া শহুরে তরুণদের সঙ্গে রসিকতা করা চরম বেয়াদবি।
কিন্তু আমাদের রাগী বন্ধুটার চোটপাট দেখে রাখালেরা জোরে শব্দ করে হেসে উঠেছিল, আর ওদের ওভাবে হাসতে দেখে আমরা নিশ্চিত ধরে নিয়েছিলাম যে ওরা সত্যিই আমাদের বোকা বানাচ্ছে। তখন আমরা পিলার খুঁজতে শুরু করেছিলাম, কিন্তু না পেয়ে ওদেরকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কত দূরে গেলে ইন্ডিয়া পাওয়া যাবে? রাখালেরা আমাদের কথা শুনে আরও জোরে হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘ইন্ডিয়ার মদ্যে খাড়ায়া ইন্ডিয়া ঢুঁড়ে বেড়ালে কি পাওয়া যায়?’
‘তাহলে কি তোরা ইন্ডিয়ার মানুষ?’
‘হয় হয়, হামরা ইন্ডিয়া, আর তোমরা বাংলাদেশ।’
‘প্রমাণ কী?’
‘হি হি হি!’
অবশেষে আমরা একটা সীমানা-চিহ্ন খুঁজে পেয়েছিলাম। কংক্রিটের চিহ্নই বটে, কিন্তু তার উচ্চতা চার আঙুলের বেশি নয়। মনে হয় কেউ মাটি দিয়ে বুঁজে দিতে চেয়েছিল। চিহ্নটা খুঁজে পেয়ে আমাদের দুই বন্ধু গৌতম আর জগন্নাথ খুশিতে বগল বাজিয়ে ধেই ধেই করে নেচেছিল, পশ্চিম দিক লক্ষ করে ভোঁ দৌড়ে চলে গিয়েছিল ‘ইন্ডিয়া’র গভীরে প্রায় ১০০ গজ পর্যন্ত।
আমরা অভিজিতের কাছে তার দাদুর বৃত্তান্ত শুনতে চাই। সে আমাদের বলে, তার দাদু বহুদিন ধরে বলে আসছিলেন যে তিনি বাংলাদেশে আসবেন। সেই যে দেশবিভাগের সময় চলে গেছেন, তারপর আর কখনো তাঁর এদেশে আসা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু তিনি নাকি সব সময়ই ভেবেছেন যে আসবেন। তারপর হঠাৎ এক দুপুরবেলা ‘বাড়ি যাব’, ‘বাড়ি যাব’ বলে অস্থিরভাবে পায়চারি শুরু করেন। সেই অস্থিরতা ক্রমেই বেড়ে চলে। অবশেষে তিনি বাড়ি বাড়ি করে পুত্র-কন্যা-নাতি-নাতনি সকলের জীবন অতিষ্ট করে তোলেন।
‘শেষমেষ বাবা আমাকে বললেন, দাদুর সঙ্গে যাও। আমি এলাম।’ অভিজিৎ আমাদের বলে। তার বলার ভঙ্গিটা আমার বেশ ভালো লাগে। খুবই সরল, অকপট ভঙ্গি। বাবা না বললে সে আসত না; এসেছে বলে যে খুব মহৎ একটা কর্তব্য পালন করছে এমন গরিমাও নেই।
‘এখানে নাকি তুলশীগঙ্গা বলে একটা নদী আছে,’ অভিজিৎ আমাদের দিকে চেয়ে বলে, ‘সেই নদীর তীরে নাকি এক শ্মশানঘাট আছে। দাদুর মাকে দাহ করা হয়েছিল ওই শ্মশানে…’ এই পর্যন্ত বলে সে থামে। তারপর স্মিত হেসে বলে, ‘আসলে, দাদুর বয়স হয়েছে তো, মানসিক ভারসাম্য একটুখানি…।’
অভিজিতের গল্প শুনতে শুনতে রাত নটা বেজে যায়। আমরা আট-দশটা ছেলে, তপনদের বসার ঘরে সবার বসার জায়গা হয় না, কেউ কেউ দাঁড়িয়ে থাকে; তপনের মা যে মুড়িমাখা দিয়েছিলেন তা সাবাড় হয়ে গেছে; বেচারি দুই দফায় চা বানিয়েছেন কুড়ি-বাইশ কাপ। কিন্তু অভিজিতের দাদুর ছায়াটাও ফেরে না। তপনকে অসহায়ের মতো দেখাতে শুরু করে; আমরা বুঝতে পারি যে উপদ্রব বেশি হয়ে যাচ্ছে।
আর অপেক্ষা না করে আমরা তপনদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি। অভিজিৎকে বলি, পরদিন বিকেলে সে যেন তপনের সঙ্গে আমাদের আড্ডায় আসে।
দুই
শহীদ মিনার ময়দানে আমাদের আড্ডা। সারা বিকেল বাদাম খেতে খেতে, সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে আমরা অভিজিতের দাদুকে নিয়ে নানা ধরনের জল্পনা-কল্পনা করি। অভিজিৎ আসেনি, কেন আসেনি এই নিয়েও নানা ধরনের কথা হয়। আমাদের বন্ধু রেজাউল বলে, অভিজিৎকে তার ভালো লাগেনি, কারণ সে কলকাতার ছেলে এবং নামকরা ইউনিভার্সটিতে পড়ে বলে নিজেকে বিরাট কিছু মনে করে, আর আমাদেরকে মনে করে ‘খ্যাত’।
জগন্নাথ ভিন্নমত প্রকাশ করে। সে বলে অভিজিৎকে তার অত্যন্ত ভদ্র ছেলে বলে মনে হয়েছে; অভিজিৎ সত্যিকারের ‘কালচার্ড’ একটা ছেলে, ইত্যাদি। জগন্নাথের কথা শুনে রেজাউল সম্ভবত ভাবে যে জগন্নাথ তাকে ‘আনকালচার্ড’ বলতে চায়। তাই সে ক্ষুব্ধ স্বরে জগন্নাথকে বলে, ‘আর হামরা আনকালচার্ড?’কিন্তু জগন্নাথ কোনো উত্তর দেয় না।
ফলে রেজাউল ধরে নেয় যে জগন্নাথ তাকে আনকালচার্ডই মনে করে। সে রেগে উঠে বলে, ‘কলকাত্তাইয়া কালচারের হামি গুষ্টি কিলাই!’
সবাই হো হো করে হেসে ওঠে।
হঠাৎ আবদুল মুমিন বলে, ‘অভিজিতের কথা শুনে মোর মনে হলো, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কথা কচ্ছে।’
‘তাতে হলোডা কী? অভিজিৎ লাটসায়েব হয়া গেল?’ রেজাউলের ক্ষোভ বেড়েই চলল।
আমি অবাক হতে হয়ে ভাবতে লাগলাম, অভিজিতের প্রতি রেজাউলের এমন অসূয়ার কী কারণ থাকতে পারে। জগন্নাথ সম্ভবত রেজাউলকে আরও খেপিয়ে তোলার মতলবে বলল, ‘অভিজিৎ লাটসায়েবই আছে, নতুন করে হওয়া লাগবে না।’
রেজাউল সত্যিই আরও খেপে উঠল, ঠোঁটদুটো শক্ত করে জগন্নাথের দিকে চোয়াল বাগিয়ে বলল, ‘তুই তো শালা এই কথাই কবু! শালা হীনন্মন্য নমঃশূদ্র!’
জগন্নাথ হাসতে হাসতে বলল, ‘তাও ভালো, মালাউন কসনি!’
আমি দেখলাম, জগন্নাথের মতলব ভালো নয়; আমি ওর মাথার পেছনে একটা মৃদু চড় মারলাম। ও ঝট্ করে ঘাড় ফিরিয়ে আমার দিকে তাকাল। আমাদের চোখাচোখি হলে আমি ওকে ফিস ফিস করে বললাম, ‘বাজে বকিস না!’
জগন্নাথ থেমে গেল, কিন্তু পয়মাল করল গৌতম। সে বলল, ‘শালারা সারা জীবন শ্রেণিসংগ্রামের রাজনীতি করলু, কিন্তুক শ্রেণি বুঝলু না! নি¤œবর্গ আর আর উচ্চবর্গ ফারাক ধরা পারিস না! অভিজিৎ চক্রবর্তী হলো উচ্চবর্গ, জগন্নাথ সাহা আর এই গৌতম দেবনাথ হলো নি¤œবর্গ। আর তোরা, খতনা-করা চুদিরভাইয়েরা, তোরা বেবাক হলু লুম্পেনস্য লুম্পেন!’
গৌতমের দিকে চেয়ে আমি হঠাৎ চিৎকার করে উঠলাম, ‘হারামজাদা, আঁতলামি বন্ধ কর! লুম্পেনের সংজ্ঞা জানিস?’
গৌতম হেসে বলল, ‘কী রে? গরুর মতন হামলে উঠলু ক্যান?’
আমি বললাম, ‘স্টপ্! আর একটাও কথা না!’
‘তুই হুকুম করলেই হলো?’
‘হয়, হলো। এইবার চুপ্ যা।’
‘জি না, এই গৌতম দেবনাথ কোনো শালার হুকুমে চুপ যায় না। তুই হামাক জ্ঞান দিবার লাগিছু লুম্পেনের সংজ্ঞা কী। চুদিরভাই, তুই নিজেই ক দিনি, লুম্পেন কাক্ কয়?’
এই সময় তিনটা ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়ায় আমাদের জটলার পাশে। আমরা বসে ছিলাম সদর রাস্তা থেকে অনেক দূরে, ময়দানের ঘাসে। রাস্তার লাইটপোস্টের আলো এত দূরে এসে পৌঁছেনি। আবছায়ায় আমরা তিন ছায়ামূর্তির মুখ দেখতে পাই না। কিন্তু একটাকে তপন বলে চিনতে পারি। ফলে বুঝতে পারি, অন্য দুজন নিশ্চয়ই অভিজিৎ ও তার দাদু। অন্ধকারে তাদের চোখের তারাগুলো জ্বলজ্বল করছিল।
আমরা অবাক হয়ে উঠে দাঁড়ালাম। এই শহর নিয়ে যে ভদ্রলোকের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই, যিনি ভোররাতে শহর ছেড়ে চলে যান গ্রামের দিকে, তিনি যে নিজেই আমাদের আড্ডায় এসে হাজির হতেন পারেন, তা কে ভেবেছিল।
আমাদের বিস্ময় দূর করতেই বোধ হয় অভিজিৎ বলল, ‘দাদুকে আপনাদের কথা বলেছি, আপনারা দাদুর সঙ্গে গল্প করতে চান। দাদু নিজেও আপনাদের কথা শুনতে আগ্রহী। তাই তো তাঁকে সঙ্গে নিয়েই চলে এলাম।’
‘এ জগন্নাথ, পাঁচুর হোটেলত্ যা,’ রেজাউলের গলা শোনা গেল, ‘চায়ের অডার দিয়ে আয়।’
‘কোনো প্রয়োজন নেই,’ এটা অভিজিতের দাদুর কণ্ঠস্বর; শান্ত, ধীর ও জলদগম্ভীর। ‘তোমরা ব্যস্ত হয়ো না, বসো।’
আমরা সবাই আবার ঘাসের উপর বসে পড়ি। তিনিও বসেন, তাঁর পেছনে বসে অভিজিৎ। তপন একে একে আমাদের প্রত্যেকের নাম বলে পরিচয় করিয়ে দিতে শুরু করে। সে যার নাম বলে, সে ভদ্রলোকের দিকে চেয়ে কপালে হাত তুলে বলে ‘আদাব’। প্রত্যেকের আদাবের জবাবে তিনিও আদাব বলেন। তারপর নিজের নামটা বলেন: নবীনচন্দ্র চক্রবর্তী।
কিন্তু ব্যস, ওটুকুই। তিনি আর কিছু বলেন না। একদম চুপ মেরে যান।
আমরা উসখুস করি, ভেবে পাই না কী করে তাঁকে জিজ্ঞাসা করব তপনের মুখে আমরা তাঁর সম্পর্কে যা শুনেছি তা সত্য কি না।
নীরবতা নেমে আসে। পুরো শহরটাই যেন চুপ মেরে যায়। আমাদের মনে হয়, ছোট্ট মফস্বল শহরটার সন্ধ্যাবেলার সব কোলাহল হঠাৎ থেমে গেছে। একটু দূরেই রেলস্টেশন, প্রতিদিন সন্ধেবেলা স্টেশনের প্লাটফরম থেকে যে কোলাহলের শব্দ এখানে ভেসে আসে, তা আজ আমরা শুনতে পাই না। আমাদের অদ্ভুত লাগে; আমরা শব্দের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি, কিন্তু কেউ কিছু বলি না, কারণ যা বলতে চাই তা বলতে পারি না। মুখের উপর তো কাউকে বলা যায় না: আপনি নাকি এদেশে মরতে এসেছেন?
এইভাবে কতক্ষণ কেটে যায় আমরা বুঝতে পারি না। হঠাৎ পাখির ডানার শব্দ শুনতে পাই, এবং দেখি, কোত্থেকে একটা পাখি এসে বসল ভদ্রলোকের বাম কাঁধে। তিনি বামে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে লাগলেন।
আবছা অন্ধকার বলে আমরা পাখিটাকে ভালো করে দেখতে পেলাম না।
‘গুদরকানি,’ কেউ ফিস ফিস করে বলে। মানে, শালিক।
‘গুদরকানি তো পোষ মানে না রে! মনে হয় ওডা ময়না।’ অন্য কেউ বলে।
ভদ্রলোক পাখিটার দিকে চেয়েই রইলেন। ছোট্ট একটা পাখি, দাঁড়িয়ে আছে একদম স্থির হয়ে।
‘আপনার পোষা ময়না, কাকাবাবু?’ এটা রেজাউলের গলা। আবছায়ায় ওর দাঁতের সাদা একটু দেখা গেল। ‘ইন্ডিয়াত্থেই সাথে নিয়াস্ছেন?’
‘না তো!’
ভদ্রলোক কথা বলতেই পাখিটা উড়ে চলে গেল, আর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর গলা থেকে চু চু আফসোসধ্বনি বেরিয়ে এল।
একটু পর তিনি বললেন, ‘পারুলিয়া গেছি, একটা কুকুর এসে আমার গা শুঁকতে লাগল। গরুগুলো বড় বড় চোখে এমনভাবে আমার দিকে চেয়ে ছিল, যেন ওরা আমাকে চেনে। কিন্তু গ্রামটার একটা মানুষও আমাকে চিনতে পারল না। পারুলিয়ায় আমার বয়সী কেউ আর বেঁচে নেই।’
‘কাউকে খুঁজতে গেছিলেন ওখানে?’
‘হ্যাঁ, ওই গ্রামটাতে আমার তিনজন বন্ধু ছিল। গিয়ে শুনলাম তিনজনই মারা গেছে। মধুপুরে এক বন্ধুকে পেয়েছিলাম, কিন্তু ওর ডিমেনশিয়া হয়েছে, আমাকে চিনতে পারল না।’
‘কাকাবাবু, আপনি কি কোনো দরকারি কাজে তাদেরকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন?’
‘না, দেখা করা আরকি।’
‘কী জন্য দেখা করতে চান?’
‘পঞ্চাশ বছর বিদেশে কাটিয়ে ফিরে এলাম…।’
বিদেশে শব্দটার উপর তিনি অতিরিক্ত জোর দিলেন। ময়দানের বাতাসে প্রতিধ্বনি বেজে উঠল: বিদেশে বিদেশে বিদেশে।
‘বিদেশে?’
‘স্বদেশে ফিরে এসেছি।’
তাঁর প্রতিটা কথা ময়দানের বাতাসে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
‘জন্মভূমি আর স্বদেশ কিন্তু এক কথা না,’ এটা রেজাউলের কণ্ঠস্বর, ‘বাংলাদেশ আপনার জন্মভূমি এটা কেউ অস্বীকার করবে না; কিন্তু আপনে এখন আর বাংলাদেশকে স্বদেশ বলতে পারেন না। আপনে এখন ইন্ডিয়ার সিটিজেন, ইন্ডিয়ার ভোটার, আপনার পাসপোর্ট ইন্ডিয়ান…।’
‘এ রেজাউল, থাম রে!’ বিরক্ত ও বিব্রত স্বরে একজন বলল।
রেজাউল থেমে গেল।
একটু পরে আবদুল মুমিন বলে, ‘কাকাবাবু, আপনার ভিসা কতদিনের?’
মুমিনের মতলবটা ধরতে পারা কঠিন। তার প্রশ্নটা নির্দোষ কৌতূহল হতে পারে, আবার উসকানিও হতে পারে।
‘তিন সপ্তাহ।’ কাকাবাবুর কণ্ঠস্বর এখন স্বাভাবিক।
‘ভিসার মেয়াদ ফুরায়ে গেলে পরে আপনে এই দেশে কীভাবে থাকবেন?’
‘ততদিনে আমার আয়ুও ফুরিয়ে যাবে।’
জটলার পেছনের সারিতে কেউ গলা পরিষ্কার করার অজুহাতে ঠাট্টাধ্বনি করে। আবছা অন্ধকারে ভদ্রলোকের দুই চোখ আমাদের মুখগুলো খুঁজতে শুরু করে; মনে হয় তারা পরখ করে দেখতে চায় আমাদের চোখেমুখে অবিশ্বাসের কৌতূক ফুটে উঠেছে কি না।
একটু পর তিনি বইয়ের ভাষায় বললেন, ‘আমি এখন আমার জীবনের অগ্রপশ্চাৎ দেখতে পাই।’
‘মানে?’
‘আমার দিব্যজ্ঞান হয়েছে।’
পেছনের দিকে কেউ হেসে ওঠে; সঙ্গে সঙ্গেই কেউ তার মুখ চেপে ধরে। হতে পারে সে নিজেই চেপে ধরে নিজের মুখ। কিন্তু তার ফলে কাকাবাবুর ভাবান্তর ঘটে না। তিনি বই পড়ার সুরে মুখস্থ বাণীর মতো বলেন, ‘আমার জন্ম হয়েছিল ১৯২০ সালের পনেরই আগস্ট। এ বছরের (১৯৯৭) আঠাশে অক্টোবর আমার মৃত্যু হবে। এই ৭৭ বছর দুই মাস তের দিনের পুরোটা জীবন আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।’
রেজাউল নিজের উরুতে চাপড় মেরে বলে উঠল, ‘এইবার চা খাওয়াই লাগবে রে!’
‘ঠিক ঠিক! চা খাওয়া দরকার!’
‘খালিমুখে চা? ঝালমুড়িও আনা হোক!’
‘ঠিক বলিছ ু রে! এ মুরারি, তুই এক দৌড়ে বাড়িত্ যা, আচাড়ের ত্যাল লিয়ে আয়!’
জগন্নাথ উঠে পাঁচুর হোটেলের দিকে হেঁটে গেল। কিন্তু মুরারি প্রসাদ আগরওয়ালাকে কেউ খুঁজে পেল না। আসলে, মুরারি যে আজ আমাদের আড্ডায় আসেনি, এটা না জেনেই তার নাম ধরে হাঁক পেড়ে তাকে আচাড়ের তেল আনতে বলা হয়েছে দেখে কেউ কেউ হেসে উঠল।
নবীনচন্দ্র চক্রবর্তীর জলদগম্ভীর কণ্ঠধ্বনিতে তাঁর ব্যক্তিত্বের যে ওজন ময়দানের বাতাসে আরোপিত হয়েছিল, তিনি দিব্যজ্ঞান লাভ করেছেন বলে দাবি করার পর তা অপসারিত হয়েছে। উপরন্তু এখন হাসিঠাট্টা শুরু হলে পরিবেশ-বিপর্যয়ের আশঙ্কায় আমার বুক দুরু দুরু শুরু হলো।
আর হঠাৎ বস্তুবাদী দর্শনজাত শ্রেণিসংগ্রামে বিশ্বাসী স্বঘোষিত নমঃশূদ্র গৌতম দেবনাথ ব্রাহ্মণ নবীনচন্দ্র চক্রবর্তীর অলৌকিক ক্ষমতাপ্রাপ্তির দাবিটাকে চ্যালেঞ্জ করে বসল: ‘কাকাবাবু, আপনে কি বলতে পারেন আগামীকাল কী ঘটবে?’
কিন্তু চক্রবর্তী মহাশয় গৌতমের ফাঁদে পা না দিয়ে মৃদু হেসে বললেন, ‘না।’
‘তাহলে কেন বলিচ্ছেন আপনে সব জানেন? আগেভাগেই সব দেখবার পাচ্ছেন?’
গৌতমের এই প্রশ্নটা খুবই রূঢ় শোনাল। ভদ্রলোক নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে নীরব হয়ে গেলেন। একটু পরেই আবার কী মনে করে গলা খাকড়ে স্পষ্ট স্বরে বললেন, ‘আমি কিছু জানি না।’
‘তাহলে আপনে স্বীকার করিচ্ছেন, দিব্যজ্ঞান বলে কিছু নাই?’
‘আমি তা বলিনি।’
‘আচ্ছা, ধরে নিলাম দিব্যজ্ঞান বলে একখান ব্যাপার আছে। তো আপনে যখন সেই দিব্যজ্ঞান লাভ করলেন, যখন নিশ্চিত হলেন যে আপনার আয়ু ফুরায়ে আস্ছে, তখন গয়া-কাশী না যায়া কেন বাংলাদেশে আস্লেন?’
‘তুলশীগঙ্গার তীরই আমার গয়া-কাশী।’
‘ও আচ্ছা। বাংলাদেশের জন্যে যখন আপনার এতই মায়া এতই টান, তাহলে এই দেশ ছ্যাড়ে চলে গেছ্লেন কেন?’
‘আমার নিয়তি!’
‘তা কেন বলিচ্ছেন? বলেন মোসলমানেরা খেদায়া দিছেল?’
‘এইটা বাড়াবাড়ি,’ আপত্তি জানিয়ে একজন বলে উঠল, ‘কথাবার্তা কিন্তুক্ সাম্প্রদায়িকতার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে!’
‘হামরা তো সাম্প্রদায়িকতার মধ্যেই আছি, ওইদিকে আবার ঠেলা লাগে নাকি?’
‘এইবার চুপ করো সবাই! আর একখান কথাও না!’
‘ক্যান? চুপ করা লাগবে ক্যান? ওইপার বাবরি মসজিদ ভাঙা হলে এইপার হিন্দু মরে ক্যান? ওরা ওরগে দেশত্ যা ইচ্ছা তাই করুক, তা লিয়ে হামরা ক্যান এই দেশত্ খুনাখুনি করি? দেশ কি তাহলে ভাগ হয়নি? একখানাই আছে? এই প্রশ্নের মীমাংসা হওয়া লাগবে আগে।’
জনতা লা-জওবাব। ফলে কথাগুলো যে বলছিল সে আরও উৎসাহ পেয়ে বলে চলল, ‘বসনিয়ার খিস্টানেরা মোসলমান ম্যারে বিনাশ করে, হামরা ত এটে খিস্টানের গলা কাটার জন্যে দৌড়ে যাই না! কিন্তু ইন্ডিয়াৎ মোসলমানের কেছু হলে হামরা ছুটে যাই এই দেশত্ কোন্টে কোন মালোয়ান আছে কতল করার জন্যে। কারণ কী? কারণ, মীমাংসা এখনো হয়নি। কারণ, হিন্দু হামার ভাই লাগে! তার সাথে মারামারি না করে হামার সুখ নাই…!’
‘পুরানা প্যাচাল থামালু, না কষে একখানা চড় খাবু?’
‘ক্যা? আমি অন্যায়টা কী কলাম?’
‘হোছে, চোপা বন্ধ কর!’
এই হুকুম জারি করল যে, সে আমাদের থেকে বছর পাঁচেকের বড়ো। কমুনিস্ট। সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়ে তিন মাসের ট্রেনিং নিয়ে এসেছিল। আমাদেরকে ডায়ালেকটিক্যাল ম্যাটেরিয়ালিজম ইত্যাদি বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরে ওইসব নিয়ে আর কথা বলে না। কিন্তু সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা শুনলে ভীষণ খেপে ওঠে।
বলা দরকার, আমাদের হিন্দু বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণ কমুনিস্ট রাজনীতি। এ শহরের শিক্ষিত হিন্দু তরুণদের মধ্যে যারা একটু রাজনীতিমনস্ক, তারা হয় মণি সিংহের নয় অধ্যাপক মোজাফফরের পার্টির অনুসারী। আর আমরা মোসলমান ছেলেরা বড় হয়েছি হিন্দু কমরেডদের হাত ধরে। আমাদের শিক্ষাদীক্ষা, রুচি-কালচার যেটুকু হয়েছে, সবই হয়েছে আমাদের দলের কল্যাণে, স্কুল-কলেজ বা পরিবারের কল্যাণে নয়। আমরা মনে করি, হিন্দু-মুসলমান বড় কথা নয়, বড় কথা হলো ধনী-গরিবের বৈষম্য। এই শিক্ষা ছাড়াও গানবাজনা, সাহিত্য-সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ে রুচি বলতে যা বোঝায়, তা-ও আমরা পেয়েছি দলের কাছ থেকে।
আমাদের কারও কারও বাপ-দাদা হিন্দুদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করে। যারা তা করে না তারা এমন কথা বলতে ছাড়ে না যে অতীত কালে হিন্দুরা বড়ই আধিপত্য ফলাত। আমাদের শহরের একমাত্র সদর রাস্তার দুই পাশে যে লাল রঙের দালান-কোঠাগুলো এখনো রুগ্নদশায় দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলোর সাবেক বাসিন্দারা নাকি কোনো কালেই বাজারের বড় মাছগুলো আমাদের বাপ-দাদাদের কিনতে দেয়নি। জেলেরা নাকি কোনো মুসলমানকেই বড় মাছ স্পর্শ করতে দিত না। বড় বড় রুই-কাতলা, আইড়-বোয়াল দেখে কোনো মোসলমান সেদিকে এগোলেই মাছের দোকানিরা নাকি হৈ হৈ করে বলে উঠত, ‘ছুঁবিন না ছুঁবিন না, এডা বাবু লিবে!’ বাবু মানে কোনো হিন্দু জোতদার কিংবা বড় ব্যবসায়ী।
কিন্তু আমাদের বাপ-দাদারা এই সব গল্প বলে আমাদের মনে হিন্দুবিদ্বেষ জাগাতে পারেনি। আমাদের পার্টি সেটা ঘটতে দেয়নি। আমরা বরং বিশ্বাস করি, ভারতবর্ষ ভেঙেছে মোসলমানেরা। ভারত ভেঙে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা না করা পর্যন্ত মোসলমানদের শান্তি হচ্ছিল না।
অধিকাংশ হিন্দু দেশ ছেড়ে চলে গেলেও আমাদের হিন্দু সহপাঠী, বন্ধু, খেলার সাথীর সংখ্যা এখনো অনেক। তারা খুব ভালো ভালো ছেলে। আমাদের বাড়ির অন্দরমহলেও তাদের আসা-যাওয়া। তাদের কেউ কেউ আমাদের সঙ্গে গরুর গোশতও খায়। আমরা তাদের সঙ্গে সরস্বতী পূজা, দুর্গা পুজা, কালী পুজা ইত্যাদি করি। আমাদের বাপ-চাচারা সবাই নামাজ রোজা করে, কিন্তু আমাদের উপর তারা কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না। আমরা শুক্রবার ছাড়া পারতপক্ষে মসজিদে যাই না। কেউ কেউ শুক্রবারেও যায় না।
কিন্তু আমাদের সংখ্যা আঙুলে গোনা যায়। আমরা বিরল সংখ্যালঘু। তা ছাড়া, আমরা সবাই যে আগের মতোই থাকছি তা বলা যাবে না। রাজনীতির ব্যাপারে আমাদের এখনকার উপলব্ধি হলো, হিন্দুরা সব আওয়ামী লীগ করে। যারা কমুনিস্ট ছিল তারাও গোপনে ভোট দেয় আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কায়। আমাদের এখন মনে হচ্ছে, হিন্দু কমুনিস্টরা এখন বিজেপিঅলাদের মতো কথা বলে। আমরা টের পাই, ওদের হিন্দুত্ববোধটাই প্রধান হয়ে উঠছে। আমরা যখন পিছন ফিরে ভাবি, দেখতে পাই হিন্দু কমরেডরা শুধু আমাদের নাস্তিকতাই দাবি করত, নিজেরা ছিল হাড়েমজ্জায় ধার্মিক।
আমরা এটাও অনুভব করি যে কমুনিস্ট রাজনীতির দুর্দশার ফলে অসাম্প্রদায়িক চেতনার ভীষণ ক্ষতি হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ এখন মুসলিম লীগ হয়ে যাচ্ছে। তাকে মুসলিম লীগ হওয়ার চেষ্টা করতে হচ্ছে, নইলে সে ভোট পাবে না বলে মনে করছে।
এদেশের হিন্দুরা মনে করে আওয়ামী লীগ তাদের একমাত্র সহায়, কিন্তু এই দল এখন আর হিন্দুদের রক্ষা করার ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। আবার তারা কিন্তু হিন্দুদের ভোট ঠিকই চায়। আওয়ামী লীগের কী মজা, হিন্দুর ভোট তাদের চেয়ে নিতে হয় না, এমনিই পায়। চাইতে হয় মুসলমানের ভোট। চাইলেও পায় না। মুসলমানের ভোট পেতে হলে আওয়ামী লীগকে প্রমাণ করতে হবে সে হিন্দুর পার্টি নয়, অধার্মিক দল নয়, ভারতের তাবেদার নয়। উল্টো, আওয়ামী লীগকে প্রমাণ করতে হবে যে সে বিএনপির চেয়ে বেশি ধার্মিক, বেশি ভারত-বিদ্বেষী।
অবশ্য এসব নিয়ে আমরা এখন মাথা ঘামাই না। হিন্দু বন্ধুদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আসলে সঙ্গের অভ্যাস, রাজনীতি-টাজনীতি কিছু নয়। দল নেই, রাজনীতি নেই, কিন্তু আমরা আছি। আমরা এক সঙ্গে ক্রিকেট খেলি, তাস খেলি, গাঁজা খাই, রোটারি ক্লাব করি, পুষ্প প্রদর্শনী করি, ইত্যাদি করি।
অবশ্য হঠাৎ হঠাৎ আমাদের মন খারাপ হয়ে যায়, যখন হুট করে কোনো এক সকালে খবর পাই, অমুক বন্ধুটা ইন্ডিয়া চলে গেছে। আমাদের কাউকে কিছুই না বলে চলে গেছে। যাওয়ার কথা যে ভেবেছিল, তা আমরা কখনোই বুঝতে পারিনি। যাওয়ার প্রস্তুতি যে নিচ্ছিল, তা-ও কোনোভাবেই টের পাইনি। তাই, এক সকালে যখন শুনি যে চলে গেছে, তখন মনটাই ভেঙে যায়।
বেশি নয়, সাম্প্রতিক কালে গেছে মাত্র দুজন। একজন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করে সদ্য চাকরিতে ঢুকেছিল। হঠাৎ এক সকালে শুনি সে চলে গেছে। আমরা তাকে মনে মনে বকা দিয়েছি: ‘বাংলাদেশের জনগণের ট্যাকায় লেখাপড়া করে ডাক্তার হয়া শালা ইন্ডিয়াত্ চলে গেলু?’
কিন্তু আমরা বুঝি, ওরা এই দেশে ভরসা পায় না; ওরা এই দেশকে নিজেদের দেশ ভাবতে পারে না।
কিন্তু কেন? কেন ওরা জš§ভূমিকে নিজের দেশ ভাবতে পারছে না? দোষটা কার? ওদের না আমাদের?
আমাদের। আমাদেরকেই ওদের ভয়।
আর, ভয় রাজনীতিকে।
যে আওয়ামী লীগকে ওরা ভোট দেয় সেই আওয়ামী লীগের লোকেরাই ওদের জমি কেড়ে নেয়, কম দামে বেচে দেওয়ার জন্য চাপ দেয়। বলে, ‘যা আছে সব আমার কাছে বেচে দিয়ে ইন্ডিয়াত্ চলে যা।’ মুখ ফুটে না বললেও তা-ই বোঝাতে চায়।
তাহলে ওরা চলে যাবে না কেন?
কিন্তু এসব কথা আমাদের মনে উদয় হয় নিতান্তই কদাচিৎ, শুধু যখন কিছু-একটা ঘটে, যখন হঠাৎ কেউ সপরিবারে তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে যায়, বা কারোর বোনের উপর কোনো বখাটের কুনজর পড়ে, বা কারোর দোকানঘর বা চাতালের জায়গা নিয়ে বিবাদ বাঁধে।
মস্কোফেরত প্রাক্তন কমরেডের ধমকে আমাদের যে বন্ধু ভারতীয় ভদ্রলোকটিকে উত্যক্ত করা থেকে নিরস্ত হয়েছিল, একটু পরেই সে আবার মুখ খুলল: ‘কাকাবাবু, আপনে কি এই অভিমান বুকে নিয়েই মারা যাবেন যে মোসলমানেরা আপনাদেক্ দেশছাড়া করিছে?’
কমরেড এবার আমাদের সেই বন্ধুটার মাথায় একটা চড় মেরে বলল, ‘কলাম প্যাচাল বন্ধ কর, তাও তোর চোপা বন্ধ হয় না?’
ভদ্রলোক বললেন, ‘আহা, মারছেন কেন?’
পিছনের দিক থেকে কেউ বলে উঠল, ‘এইটা মারা না, কাকাবাবু! মিচ্চি এনা শাসন। শালা বেশি বকবক করিচ্ছে।’
সবাই হেসে উঠল।
হাসি থামলে একজন বলল, ‘কাকাবাবু, কলকাতার গল্প বলেন।’
‘কলকাতার কী গল্প?’ ভদ্রলোক এমন ভঙ্গিতে কথাটা বললেন যেন তাঁকে বিপদে ফেলা হয়েছে, যেন তাঁর থলিতে কলকাতার কোনো গল্প নেই। কিন্তু আমাদের এই শহরে তো কলকাতা নিয়ে গল্পের অন্ত নেই।
রেলস্টেশনের দিক থেকে ট্রেনের শব্দ ভেসে এল।
একজন বলল, ‘আমার দাদা-নানারা এইখানে ট্রেনে উঠে বসত, আর নামত যায়া এক্কিবারে শিয়ালদা ইস্টেশনে। তারা কোনোদিন ঢাকাত্ যায়নি।’
ভদ্রলোক বললেন, ‘আমি তা জানি। নওগাঁ থেকে নৌকায় করেও কলকাতা যাওয়া যেত।’
‘এই কথা আমরাও শুনিছি।’
‘তখন এই দেশ অনেক বড় ছিল। দেশ নয়, এটা ছিল একটা উপমহাদেশ।’
‘হাঁ, আমরা জানি। ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট।’
‘ভারতবর্ষ।’
‘কিন্তু কাকাবাবু, আপনে তো নিজের কথা কিছুই বললেন না। আমরা আপনার গল্প শুনতে চাই।’
‘আমার গল্প? সাতাশ বছর বয়েসে জন্মভূমি ছেড়ে ভিনদেশে গিয়ে রুটলেসের মতো ভেসে বেড়ালাম পঞ্চাশ বছর। ফিরে এলাম সাতাত্তর বছর বয়েসে। এই তো আমার গল্প। এ গল্প তো তোমরা সবাই জান। আর কী বলতে পারি আমি!’
দুঃখ-বেদনা আমাদের ভাল লাগে না। আমাদের বই-পুস্তক-নাটক-সিনেমা সমস্ত কিছুতে কেবলই দুঃখের ছড়াছড়ি, অশ্রুর প্লাবন। আমাদের প্রত্যেকের পরিবারের দৈনন্দিন জীবনেও নানা রকমের দুঃখ-যন্ত্রণা আছে। আমরা আর দুঃখের কথা সহ্য করতে পারি না। কেউ দুঃখের কথা শোনাতে চাইলে আমরা বিরক্ত হই। এই ভদ্রলোকের জীবনে যে দেশত্যাগের দুঃখ ছাড়া আর কিছু নেই তা আমাদের বুঝতে কষ্ট হলো না।
ময়দানের পাশের মসজিদের মাইকে এশার নামাজের আজান বেজে উঠল।
তিন
অভিজিতের দাদুকে নিয়ে আমাদের সব কৌতূহলের অবসান ঘটে গেল। কারণ তাঁর গল্পটা পুরোনো। তিনি আর ভারতে ফিরে যাবেন না, এখানেই দেহ রাখবেন-এই কথা আমাদের হাস্যকর নাটকীয়তা বলে মনে হয়। কিন্তু তা নিয়ে রগড়ে মেতে ওঠার কথা ভাবতে পারি না, কারণ ভদ্রলোক উঠেছেন আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু তপনের বাড়িতে। তাঁকে যদি আমরা যথাযোগ্য সম্মান দেখাতে না-ও পারি, অন্তত পাগল খেপানোর মতো দুষ্টামিতে মেতে উঠতে পারি না।
আমরা মেতে উঠি কিশোরদের জন্য একটা ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন নিয়ে। ক্রিকেট আমাদের অবশেসন, উপরন্তু এ শহরের সবচেয়ে ধনী ব্যবসায়ীদের একজন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। তাই আমাদের উৎসাহ-উদ্দীপনার সীমা নেই। পুরো এক সপ্তাহ ধরে আমরা ক্রিকেট টুর্নামেন্ট নিয়ে এমন মশগুল হয়ে রইলাম যে ভারতীয় ভদ্রলোকটির কথা আর মনেই থাকল না।
টুর্নামেন্ট শেষের দিন আমরা ময়দানে গরু জবাই করি, আমাদের হিন্দু কমিউনিস্ট বন্ধুরা গরুর মাংস, আলুর দম আর ভাত খেতে খেতে নবীনচন্দ্র চক্রবর্তীকে স্মরণ করে।
একজন বলে, ‘আজ তো আঠাশ তারিখ রে, তপনের কাকাবাবুর ভিসার মেয়াদ তো আজ শ্যাষ হয়া যাবে। ভদ্রলোক এখনও আছে, না কলকাতা ফিরে চলে গেছে?’
গরু খাওয়ার আসরে তপন ছিল না। আমরা ভুঁড়িভোজনের পর ওদের বাড়ি যাই। গিয়ে তপনকে পাই, কিন্তু তার ভারতীয় কাকাকে পাই না, অভিজিৎকেও পাই না। তপন আমাদের বলে, ভদ্রলোক এখন যেখানেই যান, নাতিকে সঙ্গে নিয়ে যান।
আমরা ওকে জিজ্ঞাসা করি, ভদ্রলোকের মৃত্যুর কোনো লক্ষণ দেখা দিয়েছে কি না।
সে আমাদের এই জিজ্ঞাসাকে নিষ্ঠুর রসিকতা ভেবে মনোক্ষুণ্ন হয়। আমরা তার মান ভাঙাতে দুঃখ প্রকাশ করি। আমরা সরি বললেই তার মান ভেঙে যায়। সে বলে, তার ভারতীয় কাকাবাবু প্রতিদিন ভোরের মুক্ত হাওয়ায় বেরিয়ে যান, সারাদিন বিভিন্ন গ্রামের নির্মল বাতাসে ঘুরে বেড়ান, ফলে রাতে তাঁর সুনিদ্রার হয়।
আমরা তপনকে জিজ্ঞাসা করি তার কাকা ভিসার মেয়াদ বাড়িয়েছেন কি না। তপন বলে, সে তাঁকে মেয়াদ বাড়িয়ে নেওয়ার কথা কয়েকবার বলেছে। কিন্তু ভদ্রলোক নাকি বলেছেন যে ভিসার মেয়াদ আর বাড়বে না, বাড়ানোর সাধ্য নাকি কারোরই নেই।
আমরা তপনকে বলি, ভিসার মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়ার কথা থানাপুলিশ জানতে পেলে ওদের পরিবার ঝামেলায় পড়তে পারে। কথাটা শুনে তপনের মনে একটু ভয় দেখা দিল বলে মনে হলো। সে প্রস্তাব করল, আমরা যেন সন্ধ্যায় দলবেঁধে তাদের বাড়ি গিয়ে কাকাবাবুকে ভিসার মেয়াদ বাড়িয়ে আনার জন্যে অনুরোধ করি। কিন্তু আমরা আলসেমি করে আর তপনদের বাড়ি যাই না।
পরের শুক্রবার দুপুরে আমরা কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে যাই। কিন্তু আমরা সিরিয়াস নামাজি নই। নামাজের ফরজ অংশটুকু শেষ হলেই বেরিয়ে আসি, সুন্নতের সওয়াবের লোভ আমাদের নেই।
মসজিদ থেকে বেরিয়ে আমরা দেখতে পাই প্রায়-জনশূন্য রাস্তায় খড়ি-লাকড়িতে বোঝাই একটা ভ্যানগাড়ি টেনে নিয়ে চলেছে দুজন লোক, আর তাদের পেছনে হেঁটে চলেছেন তপনের ভারতীয় কাকা। ভদ্রলোকের পরনে ধবধবে শাদা পাঞ্জাবি ও ধূতি, মেরুদ- সোজা টানটান রেখে তিনি ভ্যানগাড়িটার পেছনে হেঁটে চলেছেন।
একটু পরেই দেখি, ভ্যানগাড়ির এগিয়ে আসছে অভিজিৎ ও তপন। তাদের চোখেমুখে এমনই বিরক্তির ভাব যে তা দেখে আমাদের মনে হয় তারা বুঝি কেঁদে ফেলবে।
তপন হাত দিয়ে ইশারা করে আমাদের ডাকে, আমরা তৎক্ষণাৎ তাদের পিছু নিই। একটু পরে লক্ষ করি, আমাদের পেছনে আরও লোকজন আসতে শুরু করেছে। মসজিদ থেকে বেরিয়ে নামাজীদের অনেকেই অন্য কোনো পথে না গিয়ে আমাদের পিছু নিচ্ছে। তাদের কারোর মুখে কোনো কথা নেই; যেন একটা মৌনমিছিল শুরু হচ্ছে।
আমরা সদর রাস্তা ধরে পশ্চিম দিকে হাঁটতে থাকি। সবার আগে খড়ি-লাকড়িতে বোঝাই সেই ভ্যানগাড়ি, তাদের পিছনে মৌন, দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ, উন্নতশির নবীনচন্দ্র চক্রবর্তী, তাঁর পিছনে তপন আর অভিজিৎসহ আমরা কজন বন্ধু এবং আমাদের পেছনে জনতা।
জনতা ক্রমেই বাড়তে থাকে। আমরা যতোই অগ্রসর হতে থাকি, আমাদের পিছনের নীরব জনতার মিছিলটা ততোই লম্বা আর ঘন হয়ে উঠতে থাকে। আমরা দেখতে পাই রাস্তার দুপাশে ঘরবাড়ির জানালায়, রেলিঙে, বারান্দায় ও ছাদে নারী, শিশু, বৃদ্ধবৃদ্ধারা উৎসুক চোখ মেলে আমাদের দিকে চেয়ে আছে।
আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো ভারতীয় ভদ্রলোকের পিছনে দল বেঁধে চলি।
একটা ক্ষীণ স্রোতধারা মাঝখানে রেখে দুই তীরে বিস্তীর্ণ বিরান চরা পেতে শুয়ে আছে তুলশীগঙ্গা নদী। ওপারে চরার শেষ প্রান্ত থেকে শুরু হয়েছে শালবন। এপারের চরায় আমরা দাঁড়িয়ে পড়ি। আমাদের সংখ্যা অগণন। আমাদের কারোর মুখে কোনো কথা নেই।
এর মধ্যে রাষ্ট্র হয়ে গেছে, এক ভারতীয় নাগরিক তুলশীগঙ্গার চরায় আত্মাহুতি দিচ্ছে। জেলা প্রশাসক পুলিশসমেত হাজির। খোলা জিপের উপর দাঁড়িয়ে তিনি হ্যান্ডমাইকে চিৎকার করে উঠলেন, ‘হোয়াট নুইসেন্স! হোয়াট এ নুইসেন্স! আত্মাহুতি দিবে নিজের দেশে গিয়ে দ্যান, এইখানে এসে কেন? ইয়ার্কি পেয়েছেন নাকি? অ্যারেস্ট হিম। নিয়ে চলো থানায়!’
পুলিশের দল ছুটে এসে ভদ্রলোককে চারদিক থেকে ঘিরে ধরে। কিন্তু আমাদের কাকাবাবু নির্বিকার, তাঁর ঋজু মেরুদ- টানটান। মাথা উঁচু করে গ্রীবা টান করে তিনি জনতার দিকে তাকান।
জনতা সমস্বরে চিৎকার করে ওঠে, ‘না না না !’
জেলা প্রশাসকের হ্যান্ডমাইক হুংকার ছাড়ে, ‘অ্যারেস্ট হিম!’
আমরা প্রতিবাদ করে উঠি, ‘না না না!’
‘সার্কাস দেখাতে চাইলে নিজের দেশে ফিরে গিয়ে দেখান। এই দেশে এসব সার্কাস-টার্কাস চলবে না। এই, কী হলো তোমার? নিয়ে চলো।’ জেলা প্রশাসকের হাত উত্তেজনায় কাঁপে।
‘না না না!’ জনতা সমস্বরে চিৎকার করে চলে।
ভ্যানগাড়িওয়ালারা চিতা সাজানো শেষ করে।
‘কী হলো? তোমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁ করে দেখছ কী? লোকটাকে নিয়ে চলো!’
‘না না না !’ জনতা খেপে ওঠে। তারা পুলিশের দলকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরে।
‘সার্চ করো! দ্যাখো, উনার কাছে কোনো দেশলাই বা গ্যাসলাইটার আছে কি না। ভালো করে খুঁজে দ্যাখো ইডিয়টের দল!’
চারজন পুলিশ কনস্টেবল এবার চারদিক থেকে নবীনচন্দ্র চক্রবর্তীকে যেন কাতুকুতু দিতে শুরু করে। তিনি তাঁর লম্বা, শক্ত, প্যাঁচানো হাড্ডিসার হাতদুটি দিয়ে তাদেরকে খড়কুটোর মতো উড়িয়ে দিলেন। তারপর প্রথমে পরনের পাঞ্জাবিটা খুলে উড়িয়ে দিলেন বাতাসে। তারপর খুলে দিলেন পরনের ধূতির গিঁট। বালুচরে খসে পড়ল শাদা ধবধবে ধূতি।
বস্ত্রহীন দীর্ঘ হালকাপাতলা ঋজু শরীরটা মাটিতে পড়ে থাকা ধুতি ডিঙিয়ে এগিয়ে চলল ইতিমধ্যে সম্পূর্ণ সজ্জিত চিতাটির দিকে। সবগুলো আঙুল মেলে মাথার উপরে দুহাত তুলে একবার জনতার দিকে চেয়ে এক দুর্বোধ্য ইঙ্গিত করে গটগট করে হেঁটে গিয়ে খড়ি-লাকড়ির তৈরি মঞ্চটার উপরে উঠে সটান শুয়ে পড়লেন।
আমরা বিস্ফারিত চোখে রুদ্ধশ্বাসে চেয়ে রইলাম।
আমরা খেয়াল করিনি, কখন হেমন্তের অপরাহ্ণে আকাশে কখন ঘন কালো মেঘ জমেছে। রোদ নেই, চরাচর কেমন আঁধার করে আসছে। আমরা আকাশে তাকিয়ে দেখতে পাই, ঝাঁকে ঝাঁকে শাদা বক উড়ে যাচ্ছে। অজস্র ফড়িং, প্রজাপতি আর নাম-না-জানা অসংখ্য পতঙ্গ ছেয়ে ফেলেছে আকাশ। আমরা স্তম্ভিত, হƒৎপি-ের আছড়ানির শব্দে আমাদের শ্বাসপ্রশ্বাস রুদ্ধ। আমাদের চোখের মণিগুলো ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে; আমরা নির্বাক, অপলক তাকিয়ে আছি চিতার উপরে শায়িত ভারতীয় ভদ্রলোকের দিকে।
হঠাৎ আকাশের ঈশান কোণ চিড়ে একটা স্ফুলিঙ্গ ঝলকে উঠল, কড়াৎ শব্দে আকাশ ফেটে চৌচির, আর সঙ্গে সঙ্গে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল চিতা। চিতার উপরে ভারতীয় ভদ্রলোকের লম্বা সটান শরীর আগুনের ভিতরে সোনার মতো চকচক করে উঠল। তারপর সেই সোনার মূর্তি এক সূক্ষ¥ সুচিকন অগ্নিশিখায় রূপান্তরিত হয়ে ধীরে ধীরে আকাশে মিলিয়ে গেল।
আকাশ ভেঙে বড় বড় ফোঁটায় হেমন্তের ঠান্ডা বৃষ্টি নেমে এল। নিভে গেল চিতার আগুন।
জেলা প্রশাসকের নির্দেশে পুলিশেরা ছুটে গিয়ে চিতার ভেজা ছাই, কাঠকয়লা, আধপোড়া চেলাকাঠের স্তূপ সরিয়ে দেখতে পেল, একটা অঙ্গারের মানুষ সোজা টানটান হয়ে শুয়ে আছে।
স্থির, নিশ্চিত, দুর্বিনীত।
আমরা বাড়ির পথে ফিরে হাঁটতে আরম্ভ করি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটে চলি। কিন্তু শহরের দিকে আমাদের চলার পথটা আর ফুরায় না।
বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসে, কিন্তু আমরা আমাদের লোকালয়ে পৌঁছুতে পারি না। কোথাও আমাদের ঘরবাড়ির চিহ্নমাত্র দেখতে পাই না।
আমরা দেখি, তুলশীঙ্গার চরা আমাদের চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। ধু ধু বিরান প্রান্তরে দিশাহারা হয়ে আমরা আমাদের ঘরবাড়ি খুঁজে বেড়াতে থাকি।
Tags: Moshiul alam, story, গল্প, বাংলাদেশ, মশিউল আলম
email:galpersamay@gmail.com
অনিমেষ বন্দ্যোপাধ্যায় on April 19, 2018
বাকরুদ্ধ । পড়ে কিরকম দমবন্ধ লাগলো । এরকম গল্প আগে পড়েছি বলে মনে পড়ছে না । নবীনচন্দ্রের আবেগের সঙ্গে কি ঋত্বিক ঘটকের ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পের’ আবেগের মিল আছে ?
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।